#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৩৬
বেশ নিরাশ ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে সবাই আদ্রিতার দিকে। আদ্রিতার সেদিকে হুস নেই। সে নিজের মতো করে চুপচাপ গালে হাত দিয়ে বসে। মৃদুল এতক্ষণ মুরগীর রোস্ট নিয়ে এতকিছু বললো তাতেও তার ভ্রুক্ষেপ নেই। যেন শুনতে পায় নি। হঠাৎই মুনমুন বললো,“আদু,
আদ্রিতা জবাব দিলো না। আদ্রিতার কান্ডে একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করলো সবাই। আশরাফ সবাইকে চুপ হতে বলে এগিয়ে গেল আদ্রিতার কাছে। সামনে গিয়ে মুখোমুখি দাঁড়ালো। তাও আদ্রিতার কোনো হেলদোল দেখা গেল। বেশ চিন্তিত হলো সবাই। আশরাফ আলতো করে আদ্রিতার কাঁধে হাত রাখলো। নিচু স্বরেই ডাকলো,“আদু,”
আদ্রিতা ভূত দেখার মতো চমকে উঠলো এবার। কোনোরকম বললো,“জি,
পরমুহূর্তেই চোখের সামনে তার বন্ধুমহলের সবাইকে দেখে হতভম্ব স্বরে বললো,“তোরা এখানে? কখন এলি?”
বিষম খেলো সবাই। তারা সেই কখন এখানে এসেছে হইচই করছে অথচ আদ্রিতা তাদের দেখতে পায় নি। সবাই বেশ বিস্মিত।’
বিকেলের ফুড়ফুড়ে আলোতে শীতল বাতাসময় পরিবেশ। হসপিটাল থেকে খানিকদূরেই অবস্থানরত এক নদীর পাড়। তার সামনের এক বেঞ্চিতে বসে আছে আদ্রিতা। আর তাকে ঘিরে দাড়িয়ে আছে আশরাফ, মুনমুন, মৃদুল, রনি আর চাঁদনী। মূলত দু’ঘন্টার একটা ছুটি নিয়ে তারা এখানে এসেছে। প্রকৃতির মিষ্টি বাতাস তাদের ছুইলো হঠাৎ। আশরাফই শুরু করলো আগে। শান্ত স্বরে জিজ্ঞেস করলো,“কি হয়েছে তোর?”
আদ্রিতার ছলছল দৃষ্টি ভঙ্গি। বুকে তীব্র ব্যাথা। তবুও প্রশ্ন এড়াতে বললো,“কি হবে?”
“আমাদের থেকে কিছু লুকাচ্ছিস তুই”–চিন্তিত স্বর মৃদুলের।
আদ্রিতা আশেপাশে চায়। বিস্মিত কণ্ঠে বলে,“না।কি লুকাবো?”
সন্দিহান দৃষ্টিতে সবাই তাকিয়ে রইলো আদ্রিতার দিকে। আদ্রিতা শুঁকনো হাসলো। বললো,“কিছু হয় নি রে আসলে কাল রাতে ঠিক মতো ঘুম হয় নি। তাই আর কি নিজেকে মরা মরা লাগছে। প্রচুর ঘুমও পাচ্ছে।”
কথাটা বলে হাই তুললো আদ্রিতা। শুরুতে কেউই বিশ্বাস করতে চাইলো না আদ্রিতার কথা। কিন্তু আদ্রিতার চোখ বোধহয় সত্যি বলছে। সে ক্লান্ত। তার চোখ খানিক লাল। নীরবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো সবাই। মৃদুল পরিবেশ ঠিক করতে বললো,“তাইলে কিছু খাওয়া যাক। ঝালমুড়ি ফুচকা খাবি তোরা?”
সবাই চেঁচিয়ে উঠলো। যার মানে ‘তারা খাবে’।
মেয়ে তিনজন ফুচকা আর ছেলে তিনজন ঝালমুড়ি খাবে বলে ঠিক করলো। আশরাফ ওরা গেলো আনতে, এরপর খেতে খেতে মৃদুলের বিয়ের কথাবার্তা চলবে। ঘুম পেয়েছে বললেই তো আর আদ্রিতাকে ঘুমোতে দেয়া যাবে না এখন।’
—-
খুলনার ফ্যাক্টরিতে পা রেখেছে ফারিশ। আজ অনেকদিন পরই পা রেখেছে এখানে। বেলা তখন বিকেল ছাড়িয়ে। ফারিশকে দেখেই সেখানকার ম্যানেজার মহিন উদ্দিন দৌড়ে আসলেন। কাঁপা কাঁপা স্বরে আওড়ালেন,“কেমন আছেন স্যার?”
ফারিশ সামনে হাটলো। তার পিছনে আদিব। আর তাদের সঙ্গে মহিন উদ্দিন। ফারিশ গম্ভীর স্বরে উত্তর দিল,
“ভালো। কাজ কেমন চলছে?”
“জে ভালোই স্যার।”
“আজ রাতে কি মাল ডেলিভারি দেয়া হবে?”
“জে স্যার।”
“কোন কোন দেশে যাবে?”
“একটা জাপানে, আরেকটা নেদারল্যান্ড।”
ফারিশ ছোট করে উত্তর দিলো,“ওহ।”
একটু থেমে আবার বলে,
“ঔষধের কি খবর?”
“স্যার দেশেই অনেকগুলো অর্ডার আছে। ঢাকার বেশিরভাগ সরকারি, বেসরকারি হসপিটালগুলো আমাদের ঔষধ ব্যবহার করছেন। বাচ্চাদের জন্য নতুন তৈরিকৃত কাশির ঔষধটাও ব্যাপক ভালো হয়েছে। ঢাকা সরকারি হসপিটালের ড. ওয়াজিহা আদ্রিতা নামের একজন ডক্টর ঔষধটার ভালো রিভিউ দিয়েছে স্যার। এছাড়া খুলনাতেও বেশ সাড়া ফেলেছে।”
ফারিশ কিছু বললো না। ওয়াজিহা আদ্রিতা নামটা শুনতেই বুক কাঁপলো ফারিশের। যন্ত্রণাও হলো বুঝি। আদিব বুঝলো। এগিয়ে এসে বললো,“আপনি ভাই ওখানের একটা চেয়ারে বসুন আমি বাকিটা দেখে নিচ্ছি।’
ফারিশ শুনলো না। জোরে নিশ্বাস ফেলে বললো,“আমি ঠিক আছি আদিব।”
কথাটা বলে ঘুরে ঘুরে দেখতে লাগলো সবটা। মেয়েটার সাথে কাটানো সুন্দর মুহূর্তগুলো মনে পড়ছে ফারিশের। অস্থির লাগছে আচমকা। মুখ থেকে অস্পষ্টনীয় বার্তা বের হলো একটু,“এভাবে না ঠকালেও বোধহয় হতো ডাক্তার ম্যাডাম।”
—-
নিঝুম রাত! চুপচাপ হাঁটছে আদ্রিতা। সেদিনের পর চারদিন কাটলো আজ। ফারিশের সাথে চারদিন যাবৎ কথা নেই। ফোন নাম্বার থাকতেও কল দেয়া মানা। আদ্রিতা চাইলেও কল করতে পারছে না। তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। ফোন করে কি বলবে তাও জানে না! ক্ষমা চাইবে কি না তাও বুঝচ্ছে না। আর ক্ষমা চাইলেই কি ফারিশ তাকে ক্ষমা করে দিবে! অবশ্যই দিবে না। আদ্রিতা চাইছে ক্ষমা না করলেও ফারিশ কম করে হলেও তার সাথে রাগারাগি করুক। চেঁচামেচি করুক। ছেলেটার এভাবে গুম হয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা আদ্রিতা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। তার কষ্ট হচ্ছে। একটা ভুল তার পুরো জীবন ওলোট পালোট করে দিলো। কোথাও গিয়ে তার মনে হচ্ছে তার কক্সবাজার যাওয়াই ভুল হয়েছে। না যেত কক্সবাজার, না দেখা হতো ফারিশের সাথে, আর না ওই পুলিশ অফিসারের সাথে। আনমনা রাস্তার কর্ণার থেকে ফুটপাতের রাস্তা থেকে নামলো আদ্রিতা। এরপর পিচঢালা রাস্তা দিয়ে হাঁটলো। তার কিছু ভালো লাগছে না। মাঝরাতে এভাবে হেঁটে বেড়ানোটাও সেইফ না। কিন্তু তবুও আদ্রিতা হাঁটছে। রজনীর রাতে, আলোকিত ল্যামপোস্টের নিচে বিষণ্ণ মন নিয়ে হাঁটছে আদ্রিতা। হঠাৎই উল্টো পথ দিয়ে একটা গাড়ি ছুটে আসলো আদ্রিতার দিকে। সে বিমূঢ় চেয়ে। গাড়িটা সরাসরি আদ্রিতার মুখোমুখি এসে থামলো। গাড়ির লাইটের আলোতে চোখ ধাদিয়ে উঠলো তার। খানিকটা ঘাবড়ানো, আর ভয়ার্ত মুখ নিয়েই সে চেয়ে রইলো গাড়িটির দিকে। চুপ হয়ে গেল গাড়ির স্থির দৃষ্টিতে বসে মানুষটাকে দেখে। ফারিশ বসে। তার গাড়ি ব্রেকফেল করেছিল। ভাগ্যিস এখানে এসে থেমেছে। সে বুঝতে পারে নি এই মুহূর্তে রাস্তার দিকে তার মুখোমুখি আদ্রিতা দাঁড়িয়ে থাকবে। ফারিশের স্থির দৃষ্টি। ফারিশ তার পকেট থেকে ফোন বের করলো। আদিবকে বললো,“আমার গাড়ি ব্রেকফেল করেছিল আদিব। নতুন গাড়ি পাঠাও আমি হসপিটাল রোডে আছি।”
ফোন কাটলো ফারিশ। সে গাড়ি থেকে বের হলো। আদ্রিতা তখনও তার দিকে তাকিয়ে। ফারিশ পুরো গাড়িটা চেক করে বুঝলো সে আসার সময় ভুল করে নষ্ট গাড়ি নিয়ে এসেছে। এই গাড়ির ব্রেকফেল আরো আগেই হয়েছিল। ফারিশ দীর্ঘ নিশ্বাস ফেললো ইদানীং কি তার ভুলের পাল্লা ভাড়ি হচ্ছে নাকি।’
ফারিশ একটু একটু করে এগিয়ে আসলো আদ্রিতার দিকে। আদ্রিতার বুক ধড়ফড় করছে। ফারিশ বললো,“আমি খুব দুঃখিত হঠাৎ এমন সামনে চলে আসায়। আসলে আমার গাড়ি ব্রেকফেল করেছিল।”
কথাটা বলেই ফারিশ সরে আসলো। আদ্রিতার গলা বুঝি আটকে গেছে। মুখ দিয়ে কথাই বের হতে চাইলো না। সে কি করবে বুঝচ্ছে না বাড়ি চলে যাবে। নাকি দাঁড়িয়ে থাকবে। দাঁড়িয়ে কেন থাকবে? ফারিশের আচরণটাও ঠিক লাগলো না। মনে হলো তাকে চেনেই না। আদ্রিতার বুক ভাড়ি হয়ে আসছে। যন্ত্রণা হচ্ছে। সে বহুকষ্টে ডাকলো,“মিস্টার বখাটে।”
ফারিশ দাঁড়ালো না মোটেও। গাড়ির চাবি বের করে গাড়িটা লক করে সে হাঁটা ধরলো উল্টোদিকে। আদ্রিতার চোখ বেয়ে পানি পড়লো আচমকা। সে কান্নামাখা মুখশ্রী নিয়েই বলে উঠল,“ফারিশ।”
না চাইতেও ফারিশের পা থেমে গেল। এই অনাকাঙ্খিত মোলাকাত ফারিশ চায় নি। ফারিশকে দাঁড়াতে দেখে আদ্রিতা চোখের পানি মুছতে মুছতে দৌড়ে গেল ফারিশের কাছে। দাঁড়ালো মুখোমুখি। বললো,“আমার আপনার সাথে কিছু কথা আছে ফারিশ?”
ফারিশের স্বাভাবিক মুখভঙ্গি। শান্ত গলা,
“আমার মনে হয় না আপনার আমার সাথে কোনো কথা থাকতে পারে।”
“অবশ্যই আছে।”
“আমি শুনতে চাইবো কেন?”
“সত্যিই কি শোনা যায় না?”
আদ্রিতার বিষণ্ণ মুখ। মলিন কণ্ঠস্বর। ফারিশ চাইলো এবার আদ্রিতার মুখশ্রীর দিকে। এতক্ষণ তাকায়নি কিন্তু এবার না তাকিয়ে পারলোই না। ফারিশ ঝুকে গেল আদ্রিতার দিকে। নিশ্বাস ছাড়লো হঠাৎ। সেই নিশ্বাস গিয়ে লাগলো আদ্রিতার মুখপানে। সে চোখ বন্ধ করে আবার খুললো। তবুও নড়লো না। স্থির দাঁড়িয়ে। ফারিশ শীতল স্বরে আওড়ায়,
“যারা মন ভাঙে, দুঃখ দেয়,হৃদয়ে জ্বালাপোড়া ঘটায় তাদের কথা শোনা কি আধও শোভা পায় ডাক্তার ম্যাডাম!”
আদ্রিতা থমকে যায়। মাথা নুইয়ে ফেলে তক্ষৎনাৎ। এ কথার পিঠে কি উত্তর দেয়া যায় সে ভাবে। কিন্তু ব্যর্থ হয়। উত্তর নেই এ কথার। ফারিশ মলিন হাসে। করুন দেখায় সেই হাসি। ফারিশ নীরব স্বরে আবার শুধায়,
“তোমায় ভালোবেসেছিলাম বলেই দুঃখ দিতে পারলে, নয়তো এই আমিকে দুঃখ দেয়ার সাহস এই ধরণীর কারো নেই।”
#চলবে….
#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৩৭
নিকষকালো অন্ধকারে ঘেরা চারপাশ। শাঁ শাঁ করে ঢেউদের শব্দ শোনা যাচ্ছে ব্রিজের নিচ বেয়ে। তুমুল বাতাস আর শীতের আভাস বইছে দারুণ। জানুয়ারি মাসের চার তারিখ পেরিয়ে পাঁচ তারিখকে বহু আগেই ছুঁয়ে ফেলেছে সময়। আদ্রিতা আর ফারিশ ঠায় দাঁড়িয়ে রাস্তার কর্নারে। কারো মুখেই কথা নেই। ফারিশের প্রতিটা কথার ধাঁজ এতটাই ধারালো যে আদ্রিতা চেয়েও আর কিছু বলতে পারছে না। ফারিশের কথার পিঠে কথা বলার মতো কোনো শব্দই খুঁজে পাচ্ছে না যেন। আর শেষ কথাটার “তুমি” সম্মোধনটা। আদ্রিতার বুকে চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে। ফারিশ দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কপাল চুলকে বললো,“রাত কিন্তু অনেক হয়েছে দাঁড়িয়ে না থেকে বাড়ি যান।”
আদ্রিতা ছলছল দৃষ্টি নিয়ে তাকালো ফারিশের দিকে। নরম গলায় প্রশ্ন করলো,“আমার কথা কি একটুও শোনা যায় না ফারিশ?”
তড়িৎ উত্তর এলো ফারিশের,
“আগে হলে যেত এখন যায় না।”
“মানুষ মাত্রই তো ভুল করে।”
“আপনি তো ভুল নয়,
“জানি অন্যায় করেছি।”
“জানেনই যখন তখন বলছেন কেন?”
“আমি একটু সময় নিয়ে কিছু কথা বলতে চাই।”
মিনতির স্বরে শুধায় আদ্রিতা। ফারিশ শোনে না। গম্ভীর এক আওয়াজে বলে,
“আমার মনে হয় না আমাদের আর কোনো বলার মতো কথা থাকতে পারে।”
“আমার তো কিছু বলার আছে।”
“কিন্তু আমার কিছু শোনার নেই।”
“এত ঘৃণা,
মলিন হাসে ফারিশ। বলে,
“ফারিশ মানুষটাই ঘৃণার।”
“না।”
হেঁসে ফেলে ফারিশ। এবারের হাসিটায় খানিকটা শব্দও হয় বটে। ফারিশ বলে,“ফারিশকে ঠকানো যায়,তার সাথে মিথ্যে অভিনয় করা যায়,কিন্তু ভালোবাসা যায় না।”
আদ্রিতা আবারও চুপ হয়ে গেল। ফারিশ চায় তার পানে। মৃদুস্বরে আওয়াড়,,“আপনার কি মনে আছে ডাক্তার ম্যাডাম আপনাকে একদিন হসপিটাল বসে আমি একটা প্রশ্ন করেছিলাম?”
চকিত চাইলো আদ্রিতা। চাইলো ফারিশের চোখের দিকে। কি নিদারুণ বিষণ্ণ মাখা সেই চোখ জোড়ায়। আদ্রিতা প্রশ্ন করে,“কোন কথা?”
ফারিশ সময় নেয় না। শান্তস্বরে বলে,“আপনায় জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমাকে কি ভালোবাসা যায় ডাক্তার ম্যাডাম?”
থমথমে মুখটা তড়িৎ কেঁপে উঠলো আদ্রিতার। বিস্মিত নজরে চোখের পলক ফেললো বার কয়েক। হাত কচলালো মুহুর্তে। ফারিশ দেখলো। বললো,“সেদিন আপনার উত্তর কি ছিল তা কি আপনার মনে পড়ে।”
আদ্রিতা মাথা নুইয়ে ফেলে আবার। যার অর্থ ‘তার মনে আছে’। ফারিশ বলে ওঠে তক্ষৎনাৎ,“আপনি উত্তরে বলেছিলেন ‘পৃথিবীর সব মানুষকেই ভালোবাসা যায় শুধু সেই মানুষটাকে ভালোবাসার মর্মতা বুঝতে হয়।’ এখন প্রশ্ন হলো আমি কি মর্মতা বুঝে নি?”
আদ্রিতা কিছু বলে না। ফারিশ চুপ থাকে না আবার বলে,“আজ আপনি সত্যি সত্যিই প্রমাণ করে দিলেন ফারিশকে ভালোবাসা যায় না। ফারিশরা কারো ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্যই নই বোধহয়।”
করুন শোনালো ফারিশের শেষ কণ্ঠস্বর। তার কথা বোধহয় আবার আটকে আসছে। আদ্রিতা এবার মুখ খোলে। লজ্জিত স্বরে বলে,
“আপনি ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য ফারিশ।”
ফারিশ নিজেকে সামলে বলে,
“তাহলে কি করে ঠকালেন বলুন তো?”
“আমায় কি একবার ক্ষ..
পুরো কথা শেষ হওয়ার আগেই ফারিশ হাত দেখিয়ে থামিয়ে দেয় তাকে। বলে,“ক্ষমা শব্দটা ব্যবহার করবেন না ওটা শুনতে ইচ্ছে করছে না। আপনি বাড়ি যান।”
আদ্রিতা গেল না। আদিবের গাড়ি আসলো তখন। ফারিশ তাদের গাড়িটা দেখতে পেয়েই ছুটে গেল সেদিকে। আদ্রিতা তার পানে চেয়ে। অতঃপর আর কোনো কথা না বাড়িয়েই চলে গেল ফারিশ আর আদিব। আদিব আদ্রিতাকে দেখলেও কিছু বললো না। চুপচাপ চলে গেল।’
আদ্রিতা বিস্মিত মন ভাঙা মন নিয়ে দাঁড়িয়ে। চোখ বেয়ে দু’ফোটা পানি গড়িয়ে পড়লো নিচে।’
—
আজ মৃদুলের বিয়ে! তুমুল হইচই আর গানবাজনা হচ্ছে বাড়ির ভিতর। বড় বড় বাস ভাড়া করা হয়েছে বরযাত্রীদের যাওয়ার জন্য। মৃদুলদের জন্য স্পেশাল ফুল সাজানো গাড়ি। সেই গাড়ি করে যাবে আদ্রিতা,মুনমুন, রনি,আশরাফ, মৃদুল আর চাঁদনী। গাড়িটা বড়সড়। আদ্রিতা ভাড়ি একটা লেহেঙ্গা পড়েছে। চুলগুলো খোলা। মুখে মলিন হাসি ঝুলছে। বাকিরাও সেজেছে খুব। মৃদুলের কাজিনকুজিনও আসছে পিছনের গাড়ি করে। মৃদুল ওরা গাড়িতে বসতেই গাড়ি চলতে শুরু করলো। মৃদুল টিস্যু দিয়ে নিজের মুখটা মুছতে মুছতে বললো,“দোস্তরা আমার না খুব নার্ভাস লাগছে! গাড়ি থাইক্যা নাইম্যা যামু নি।”
আশরাফ চোখ কুঁচকে ফেললো। সে গাড়ি চালাচ্ছে। আশরাফ লুকিং গ্লাস দিয়ে এক পলক মৃদুলকে দেখে বললো,“মৃদুলের বাচ্চা সেদিনের মতো যদি আজকেও অজ্ঞান-টজ্ঞান হোস তো দেখিস। বাড়ি এসে তুমুল পিডামু।”
আশরাফের কথা শুনে গাড়ি কাঁপিয়ে হাসলো সবাই। আদ্রিতাও হাসলো খানিকটা। মৃদুল কাচুমাচু হয়ে বললো,“ওইদিন কি আমি ইচ্ছা কইরা অজ্ঞান হইছিলাম নি। ওটা তো জাস্ট এক্সিডেন্ট ছিল।”
“ওই এক্সিডেন্টই আজ যেন না ঘটে চান্দু”–রনির গম্ভীর আওয়াজ।”
“এই তোরা থামবি বেচারা বিয়ে করতে যাচ্ছে এত শাসন না করলেও চলবে।” –চাঁদনী কথাটা বলে মৃদুলের কাঁধে হাত দিলো।’ মৃদুল মায়াভরা দৃষ্টি নিয়ে তার পানে চেয়ে রইলো। যেন এই মুহূর্তে তার সবচেয়ে বন্ধুই হচ্ছে চাঁদনী।”
প্রচুর হুল্লোড় আর হাসি তামাশা নিয়ে গাড়ি ছুটে চললো মৃদুলের শশুর বাড়ি। আদ্রিতাও নিজেকে তাদের মধ্যে জড়িয়ে নিল।’
পাক্কা দু’ঘন্টা পর গাড়ি এসে থামলো আহসান মঞ্জিলের সামনের। আহসান নীলিমার বাবার নাম। মৃদুলদের গাড়ি দেখেই কেউ একজন ছুটে গেল ভিতরে চিল্লাতে চিল্লাতে বললো,“বর আইছে, বর আইছে।”
মৃদুলের বুকটা কেঁপে উঠলো আচমকা। সে বুকে হাত দিয়ে বললো,“আমার কইলজা কাফে ভাই।”
আদ্রিতা মাথায় চাটি মারলো তার। বললো,“এত নাটক করিস না। ভাবি বইসা আছে।”
ভাবির কথা শুনতেই মৃদুলের মাঝে সাহস চলে আসলো। বেশ ভাব নিয়ে বললো মৃদুল,“প্রথমবার বিয়ে করছি না একটু নাটক না করলে চলে।”
আশরাফ হেঁসে বললো,“বুঝচ্ছি। এবার চল হাঁদা।”
গেটের কাছে আসতেই বাঁধায় এসে দাড়ালো নয়নতারাসহ আরো কিছু মেয়েপক্ষরা। তাদের একটাই কথা বিশ হাজার টাকা না দিলে জামাইকে ভিতরে ঢুকতে দিবে না। তা নিয়ে বেশ তর্কাতর্কি হচ্ছে আশরাফ আর নয়নতারা মধ্যে। আর বাকিরা মজা নিচ্ছে।’
—
রুম জুড়ে আধার। ঘুটঘুটে অন্ধকার বলে যাকে। অথচ বাহিরে তীব্র রোদ। বদ্ধ একখানা রুম। চেয়ারে বসে আছে কেউ, হাতে খালি মদের গ্লাস। গায়ের জড়ানো ধূসর রঙের পাঞ্জাবি। মুখ ভর্তি দাঁড়ি, কুচকুচে কালো চোখ, গায়ের রঙ ফর্সা, সুঠাম দেহের অধিকারী এক সুদর্শন পুরুষ বলা যায়। তীব্র সেই অন্ধকারে বসে আছে লোকটি। রকিং চেয়ারে দুলছে। হঠাৎ মোবাইল বাজলো তার। চেয়ারের পাশে থাকা ছোট্ট টি-টেবিলটার ওপরে ফোনটার লাইট জ্বলছে। লোকটা বিরক্ত হলো। নীরবতার ভিড়ে হঠাৎ ঝনঝাল তার পছন্দ হয় নি। লোকটা ফোনটা তুললো না। সেকেন্ড টাইম বাজতেই একরাশ বিরক্ত নিয়ে ফোনটা তুললো। কিছু বলার পূর্বেই অপরপাশে থাকা লোকটা আতঙ্কিত কণ্ঠে বললো,“বস দেড়শো মেয়ের মধ্যে একটা মাইয়া কম পড়ছে।”
মুহুর্তের মধ্যে মেজাজ তুঙ্গে উঠলো তার। তীব্র রাগ নিয়ে তীক্ষ্ণ স্বরে আওড়ালো,“কি করে কমলো?”
অপরপাশের মানুষটি ভয়ে ভয়ে বললো,“বস গলায় চাকু দিয়া পোঁচ দিছে নিজে নিজেই।”
লোকটি কিছু বললো না। চুপ থাকলো অনেকক্ষণ। এরপর শান্ত গলায় বললো,“কালকের মধ্যে নতুন মেয়ে চাই আমার। বুঝেছো লতিফ!”
লতিফ মাথা নাড়িয়ে বললো,“দেখতাছি বস, দেখতাছি।”
ফোন কেটে গেল। পাঁচ মিনিট সব চুপ। এরপরই ড্রয়ার থেকে ম্যাচের কাটি বের করলো লোকটি। একটা জ্বালিয়ে কাছের মোমবাতিটি জ্বালালো। বিশ্রী এক হাসি দিয়ে বললো,“ফারিশ, আমি যে ফিরে এসেছি এবার তোর কি হবে? প্রতিশোধের আগুন যে এবার দাউদাউ করে জ্বলবে।”
কথাটা বলেই হাসতে লাগলো লোকটি। ঘর কাঁপানো এক ভয়ংকর হাসি।’
—-
তখন নিরিবিলি বিকেল। ফারিশ বসে আছে তার সিঙ্গেল সোফায়। চোখে মুখে বিষণ্ণ ভাব। আদিব আসলো তখন। পাশে বসে বললো,“ভাই একটা খবর আছে?”
ফারিশ তাকালো আদিবের দিকে। বললো,
“কি খবর?”
“আরশাদ জেল থেকে পালিয়েছে।”
ফারিশ অবাক হলো না মোটেও। এ খবর সে আরো দু’মাস আগে জেনেছে। অথচ আদিব জানছে আজকে। ফারিশ শান্ত স্বরে বললো,“জানি আমি।”
আদিব ভয়ার্ত কণ্ঠে বললো,“এবার কি করবেন ভাই?”
ফারিশের তড়িৎ উত্তর,
“যেখান থেকে পালিয়েছে সেখানেই পাঠাবো।”
“আপনার ক্ষতি করতে চাইলে,
“ভয় পেও না কিছু হবে না।”
হঠাৎই প্রসঙ্গ পাল্টে ফারিশ বললো,
“তুমি কি চাঁদনীর সাথে যোগাযোগ রাখছো না আদিব?”
আদিব একটু ভড়কায়। পরমুহূর্তেই নিজেকে সামলে তড়িৎ জবাব দেয়,“না।”
#চলবে…
#TanjiL_Mim♥️.