এক ঝড়ো হাওয়ায় পর্ব-১৪

0
5

#এক_ঝড়ো_হাওয়ায়
#লেখনীতে-ইনসিয়া আফরিন ইমারা
#পর্বঃ১৪

নাওয়াস রিনার কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছে। রিনা নাওয়াসের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। নাওয়াস চোখ বন্ধ করে। চোখ বন্ধ করা মাত্রই প্রত্যাশার টলমলে আঁখিযুগল ভেসে ওঠে। নাওয়াস ধপ করে চোখ খুলে উঠে বসে। হঠাৎ নাওয়াসকে উঠতে দেখে রিনা অবাক হোন। চিন্তিত কণ্ঠে বললেন,

“কী হয়েছে? এমন অস্থির কেন লাগছে?”

নাওয়াস রিনার দিকে তাকায়। কয়েক মিনিট গড়ায়। মন্থর কণ্ঠে বলে,

“তোমার প্রত্যাশার কথা মনে আছে?”

“হ্যাঁ! মনে কেন থাকবে না? ওমন মিষ্টি মেয়েকে ভুলা যায়? বিপদের সময় মেয়েটা যেভাবে আমাদের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলো। আজ কাল এমন কাউকে দেখায় যায় না।”

প্রত্যাশার বিষয়ে কথা বলার সময় রিনার চোখ মুখ উজ্জ্বল হয়ে যায়। নাওয়াস নিজের মায়ের মুখশ্রী অবলোকন করে।

“নিহানের থেকে শুনেছিলাম। ও না-কি তোর বন্ধু হয়। মেয়েটাকে একদিন বাড়িতে নিয়ে আসিস তো। ভালো করে পরিচয় করা হয়নি।

“প্রত্যাশা আমাকে ভালোবাসে!”

রিনা থেমে যায়। নাওয়াসের আনন পানে চায়। নাওয়াস রিনার দিকে চেয়ে ছিলো। নাওয়াসের অশান্ত চোখের দিকে চেয়ে রিনা বলেন,

“সংশয়ের সূত্রপাত কী এখান থেকেই?”

নাওয়াস হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়িয়ে বলে,

“আমি ওকে বন্ধু ছাড়া অন্য কিছু ভাবি না। কিন্তু পিয়াশ,তন্ময়,মিন্টু বলছে আমি না-কি ভুল। প্রত্যাশা আমার বন্ধুর থেকেও বেশি কিছু…”

“তোর মন কী বলে?”

রিনার প্রশ্নে নাওয়াস থেমে যায়। প্রশ্নাত্মক চোখে চেয়ে রয়। শুধাল,

“আমার মন?”

“হুম! মন… প্রত্যাশাকে নিয়ে কিছু অনুভব করিস?”

“তুমি ও এই কথা বলছো?”

রিনা হাসলেন বললেন,

“আমি তো তোকে জিজ্ঞেস করছি। তুই কী প্রত্যাশার জন্য কিছু অনুভব করিস। কি-না?”

নাওয়াস ত্রস্ত বলল,

“প্রত্যাশা আমার বন্ধু। অনেক ভালো বন্ধু।”

“আচ্ছা ঠিক আছে। একটা কথা বলতো, তোর ওকে কেমন লাগে?”

নাওয়াস বিলম্বহীন বলে,

“নিঃসন্দেহ প্রত্যাশা খুব ভালো মেয়ে। সাহসী, আত্মনির্ভরশীল, আত্মমর্যাদা সম্পন্ন স্বাধীন চিন্তা ধারার একটা মেয়ে। যে ন্যায় কে ন্যায় আর অন্যায় কে অন্যায় বলার সৎসাহস রাখে। ওর ব্যক্তিত সবার থেকে আলাদা। একদম আলাদা। সি ইজ ইউনিক। আমি ওর মতো কাউকে আগে দেখিনি। জানো মা আমার সাথে ওর প্রথম সাক্ষাৎ এ ও আমায় থা’প্প’ড় মে’রে ছিলো। ওর চোখে মুখে সে কী তেজ। আমার চোখে চোখ রেখে কথা বলেছিলো। আমি ভিষণ অবাক হয়েছিলাম। ওর চোখের তেজস্ক্রিয়তাই।”

রিনা আবারও শুধাল,

“আর ওর সঙ্গ?”

এবার নাওয়াসের মুখের আদল পরিবর্তন হয়। চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। হাসি হাসি আদলে বলে,

“ভিষণ ভালো লাগে। ওর সাথে থাকলে আমি একটা পসেটিভ ভাইব পায়। ওর ভিতরের পসেটিভিটি আমিও ফিল করতে পারি। ইন ফ্যাক্ট ওই তো আমার ভুল গুলো ভাঙিয়েছে। আমাকে সঠিক পথ দেখিয়েছে। ওর সান্নিধ্যে এসেই তো আমি তোমাদের সবাইকে উপলব্ধি করেছি। তোমাদের ভালোবাসা উপলব্ধি করেছি। সি হ্যাজ বি-কাম অ্যান এঞ্জেল ইন মাই লাইফ! সি ইজ ব্লেসিং ফর মি…”

“প্রত্যাশা যদি কখনও দূরে চলে যায়?”

নাওয়াস চমকিত রিনা দিকে চায়। ত্রাস স্বরে বলে,

“দূরে কেন চলে যাবে?”

রিনা কিঞ্চিৎ হাসলেন। বলেন,

“যার কথা উঠলেই তোর চোখে-মুখে খুশি খেলে যায়। যাকে নিয়ে কথা বলার সময় তোর ঠোঁট থেকে হাসি সরে না। যার সান্নিধ্যে তুই নিজেকে বদলে নিয়েছিস। যার দূরে যাওয়ার কথা শুনে তোর চোখে ভয় ভীড় করে। সে কী শুধুই তোর বন্ধু হতে পারে? একবার নিজেকে নিজেই জিজ্ঞেস কর।”

নাওয়াস ভাবুক হয়। রিনা ফের বলে,

“যখন আমাদের কারো সান্নিধ্য ভালো লাগে। তার আগমনে উৎফুল্লতা কাজ করে। এবং তার দূরে যাওয়ায় কষ্ট হয়। তখন সে শুধু আমার বন্ধু হয় না। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে কখনই সারা জীবন বন্ধু হয়ে থাকতে পারে না। তবে দুজন পার্টনার অবশ্যই ভালো বন্ধু হতে পারে। বন্ধুত্ব সম্পর্ক খুব পবিত্র। তার থেকেও পবিত্র হচ্ছে ভালোবাসা। প্রত্যাশার মনে যে অনুভূতি আছে। সেই অনুভূতি তোর মনেও আছে।”

নাওয়াস বিস্মিত লোচনে রিনার দিকে চাইল। বলল,

“আমার মনে প্রত্যাশাকে নিয়ে এমন কোনো অনুভূতি নেই। আমি ওকে শুধু নিজের বন্ধুই ভাবি।”

“এটা তোর মস্তিষ্কের ভাবনা। মনের না। বিশ্বাস না হলে নিজেই নিজের মন কে জিজ্ঞেস কর।”

নাওয়াস দ্বন্দ্বে পড়ে যায়। নিজের মনেকে প্রশ্ন করে,

“সত্যিই কী প্রত্যাশা শুধু আমার বন্ধু? না-কি তার থেকেও বেশি কিছু?”

কেমন একটা ঘোলা উত্তর পায়। যা ওর বোধগম্য হয়না। রিনা হয়তো বোঝেন তাই বললেন,

“তোর মস্তিষ্কের ধারণা ও শুধুই তোর বন্ধু। বন্ধুর সম্পর্কে এমন অনুভূতি আসা অন্যায়। যার জন্য তুই তোর মনের কথা বুঝতে পারছিস না।”

“তাহলে তুমিই বলো কী করলে বুঝতে পারবো? আমার সংশয় কাটবে?”

নাওয়াসের বাচ্চাসুলভ কথায় রিনা মনে মনে হাসলেন। বললেন,

“ওর থেকে দূরে গিয়ে। তুই যদি ওর থেকে দূরে চলে যেতে পারিস। ওকে ভুলে যেতে পারিস। তাহলে বুঝবি ও শুধুই তোর বন্ধু। আর যদি তুই ওকে ভুলতে না পারিস জানবি,প্রত্যাশা শুধু মাত্র তোর বন্ধু না।”

রিনার নিঃসৃত বাক্যে নাওয়াস আতঁকে ওঠে। আতঙ্কিত হয়ে বলে,

“কী বলছো? ওর সাথে একদিন কথা না বললে আমার অস্থির লাগে। জানো বিগত সাতদিন প্রত্যাশা আমার সাথে কথা বলেনি। দেখা করেনি। এই সাতদিন আমার কত কষ্টে কেটেছে? আমার পক্ষে ওকে ভুলে যাওয়া সম্ভব না। প্রত্যাশা আমার সাথে ওতপ্রোত ভাবে জড়িয়ে আছে।”

রিনা গাল ভরে হাসেন। নাওয়াস তা দেখে ভরকে যায় বলে,

“হাসছো কেন?”

রিনা নাওয়াসের মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলে,

“এখুনি কী বললি সেগুলো একটু ভাব। এগুলো তোর মনের কথা। একজন বন্ধুর জন্য কখনই এই ধরনের মনোভাব কাজ করে না।”

নাওয়াস থমকায়। নিজের কথাগুলো নিজ মনে আওড়ায়। রিনা বলে,

“পেলি উত্তর?”

নাওয়াস ভেঙে ভেঙে বলল,

“আআমি প্র..প্রত্যাশাকে ভা-ভালোবাসি?”

নাওয়াস রিনার দিকে চাইল। রিনা চোখের ইশারায় হ্যাঁ বলল। নাওয়াস কম্পিত কণ্ঠে বলল,

“কিন্তু ও তো আমার বন্ধু হয়…”

“উঁহু্! সেটা তোর মস্তিষ্কের কাছে। মনের কাছে নয়। তুই সব সময় মস্তিষ্কের কথা শুনিস। তাই মনের ভাষা বুঝতে পারচ্ছিস না। মনের কথা শোন বুঝতে চেষ্টা কর। সব সংশয় দূর হয়ে যাবে। তুই প্রত্যাশাকে ভালোবাসিস এটা স্বচ্ছ জলের মতো পরিষ্কার হয়ে যাবে।”

নাওয়াস চোখ বন্ধ করে নিলো। পিয়াশ,তন্ময়,মিন্টুর,ওর মা সবার কথা মনে করলো। সর্বশেষ প্রত্যাশা ‘ভালোবাসি’ কথাটা মনে করে যা শুনে নাওয়াসের খারাপ লাগেনি। বরং মনের গহীনে কোথাও একটা ভালো লাগা কাজ করেছে। সেটা তখন উপলব্ধি না করলে এখন করছে। নাওয়াস নিজের মনকে প্রশ্ন করে এই অনুভূতির সূত্রপাত কবে হয়েছিলো। নাওয়াসের মানসপটে নিহানদের স্কুলের ফাংশনের ওই দিনের দৃশ্য ভেসে ওঠে। শাড়ি পরিহিত প্রত্যাশাকে দেখে নাওয়াসের হৃদস্পন্দনের থমকে যাওয়া। পরক্ষণে দ্রুতগতিতে লাফানো। সব কিছুর জানান দেয় নাওয়াস ওই দিন-ই এই অনুভূতির সূচনা হয়। যা ধীরে ধীরে ওর হৃদয়কে গ্রাস করে। আনমনে নাওয়াসের ঠোঁটের কোণে হাসি ফোঁটে। মনে মনে কয়েক বার আওড়ায়,

“আমি প্রত্যাশাকে ভালোবাসি!”

নাওয়াসের ঠোঁটের হাসি প্রস্তর হয়। নাওয়াস যখন প্রত্যাশার ভাবনায় মশগুল ছিলো। সেই সময় প্রত্যাশার ভেজা চোখজোড়া দৃশ্যমান হয়। নাওয়াস তুরন্ত চোখ খুলল। বলল,

“মা আমি একটা ভুল করেছি। নিজের মনের কথা না বুঝেই প্রত্যাশাকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। ও যখন আমার ভালোবাসি বলেছিলো। আমি ওর অনুভূতিকে ভ্রম বলেছিলাম।”

নাওয়াসের করুণ কণ্ঠ। রিনা আস্বস্ত করে বললেন,

“কাল ওর সাথে দেখা করে নিজের ভুলের জন্য ক্ষমা চেয়েনিস। সাথে নিজের অনুভূতির কথাও জানিয়ে দিস।”

“ও যদি না মানে? আমার জন্য ওর চোখে অশ্রু এসেছে। ভাবতে পারচ্ছো? ঠিক কতটা কষ্ট পেলে,ওর মতো শক্ত,কঠিন মেয়ের চোখে অশ্রু আসে?”

নাওয়াসের পা’গলামোতে আবারও হাসেন রিনা। বলেন,

“নারী যতই কঠিন হোক না-কেন, নিজের প্রিয় পুরুষের কাছে সে সকল সময় কাঁদা-মাটির মতো নরম হয়।”

নাওয়াস ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।

“এত ভাবছিস না! আয় একটু ঘুমিয়ে নে।”

নাওয়াস শুয়ে পড়ে। তবে ঘুমায় না। বলা চলে ঘুম ওর চোখে ধরা দেয়না। একরাশ অস্থিরতা নিয়ে চোখ বন্ধ করে থাকে। মনের মধ্যে নানা চিন্তা ঘুরপাক খায়। এই যেমন, প্রত্যাশা ওকে মেনে নিবে কি-না। আচ্ছা প্রত্যাশা আমার থেকে দূরে চলে যাবে না তো? নিজে নিজের ভাবনায় নিজেই আঁতকে ওঠে। আওড়ায়,

“না না প্রত্যাশা এমন মেয়ে না।”

রিনা নাওয়াসের মনের ভাব বুঝে রাতটা ও-কে সঙ্গ দিয়েই কাটান। মায়ের ভরসার হাত পেয়ে শেষ রাতের দিকে নাওয়াসের চোখ লেগে যায়।
_________

পরেরদিন নাওয়াস প্রত্যাশার বুটিকে যায়। সেখানে গিয়ে দেখে বুটিকে তালা দেও। নাওয়াস চিন্তিত হয়। কেননা প্রত্যাশা বুটিকে নিজে না এলেও কখনও তালা ঝোলে না। ওর সহকর্মী মেয়েটা বুটিক খোলে। নাওয়াস প্রত্যাশাকে কল করে কিন্তু পায়না। নাওয়াস ভাবে প্রত্যাশা রাগ করে কল ধরছে না। তখনই নাওয়াসের পিউয়ের কথা স্মরণে আসে। পিউকে যদি পায় তবে কোনো ভাবে প্রত্যাশা অব্দি ওর কথা পৌঁছে দেওয়া যাবে। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। নাওয়াস হাত ঘড়িতে সময় দেখে। পিউদের স্কুল ছুটি হতে অনেক দেরী। তবে একটু পরে টিফিন দিবে। তখন দেখা করতে পারবে। নাওয়াস কাল বিলম্ব না করে স্কুলে ছোটে। নিহান নামাজ পড়ে বের হয়। নিহানদের স্কুলে নামাজের জন্য মসজিদ আছে। মসজিদ থেকে বের হয়ে গেটের কাছে নাওয়াসকে দেখতে পায়। হাসি মুখে সেই দিকে এগিয়ে যায়।

“ভাইয়া তুমি?”

নিহানের কণ্ঠে নাওয়াস হকচকায়। নিহানকে দেখে বলল,

“পিউ কোথায় রে?”

নিহান শুধাল,

“পিউ? ও-তো আজ স্কুলে আসেনি।”

নাওয়াস বিচলিত কণ্ঠে বলে,

“আসেনি? কিন্তু কেন?”

নাওয়াসের এরূপ ব্যবহারে নিহান কিংকতর্ব্যবিমুঢ় হয়। বলে,

“ওদের গ্রামে জমি নিয়ে কি-সব ঝামেলা হয়েছে। সে-সব ঝামেলা মেটাতেই ওর বাড়ির সবার, আজকে সকালে গ্রামে যাওয়ার কথা। সেই জন্য কাল স্কুল থেকে সপ্তাহখানেকের ছুটিও নিয়েছে।”

নাওয়াস মনে মনে আওড়ায়,

“এর মানে প্রত্যাশাও সবার সাথে গেছে। আর তাই ও-কে পাচ্ছিনা। ধ্যাত! ওর আজই গ্রামে যেতে হলো?”

“কিন্তু তুমি পিউকে কেন খুঁজছিলে?”

নিহানের প্রশ্নে নাওয়াসের ভাবনায় ছেদ পড়ে। বলে,

“এমনি-ই! তুই ক্লাসে যা!”

নাওয়াস দাঁড়ায় না চলে যায়। নিহান বিহ্বল হয়ে নাওয়াসের প্রন্থান দেখে।
.
.
.
পরের দিন গুলো নাওয়াসের বিষাদে কাটে। গুনে গুনে দশ দিন পর নাওয়াস প্রত্যাশার দেখা পায়। তখন গোধূলি বিকেল ছিলো। প্রত্যাশা দুপুরেই গ্রাম থেকে ফিরেছে। বাড়ি না গিয়ে সোজা বুটিকে গেছিলো। বিকেলের দিকে বুটিক থেকে বাড়ি ফিরছিলো। নাওয়াস প্রত্যাশার খোঁজে নিয়ম করে কয়েক বেলা বুটিকে আসে। অনাকাঙ্খিত ভাবে আজ কাঙ্খিত রমনীর দেখা মিলে। নাওয়াসের মেঘাচ্ছন্ন আননে ঝমঝমিয়ে খুশির বৃষ্টি হয়। সময় ব্যয় না করে ঝড়ের বেগে প্রত্যাশার নিকট যায়। প্রত্যাশা গেটে তালা লাগিয়ে পিছে ফিরতেই নাওয়াস সোজার ওর সামনে বাইক থামায়। অকস্মাৎ এমন করে বাইক সামনে আসায় প্রত্যাশা চমকে ওঠে। প্রত্যাশা নিজেকে সামলানোর আগেই নাওয়াসের গমগমে ভারিক্কী আওয়াজ কর্ণপাত হয়,

“বাইকে ওঠো!”

প্রত্যাশা মুখ খুলতে নিলে, নাওয়াস কণ্ঠে দ্বিগুন গাম্ভীর্যতা এনে বলে,

“চুপ-চাপ বাইকে ওঠো।”

নাওয়াসের কণ্ঠ স্বরে রাগের আভাস। প্রত্যাশা কিছু বলে না। বাইকে উঠে বসে। নাওয়াস প্রত্যাশাকে নিয়ে ওর প্রিয় জায়গা,ওই কৃষ্ণচূড়া গাছের ওখানে নিয়ে আসে। জায়গাটা নিরিবিলি। মানুষের কোলাহল কম। আর তাই নাওয়াসের বেশ পছন্দের এই জায়গা। বাইক থামতেই প্রত্যাশা নেমে পড়ে। নাওয়াস বাইক স্ট্যান্ড করে। প্রত্যাশার মুখো-মুখি দাঁড়ায়।

“হঠাৎ এখানে নিয়ে আসলে?”

নাওয়াস চোখ-মুখ শক্ত করে বলে,

“এতদিন কোথায় ছিলে?”

প্রত্যাশা নিকট নাওয়াসকে অন্যরকম লাগে। এর আগে নাওয়াস কখনও এভাবে কথা বলেনি। স্বাভাবিক ভাবেই উত্তর করে।

“গ্রামে!”

“ফোন কেন ধরোনি?”

“গ্রামে নেটওয়ার্ক ছিলো না।”

“গ্রামে যাওয়ার আগে আমাকে জানাওনি কেন?”

“আমি নিজেও জানতাম না হুট করেই…”

প্রত্যাশাকে কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়ে, নাওয়াস ক্ষিপ্ত গতিতে প্রত্যাশার বাহু আঁকড়ে ধরে। রাগান্বিত কণ্ঠে বলে,

“তুমি জানতে না মানে কি? যখন জেনে ছিলে,তখন কেন জানাওনি? অন্য সময় তো বাড়ি থেকে এক পা বেরুলে আমাকে জানাও…”

প্রত্যাশা উত্তর করার আগে,নাওয়াস আবার বলে,

“তোমার একবারও মনে হয়নি যে আমি চিন্তা করতে পারি? না-কি ইচ্ছে করেই জানাওনি? তুমি জানো তোমাকে না পেয়ে আমার কী অবস্থা হয়েছিলো? তোমার খোঁজে আমি নিহানের স্কুলেও গেছিলাম। তখন জেনেছিলাম, তোমরা সপ্তাহ খানেকের জন্য লগ্রামে গেছো। তারপরও আমি রোজ তোমার বুটিকের কাছে আসতাম। সপ্তাহ পেরিয়ে গেলো। তবুও তোমার আসার কোনো খবর পায়নি। এই কটা দিন আমার কীভাবে কেটেছে,সে সম্পর্কে তোমার কোনো আইডিয়া আছে?”

শেষোক্ত কথা নাওয়াস নরম কণ্ঠে বলে। প্রত্যাশা নাওয়াসকে অবলোকন করল। বলল,

“আমার অনুপস্থিতিতে কী তোমার জীবনে আদৌ কোনো প্রভাব পড়ে?”

নাওয়াস ভ্রু গুঁটিয়ে প্রত্যাশার দিকে চায়। সহসাই বলে,

“অবশ্যই পড়ে! তোমার অনুপস্থিতিতে আমার জীবনে বিরূপ প্রভাব পড়ে।”

প্রত্যাশা নাওয়াসের নিঃসৃত বাক্যে প্রত্যাশা বিমূর্ত হয়। বলে,

“কেন?”

“কারণ আমিও তোমাকে ভালোবাসি তাই…”

প্রত্যাশা হতভম্ব হয়। বিস্ময়ে মূঢ় বনে যায়। পরক্ষণে সেদিন নাওয়াসের প্রত্যাখ্যানের কথা স্মরণ হয়।

“তুমি কী আমার সাথে ইয়ার্কি করছো?”

নাওয়াস প্রত্যাশার নিরেট আনন পানে গভীর নজরে চাইল। মেয়েটার মুখশ্রী নিরেট হলেও অক্ষিকটর টলমলে। নাওয়াস প্রত্যাশা বাহু ছেড়ে দিলো। প্রত্যাশার র’ক্তিম মুখশ্রী হাতের আঁজালে নিয়ে শান্ত,গভীর,প্রেমময় কণ্ঠে বলল,

“আমি বরাবরই অগোছালো। ঠিক মতো কথাও বলতে জানি না। এমনকি নিজের মনের অনুভূতিও বুঝতে পারি না। আর তাই তো সেদিন তোমার অনুভূতিকে ভ্রম বলেছিলাম। বাট আই ওয়াজ রং! তোমার অনুভূতি ভ্রম না। ভ্রমের মধ্যে আমি ছিলাম। আমার অনুভূতি গুলোকে বন্ধুত্বরের জালে আটকে রেখে ছিলাম। সত্যিকার্থে তুমি কখনোই আমার বন্ধু ছিলে না। তোমার প্রতি আমার মনের কোণে একটা সুপ্ত অনুভূতি জন্মেছিলো। আমার অজান্তেই। তার ওপরে বন্ধুত্বের শীলমোহর পড়ায়, অন্য কোনো নাম আমার মস্তিষ্ক মানতে পারেনি। মনের কাছে কী আর মস্তিষ্কের জোর খাটে? খাটে না। আমার মস্তিষ্কও যুক্তি তর্কে হেরে গেছে, আমার অনুভূতির কাছে। এই দশটা দিন তোমার শূন্যতা আমার মস্তিষ্ককেও বুঝিয়ে দিয়েছি, তুমি শুধু আমার বন্ধু নও। তার থেকেও বেশি কিছু… এমন একজন যাকে ছাড়া আমার নিঃশ্বাসের সমাপ্তি ঘটতে পারে…”

প্রত্যাশা দৃষ্টিতে বিস্ময়,সংশয়,দ্বিধা। সাথে রয়েছে প্রশ্ন। নাওয়াস বলল,

“বখাটে,বাউণ্ডুলে নাওয়াস আফফানকে যেমন সোজা পথে এনেছো। এই অগোছালো নাওয়াস আফফানের জীবন গুচ্ছিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নেবে? সারা জীবনের জন্য এলোমেলো,অযত্নশীল আমিটার হবে? হয়তো খুব বেশি ভালোবাসতে পারবো না। তবে যতটুকু ভালোবাসলে পরকালে তোমায় পাবো,ততটুকু ভালো আমি ঠিকই বাসবো…”

প্রত্যাশা কম্পতি কণ্ঠ। মাথার তালু থেকে পায়ের তালু অব্দি শীতল হয়ে আসে। প্রত্যাশা দিন,কাল,পাত্র ভুলে নাওয়াসের বুকে ঝাপিয়ে পড়ে। সিক্ত কণ্ঠে বলে,

“পারবো! এই অগোছালো, বাউণ্ডুলে তুমিটাকেই তো আমি চাই। যাকে আমি ভালোবেসে যত্নে গোছাবো, গড়বো নতুন ভাবে। তোমার আমায় ভালো না বাসলেও চলবে। শুধু সারা জীবন পাশে থেকো…”

নাওয়াসও প্রত্যাশাকে বাহুডোরে আগলে নিলো। দুজন ভালোবাসার মানুষের অন্তঃকরণের বয়তে থাকা ঝড়ো হাওয়ার সমাপ্তি ঘটল। তাদের এই প্রেমময় মুহূর্তের সাক্ষী হয়ে রইল কৃষ্ণচূড়া গাছ। এবং সেই গাছে বসা একযুগল পাখি। ওদের এই পূর্ণতায় যারা গেয়ে উঠল প্রেমের গান।

চলবে…

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে