এক পশলা ঝুম বর্ষায় পর্ব-৩৪+৩৫

0
439

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৩৪

নিস্তব্ধ চারপাশ। পিনপিনে নীরবতা বিরাজ করছে পুরো পরিবেশ জুড়ে। এই শীত সমৃদ্ধ পরিবেশেও আদ্রিতা ঘামছে। তার শরীর চুইয়ে বুঝি ঘাম ঝড়ছে। গরমে বিতৃষ্ণা লাগছে। আদ্রিতা নড়ে চড়ে উঠলো। খানিকটা থমকানো কণ্ঠস্বরে বললো,“এসব আপনি কি বলছেন?”

ফারিশের ঠোঁট জুড়ে তখনও মলিন হাসি। ভিতরটা যেন একটু একটু করে খন্ড খন্ড হচ্ছিল। ফারিশ করুণ চোখে প্রশ্ন করলো,“আপনি বুঝতে পারেন নি?”

আদ্রিতা নিশ্চুপ কি বলবে বুঝচ্ছে না। হঠাৎই ফারিশের নজরে আসলো আদ্রিতার ফোনের দিকে। কিছু একটা চলছে। ফারিশ আচমকাই খপ করে আদ্রিতার হাত থেকে ফোনটা নিলো। আদ্রিতা চমকে উঠলো। বিস্ময় নিয়ে কিছু বলবে তার আগেই ফারিশ দেখলো রেকর্ডার অন করা। রেকর্ড হচ্ছিল কতক্ষণ আগের তার আর আদ্রিতার কথা বলার মুহূর্তগুলো। এবার যেন আদ্রিতা পুরোদমে থমকে গেল। ঘাবড়ে গেল পুরো। ফারিশ মোবাইলটা দেখিয়ে বললো,“আমায় আপনি ভালোবাসেন নি আদ্রিতা। আমি বুঝতে পেরেছি। আমার সম্পর্কে জানার জন্য এত নিখুঁত অভিন..।”

ফারিশ চুপ হয়ে গেল। তার নিশ্বাস আঁটকে আসছে। কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে। বিশ্বাস করতেও খারাপ লাগছে এতদিন যাবৎ যে মেয়েটাকে নিয়ে এত এত স্বপ্ন দেখলো ফারিশ। নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন। ছোট্ট সংসার পাতার স্বপ্ন। অথচ যাকে নিয়ে দেখলো সেই মেয়েটা নাকি তাকে ভালোবাসে নি। শুধুমাত্র তার সম্পর্কে জানার জন্য অভিনয় করে গেল।’

ফ্লাসবেক…

চাঁদনীর সাথে সময় কাটিয়ে আদিব যখন বেরিয়ে আসতে চায় হসপিটাল থেকে সেই মুহুর্তেই আদিব দেখতে পায় পুলিশ অফিসার কিশোরকে। যে কি না আদ্রিতার চেম্বারে ঢুকে। আদিব কৌতুহলী এগিয়ে যায় চেম্বারের দিকে।

অন্যদিকে,
আদ্রিতা বাহিরে ফারিশের কাছে যাবে সেই মুহূর্তেই কিশোরকে দেখলো। কিশোর ভিতরে ঢুকেই বললো,“কেমন আছেন ডাক্তার সাহেবা?”

আদ্রিতা বেশ অবাক চোখে তার পানে তাকালো। বললো,“আপনি এখানে?”

কিশোরের মুখ হাসি হাসি। আদ্রিতার সাজগোছ দেখেই মিষ্টি হাসলো সে। বললো,“মাফিয়া সাহেবকে তো ভালোই পটিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু তার সম্পর্কে এখনও তো কোনো প্রমাণ পেলাম না।”

আদ্রিতা তখনই বলে,“আমি চেষ্টা করছি তো অফিসার। উনি কাল থেকে কিছু বলবে বলবে বলেও বলছেন না। কাল রাতে ভেবেছিলাম বলবে মোবাইলে রেকর্ড করার জন্য রেকর্ডারও অন করেছিলাম কিন্তু উনি কিছু বলেন নি। অথবা বলতে পারেন নি। দেখুন সেই কক্সবাজার থেকে আমায় আপনারা বিরক্ত করছেন। আমার এখন মনে হচ্ছে আপনার কথা শোনা আমার উচিত হয় নি।”

আদ্রিতার রাগ উঠলো। শুধুমাত্র এই অফিসারের কাজে হেল্প করার জন্য ফারিশের জীবনে ঢুকে আদ্রিতা। কক্সবাজারের সেই ক্যান্সারের কথা বলা লোকটাও মিথ্যে ছিল সে আসলে এই কিশোরের একজন লোক ছিল। সেই আদ্রিতাকে বলে ফারিশ একজন মাফিয়া। দেশ বিরোধী মাফিয়া। কিন্তু তাদের কাছে কোনো প্রমাণ নেই। ফারিশের পাওয়ার আর বুদ্ধিমত্তার কাছে বার হেরে যায়। যার কারণে তারা তাকে ধরতে পারছে না। এখন আদ্রিতা যেন তাদের সাহায্য করে। কারণ তারা দেখেছে ফারিশ একটু হলেও আদ্রিতার প্রতি উইক। আদ্রিতা শুরুতে এসবে রাজি হতে চায় নি। কিন্তু পরে কিশোরের অনেক অনুরোধের পর রাজি হয়। ভালোবাসাটাকে নোংরাভাবে ব্যবহার করার জন্য আদ্রিতার নিজের দিকে তাকাতেও এখন লজ্জা লাগে।

কিশোর আশপাশ দেখে বললো,“কুল ডাউন ডাক্তার সাহেবা। পারেন নি কিন্তু পারবেন। আমার মনে হয় আজই ফারিশ আপনায় সব বলবে।”

উত্তরে আদ্রিতা কিছু বলে না।’
এদিকে দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে থাকা আদিব সব শুনে যেন স্তব্ধ হয়ে গেল। তার নিজেরই বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে ডাক্তার ম্যাডাম ফারিশ ভাইয়ের সাথে অভিনয় করেছে। আদিব টের পেল আদ্রিতা চেম্বার থেকে বের হচ্ছে সঙ্গে সঙ্গে সে আড়াল করে দূরে গিয়ে দাঁড়ালো। এরপর কিশোরও বের হলো। আদিব হন্তদন্ত হয়ে যায় কি করবে না করবে বুঝতে বুঝতে সে কল করে ফারিশকে। কিন্তু ফারিশ তার কথা না শুনে একা একাই সব বলে কেটে দেয়। এরপর থেকেই আদিব লাগাতার কল করে ফারিশকে। কিন্তু ফারিশ তোলে না। অতঃপর একান্নবারের কলটা তোলে। আর সব শেষ।’

ফ্লাসবেক ওভার…

নির্বিকার চাহনি নিয়ে ফারিশ তাকিয়ে আছে আদ্রিতার দিকে। আদ্রিতার চোখে মুখে ভয়। সে বুঝতে পারে নি। আচমকাই ফারিশ সব জেনে। আদ্রিতা মাথা নুইয়ে রইলো। ফারিশ অসহায় কণ্ঠস্বরে বলে,“এমনটা কেন করলে আদ্রিতা? আমাকে জানার জন্য আর কি কোনো পথ ছিল না?”

আদ্রিতা চোখ তুলে তাকালো ফারিশের দিকে। ফারিশ আবার তাকে তুমি করে বলছে। অথচ এই তুমির মাঝে কোনো ভালোবাসা নেই আছে ঘৃণা। আদ্রিতা জবাব দেয় না। ফারিশ আবার বলে,“কেন করলেন এমনটা?”

আদ্রিতা নিরুত্তর। ফারিশের চারপাশ বুঝি ঘুরছে। তার মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। বিষয়টা কোনোভাবেই মানতে পারছে না। ফারিশ শক্ত করে আদ্রিতার দু’হাত চেপে ধরলো। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললো,“আমার দিকে তাকান।”

আদ্রিতা তাকায়। ফারিশের চোখদুটো রক্তলাল বর্ণ ধারণ করছে। আদ্রিতা তাকাতে পারছে না। নিজেকে বড্ড অপরাধী লাগছে। তাও আদ্রিতা তাকালো। ফারিশ বললো,“কেন করলেন এমন? আমার ভালোবাসা তো মিথ্যে ছিল না। আমি তো সত্যি সত্যিই আপনায় ভালোবেসেছিলাম। এই হৃদয় দিয়ে ভালোবেসেছিলাম। কিন্তু আপনি এমনটা কেন করলেন?”

আদ্রিতা নিরুপায় কণ্ঠস্বর,
“পুলিশ আমায় বাধ্য করেছিল।”
“একটা মানুষকে ঠকাতে কষ্ট লাগলো না কোনো।”

আদ্রিতা কি বলবে বুঝচ্ছে না। ফারিশ পুনরায় আওড়ায়,“ভালো না বাসার ইচ্ছে যখন ছিল। তখন না বাসতেন এত অভিনয়ের কি দরকার ছিল?”

আদ্রিতা মাথা নিচু করে রয়। ফারিশ আদ্রিতার হাত ছেড়ে দেয়। অনেকক্ষণ চুপ থেকে জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলে। বুকের বামপাশটা দেখিয়ে বলে,
“আমার ভেতরটা ছারখার হয়ে যাচ্ছে আপনি কি টের পাচ্ছেন?”

আদ্রিতার বুক কেঁপে উঠলো সে কথা শুনে। চোখে পানি টলমল করছে। নিজেকে শক্ত রাখা যাচ্ছে না। ফারিশ আর কথা বাড়ালো না। শক্ত কণ্ঠে বললো,“নামুন।”

আদ্রিতা চাইলো ফারিশের দিকে। ফারিশ সরাসরি আদ্রিতার দিকে তাকিয়ে বললো,“আমার গাড়ি থেকে নামুন।”

আদ্রিতা কোনোরকম কাঁপা কাঁপা স্বরে বললো,“ফা..রি

পুরোটা শেষ করার আগেই ফারিশ ভয়ংকর রেগে গিয়ে কর্কশ কণ্ঠে বলে,“আপনার ওই মুখে আমি আমার নাম শুনতে চাই না। বের হন দ্রুত।”

ফারিশের হুংকার শুনে আদ্রিতা আর বসে থাকতে পারলো না। দ্রুত গাড়ি থেকে নামলো। ফারিশ বললো,“নিজের ভালো চাইলে আর কোনোদিন আপনার মুখ আমায় দেখাবেন না। ভালো থাকুন সবসময়।”

কথাটা বলেই ফারিশ আর এক মুহূর্তও দাঁড়ালো না। দ্রুত স্পিড বাড়িয়ে গাড়ি নিয়ে চলে গেল দূরে -সূদুরে। আদ্রিতায় ঠায় দাঁড়িয়ে। তার কষ্ট হচ্ছে। বুক ফেটে যাচ্ছে। জ্বালাপোড়া করছে ভিতরে। আদ্রিতা বুকে হাত দিলো। বিড় বিড় করে বললো,

“এত তো কষ্ট হওয়ার কথা ছিল না আদু। তুই তো শুরুই করেছিলি অভিনয় দিয়ে। তবে কি অভিনয় করতে গিয়ে সত্যি সত্যিই ভালোবেসে ফেলেছিস ফারিশকে।”

আদ্রিতা আচমকা কেঁদে উঠলো। পরিবেশ তখন প্রবল বেগের বাতাসের ধাক্কায় কাঁপছে। নদীর স্রোতও বইছে অহরহ। সঙ্গে নামছে অন্ধকার। ঘনকালো অন্ধকার।’
—-
রাত তখন আটটা। হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি ঢুকছে আদিব। তার ফারিশ ভাই কোথায় জানার জন্য মনটা ছটফট করছে। ফারিশ তাকে বলেছিল আদ্রিতাকে নিয়ে কোথাও ঘুরতে যাবে। একটা সুন্দর বিকেল করবে। কিন্তু কোথায় যাবে তা বলেনি। তবুও আদিব ঢাকার অনেক জায়গায় গিয়েছিল কিন্তু ফারিশকে পায় নি। শেষমেশ হতাশ হয়ে বাড়ি আসলো। আদিব বাড়ির সদর দুয়ার খোলা দেখেই বুঝতে পারলো ফারিশ বাড়িই এসেছে। আদিব দ্রুত পা চালিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠলো। ফারিশের রুমের দরজা খোলা। আদিব দৌড়ে ঢুকলো ভিতরে। বুক কেঁপে উঠলো তার। পুরো কক্ষের জিনিসপত্র ভেঙেচুরে তছনছ করে ফেলেছে ফারিশ। কোথাও কোথাও রক্তের ফোটাও দেখা যাচ্ছে। আঁতকে উঠলো আদিব। পুরো রুমেও চোখ বুলিয়ে ফারিশকে দেখা গেল না। আদিব একটু একটু করে এগিয়ে গেল বেলকনির দিকে। বেলকনির কাছে গিয়ে চোখ দিতেই আরো চমকে উঠলো। ফারিশ পুরো অগোছালো ভঙ্গিতে নিচে বসে আছে। হাত দিয়ে টপটপ করে রক্ত পড়ছে। পাশেই মদ আর সিগারেট। ফারিশ মদ খাচ্ছে আবার। গত একমাস যাবৎ ফারিশ এগুলো সব ছেড়ে দিয়েছিল। আদ্রিতার মিথ্যে ভালোবাসা তাকে একটু একটু করে ভালো বানাচ্ছিল। ফারিশ নামাজ পড়াও শুরু করেছিল।’

আদিবের চোখ ভেসে উঠলো। সে দৌড়ে ফারিশের পাশে বললো। অসহায়ত্ব নিয়ে বললো,“ভাই।”

ফারিশ নির্বিকার ভঙ্গিতে আদিবের দিকে তাকালো। শান্ত স্বরে বললো,“তুমি এসেছো আদিব। এত দেরি করলে যে,

আদিবের চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। ফারিশ বললো,
“আরে তুমি কাঁদছো কেন আমি ঠিক আছি।”
“তুমি ঠিক নাই ভাই।”

ফারিশ মদের গ্লাসে চুমুক দিলো। বললো,“আমি ঠিক আছি আদিব।”

আদিব আবারও বললো,
“তুমি ঠিক নাই ভাই।”
“আমি খুব বোকা তাই না আদিব। না হলে একটা মেয়ে এতদিন যাবৎ আমার সাথে মিথ্যে ভালোবাসার নাটক করলো আর আমি শালার ধরতেই পারলাম না।”

আদিব ড্রিংকের গ্লাসটা হাতে নিয়ে বললো,
“ভাই আমার রুমে চলো আজ তুমি ওইখানেই ঘুমাবে।”
“আমি খুব বোকা তাই না আদিব।”

আদিবের বুক কেঁদে ওঠে। সে বলে,
“তুমি বোকা নও ভাই।”

ফারিশ আচমকাই জড়িয়ে ধরে আদিবকে। আদিব হতভম্ব হয়ে যায়। ফারিশ বলে,
“আমার খুব কষ্ট হচ্ছে আদিব। আমি নিতে পারছি না। আমার বুকটা ফেঁটে যাচ্ছে। তুমি আমার বুকে গুলি করো আদিব।”

আদিব যেন পুরোদমে থমকে গেল ফারিশের কথা শুনে। এই কোন ফারিশকে দেখছে। আদিব কান্নাভেজা কণ্ঠেই বললো,“ভাই এভাবে বলবে না। তোমার কিছু হয়ে গেলে আমি কি নিয়ে থাকবো।”

ফারিশ জবাব দেয় না। কতক্ষণ পর আবার আওড়ায়,“ও আমায় ভালোবাসে নি আদিব। ও আমায় ভালোবাসে নি। আমার নিজেকে পাগল পাগল লাগছে। মনে হচ্ছে আমি যেন পুরোটাই শেষ হয়ে গেলাম।”

ফারিশের নেশা হয়ে গেছে। শরীরের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আদিব বহুকষ্টে তাকে ধরে দাঁড় করালো। এগিয়ে যেতে যেতে বললো,“সব ঠিক হয়ে যাবে ভাই। সব ঠিক যাবে।”

ফারিশ মাতাল স্বরে আবারও শুধায়,“ও আমায় ভালোবাসে নি আদিব,ও আমায় ভালোবাসে নি।”

#চলবে…

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৩৫

পৃথিবী তখন গভীর ঘুমে মগ্ন। গাঁ কাঁপা এই শীতে বেশিরভাগ মানুষই ল্যাপকম্বল জড়িয়ে শান্তির ঘুম ঘুমাচ্ছে। অথচ ঘুম নামক এই শান্তির ভিড়ে অশান্তি নিয়ে বেলকনিতে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আদ্রিতা। তার ভিতর পুড়ে ছারখার হচ্ছে। ফারিশের সেই ঘৃণা ভরা চোখ। নিশ্বাস আঁটকে আসার মুহূর্ত। কথা বলার ধরণ, কণ্ঠস্বর সব আদ্রিতাকে ধ্বংস করে দিচ্ছে। আদ্রিতা বুঝতে পেরেছে, সে কাজটা ঠিক করে নি। পুলিশের কথা শুনে ফারিশের সাথে অন্যায় করেছে। ভুল করেছে, না ভুল নয় ভয়ংকর অপরাধ। যে অপরাধের ক্ষমা নেই। আদ্রিতার চোখ বেয়ে পানি পড়ছে। আদ্রিতা ফারিশকে সত্যিই ভালোবাসে। শুরু থেকেই ফারিশকে তার ভালো লাগতো। তার কথা বলার ধরণ, হঠাৎ করে রাগ দেখানো। সব। কক্সবাজারের কিছু মুহূর্তও তার পছন্দের। বিশেষ করে রাতের সেই আলাপন। কিন্তু আদ্রিতা বুঝতে পারে নি তার ভালো লাগা আসলে ভালোবাসা ছিল। আদ্রিতার মনে পড়লো কক্সবাজার থেকে সেই ফেরত আসার দিনটা। সোহেল গাড়ি আনতে লেট করায় তাকে কল করে তখন একটা লোক আদ্রিতাকে প্রশ্ন করে “আপনি ডক্টর আদ্রিতা তো?”

আদ্রিতা তক্ষৎনাৎ পিছন ঘুরে চায়। অনাকাঙ্ক্ষিত লোকটিকে দেখতে পেয়ে বলে,“জি। আমি ডক্টর আদ্রিতা।”

তখনই লোকটি বলে,“আসলে ম্যাডাম আমার বাবার বিষয়ে কিছু কথা ছিল।”

আদ্রিতা তখনও বুঝতে পারে নি লোকটি আসলে একজন পুলিশ ছিল। বাবার ক্যান্সারের কথা বলে আদ্রিতা আর সেই লোকটি গিয়ে বসে আধ ফাঁকা এক রেস্টুরেন্টে। যেহেতু সোহেল আসতে লেট করছিল তাই আর বারণও করতে পারে নি আদ্রিতা। তখনই লোকটি বলে,
“সরি ম্যাম পাবলিক প্লেসে কথাগুলো বলা যেত না তাই মিথ্যে বলে এখানে আনা লাগলো”

আদ্রিতা বেশ অবাক হয়ে বলে,“মানে?”
লোকটি দ্রুতই বলে,“আসলে ম্যাডাম আমি একজন পুলিশ। গত তিনদিন যাবৎ আপনায় যে লোকটার সাথে দেখা যাচ্ছে ফারিশ মাহমুদ। আপনি কি জানেন উনি কে?”

আদ্রিতা বিনাদ্বন্দে বলে,“জি। জানি। উনি একজন ঔষধ কোম্পানির মালিক।”

লোকটি হাসে। বলে,“না আপনি ভুল জানেন উনি আসলে একজন মাফিয়া। দেশ বিরোধী মাফিয়া। ওনার অনেকগুলো বেআইনি কারখানা আছে। এই ধরনের নানা কিছু বলে আদ্রিতাকে।”

কিন্তু আদ্রিতা মানতে চায় না। আদ্রিতাকে অনেক অনুরোধ করা হয়। শেষমেশ উপায় না পেয়ে রাজি হয়। আদ্রিতা কাজটা করার সময়ও জানতো না ফারিশ সত্যিই একজন মাফিয়া। এমনকি গত দু’দিন আগেও ধরতে পারে নি। সে ভেবে নিয়েছিল পুলিশগুলো তাকে মিথ্যে বলেছে। ফারিশ খারাপ মানুষ নয়। হয়তো সন্দেহের বসে ওসব বলছে। আদ্রিতা ফারিশের সাথে অভিনয় করবে ভেবে মিশলেও। তার করা আচরণ। কোনোটাই অভিনয় ছিল না। যা করেছে সব মন থেকে। মাঝরাতে ফারিশের সাথে ঘুরতে যাওয়া, ফোনে কথা বলা, ফারিশের জন্য কালকের সাজার মুহুর্তটা সব মন থেকে করা। আদ্রিতা বুঝতেই পারে নি সে এতদিন অভিনয় করে নি। সত্যিই ভালোবেসেছিল ফারিশকে। ফারিশের প্রতি তার অনুভূতি কোনোটাই মিথ্যে ছিল না। কিন্তু এগুলো এখন ভেবে কোনো লাভ নেই আদ্রিতা এবার যতই ফারিশকে বোঝাক ফারিশ তাকে বিশ্বাস করবে না। কোথাও গিয়ে আদ্রিতা অন্যায় তো করেছে। ফাস্টলি বাংলো বাড়ির ঠিকানা আদ্রিতাই কিশোরকে দেয়। তারা পুরো বাড়ি খোঁজ করে কিন্তু কিছুই পায় না। আদ্রিতা তা শুনে খুশি হয়। অনেক কিছু বলেও কিশোরকে। ফারিশের বলা কথাগুলো আদ্রিতা সিরিয়াস নেয় নি প্রথমে কিন্তু ফারিশের বলা গাড়িতে বসে কথাগুলোর মধ্যে পপিগাছ– এটা আদ্রিতাকে ভাবাচ্ছে। পরে ভাবছে পপিগাছ থেকে পাওয়া একটা অংশ যা ‘মরফিন’ নামে পরিচিত যা দিয়েই ঔষধ বানানো হয়। এখানে খারাপের কিছু নেই।”

আদ্রিতা চোখ খুলে চাইলো। তার নিশ্বাস আটকে আসছে। দম বন্ধ হওয়ার মতো অনুভূতি হচ্ছে। আদ্রিতা ভেবেছিলাম ফারিশের কথার মধ্যে যদি মাফিয়া-টাইপ কিছু না থাকে তবে কিশোরকে তা দেখিয়ে শাসাবে। কিন্তু তার আগেই সব শেষ। ফারিশের কথাও আর শোনা হলো না।’

আদ্রিতা নীরবে চোখের পানি ফেললো। আদ্রিতার ফোন বাজলো তখন। এতরাতে কল। আদ্রিতা হেঁটে তার রুমের মধ্যে গেল। ঘড়িতে দু’টো ছাড়িয়ে। কলটা কেটে গিয়ে আবার কল বাজলো। কিশোর কল করেছে। আদ্রিতার চরম বিরক্ত লাগলো। কিশোর সবসময় এই টাইমেই কল করে। কারণ সে জানে আদ্রিতা বেশির ভাগ সময়ই এই টাইমে তার চেম্বারের থাকে। আদ্রিতা প্রথমে কলটা তুলবে না ভাবলো। কিন্তু পরে আবার তুললো। বিরক্ত নিয়ে বললো,“হ্যালো।”

ওপাশ থেকে কিশোরের কণ্ঠ শোনা গেল। সে বললো,“কিছু কি পেয়েছেন ডাক্তার সাহেবা?”

আদ্রিতা তেতে উঠলো,“কি পাবো বলুন তো। শুধুমাত্র আপনাদের জন্য একটা মানুষের সাথে আমি বেইমানি করেছি। শুধুমাত্র আপনাদের জন্য তাকে আমি কাঁদিয়েছি। ফারিশ কোনো মাফিয়া নয়। বুঝতে পেরেছেন সে কোনো মাফিয়া নয়। আর হ্যা ফারিশ সব জেনে গেছে। আমি যে আপনাদের কথা শুনে তার জীবনে ঢুকেছিলাম সব জেনে গেছে। আর ফোন দিবেন না আমায়। আবারও বলছি ফারিশ কোনো মাফিয়া নয়। তার পিছনে না ছুটে যে আসল দোষী তাকে ধরুণ।”

কল কেটে দিলো আদ্রিতা। মোবাইলটা ছুড়ে মারলো খাটে। তার কিছু ভালো লাগছে না। সবকিছু ভেঙেচুরে তছনছ করে দিতে ইচ্ছে করছে।’
—-
বছরের শেষ দিন আজ। আজকের দিন পেরিয়ে রাত বারোটা পার হলেই নতুন বছরের আগমন হবে আর পুরনো বছরের ছুটি। ফারিশ ঘুমোচ্ছে। গভীর ঘুমে মগ্ন সে। কাল আদিব তাকে নিয়ে আসে আদিবের ঘরে। বিছানায় শুয়ে দেয়। কম্বল জড়িয়ে দেয় গায়ে। কনকনে শীতের মাঝে কম্বলের ছোঁয়া লাগতেই ক্লান্তিত দেহখানা নিস্তেজ হয়ে পড়ে বিছানায়। ফারিশ ঘুমিয়েছে টের পেতেই আদিব চলে যায় ফারিশের রুমে। তছনছ করা রুমটা সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।’

সূর্যের প্রখর তেজে ফারিশের ঘুমটা ভাঙতে থাকে হঠাৎ। কিছু একটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আদ্রিতার সেই ঠোঁট, না ঠোঁট নয়। ঠোঁটের জড়ানো কথা। আদ্রিতার পলকহীনভাবে তার দিকে তাকিয়ে থাকা, কনকনে শীতে আদ্রিতার কোলে শুয়ে থাকার সুন্দর মুহূর্তটা। কালকের সেই ভয়ংকর মুহূর্ত, কক্সবাজার থেকে ফেরার মুহূর্ত, রেস্টুরেন্টে খাওয়া,আদ্রিতাকে কোলে তোলা। সবই ফারিশের চোখের সামনে ভেসে উঠলো। কিন্তু এসবের মাঝেও কিছু একটা নজরে আসলো ফারিশের তা হলো আদ্রিতার চোখ। কি মায়াবী সেই চোখ জোড়া। ফারিশের আচমকা মনে হলো,“এত সুন্দর মায়াবী চোখজোড়াও কি ফারিশের সাথে মিথ্যে খেলা খেললো।”

আচমকাই চোখ খুলে চাইলো ফারিশ। আশপাশটা দেখতে লাগলো খুব। বুঝলো আদিবের রুমে সে শুয়ে আছে। ফারিশ শোয়া থেকে উঠে বসলো। মাথা তার ভাড় হয়ে আছে। মুখ থেকে মদের গন্ধ আসছে। ফারিশ কতক্ষণ নিজের মাথা চেপে ধরে বসে রইলো। মুখ থেকে অস্পষ্টনীয় কণ্ঠে বললো,“আমাকে ভেঙে দেয়ার জন্য দারুণ পথ বেছে নিয়েছিলেন ডাক্তার ম্যাডাম। কিছুটা সফলও হয়েছেন বলা যায়।”

ফারিশ হেঁসে ফেলে। ফারিশকে ভেঙে দেয়া সত্যিই কি খুব সোজা। কালকের দিনটা তার বিষাক্ত ছিল। কিন্তু আজকের সকালটা তা নয়। ফারিশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে নিজেকে বুঝায়,“জীবন তো কম আঘাত দেয় নি ফারিশ। তোর তো ফুলহীন একটা বাগান ছিল,অথচ সেই বাগানে সামান্য একটা ছোট্ট ছুরি এসে তছনছ করে দিলো। কিন্তু ছুরি তো জানে না। ফারিশের ফুলহীন বাগান কতটা শক্তপোক্ত আর চওড়া। এক ছুরি দিয়ে তো একদিনের মধ্যে বাগান শেষ করা যাবে না।”

ফারিশ গম্ভীর এক আওয়াজে আদিবকে ডাকলো। বললো,“আদিব…

আদিব তখনই দৌড়ে আসলো। কিচেনে কাজ করছিল। আদিব বললো,“কি হয়েছে ভাই?”

ফারিশ তাকালো আদিবের দিকে। স্বাভাবিক কণ্ঠে বললো,“গাড়ি বের করো খুলনার ফ্যাক্টরিতে যাবো?”

আদিব বেশ বিস্মিত হয় বলে,“আজই যাবেন ভাই?”
ফারিশ বিছানা ছেড়ে নামতে নামতে বলে,“হুম।”
—-
নিজের চেম্বারের চুপচাপ বসে আছে আদ্রিতা। মনমরা লাগছে নিজেকে। তখনই ঝড়ের বেগে তার চেম্বারে ঢুকলো আশরাফ, মুনমুন, মৃদুল, রনি আর চাঁদনী। মৃদুল তো চেঁচিয়ে বললো,“উড়ে দোস্ত বিয়া খামু?”

ওর কথা শুনে হেঁসে ফেললো সবাই। আশরাফ মৃদুলের মাথায় চাটি মেরে বললো,“আরে হাঁদা তুই বিয়া করবি বিয়া তো খামু আমরা।”

মৃদুল দাঁত কেলিয়ে বলে,“ওই একই হইলো। তোগো চাইয়া বেশি খামু আমি। ইয়া ইয়া মুরগীর রোস্ট।”

মৃদুলের কথায় আবারও হাসলো সবাই। শুধু হাসলো না আদ্রিতা। কারণ সে তো মগ্ন অন্যকোথাও!’

#চলবে….

[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ]

#TanjiL_Mim♥️.গল্পের

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে