এক পশলা ঝুম বর্ষায় পর্ব-৫২+৫৩

0
480

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৫২

হন্তদন্ত হয়ে পুলিশ স্টেশন ঢুকলো আদিব। আর একটু আগাতেই তার পথ আটকালো নয়নতারা। শান্ত স্বরে বলল,“কোথায় যাচ্ছেন ভাইয়া?”

আদিব তাকায় নয়নতারার দিকে। বলে,
“আমি ফারিশ ভাইয়ের সাথে দেখা করতে চাই।”
“এভাবে তো আমরা আপনার সাথে দেখা করাতে পারি না।”
“দয়া করে আমায় ভিতরে যেতে দেও। আমি অল্পক্ষণ থাকবো। ভাইকে দুটো কথা বলেই চলে আসবো।”

নয়নতারা মাথা নত করলো। অফিসে কিশোর নেই। কিশোর যাওয়ার আগে নয়নতারাকে পই পই করে বলে গেছে,“আমি যতক্ষণ পর্যন্ত না আসবো ততক্ষণ পর্যন্ত ফারিশের সাথে কাউকে দেখা করতে দিবেন না মিস নয়নতারা।”

নয়নতারাও মাথা নাড়িয়ে হা জানায়। কিন্তু এখন আদিবকে কি করে আটকাবে। নয়নতারার ভাবনার মাঝেই আদিব আবার বলে,“প্লিজ নয়নতারা আমায় একটিবার যেতে দেও।”

নয়নতারা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল,
“ভাইয়া অফিসে কিশোর স্যার নেই। উনি বলে গেছেন আমি যেন কাউকে ফারিশ ভাইয়ের সাথে দেখা করতে না দেই।”
“প্লিজ নয়নতারা মাত্র পাঁচ মিনিটের জন্য আমায় দেখা করতে দেও।”

নয়নতারা মানলো। বলল,
“ঠিক আছে কিন্তু বেশি সময় নিয়েন না ভাইয়া।”

আদিব কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো। দ্রুত ঢুকে গেল ভিতরে। নয়নতারা দরজার কাছে দাঁড়ালো। মনে মনে প্রার্থনা করল,“কিশোর স্যার আসার আগে যেন আদিব ভাই বেরিয়ে যান।”


চুপচাপ বসে আছে ফারিশ। সময় কেমন হবে বিকেলের প্রথম প্রহর। পুরো একটা দিন কেটে গেল ফারিশ চার দেয়ালে বন্দী। ফারিশের আচমকা আদ্রিতাকে দেখতে মন চাইলো। কিন্তু কি করে দেখবে? ফারিশের অসহায় লাগলো। মেয়েটা একবার আসতো। আদিব কি করছে? তাকে ছাড়া চলতে পারছে তো। ফারিশের এত খারাপ লাগছে বোঝানো যাচ্ছে না। হঠাৎ আদিবের কণ্ঠ শোনা যায়। সে নিদারুণ বিষণ্ণ সুরে ডাকে,“ভাই।”

ফারিশের বুকটা বুঝি আচমকা কেঁপে উঠলো। পুরো একটা দিন পর আদিবের কণ্ঠ শুনছে ফারিশ। ফারিশ চাইলো। আদিব অসহায়ের ন্যায় দাঁড়িয়ে। চোখ ছলছল। ছেলেটা কাঁদবে। ফারিশ বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। একটু একটু করে এগিয়ে গেল আদিবের দিকে। আদিব শক্ত করে জেলের শিক চেপে ধরলো। ইচ্ছে করছে জেলের শিক ভেঙে ফারিশকে বের করতে। ফারিশ হাসার চেষ্টা করলো। আশ্চর্য! তার হাসি আসছে না। ফারিশ তাও চেষ্টা করলো। না হচ্ছে না। ফারিশ জোরে নিশ্বাস ফেলে বলল,“কেমন আছো আদিব?”

আদিব শোকাহত স্বরে বলে,
“ভালো।”
“আমায় মিথ্যে বলছো?”
“সত্যিটা জেনেও জানতে চাইলে কেন?”

ফারিশ উত্তর দেয় না প্রসঙ্গ পাল্টে বলে,
“তোমার ডাক্তার ভাবি কেমন আছে আদিব?”
“তুমি যেমনটা রাখতে চেয়েছিলে তেমনটাই আছে।”
“আমার উপর রাগ করেছো তুমি?”

আদিব জবাব দেয় না। মাথা নুইয়ে ফেলে। ফারিশ বলে,
“তোমাকে এখানে আসতে বারণ করেছিলাম না আদিব। তাও এলে কেন?”
“তোমার কি কষ্ট লাগছে না ভাই?”
“ফারিশদের কষ্ট লাগে না।”

তড়িৎ জবাব ফারিশের। আদিব মৃদু স্বরে বলে,
“তুমি খুব স্বার্থপর ভাই।”
“চলে যাও আদিব।”

কথা বলে মুখ ঘুরিয়ে নেয় ফারিশ। শক্ত কণ্ঠে বলে,
“তোমায় দেশ ছাড়তে বলেছিলাম আমি।”
“আমিও তো বলেছি ছাড়বো না।”
“চলে যাও। এখানে আর এসো না।”
“তুমি একটা নিষ্ঠুর মানুষ।”

ফারিশ জবাব দেয় না। আদিবের নিজেকে ধৈর্য্যহীন লাগে। বিতৃষ্ণা নিয়ে বলে ওঠে,“তুমি বাবা হতে চলেছো ভাই।”

কথাটা যেন ভূমিকম্পের ন্যায় কানে বাজলো ফারিশের। ফারিশে রুহু সমেত কেঁপে উঠল। এ কি শুনলো সে? ফারিশ ঘুরে চাইলো। আদিবের আর একটু কাছে এগিয়ে বলল,
“এসব তুমি কি বলছো আদিব?”
“সত্যি বলছি ভাই ডাক্তার ভাবি মা হতে চলেছেন।”

ফারিশের হঠাৎ সবটা এলেমেলো লাগলো। আদিব বলল,“এবার তো মনে করো ভাই তুমি কাজটা ঠিক করো নি।”

ফারিশ জবাব দেয় না। কি বলবে! সবটা এমন অগোছালো লাগলো কেন! আদিব বলল,
“এবার কি করবে ভাই?”

ফারিশ শক্ত মুখে চোখ বন্ধ করে বলল,
“তুমি বাড়ি যাও আদিব।”
“এখান থেকে বার হওয়ার কোনো কি পথ খোলা নেই?”

ফারিশ কপট রাগ দেখিয়ে বলে,
“না নেই। তুমি যাও।”
“আদ্রিতা ভাবির কাছে ফেরার ইচ্ছে নেই।”

ফারিশ মলিন মুখে বলে,
“আমি কি করবো আদিব? কিছু করার নেই তুমি চলে যাও?”

আদিব কিছু বলবে এরই মাঝে নয়নতারা ছুটে আসলো। থরথর করে বলল,“আদিব ভাইয়া চলুন কিশোর স্যার এসে পড়েছেন।”

ফারিশ আতঙ্কিত স্বরে বলল,
“তুমি যাও আদিব।”
“ভাই,
“তোমাকে যেতে বলেছি আমি,

প্রচুর বিতৃষ্ণা নিয়ে বলল ফারিশ। আদিব কিছু সময় চুপ থাকলো। ফারিশের অস্থিরতা দেখে আর দাঁড়ালো না। আদিব অশ্রু ভেজা চোখে বলল,
“আপনি খুব খারাপ ভাই। আপনি খুব খারাপ।”

কথাটা বলেই চলে গেল আদিব। ফারিশ ঠায় দাঁড়িয়ে। জেলের শিক শক্ত করে চেপে ধরলো। তার হঠাৎ রাগ লাগছে। এত রাগ হচ্ছে, ইচ্ছে করছে নিজের প্রানটাই নিয়ে নিতে। আদ্রিতার মুখখানা চোখের সামনে ভেসে উঠলো ফারিশের। ফারিশ জেলের দেয়ালে ঘুষি মারলো। তার জীবনটা এমন কেন হলো? ফারিশ ভুল করেছে। আদ্রিতাকে তার জীবনে আনা ঠিক হয় নি। আদ্রিতার জীবন নষ্ট করেছে ফারিশ। কথাটাগুলো ভেবেই রাগ হলো ফারিশের। সে পরপর কতগুলো ঘুষি মারলো দেয়ালে। সেই মুহূর্তে হাজির হলো কিশোর। ফারিশকে পাগলের মতো করতে থতমত খেল কিশোর। দৌড়ে ছুটে গেল জেলের ভিতর। ধরলো ফারিশকে। বলল,
“এসব কি করছেন আপনি?”

ফারিশ কিশোরের কথার উত্তর দেয় না। অনবরত ঘুষি মারতে থাকে। কিশোর উপায় না পেয়ে দুজন কনস্টেবলকে ডাকে। তারা দৌড়ে আসে। কিশোর একটা চেয়ার আর দড়ি আনতে বলে। তারা আনে। অতঃপর তিনজন পুলিশ মিলে ফারিশকে চেয়ারের সঙ্গে বেঁধে দেয়। কিশোর বলে,“শান্ত হন ফারিশ এসব কি করছেন?”

ফারিশ বলে,
“আপনার কাছে রিভলবার নেই আমার বুকে গুলি করুন অফিসার। আমার আর সহ্য হচ্ছে না।”

কিশোর কি বলবে বুঝছে না। আচমকা ফারিশের হলো টা কি!’

সময় গেল দশ মিনিট। পরিবেশ হলো শান্ত। কিশোর বাকি দুজন কনস্টেবলকে চোখের ইশারায় বললো চলে যেতে। তারাও আদেশ মেনে চলে গেল। কিশোর জেল থেকে বেরিয়ে ফারিশের জন্য পানি আর একটা চেয়ার নিয়ে আসলো। ফারিশের একহাত খুলে হাতে দিল পানি। ফারিশ নিলো। কিশোর বলল,
“পানিটা খান।”

ফারিশ খেল। অতঃপর কিশোর সামনে চেয়ারটায় বসলো। শান্ত স্বরে বলতে লাগলো,
“আপনি কি জানেন ফারিশ সাহেব আমার আপনার ওপর একটা চাপা রাগ ছিল। অবশ্য ছিল বললে ভুল হবে এখনও বোধহয় আছে।”

ফারিশ অবাক স্বরে বলে,
“কিসের রাগ?”
“বলছি,

ফারিশ চেয়ে রয় কিশোরের মুখের দিকে। কিশোর তপ্ত নিশ্বাস ফেলে বলতে শুরু করে,
“আপনার মনে আছে কি না জানি না বছর তিনেক আগে আপনাকে খোঁজার জন্য আপনার গাড়ির সামনে একটি মেয়ে আসে। মেয়েটার নাম মাইশা। একজন জার্নালিস্ট ছিল।”

ফারিশ অবাক হলো কিশোরের কথা শুনে। বছর তিনেক আগে। হ্যাঁ ফারিশের মনে পড়েছে, একদিন মধ্যরাতে একটা মেয়ে হঠাৎ তার গাড়ির সামনে এসে সাহায্য চায়। বলে তাকে কিছু বাজে লোক তাড়া করেছে ফারিশ যেন তাকে সাহায্য করে। ফারিশ সেদিন সাহায্য করে। এরপর,

কিশোর বলে ওঠে তখন,
“মেয়েটা আপনায় ভালোবেসে ছিল ফারিশ। আর আপনি তাকে রিজেক্ট করেন। ও মূলত আপনার বিরুদ্ধে প্রমাণ খোজারের জন্য গিয়েছিল। কিছুমিছু পেয়েও ছিল। কিন্তু ও বেইমানি করে আপনি মাফিয়া জেনেও বলে মাফিয়া নন। আপনি যেদিন ওকে রিজেক্ট করে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছিলেন সেইদিন ও গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে। ও আমার বোন ছিল। আমার কথাতেই ও আপনার কাছে এসেছিল আদ্রিতার মতো। কিন্তু ওই যে আপনি আদ্রিতার প্রেমে পড়লেও আমার বোনের প্রেমে পড়লেন না। এই ব্যাপারটায় আমার প্রথমে রাগ থাকলেও এখন আর নেই। কারণ এতে আপনার কোনো দোষ ছিল না। তবুও ভাই তো তাই রাগ নিয়েই আপনার বিরুদ্ধে শুধু প্রমাণ খুঁজেছি। কিন্তু আপনার বুদ্ধিমত্তার কাছে আমি প্রতিবার ব্যর্থ হয়েছি। সেদিন যখন আপনি আমায় ফোন করে বললেন আপনি আত্নসমর্পণ করবেন। বিশ্বাস করুন আমি দারুণ অবাক হয়েছি। ভালোবাসা মানুষকে জেনেশুনে এমন মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিতে পারে এ যেন আপনায় না দেখলে জানতামই না। আপনি চিন্তা করবেন না আমি আপনার তরফ থেকে আদালতে একটা দরখাস্ত পাঠাবো, সেখানে বিশেষ করে ওই মেয়ে পাচারকারীর দলটা ধরিয়ে দেওয়ার কথা উল্লেখ থাকবে। আশা করি তারা আপনার শাস্তি কমিয়ে দিবেন।”

এই বলে ফারিশের হাত পায়ের বাঁধন খুলে দিল কিশোর। ফারিশ বলল,
“আপনার বোনকে আমি বুঝিয়ে ছিলাম আমার জীবন ঠিক নয়। কিন্তু ও যে এমন কিছু করবে আমি ভাবতে পারি নি।”

কিশোর মৃদু হেঁসে বলে,
“বুঝতে পেরেছি। আবেগী ছিল আমার বোনটা যার দরুন এমনটা করেছে। যাক আপনার ভালো হোক।”

কিশোর চোখ মুছে বেরিয়ে গেল জেলের ভিতর থেকে ফারিশ চুপচাপ বসে। এসব সে কি শুনলো? মাইশা মেয়েটা আর ফারিশের কাছে আসছে না বলে ফারিশ ভেবেছিল বোধহয় বিষয়টা বুঝতে পেরে নিজেকে গুটিয়ে নিয়ে নতুনভাবে জীবন শুরু করেছিল মাইশা। এরপর কাজে কাজে আর মেয়েটার কথা মনে ছিল না ফারিশের। অথচ আজ কি শুনলো?’ ফারিশের ভীষণ মন খারাপ হলো।


টানা কয়েকদিন ফারিশকে জেলবন্দী করে রাখা হলো। এই কয়েকদিনে ফারিশ শুধু চুপচাপ বসেই থাকলো। সারাক্ষণ ভাবলো। আদ্রিতার কথা, আদিবের কথা, তার অনাগত সন্তানের কথা।’ ফারিশ বুঝতে পারছিল না কি করবে? তিশার কথাটা কি তার শোনা উচিত ছিল?”

আজ সোমবার। ফারিশের কেসটা কোর্টে ওঠার দিন। আজই হয়তো ফারিশের কাজের শাস্তি কিরূপ হবে তা জানা যাবে। আদ্রিতা তৈরি হচ্ছে। তার চোখের নিচে কালো দাগ পড়েছে। গত কয়েকদিন যে নির্ঘুম কাটিয়েছে। এই কয়েকদিনে ফারিশের সাথে কোনোরূপ যোগাযোগ করে নি আদ্রিতা। মাঝে পাঁচ’দিন আগে আদ্রিতার বাবা, মা আর ভাই এসেছিল তার সাথে দেখা করতে। আদ্রিতার মায়ের সে কি কান্না! আদ্রিতা শুধু বুঝিয়েছে কিছু হয় নি মা। সব ঠিক হয়ে যাবে। আদিবের মন খারাপ থাকে সারাক্ষণ। কি করবে? ভেবে পায় না। বসে বসে কি শুধুই দেখবে ফারিশ ভাইয়ের শাস্তির কাহিনি।’

#চলবে…

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৫৩

বিষণ্ণ মনে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে আছে আদ্রিতা। পরনে আকাশীরঙা সেলোয়ার-কামিজ। চুলগুলো কালো রাবার ব্যান্ড দিয়ে বাঁধা। আদ্রিতা ক্ষণে ক্ষণে উপলব্ধি করছে তার সঙ্গে বেড়ে ওঠা অংশটাকে। আদ্রিতার চোখ বেয়ে পানি পড়লো। এত বেশি কষ্ট হচ্ছে। আদ্রিতা মনে মনে পরিকল্পনা করছে ফারিশকে কোর্টে ওঠানোর আগে একবার দেখা করবে। আবার ভাবছে না থাক। আদ্রিতার আজকাল কিছুই ভালো লাগে না। সে বুঝতে পারছে তার আগামী জীবন কাটবে একটা জেলে বসে থাকা আসামীর অপেক্ষা করতে করতে। অপেক্ষা বড় অদ্ভুত জিনিস। ধৈর্য্যশীল মানুষদের জন্য অপেক্ষা কোনো ব্যাপার নয়। কিন্তু অধৈর্য্যশীল মানুষদের জন্য এই অপেক্ষা বড্ড ভয়ংকর জিনিস। দুনিয়াতে সব অপেক্ষার চেয়ে কঠিন অপেক্ষা হলো একটা জীবিত মানুষের ফিরে আসার অপেক্ষা। বড়ই ভয়ানক। আদ্রিতা তা দিনে দিনে উপলব্ধি করছে। চাঁদনীর গলা শোনা গেল। দরজার মুখে দাড়িয়ে বিষণ্ণ স্বরে বলল,
“আদু।”

আদ্রিতা শুনেও বোধহয় শুনলো না। চাঁদনী দ্বিতীয়বার ডাকতেই তার হুস আসল। ছলছল নয়নে পিছন চাইলো। চাঁদনীর বুকটা কেঁপে উঠল। প্রিয় বান্ধবীর এমন নিরাশময় চেহারা, এমন দুঃখকাতর জীবন মেনে নিতে পারছে না। মনে মনে খুব করে চাইছে আজ কোনোভাবে যদি ফারিশ ভাইয়ের মুক্তি হতো তবে বেশ হত। চাঁদনী দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কারণ সে জানে এমনটা হওয়ার নয়। চাঁদনী আদ্রিতার দিকে একটু এগিয়ে গেল। শান্ত স্বরে বলল,“যাবি না?”

আদ্রিতা বিষণ্ণ মনে এগিয়ে আসে তখন। মলিন কণ্ঠে শুধায়,“যাবো।”

আদ্রিতাকে নিয়েই নামলো চাঁদনী। আদিব বাড়ির রাস্তার ধারে গাড়ি নিয়ে দাঁড়ানো। তার ভীষণ কান্না পাচ্ছে। চেষ্টা করছে নিজেকে সামলানোর। তবে আদিব জানে এ চেষ্টায় প্রতিবারের মতোই ব্যর্থ হবে৷ আদিবের মনে আছে একবার ছোট বেলায় দৌড়াতে গিয়ে আদিব পড়ে গিয়ে হাঁটুতে ব্যাথা পায়। ব্যাথা পেয়ে আদিবের সে কি কান্না। ফারিশ ছুটে এসে তাকে ধরার বদলে পাশে বসে। হাসতে হাসতে বলে,
“তুমি এত কাঁদতে পারো আদিব, তোমার কান্না দেখলে আমার হাসি পায়।”

আদিব আচমকা হেঁসে ফেলে। ফারিশ ভাইয়ের হাসিটা কতই না মোহনীয় ছিল। আদিব দীর্ঘশ্বাস ফেললো। বুকটা ধরে আসছে। শুধু মাথায় ঘুরছে,
কোথায় গেল সেই সোনালী সময়গুলো। আদিবের চোখের কোনে পানি জমে। চোখের পানিটুকু হাত দিয়ে দ্রুত মুছে নিল আদিব। চাঁদনী কাঁধে হাত রাখে তখন। আদিব চমকে তাকায়। বলে,
“ডাক্তার ভাবিকে এনেছো চাঁদ?”

চাঁদনী মলিন মুখে বলে,
“এনেছি।”

আদিব মুখ লুকিয়ে গাড়ির ভিতর ঢুকতে নেয়। চাঁদনী ধরে। শীতল স্বরে বলে,
“কান্না পেলে কান্না লুকাতে নেই। তুমি কাঁদো। বেশি কষ্ট হলে আমায় জড়িয়ে ধরে কাঁদো। তবুও কাঁদো।”

আদিব করুন চোখে তাকায়। হঠাৎ কেমন হয়ে যায়। সে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে চাঁদনীকে। বলে,“আমার বুক ফেটে যাচ্ছে চাঁদ, আজ ফারিশ ভাইয়ের কিছু হয়ে গেলে কি করবো আমি?”

আদিবের পিঠে হাত বুলায় চাঁদনী। ধাতস্ত কণ্ঠে বুঝায়,“ভয় পেও না কিছু হবে না।”

আদিব কথা শোনে। বুঝে। ভয় না পাওয়ার চেষ্টা চালায়। তবুও তার ভয়টা কমে না।’


আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে আছে ফারিশ। মলিন মুখ। পরনে সেই ধূসররঙা শার্ট। কালো প্যান্ট। চুলগুলো এলোমেলো। মুখের খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি খানিক বেড়েছে। চোখে মুখে মলিনতার ছড়াছড়ি। তাকে ঘিরে সামনের বেঞ্চগুলোতে বসে আছে কতশত মুখ। এদের মধ্যে সবচেয়ে করুন মুখে বসে আছে আদ্রিতা। কতদিন পর আদ্রিতাকে দেখলো ফারিশ। আদ্রিতার চেহারার দিকে তাকালেই ফারিশের হৃৎপিণ্ড থমকে যাচ্ছে। বার বার মন কইছে,’মেয়েটা এলো কেন? না আসলেই হতো না।’ অাদ্রিতার বন্ধুমহলের সবাই এসেছে। আদ্রিতার বাবা, মা আর ভাইও আছে। পুলিশ বেসে দাঁড়িয়ে আছে কিশোর, নয়নতারা সহ আরো কিছু পুলিশ। এদের মধ্যে এক পশলা ঝুম বর্ষার রাতে ফারিশকে ধাওয়া করা সেই পাঁচ জন পুরুষ আর একজন মহিলাও আছে। তারা বুঝতে পেরেছে সেইদিন ড. আদ্রিতা তাদের মিথ্যে বলেছিল। কোর্টে তিশাও এসেছে আজ। তার বড্ড খারাপ লাগছে। ফারিশ পুরো জায়গায় চোখ বুলিয়ে বুঝলো,এত মানুষের মাঝেও একটা মানুষ মিসিং আর সেই মিসিং মানুষটা হলো আদিব। ফারিশ জানে আদিব এসেছে শুধু তার সামনে আসতে পারছে না। ফারিশ চায়ও না আদিব আসুক।’


সময় গেল। পরিবেশ হলো থমথমে। জজ সাহেব ভিতরে ঢুকেছেন মিনিট পাঁচেক হবে। আদালতে উপস্থিত এক উকিল ফারিশ রিলেটেড সমস্ত ঘটনা উল্লেখ করলেন। তার সঙ্গে বললেন ফারিশের যেন কঠিন থেকে কঠিনতম শাস্তি হয়। ফারিশের পক্ষে কেউ ছিল না। যার দরুন এক পাক্ষিক সব হলো। জজ সাহেব পুরো ঘটনা শুনে কিছু সময় চুপ থাকলেন। ফারিশকে জিজ্ঞেস করলেন,“আপনার কিছু বলার আছে ফারিশ মাহমুদ?”

ফারিশ এতক্ষণ মাথা নুইয়ে চুপটি করে উকিলের কথা শুনছিল মন দিয়ে। এতক্ষণ পর তাকে কিছু বলতে বলায় সে সরাসরি চাইলো জজ সাহেবের দিকে। শান্ত গলায় বলল,“জজ সাহেব আমি যদি শুরু থেকেই সবটা শুরু করি। তবে কি সেটা অন্যায় হবে?’উকিল সাহেব অনেক কিছু বললেন, আমি খারাপ, আমি মাফিয়া, আমি মানুষের ক্ষতি করেছি, দেশের ক্ষতি করেছি। কিন্তু উনি তো একবারও আমায় এটা প্রশ্ন করলেন না আমি এমন কেন করেছি। কিভাবে ঢুকে গেলাম এমন বেআইনি কার্যক্রমে। মানুষ কি জন্মের পরই পাপী হয় জজ সাহেব? আমাকে একটু সময় দিলে আমি কিছু বলতে চাই।”

জজ সাহেব সুযোগ দিলেন। দিলেন সময়। শুকনো কণ্ঠে জানালেন,“ঠিক আছে বলুন?”

ফারিশ এক ঝলক আদ্রিতার দিকে তাকালো। আদ্রিতার দৃষ্টিও তার দিকে। ফারিশ অপরাধীর ন্যায় চোখ নামিয়ে নিল। জজ সাহেবের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করল,
“আমি ফারিশ। আমার নামটা রেখেছিলেন রংপুরের একজন ইমাম সাহেব। বেশির ভাগ সন্তানদেরই নাম রাখে তাদের বাবা মা। কিন্তু আমার বেলায়। এখানে উপস্থিত অনেকেই হয়তো জানে তাদের বাবা মা কে? কিন্তু আমার কে মা, আমার কে বাবা এটাই আমি জানি না। রংপুরের ইমাম সাহেব বলেছিলেন কেউ একজন আমাকে রংপুরের এক মসজিদ রেখে যান। তারপর থেকেই তিনি পালেন। নাম দেন। জীবন যখন আমার পাঁচ বছর বয়সে দাঁড়িয়ে। তখন এই ঘটনা আমি জানি। বলুন না জজ সাহেব আমার কি দোষ ছিল আমার জন্মদাতাদের আমি কি বলেছিলাম আমায় জন্ম দিয়ে মসজিদে ফেলে যেতে। তারা জীবনে ভুল করেছে আর আমায় দিয়েছে সাজা। এমন শতশত ছেলেমেয়ে আছে যারা রাস্তার এ কোনায় ও কোনায় পড়ে থাকে। আমিও তেমনই রাস্তার ছেলে ছিলাম। আমাকে পাঁচ বছর বয়সে ইমাম সাহেব ঢাকা নিয়ে আসেন। এখনকার এক এতিমখানায় রেখে যান। সেখানে আমি দু’বছর ছিলাম। তারপর আমাদের তাড়িয়ে দেয়া হয়। জীবন যে কি কঠিন জজ সাহেব তা আমি উপলব্ধি করেছি সেই সব দিনগুলোতে যে দিনগুলোতে আমার পাশে কেউ ছিল না, রোদ্দুরে পুড়েছি, পথে পথে ঘুরেছি, কেউ দু’পয়সার খাবার কিনে দেয় নি। ক্ষুধার জ্বালা কি যে ভয়ংকর জ্বালা তা যদি আপনায় বোঝানো যেত। তারওপর এরওর অহেতুক মার। তবুও জীবন চলছিল। হঠাৎ জীবনে মোড় আসে,

দিনটি ছিল বর্ষাকালের। মাঝরাত। বাহিরে তুমুল বেগের বর্জপাত আর বৃষ্টি হচ্ছিল। মাথায় টিন চাপিয়ে রাস্তার এক কিনারায় বসেছিলাম আমি। তখন আমার বয়স হয়তো দশ। সে রাতের বর্জপাত আর টিনের ঝাঁকড়ানির শব্দে আমি ভয়ে স্তব্ধ। পুরো রাস্তা নির্জন। কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ। ল্যাম্পপোস্টও জ্বলছে নিভছে। আমি ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে বসে। তখনই কোথা থেকে যেন একটা লোক রক্তাক্ত অবস্থায় ছুঁটে আসে আমার কাছে। পায়ে আঘাত থাকায় সে লুটিয়ে পড়ে আমারই সামনে। আমি ভয়ার্ত হয়ে লোকটার কাছে যাই। লোকটা আর্তনাদ ভরা কণ্ঠে বলে,“আমাকে বাঁচাও তুমি, নয়তো ওরা আমায় মেরে ফেলবে।”

কথা শুনে আমি সামনে তাকাতেই দেখি দুজন লোক এগিয়ে আসে। গুলির শব্দ হয়। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই লুটিয়ে পড়া লোকটাকে অনবরত গুলি মারে আমারই চোখের সামনে। লোকটি তখন বাঁচার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালায়। কিন্তু পারে না মারা যায়। আমি গুলির শব্দের ভয়ে কুঁকড়ে যায়ই রুহু সমেত কাঁপে। তখনই একটা ছেলে আমায় দেখে বলে,“আমি দেখে ফেলেছি আমাকেও মেরে ফেলবে।”

সেইসময় আমি ছোট থাকলেও আমার বাঁচার ইচ্ছে ছিল প্রবল। ভয়ার্ত আমি আতঙ্কিত হয়ে ঘটিয়ে ফেলি আরেক ঘটনা। নিচে পড়ে থাকা একটা পিস্তল উঠিয়ে তাদের মেরে দেই। এটাই ছিল আমার প্রথম খুন।

আদালতের উপস্থিত সবাই থমকে গেল ফারিশের কথা শুনে। জজ সাহেব বলে উঠল,“তুমি মেরে দিলে? কিন্তু এমন ঘটনা তো আমার নজরে আসে নি।”

ফারিশ মৃদু হেসে বলে,“এই দুনিয়া ছলনাময়ীদের দখলে জজ সাহেব, আপনি ঠিক ততটুকুই দেখবেন যতটুকু তারা আপনায় দেখাবে। সে রাতে আমার এই ঘটনা একজন দেখেছিল। ওনার নাম মোসাদ্দেক হোসেন। উনিই ঘটনা লুকায়। কেউ জানলোই না হঠাৎ এক রাতে এক শিশুর সাথে কি ঘটে ছিল! আমার যে ব্যবসা, যে বেআইনি কারবার সব ওনার। আমাকে এই লাইনেও উনিই এনেছিলেন। আমি ছোট ছিলাম ভালো মন্দ কিছু বুঝতাম না। উনি আমায় পড়াশোনা শেখায়, ঋণী করেন। বড় করেন। বানায় মাফিয়া। আফিম ব্যবসায়ী। অস্ত্র পাচারকারী। ব্যাস সেই থেকেই আমি মাফিয়া। দেশ বিরোধী মাফিয়া।”

জীবনে আমি কখনো উপলব্ধি করি নি আমি ভুল করছি। অন্যায় করছি। কারণ আমার নেশা ছিল একটাই টাকা,টাকা, শুধুই টাকা। মোসাদ্দেক হোসেন মারা গিয়েছিলেন প্রায় চারবছর আগে তারপর থেকেই এই ব্যবসা আমি নিজেই চালাই। ছাড়ার কথা মাথাতেই আসে নি। সব ঠিকই ছিল। কিন্তু হঠাৎ এক পশলা ঝুম বর্ষায় আমার জীবনে আগমন ঘটে এক রমণীর। তার ভালোবাসায় স্নিগ্ধ হয়েই নিজের পাপ ধৌত করতে এসেছি জজ সাহেব। আমি জানি আমি অন্যায় করেছি। পাপ করেছি। কিন্তু আমি ইচ্ছে করে এসব করি নি। আমার জীবনই আমায় এখানে নিয়ে এসেছে। আমায় যা শাস্তি দিবেন আমি মাথা পেতে নেব। শুধু আমার অনুরোধ আমাকে বেঁচে থাকার অনুমতিটুকু দেয়া হোক। আমি বাঁচতে চাই জজ সাহেব। পাপ ধুঁইয়ে নতুন করে বাঁচতে চাই। প্রথমবার বাঁচার জন্য আমি অস্ত্র হাতে খুন করেছিলাম আর শেষবারের বাঁচার জন্য আমি কাঠগড়ায় এসেছি। আমি শুধু বাঁচতে চাই জজ সাহেব। এবার বাকিটুকু আপনি যা করেন। আমি তাই মাথা পেতে নেব।’

দীর্ঘ বক্তব্য শেষ করে ফারিশ দম ফেললো। পুরো বিচারসভা নিস্তব্ধ হয়ে গেল। সবাই চুপচাপ। এবার আর কেউ ফারিশের ফাঁসি চায় না। শাস্তি দেয়া হোক কিন্তু ছেলেটাকে বাঁচিয়ে রেখে শাস্তি।’

সবাই জজ সাহেবের রায়ের জন্য অপেক্ষা করছেন। তিনি কিছু সময় চুপ থেকে বললেন,“এই মামলার রায় বুধবার বারো ঘটিকায় জানাবো হবে।”

বিচারকের কথা শুনে ফারিশ পুনরায় তাকায় আদ্রিতার দিকে। আদ্রিতার মলিন মুখ। চোখ ছুঁইয়ে পানি। ফারিশের বুকটা কেঁপে ওঠে। সে শীতল কণ্ঠে ধীরস্বরে আওড়ায়,
“তুমি এভাবে কেঁদো না গো বেলীপ্রিয়া, তোমার কান্নায় যে আমার নিশ্বাস আঁটকে আসে।”

#চলবে…

#TanjiL_Mim♥️.

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে