এক পশলা ঝুম বর্ষায় পর্ব-৪৪+৪৫

0
457

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৪৪

বড্ড অস্থিরতায় ভরপুর নয়ন নিয়ে তাকিয়ে আছে আদ্রিতা ফারিশের দিকে। আশ্চর্য ফারিশের এত ঘাবড়ানোর কি আছে? সে কি সিরিয়াস হয়ে কথাটা বলেছিল নাকি! বলেছে তো মজা করে। হঠাৎই আদ্রিতার মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেললো। সে মনে মনে হাসলো। ফারিশের গা ঘেঁষে বসলো একটু। ফারিশ চমকে উঠলো এতে। বললো,“এখনই গা ঘেঁষে বসার কি আছে দূরে সরো?”

আদ্রিতা সরলো না। ফারিশের কানে কানে ফিসফিস করে বলে,“এত ঘাবড়াচ্ছেন কেন মাফিয়া সাহেব? আমি বউ হয়ে ঘাবড়াচ্ছি না আর আপনি স্বামী হয়ে ঘাবড়াচ্ছেন।”

ফারিশ সরাসরি চাইলো আদ্রিতার দিকে। আদ্রিতার চোখে মুখে রহস্যের হাসি। ফারিশ বুঝেছে এ মেয়ে মতলব। ফারিশ এবার সিরিয়াস হলো। নিজেই আদ্রিতার কোমড় জড়িয়ে কাছে আনলো। বললো,“প্রথমবার তো তাই একটু ঘাবড়াচ্ছি। তুমি মানিয়ে নিতে পারলে দেখবে আর ঘাবড়াবো না।”

আদ্রিতা চমকালো এবার। হাসি আসলো তার। তবে হাসলো না। আদ্রিতা বুঝেছে তার আর মজা করা হলো না। এই ছেলে এখন ভয় পেল না কেন! ফারিশ বুঝি আদ্রিতার মনের কথা বুঝলো। আদুরে গলায় বললো,“ফারিশকে ভয় পাওয়ানো এত সোজা বুঝি।”

আদ্রিতা ভ্রু-কুচকে নিজেকে ছাড়ানো চেষ্টা করলো। বললো,“ছাড়ুন তো। আপনি একটা পাঁজি লোক শুধু শুধু এতক্ষণ নাটক করছিলেন।”

ফারিশ চমৎকার ভাবে হাসলো। আদ্রিতার সেই হাসিতে চোখ আটকালো। লোকটা এত সুন্দর হাসে যে আদ্রিতা বার বার প্রেমে যায়। আদ্রিতার চাহনি খেয়াল করলো ফারিশ। সে শীতল গলায় আওড়ালো,
“এভাবে তাকাবেন না ডাক্তার ম্যাডাম, আপনার চাহনি যে আমাকে ভিতর থেকে বড্ড ক্ষত-বিক্ষত করে দেয়।”

আদ্রিতার মুখভঙ্গি পাল্টালো। এই ছেলে আবার তাকে আপনি করে বলছে। কি সুন্দর এতক্ষণ তুমি বলছিল। ফারিশের তুমিটাতে আদ্রিতা অন্যরকম সস্থি পায়। আদ্রিতা বললো,“ক্ষতের কি আছে ভালোবাসায় কোনো ক্ষত নেই। আছে শুধু পবিত্রতার ছোঁয়া। ”

ফারিশের আচমকা কি যেন হলো সে ছেড়ে দিলো আদ্রিতাকে। আদ্রিতা খানিকটা অবাক হলো এতে। বললো,“কি হয়েছে?”

ফারিশ মাথা নিচু করে বলে,
“আমার জীবনে আপনার আসাটা কি ঠিক হলো?”
“কেন ঠিক হবে না।”
“আমার জীবন যে বড্ড অগোছালো।”
“থাকুক না একটু অগোছালো ক্ষতি কি তাতে?”
“ক্ষতি কি সত্যি নেই?”
“আমি তো দেখি না।”
“তুমি কি পারবে আমার সাথে সারাজীবন অগোছালো হয়ে থাকতে?”
“আপনি সাথে থাকলে আমি ঠিক মানিয়ে নিবো।”

ফারিশ আদ্রিতার দু’হাত আঁকড়ে ধরলো। মলিন মুখে বললো,
“জানো তো আমি এই জীবনে আসতে চাই নি কিন্তু সময়, পরিস্থিতি আমায় এখানে এনে ঢেকিয়েছে।”
“ছেড়ে আসা কি সম্ভব?”
“ছেড়ে দিলে আমার মৃত্যু নিশ্চিত।”

আদ্রিতা সঙ্গে সঙ্গে থমকে গেল। বললো,“দরকার নেই। আড়ালের জিনিস আড়ালেই রাখুন। আজ আমি আড়াল করবো ভবিষ্যতে আমাদের সন্তানেরা আড়াল করবে। তারাও নিশ্চয়ই বাবা প্রেমিক হবে। আপনি আর এসব নিয়ে ভাববেন না। কাল আমাকে হসপিটাল যেতে হবে আসুন ঘুমিয়ে পড়ি।”

ফারিশ কিছু বলে না। চুপ করে রয়। আদ্রিতা বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। তার গায়ে জড়ানো ছিল ভাড়ি লেহেঙ্গা। আদ্রিতার হঠাৎ মনে হলো সে একটা কঠিন ভুল করে ফেলেছে। আসার সময় কোনো জামাকাপড় আনা হয় নি। এগুলো পড়ে তো ঘুমানো সম্ভব নয়। আদ্রিতা ফারিশের দিকে তাকিয়ে বললো,“আপনার জামা কাপড় কোথায় থাকে মাফিয়া সাহেব?”

ফারিশ শান্ত দৃষ্টি নিয়ে তাকায় আদ্রিতার দিকে। হাত দেখিয়ে আয়নার পাশেই বিশাল আলমারিটাকে দেখিয়ে বলে,“ওইখানে।”

আদ্রিতা দ্বিতীয়হীন এগিয়ে গেল সেখানে। আলমারি খোলাই ছিল। আদ্রিতা আলমারি খুলে দেখলো ফারিশের বেশ কিছু শার্ট প্যান্ট রয়েছে। আদ্রিতা অনেক খুঁজেফুজে মেরুন রঙের একটা ফু’হাতার টিশার্ট বের করলো। সঙ্গে কালো জিন্স। এরপর সেগুলো নিয়ে ছুটে গেল ওয়াশরুমের দিকে। ফারিশ শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলো আদ্রিতার কর্মকান্ড। কিছু বলতে পারলো না। তবে বুঝেছে খানিকটা। কেন নিলো?’

আধঘন্টা পরই মুখের সাজগাজ মুছে ফারিশের টিশার্ট আর জিন্স পড়ে বেরিয়ে আসলো আদ্রিতা। গায়ে গাতোরের অলংকার খুলে রাখলো আয়নার সামনে। এরপর খুলে ফেলা লেহেঙ্গাটা ফারিশের বেলকনিতে টানাতে গেল। ফিরে এসে ফারিশকে একই ভঙ্গিতে বসে থাকতে দেখে বললো,“আপনি কি সারারাত ওভাবেই বসেই থাকবেন?”

ফারিশের উসখুস চাহনী। অস্থিরতায় বুকভাড়। সে মলিন মুখে আবদারের স্বরে শুধালো,“আমায় একটু জড়িয়ে ধরবে বউ?”

আদ্রিতা চকিত চমকে উঠলো। কিছু বলতে যাবে তার পূর্বেই পুরো ঘর জুড়ে অন্ধকার নামলো। কারণ ফারিশের ঘরে তখন লোডশেডিং হয়েছে। আদ্রিতা তখনও বেলকনির দরজার মুখে ঠায় দাঁড়ানো। হঠাৎ ম্যাচের কাটি জ্বলে উঠলো। ড্রয়ার থেকে মোমবাতি বের করে সেটা জ্বালালো ফারিশ। আলতো হাতে রাখলো ড্রেসিং টেবিলের উপর। আদ্রিতা এগিয়ে এলো। মুখোমুখি বসলো। মিষ্টি হেঁসে বললো,“ধরুন।”

ফারিশ দেরি করলো না মোটেও তক্ষৎনাৎ জড়িয়ে ধরলো আদ্রিতাকে। আদ্রিতা চুপচাপ বসে নিজেও ধরেছে তো ফারিশের পিঠ। লোকটার বুকভরা চাপা আর্তনাদ আদ্রিতা টের পাচ্ছে। মাঝে মাঝে আমরা ভুল কাজ থেকে সরে আসতে চাইলেও সরে আসতে পারি না। কারণ সরে আসার সময়টায় যে আমরা বড্ড দেরি করে ফেলি। আদ্রিতা চায় ফারিশ সব থেকে বেরিয়ে আসুক। কিন্তু ফারিশ যে বললো, বেরিয়ে আসতে চাইলেই মৃত্যু নিশ্চিত। কথাটা ভেবেই বুক কেঁপে উঠলো আদ্রিতার। সে ফারিশের শার্টটা পিছন থেকে শক্ত করে চেপে ধরলো। আদ্রিতা হঠাৎ বললো,“আপনি একবার আমায় আবদার করে ছিলেন আমাদের যতবার দেখা হবে ততবার যেন আমি আপনায় দশ মিনিট করে জড়িয়ে ধরি। সে আবদার এতদিন আমি রাখি নি। তাই আজ থেকে আপনি দশ মিনিটের জায়গায় আমায় ত্রিশ মিনিট জড়িয়ে ধরে বসে থাকতে পারবেন আমি কিছু মনে করবো না।”

ফারিশ কথাটা শোনে। ঠোঁট মেলে কিঞ্চিৎ হাসে। তবে কিছু বলে না। আদ্রিতাকে জড়িয়ে ধরার মাঝে ফারিশ বরাবরই অন্যরকম প্রশান্তি পায়। ফারিশ চোখ বন্ধ করলো। প্রকৃতি তখন নীরব। অন্ধকারে টুইটুম্বর পুরো শহর। আকাশ জুড়ে থাকা চাঁদটাও বুঝি মেঘে থাকতে ব্যস্ত। তবে এতো ব্যস্ততার ভিড়েও মিট মিট করে জ্বলছিল একখানা আগুনবাতি।”
—-
সূর্যের তীব্র রোদে ঘুম ভাঙলো ফারিশের। পাশ ফিরে আদ্রিতাকে না দেখে খানিকটা চমকে উঠলো। শোয়া থেকে উঠে বসলো দ্রুত। জোরে হাক দিয়ে ডাকলো,“আদিব।”

আদিব দ্রুত ছুটে আসলো তখন। থরথর করে বললো,“বলুন ভা…

পুরো কথা শেষ করার আগেই ড্যাব ড্যাব করে ফারিশের দিকে তাকিয়ে রইলো আদিব। ফারিশ নিচের দিকে তাকিয়েই প্রশ্ন করলো,“আদ্রিতা কোথায় আদিব?”

আদিব জবাব দিলো না। ফারিশের দিকেই চেয়ে রইলো শুধু। ফারিশ এবার তাকালো আদিবের দিকে। বললো,“কি হলো আদিব কথা বলছো না কেন?”

পুরো কথা শেষ করে আদিবের মুখশ্রীর দিকে তাকাতেই বিব্রত হলো ফারিশ। আদিব যেন কিভাবে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ফারিশ অবাক স্বরে বললো,“কি হলো আদিব তুমি এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? আমাকে এর আগে দেখো নি।”

আদিব আচমকা লাজুক হাসলো। বেশ লাজুকতা নিয়ে বললো,“দেখেছি তো ভাই তবে আজকে।”

বলেই রুম থেকে বেরিয়ে গেল আদিব। ফারিশ হতভম্ব হয়ে চেয়ে। ব্যাপারটা কি হলো?”
ফারিশ বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। নিজের শার্টের দিকে তাকালো। সামনের কিছু বোতাম খোলা সঙ্গে বুকের উপরে লিপস্টিকের দাগ। ফারিশ বিস্মিত হয়ে গেল ঘটনাটায়। হতভম্ব স্বরে বললো,“এসব লাগলো কখন? কাল রাতে ছাহ্। আদিব কি ভাবলো তাকে। পরক্ষণেই ভাবলো এত ভাবার কি আছে বউ কিস করেছে পাশের বাড়ির খসেটি খালা তো দেয় নাই। ফারিশ নিজের আচরণে নিজেই অবাক। ফারিশ আবার লজ্জা পাওয়া শুরু করলো কবে!’ ফারিশ একটা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে টাওয়াল হাতে ওয়াশরুমে চলে গেল।’

রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে আজকের ব্রেকফাস্ট তৈরি করছে আদ্রিতা। রান্না প্রায় শেষ। আদ্রিতার গায়ে জড়ানো সবুজরঙা শাড়ি। শাড়িটা আদিব তাকে দিয়েছে। কাল রাতেই চাঁদনীকে নিয়ে কিনেছিল এটা। শাড়িটা ফারিশের রুমের আলমারির পাশেই ব্যাগের মধ্যে ছিল। কিন্তু আদ্রিতা দেখে নি। দেখেছে আজকে সকালে। শাড়ির উপর ব্যাগের মধ্যে ছোট্ট চিরকুটে লেখা ছিল,“ডাক্তার ভাবি এটা আপনার জন্য।”

চিরকুট পড়ে আদ্রিতা মিষ্টি হাসে তখন। তারপরই শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে চলে আসে নিচে। আদ্রিতা খাবার বেড়ে টেবিলের রাখলো। সেই মুহূর্তে সেখানে হাজির হলো আদিব। বললো,“ডাক্তার ভাবি এসব কি করছো? সকালের নাস্তা প্রায় সময় আমি বানাই।”

আদ্রিতা মিষ্টি হেঁসে বলে,“আজ থেকে আমি বানাবো। আর কিছুদিন পর আমি আর চাঁদনী।”

আদিন লাজুক হাসলো এতে। বললো,
“বিয়েটা কি করতেই হবে ডাক্তার ভাবি?”
“অবশ্যই। বিয়ে না করলে আমি আর চাঁদনী একসাথে থাকবো কেমন করে। তুমি বসো ভাইয়া আমি বাকি খাবার নিয়ে আসছি।”

আদিবও বলে,
“আচ্ছা ডাক্তার ভাবি।”

আদিব চেয়ারে বসলো। আদ্রিতা গেল রান্নাঘরের দিকে। এমন সময় সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসলো ফারিশ। গায়ে জড়ানো নেভিব্লু কালারের শার্ট, কালো প্যান্ট। আদিব ফারিশকে দেখেই হাসলো। ফারিশ এগিয়ে এসে বললো,“এভাবে হাসার কি আছে জীবনে লিপস্টিক দেখো নি।”

আদিব কোনোরকম বললো,“দেখেছি তো ভাই। তবে মেয়েদের ঠোঁটে। আপনার শরীরে পেতথমবার।”

ফারিশ বসতে বসতে বললো,“আমিও তোমার শরীরে পেতথমবার দেখার ব্যবস্থা করছি দাঁড়াও।”

কথা শুনে আদিবের কাশি উঠলো হঠাৎ।’

#চলবে….

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৪৫

হঠাৎই আদিবকে কাশতে দেখে হকচকিয়ে উঠলো আদ্রিতা। খাবারের বাটিটা টেবিলে রাখতে রাখতে বললো,“কি হলো ভাইয়া আপনি কাশছেন কেন?”

আদিব কিছু বলতে পারলো না। কাশতেই থাকলো।আদ্রিতা দ্রুত আদিবের হাতে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বললো,“পানি খান ভাইয়া?”

আদিব পানির গ্লাসটা নিলো। ঢকঢক করে পানি পান করে বললো,“শুকরিয়া ডাক্তার ভাবি।”

বিনিময়ে আদ্রিতা মৃদু হাসলো। ফারিশের নজর তখন আটকানো ছিল আদ্রিতার গায়ে জড়ানো সেই সবুজরঙা শাড়িটার দিকে। মুখের মৃদু সাজে আর কোমড়ে গুঁজে রাখা আঁচলের ভাজে যেন বউ বউ দেখাচ্ছে আদ্রিতাকে। ফারিশ দৃষ্টি সরালো। বেশি বেহায়া হচ্ছে নাকি তার চোখ। আদিব বুঝি খেয়াল করলো বিষয়টা। সে বললো,“ভাই চোখ সরানোর প্রয়োজন নেই আপনারই তো বউ।”

বিষম খেলো ফারিশ। চোখ গরম করে তাকালো আদিবের দিকে। আদিব হাসলো। দারুণ মিষ্টি দেখাচ্ছিল সেই হাসি। পুরোই তৃপ্তিময়। আদ্রিতা দুই ভাইয়ের ফিসফিস করে কথা বলার দৃশ্য দেখে বললো,“আমায় রেখে কি কথা হচ্ছে শুনি?”

আদিব কিছু বলার জন্য মুখ খুললেও ফারিশ কথা কেঁড়ে নিয়ে বলে উঠল,“আদিবের বউ লাগবে।”

আদিব অবাক হলো ফারিশের কথা শুনে। সে কখন বললো তার বউ লাগবে। অাদ্রিতা টেবিলে বসতে বসতে বললো,“আজই কাজী অফিস চলুন আমাদের মতো আদিব ভাইয়ার বিয়েটাও দিয়ে দেই। কি বলুন?”

আদিবের আবার কাশি উঠলো। আদ্রিতা হতভম্ব হয়ে চেয়ে। পুনরায় পানির গ্লাস এগিয়ে দিয়ে বললো,“কি হলো ভাইয়া আপনায় যক্ষা রোগে ধরলো নাকি এত কাশছেন কেন?”

ফারিশ হেঁসে উঠলো। মুখে স্যান্ডউইচ পুড়ে বললো,“ওসব যক্ষা টক্ষা কিছু না। আদিবের এই কাশিকে কি কাশি বলে জানো?”

আদ্রিতা বেশ আগ্রহ নিয়ে বললো,“কি কাশি?”
আদিব অসহায় মুখে ফারিশের পানে চেয়ে। ফারিশ বলে,“বউ কাশি।”

আদ্রিতা চোখ বড় বড় করে বললো,
“বউ কাশি আবার কি কাশি?”
“বউয়ের ভয়ে যে কাশি উঠে তাকে বলে বউ কাশি। আদিব বউ আসার ভয় পাচ্ছে তাই কাশছে। তাই আদিবের এই কাশিকে বলে বউ কাশি।”

ফারিশের কথা শুনে আচমকাই হেঁসে উঠলো আদ্রিতা। টেবিল কাঁপানো এক হাসি। আর আদিব লজ্জায় মিইয়ে যাচ্ছে পুরো। আদিব কোনোরকম ব্রেকফাস্ট করেই উঠে গেল। যেতে যেতে বললো,“ভাই আমি গাড়িতে আছি তুমি সময় নিয়ে এসো।”

ফারিশ উত্তরে শুধু বলে,“হুম।”
আদিব যেতেই আদ্রিতা বললো,“আপনি কাজটা ঠিক করেন নি?”

ফারিশ অবাক হয়ে বলে,
“কোন কাজটা?”
“এই যে বউকাশি আদিব ভাইয়া লজ্জায় না খেয়ে চলে গেছে।”
“ওসব কিছু না। ও আমাদের দু’জনকে একত্রে রাখার জন্য দ্রুত বেরিয়েছে।”

আদ্রিতা কিছু বললো না। চায়ের কাপে চুমুক দিলো। ফারিশ শীতল স্বরে শুধালো,
“এত সেজেছে কেন?”
“কেন আমায় ভালো লাগছে না।”

ফারিশের তড়িৎ উত্তর,“না।”
মনটা খারাপ হয়ে গেল আদ্রিতার। মাথা নুইয়ে ফেললো মুহূর্তেই। ফারিশ হেঁসে উঠলো। বললো,“কেউ অসুন্দর বললেই মানুষটা কিন্তু অসুন্দর হয়ে যায় না। কিছু অসুন্দর বলার মাঝেও দারুণ সুন্দরতা আছে। তুমি কি তা দেখতে পাও আমার সবুজরঙা বেলীপ্রিয়া।”

আদ্রিতা মুগ্ধ নয়নে তাকালো ফারিশের দিকে। মুখ ভাড় করে বললো,“তখন মিথ্যে বললেন কেন?”

ফারিশের মলিন চোখ। ঠোঁটে জড়ানো করুন হাসি। সে বলে,“মিথ্যে কখন বলেছি আমার না’য়ের মাঝেই হা’য়ের বসবাস। এখন তুমি ধরতে না পারলে আমি কি করতে পারি!”

আদ্রিতার বিস্মিত আঁখি। সে টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালো। বললো,
“আপনি একটা যাচ্ছে তাই লোক।”

ফারিশও উঠে দাঁড়ালো তখন। আদ্রিতা তার পানে চেয়ে। ফারিশ আদ্রিতার কাছাকাছি এসেই কোমড়ে গুঁজিয়ে রাখা শাড়ির আঁচলটা টান মেরে বের করলো। আদ্রিতা হতভম্ব হয়ে গেল ফারিশের এহেম কান্ডে। চোখ বন্ধ করে ফেললো মুহূর্তেই। ফারিশ তা দেখে মৃদু হাসলো। আদ্রিতার কানের কাছে ঠোঁটটা নিয়ে ফিসফিস করে বললো,“জানি তো। আমি সত্যি খুব বাজে লোক।”

আদ্রিতা চোখ খুললো। দৃষ্টি হলো এক। আদ্রিতা বলে,
“আমায় কিন্তু হসপিটাল যেতে হবে।”
“সে যাও, তবে আমি ডাকলেই আসতে হবে কিন্তু।”
“আমি কি আসতে বাধ্য নাকি?”
“ভুলে যেও না আমার বিয়ে করা বউ তুমি। বাধ্য তো বটেই।”

হেঁসে ফেলে আদ্রিতা। বলে,“বিয়ে করতে ভয় পাওয়া মানুষটা বউয়ের উপর অধিকার দেখাচ্ছে ব্যাপারটা কিন্তু ইন্টারেস্টিং।”

ফারিশের সঙ্গে সঙ্গে উত্তর,“তুমি হয়তো জানো না আমি মানুষটাও দারুণ ইন্টারেস্টিং।”

আদ্রিতা গলা জড়িয়ে ধরলো ফারিশের। আদুরে গলায় আওড়ালো,“আপনি মানুষটা তো আমারই। ধীরে ধীরে দেখবেন আপনার সবটা জেনে নিবো।”

কথাটা বলেই টুক করে গালে চুমু কাটলো ফারিশের। ফারিশ হতভম্ব হয়ে বললো,“এই তুমি ঠোঁটে লিপস্টিক লাগিয়ে আমায় চুমু খাবে না।”

আদ্রিতা বিস্ময়কর চাহনী নিয়ে বললো,
“কেন?”
“আমার একটা মানসম্মান আছে বুঝো না কেন?”
“স্বামীদের মানসম্মান থাকে না। এখন যান।”

আদ্রিতা ছেড়ে দিলো ফারিশকে। ফারিশ ছাড়লো না। নিজের গালটা আদ্রিতার গালে সাথে ঘষা দিয়ে বললো,“যে গালে বউ চুমু খায় সেই গাল নিয়ে হাসাহাসি মানায় না।”

ফারিশ চলে গেল। আদ্রিতা কিংকর্তব্যবিমুঢ় চাহনি নিয়ে দাঁড়িয়ে। ছেলেটা কি বলে গেল সব যেন মাথার উপর দিয়ে গেল। আদ্রিাতর ঠোঁটে তো লিপস্টিক ছিল না তবে ফারিশ মুছলোটা কি? আদ্রিতা বামহাতটা নিজের গালে লাগালো। তেল তেল লাগলো কিছু। আদ্রিতা চোখ গরম করে বললো,“অসভ্য লোক। খাবার খেয়ে মুখ মুছে নাই।”
—-
সে এক শুক্রবারের বিকেল। প্রকৃতি তার শীতের রেশ কাটিয়ে টগবগা গরম দিচ্ছে। আদ্রিতা আর ফারিশের বিয়ের কেটে গেল দু’দুটো মাস। আজ হসপিটাল বন্ধ আদ্রিতার। তাই ফারিশের রুমে বেলকনিতে চেয়ার পেতে হুমায়ুন আহমেদের লেখা ‘আজ আমি কোথাও যাবো না’ বইটি পড়ছে। আদ্রিতা তার অবসর সময়ে বই পড়তে পছন্দ করে। বাবার বাড়িতে তার ছোটখাটো একটা লাইব্রেরিও ছিল। ফারিশ আর আদ্রিতার বিয়ে উপলক্ষে কোনো বড়সড় অনুষ্ঠান করা গেল না। আদ্রিতার বাবা চেয়েছিলেন করতে কিন্তু আদ্রিতা বারণ করে। খুব অল্প মানুষের ভিড়ে নিজ বাড়িতে ছোটখাটো ভরপুর খাওয়া দাওয়ার আয়োজন করা হয় শুধু। সেখানে আদ্রিতার বাবার অল্প কিছু কলিগরা, আদ্রিতার বন্ধুবান্ধব আর তাদের আত্মীয়স্বজনরা থাকে। আদ্রিতার ফুপু খালারা খানিকটা রাগ করেছিল বটে। এভাবে কাউকে কিছু না জানিয়ে ধাপ করে মেয়ের বিয়ে দেয়ার জন্য। আদ্রিতার বাবামায়ের উপর ক্ষিপ্ত ছিল দারুণ। তবে রাগ বেশি রাখা গেল না। খাওয়াদাওয়ার মাঝেই চুকিয়ে গেল সবটা।’

বাড়ির কলিংবেল বাজলো হঠাৎ। আদ্রিতা হকচকিয়ে উঠলো তাতে। এই সময় কে আসলো। ফারিশ আসে তো সেই রাতে। আদ্রিতা বই রেখে উঠে দাঁড়ালো। চলে গেল নিচে। দরজা খুলতেই দেখলো পুলিশ অফিসার কিশোর এসেছে। আদ্রিতা তাকে দেখে অবাক হয়ে বললো,“আপনি এখানে?”

কিশোর একগাল হেঁসে বললো,“কেমন আছেন ডাক্তার সাহেবা?”

আদ্রিতা বিরক্ত হলেও। মুখে বিনয়ের হাসি রেখে বললো,
“ভালো। আপনি?”
“আমিও ভালো।”

কিশোর ভিতরে ঢুকলো। বললো,“চা খেতে এলাম। ফারিশ সাহেব বাড়ি আছেন?”

আদ্রিতা বললো,
“না।”
“ঠিক আছে। আপনি চা বানিয়ে আনুন আমি বসছি।”

কিশোর সোফায় বসলো। আদ্রিতা বিস্মিত হয়ে চলে গেল রান্নাঘরের দিকে। এভাবে হুট করে কিশোরের চা খেতে আসাটা কতটা যুক্তিযুক্ত ধরতে পারছে না আদ্রিতা।’

ফারিশ আসলো তার কিছুসময় পরে। কিশোরকে দেখে সে কিছু বললো না। আদ্রিতা তখন রান্নাঘর থেকে কিশোরের জন্য চা বানিয়ে আনছিল। ফারিশকে দেখে বুকটা কেঁপে উঠলো হঠাৎ। কোনোরকম বললো,“আপনি চলে এসেছেন?”

ফারিশ স্মিথ হেসে বললো,
“হুম।”

আদ্রিতা কিশোরের হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিয়ে ফারিশকে বললো,
“আচ্ছা আপনি বসুন আমি আপনার জন্য চা নিয়ে আসছি।”

ফারিশ সঙ্গে সঙ্গে নাকচ করলো তাতে। বললো,“চা খাবো না। কফি খাবো।’

আদ্রিতা বিনাবাক্যে তাই বানাতে গেল। আদ্রিতা যেতেই কিশোরের মুখোমুখি বসলো ফারিশ। বললো,“কেমন আছেন অফিসার সাহেব?”

কিশোর চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে বললো,
“ভালো। আরশাদকে ধরতে পেরেছি।”
“আমার সাহায্য নিলে আরো আগেই ধরতে পারতেন।”
“হয়তো পারতাম। তবুও নিজে খুঁজেছি ভাবলে গর্ববোধ হয়।”

ফারিশ সে কথার জবাব না দিয়ে বললো,
“কোথায় পেলেন?”
“কুমিল্লায়। পরিত্যাক্ত এক জমিদার বাড়িতে লুকিয়ে ছিল।”
“ওহ আচ্ছা।”
“জি।”
“এই খবর জানানোর জন্যই কি বাড়িতে এলেন?”
“যদি বলি আপনার বাড়িটা সার্চ করতে?”

ফারিশ ঘাবড়ায় না মোটেও। বলে,“করতেই পারেন। কিন্তু কারণ ছাড়া সার্চ করাটা আধও কি যুক্তিযুক্ত অফিসার সাহেব।”

কিশোর চর্তুথ বারের মতো চায়ের কাপে চুমুক দিলো তখন। একগাল হেঁসে বললো,“মজা করছিলাম। আপনার বউ কিন্তু চা টা দারুণ বানায়।”

ফারিশ কিছু বলে না। আদ্রিতা এগিয়ে আসে তখন। হাতে কফির কাপ। আদ্রিতা ফারিশের হাতে কফির কাপটা এগিয়ে দিয়ে বললো,“ধরুন।”

ফারিশ নিলো। এর পরপরই কিশোর উঠে দাঁড়ালো। বললো,“ঠিক আছে আজ তবে আসি। পরে আবার দেখা হবে।”

ফারিশ কফির কাপে চুমুক দিয়ে বলে,“এখনই চলে যাবেন আর একটু বসতেন।”

কিশোর আদ্রিতার দিকে একপলক চেয়ে বললো,“আজ থাক। অন্যআরেক দিন বসবো।”

কিশোর চলে গেল। আদ্রিতা বিমুঢ় তার পানে চেয়ে। সে ধরতে পারলো না কিশোর আচমকা এসে চলে গেল কেন! ফারিশ তার কফিটা শেষ করলো। মিষ্টি করে বললো,“আদ্রি শোনো?”

আদ্রিতা গেল। বিয়ের পর থেকে ফারিশ আদ্রিতাকে ছোট করে ‘আদ্রি’ ডাকে। আদ্রিতা ফারিশের সামনের টি-টেবিলটার উপরে বসলো। ফারিশ কিছু বলার আগেই আদ্রিতা বলে উঠল,“আমি কিন্তু ওনায় ডাকি নি।”

ফারিশ হেঁসে বলে,“জানি আমি।”
ফারিশ হাত বারিয়ে আদ্রিতা কাছে ডাকলো। আদ্রিতা গেল। তবে খানিকটা সংকোচ নিয়ে বললো,
“দরজা খোলা তো?”
“কিছু হবে না তুমি আসো।”

আদ্রিতা কোলে বসলো ফারিশের। বুকে জড়িয়ে ধরলো তাকে। বললো,“কিছু কি হয়েছে?”

ফারিশ উত্তর দিলো সঙ্গে সঙ্গে,
“কি হবে? আমার তুমি থাকলে কিছু হয় নাকি।”
“আপনায় বড্ড বিষণ্ণ দেখাচ্ছে।”
“ওসব কিছু না।”
“আপনি হয়তো ভুলে যাচ্ছেন আপনি যখন দারুণ বিষণ্ণে তখনই এইভাবে জড়িয়ে ধরেন আমায়।”

ফারিশের উত্তর আসে না আর। আদ্রিতা প্রসঙ্গ পাল্টে বলে,
“আদিব ভাইয়া এলো না। কোথায় সে?”

ফারিশ এবার উত্তর দেয়। বলে,
“চাঁদনীর সাথে লুকোচুরি খেলছে।”

হেঁসে ফেলে আদ্রিতা। আজ থেকে ঠিক পনের দিন আগে বিয়ে হয় আদিব আর চাঁদনীর। ফারিশদের মতোই কোনো ঝাকঝমক ছাড়াই কাজী অফিসে বিয়ে দেয়া হয় তাদের। সে আদিবের কি ঘাবড়ানো। চাঁদনী কবুল বলতে সময় না নিলেও আদিব পাক্কা পনের মিনিট সময় নিয়েছে কবুল বলতে। আরো সময় নিতো তবে ফারিশের চোদ্দ মিনিটের ধমকের পর ফটাফট বলে ওঠে কবুল, কবুল, কবুল। তিন কবুল। আদিবের কান্ডে সেদিন হাসে সবাই। ফারিশও হাসে তবে সবার আড়ালে। উল্টোদিক ঘুরে। এখন এই বাড়িতে তারা চারজন থাকে। আদিব-চাঁদনী, ফারিশ আর আদ্রিতা। আদ্রিতা এবার বুঝলো এই জন্যই বুঝি একঘন্টা আগে চাঁদনী কাজের বাহানা দেখিয়ে বেরিয়ে গেল। ফিরুক! আচ্ছা করে দেবে এক ঘা। বলে গেলে কি হতো?– আদ্রিতা সে নিয়ে ভাবলো না আর।’

ফারিশ আদ্রিতা অনেকক্ষণ চুপ থাকলো। হঠাৎ আদ্রিতা প্রশ্ন করে,
“কাজে যাবেন না?”

প্রশ্ন শুনে ফারিশের হাতের বাঁধন হয় শক্ত। শরীরের সমস্ত ভাড় লুটিয়ে পড়ে আদ্রিতার ঘাড়ে। সে চোখ বন্ধ করে শীতল স্বরে শুধায়,“আজ আমি কোথাও যাবো না।”

আদ্রিতা আচমকা চমকায়। কথাটা করুন লাগলো তার।’

#চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে