এক পশলা ঝুম বর্ষায় পর্ব-২৮+২৯

0
428

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ২৮

মাথা নিচু করে আতঙ্কিত চেহারা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নয়নতারা। মৃদুলের কান্ডে সে প্রচন্ড ঘাবড়ে গেছে। নয়নতারা বুঝতে পারে নি সামান্য একটু মজা করার জন্য পাত্র এভাবে জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে। শুঁকনো ঢোক গিললো নয়নতারা। নীলিমা দৌড়ে রুমে আসলো তখন। তার বাবা মাও এলো। নীলিমা নয়নতারার কাচুমাচু মুখখানা দেখে বললো,“কি করেছিস?”

নয়ন মিনমিনিয়ে নিজের চোখের চশমাটা ঠিক করে বললো,“আমি কিছু করি নি। খালি বলেছি আমি নীলিমা ব্যাস তাতেই অজ্ঞান হয়ে গেছে।”

মৃদুল দেখছে আশরাফকে। বাকিরা দাঁড়িয়ে আছে। রনির চোখে মুখে বিস্ময়। ছ্যাড়াডা কামডা করলো কি? আশরাফ পানি আনতে বললো। নয়নতারা দৌড়ে পানি আনতে গেল। আদ্রিতারা অবাক চোখে তার যাওয়ার পানে তাকালো। এই বুড়ো মহিলা এভাবে দৌড়ে গেল কিভাবে। একটু আগেও তো কাঁপতে কাঁপতে আসছিল। নয়নতারা দৌড়ে এসে আশরাফের হাতে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিয়ে বললো,“নিন।”

আশরাফ একঝলক তাকালো মহিলাটির দিকে। কণ্ঠটা কেমন ইয়াং মেয়েদের মতো ঠেকলো। আশরাফ বেশি ভাবলো না দ্রুত পানির গ্লাসটা নিয়ে পানি ছিটালো মৃদুলের চোখে মুখে। সঙ্গে সঙ্গে লাফ মেরে উঠে বসলো মৃদুল। থমথমে কণ্ঠে চেঁচিয়ে বললো,“আব্বা আমি বিয়া করতাম না।”

আশরাফ ওরা নিরাশ হলো মৃদুলের কান্ডে। নিজেদের মুখে চাপড় মারলো সবাই। এমনিতেই লজ্জায় মিইয়ে যাচ্ছে তারা। তারওপর মৃদুলের এমন উদঘাট কান্ড। নীলিমার বাবা এতক্ষণ পর খেয়াল করলো তাদের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা এক সাদা চুলওয়ালা মহিলাকে। তাকে চিনতে না পেরে বললো,“আপনি কে?”

নয়নতারা কাচুমাচু হলো এবার। নীলিমা বললো,“বাবা ও নয়ন।”

সঙ্গে সঙ্গে চোখ বড় বড় করে বললো,“ও নয়নতারা।”

সবাই চাইলো নয়নতারার দিকে। নয়নতারা মাথা নাড়ালো নীলিমার বাবার কথায়। নীলিমার বাবা বললেন,“তার মানে এসবের পিছনে তোর হাত আছে।”

নয়নতারা এগিয়ে আসলো। মাথার ঘোমটা তার অনেক আগেই পড়ে গেছে। নয়নতারা তার মাথায় লাগানো আলগা সাদা চুলের গোচা খুলে ফেললো। চোখের চশমাও খুললো। গালে লাগানো আলগা ফেস মাস্ক আর মেকাপ উঠাতেই তার ঝকঝকে ফর্সা মুখখানা আর ঘনকালো চুলগুলো দেখা গেল। আশরাফের নজর কাড়লো সেই মুখশ্রী। নয়নতারা থমথমে কণ্ঠে বললো,“বিশ্বাস করুন আঙ্কেল আমি একটু মজা করছিলাম কিন্তু উনি যে অজ্ঞান হয়ে যাবেন বুঝতে পারি নি। আমি খুব দুঃখিত আঙ্কেল।”

উপস্থিত সবাই এতক্ষণে পুরো ঘটনা ঠাহর করতে পারলো। নীলিমা এগিয়ে গেল মৃদুলের দিকে। বসলো ওর পাশ দিয়ে। মৃদু কণ্ঠে আওড়ালো,“আপনি ঠিক আছেন তো। ও আমার ফ্রেন্ড নয়নতারা। আপনাদের সাথে একটু মজা করার জন্য ওমন সেজে এসেছিল। ও নীলিমা না আমি নীলিমা।”

মৃদুল এবার চাইলো নীলিমার দিকে। মুগ্ধ হলো। না বাবার চয়েস খারাপ না। নীলিমার বাবা কি বলবেন বুঝতে পারছে না। নীলিমার মাও চুপ। অতঃপর নীলিমার বাবাই লজ্জিত স্বরে বললো,“তোমরা কিছু মনে করো না ও একটু ওমনই ফাজিল টাইপের মেয়ে।”

সবার দারুণ হাসি পাচ্ছে বিষয়টায়। কিন্তু তারা হাসতে পারছে না। আশরাফ অনেকটা নিজেকে সামলে বললো,“আমরা কিছু মনে করি নি।”

নয়নতারা সরাসরি চাইলো আশরাফের দিকে। সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো,“আমি খুবই দুঃখিত বিষয়টায়। কিন্তু আমি সত্যি বুঝতে পারি নি উনি এই সামান্য বিষয়টায় অজ্ঞান হয়ে যাবেন।”

মৃদুলের এবার লজ্জা লাগছে। ইস! এটা কি করে ফেললো। মৃদুল মিটমিট করে তাকালো তার বন্ধুদের দিকে। চোখ গরম করে তাকিয়ে আছে সবাই। সে বুঝতে পেরেছে আজ চরম লেভেলের লজ্জাজনক একখানা কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছে। যা তার বন্ধুমহলের সদস্যদের দারুণ লজ্জায় ফেলেছে।’
—-
রাত তখন বেশ গভীর। কনকনে শীতের আভাস বইছে চারিপাশে। আজ হসপিটাল থেকে বের হতে রাত প্রায় তিনটে বেজে গেল আদ্রিতার। ক্ষিদে আর ক্লান্তিতে শরীর অবশ প্রায়। আদ্রিতা বরাবরের মতো সোহেলকে ডাকলো। সোহেল এলো। দ্রুত জবাব দিলো,“ম্যাডাম হয়েছে।”

আদ্রিতার ক্লান্তমাখা শরীরে উত্তর,
“হুম। চল দ্রুত।”
“আচ্ছা ম্যাডাম আসেন।”

আদ্রিতা হেঁটে গিয়ে বসলো গাড়িতে। সোহেলও ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্ট্যার্ট দিলো। কিন্তু অবাক করার বিষয় হলো গাড়ি স্ট্যার্ট হচ্ছে না। সোহেল বেশ কয়েকবার চেষ্টা করার পরও গাড়ি স্ট্যার্ট না হওয়ায় বিরক্তিতে অতিষ্ঠ হলো আদ্রিতা। থমথমে কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,“কি হয়েছে সোহেল?”

সোহেলের নিরাশ চাহনি। হতাশায় ঘেরা মুখ। সে বললো,
“বুঝচ্ছি না ম্যাডাম।”
“রাত হলে এটার কি হয় সোহেল?”
“আমিও জানি না দিনে তো ঠিকই থাকে রাতে কি হয় বুঝি না।”

সোহেল গাড়ি থেকে নামল। গাড়িটা অনেকক্ষণ চেক করে বললো“ম্যাডাম গাড়িতে তেল নেই।”

আদ্রিতার ইচ্ছে করছিল সোহেলকে অনেক্ক্ষণ পেটাতে কিন্তু পারলো না। সে গাড়ি থেকে বের হলো। বিরক্ত নিয়ে বললো,
“এটা আরো আগে দেখো নি কেন সোহেল?”

সোহেল মাথা নুইয়ে বললো,“বিশ্বাস করুন ম্যাডাম সকালেও ফুল ছিল হঠাৎ কি করে খালি হয়ে গেল বুঝচ্ছি না।”

আদ্রিতা আর কথা বাড়ালো না। সোহেল বললো,“গাড়ি এনে দিবো ম্যাডাম।”

তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিয়ে তাকালো আদ্রিতা। বললো,“আগে এটাকে ঠিক করো সোহেল। কাল থেকে এমন হলে আমি তোমায় দেখে নিবো।”

কথাটা বলে হনহন করে হেঁটে গেল আদ্রিতা। সোহেল মাথা নুইয়ে দাঁড়িয়ে। রাগে ফুঁসলো আদ্রিতা। সে বুঝতে পারছে না রোজ রাতে গাড়িটার হয় কি। আদ্রিতা তার মায়ের নাম্বারে কল করলো। সঙ্গে সঙ্গেই ধরলো তার মা। যেন তার কলেরই অপেক্ষায় ছিল এতক্ষণ। আদ্রিতার মা চিন্তিত স্বরে বললো,
“কখন ফিরবি আদ্রিতা?”
“আমার একটু লেট হবে। তুমি ঘুমিয়ে পড়ো মা।”

কথাটা বলেই ফোনটা কেটে দিল। কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তার খুব ক্ষিদে পেয়েছে। এত রাতে খাওয়ার মতো কিছু নেই আশেপাশে। পুরো রাস্তা ফাঁকা। গাড়ি টাড়ি কিছুই দেখা যাচ্ছে না তেমন। আদ্রিতার ইচ্ছে করছে সোহেলের কানটা ছিঁড়ে ফেলতে। ছেলেটা আগের চেয়ে বড্ড বেখেয়ালি হয়ে গেছে। এমন চলতে থাকলে সে সোহেলকে বাদ দিয়ে নতুন ড্রাইভার রাখবে। কথাগুলো একা মনে বলছে আর হাঁটছে আদ্রিতা। হঠাৎই পিছন থেকে গাড়ির হর্ণ বাজার আওয়াজ শোনা গেল। আদ্রিতা আরো বিরক্ত হলো এতে। পিছন ঘুরে বিরক্ত নিয়েই চোখ মুখ কুঁচকে বললো,“সমস্যা কি এভাবে মাঝরাতে শুধু শুধু হর্ণ বাজাচ্ছেন কেন?”

ফারিশের কণ্ঠ শোনা গেল। সে বললো,“সমস্যাটা হচ্ছেন আপনি।”

আদ্রিতার টনক নড়লো। ফ্যাল ফ্যাল দৃষ্টি নিয়ে তাকালো ফারিশের মুখের দিকে। বিস্মিত কণ্ঠে প্রশ্ন বললো,“আপনি এখানে?”

ফারিশ গাড়ির দরজা খুলে দিলো। আদ্রিতা ছুটে গিয়ে বসলো গাড়িতে। সিটব্লেট লাগিয়ে বললো,“এত রাতে এখানে কি করছিলেন?”

ফারিশের এক বাক্যের জবাব,“অপেক্ষা।”
আদ্রিতা চোখ বড় বড় করে চাইলো ফারিশের দিকে। ক্লান্তি ভাবটা আচমকাই উবে গেল কোথাও। সে বললো,“আপনি কখন থেকে আমার অপেক্ষা করছিলেন?”

ফারিশের আবারও এক বাক্যের উত্তর,“অনেকক্ষণ।”

আদ্রিতা জোরে নিশ্বাস ফেলে তার মাথাটা এলিয়ে দিলো গাড়ির সিটে। চোখ বন্ধ করে বললো,
“খুব ভালো করেছেন আমার অপেক্ষায় ছিলেন নয়তো এতরাতে কতদূর আমার হাঁটা লাগতো কে জানে।”
“কেন আপনার গাড়ি কই?”
“আর বলবেন না ওটায় কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। রোজ রাতে সমস্যা করছে। পরশু টায়ার ফেটে গেছিল। কাল ঠিক ছিল। কিন্তু আজ আবার তেল নেই।”

ফারিশ ছোট করে বললো,“ওহ।”
আদ্রিতা চাইলো ফারিশের দিকে মাঝে একদিন তার সাথে ফারিশের দেখা হয় নি। তবে রাতে কথা হয়েছিল। আদ্রিতা বললো,
“কাল এলেন না কেন?”
“রোজ তো গাড়ি নষ্ট করা যায় না। তাই ভেবেছি একদিন পর পর করবো।”

মুহুর্তের মধ্যে চোখ চড়ুই গাছ আদ্রিতার। বিস্ময়কর এক চেহারা নিয়ে বললো,
“তার মানে এই দুইদিন।”
“হা আমি করেছি।”
“কিন্তু কেন?”
“এভাবে একসাথে বাড়ি ফেরার জন্য।”
“আমায় বললে কি আমি আসতাম না।”
“চমকানো তো যেত না।”

আদ্রিতা হেঁসে ফেলে। বলে,
“আপনি আসলেই একজন অদ্ভুত মানুষ।”

ফারিশের তড়িৎ উত্তর,
“জানি তো।”
“কাল থেকে আর গাড়ি নষ্ট করবেন না। এই দূরে অপেক্ষা করবেন আমি আসবো।”

ফারিশ রাস্তার পানে তাকিয়েই বলে,“আচ্ছা।”
আদ্রিতার পেটে মোচড় দিয়ে উঠলো। দ্বিধাহীন কণ্ঠে বললো,
“আমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে।”

ফারিশ অনেকক্ষণ চুপ থেকে বললো,
“আমাকে কি বিশ্বাস করা যায় ডাক্তার ম্যাডাম?”

আদ্রিতা চমকালো,ভড়কালো, অবাক হলো খুব। বললো,
“কেন যাবে না।”
“তাহলে আমার সাথে যাবেন দূরে।”

আদ্রিতার মিনমিনিয়ে বললো,
“কোথায়?”
“আছে এক জায়গা যাবেন।”
“আমার যে ক্ষিদে পেয়েছে।”
“তার জন্যই তো যাবো। আপনাকে খাওয়াবো। যাবেন?”

আদ্রিতা বেশি ভাবলো না। বললো,“ঠিক আছে।”
ফারিশ দ্রুত গাড়ি ঘোরালো। গাড়ির স্পিড দিল বাড়িয়ে। আদিবকে কল করে বললো,“আদিব আজ রাতে আমি ফিরছি না। তুমি চিড়ামুড়ি কিছু একটা খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।”

অপরপাশের কিছু শোনা গেল না তার আগেই ফারিশ ফোন কেটে দিয়েছে। আদ্রিতা তার দিকে তাকিয়ে। ফারিশ বিনা কথায় পুরো এক ঘন্টার রাস্তা আধঘন্টায় এসে থামালো গাড়ি। আতঙ্কিত আদ্রিতার তখন থমকানো মুখ। সে ডান পাশে চাইলো। বনজঙ্গলে ঘেরা একটা জায়গা। আদ্রিতা সরু চোখে তাকালো ফারিশের দিকে। বললো,
“আমরা কি এখানেই নামবো?”

ফারিশ জবাব দিলো না। সরল দৃষ্টি নিয়ে তাকালো আদ্রিতার মুখশ্রীর দিকে। করুন স্বরে বললো,
“আমার যদি হঠাৎ প্রেম প্রেম পায় তবে কি আপনি খুব রাগ করবেন ডাক্তার ম্যাডাম?”

আদ্রিতার বিস্মিত চেহারা। চোখ মুখ কুঁচকালো। শরীর অবশ হলো প্রায়। সে বললো,“এসব কি বলছেন?”

ফারিশের দুষ্ট মার্কা হাসি,
“আমি জানি বিয়ের আগে প্রেম প্রেম পাওয়াটা একটা দণ্ডনীয় অপরাধ। তবুও হঠাৎ পেয়ে বসলে আপনি কি রাগ করবেন?”

আদ্রিতার দৃষ্টি ভঙ্গি পাল্টালো। কিছু বুঝলো। হাসলো। সুরেলা সুরে আওড়ালো,“আমি আপনায় খুন করবো ফারিশ।”

ফারিশের মুখ হাসি হাসি। দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। সে নরম কণ্ঠে শুধালো,
“পারলে মারুন। আপনি মারলে আমি বেঁচে যাই।”

#চলবে….

#এক_পশলা_ঝুম_বর্ষায়❤️
#লেখিকা:#তানজিল_মীম❤️
— পর্বঃ২৯

কনকনে শীতে থর থর করে কাঁপছে শরীর। আদ্রিতা তার গায়ে জড়ানো কালো চাঁদরটা আর একটু শক্ত করে চেপে ধরলো। আশপাশ পুরো নির্জীব। বনজঙ্গলের ঘেরা পুরো জায়গাটা। নিশি রাতের শিশিরে ভেজা মৃদু ঘাসের ওপর মোড়া পেতে বসে আছে আদ্রিতা। তার সামনেই ডালপালা পুড়িয়ে আগুন জ্বালাতে ব্যস্ত ফারিশ। আদ্রিতার সামনে একটা থমথমে বাড়ি দেখা যায়। বাড়িটা অনেক পুরোনো আর ভুতূরে টাইপ। ফারিশ সেই বাড়ির ভিতর ঢুকেই ডালপালা নিয়ে এসে এই মৃদু ভেজা ঘাসের উঠোনে আগুন জ্বালাচ্ছে। আদ্রিতা প্রশ্ন করলো,“আমরা কি বাড়ির ভিতর যাবো না?”

ফারিশ একঝলক চাইলো আদ্রিতার মুখশ্রীর দিকে। পরমুহুর্তেই দ্রুত জবাব দিলো,“আমরা না শুধু আপনি।”

আদ্রিতা হতাশ হলো। মুখভঙ্গি বদলালো। সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
“এমনটা কেন?”
“আমার ইচ্ছে তাই।”
“এমন অদ্ভুত ইচ্ছে কি বেমানান নয়।”
“হয়তো বেমানান তবে আমার কাছে সুন্দর।”

আদ্রিতা চুপ হয়ে গেল। ফারিশ আগুন জ্বালিয়ে ফেললো কিছুক্ষণেই। একটা ডাল আগুনে পেতে তাড়া দিয়ে বললো,
“এবার বলুন কি খাবেন?”
“আপনি যা খাওয়াবেন। আর তাছাড়া আপনার কাছে এই মুহূর্তে খাওয়ানোর মতো কি কি আছে তা আমি কি করে জানবো?”
“ডিম রুটি খাবেন। আমি শুধু অমলেট বানাতে পারি।”

আদ্রিতা মৃদু হাসলো। বললো,
“করুন। তবে জলদি করবেন। আমার কিন্তু দারুণ ক্ষিদে পেয়েছে।”

ফারিশ দেরি করলো না। সে চলে গেল বাড়ির ভিতর। আদ্রিতা চুপচাপ বসে আগুন পোয়ালো। ফারিশ ফিরে এলো মিনিট পনের পরে। হাতে কিছু গরম করা পাউরুটি আর দুটো ডিমের অমলেট।’

আগুনের তাপে ঘাসের জমির কিছু অংশ গেছে বেশ শুকিয়ে। ফারিশ সেই শুঁকনো ঘাসের উপর বসলো। আদ্রিতার দিকে অমলেটের প্লেটটা এগিয়ে দিয়ে বললো,“ভয় পেয়েছিলেন?”

আদ্রিতা তড়িঘড়ি করে বললো,“অল্পস্বল্প।”
ফারিশ হাসে। আদ্রিতা চেয়ে রয় শ্যামবর্নের সেই পুরুষটির দিকে। মানুষটা হাসলে এত কেন সুন্দর লাগে কে জানে। আদ্রিতা প্লেট ছুঁইলো। মোড়া ছেড়ে ফারিশের মুখোমুখি একটু দূরত্ব নিয়ে বসলো। বললো,
“আপনি খাবেন না?”
“না। আপনি খান।”
“কেন?”
“আমার ক্ষিদে পায় নি।”

আদ্রিতা কথা না বাড়িয়ে খাওয়া শুরু করলো। খুব জলদি জলদিই করলো। ফারিশ তার পানে তাকিয়ে। বোঝাই যাচ্ছে মেয়েটার বেশ ক্ষিদে পেয়েছে। আদ্রিতার বেনুনী করা চুলগুলো বেশ এলেমেলো ভাবে ছড়িয়ে আছে সামনে। গায়ে জড়ানো সবুজ রঙা চুড়িদার। বুকে জড়ানো কালো চাদর। খুবই সাদামাটা। তবুও অসাধারণ দেখাচ্ছে। চোখে পলক ফেলছে বার বার। ক্লান্তি ভাবটা আগের চেয়ে বেশ কমেছে। ফারিশ আদ্রিতার থেকে দৃষ্টিতে সরিয়ে আগুনের দিকে চাইলো। পাশে জমিয়ে রাখা শুঁকনো ডাল দিলো। ডালের ছোঁয়া পেতেই তড়তড় করে বেড়ে উঠলো আগুন। গরম গরম উষ্ণতা আরো বাড়লো। শীত কমিয়ে দিলো আর একটু। আদ্রিতা খেতে খেতেই প্রশ্ন করলো,“এখানে কে থাকে?”

ফারিশের তড়িৎ উত্তর, “কেউ না।”
আদ্রিতার বিস্মিত নজর। বার পলক ফেলা পাপড়িযুগল। ফারিশ নিজেই বললো,
“এককালে এই বাড়িতে আমি আর আদিব থাকতাম। এখন আর থাকি না। তবে মাঝে মাঝে আসা হয়।”

আদ্রিতাকে শান্ত দেখালো। উত্তেজিত ভাব কমলো। নরম করে বললো,“ওহ আচ্ছা।”

এরপর নীরবতা চললো অনেকক্ষণ। আদ্রিতা তার খাওয়া শেষ করলো। বেশ ভালো লাগছে এখন। ফারিশ তার দিকে পানির গ্লাসটা এগিয়ে দিলো। আদ্রিতা নিলো। একটু সময় নিয়ে ঢকঢক করে পুরো পানিটা শেষ করলো। জোরে নিশ্বাস ফেলে বললো,“অবশেষে নিজেকে শান্ত লাগছে।”

ফারিশ পানির গ্লাসটা পুনরায় হাতে নিয়ে পাশে রাখলো। বললো,“অমলেট কেমন লাগলো?”

আদ্রিতা তৃপ্তির ঢেঁকুর দিয়ে বললো,“দারুণ।”
ফারিশ খুশি হলো। আদ্রিতা এবার আয়েশ করে আগুনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো। বললো,
“জায়গাটা সুন্দর তবে ভয় ভয় লাগে।”
“ভয় কিসের আমি তো আছি।”
“তাই তো চুপচাপ আছি নয়তো কখন দৌড়ে পালাতাম।”

ফারিশ এবার উচ্চ শব্দে হাসলো। আদ্রিতাও হাসলো। ফারিশ আকাশ পানে চাইলো। খোলা আকাশের মাঝে অনেকগুলো তাঁরা দেখা যাচ্ছে। এত রাতে আকাশ ভর্তি তাঁরা এ যেন প্রথম লক্ষ্য করলো ফারিশ। ফারিশ মৃদু স্বরে বললো,“আকাশটা আজ খুব সুন্দর তাই না।”

আদ্রিতাও তাকালো আকাশের দিকে। বললো,“হুম।”

আবারও নীরবতা ভর করলো দুজনের মাঝে। কথা বলার মতো কোনো কথাই যেন পাচ্ছে না। সময়ের চাকা টিকটিক করে বাড়ছিল শুধু। হঠাৎই ফারিশ নিঃসংকোচে আবদারের স্বরে বললো,“আমি আপনার কোলে মাথা রাখি ডাক্তার ম্যাডাম?”

আদ্রিতার অদ্ভুত চোখ। ফারিশের শীতল দৃষ্টি। কণ্ঠস্বর বেশ নরম। আদ্রিতা বেশি সময় নিলো না। মাথা নাড়িয়ে মিষ্টি হেঁসে বললো,“আচ্ছা রাখুন।”

ফারিশ খুশি হলো। বিনা দ্বিধায় সে শুয়ে পড়লো নিচে মাথা রাখলো আদ্রিতার কোলে। আদ্রিতার হাত আপনাআপনি চলে গেল ফারিশের চুলে। হাত বুলাতে লাগলো ধীরে ধীরে। ফারিশ চোখ বন্ধ করলো। বললো,
“জানেন আমি না কখনো এভাবে কারো কোলে মাথা রাখি নি। আপনাকে কেন যেন আমার বড্ড আপন মনে হয়। কি যাদু করলেন বলুন তো?”

আদ্রিতা উত্তর দেয় না। ফারিশ আবারও বলে,
“আমার বয়স যখন পাঁচ তখন প্রথম রংপুরের সেই ইমাম আমায় নিয়ে ঢাকা আসেন। আমাকে বলে এখন থেকে নিজের দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হবে। আমি তখন বেশ অবাক হই তার কথায়। আমাকে তিনি রেখে গেলেন এক এতিম খানায়। সেখানেই পরিচয় হয় আমার আদিবের সাথে। কিছু ছেলেরা ওকে ধরে মারছিল আমি আটকায়। তাদের থামাই। সেই থেকেই নাকি ওর জীবন বদলে যায়। এতিম খানায় থেকে ছিলাম দু’বছর। হঠাৎ শুনি যিনি এতিম খানা করেছিলেন তার ছেলে নাকি এতিম খানা বিক্রি করে দেয়। আমাদের এক নিমিষেই সেখান থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। কে কোথায় গিয়েছিল জানা নেই। তবে আদিব আমার সঙ্গেই ছিল। ক্ষুধার জ্বালা ভয়ংকর জ্বালা আমি বুঝি। এমনও দিন গেছে আমাদের শুধু পানি খেয়ে কেটেছে পুরো চব্বিশ ঘন্টা। আদিব আমার চেয়ে এক বছরের ছোট ছিল। ক্ষুধার জ্বালা সইতে পারতো কম। কাঁদতো আমায় ধরে। আমি শুধু হাত বুলিয়ে দিতাম মাথায়। কি করতাম? কিছু তো করার নেই। জুতা পালিশ করে যা ইনকাম হতো তা দিয়ে মোটামুটি একবেলা চলে যেত কিন্তু রাত হলে সেই আবার জ্বালা। ধীরে ধীরে সয়ে গেল সব। শীতের এই কনকনে রাতে শুধু পলিথিন চাপিয়ে শুয়ে কাটিয়েছি কতরাত ঠিক নেই। পুলিশের হাতের মারও কম খাওয়া হয় নি মোদের। তবুও জীবন সুন্দর। তাই না।”

আদ্রিতা কি বলবে বুঝে না। ফারিশ চুপ হয়ে গেল। আর কিছু বললো না। তার খুব ঘুম পাচ্ছে। গভীর ঘুম। শান্তির ঘুম। আদ্রিতা ঘুমন্ত ফারিশের দিকে চাইলো। সে বুঝলো ফারিশ আর কিছু বলবে না। আদ্রিতা জোর করলো না। প্রশ্ন করলো না কোনো। চুপচাপ বসে চেয়ে রইলো ফারিশের মুখের দিকে। সামনেই জ্বলজ্বল করে জ্বলছে আগুন। আদ্রিতা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সে বুঝলো। সবার ছেলেবেলা সুন্দর হয় না। তারটা সুন্দর ছিল কিন্তু ফারিশের ছিল না। বুকচাপা এক আর্তনাদ বেরিয়ে আসলো আদ্রিতার।’

সময়ের কাটা সুড়সুড় করে বাড়ছে। ফারিশ গভীর ঘুমে মগ্ন তখন। আগুন প্রায় নিভে যাওয়ার মুহূর্তে। শুঁকনো ডাল আর নেই। আদ্রিতা এবার ডাকলো ফারিশকে। বললো,“শুনছেন,উঠুন। বাড়ি যাবেন না?”

ফারিশ হাল্কা নড়লো। আদ্রিতাকে আর একটু শক্ত করে চেপে ধরলো। আদ্রিতা অনুভব করলো তার শরীর মৃদু কাঁপছে। হয়তো ফারিশের সংস্পর্শে। আদ্রিতা আবারও ডাকলো। জোরেশোরে বললো এবার,“ফারিশ উঠুন না প্লিজ।”

ফারিশ এবার উঠলো। আশপাশ দেখলো। আচমকাই শোয়া থেকে উঠে বসলো। অদ্ভুত এক প্রশ্ন করলো,“আপনি যান নি?”

আদ্রিতা চোখ মুখ কুঁচকালো। বিতৃষ্ণা নিয়ে বললো,“আমার কি একা একা যাওয়ার কথা ছিল।”

ফারিশ চুপ করে রইলো। তার মনে হচ্ছে সে বহুকাল পর একটু আরামে ঘুমিয়ে ছিল। এই আরাম সে বিগত বহুবছর পায় নি। ফারিশের নিজেকে গোছাতে সময় লাগলো দু’মিনিট। সে বললো,“চলুন যাই। ক’টা বাজে?”

আদ্রিতা তার হাত ঘড়িটা দেখলো। বিনয়ের সাথে বললো,
“সাড়ে চারটা।”
“আমি কি অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে ছিলাম?”
“না। খুব জোর পনের মিনিট।”

ফারিশের এবার বেশ অবাক লাগলো। মাত্র পনের মিনিট ঘুমিয়েছে অথচ তার কাছে মনে হচ্ছে বহুক্ষণ ঘুমিয়েছে অনেক ঘন্টাও ছাড়িয়ে গেছে বোধহয়। ফারিশ বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। আদ্রিতাও উঠলো। আগুন ততক্ষণে পুরো দমে নিভে গিয়ে লাল লাল ফুলকি দেখাচ্ছিল শুধু। ফারিশ তাড়া দিয়ে বললো,“দ্রুত চলুন আপনায় বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসি।”

আদ্রিতা শুনলো। মাথা নাড়িয়ে বললো,“ঠিক আছে।”
—-
নীরবে গাড়ি চালাচ্ছে ফারিশ। মুখে কোনো কথা নেই। আদ্রিতাই বললো আগে,
“আপনি সেই বাড়ির ভিতর না নিয়েই পারলেন আমায়।”
“বাড়ির ভিতর নেয়ার কি কোনো কথা ছিল?”
“বাড়ির ভিতর কি রহস্য লুকিয়ে রেখেছেন তা বলুন।”

ফারিশের নিবিড় উত্তর,“একটা খাট আর একটা আলমারি। ওহ রান্নাঘরের বাহিরে একটা ফ্রিজ আছে। আর রান্নাঘরের ভিতরে রান্নার সরঞ্জাম। হাড়ি পাতিল। এই রহস্য।”

আদ্রিতার সন্দিহান দৃষ্টি,
“তাহলে ভিতরে নিলেন না কেন?”
“আসলে বদ্ধ করে আমার ভীষণ ভয় লাগে।”

আদ্রিতা অবাক হয়ে বললো,“মানে। আপনি তো একাই বাড়ির ভিতর থাকলেন আমায় নিলেন না তখন ভয় করলো না।”

ফারিশের এলেমেলো দৃষ্টি। বিষণ্নভরা চাহনি। সে বললো,“একা নয় আপনায় নিয়ে বদ্ধ করে থাকতে আমার ভয় লাগে।”

আদ্রিতার চোখমুখ ভয়ংকরভাবে কুঁচকে গেল। অদ্ভুত স্বরে আওড়ালো,“কি বলতে চাচ্ছেন একটু পরিষ্কার করে বলুন তো?”

ফারিশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে উঠল,
“আমি আগে প্রচুর ধৈর্য্যশীল পুরুষ ছিলাম। কিন্তু ইদানীং আপনি আশেপাশে থাকলে আমার নিজেকে বড্ড অধৈর্য্যশীল পুরুষ মনে হয়। এমনিতেই নিশিরাত কনকনে ঠান্ডা। তারওপর যদি হয় বদ্ধ ঘর। আমি তো বেসামাল হয়ে উঠবো। বদ্ধ ঘরে আমার যদি প্রেম প্রেম পায় তখন। দেখুন আমি যথেষ্ট সতর্কবান মানুষ। বিয়ের আগে নো বদ্ধঘর।”

আদ্রিতার আচমকাই প্রচন্ড হাসি পেল। কি অদ্ভুত লজিকে তাকে বাড়ির ভিতরে নিলো না। আদ্রিতা হেঁসে উঠলো। হাসতে হাসতে বললো,“আপনি এক বদ্ধ উন্মাদ ফারিশ।”

ফারিশের সহজ সরল উত্তর,“জানি তো।”
আদ্রিতা হাসতে থাকলো। তার ফারিশের কথায় দারুণ মজা লেগেছে। প্রকৃতি তখন একটু একটু করে জানা দিচ্ছিল রাতের আঁধার ছাড়িয়ে দিন আলো আসছে। আশেপাশে মসজিদ নেই। যার দরুন তারা টের পাচ্ছে না দূর আকাশে ফরজের আজান দিচ্ছে। ফারিশ একটুখানি গাড়ির জানালা খুললো। সঙ্গে সঙ্গে এক শীতল হাওয়া তাকে নাড়িয়ে দিলো। আদ্রিতার তখনও মুখ ভরা হাসি। ফারিশের সেই হাসিতে চোখ আটকালো ক্ষণে ক্ষণে বহুবার। ফারিশ বুকে হাত দিলো। মনে মনে আওড়ালো,
“এভাবে হাসবেন না ডাক্তার ম্যাডাম,আপনি হাসলে আমার যে বড্ড ব্যাথা লাগে।”

#চলবে….

#TanjiL_Mim♥️

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে