#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৫০
হাত খসে নিচে পড়লো চিঠি। আদ্রিতা স্তব্ধ বনে খাটে বসে পড়লো। আদিব মাথা নুইয়ে দরজার কর্নারে দাঁড়িয়ে। চাঁদনীও নেই যে আদ্রিতাকে বোঝাবে। সামলাবে। আদ্রিতার হঠাৎ বুকে ব্যাথা উঠলো। চোখের পাপড়ি ভিজে আসলো আপনাআপনি। পেটে হাত রাখলো নীরবে। আদ্রিতার এত কষ্ট হচ্ছে, পাষাণ লোকটা এভাবে ব্যাথা দিয়ে চলে গেল। আদ্রিতা বিড়বিড় করে বলল,“চলেই যখন যাবে তখন এসেছিলে কেন? সেই এক পশলা ঝুম বর্ষায় এলাহী কান্ড ঘটিয়ে আমার হৃদয় নাড়িয়ে ছিল কেন? আমাদের গন্তব্য কি এতটুকুই ছিল বখাটে সাহেব? আমি তো তোমায় নিয়ে শেষ পর্যন্ত বাঁচতে চেয়েছিলাম। একটু পারলে না আমার মতো স্বার্থপর হতে। এখন এই ভাঙামন নিয়ে আমি কিভাবে চলবো ফারিশ। আমাদের সন্তান তাকেই বা কি জবাব দিবো? তুমি এমনটা কেন করলে? একেবারেই কি না করলে হতো না?”
আদ্রিতা ভেঙে পড়েছে। তার মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। চারপাশ বুঝি ফারিশের শূন্যতায় খাঁ খাঁ করছে। আদ্রিতা নিজের মাথা চেপে ধরলো। আদিব এগিয়ে আসলো তখন। তারও তো কষ্ট হচ্ছে। ফারিশ ভাই খুব বাজে কাজ করেছে। এটা না করলে কি সত্যিই হতো না। আদিব আদ্রিতার পাশে এসে বসলো। আদুরে গলায় বলল,“ডাক্তার ভাবি।”
আদ্রিতা অশ্রুমাখা চোখ নিয়ে তাকালো আদিবের দিকে। শান্ত গলায় বলল,“কাজটা কি ঠিক করলো আদিব ভাইয়া?”
আদিব সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিতে পারে না। চুপ থাকে। কিছু সময় যায়। আদিব কথা সাজায়। এরপর নিজেকে ধাতস্থ করে বলে,“প্রথম প্রথম আমারও মনে হয়েছিল ভাই কাজটা ঠিক করে নি ডাক্তার ভাবি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে বোধহয় দরকার ছিল। ফারিশ ভাই নিতে পারছিল না ব্যাপারটা। তার কষ্ট হচ্ছিল। আঘাত লাগছিল। আমি আঁচ করতে পারছি ভাই কতটা যন্ত্রণা নিয়ে এই কঠিন সিদ্ধান্তটা নিয়েছে। তুমি চিন্তা করো না ভাবি। ভাই আমায় বলেছে, চার-পাঁচ বছর পর ভাই ফিরে আসবে। তারপর আমরা নতুন করে বাঁচবো। জানো তো ভাই আমায় কখনো মিথ্যে বলে না। ভাই তোমায় চিঠিতে বলেছে না এসব?”
আদ্রিতা মাথা নাড়ায়। যার অর্থ,’বলেছে।’
আদিব খুশি হলো। বলল,“পাঁচবছর খুব বেশি সময় না ভাবি। দেখবে দেখতে দেখতে কেটে যাবে। ভাই আমাকে একটা দায়িত্ব দিয়েছে। বলেছে, ভাই যতদিন না ফিরে আসে ততদিন আমি তোমার খেয়াল রাখি। তুমি কোনো চিন্তা করো না ভাবি আমি আছি তো। আর চাঁদনীও তো আছে। ভাই ফিরে আসবে ভাবি, দেখে নিও ভাই তাড়াতাড়ি ফিরে আসবে।”
বলতে বলতে গলা ধরে আসছে আদিবের। নিজেকে শক্ত রাখা যাচ্ছে না। পাঁচবছর সত্যি কি খুব কম সময়? আদিব নিজের চোখ মুছতে মুছতে আবার বলল,“তুমি কষ্ট পেও না ভাবি। দেখো না আমিও কষ্ট পাচ্ছি না।”
আদ্রিতা বিস্মিত নজরে তাকিয়ে থাকে আদিবের দিকে। চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে আদিব কাঁদছে, কষ্ট পাচ্ছে তবুও মুখে বলছে কষ্ট পাচ্ছে না। কি অদ্ভুত!’
দুজনের মাঝে নীরবতা চলল অনেকক্ষণ। সন্ধ্যা নেমে আসছে ধরণীতে। দূর থেকে মুয়াজ্জিনের কণ্ঠ ভেসে আসছে। আজান দিচ্ছেন তিনি। আদ্রিতা নিজেকে শক্ত করল। চোখ মুছে বলল,“আমায় জেলখানায় নিয়ে চলো আদিব ভাইয়া আমি ওনার সাথে দেখা করতে চাই।”
আদিব কিছু সময় চুপ থেকে বলে,“ওনারা কি দেখা করতে দিবে?”
আদ্রিতা দাঁড়িয়ে পড়ে। বলে,“তুমি নামাজ পড়ে আসো ভাইয়া। তারপর আমরা পুলিশ স্টেশন যাবো।”
কথাটা বলেই ওয়াশরুমে ঢুকলো আদ্রিতা। ওজু করতে হবে। আদিব উঠে দাঁড়ালো। নিচে উল্টে পড়ে থাকা ফারিশের চিঠিটা উঠালো। তবে পড়লো না। কারণ ফারিশকে যখন কিশোর হাতে হ্যানকাপ পড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। তখন আদিব ছিল ঠায় দাঁড়িয়ে। বুক জুড়ে চলছিল কি বিষাদ! ঠিক সেই সময় ফারিশ আদিবের হাতে এই চিঠিটা ধরিয়ে দেয়। আদেশস্বরূপ বলে,“এটা আদ্রিকে দিও। আর শোনো, তুমি এই চিঠি খুলবে না আদিব। এটা একান্তই আমার বউয়ের জন্য লেখা। তুমি ভুলেও খুলবে না। পড়বে না।”
আদিব সেই কথা রেখেছে সে চিঠি খোলেও নি,পড়েও নি। কারণ আদিব কখনো ভাইয়ের হুকুমের অবাধ্য হয় না। আজও হয় নি। আদিব টেবিলের উপর চিঠিটা রেখেই রুম থেকে বের হলো। নিজ রুমে গিয়ে নামাজের টুপিটা নিয়ে বেরিয়ে গেল বাসা থেকে।’
–
তখন সন্ধ্যে সাড়ে সাতটা। আদ্রিতা আর আদিব দাঁড়িয়ে আছে পুলিশ স্টেশনের বাহিরে। আদিব ভিতরে ঢুকবে কি ঢুকবে না ভেবে পায় না। কারণ ফারিশ ভাই তাকে বারন করেছে পুলিশ স্টেশন আসতে। আদ্রিতা বোধহয় ব্যাপারটা বুঝলো। সে বলল,“তুমি দাঁড়াও ভাইয়া আমি একাই যাচ্ছি।”
কথাটা বলে আদ্রিতা একাই চলে গেল। আদিব দাড়িয়ে রইলো। ভিতরে ঢোকার সাহস এলো না।’
আদ্রিতা একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে। তার ভিতরটা কেমন কেমন করছে। আদ্রিতা আশপাশ দেখলো। তাকে প্রথমেই নজরে পড়লো কিশোরের। সে মিষ্টি হেঁসে বলল,“আসুন ডাক্তার সাহেবা। আমি জানতাম আপনি আসবেন।”
আদ্রিতা নীরবে এগিয়ে গেল। শান্ত স্বরে বলল,“আমি একটু ফারিশের সাথে দেখা করতে চাই অফিসার।”
কিশোর নাকচ করলো প্রথমে। বলল,“আমরা তো এভাবে দেখা করতে দিতে পারি না ডাক্তার সাহেবা।”
আদ্রিতা মিনতির স্বরে বলল,“একটু দেখি।”
কিশোর বুঝলো। বলল,“ঠিক আছে। তবে একটুই যেন দেখেন।”
আদ্রিতা আর কথা বাড়ালো না। বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। এগিয়ে গেল লকাপের দিকে।’
গায়ে ধূসর রঙের শার্ট। কালো প্যান্ট। অগোছালো চুল। আর শ্যামবর্ণের মুখখানা নিয়ে মাথা নুইয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বসে আছে ফারিশ। আদ্রিতার বুক কেঁপে উঠলো এমন দৃশ্য দেখে। বুকখানায় এত কষ্ট হচ্ছে তখন। আদ্রিতা নিজের চোখ মুছে ডাকলো,“মিস্টার বখাটে।”
তড়িৎ চমকে উঠলো ফারিশ। চোখ তুলে চাইলো তক্ষৎণাৎ। আদ্রিতার মুখটা দেখলো। কেমন থমথমে হয়ে আছে। ফারিশের হৃদয়খানায় বুঝি হাহাকার করে উঠলো। ফারিশ বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। একটু একটু করে এগিয়ে আসলো। প্রশ্ন করলো,“তুমি কেন এসেছো বেলীপ্রিয়া?”
আদ্রিতা মলিন মুখে চায়। বলে,
“এমনটা করা কি খুব দরকার ছিল ফারিশ?”
ফারিশ তপ্ত নিশ্বাস ফেলে বলে,
“বোধহয় ছিল।”
“আমি যে ভালো নেই তুমি কি দেখতে পাচ্ছো?”
“পাচ্ছি।”
“আমি যে তুমিহীনা ভালো থাকবো না এটা জানতে না?”
“জানতাম।”
“তবুও কেন করলে?”
“আমি যে বাধ্য ছিলাম। তুমি তো জানো।”
“একটু কি স্বার্থপর হওয়া যেত না?”
“বোধহয় যেত কিন্তু সস্থি পাচ্ছিলাম না।”
“আমার ভালোবাসা তোমায় সস্থি দিত না ফারিশ?”
ফারিশ কথা বলে না। চুপ করে রয়। মাথা নুইয়ে ফেলে। আদ্রিতা আবার বলে,“আমায় ছেড়ে যাওয়ার এত তাড়া তোমার।”
ফারিশ চোখ তুলে তাকায়। বিষণ্ণ কণ্ঠে জানায়,
“আমার কষ্ট হয় বেলীপ্রিয়া।”
মলিন মুখে হাসলো আদ্রিতা। কি বলবে ভেবে পায় না আর। ফারিশ মাথা নুইয়ে বলে,“চলে যাও।”
আদ্রিতা লকাপের শিকে হাত রাখে। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে শুধায়,“এতটা পাষাণ কিভাবে হলে?”
ফারিশ ছলছল নয়নে তাকায়। আদ্রিতার হাতটা ধরে। আদ্রিতার শরীর ফারিশের স্পর্শে আরো কাতরে উঠল তখন। ফারিশ বলল,“আমায় ভুল বুঝছো বেলীপ্রিয়া?”
আদ্রিতা জবাব দিতে চায় না। ফারিশ মৃদু হেসে বলে,“সত্যি করে বলো তুমি কি এমনটা চাওনি আদ্রি?”
আদ্রিতা চোখ তুলে সরাসরি তাকায়। এবারও কিছু বলে না। ফারিশ হেঁসে বলে,“বাড়ি যাও বেলীপ্রিয়া। এখানে আর এসো না।”
আদ্রিতা গেল না। ঠায় দাড়িয়ে রইলো। তবে কোনো কথাও বললো না। চুপচাপ পাথর মনে দাঁড়িয়ে থাকলো। ফারিশ বলে,“আমার ভাইটার যত্ন নিও আদ্রি, ও খুব ভীতু। জানোই তো। আমার শাস্তির কথা ওকে এখনই জানিও না। আমার কেসটা যেদিন কোটে উঠবে ওইদিন তুমি বা আদিব কেউই এখানে থেকো না। দূরে কোথাও চলে যেও কেমন।”
এই বলে আদ্রিতার দু’গাল চেপে চোখের পানি মুছে দিল। এরপর খুশি মনে বলল,“এবার বাড়ি যাও। নিজের যত্ন নিও বেলীপ্রিয়া। আমি থাকি বা না থাকি নিজের যত্ন নিতে ভুলো না কিন্তু।”
আদ্রিতা আর সেখানে দাঁড়াতে পারছে না। বুকের ভেতর যে তোলপাড় শুরু হয়েছে তা এত সহজে ঘুচবে না। আদ্রিতা বলল,
“আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। যন্ত্রণায় ছটফট করছে। আমার বাঁচতে ইচ্ছে করছে না।”
আঁতকে উঠল ফারিশ। ঠোঁটে হাত দিয়ে বলল,“হুস! এভাবে বলে না। আমি ফিরবো দেখো।”
আদ্রিতা আর কিছু বলতে পারলো না। একরাশ অভিমান। জড়তা, ভয় আর যন্ত্রণা নিয়ে ছুটে আসলো। ফারিশ শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলো।’
–
পরেরদিনটা যেন বিষণ্ণের সকাল। বাংলাদেশের সমস্ত টিভি চ্যানেলে ফারিশের কেচ্ছার কথা জানালো হলো। ঔষধ কোম্পানির আড়ালে ফারিশের এই বেআইনি কারবার। আফিমসহ সকল নেশালো দ্রব্য এবং দেশীয় অস্ত্রের সবটা টিভিতে দেখানো হল। একদল জনগণ ক্ষিপ্ত হয়ে ফারিশের ঔষধ কোম্পানিতে ভাংচুর চালালো, কেউ কেউ আগুন জ্বালিয়ে দিল। ফারিশের তৈরিকৃত সকল ঔষধ ব্যান করা হলো। যদিও তাতে কোনো ভেজাল ছিল না। তবুও!’
আদ্রিতার কলিগ,বাবা,মা, ভাই, আত্মীয়স্বজন সবাই হতভম্ব হয়ে গেল এমন নিউজে। একের পর এক কল আসছে আদ্রিতার বাবা,মা, ভাইর ফোনে। তারা ফোন তুলছে না। ফারিশের বাড়িতে ভাংচুর করা হলো। ভাগ্যিস তখন বাড়ির ভিতর আদিব আর আদ্রিতা ছিল না। খবর পেয়ে সূদুর চট্টগ্রাম থেকে ছুটে আসছে চাঁদনী। এই একদিনের ব্যবধানে কি ঘটে গেল সে বুঝতে পারছে না। ফারিশ ভাই মাফিয়া এই যেন তার বিশ্বাস হচ্ছে না।’
বাকরুদ্ধ হয়ে গেল আদ্রিতার বন্ধুমহলের সকল সদস্য। মৃদুল,রনি,মুনমুন,আশরাফ ইতিমধ্যে বেরিয়ে পড়েছে আদ্রিতার খোঁজে। প্রাণ প্রিয় বান্ধবীটার কি অবস্থা হচ্ছে এটা তারা ধরতে পারছে না। আদিবকে কল করা হয়েছে। সে একটা এড্রেস দিয়েছে। সেই এড্রেসের উদ্দেশ্যেই রওয়ানা দিয়েছে সবাই। এই বিষয়টা সম্পর্কে আদিব ফারিশ ছাড়াও নয়নতারা জানতো। কিন্তু ফারিশ বারণ করায় কাউকে কিছু বলতে পারে নি সে। এজন্য খানিকটা ক্ষিপ্ত আশরাফ। চাপা উত্তেজনায় ভরপুর ঢাকার শহর। আজকের নিউজ চ্যানেলগুলোতে যেন ফারিশেরই উদ্ভাবন।’
–
বেলা এগারোটা। পুলিশ স্টেশনের বাহিরে এসে থামলো একটা রিকশা। সেখান থেকে নামলো একটি মেয়ে। পরনে সাদা রঙের থ্রি-পিস। সে ভিতরে এগিয়ে আসলো। কিশোরের মুখোমুখি দাড়িয়ে হাতে একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে বলল,
“আমি ফারিশ মাহমুদের সাথে দেখা করতে এসেছি।”
#চলবে…
#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৫১
“আমাকে চিনতে পারছেন ফারিশ ভাইয়া?”
আচমকা এক মেইলি কণ্ঠ কানে আসতেই খানিক চমকে চাইলো ফারিশ। সাদা থ্রি-পিস পড়া এক মেয়ে দাঁড়িয়ে। ফারিশ বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। এগিয়ে গেল মেয়েটির পানে। মেয়েটি ফারিশকে দেখেই মৃদু হাসলো। আবার জিজ্ঞেস করল,“আমাকে চিনতে পেরেছেন ভাইয়া?”
ফারিশ কতক্ষণ চেয়ে দেখলো মেয়েটিকে। অদ্ভুত ব্যাপার তার মেয়েটির কথা মনে পড়ছে না। ফারিশের স্মৃতি শক্তি খুব একটা দূর্বল নয় তবুও মেয়েটিকে তার মনে পড়ছে না। মেয়েটি ফারিশের দৃষ্টি ভঙ্গি বোধহয় বুঝতে পারলো। সে বলল,“আমি তিশা ভাইয়া। আপনার মনে আছে ওই এক বছর আগে মেয়ে পাচার কারির হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন।”
ফারিশের তড়িৎ মনে পড়ে গেল সবটা। এই মেয়েটা ল’য়ের স্টুডেন্ট ছিল। ফারিশ দারুণ অবাক হলো। সে ভাবতেও পারে নি। ওই মেয়েটা আসবে। ফারিশ বিস্মিত নজরে কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,
“কেমন আছো তুমি?”
তিশা মিষ্টি স্বরে বলল,
“ভালো ভাইয়া। আপনি?”
“আমি তো এই আছি।”
“আপনি সত্যি মাফিয়া ভাইয়া?”
ফারিশ মাথা নাড়িয়ে বলে,
“দেখে মনে হয় না তাই না।”
“তেমনটাই।”
“আসলে কি বলো তো দুনিয়ার সব খারাপ মানুষই ভালো মানুষের মুখোশ নিয়ে ঘোরে।”
“আপনি খারাপ মানুষ নন।”
চমৎকার হাসলো ফারিশ। বলল,
“টিভিতে আমার অস্ত্র সস্ত্র, মাদকদ্রব্য দেখো নি?”
তিশা কথা বলে না। ফারিশ বলে,
“তুমি কি আমাকে সাহায্য করতে এসেছো?”
“বিষয়টা মিথ্যে হলে আমি প্রাণপণ চেষ্টা করবো।”
ফারিশ বলে,
“আমি যে আত্মসমর্পণ করেছি শোনো নি?”
“শুনেছি। তবুও মিথ্যে বলে মনে হয়েছে। কারো কি ব্ল্যাকমেলের শিকার হয়েছেন ভাইয়া।”
ফারিশ মাথা নাড়ায়। যার অর্থ, ‘হয়েছে।’
তিশার ঠোঁটে হাসি রেখা দেখা যায়। সে আওয়াজ করে বলে,“সত্যি। নাম বলুন আমি সাক্ষর প্রমাণ সংগ্রহ করে আপনায় ছাড়াবো।”
ফারিশ আবার হাসে। মেয়েটার কথায় তার এত হাসি পাচ্ছে। ফারিশ বলে,“সে তো কোনো মানুষ নয় তিশা।”
তিশা অবাক হয়ে বলল,
“মানে?”
“আমি যে ভালোবাসায় ব্ল্যাকমেল বদ্ধ তিশা।”
তিশা ফারিশের কথার আগামাথা বুঝে না। তিশা বলে,“আমায় একটু বুঝিয়ে বলুন না।”
ফারিশ দ্বিধাহীন কিছু কিছু বললো। তিশা অবাক না হয়ে পারলো না। ভালোবাসার জন্য জেল খাটছে এসেছে ফারিশ। তিশা বলল,
“আমি আপনায় বের করবো ফারিশ ভাইয়া। আপনি কোনো টেনশন করবেন না পুরো কেস আমি ঘুরিয়ে দিব। আমি জানি এতে আমাকে অনেকগুলো মিথ্যে সাজাতে হবে তবুও আমি আপনায় বাঁচাবো।”
ফারিশ সঙ্গে সঙ্গে নাকচ করলো তাতে। বলল,
“লোকে বলে খারাপ মানুষের সাথে মিশলে মানুষ খারাপ হয়ে যায়। তুমি তো আমার সাথে মেশো নি তবুও খারাপ কেন হচ্ছো?”
“আমি আপনায় বাঁচাতে চাই ভাইয়া। মাঝে মাঝে কিছু ভালোর জন্য আমাদের একটু আকটু খারাপ হতে হয়।”
“এতে আমার আত্নসমর্পণ করে লাভটা কি হলো?”
“বেআইনী কাজ থেকে তো মুক্তি পেলেন।”
“তোমার কি মনে হয় জেল থেকে বের হলেই আমি মুক্ত। শুনেছি আমার সাথে যারা কাজ করতো তাদের মধ্যে দুজন পালিয়েছে। তোমার কি মনে হয় তারা আজীবন পালিয়ে থাকবে আমায় খুন করতে আসবে না।”
তিশা কি বলবে বুঝতে পারছে না। ফারিশ বলে,
“একটা কথা বলি শোনো,আইনের পোশাক যেহেতু পড়েছো। সবসময় সত্যের হয়ে লড়বে। আর আমার সত্য হলো আমি পাপী। আমার মুক্তি নেই। কঠিন শাস্তিই আমার প্রাপ্য।”
“আমি আপনায় সাহায্য করতে চাই ভাইয়া?”
“করবে তো তবে এবার নয় পরের বার। পরেরবার ফারিশ ভুল করবে না।”
তিশা ছলছল নয়নে তাকিয়ে রয় ফারিশের দিকে। ফারিশ শান্ত গলায় বলে,“চলে যাও তিশা। আমার এই মুহূর্তে সাহায্যের প্রয়োজন নেই। পরেরবার লাগলে আমি নিজে তোমায় ডাকবো।”
তিশা মাথা নুইয়ে বলে,
“আপনার ওপর যে অভিযোগগুলো আছে তার শাস্তি অনেক কঠিন ভাইয়া। মৃত্যুদন্ড হওয়ার চান্স আশি পারসেন্ট। বাকি বিশ পারসেন্টের শাস্তিও সহজ নয়। কম করে হলেও পনের থেকে বিশ বছরে জেল।”
শাস্তির কথা শুনে ফারিশ হাসিমুখে বলে,
“যে শাস্তিই হোক আমি নিতে প্রস্তুত।”
“একটু কি মিথ্যের আশ্রয় নেয়া যায় না?”
“এতদিন যাবৎ তো ছিলাম মিথ্যের আড়ালে প্রথমবার সত্যের কাছে এলাম। কঠিন হলেও শান্তি পাচ্ছি। মিথ্যেতে শান্তি নেই আছে গুমোট অশান্তির নিঃশ্বাস।”
তিশা আর কিছু বলতে পারলো না। অতঃপর তাকে নিরাশ হয়েই ফিরতে হলো। ফারিশ কিছুতেই রাজি হলো না। তিশা তপ্ত নিশ্বাস ফেলে পুলিশ স্টেশন থেকে বের হলো। কি করবে বুঝতে পারছে না। মানুষটা বাজে কাজ করলেও মনটা ভালো ছিল। তিশার মন খারাপ হলো। মনে মনে ভাবলো,
“আমার কথাটা মানলে খুব বেশি কি ক্ষতি হতো ফারিশ ভাইয়া?”
প্রশ্ন আসলো। তবে উত্তর আসলো না। তিশা প্রচন্ড মন খারাপ নিয়ে চলে গেল।’
–
পুরনো বাংলো। এটা হলো সেই বাংলো যেখানে ফারিশ আর আদ্রিতা প্রায় আসতো। বাংলোর ওই সামনের উঠোনটায় গতবারের শীতের সেই সময়ে আগুন জ্বালিয়ে ফারিশ আদ্রিতার কত প্রেমআলাপ চলতো। আদ্রিতা জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছে সেই উঠোনটার দিকে। মন জুড়ে বিষাদ ঘুরছে। আদিবের আওয়াজ শোনা গেল তখন। সে বলছে,
“ডাক্তার ভাবি আসবো?”
আদ্রিতা পিছন ঘুরে চাইলো। আদিব খাবার নিয়ে এসেছে। আদ্রিতা কাল থেকে কিছু খায় নি। আদিব খাবার নিয়ে যেতে যেতে বলল,“খাবারটা খেয়ে নেও ভাবি।”
আদ্রিতা শান্ত ভঙ্গিতে বলে,“আমার খেতে ইচ্ছে করে না ভাইয়া।”
আদ্রিতার অসহায় কণ্ঠস্বর শুনে আদিবের কষ্ট লাগলো। খাবারটা বিছানায় রেখে বলল,
“এভাবে বলে না ভাবি শক্ত হও ভাই ফিরে আসবে দেখো। ভেঙে পড়লে কি চলবে বলো?”
আদ্রিতা হেঁটে আসতে নেয়। দাঁড়িয়ে থাকতে আর ভালো লাগছে না। হঠাৎ আদ্রিতার মাথা চক্কর দিয়ে উঠলো। সে পড়ে যেতে নিলো সঙ্গে সঙ্গে তাকে ধরে বসলো আদিব। বলল,“সাবধানে ভাবি।”
আদ্রিতা শক্ত হয়ে দাঁড়াতে চাইলো। পেট কামড়ে বমি আসলো তখন। আদ্রিতা দ্রুত ছুট লাগালো ওয়াশরুমে। আদিব চিন্তিত নজরে তার পানে তাকানো। কাল রাত থেকেই দেখছে আদ্রিতা ভাবি ঠিক নেই। ঘন ঘন বমি করছে। আদিব ওয়াশরুমের দিকে যেতে গিয়েও গেল না। খানিক সংকোচ লাগে। বাড়ির কলিংবেল বাজলো তখন। আদিব আদ্রিতাকে বলে চলে যায় নিচে। নিশ্চয়ই আদ্রিতার বন্ধুমহলেরা এসেছে।”
সোফায় গোল হয়ে বসে আছে আশরাফ, রনি,মুনমুন, মৃদুল আর আদিব। চাঁদনী এখনও চট্টগ্রাম থেকে পৌছায় নি। আদ্রিতা ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে সোফায় বসেছে মাত্র। মুনমুনই তাকে ধরে বসালো। সবাই ফ্যাল ফ্যাল নজরে তাকিয়ে আছে আদ্রিতার দিকে। আদ্রিতা বেশ বিরক্ত নিয়ে বলল,
“তোরা এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন? আগে কখনো দেখিস নি আমায়।”
জবাব দিতে চায় না কেউই। কিছু সময় পর মৃদুল বলে,“তুই ঠিক আছিস তো আদু?”
আদ্রিতা স্বাভাবিক কণ্ঠেই বলে,
“হুম।”
মুনমুন বলছে,“এমন বমি কি তোর ঘনঘন হচ্ছে? চোখ মুখেরও তো বেহাল অবস্থা।”
আদ্রিতা কিছু বলার আগেই আদিব বলে উঠল,
“হুম। কাল থেকেই দেখছি।”
মৃদুল হেঁসে বললো,“দোস্ত আমরা কি মামা হমু?”
মৃদুলের আকস্মিক প্রশ্নে হতমত খেয়ে গেল সবাই। এমন একটা সময়ে এই কথাটা কি বলার মতো সময়। রনি বলল,“তুই আর মানুষ হলি না।”
মুনমুন চেয়ে চেয়ে দেখলো আদ্রিতাকে। মৃদুলের কথাটা একেবারেও ফেলে দেয়ার মতো নয়। আদ্রিতার চোখমুখ যেন সেদিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে। আদিব বিস্মিত নজরে তাকিয়ে আছে আদ্রিতার দিকে। আদ্রিতা কিছু বলছে না। মুনমুন বলল,“মৃদুলের ধারণা কি ঠিক আদু?”
আশরাফ বলল,“তুইও মৃদুলের মতো শুরু করলি।”
মুনমুন বলল,“আদ্রিতার মুখ থেকেই শুনি।”
সবাই আদ্রিতার দিকে তাকাল। মুনমুন ফের প্রশ্ন করে,“আদু মৃদুলের ধারণা কি সত্যি?”
আদ্রিতা এবার মাথা নাড়ালো। মলিন মুখে জানালো,“সত্যি।”
আদিব হতভম্ব হয়ে গেল আদ্রিতার উত্তর শুনে। বুকের ভেতর আচমকা মোচর দিয়ে উঠলো। এমন একটা সময়ে তার ভাই বাড়ি নেই। আদিবের ভাবতেই কান্না পাচ্ছে। আদিব উঠে দাঁড়ালো। তার মনে হলো এই খবরটা ভাইকে দেয়া দরকার।
বিষয়টা খুশির হলেও আদ্রিতার বন্ধুমহলের কেউ খুশি হতে পারলো না। সবার চোখে মুখে বিষণ্ণ ভাব। এখন কি হবে? ফারিশের কথা চিন্তাও করতে পারছে না কেউ। তারা বুঝতেই পারে নি যাকে নিয়ে তারা পুলিশ স্টেশনে অভিযোগ করতে গিয়েছিল সে আসলেই মাফিয়া ছিল। অথচ তখনকার পরিস্থিতি আর এখনকার পরিস্থিতি কত ভিন্ন। আগামীতে কি হবে কেউ ধরতে পারছে না যেন। সবার চোখেমুখে চিন্তার ছাপ। কেমন হবে তাদের বান্ধুবীর ভবিষ্যতে?”
আদিব বাড়ি থেকে বেরিয়ে গেছে। নিজে ড্রাইভ করে ছুটছে। তার উদ্দেশ্য আদ্রিতার মা হওয়ার ব্যাপারটা ফারিশকে জানানো। তাকে বোঝানো সে যেটা করেছে সেটা ভুল করেছে। ঠিক করে নি। আদিবের মাথা কাজ করা হঠাৎ বন্ধ করে দিয়েছে সে ভুলতে বসেছে ফারিশের বলে যাওয়া একটি কথা,“তুমি পুলিশ স্টেশন আসবে না আদিব।”
#চলবে….
[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ। আপাতত কিছু বলার নেই শুধু বলবো একটু ধৈর্য্য ধরতে।]
#TanjiL_Mim♥️.গল্পের