এক পশলা ঝুম বর্ষায় পর্ব-৩৮+৩৯

0
454

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৩৮

নিজের হাইস্কুলের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আদ্রিতা। আজ বহুদিন পর এখানে এসেছে সে। ইচ্ছাকৃত নয়। বিকেলের দিকটায় খুঁটিনাটি বাজার করতে বেরিয়েছিল আদ্রিতা। কাল মৃদুলের বিয়েতে বেশ আনন্দ হইচই করেছে তারা। নয়নতারা আর আশরাফের সাথে বেশ ভাব জমেছে। আসার সময় ফোন নাম্বারও আদান-প্রদান হয়ে গেছে। আদ্রিতা খুশি যাক তাদের ফ্রেন্ড গ্রুপের শেষ সিঙ্গেল ছেলেটাও মিঙ্গেল হওয়ার লাইন ঢুকেছে। চাঁদনীর জন্য খারাপ লাগছে আদ্রিতার। সে শুনেছে আদিব তার সাথে কথা বলছে না। কারণ কি তাও বলছে না। তবে আদ্রিতা জানে এর কারণ কি! কি করবে ভেবে পায় না। আদ্রিতার যে ফারিশের সাথে সম্পর্ক ছিল বা তাদের ভিতরকার যে ঘটনাগুলো ঘটেছে তার কিছুই আদ্রিতার বন্ধুমহল জানে না। আদ্রিতা বলে নি। আর বলতেও চাইছে না। কি বলবে তাও একটা প্রশ্ন! নিজের ওপর অত্যাধিক ঘৃণা ধরেছে আদ্রিতার। বিতৃষ্ণায় সবকিছুই শূন্য শূন্য লাগে। আদ্রিতা চেয়েও কিছু করতে পারছে না। ফারিশ তাকে শুনতেই চাইছে না। ফারিশের ওপর আদ্রিতার এসব নিয়ে কোনো রাগ বা ক্ষোভ নেই যা আছে সেটা হলো খারাপ লাগা,ইমোশন। ফারিশের জায়গায় আদ্রিতা থাকলেও সেইম কাজ করতো। কিন্তু আদ্রিতা ফারিশকে কি করে বোঝাবে যে আদ্রিতা এতদিন যা করেছিল তা অভিনয় ভেবে করলেও কোনোটাই অভিনয় ছিল না। সত্যিকারের ভালোবাসা ছিল। সেই গভীর রাতের কনকনে শীতের মাঝে আগুন নিয়ে বসে থাকার সুন্দর মুহূর্তগুলো যেন এখনো আদ্রিতার চোখে ভাসে। চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়লো আদ্রিতার।

আদ্রিতা বন্ধ থাকা স্কুলটার দিকে তাকিয়ে রইলো। তার শৈশবের কতকত স্মৃতি জড়িয়ে আছে এই স্কুল নিয়ে। কত হাসি, তামাশা, হুল্লোড়। ইস! আনমনা হেঁসে উঠলো আদ্রিতা। যাকে বলে দুঃখের মধ্যেও হাসি।’

কাল মৃদুলের বৌ-ভাত। আদ্রিতাদের সকাল সকালই যেতে বলেছে সেখানে। আপাতত হসপিটাল থেকে তিনদিনের ছুটি নেয়া। আদ্রিতা আর দাঁড়ালো না। বিকেল হয়েছে বাড়ি ফেরা দরকার। আদ্রিতা উল্টোদিকে হাঁটা ধরলো। আদ্রিতার বাড়ি এদিকে নয়। অথচ আজ আনমনা হাঁটতে হাঁটতে এদিকে চলে আসলো। এলাকাটা খুব নিরিবিলি। বিশেষ করে চারটার পর। পুরো স্কুল ফাঁকা থাকে আর আশপাশটাও। আদ্রিতার যেতে যেতে মনে পড়লো এই পথ দিয়েই একসময় কাঁধে স্কুল ব্যাগ, গায়ে ইউনিফর্ম জড়িয়ে হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফিরতো। তখন আদ্রিতারা এই কাছেই একটা দোতলা বাড়িতে ভাড়া থাকতো। এখন নিজেদের বাড়ি হয়েছে বাবা করেছেন সেখানেই থাকে। স্কুল থেকে বেশ দূরে তার অবস্থান। আদ্রিতা পুরনো স্মৃতিগুলো ভাবতে ভাবতে আস্তে আস্তে হাতে বাজারের ব্যাগ নিয়ে চললো। চারপাশ চুপচাপ। হঠাৎ আদ্রিতার মনে হলো কেউ বুঝি তার পিছন পিছন আসছে। আদ্রিতা পিছন ঘুরে চাইলো কিন্তু না কিছুই নেই সব ফাঁকা। খুব একটা ভাবলো না সে হাঁটা ধরলো। আবারও শোনা গেল কারো পায়ের পদধ্বনি তাও একজন না দুজনের। আদ্রিতা আবারও ঘুরলো কিন্তু কাউকে দেখে হাঁটলো। হয়তো মনের ভুল।’

আদ্রিতা হাঁটতেই একটা গলির ভিতর থেকে দুটো ছেলে বের হলো। কাউকে ফোন করে বললো,“গলির মুখে গাড়ি নিয়ে আয় বলির পাঠা পাইয়া গেছি।”

কথাটা বলেই আদ্রিতার থেকে দূরত্ব নিয়ে ওর পিছু পিছু হাঁটলো।’

আচমকাই গা ঘেঁষে একটা গাড়ি থামতেই আদ্রিতা চমকে উঠলো। ঘাবড়ে গেলো খানিকটা। হাত ফসকে পড়ে গেল হাতের ব্যাগটা। ব্যাগ থেকে পড়ে গেল কিছু আলু পেঁয়াজ। আদ্রিতা বিচলিত হয়ে নিচে বসে সেগুলো ওঠাতে ব্যস্ত হলো। গাড়ি চালিত মানুষটি দ্রুত গাড়ি থেকে নামলো। হতভম্ব স্বরে নিচে বসে বললো,“আপনি ঠিক আছেন তো আসলে আমি..

পুরো কথা শেষ করার আগেই আদ্রিতাকে দেখে চোখমুখ খিঁচে ফেললো আদিব। কারণ গাড়ি চালক আর কেউ নয় আদিব ছিল। আদ্রিতাও তার দিকে তাকিয়ে বললো,“আদিব,

আদিব উঠে বিনা বাক্যে হাঁটা ধরলো। আদ্রিতা দ্রুত উঠে দাড়িয়ে বললো,“আদিব ভাইয়া যাবেন না প্লিজ।”

আদিব একটু দাঁড়িয়ে আবার হাঁটা ধরলো। আদ্রিতা অসহায় ন্যায় বললো,“প্লিজ ভাইয়া যাবেন না।”

খুবই করুণ কণ্ঠস্বর আদ্রিতার। আদিবের মায়া হলো সে দাঁড়ালো। আদ্রিতা দৌড়ে গিয়ে আদিবের মুখোমুখি দাঁড়ালো। বললো,“আমি জানি আমি অন্যায় করেছি। তবুও আমার সাথে কি একটু কথা বলা যায় না।”

আদিব আর ফারিশের মতো করে বলতে পারলো না,“না যায় না। সে করুণ দৃষ্টি ফেললো আদ্রিতার দিকে। মেয়েটার চোখ মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে আদ্রিতা দারুণ অনুতপ্ত। আদিব দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললো,“এত কিছু তো করলেন আর কি করতে চান?”

আদ্রিতা কেঁদে উঠলো হঠাৎ। আদিব ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেল তাতে। উত্তেজিত হয়ে বললো,“আরে আরে কাঁদছেন কেন?”

আদ্রিতা কাঁদতে কাঁদতেই জবাব দিলো,“আমি আপনাদের কি করে বোঝাবো যে আমি ফারিশের সাথে অভিনয় করি নি।”

আদিব অবাক হলো খুব। কথার অর্থ না বুঝে বললো,“মানে।”

আদ্রিতা উত্তর দিতে পারলো না। তার চোখ বেয়ে অজস্র হারে পানি পড়ছে। আদিব কি করবে বুঝতে না পেরে দ্রুত গাড়ির কাছে ছুটে গেল। গাড়ির ভিতর থাকা পানির বোতলটা এনে আবার এগিয়ে আসলো আদ্রিতার দিকে। পানিটা এগিয়ে দিয়ে নরম গলায় বললো,“খান।”

আদ্রিতা পানির বোতলটা নিলো ঢকঢক করে পানিটা গিলে বললো,“ধন্যবাদ।”

আদিব আর আদ্রিতা গিয়ে বসলো সামনের ফুটপাতের রাস্তার উপর। আদিবের গাড়ি পাশেই। আদিব শান্ত ভাবেই জিজ্ঞেস করলো,“বলুন কি হয়েছে?”

আদ্রিতা ছলছল নয়নে আদিবের দিকে তাকিয়ে বললো,“আমায় কি একবার ক্ষমা করা যায় না?

আদিব জবাব দেয় না। আদ্রিতা আবার বলতে থাকে,
“আমি মানছি আমি ভুল করেছি। মানুষ মাত্রই তো ভুল হয় বলুন। ওই পুলিশ অফিসার আমায় ইমোশনালি ব্ল্যাকমেল করে কাজটা করতে বলেছিল। আমি হাজারবার বারণ করেছি কিন্তু শুনতে চায় নি। আমার ফারিশকে প্রথম থেকেই পছন্দ ছিল। সেই যে এক পশলা ঝুম বর্ষায় সে আহত অবস্থায় আমার হসপিটাল এসেছিল সেদিন থেকেই। লোকটার কথা বলার স্টাইল, এটিটিউড সব আমার ভালো লেগেছিল প্রথম দিনই। কিন্তু ওইদিন আমি আতঙ্কিত হয়ে যাই। উনি আমার পিঠে ছুরি বসিয়ে কিছু মানুষকে মিথ্যে বলতে বলে সে এখানে আসেনি। আমিও আতঙ্কিত হয়ে মিথ্যে বলি। পরেরদিন সকালে খবরে দেখানো হয় এক মাফিয়া হসপিটালে ঢুকে। আপনি বলুন আমার কি খটকা লাগবে না। এরজন্য বন্ধুদের ওনার কথা বলতেই তারা আমায় পুলিশ স্টেশন নিয়ে যায়। জানি উনি কোনো মাফিয়া টাফিয়া কিছু না একজন ঔষধ কোম্পানির মালিক। ওইদিন প্রথম অনুতপ্ত হই। তারপর উনি আমায় ধরে নিয়ে যায়। আমাদের কক্সবাজারে সাক্ষাৎ হয়। ওনার সাথে আমার যতবার দেখা হতো আমি ততবারই মুগ্ধ হতাম। দারুণ ভালো লাগতো ওনাকে, ওনার রাগটাকে। আলাদা অনুভূতিও তৈরি হয় ওনার প্রতি। কিন্তু আমি বুঝতে পারি নি। আমি ওনাকে ভালোবাসতে শুরু করেছি। যেই মুহূর্তে আমি বিষয়টা বুঝবো সেই মুহূর্তেই কিশোরের আগমন। ওনার কথা শুনে আমি ফারিশের সাথে একটু ঘনিষ্ঠ হই। আমি নিজের দিক থেকে তার সাথে কাটানো মুহূর্তগুলোকে অভিনয় করছি ভাবতাম। কিন্তু ওগুলো আসলে অভিনয় ছিল না। প্রতিটি মুহূর্ত আমার ভিতর থেকে আসা চরিত্র ছিল। আমি অভিনয় করছি ভাবলেও আমি অভিনয় করি নি। ফারিশের সাথে কাটানো সময়টুকুতে আমার কোথাও মনে হয় নি সে খারাপ। বা মাফিয়া। তার সাথে মেশার আগেও আমি জানতাম না সে আধোতেও মাফিয়া কি না। এখনও তো জানি না। তবে আমি বিশ্বাস করি ফারিশ কোনো মাফিয়া নয়। আমাদের বিচ্ছেদ ঘটার দু’দিন আগে থেকে ফারিশ আমায় কিছু বলবে বলবে বলেও বলছিল না। আমি ভেবেছিলাম সেই কথাগুলো যদি মাফিয়া রিলেটেড কোনো কথা না হয়। কিশোরকে তার রেকর্ড শুনিয়ে মুখের উপর বলবো,“বিশ্বাস হলো আপনার। আমার ফারিশ কোনো মাফিয়া নয়।” – এরপর আমি আর ফারিশ বিয়ে করে সুখে থাকতাম। কিন্তু তার আগে আমি এগুলো সব বলতাম। কিন্তু দেখেন কি করে সবটা এলোমেলো হয়ে গেল। আমি শুরুটা অভিনয় দিয়ে করলেও কোনোটাই অভিনয় ছিল না। আমি কি করে বুঝাই ফারিশকে। আমার খুব কষ্ট হয় আদিব। আমি সত্যিই ফারিশকে ভালোবাসি। তার সাথে সারাজীবন থাকতে চাই। বাঁচতে চাই নতুন করে।”

বলতে বলতে আবার কেঁদে উঠলো আদ্রিতা। আদিব কি বলবে বুঝতে পারছে না। তার কি সান্ত্বনা দেয়া উচিত নাকি রাগ দেখানো উচিত বুঝতে পারছে না।’

আদিব স্নেহময় হাতে আদ্রিতার মাথায় হাত বুলালো। বললো,“কি বলবো সত্যি বুঝচ্ছি না।”

আদ্রিতা ছলছল নয়নে তার পানে তাকিয়ে বলে,“আমায় কি একবার ক্ষমা করা যায় না?”

আদিব উত্তর দিতে পারে না। তার ফোন বাজে। একটা ইমারজেন্সি কাজের জন্যই এদিকে এসেছিল আদিব। ফারিশের আসার কথা থাকলেও শেষ মুহূর্তে হঠাৎ মত বদলায়। আদিবও জোর করে নি। আদিব বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। বলে,“আমায় যেতে হবে।”

আদ্রিতাও বারণ করে না। চোখ মুছে বলে,
“লাস্ট একটা কথা বলবো ভাইয়া?”

আদিব মাথা নাড়িয়ে বলে,“বলুন?”
আদ্রিতাও উঠে দাঁড়ায়। মায়াভরা কণ্ঠে বলে,“আমার জন্য চাঁদনীকে ছাড়বেন না ভাইয়া ও এসব বিষয়ে কিছু জানে না। কিছু না। শুধু ও না আমার বন্ধুবান্ধব কেউই এসবের কিছু জানে না। আমার জন্য ওকে শাস্তি দিবেন না।”

আদিব এবার এ কথার উত্তর দেয় না। ছোট করে বলে,“ভালো থাকবেন।”

বিনিময়ে মৃদু হাসে আদ্রিতা। আদিব গাড়িতে উঠে বসে। তার ওদিকে যেতে হবে। না হলে আদ্রিতাকে সে বাড়ি পৌঁছে দিত। ছোট্ট দীর্ঘশ্বাস ফেলে চলে গেল আদিব।

আদ্রিতাও আর বসে রইলো না। সন্ধ্যা নামবে তাকে দ্রুত বাড়ি ফিরতে হবে। আদ্রিতা তার ব্যাগটা নিয়ে হাঁটা ধরলো।’

এতক্ষণ পর সামনের মেয়েটাকে একা পেয়ে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো পিছনের ছেলেদুটো। এতক্ষণ তারা গলির মুখে লুকিয়ে ছিল। আদিবের গাড়িটা গলির মুখটা ছাড়াতেই। আচমকা আরেকটা বড়গাড়ি এসে থামলো আদ্রিতার মুখোমুখি। আদ্রিতা কিছু বুঝে ওঠার আগেই গাড়ির দরজা খুলে তাকে জোর জবরদস্তি উঠিয়ে নিলো গাড়িতে। হাত থেকে বাজারের ব্যাগ পড়ে গেল নিচে। আদ্রিতা চেঁচানোর আগেই মুখে রুমাল চেপে ধরলো আগন্তুকরা। সঙ্গে সঙ্গে সে লুটিয়ে পড়ে গাড়ির ভিড়ে। ধীরে ধীরে চারপাশটা হয়ে গেল অন্ধকার। ঘুটঘুটে অন্ধকার।”
—-
বেশ কয়েকদিন পর আজ নিজের ঔষধের কোম্পানিতে পা রেখেছে ফারিশ। এতদিনের সব ঝামেলার জন্য এদিকটায় খুব একটা নজর পড়ে নি তার। ফারিশ জোরে নিশ্বাস ফেললো। এরপর আস্তে আস্তে ঢুকে গেল ভিতরে।”

#চলবে…..

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৩৯

প্রকৃতি তখন সন্ধ্যার দখলে। অন্ধকার নেমেছে ধরণীতে। আদ্রিতাকে রাখা হলো একটা বন্ধ ঘরে। তার মাথাটা এলানো ছিল কারো কাঁধে। আদ্রিতার হুস ফিরলো। সে আস্তে আস্তে বসা তার এলিয়ে যাওয়া মাথাটা উঠালো। অন্ধকারের মতো ঝাপসা ঝাপসা লাগছে চারপাশ। কিছু সময় এগোতেই আদ্রিতার কাছে চারপাশ পরিষ্কার হলো। তার হাত বাঁধা। আদ্রিতার আশপাশ দেখলো অনেক মেয়েদের আর্তনাদ শোনা যাচ্ছে। চকিত চমকে উঠলো আদ্রিতা। এখানে সে একা নয় তার মতো আরো অসংখ্য মেয়ে আছে। আদ্রিতার পুরো বিষয়টা বুঝতে কিছু সময় লাগলো। তার মানে সে অপহরণ কারীদের নিকট বন্দী। আদ্রিতা তার পাশের মেয়েটিকে আতঙ্কিত হয়ে জিজ্ঞেস করলো,“আমি এখানে এসেছি কতক্ষণ হয়েছে?”

মেয়েটি উত্তর দিলো,“ঘন্টা দুই।”
আশেপাশের মেয়েরা কাঁদছে। তাদের চিতকারে আদ্রিতার বুকের ভেতরটা কামড়ে উঠলো। এ কোথায় এসে পৌঁছালো। একটা মেয়ে দরজা ধাক্কাচ্ছে। আর বলছে,“আমাগো ছাইড়া দে শয়তানগুলা, তোগো কোনোদিন ভালো হইবো না। আমাগো ছাড় শয়তান।”

তার কথা শুনে একজন এসে দরজা খুললো। স্ব-জোরে মেয়েটির গালে থাপ্পড় মেরে বলল,“শালী ছাইড়া দেওনের জন্য বুঝি ধইরা আনছি তোগো। আর কিছু সময় হেরপরই তোগো আরেক দেশে পাঠাইয়া দিমু। সুখে থাকবি তোরা।”

লোকটার কথা শুনে মুখে থুঁ মারলো থাপ্পড় খাওয়া মেয়েটি। চেঁচিয়ে বললো,“তোগো কোনোদিন ভালো হইবো না। কোনোদিন না।”

লোকটা রেগে গেল। তড়িৎ হাতে থাকা একটা ইনজেকশন পুস করে দিলো মেয়েটার ঘাড়ে সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটি এলিয়ে পড়লো নিচে। বাকি সবাই আঁতকে উঠলো এমন ঘটনা দেখে। আদ্রিতা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে। লোকটা চলে গেল। দরজা আঁটকে দিলো ভেতর থেকে।’

আদ্রিতার মাথা কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে। তারওপর এই মেয়েগুলোর আর্তনাদ যেন আরো ধারালো বিঁধছে কানে। আদ্রিতা চেঁচিয়ে উঠলো হঠাৎ। কড়া কণ্ঠে বললো,“তোমরা কাঁদছো কেন থামো?”

কেউই থামলো না। আদ্রিতার বিরক্তিতেই মাথা ধরেছে সে আবার চেঁচিয়ে বললো,“কাঁদছো কেন থামো বলছি?”

এবার থেমে গেল সবাই। আদ্রিতা বললো,“আমরা এখানে কতগুলো মেয়ে আছি?”

একটা মেয়ে বললো,“তুমারে লইয়া দেড়শো।”
আদ্রিতা চুপ থাকলো কিছুক্ষণ এরপর প্রশ্ন করলো, তাদের কি আলাদা আলাদা ঘরে রাখা?”

রোগা মতো মেয়েটি বললো,“হা। প্রত্যেক ঘরে মনে হয় বিশজন কইরা।”

আদ্রিতা শুনে আঁতকে উঠলো। কি করবে ভেবে পায় না। কিন্তু কিছু তো একটা করতেই হয়।’
—-
রাত তখন এক’টা। হন্তদন্ত হয়ে গাড়ি ড্রাইভ করছে ফারিশ তার পাশেই আদিব। মূলত আদ্রিতাকে খোঁজার জন্যই তারা বেরিয়েছে। সেই সময় আদিব গলির মুখ থেকে বের হওয়ার পূর্বে গাড়ির ডানেপাশের লুকিং গ্লাসে দেখেছে দুটো ছেলে আদ্রিতাকে তুলে নিয়েছে। সে সঙ্গে সঙ্গেই গাড়ি গোড়ায় কিন্তু আদিব যতক্ষণে আসে ততক্ষণে আদ্রিতাকে নিয়ে চলে যায় আগন্তুকরা। আদিব পিছু নেয় গাড়িটির। শেষ মুহূর্তে এসে গুলিয়ে ফেলে। আদিব সেই মুহূর্তেই ফারিশকে কল করে। ফারিশ সব শুনেই ছুটে আসে। আদ্রিতার আদিবকে বলা সব কথাও ফারিশকে বলে। ফারিশের সেই বিষয়ে কোনো ভারাক্রান্ত নেই। এই মুহূর্তে তার একমাত্র কাজ হচ্ছে আদ্রিতাকে খুঁজে বের করা। সেই সন্ধ্যা থেকে খুঁজছে। পুলিশকেও বলা হয়েছে সবটা। কিশোর নিজে এই নিখোঁজ কেসটা নিয়েছে। ফারিশ আদিবকে বললো,
“গাড়ির নাম্বার সঠিক ছিল তো আদিব?”
“জি ভাই।”
“গাড়ির কালার সাদাই ছিল?”
“জি।’

আঁকাবাঁকা রাস্তা পেরিয়ে পৌছাতে পৌঁছাতে হঠাৎ আদিব বললো,“ভাই এহিনে থামান।”

ফারিশ থামালো। আদিব গাড়ি থেকে নামলো দ্রুত। এগিয়ে গেল কাছে এক জঙ্গলের ভিড়ে গাছের আড়ালে। সেখানে একটা গাড়ি রাখা। এর আগেও এমন গাড়ি কয়েকটা দেখেছে কিন্তু নাম্বার মেলেনি।আদিব তার মোবাইলের ফ্লাশ লাইট অন করে পুরো গাড়িটা দেখলো। নাম্বার চেক করে বুঝলো। এটাই সেই গাড়িটা। ফারিশ গাড়ি থেকে নেমে দ্রুত এগিয়ে আসলো। বললো,“কিছু দেখলে আদিব?”

আদিব ফারিশের দিকে তাকিয়ে বললো,
“ভাই এই গাড়িটাই।”
“তুমি শিওর আদিব?”
“জি ভাই। ডাক্তার ভাবিরে এই গাড়িতেই নিছে।”

ফারিশ আদিবকে এক সেকেন্ড দাঁড়াতে বলে গাড়ির কাছে গেল। গাড়ির সিটের নিচে লুকিয়ে রাখা পিস্তলটা নিলো। এরপর আদিবকে নিয়ে জঙ্গলের ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে বললো,“সাবধানে আসো আদিব।”

আদিব শুনলো। ভয় পেলেও চললো ফারিশের পিছু পিছু। কিছুদূর এগোতেই হঠাৎ নজরে আসলো একটা পুরনো বাংলো বাড়ির। চারপাশ আটকানো। ফারিশ কৌতুহলী এগিয়ে গেল। আদিব ভয়ে কাইত। সে ফারিশের শার্টের কোনা ধরে শুঁকনো ঢোক গিললো। বললো,
“ভাই ভিতরে যাওয়া কি ঠিক হবে? কোনো ভূতটূত থাকলে।”
“ভূত বলতে কিছু নেই আদিব। মানুষই ভূত বুঝেছো। আর শার্ট না ধরে হাত ধরো। শার্টটা ছিঁড়ে গেলে।”

লজ্জায় পড়লো আদিব। শার্ট ছেড়ে হাত ধরলো ফারিশের। আদিব যে কেন এত ভীতু তা আদিব নিজেও জানে না। ফারিশের মতো একটা মানুষের সাথে চলাফেরা তার। অথচ আজও একটু ভয় কমলো না।’

ফারিশ সরাসরি বাংলোর দরজার সামনে দাঁড়ালো। তালা বদ্ধ। ভিতরে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না। আদিব সাইট করে দাঁড়ালো। ফারিশ মোবাইলের আলো দিয়ে আশপাশ দেখলো। একটা বড় ইট নিয়ে মারতে লাগলো তালাতে। তালাটাতে খুব বেশি জোর লাগাতে হলো না। চারপাঁচটা বারি মারতেই খুলে গেল। দরজা খুলতেই ফারিশ সঙ্গে সঙ্গে ভিতরে ঢুকলো। বিশাল একটা রুম। তার চারদিকে অনেকগুলো দরজা যার প্রত্যেকটাই খোলা। ফারিশ হতাশ হলো। তার কেন যেন মনে হলো সে আসতে দেরি করেছে। আদ্রিতা এখানেই ছিল। কিন্তু এখন নেই।”

আদিব দরজা হাতরে তখনই ভিতরে ঢুকলো। আশেপাশে কাউকে না দেখে বললো,“ভাই বাড়ি দেখি ফাঁকা।”

ফারিশের হঠাৎ চোখ গেল নিচে পড়ে থাকা একটা কানের দুলের দিকে। কানের দুলটা আদ্রিতার। বোধহয় টেনে নিয়ে যাওয়ার সময় খুলে গিয়েছিল। ফারিশ এটা বেশ কয়েকবার আদ্রিতার কানে দেখেছিল। তার মনে আছে একবার আদ্রিতা বলেছিল এটা তার মায়ের দেয়া।’

ফারিশের নিজের ওপর রাগ উঠলো আর কতক্ষণ আগে কি আসতে পারতো না এখানে।’

দূর থেকে ট্রাক যাওয়ার শব্দ শোনা গেল। ফারিশ উঠে দাঁড়ালো দ্রুত। আদিবকে বললো,“কিশোরকে কল করে এখানে আসতে বলো আদিব। আমরা বোধহয় খুব দেরি করি নি।”

আদিব শুনলো। ফারিশ তক্ষৎনাৎ বের হলো বাংলোর ভিতর থেকে আদিবও গেল তার পিছন পিছন। কল করলো হাঁটতে হাঁটতে।’
—-
গভীর রাতে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে একটা ট্রাক বের হলো রাস্তায়। ট্রাকের ভিতর আছে পঞ্চাশটা মেয়ে। যাদের সবারই হাত পা মুখ বাঁধা। আদ্রিতা কিছু করতে পারে নি। তার করার কিছু ইচ্ছে থাকলেও সে ব্যর্থ হয়েছে। সবসময় নিজের কাছে ইনজেকশনসহ নানাবিদ ঔষধী নিয়ে ঘুরলেও আজ সময়ের সময় তার কিছু ছিল না। ব্যর্থ আদ্রিতা। তার নিজের ওপরই রাগ হচ্ছে এখন। চোখ বেয়ে পানি পড়ছে আদ্রিতার। আর বুঝি ফারিশের নিকট যাওয়া হলো না। চোখে ঝাপসা দেখছে আদ্রিতা। হঠাৎ গাড়িতে ব্রেককষা হলো। গাড়ি গেল থেমে। সব মেয়েরা একত্র হয়ে একদিকে এলে পড়লো। কর্নারে থাকা মেয়েগুলো ব্যাথাও পেয়েছে দারুণ।’

গাড়ির চালক বিরক্ত। হঠাৎ সামনে কেউ চলে আসায়। ড্রাইভারের পাশে ছিল আরেকটা লোক মুনিব। সেও বসে চুপচাপ। ফারিশ এগিয়ে আসলো তখন। ফেক একটা পুলিশ অফিসারের আইডি কার্ড দেখিয়ে বললো,“পুলিশ। এতরাতে ট্রাকে করে কি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।”

ঘাবড়ে গেল মুনিব। বললো,“তেমন কিছু না সাব। গরুর খড়।”

ফারিশ মানতে চাইলো না। মুনিবকে ইশারায় নামতে বললো। মুনিব নামলো। আদিব চুপচাপ ফারিশের পাশে দাঁড়ানো। তার কপাল চুইয়ে ঘাম পড়ছে। ফারিশ মুনিবকে বললো,
“ভিতরে কি আছে আমি দেখতে চাই?”
“সাহেব গরুর খড়ই আছে।”
“তাই দেখবো আমি। রতন গাড়ির কাগজগুলো দেখো।”

আদিব চমকে উঠলো। কোনোরকম বললো,“দেখাতাছি ভা,উম দেখতাছি স্যার।”

ড্রাইভারের কাছে গাড়ি কাগজ চাইলো আদিব। আর ফারিশ গেল মুনিবের সাথে গাড়ির পিছনে। হুকুম দিয়ে বললো,“গেট খোলো।”

মুনিবের মাথা চুইয়ে ঘাম পড়ছে। কি করবে বুঝচ্ছে না। এভাবে হুট করেই পুলিশ চলে আসবে সে বুঝতে পারে নি।’

এদিকে আদ্রিতা যেন স্পষ্ট ফারিশের কণ্ঠ শুনতে পাচ্ছে। মুখ ফুটে কিছু বলবে তাও পারছে না। অসহায় লাগছে নিজেকে। ফারিশ তীক্ষ্ণ স্বরে শুধায়,“খোলো তাড়াতাড়ি আমার কাছে সময় নেই।”

মুনিব বললো আবার,“গরুর খড়ই আছে সাব।”

এবার হুংকার দিয়ে উঠলো ফারিশ। মুনিব ঘাবড়ে গিয়ে দ্রুত দরজা খুললো। কিছু গরুর খড় পড়লো নিচে। ফারিশ হতাশ হলো। খড়ের মধ্যে হাত দিলো। এখানেও নেই আদ্রিতা। আদিব ছুটে আসলো তখন। গাড়ির কাগজ দেখিয়ে বললো,“স্যার গাড়ির কাগজ।”

ফারিশ একবার চোখ বুলালো। সে আর্তনাদ ভরা কণ্ঠে বললো,“আপনি কোথায় ডাক্তার ম্যাডাম?”

ঠিক সেই মুহূর্তের ট্রাকের ভিতর দিয়ে বিকট এক শব্দ আসলো। আদিব, ফারিশ, মুনিব তিনজনই চমকে উঠলো। ফারিশ বললো,“কিসের শব্দ হলো?”

মুনিব বললো,“কই কিছুর শব্দ নাই তো সাহেব।”
পরপর আরো দু’বার শব্দ হলো। ট্রাকের ভিতরের মেয়েরা যে যেভাবে পারছে শব্দ করছে। কেউ পা দিয়ে, কেউ হাত দিয়ে, কেউ মাথা দিয়ে। ফারিশ দ্রুত খড় সরানোর চেষ্টা করলো। মুনিব দৌড় দিবে তখনই। তাকে সাহস করে ধরলো আদিব। সেই মুহুর্তেই সেখানে উপস্থিত হলো কিশোর। ড্রাইভারও পালিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু পারে নি। কিশোর নাক বরাবর কয়েকটা ঘুষি মারলো মুনিবকে।’

অতঃপর সামনের সাজিয়ে রাখা খড়গুলো সরাতেই স্পষ্ট দেখা গেল বেশ কয়েকটা মেয়েদের মুখ। আর তাদের মাঝে আদ্রিতাকে। ফারিশ চেয়ে রইলো তার দিকে। আদ্রিতাও দেখলো। মলিন চোখ তার।’

একে একে মেয়েগুলো বের হলো। সবাই ফারিশকে ধন্যবাদ জানাচ্ছে। কেউ ভাইজান ডেকে কেঁদে ফেলছে। এই মেয়েগুলোর বেশির ভাগ ইউনিভার্সিটিতে পড়া মেয়েরা। যারা বাবা মাকে ছেড়ে হোস্টেলে থাকে। এদের মধ্যে কিছু মেয়ে বিবাহিত ছিল। একটা মেয়ে ছিল যে উকিল হবে। সে ল এর স্টুডেন্ট। মেয়েটার নাম তিশা। তিশা ফারিশের হাত ধরে কেঁদে কেঁদে বললো,“আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ভাইয়া আজ আপনি না এলে আমরা সবাই ধ্বংস হয়ে যেতাম। আমি একজন ল’য়ের স্টুডেন্ট। খুব শীঘ্রই উকিল হবো। আপনার জীবনে যদি কখনো প্রয়োজন পড়ে আমায় জানাবেন ভাইয়া। আমি আমার সর্বশ দিয়ে আপনায় সাহায্য করার চেষ্টা করবো।”

ফারিশ শুধু দেখলো মেয়েটাকে। গালে পাঁচ আঙুলের দাগ। খুব মেরেছিল বোধহয়। ফারিশ মেয়েটার মাথায় হাত বুলালো। বললো,“ভালো থেকো সবসময়।”

মেয়েটি মিষ্টি হাসে। সব মেয়েদের কিশোরের হাতে তুলে দেয়া হলো। এখানে টোটাল পঞ্চাশজন মেয়ে ছিল বাকিরা আরো দুটো ট্রাকে। মুনিবকে মেরে বাকিগুলারও হদিস পাওয়া যাবে। কিশোর এগিয়ে আসলো। বললো,“আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ ফারিশ।”

ফারিশ চায় কিশোরের দিকে। বলে,“আপনায় আগেই বলেছিলাম আমার পিছনে না ঘুরে আসল অপরাধীকে ধরুন। এই সব কাজ আরশাদ করেছে। যে দু’মাস আগে জেল থেকে পালিয়েছে। আমার সেদিনের ট্রাকেও মেয়েও ওই রেখেছিল।”

কিশোর হাত মেলায় ফারিশের সাথে। বলে,“ইনফরমেশন দেয়ার জন্য আপনায় ধন্যবাদ। বাকিটা আমরা দেখে নিচ্ছি।”

বলেই চলে যেতে নিলো কিশোর। পরপরই দাড়িয়ে বললো,“ডাক্তার সাহেবাকে পারলে ক্ষমা করে দিয়েন ওনার কোনো দোষ নেই। আমিই বাধ্য করেছিলাম তাকে।”

ফারিশ কিছু বলে না। কিশোর চলে যায়। ফারিশের দৃষ্টি যায় ট্রাকের পাশ দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ডাক্তার ম্যাডামের দিকে। কেমন মলিন মুখে তাকিয়ে আছে তার দিকে। ফারিশ মনে মনে আওড়ায়,
“এভাবে কেন তাকান ডাক্তার ম্যাডাম,আপনার চাহনি যে বরাবরই আমায় নিঃস্ব করে ছাড়ে।”

#চলবে….

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে