এক পশলা ঝুম বর্ষায় পর্ব-৩০+৩১

0
448

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৩০

সময়ের স্রোতে ভাসমান প্রকৃতি। মাঝে দিন পেরুলো অনেকগুলো। প্রায় মাসের কাছে ছুঁই ছুঁই। নতুন বছর আসতে খুব বেশি দেরি নেই। হাতে গোনা দু-চারদিন বাকি। ফারিশ এখন আদ্রিতাতে আসক্ত। রোজ রাতে প্রেমআলাপ। আর দু’দিন পর পর রাতের ঘুরাঘুরি। এটা একটা রুটিনে পরিনত হয়ে গেছে। আদ্রিতাকে ছাড়া ফারিশের চলে না এখন। ফারিশ চাইছে শীঘ্রই বিয়ে করতে। কিন্তু কোথাও গিয়ে দোটানায় পড়ছে। সে কি করে? সে সম্পর্কে আদ্রিতা এখনও অবগত নয়। ফারিশের ভিতর কিছুটা হলেও ভয় ঢুকেছে। আদ্রিতা তার সম্পর্কে জানলে মেনে নিবে তো। নাকি ছেড়ে চলে যাবে। ফারিশ জেনেছে কক্সবাজারের সেই পপি গাছে ফলন হয়েছে ভালো। খুব শীঘ্রই গাছে ফল ধরবে। ফারিশ বেশ চিন্তিত। কি করা যায়! যে ভয় তার শুরুতে ছিল সেই ভয় ধীরে ধীরে বাড়ছে। বিষয়টা চেপে যাবে তাতেও শান্তি পাচ্ছে না। আবার বলে দিবে তাও পারছে না। দ্বিধাদ্বন্দে আছে খানিকটা।’

প্রকৃতি তখন দুপুরের দখলে। ক্লান্ত শরীরে গাড়িতে বসে আছে ফারিশ। আকাশ ছুঁয়ে রোদ্দুর উঠেছে তখন। ঢাকার শহরে বেশ জ্যাম আজ। যানযটে আটকা পড়েছে ফারিশ আর আদিব। আদিব ড্রাইভ করছে। তার পাশে ফারিশ। আদিব প্রশ্ন করলো,“ভাই কাশ্মীরের লোকেরা আবার মাল চাচ্ছে দিবো কি? আগেরবার দেরি করেছিলাম বলে ক্ষেপে ছিল। পরে আবার দমেও গেছে। এবার বেশি চাচ্ছে। কি করবো?”

ফারিশ দু’মিনিট ভেবে বললো,
“দিয়ে দেও।”
“আচ্ছা।”
“কারখানায় কাজ কেমন চলছে?”
“রাত একটায় একবার যাবেন ভাই।”
“আজ হবে না। কাল যাবো।”
“ঠিক আছে।”
“এখন কই যাবেন?”
“পুরনো বাড়ি যাবো।”
“আচ্ছা।”

জ্যাম কাটলো আরো দশ মিনিট পর। আদিব গাড়ি স্টার্ট দিলো। ফারিশ চুপচাপ বসে। সে প্রশ্ন করলো,“তুমি এখনও ডাক্তার ম্যাডামের বন্ধুকে প্রপোজ কেন করো নি আদিব?”

আদিব বিষম খায়। হাত অবশ হয়ে আসে। কণ্ঠনালিতে কথায় আঁটকায়। তবুও আদিব নিজেকে সামলে বলে,“আমি বলতে পারি না ভাই। আমার ভয় লাগে।”

ফারিশের গম্ভীর মুখ। চোখে মুখে বিষণ্ণ। সে হাসলো না। বেশ গভীর ভাবনা নিয়ে বললো,“তুমি কি চাচ্ছো তোমার হয়ে আমি ডাক্তার ম্যাডামের বন্ধুকে প্রপোজ করি?”

আদিব কি বলবে বুঝে না। চুপ করে রয়। ফারিশ আবারও বলে,“কালকের মধ্যে এই মামলা সেট করবে আদিব। তুমি না পারলে আমি কিন্তু দেখবো।”

আদিব তাও কিছু বলে না। কি বলবে তাও জানে না। আদিব চেষ্টা করে। বেশ কয়েকবার সে গিয়েও ছিল চাঁদনীর কেভিনে। কিন্তু মেয়েটার সামনে গেলেই আদিব চুপসে যায় এমন ভাব নেয় যেন মেয়েটাকে সে চেনেই না। প্রথম দেখছে। এই ধরনের পরিস্থিতিতে কখনো পরে নি আদিব। তাতেও সমস্যা হচ্ছে। চাঁদনী কি না কি বলে তা নিয়েও সে ডিপ্রেশনে আছে। মেয়েটার কথার যে ধাঁজ। কখন না হাত চালিয়ে বসে গালে। এ ভেবেও আদিব সাহস পায় না।’

পুরো রাস্তায় চুপ থাকলো আদিব। ফারিশও কিছু বললো না। তবে সে মনে মনে ভেবে নিয়েছে কালকেও যদি আদিব কিছু করতে না পারে তাহলে ফারিশই দেখবে বিষয়টা। নির্জন দুপুরে গাড়ি এসে থামলো সেদিনের আদ্রিতাকে নিয়ে আসা পুরনো বাংলো বাড়ির সামনে। ফারিশ বের হলো। আদিবও নামলো। সেদিনের পুড়ে থাকা ডালপালা গুলো সেখানেই লুটিয়ে পড়ে। কালো কুচকুচে রঙেই সজ্জিত তারা। ফারিশ সেদিনের পর আর এদিকে আসে নি। ফারিশ জ্বলে যাওয়া ডালগুলোতে একবার চোখ বুলিয়ে বাড়ির দরজার মুখে দাড়ায়। আশপাশ দেখে। আদিব টবের নিচে লুকিয়ে রাখা চাবিটা উঠিয়ে ঘরের দরজা খুলতে নিলো। হঠাৎই কিছু একটার আচ পেল ফারিশ। সঙ্গে সঙ্গে সে আদিবের হাত ধরে থামিয়ে দিলো দরজা খোলা থেকে। আদিব বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন ছুড়লো,“কি হলো ভাই?”

ফারিশ নিজ ঠোঁটে আঙুল দিয়ে বললো,“হুস। চুপ। এখানে কেউ আছে আদিব?”

আদিব বিচলিত হলো। ফিসফিস করে বললো,“এখানে কে থাকবে?”

ফারিশ জবাব দিলো না। আচমকাই পিঠের পিছনে লুকিয়ে রাখা পিস্তলটা হাতে নিলো। আদিব ঠায় দরজার সামনে দাঁড়িয়ে। ফারিশ আদিবকে মৃদুস্বরে বলে,“একদম নড়বে না এখানেই চুপটি করে বসে থাকবে। কেমন!”

আদিব মাথা নাড়ায়। যার অর্থ, ‘সে বসে থাকবে’। ফারিশ আস্তে আস্তে বাড়ির কর্ণারটা দেখলো কারো পদধ্বনি পাওয়া গেল। ফারিশ আচমকাই দৌড় দিলো। সঙ্গে সঙ্গে জঙ্গলের ভিড়ে লুকিয়ে থাকা কেউ আড়াল থেকে বেরিয়ে দৌড় দিলো। ফারিশ তার পিছু নিলু। লোকটি হতভম্ব হয়ে গেল। ফারিশ কাঙ্ক্ষিত লোকটিকে দেখতে পেয়েই পায়ে গুলি করতে নিলো। কিন্তু সামনে গাছ চলে আসায় লাগলো না। লোকটি গায়ে চাঁদর মুড়ি দিয়ে অনবরত দৌড়াচ্ছে। ফারিশও তার পিছনে ছুটছে। কিন্তু লোকটা একসময় পালাতে সক্ষম হলো। ফারিশ গুলি মারলো সেটা লাগলো সোজা লোকটির হাতে। তবুও পিছন ঘুরলো না। হাত চেপে বেরিয়ে আসলো সেখান থেকে। চাঁদর লুটিয়ে পড়লো নিচে।’

ফারিশ আশপাশ দেখে। বিরক্ত নিয়ে বললো,“শীট।”

ভয়ে কাচুমাচু হয়ে বসে আছে আদিব। থরথর করে কাঁপছে। গুলির শব্দ কানে আসলেই আদিব প্রচন্ড ঘাবড়ে যায়। তার শরীর দিয়ে ঘাম বের হয়। নিজেকে সামলাতে প্রায় সময় অক্ষম হয়। ফারিশ এসে বসলো তার পাশে। হাতের পিস্তল সরিয়ে বললো,“খুব ভয় পেয়েছো আদিব?”

আদিব ঘাবড়ে গেল। সে বাচ্চাদের মতো করে বললো,“আমি এখানে থাকবো না ভাই, আমি এখানে থাকবো না।”

ফারিশ আদিবের মাথায় হাত বুলালো। শান্ত স্বরে বললো,“ভয় কেন পাচ্ছো। তোমার ফারিশ ভাই আছে না। তোমার কিছু হবে না আদিব। এই ফারিশ তোমার কিছু হতে দিবে না।”

আদিব চুপ করে রয়। কিছু বলে না। ফারিশের মনে পড়লো ছোট বেলার এক ঘটনা। যেই ঘটনার পর আদিব কখনোই তাকে তুই করে বলে না। বলে তুমি করে।”

সে অনেক বছর আগের পুরনো ঘটনা। তখন মাঝরাত। বাহিরে তুমুল বেগের বর্জপাত আর বৃষ্টি হচ্ছিল। মাথায় টিন চাপিয়ে রাস্তার এক কিনারায় বসে ছিল ফারিশ আর আদিব। তখন তাদের বয়স দশ, নয়। ফারিশের দশ আর আদিবের নয়। আদিব ছোট থেকেই অনেক ভীতু টাইপের। সবকিছুতে তার ভয়। দারুণ ভয়। সে রাতের বর্জপাত আর টিনের ঝাঁকড়ানির শব্দে আদিব ভয়ে স্তব্ধ। পুরো রাস্তা নির্জন। কুকুরের ঘেউ ঘেউ শব্দ। ল্যাম্পপোস্টও জ্বলছে নিভছে। তখনই কোথা থেকে যেন একটা লোক রক্তাক্ত অবস্থায় ছুঁটে আসে তাদের দিকে। পায়ে আঘাত থাকায় সে লুটিয়ে পড়ে ফারিশদের সামনে। ফারিশ আদিব দুজনেই লোকটার কাছে যায়। লোকটা আর্তনাদ ভরা কণ্ঠে বলে,“আমাকে বাঁচাও তোমরা নয়তো ওরা আমায় মেরে ফেলবে।”

ফারিশ তখন সামনে তাকায়। দুজন লোক এগিয়ে আসে। গুলির শব্দ হয়। তারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই লুটিয়ে পড়া লোকটাকে অনবরত গুলি মারা হয় তাদেরই চোখের সমানে। লোকটি তখন বাঁচার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা চালায়। কিন্তু পারে না মারা যায়। ফারিশ আদিব দুজনেই ছোট তারা কিছুই বোঝে না। আদিব ফারিশের হাত ধরে গুলির শব্দে ভয়ে কুঁকড়ে যায়। রুহু সমেত তার ভয়ে কাঁপে। কিন্তু ফারিশ থাকে স্থির। তার দৃষ্টি থাকে ওই লোকদুটোর চোখ আর তাদের হাতে থাকা পিস্তলের দিকে। তখনই একটা ছেলে বলে,“এরা দুজন দেখে ফেলেছে এদেরকেও মেরে ফেল।”

আদিব ঘাবড়ে যায়। ফারিশের হাত আরো শক্ত করে খামছে ধরে। আমতা আমতা করে বলে,“আমগো মাইরা ফালাইবো ভাই। আমরা আর বাঁচুম না।”

‘আমরা আর বাঁচুম না’। কথাটা ছোট ফারিশের বুকে গিয়ে বিঁধে। কি করবে ভাবে। ছেলেগুলো ততক্ষণে এগিয়ে আসে। প্রথম আঘাতটা তারা আদিবকে করে। মাথা ফেটে যায়। আদিবের মুখে গুলি ধরে যেই না শুট করবে সেই মুহূর্তেই ফারিশ মরে থাকা সেই লোকটির পকেটের পিস্তলটা উঠিয়ে পর পর কয়েকটা গুলি মারে। আদিব থমকে গিয়ে লুটিয়ে পড়ে নিচে। আরেকটা ছেলে ফারিশের এহেম কান্ড দেখে রাগ নিয়ে ছুটে আসতেই তার দিকেও গুলি তাক করে ফারিশ। সেও মরে যায়। দূর থেকে এই ঘটনা কেউ লক্ষ করে। তার সাথে করেই নিয়ে আসে ফারিশ আর আদিবকে। আদিব সেদিন রাতেও এমন ভয়ার্ত কণ্ঠে বলেছিল,“আমি এহিনে থাকুম না ভাই, আমি এহিনে থাকুম না।”

সময় গড়ালো। পরিস্থিতি সামলে এলো। বাড়ির ভিতর আর ঢোকা হলো না। ফারিশ দীর্ঘ নিশ্বাস নিলো। মাথায় তখন একটি প্রশ্নই ঘুরছিল,“কে ছিল ওই চাঁদরের আড়ালে?”
—–
নিজের চেম্বারে বসেছিল আদ্রিতা। তখনই হন্তদন্ত হয়ে কে যেন চেম্বারে ঢুকলো। লোকটি আহত। হাত দিয়ে কলকলিয়ে রক্ত পড়ছে। আদ্রিতা বেশ চিন্তিত স্বরে এগিয়ে এসে বললো,
“কি হয়েছে আপনার?”

লোকটি কোনোমতে বললো,“আমার হাতে গুলি লেগেছে প্লিজ আমার চিকিৎসা করুণ।”

আদ্রিতা শুনলো। দ্রুত লোকটিকে নিয়ে ছুটে গেল ইমারজেন্সি ওয়ার্ডে। আদ্রিতার ফোনে মেসেজ আসে তখন। ফারিশ লেখে,“আমার আপনাকে অনেক কিছু বলার আছে ডাক্তার ম্যাডাম। শোনানোর জন্য আমার কিছু সময় চাই।”

#চলবে….

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ৩১

তখন রাত। গভীর রাত। শীতের আভাস প্রচুর। বাহিরে বাতাস বইছে। শিরশিরিয়ে উঠছে শরীর। আদ্রিতা আর ফারিশ জ্বলন্ত আগুনের নিকট বসে। একটু দূরত্বে। একদম নিরিবিলি পরিবেশ। শহর ছেড়ে দূরে। নদীর স্রোত বইছে কাছে। ফারিশ আদ্রিতার পানে তাকানো। তার দৃষ্টি শান্ত। স্বাভাবিক। নির্জীব। কিছু ভাবছে। আদ্রিতা পখর করলো তা। সে দেখছে বেশ অনেকক্ষণ যাবৎই ফারিশ তাকিয়ে আছে তার দিকে কিন্তু কিছু বলছে না। অথচ ছেলেটা ফোনে মেসেজ দিয়ে বলছিল,‘সে কিছু বলতে চায়।’

আদ্রিতার কণ্ঠে দৃঢ়তার ছোঁয়া মিললো। আঙুল কচলে বললো,“মিস্টার বখাটে।”

ফারিশের ধ্যান ফিরলো। আশপাশ দেখলো। পরমুহূর্তেই আদ্রিতার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,“জি বলুন।”

আদ্রিতার নিরাশ চাহনি। অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে মুখে। আদ্রিতা একটু এগোলো সামান্য দূরত্ব ঘুচিয়ে বললো,“কি হয়েছে আপনার কিছু বলছেন না কেন?”

ফারিশ নিরুত্তর। আদ্রিতার দিকে তাকিয়ে। আদ্রিতা হাত ধরলো ফারিশের। আবারও প্রশ্ন ছুড়লো,“কি হয়েছে কিছু বলছেন না কেন?”

ফারিশের চোখে মুখে বিস্ময়। অস্থির লাগছে ভিতরটা। সে শীতল স্বরে এতক্ষণ পর আওড়ালো,“আমায় একটু জড়িয়ে ধরবেন ডাক্তার ম্যাডাম, আমি নিজেকে সামলাতে ব্যর্থ হচ্ছি।”

আদ্রিতার বুকের ভেতর মোচর দিয়ে উঠলো। মানুষটা এমন তো করে না কখনো। হা মাঝে মাঝে আবদার করে হাত ধরার, মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়ার, কোলে মাথা রাখার। কিন্তু আজকের কণ্ঠস্বর কেমন যেন ঠেকলো আদ্রিতার। খুব বেশি অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে ফারিশের চোখে মুখে। আদ্রিতা বেশি সময় নিলো না। সে নিজ থেকেই জড়িয়ে ধরলো ফারিশকে। ফারিশও ধরলো। তার বুকের ভেতর টিপ টিপ করছে। শ্বাসটা বুঝি আঁটকে আসছে। এক ভয়ানক খারাপ লাগা কাজ করছে। আদ্রিতা তাকে ছেড়ে চলে যাবে কি না ভাবলেই তার মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। আদ্রিতা ফারিশের পিঠে হাত বুলালো। ফারিশের গায়ে জড়ানো ছিল শুধু ছাইরঙা শার্ট। গায়ে কোনো গরম পোশাক ছিল না। তার নাকি গরম লাগছে সেইজন্য গায়ের জ্যাকেট খুলে রেখেছে মাটিতে। আদ্রিতা ফারিশের পিঠে হাত বুলাতেই অনুভব করলো ফারিশের পিঠের সেই ক্ষত। লম্বা আকৃতি রেখাটা যেন এখনও হাতে বিঁধছে। আদ্রিতা প্রশ্ন করলো,“এবার বলুন না। কি হয়েছে? আপনায় এমন অস্থির লাগছে কেন?”

ফারিশ চোখ বন্ধ করেই বলতে লাগলো,
“আমি আপনায় কিছু বলতে চাই কিন্তু বলতে পারছি না।”
“কেন পারছেন না?”
“আমার ভয় লাগছে।”
“ভয় কিসের আমি তো আপনার আপন মানুষ আমাতেও এত ভয়।”
“কথাগুলোই এত তেঁতো যে আমি নিজেই সইতে পারছি না।”

আদ্রিতা চিন্তিত হলো। তবুও নিজেকে সামলে বললো,“এত ভাবছেন কেন বলেই ফেলুন না।”

ফারিশ প্রসঙ্গ পাল্টালো। অদ্ভুত স্বরে বললো,“আমায় কি আপনি খুব ভালোবাসেন ডাক্তার ম্যাডাম?”

চমকে উঠলো আদ্রিতা। বিস্ময়কর কণ্ঠে বললো,
“হঠাৎ এ প্রশ্ন?”
“আমরা তো সরাসরি কখনোই একে অপরকে বলি নি আমি তোমায় ভালোবাসি।”
“না বললে কি ভালোবাসা যায় না।”

ফারিশ চোখ খুললো। চমৎকার এক হাসি ফুটে উঠলো মুখে। সে আদ্রিতাকে ছাড়লো। মলিন মুখে বললো,“আমাকে ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছে আছে আপনার?”

রুহু সমেত কেঁপে উঠলো আদ্রিতার। এ বুঝি ভয়ংকর এক প্রশ্ন ছিল আদ্রিতার জীবনে। সে ভড়কালো। আঁখিযুগলে অশ্রুরেখা মিললো। কেমন করে যেন বললো,“এভাবে কেন বলছেন ফারিশ?”

ফারিশ তক্ষৎনাৎ উত্তর দিলো,
“আমি ভালো মানুষ নই। আমার শরীর জুড়ে পাপ।”

আদ্রিতা যেন পুরোদমে স্তব্ধ হয়ে গেল ফারিশের কথায়। শরীর অবশ হয়ে আসছে। আদ্রিতা নিজেকে শক্ত করলো। জোরে জোরে নিশ্বাস ফেলে নিজেকে দমালো। শান্ত স্বরে বললো,“আমার সাথে মজা করছেন ফারিশ?”

ফারিশের মলিন মুখ। চোখের চাহনি লজ্জিত। সে মাথা নুইয়ে বললো,“ইস! যদি সত্যিই মজা হতো।”

আদ্রিতা এবার পুরোপুরি স্বাভাবিক হলো। সিরিয়াস কণ্ঠে ফারিশের চোখের দিকে তাকিয়ে বললো,“আমার দিকে তাকিয়ে বলুন ফারিশ। কি হয়েছে? কি পাপ করেছেন আপনি?”

ফারিশ চাইলো না। চুপ করে রইলো। তার গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। এত বেশি কষ্ট কেন হচ্ছে। আদ্রিতা সব শুনে ছেড়ে চলে যেতে যাবে বলে। নিশ্চয়ই যাবে না। সে কি ছেড়ে যাওয়ার মতো মানুষ। অবশ্যই আদ্রিতার কাছে তা নয়। মেয়েটি তাকে যথেষ্ট ভালোবাসে। ফারিশ দম ফেললো। আদ্রিতার অস্থির লাগছে। সে দ্রুত প্রশ্ন করলো,“চুপ করে থাকবেন না ফারিশ। কথা বলুন। আমার দিকে তাকান।”

ফারিশ এবার চাইলো আদ্রিতার দিকে। মেয়েটার চোখ জুড়ে অস্থিরতার ছোঁয়া। সবটা জানার আগ্রহতা। চিন্তিত ভাব। থমথমে শরীর। সবটাই বুঝচ্ছে ফারিশ। ফারিশ আশপাশে আবার তাকালো। বিতৃষ্ণা লাগছে। পানি খেতে ইচ্ছে করছে। তৃষ্ণার্ত ঠেকছে গলায়। কিন্তু আশেপাশে পানি নেই। ফারিশ ঘামছে। এই কনকনে শীতের রাতেও সেও ঘামছে। আদ্রিতা নির্বিকার। ফারিশ বললো,“যদি কখনো শোনেন আমি মানুষটা..

ফারিশ বলতে পারছে না। তার গলা ধরে আসছে। আশ্চর্য! এত বেশি কষ্ট কেন হচ্ছে। এমনটা তো হওয়ার কথা নয়। ফারিশ বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো আচমকা। তড়তড় করে বললো,“আপনি এখানে চুপটি করে বসুন আমি এক্ষুণি আসছি।”

আদ্রিতার পাল্টা জবাবের অপেক্ষা করে না ফারিশ। চলে যায়। আদ্রিতা স্তব্ধ নয়নে তার পানে তাকিয়ে। বড্ড বেশিই কি কষ্ট পাচ্ছে কোনো বিষয় নিয়ে। আদ্রিতা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। নিচে শুইয়ে রাখা ফোনটা হাতে নিলো। কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে আবার বন্ধ করে দিলো। এরপর চাইলো আগুনের ফুলকির দিকে। দাউদাউ করে জ্বলছে আগুন। শীতের রেশ বেজায় কম।’

ফারিশ ছুঁটে এসে গাড়ির নিকট দাঁড়ালো। গাড়ির ভিতর থাকা পানির বোতলটা নিয়ে ঢকঢক করে পুরো এক বোতল ঠান্ডা পানি গিলে নিয়ে শান্ত হলো। বার কয়েক নিশ্বাসও ফেললো এর মধ্যে। মিনিট পাঁচ যেতেই ফারিশ নিজেকে সামলাতে সফল হলো। গায়ের অস্থির ভাবটা কাটলো। শীত ঠেকলো এবার। ফারিশ চিন্তা করলো। আজ বলবে না। কাল বলবে। ভয় হয় হোক। কালকেই বলবে সব। তারপর আদ্রিতা যা সিদ্ধান্ত নেয়। সবটা আদ্রিতার হাতে। বুকে জড়িয়ে নিলে যত্নে রাখবে। আর ছুড়ে ফেলে দিলে.. ভাবলো না ফারিশ। আরো কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থেকে চলে গেল আদ্রিতার নিকট।’
—-
রাতের তখন শেষ প্রহর চলছে। আদ্রিতা আর ফারিশ বাড়ির পথে যাচ্ছে। ফারিশ চুপচাপ গাড়ি চালাচ্ছে। আদ্রিতা ঘুরে ঘুরে তাকে দেখছে। কিছু বলতে পারছে না। আদ্রিতা অনেকক্ষণ হা-হুতাশ করে শেষমেশ প্রশ্ন করেই বসলো,“আপনি তো কিছু বললেন না ফারিশ?”

ফারিশের চোখ মুখের চাহনি আগের চেয়ে ভিন্ন। ফারিশ বললো,“কিছু বলবো ভেবেছিলাম কিন্তু এখন বলতে ইচ্ছে করছে না।”

আদ্রিতা ভ্যাবাচ্যাকা খেল। অদ্ভুত স্বরে বললো,
“আপনি কি একটা পাগল?”
“হতে পারি। জানা নেই।”

আদ্রিতার চোখেমুখে রাগ ফুটে উঠলো। এমন মিনিটে মিনিটে রঙ বদলানো পুরুষ মানুষ দুটো দেখেনি। সে নাক ফুলিয়ে বললো,“আপনি একটা অসভ্য মানুষ।”

ফারিশ হাসলো। অদ্ভুত সুন্দর দেখালো সেই হাসি। একটু থেমে নীরব কণ্ঠে শুঁধালো,“আমাকে অসভ্য বলবেন না ডাক্তার ম্যাডাম, আমি সত্যি সত্যি অসভ্য হয়ে গেলে আপনি কিন্তু সইতে পারবেন না।”

আদ্রিতা চোখ রাঙালো। ভেবেছে কি! এমন আধখাওয়া কথাবার্তা বললেই আদ্রিতা গলে যাবে। আদ্রিতার খুব রাগ হচ্ছে। কেউ কিছু বলবে বলেও যখন বলে না তখন তার দারুণ রাগ হয়। যেমন এখন হচ্ছে।”

আদ্রিতাদের গাড়ি এসে থামলো আদ্রিতার বাড়ির সামনে। আদ্রিতা কোনো কথা না বলে রাগ নিয়ে বেরিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু পারলো না। এক পুরুষালির ভাড়ি কণ্ঠ তাকে থামালো। সে বললো,“আদ্রিতা শোনো।”

এই প্রথম ফারিশের মুখে নিজের নাম শুনতে পেল আদ্রিতা। সে থমকালো,ভড়কালো, অবাক হয়ে চাইলো ফারিশের দিকে। ফারিশ আদ্রিতার হাত ধরলো দ্বিধাহীন। খুব সরল কণ্ঠে বললো,“আমার একটা সুন্দর নিরিবিলি বিকেল চাই ডাক্তার ম্যাডাম।”

আদ্রিতার চোখে মুখে আবারও বিস্ময়। সে বললো,
“আপনি তো আসেনই রাতের বেলা বিকেল পাবো কই?”
“কালকের বিকেলটা কি আমায় দেয়া যায়?”

আদ্রিতা কিছুসময় ভেবে বললো,
“আপনি থাকবেন?”

তড়িৎ উত্তর ফারিশের, “আপনি রাখবেন।”
আদ্রিতা হেঁসে উঠলো আচমকা। মিষ্টি হেঁসে জবাব দিল,“ভেবে দেখবো।”

আদ্রিতা বেরিয়ে গেল। ফারিশ আবার বললো,“বিকেলটায় কিন্তু ভিন্ন কিছু চাই ডাক্তার ম্যাডাম।”

ফারিশ দাঁড়ালো না আর। আদ্রিতার কথাটা বুঝতে দু’সেকেন্ডের মতো সময় লাগলো। পরমুহূর্তেই নিজের দিকে তাকিয়ে। অস্পষ্টনীয় ভাবে বললো,“ঠিক আছে মিস্টার বখাটে।”
—-
পরেরদিন আদ্রিতা হসপিটাল বান দিয়েছে। সকাল সকালই ফোন করে বলেছে,“বিকেলটায় না থাকলেও রাতের বেলা যাবে। অনেক দের অবদি থাকবে।”
মৃদুলের বিয়ের ডেট পড়েছে সামনে। মুনমুন আর রনির সম্পর্কটাও মেনে নিয়েছে তাদের পরিবার। খুব শীঘ্রই তাদের বিয়ে পড়ানো হবে। আশরাফের খাতা এখনো খোলে নি। তবে শীঘ্রই খুলবে বলে ভেবে নিয়েছে সবাই। চাঁদনীর ব্যাপারটা এখনও আঁটকে। এর একটা কিছু করতেই হয়। আদিব প্রায়সই তাদের হসপিটালের আসে। এটা ওটার ছুতা দিয়ে পাশ কাটিয়ে যায়। কিন্তু আধও কি কারণে আসে আদ্রিতা বুঝি একটু হলেও ধরতে পারে।”

বেলা এগারোটা। সূর্যের তবে তেজমাখা রোদে ঘুম ভাঙলো আদ্রিতার। ফোনের কিরিং কিরিং শব্দ বাজলো তখন। আদ্রিতা মৃদু হাসলো। ফারিশ কল করেছে। আদ্রিতা ফোনটা তুললো। ঘুমঘুম কণ্ঠে বললো,“জি বলুন মিস্টার বখাটে।”

তখনই অপর পাশ থেকে হতাশার সুরে বলে উঠলো ফারিশ,“আপনাকে কতবার বলবো আমি বখাটে নই।”

আদ্রিতার নিদারুণ সুখময় কণ্ঠস্বর,“জানি তো।”

#চলবে….

[ভুল-ত্রুটি ক্ষমার সাপেক্ষ]

#TanjiL_Mim♥️.গল্পের

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে