এক পশলা ঝুম বর্ষায় পর্ব-৪০+৪১

0
464

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৪০

নিকষকালো আঁধারে ভরপুর চারপাশ। গাছের পাতা নড়ছে মৃদু। ফারিশ দাঁড়িয়ে চুপচাপ। দৃষ্টি তার আদ্রিতার নুইয়ে রাখা মুখশ্রীর দিকে। সে কি এগিয়ে যাবে? নাকি আদ্রিতা এগিয়ে আসবে। ফারিশ গেল না। ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। আদ্রিতা মাথা তুলে চাইলো। ফারিশের আঁখিদ্বয় তখনও আদ্রিতাতেই নিবদ্ধ। আদ্রিতাই এগিয়ে আসতে লাগলো। ফারিশ চেয়ে চেয়ে দেখলো শুধু।’

আদিব দাঁড়ানো একটু দূরে। তার মনে হচ্ছে এই মুহূর্তে এখানে দাঁড়ানোটা ঠিক হবে না। কিন্তু কোনদিক যাবে বুঝতে পারছে না। সবদিকেই জোনাকরাতের অন্ধকার। আদিবের ভয় লাগছে। আদিব ট্রাকের সামনের ঢাকার পাশ দিয়ে নিচে বসলো। পকেট থেকে মোবাইল আর ইয়ারফুন বের করলো। আদিব সবসময় তার পকেটে ইয়ারফুন রাখে। যদি কখনো সখনো লেগে বসে। আদিব ইয়ারফুন কানে গুঁজলো। আয়াতুল কুরসি অন করে চোখ বন্ধ শুনতে লাগলো তা। আর কোনো প্যারা নাই। এমন ভুতুড়ে পরিবেশ এবার আদিব তুড়ি মেরে পার করে দিতে পারবে।’

আদ্রিতা এগিয়ে এসে ফারিশের মুখোমুখি দাঁড়ালো। মাথা নোয়ানো। তার প্রথম প্রশ্ন,“আপনার কোথাও লাগে নি তো?”

ফারিশ মৃদু হাসে। মলিন মুখে আওড়ায়,“লেগেছে তো?”
আদ্রিতা চোখ তুলে চাইলো তখন। চিন্তিত কণ্ঠে বললো,“কোথায় লেগেছে?”

ফারিশ তার বুকের বা’পাশটা দেখিয়ে বললো,“এইখানে।”

আদ্রিতা ফারিশের কথার অর্থ বুঝতে পেরে বললো,“আমায় কি একটিবার ক্ষমা করা যায় না ফারিশ?”

ফারিশের তড়িৎ উত্তর,“না।”
আদ্রিতা ছলছল নয়নে তাকায় ফারিশের দিকে। লোকটা এত বেশি পাষাণ কেন। আদ্রিতা আচমকাই জড়িয়ে ধরে ফারিশকে। ফারিশ ঘাবড়ায় না। আদ্রিতাকেও ধরে না। শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আদ্রিতা তখন ফারিশের গলা জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বলে ওঠে,“আমায় ক্ষমা করে দিন না ফারিশ। বিশ্বাস করুন আমি আপনায় সত্যি ভালোবাসি। আমি মানছি আমি ভুল করেছি। মানুষ মাত্রই তো ভুল হয় বলুন। ওই পুলিশ অফিসার আমায় ইমোশনালি ব্ল্যাকমেল করে কাজটা করতে বলেছিল। আমি হাজারবার বারণ করা শর্তেও শুনতে চায় নি। আমি আপনাকে প্রথম থেকেই পছন্দ করতাম। সেই যে এক পশলা ঝুম বর্ষায় আহত অবস্থায় আমার হসপিটাল এসেছিলেন তখন থেকেই। আপনার কথার বলার স্টাইল, এটিটিউড সব আমার ভালো লেগেছিল প্রথম দিনই। কিন্তু ওইদিন আমি আতঙ্কিত হয়ে যাই। আপনার ছুরি ধরার বিষয়টা আমায় এলেমেলো করায়। এরপর আমাদের নানা ভাবে দেখা হয়। আপনি আমায় তুলে নিয়ে যান। কক্সবাজারের আপনার সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত আমি মন থেকে অনুভব করি বিশ্বাস করুন। আমি জানতাম আমি আপনার সাথে অভিনয় করছি কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি আপনার সাথে বিন্দুমাত্র অভিনয় করি নি। যা করেছি মন থেকে। আমাকে ক্ষমা করে দিন না ফারিশ। আমি আপনায় বিয়ে করতে চাই। একসাথে সারাজীবন বাঁচতে চাই। আমি আর কোনোদিন আপনায় ঠকাবো না। আপনায় ঠকিয়ে আমি ভালো ছিলাম না ফারিশ। আমি ঠুকরে ঠুকরে মরেছি এই কয়দিন। আমি তো ভেবেছিলাম আপনার সাথে বোধহয় আমার আর দেখা হবে না। কিন্তু হলো। আমায় একটি বার ক্ষমা করুন। আমি আর কোনোদিন আপনায় ঠকাবো না। প্লিজ ফারিশ এবারের মতো ক্ষমা করুন।”

আদ্রিতার আর্তনাদ ভরা কণ্ঠ। চোখে মেশানো জলস্রোত। ফারিশ কিছু বলে না। পাথরের ন্যায় দাঁড়িয়ে থাকে চুপচাপ। আদ্রিতার কান্না থামে না। সে ফারিশের গলা ছেড়ে শার্ট চেপে ধরে কাঁদে। কাঁদতে কাঁদতে তার হেঁচকি উঠে যায়। এবার বুঝি পাষাণ ফারিশের মন গললো। দু’হাতে জড়িয়ে ধরলো আদ্রিতাকে। আদ্রিতা তা অনুভব করে বলোল,“আমায় ক্ষমা করে দিয়েছেন ফারিশ?আর ঘৃণা নেই তো মনে।”

ফারিশ এক সেকেন্ড, দু’সেকেণ্ড, তিন সেকেন্ড চুপ থেকে শীতল স্বরে শুধায়,
“আপনি কি জানেন ডাক্তার ম্যাডাম? যাকে ভালোবাসা যায়। তাকে ঘৃণা করা যায় না। আমি ঘৃণা করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু পরিশেষে দারুণ ব্যর্থ হয়েছি।”

আদ্রিতা খুশি হলো। তার নয়ন জোড়া খুশিতে খিলখিলিয়ে উঠলো। সে আর একটু শক্ত বাঁধনে জড়িয়ে ধরলো ফারিশকে। ফারিশ অনুভব করলো। আজ আদ্রিতা বুঝি পুরোপুরি তার সাথে মিশে যেতে চাইছে। ফারিশ হেঁসে বলে,“আবারও প্রেমআলাপের গল্প কি শুরু হবে?”

আদ্রিতা বলে,“কেন নয়!’
হঠাৎ ফারিশের মনে হলো তার সব বলে দেয়া উচিত। ফারিশ বলে,“আমায় আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরুন না ডাক্তার ম্যাডাম। আমি আপনায় কিছু বলবো। কথাগুলো শোনার পর যদি আপনি আমায় ছাড়েন তবে আপনার মুক্তি চিরতরে মুক্তি। আর যদি না ছাড়েন তবে…

পরেরটা আর বললো না ফারিশ। থেমে গেল। আদ্রিতা বললো,
“তবে কি?”
“না ছাড়ার তবেটা আজ থাকুক পরে বলবো।”
“যা বলবেন তা খুব কঠিন।”
“কঠিন কি না জানি না। তবে জটিল দারুণ।”
“আপনি বলুন আমি শুনছি।”

আদ্রিতা ফারিশকে শক্ত করে ধরে। একটা মানুষকে জড়িয়ে ধরার অনুভূতিটা আজ যেন গভীরভাবে আঁকড়ে ধরেছে আদ্রিতাকে। ফারিশ নিশ্বাস ফেলে বলে ওঠে,“আমি সত্যিই মাফিয়া আদ্রিতা। দেশ বিরোধী মাফিয়া।”

আদ্রিতা কথাটার গুরুত্ব দেয় না। বলে,
“মজা করছেন?”
ফারিশের তড়িৎ উত্তর,“না সত্যি বলছি। সেদিনও আমি এই কথাই বলতে নিয়েছিলাম। আমি সত্যিই মাফিয়া। সেদিন রাতের এক পশলা ঝুম বর্ষায় হসপিটালে ঢুকে পড়া মাফিয়াটি আমিই ছিলাম। কিশোর আমার সম্পর্কে আপনায় যা বলেছে তা সব সত্য। আমি একজন মাদকব্যবসায়ী। এছাড়াও আমার অনেকগুলো বেআইনি কারবার আছে। আপনায় আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম না সেদিন আপনি পপি গাছের নাম শুনেছেন কিনা। যার ইংরেজি নাম হলো Papaver somniferum যা দিয়ে আফিম তৈরি হয় এছাড়াও এ থেকে মরফিন পাওয়া যায়। আমার দেশের কিছু জায়গায় পপি গাছ আছে। সেই গাছের দু প্রজাতি দিয়ে আমি আফিম আর মরফিন পাই। যার একটা দিয়ে নেশাদ্রব্য তৈরি হয় আর একটা দিয়ে ঔষধ। দেশের মানুষ আমাকে একজন ঔষধ কোম্পানির মালিক জানলেও। আমি ঔষধের পাশাপাশি মরণব্যাধিও তৈরি করি। যাকে বলে একহাতে মানুষ বাঁচাই আরেক হাতে মারি। আমি ভালো মানুষ নই। এবার আপনি চাইলে এই কথা কিশোরকে বলে দিতে পারেন। আমি কিছু মনে করবো না।”

কথাগুলো বলে থেমে গেল ফারিশ। কতকাল আর এ কথা লুকিয়ে রাখবে। মিথ্যে দিয়ে জীবন শুরু করলে কখনোই জীবন সুন্দর হয় না। তার চেয়ে বিষাদ ভালো। ফারিশ কিছুসময় পর বুঝতে পারলো এতকিছু শোনার পরও আদ্রিতা তাকে ছেড়ে দেয় নি। জড়িয়ে ধরে দাঁড়িয়ে আছে। ফারিশ বললো,“আদ্রিতা।”

আদ্রিতা সঙ্গে সঙ্গেই বললো,“হুস। চুপ থাকুন। আর কিছু শুনতে ইচ্ছে করছে না। যা এতবছর লুকিয়ে রেখেছেন আজ থেকেও লুকিয়ে রাখুন। আমিও না হয় ভালোবাসার জন্য একটু স্বার্থপর হলাম। আমি কোনো মাফিয়া সাহেবকে চিনি না। আমি চিনি আমার মিস্টার বখাটেকে। যে কিনা একজন ঔষধ কোম্পানির মালিক।”

সময় চলতে থাকে। দুজনেই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। ফারিশ আদ্রিতার কথার পিঠে আর কিছু বলতেই পারলো না। বেশ কিছু সময় পর আদ্রিতা ফারিশকে ছাড়ে। ফারিশ তাকায় আদ্রিতার দিকে। বলে,
“একটুও ভাবলেন না?”
“আপনার বউ হবো এত ভেবে আমার কি কাজ! চলুন আমায় বাড়ি পৌঁছে দিবেন।”

ফারিশ কথা না বলে আদ্রিতার দিকে তাকিয়ে থেকেই এগিয়ে চলে। হঠাৎই ফারিশের মনে পড়ে তার সাথে আদিবও ছিল। ফারিশ আদ্রিতার থেকে নিজের হাতটা ছাড়ালো। বললো,“এক সেকেন্ড।”

আদ্রিতা শুনলো। ফারিশ আশেপাশে তাকিয়ে ডাক দিলো,“আদিব।”

আদিবের সাড়াশব্দ নেই। ফারিশ আতঙ্কিত হলো আবার। সে উচ্চ শব্দে ডাকলো,“আদিব কোথায় তুমি?আদিব। আমি তোমায় ডাকছি আদিব।”

আদিবের এবারও সাড়াশব্দ পাওয়া গেল না। কারণ সে যে কানে ইয়ারফুন গুঁজে আয়াতুল কুরসি শুনতে শুনতেই ঘুমিয়ে পড়েছে রাস্তায়।’

ফারিশ আরো দু’তিনবার ডাকতে ডাকতে ট্রাকের চাকার কাছে এসে ঠেকলো। আদিব বাচ্চাদের মতো ট্রাকের সাথে পিঠ ঠেকিয়ে ঘুমিয়ে আছে। ফারিশ হাঁপ ছেড়ে বাঁচলো। এই ছেলেটা আর বড় হলো না। আদ্রিতা এগিয়ে আসলো তখন। হতভম্ব গলায় বললো,“আদিব ভাইয়াকে পেয়েছেন ফারিশ?”

ফারিশ হেঁসে বলে,“হুম।”
ফারিশ তার মোবাইলের ফ্যাশ লাইট অন করে মুখে ধরলো আদিবের। বললো,“আদিব ওঠো বাড়ি যাবে না, আদিব।”

দু’বার ডাকতেই আদিব উঠে গেল। কান থেকে ইয়ারফুন খসে পড়লো নিচে। আদিব বললো,“আপনাদের হয়ে গেছে ভাই।”

ফারিশ বলে,“হয়েছে পাগল। চলো এখন বাড়ি যাই।”
আদিব উঠে দাঁড়ায়। বলে,“চলুন ভাই এই ট্রাকে করেই যাই। আপনি আর ডাক্তার ভাবি ট্রাকের পিছনে বসুন। আমি ট্রাক চালিয়ে নিয়ে যাই।”

ফারিশ সঙ্গে সঙ্গে নাকচ করলো। বাম হাতে আদিবের কাঁধ চেপে সামনে হাঁটতে হাঁটতে বললো,“কিসব বলছো আদিব? তোমার মাথা ঠিক আছে।”

আদিব অবাক হয়ে বলে,“খারাপ কি বললাম ভাই?”
ফারিশের ডানপাশেই হাঁটছিল আদ্রিতা। তার বাম হাতটা মুঠোতে ছিল ফারিশের। ফারিশ বলে,“তুমি বুঝো না কেন আদিব, বিয়ের আগে নো বদ্ধঘর।”

ফারিশের কথা শুনে হেঁসে ফেলে আদ্রিতা। আদিব বলে,“আপনিও না ভাই।”

ফারিশ হাসে। রাতটা তখন প্রায় শেষ প্রহরের দিকে। ছিমছাম রাস্তায় হাঁটছে আদিব,ফারিশ আর আদ্রিতা। আদ্রিতা ফারিশের কথা শুনে মুখে কিছু বলতে না পারলেও মনে মনে ঠিকই আওড়ায়,“লোকটা আসলেই একটা বজ্জাত। চরম লেভেলের বজ্জাত।”

#চলবে….

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৪১

রাতের আঁধার ছাড়িয়ে তখন দিনের আলো ফুটলো কেবল। আদিব গাড়ির পিছন সিটে বসে ঘুমে কাত। আদ্রিতাও ঘুমাচ্ছে জানালার পাশে মাথা ঠেকিয়ে। ফারিশ জেগে। চুপচাপ বসে বসে গাড়ি ড্রাইভ করছে। ফারিশের বর্তমান অনুভূতি কেমন তা বোঝা যাচ্ছে না। তবে ফারিশের মাথায় ঘুরছে আরশাদ। কিশোর আজকের মধ্যে ধরতে না পারলে এই কাজটা ফারিশই করবে। ফারিশ তার লোক লাগিয়ে দিয়েছে। আরশাদকে খোঁজা হচ্ছে। আশা রাখে খুব শীঘ্রই আরশাদকে ধরতে সে সক্ষম হবে। আরশাদের সাথে ফারিশের পরিচয় খুব অল্প সময়ে। তারা ঔষধের কেনা বেচা নিয়ে পার্টনারশিপে ব্যবসা করত। ফারিশ যে আলাদাভাবে মাদক ব্যবসায়ী এ সম্পর্কে আরশাদ অবগত ছিল না। কিন্তু আরশাদ সম্পর্কে ফারিশের সব জানা ছিল। পার্টনারশিপের দশদিনের মাথাতেই ফারিশ জেনে যায় আরশাদের আলাদাভাবে মেয়ে পাচার করার কাজ করছে। যা ফারিশের পছন্দ হয় নি। মেয়ে মানুষ নিয়ে ব্যবসা করা ফারিশের পছন্দ নয়। তাই ফারিশ পুলিশের নিকট আরশাদকে ধরিয়ে দেয়। তার পনের বছরের জেলবন্দীর সাজা দেয়া হয়। কিন্তু দু’বছরের মধ্যেই আরশাদ জেল থেকে পালায়। আদ্রিতা সম্পর্কে আরশাদ কতটুকু অবগত বা আধও অবগত কি না এ সম্পর্কে ফারিশ তেমন কিছু জানে না। তবুও কোথাও গিয়ে সংশয় যদি জেনে থাকে।’

আদ্রিতার ঘুম ভাঙলো হঠাৎ। সে দ্বিধাহীন ফারিশের বুকে মাথা রাখলো। ফারিশ কিছুটা চমকে উঠলো এতে। নিজের ভাবনা গুলো ভুলে গেল মুহূর্তেই। ফারিশ নিজেকে সামলালো। আদ্রিতা ফারিশের গলা জড়িয়ে ধরে মিষ্টি হেঁসে বললো,“শুভ সকাল মিস্টার বখাটে।”

ফারিশ আদ্রিতার পানে না তাকিয়েই বললো,“আপনায় কতবার বলবো আমি বখাটে নই।”

হাসে আদ্রিতা। বলে,“জানি তো। তাও আপনাকে বখাটে ডাকতে আমার ভালো লাগে।”

ফারিশ এ কথার আর জবাব দিলো না। আদ্রিতা কিছু সময় চুপ থেকে বলে,“আজ আমার বন্ধু মৃদুলের বৌভাত আপনি কি যাবেন ফারিশ?”

ফারিশের দ্বিধাহীন জবাব,“কি পরিচয়ে যাবো?”
আদ্রিতা অবাক হয়ে বললো,“কেন আমার বয়ফ্রেন্ডের পরিচয়ে।”

ফারিশ নাকচ করলো তাতে। বললো,“না আমার কাজ আছে। আপনি ঘুরে আসুন।”

আদ্রিতা খানিকটা বিরক্ত নিয়ে বললো,
“আপনি কি আমায় তুমি করে বলতে পারেন না ফারিশ?”
“আপনিটাতেই কেমন যেন আমি সস্থি পাই।”
“কিন্তু আমার অসস্থি লাগে।”

চোখ মুখ কুঁচকে বললো আদ্রিতা। ফারিশ হাসলো। বললো,“বিয়ে হোক বলবো?”

আদ্রিতা খুশি মুখে বললো,“সত্যি বলবেন।”
ফারিশ এক ঝলক আদ্রিতাকে দেখলো। পরক্ষণেই দৃষ্টি সরিয়ে বললো,
“হুম।”
“বিয়ে কবে করবেন ফারিশ? চলুন আজই করে ফেলি।”

ফারিশ নিরুত্তর। আদ্রিতা বিচলিত হয়ে বললো,“করবেন বিয়ে চলুন আজই করে ফেলি।”

ফারিশ এবারও উত্তর দিল না। আদ্রিতা এবারও উত্তর না পেয়ে পাল্টা কিছু জিজ্ঞেস করলো না। নীরবতা চললো বেশ কতক্ষণ। ফারিশ গাড়ি থামালো হঠাৎ। আদিব একটু নড়ে চড়ে উঠে। পরক্ষণেই আয়েশ করে শুয়ে পড়লো গাড়ির সিটে। গভীর ঘুম পেয়েছে তার। আদ্রিতা তার মাথাটা ফারিশের নিকট থেকে উঠালো। সোজা হয়ে বসে বললো,“গাড়ি থামালেন যে?”

ফারিশ আদ্রিতার চোখের দিকে তাকিয়ে শীতল স্বরে শুধায়,“আপনার আচরণ আমার কাছে ঠিক লাগছে না ডাক্তার ম্যাডাম?”

আদ্রিতা বিষম খেয়ে বল,“মানে?”
ফারিশের তড়িৎ উত্তর,“আমি একজন মাফিয়া আদ্রিতা।”
আদ্রিতার ভাবনাহীন উত্তর,
“তো।”
“আপনি আমার সাথে সত্যি থাকতে চান? বিয়ে করতে চান?”

আদ্রিতা তক্ষৎণাৎ উত্তর,
“হুম।”

ফারিশ আবার বলে উঠে,“ধোঁকা দেয়ার চেষ্টা চালাচ্ছেন নাকি ডাক্তার ম্যাডাম?”

আদ্রিতার মুখটা মলিন হয়ে গেল। ফারিশ তা দেখে হাসলো। বললো,“আরে মজা করছিলাম চলুন।”

এই বলে ফারিশ আবার গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ছুটলো দূরে। গাড়ি এসে সোজা থামলো আদ্রিতাদের বাড়ির সম্মুখে। আদ্রিতা গাড়ি থেকে নামলো না। চুপটি করে বসে রইলো। ফারিশ বললো,“কি হলো যান?”

আদ্রিতা গেল না। তাও বসে রইলো। ফারিশ তার কপাল চুলকে বলে,“কি হয়েছে? রাগ করেছেন?”

আদ্রিতা জবাব দেয় না। ফারিশ আদ্রিতার দু’কাধ চেপে ধরে বলে,“আমি মজা করছিলাম।”

আদ্রিতা মলিন মুখে তাকালো ফারিশের দিকে। চোখ ভিজে এসেছে তার। আদ্রিতা বলে,“কি করলে বুঝবেন আমি ধোঁকা দিবো না?”

ফারিশ হাসলো। আদ্রিতার চোখের পানিটুকু নিজ হাতে মুছে দিয়ে মজার ছলে বললো,“বিকেলেই বিয়েটা করলে। এখন নামুন আপনার বাবা মা আপনার অপেক্ষা করছে। দুশ্চিন্তা করছে নিশ্চয়ই। তাড়াতাড়ি যান।”

আদ্রিতা নেমে পড়লো। গাড়ির দরজা আঁটকে জানালা দিয়ে তাকিয়ে বললো,“সাবধানে যাবেন।”

ফারিশ মাথা নাড়িয়ে বলে,“নিশ্চয়ই।”
অতঃপর ফারিশ চলে যায়। আদ্রিতাও জোরে দম ফেলে ছুটে চলে গেল বাড়ির ভিতর। ঘরে ঢুকতেই তার মা এসে বুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো। আদ্রিতা চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিল শুধু। মনে মনে কি যেন ভাবে?”
—-
মৃদুলের বউভাত শেষের পথে। নয়নতারা আর আশরাফকে বেশ সাথে সাথে দেখা যাচ্ছে দুপুর থেকে। বেলা তখন প্রায় চারটা। আদ্রিতা ভাড়ি লেহেঙ্গা পড়ে নিজেকে সাজিয়েছে খুব। বড় কমিউনিটি সেন্টারে মৃদুলের বৌভাতের অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়ে ছিল।’

আদ্রিতা সবাইকে একত্রে ডাকলো। এখন তারা বাড়ি ফেরার মেজাজে ছিল। আদ্রিতার ডাকে সবাই একজোট হলো। মৃদুল বললো,“কি হইছে কি কবি তুই?”

আদ্রিতা সবার দিকে একঝলক তাকিয়ে তড়িৎ বলে,“আমি বিয়ে করবো আজ আর এক্ষুণি।”

সঙ্গে সঙ্গে সবাই যেন বিষম খেল। রনি মাত্রই তার কোকের বোতলে এক চুমুক দিয়েছিল। সেটাও হজম করতে না পেরে কলকলিয়ে ফেলে দিল। চাঁদনী বললো,“মজা করছিস আদু?”

আদ্রিতা চোখে মুখে সিরিয়াস দৃষ্টি ভঙ্গি এঁটে বলে,“না আমি সিরিয়াস।”

আশরাফ আদ্রিতার দিকে এগিয়ে গেল। শান্ত গলায় আওড়ালো,
“ছেলেটা কে?”
“ফারিশ মাহমুদ।”

এবার যেন আরো শকড হলো সবাই। মুনমুন বললো,“ফারিশ ওই যে ঔষধ কোম্পানির মালিক।”

আদ্রিতার দ্বিধাহীন উত্তর,“হুম।”
——
শেষ বিকেলের রোদটুকু বিছানায় চুইয়ে ফারিশের গায়ে ঠেকছে। গায়ে তার পাতলা কাঁথা জড়ানো। জানুয়ারির শীতটা খুব একটা গায়ে লাগে না তখন। ফারিশ ঘুমোচ্ছে। বাড়ি এসেই গোসল সেরে ন’টার দিকে সে ঘুম দেয়। যেই ঘুম এখনো ভাঙে নি। গত কয়েকদিনের না হওয়া ঘুমগুলো যেন আজ একদিনেই পূরণ করছে ফারিশ। আদিব রুমে ঢুকে তখন। পরে আবার বেরিয়ে যায়। এর কিছুক্ষণ পর ভাড়ি লেহেঙ্গা গায়ে জড়িয়ে আদ্রিতা আসে। ফারিশকে ঘুমিয়ে থাকতে দেখে মৃদু হেঁসে গিয়ে পাশে বসে। কপালে হাত ছুঁইয়ে বলে,
“মিস্টার বখাটে উঠুন।”

ফারিশ এক চুলও নড়লো না। আদ্রিতা এবার আর একটু উচ্চ শব্দে বললো,“ফারিশ শুনছেন,

এবার খানিকটা নড়লো ফারিশ। ঘুম ঘুম কণ্ঠে বললো,“উফ। ডাকছো কেন? দেখছো না আমি ঘুমোচ্ছি।”

আদ্রিতা মিষ্টি হাসে। বলে,“এখন উঠুন পরে ঘুমাবেন।”

ফারিশ স্বপ্ন দেখছে আদ্রিতা নতুন বউয়ের মতো লাল টুকটুকে শাড়ি পড়ে তাকে ডাকছে। ফারিশ ঘুমের ঘোরে আদ্রিতার হাতটা জড়িয়ে ধরে বললো,”এত সেজেছো কেন তোমায় যে পুরো বউ বউ লাগছে।”

বাস্তবিক আদ্রিতা তা শুনে হেঁসে উঠলো। সে বুঝলো ফারিশ স্বপ্ন দেখছে। আদ্রিতা খানিকটা ঝুকলো ফারিশের দিকে। কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে ফিস ফিস করে বললো,“ফারিশ উঠুন বিয়ে না করলে বউ বউ লাগবে কেমন করে?”

তড়িৎ ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো ফারিশ। ঘুম ভেঙে গেল তার। চোখ মেলেই আদ্রিতাকে মুখোমুখি আর ভাড়ি লাল টুকটুকে লেহেঙ্গা পড়নে দেখে অবাক স্বরে বললো,“আপনি এখানে কি করছেন ডাক্তার ম্যাডাম?”

আদ্রিতা আয়েশ করে বসে বললো,“কি আর করবো? বিয়ে করবো উঠুন।”

ফারিশের মুখভঙ্গি পাল্টে গেল হঠাৎ। বিস্মিত স্বরে আওড়ালো সে,“কি বলছেন? পাগল হলেন নাকি।”

আদ্রিতার বিরক্ত লাগলো এবার চোখ মুখ কুঁচকে বললো,“পাগল হওয়ার কি আছে বিয়ে করবো বলেছি।”

ফারিশ শোয়া থেকে উঠে বসলো। চোখ মুখ ঢলতে ঢলতে হাই তুলে বললো,
“মজা করছেন?”
“আশ্চর্য মজা করবো কেন? ফ্রেশ হন আমরা কাজি অফিস যাবো।”

আদ্রিতার কথাগুলো এবার যেন সত্যিই সত্যিই লাগছে ফারিশের। সে প্রশ্ন করলো,
“সত্যিই কাজি অফিস যাবো?”

আদ্রিতা মাথা নাড়িয়ে লাজুক স্বরে বললো,“জি।”
সঙ্গে সঙ্গে গুরুতর ভাবে বিষম খেল ফারিশ। বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে রইলো শুধু, তার ডাক্তার ম্যডামের দিকে।’

#চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে