#এক_ঝড়ো_হাওয়ায়
#লেখনীতে-ইনসিয়া আফরিন ইমারা
#পর্বঃ১৩ (প্রথমাংশ)
প্রত্যাশা একটা ক্যাফেতে বসে আছে। আজ সকালে যখন বুটিকে আসছিলো। তখনই পূর্ব ইমাম ওকে জানান। একটা ভালো পাত্রের খোঁজ পেয়েছেন। কিন্তু পাত্র আগে নিজে পাত্রীর সাথে কথা বলতে চাই। সেকারণেই পূর্ব ইমাম প্রত্যাশাকে ওই ছেলের সাথে দেখা করতে ক্যাফেতে পাঠায়। অনিচ্ছার শর্তেও প্রত্যাশা ক্যাফেতে আসে। ওই ছেলের জন্য। প্রত্যাশা বিগত এক ঘণ্টা যাবত্র ক্যাফেতে অপেক্ষা করছে। এভাবে সঙের মতো বসে থেকে প্রত্যাশা বিরক্ত হয়। উঠে চলে যেতে নিলে একজন সামনে এসে বসে। বলল,
“হাই আমি সমুদ্র! তুমি নিশ্চয়ই প্রত্যাশা? কখন এসছো?”
এমন হুড়মুড়িয়ে কথা বলায় প্রত্যাশা ভ্রু কুঁচকায়। বলে,
“আমি সময়ের অনেক পাক্কা। সময়েই এসেছি।”
ছেলেটা হেলার সহিত বলল,
“ওহ্ আচ্ছা!”
প্রত্যাশার ভিষণ রাগ হয়। একে তো এক ঘণ্টা দেরী করে এসেছে। তার জন্য কোথায় স্যরি বলবে। স্যরি তো দূরে থাক। চোখ মুখে নূন্যতম অনুতাপের ছাপ পর্যন্ত নেই। উল্টে এমন গাছাড়া ব্যবহার করছে। যাতে মনে হচ্ছে,এক ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করাটা যেন কোনো বিষয়ই না।
“কী নিবে চা না-কি কফি?”
“নো থ্যাংঙ্ক’স আমি অলরেডি দু কাপ কফি নিয়েছি।”
“ওকে দ্যান আমার জন্য অডার্র করি।”
প্রত্যাশার এই কথাতেও ছেলেটা বিশেষ প্রক্রিয়া দেখালো না। নিজের মতো ওয়েটার ডেকে কফি অডার্র করল। প্রত্যাশার বুঝতে বেগ পোহাতে হয়না ছেলেটা অত্যন্ত অ্যারোগেন্ট। প্রত্যাশার ইচ্ছে করল। এই মুহূর্তে এখান থেকে চলে যেতে। শুধু মাত্র ভদ্রতার খাতিরে সেটা করলো না।
“তোমার বাবা নিশ্চয়ই বলেছে, আমার বিষয়ে?”
সমুদ্র নামক ছেলেটার কথায় প্রত্যাশার ধ্যান ভাঙে। ছোটো করে বলে,
“হুম!”
সমুদ্র বলল,
“সরাসরি পয়েন্টে আসি তাহলে।”
প্রত্যাশা এপর্যায়ে নড়েচড়ে বসে।
“তোমার ব্যাপারে আমি সবটা খোঁজ নিয়েছি। তোমার তো একটা বুটিক আছে তাই না?”
“হুম আছে।”
“তা তুমি কেন নিজের বিজনেস করো? তোমার বাবার ফিন্যানসিয়াল কন্ডিশন যথেষ্ট ভালো। দেশের নামকরা ঔষধের ডিলার।”
“আমি নিজের জন্য কিছু করতে চাই। বাবার ওপর ডিপেন্ড হয়ে নিজের পুরো লাইফ লিড করতে চাই না।”
প্রত্যাশার কণ্ঠে দৃঢ়তা। ছেলেটা এমন টুকটাক আরও কথা জিজ্ঞেস করলো। প্রত্যাশার মনে হলো ও কোনো চাকরির ভাইভা দিচ্ছে। মনে মনে বিরক্ত হলেও, প্রত্যাশা চুপচাপ উত্তর করলো শুধু। ফিরতি কোনো প্রশ্নও করেনি। সব শেষে ছেলেটা বললল,
“ওয়েল আমার তোমাকে ভালো লেগেছে। বাট একটা প্রব্লেম আছে।”
সহসাই প্রত্যাশার ললাটে ভাঁজ পরে।
“বিয়ের পর তোমাকে তোমার বিজনেস ছাড়তে হবে। আমার ফ্যামিলিতে মেয়েদের বাইরে কাজ করার নিয়ম নেই। আর আমিও পছন্দ করি না। ইনকাম করার জন্য আমরা পুরুষ মানুষরা আছি। মেয়েদের কেনো করতে হবে? মেয়েরা শুধু সংসারের কাজ করবে।”
প্রত্যাশার মুখের অভিব্যক্তি বদলে যায়। চোখ মুখ শক্ত করে বলল,
“এটা শুধু মাত্র আমার বিজনেস নয়। এটা আমার স্বপ্নও।”
সমুদ্র অবজ্ঞা হাসি হেসে বলল,
“স্বপ্ন? এই সব স্বপ্ন দিয়ে কী হবে? মেয়েদের স্বপ্ন হওয়া উচিত ঘর সংসার নিয়ে।”
প্রত্যাশা বুঝল। ছেলেটা শুধু অ্যারোগেন্ট নয়। সাথে অত্যন্ত নিম্ন মানসিকতার। যে মেয়েদের সামান্যতম সন্মান করতে জানে না। প্রত্যাশা চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। সমুদ্র ভ্রু বাকিয়ে প্রশ্ন করে,
“অ্যানি প্রব্লেম!”
“আমার মনে আমাদের আর কথা বাড়িয়ে সময় নষ্ট করার দরকার নেই। কারণ আমি আমার স্বপ্ন স্যাকরিফাইস করতে পারবো না।”
প্রত্যাশা সমুদ্রের উত্তরের অপেক্ষা না করেই চলে যায়। সমুদ্র প্রত্যাশার প্রন্থান পথে হতবিহ্বল হয়ে চেয়ে থাকে। ক্যাফে থেকে বেরিয়ে প্রত্যাশা জোরে জোরে শ্বাস নিলো। মেজাজ পুরো খারাপ হয়ে গেছে। প্রত্যাশা ব্যাগ থেকে ফোন বের করল। নাওয়াস কে কল করল। নাওয়াস মিটিং এ ছিলো। প্রত্যাশার কল দেখে বলল,
“এক্সকিউজ মি!”
নাওয়াস একটু সাইডে এসে কল রিসিভ করে।
“হ্যালো!”
“আমি তোমার সাথে দেখা করতে চাই এখুনি।”
নাওয়াসকে কোনো কথার বলার সুযোগ না দিয়েই, নিজ বাক্য ব্যয় করে কল কেটে দিলো। নাওয়াস কান থেকে ফোন সরিয়ে,সামনে ধরে বোকার মতো চেয়ে রইল।
.
.
.
নাওয়াস আর প্রত্যাশা পার্কে বসে আছে। প্রত্যাশা মাটির দিকে চেয়ে আছে। নাওয়াস প্রত্যাশাকে অবলোকন করে। নীরবতা কাটাতে নাওয়াস বলল,
“প্রত্যাশা?”
“একজন মানুষের মানসিকতা এতোটা নিচু কী করে হয়?”
প্রত্যাশার কথা নাওয়াসের মাথার উপর দিয়ে যায়। তাই নরম কণ্ঠে শুধাল,
“কী হয়েছে? তুমি যদি আমাকে সবটা না বলো। আমি বুঝবো কী ভাবে?”
প্রত্যাশা নাওয়াসকে সব খুলে বলল। সব শুনে নাওয়াসেরও প্রচুর রাগ হয়। রাগান্বিত কণ্ঠে বলে,
“তোমার বাবা এই সব নমুনা গুলো কে কোথা থেকে ধরে আনে বলো তো? তোমাকে যখন ডমিনেন্ট করে কথা বলছিলো। দুটো থা’প্প’ড় লাগাতে পারলে না? কত বড়ো সাহস তোমায় কি-না তোমার স্বপ্ন ছাড়তে বলে? তোমার স্বপ্ন নিয়ে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে? ইচ্ছে তো করছে শা’লা কে মে’রে মুখ ভেঙে দিই।”
নাওয়াসের এরূপ প্রক্রিয়া প্রত্যাশা চমকায়,থমকায়। একরাশ বিস্ময় নিয়ে শুধায়,
“তুমি এমন রিয়েক্ট করছো কেন?”
“তো কী করবো? ওর সাহস কী করে হলো তোমার সাথে এভাবে বিহেভ করার?”
নাওয়াস থামে তারপর বলে,
“শুনো আজ তুমি তোমার বাবাকে জানিয়ে দিবে। তুমি এখন বিয়ে করবে না। উনি যেন আর এমন যাকে তাকে ধরে না নিয়ে আসেন। বুঝেছো?”
প্রত্যাশা মাথা নাড়ায়। প্রত্যাশার চোখে এখনও বিস্ময়। নাওয়াস প্রত্যাশার মন ভালো করতে ওকে বলে,
“ঘুরতে যাবে?”
“কোথায়?”
“গন্তব্যহীন!”
প্রত্যুত্তরে প্রত্যাশা হাসে। তারপর দুজনে চলে যায় উদ্দেশ্যেহীন পথে। নাওয়াসের সাথে ঘুরে প্রত্যাশার মন ভালো হয়ে যায়। প্রত্যাশা বাড়ি ফিরতেই পূর্ব ইমামের মুখোমুখি হয়। পূর্ব ইমামের গুরুগম্ভীর মুখ দেখেই প্রত্যাশা আন্দাজ করে উনি কী বলবেন। এবং প্রত্যাশার অনুমান সঠটিক করে পূর্ব ইমাম বললেন,
“তুমি সমুদ্রের সাথে খারাপ ব্যবহার কেন করেছো?”
প্রত্যাশার সহজ স্বীকারোক্তি।
“আমি শুধু মাত্র ওনাকে আমার মতামত জানিয়েছি। আর এটা যদি ওনার ভাষায় খারাপ ব্যবহার করা হয়। তবে হ্যাঁ আমি খারাপ ব্যবহার করেছি।”
“কেন করেছো?”
“কেন তুমি জানো না? তোমাকে জানায়নি? নাকি শুধু আমি খারাপ ব্যবহার করেছি সেটাই বলেছে।”
“সমুদ্র কী এমন বলেছিলো? যার জন্য তুমি না বলেছো?”
“আমাকে আমার স্বপ্ন ছাড়তে বলেছিলো। বলেছিলো বুটিকের কাজ ছেড়ে দিতে।”
“তার জন্য তুমি না বলেছো?”
“হ্যাঁ!”
পূর্ব ইমাম বিরক্তির সহিত বলল,
” এটা এমন কী বিষয়? ছেড়ে দিতে। একটা সামান্য বুটিকের জন্য তুমি এতো ভালো একটা ছেলেকে অপমান করলে?”
প্রত্যাশা হতবুদ্ধির ন্যায় পূর্ব ইমামের আনন পানে চাইল। অবিশ্বাস্য স্বরে বলল,
“বাবা তুমি বলছো এই কথা?”
“হ্যাঁ বলছি!”
প্রত্যাশা কণ্ঠে দৃঢ়তা এনে বলল,
“তাহলে তুমিও শুনে রাখো। আমি আমার স্বপ্নের বিনিময়ে কোনো কাজ করবো না।”
প্রত্যাশা আর এক মুহূর্ত দাঁড়ায় না। নিজের ঘরে চলে যায়। পূর্ব ইমাম হতবাক হয়ে প্রত্যাশার গমন পথের দিকে তাকিয়ে থাকে। মিনা বললেন,
“ও যখন বিয়েতে রাজি হয়েছে, তখন এমন কারো সাথে বিয়ে দিন। যে ওর স্বপ্নসহ ওকে বিয়ে করবে।”
মিনা নিম্ন কণ্ঠে কথাটি বলেন। ভেবেছিলেন স্বামী হয়তো ধমকাবেন। কিন্তু এমন কিছু করেন না। বরং নীরবে চলে যান। এতে মিনা অবাক হয় বটে।
_______
প্রত্যাশা নতুন ড্রেসের জন্য কিছু ডিজাইন করছিলো। প্রত্যাশার অভেস্য আছে। ডিজাইন করতে করতে রেডিও শোনা। আজকেও তাই করছিলো। তখন রেডিও-তে একজন টপিক হিসেবে বলল, বন্ধুত্ব আর প্রেম। এটাই তাদের আজকের বিষয় বস্তুত। সেখানে একজন গল্প ই-মেইল করেছে। তাদের প্রেমের শুরুটা হয় বন্ধুত্ব দিয়ে। প্রথমে তারা একে অপরকে সহ্য করতে পারতো না। পরবর্তিতে কিছু ঘটনার মাধ্যমে বন্ধুত্বের শুরু হয়। এরপর প্রেম। এখন তারা বিবাহিত। এবং আজ তাদের বিশতম বিবাহ বার্ষিকী। প্রত্যাশা ভিষণ মনোযোগ সহকারে ওদের গল্প শুনলো। গল্পটা শোনার সময় প্রত্যাশার মানসপটে নাওয়াসের মুখশ্রী দৃশ্যমান হয়। প্রত্যাশা থমকে যায়। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে,
“আমি নাওয়াসের কথা কেন ভাবলাম? আমাদের বন্ধুত্বের শুরুটাও এমন বলে?”
প্রত্যাশা আর কোনো কিছু শোনে না। চুপচাপ শুয়ে পড়ে। ওর মাথায় অনেক কিছু ঘুরতে থাকে। এটা আজ প্রথম ঘুরছে এমন না। আরও আগে থেকেই ঘুরছে। প্রত্যাশা বোঝে তবুও নিজেকে বোঝায়। এই অনুভূতিটা ভুলও হতে পারে। তার এখন আবেগের বয়স নেই। আবেগে গা ভাসানো উচিত না। নিজের মনকে এমন সাত পাঁচ বুঝিয়ে প্রত্যাশা ঘুমিয়ে গেলো। তারপরের দিন গুলো প্রত্যাশার প্রচন্ড বিষণ্ণতায় কাটলো। কেননা নাওয়াস ব্যবসার কাজে শহরের বাইরে গেছে। এখন ব্যবসার পুরো দায়িত্ব নাওয়াসের ওপর। সেকারণে নাওয়াস অনেক ব্যস্ত হয়ে পরেছে। দু-দন্ড প্রত্যাশার সাথে কথা বলতে পারছে না। প্রত্যাশা নাওয়াসকে কল করে। কয়েক বার রিং হয়ে কেটে যায়। প্রত্যাশা বলে এই শেষ তাই বলে কল করে। তখন কল রিসিভ হয় প্রত্যাশা উৎফুল্ল চিত্তে হ্যালো বলতে নিবে। তখন ফোনের ওপর পাশ থেকে রিনরিনে একটি মেয়েলী কণ্ঠ শোনা যায়। সহসাই প্রত্যাশার ভ্রু গুটিয়ে আসে।
“হ্যালো কে বলছেন?”
“আপনি কে বলছেন? এটা তো নাওয়াসের ফোন? আপনার কাছে কী করে এলো?”
প্রত্যাশার ফিরতি প্রশ্নে মেয়েটা বলে,
“জ্বি! উনিই আমাকে ফোনটা রাখতে দিয়েছেন। কাইন্ডলি আপনি কে বলবেন?”
“আপনি ফোনটা নাওয়াসকে দিন।”
“স্যরি উনি এখন বিজি আছেন। ওনাকে ফোন দেওয়া যাবে না। আপনার কী প্রয়োজন আমাকে বলুন। আমি ওনাকে বলে দিবো।”
মেয়েটির কথায় প্রত্যাশার রাগ হয়। বিনা বাক্যে কট করে কল কেটে দেয়। নাওয়াস মিটিং করে বের হয়ে আসে। নাওয়াসকে দেখে মেয়েটা বলল,
“স্যার আপনাকে একজন ফোন করেছিলো। অনেকবার কল করাই আমি বাধ্য হয়েই রিসিভ করি।”
নাওয়াস ফোনটা নিলো কল লিস্ট চেক করে দেখলো প্রত্যাশা কল করে। মেয়েটিকে চলে যেতে বলল। মেয়ে বিনাবাক্যে চলে যায়। মেয়েটি নাওয়াসের পিএ। নাওয়াস প্রত্যাশাকে কল করে। প্রত্যাশা কল রিসিভ করে।
“কল করেছিলে?”
“মেয়েটা কে ছিলো?”
প্রত্যাশার এহেন উত্তরে নাওয়াস ভরকে যায়। শুধায়,
“কোন মেয়ে?”
“যে তোমার ফোন ধরে ছিলো?”
“ওহ আচ্ছা! ওর নাম দিশা। আমার পিএ।”
নাওয়াসের কথায় প্রত্যাশার রাগ বাড়ে। বলল,
“তোমার পিএ একজন মেয়ে?”
“হ্যাঁ কেন?”
“ওর কাছে তোমার ফোন কী করছিলো?”
“আমি মিটিং এ ছিলাম। তাই ওর কাছে ফোনটা রেখেছিলাম।”
“আগে তো কখনও ওর কথা আমায় বলোনি।”
“এক সপ্তাহ আগেই জয়েন করেছে।”
“বাহ্! এক সপ্তাহ আগে জয়েন করেছে। আর তুমি তাকে ফোন দিয়ে দিলে?”
নাওয়াস প্রত্যাশার রুক্ষ আচারণে রিতীমত অবাক হয়। বেশ স্বাভাবিক ভাবেই বলে,
“এখানে মিটিংএ ফোন অ্যালাউ না। সেই জন্যই ওর কাছে রেখেছিলাম।”
“তুমি নিজের পিএ বদলাবে। আর একজন পুরুষ পিএ রাখবে।”
“কেন?”
নাওয়াসের বোকা প্রশ্নে প্রত্যাশা রেগে বলল,
“জানি না!”
বলেই প্রত্যাশা কল কেটে দিলো। নাওয়াস বিহ্বল হয়ে ফোনের দিকে তাকিয়ে থেকে বিড়বিড় করলো।
“এর আবার কী হলো?”
চলবে…
#এক_ঝড়ো_হাওয়ায়
#লেখনীতে-ইনসিয়া আফরিন ইমারা
#পর্বঃ১৩ (শেষাংশ)
প্রত্যাশা সেদিন পর থেকে রাগ করে নাওয়াসের সাথে কথা বন্ধ করে দিয়েছে। নাওয়াস কল করলেও ও রিসিভ করেনি। এমন কী বুটিকেও যায়নি। নাওয়াস ভেবে পাচ্ছে না প্রত্যাশা হঠাৎ এমন কেন করছে? কোনো বিষয় নিয়ে কী রেগে আছে? নিহানের স্কুলেও গেছিলো। পিউকে প্রত্যাশার বিষয়ে জিজ্ঞেস করে। পিউ জানায় প্রত্যাশা না-কি কারো সাথে ঠিক করে কথা বলছে না। কাজেও যাচ্ছে না। সব সময় দরজা আটকে বসে থাকে। নাওয়াস ভেবে পায়না প্রত্যাশার এহেন আচারণের পিছনে কারণ কী।
দিনটা শুক্রবার নাওয়াস, পিয়াশ,তন্ময়,মিন্টু ব্যস্ততা বাদ দিয়ে আজ অনেক দিনপর আবার একত্রি হয়েছে। ঠিক করে সবাই আজ সারা দিন আড্ডা দিবে। নাওয়াসের তেমন ইচ্ছে না থাকলেও ওদের সাথে যায়। সেই কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বাইক নিয়ে বসে সবাই আড্ডা দিতে থাকে। নাওয়াসকে উদাস দেখে পিয়াশ বলে,
“ভাই আপনার কী হয়েছে? আপনাকে কয়েকদিন থেকে অন্যমনস্ক লাগছে? আপনি কী কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তিত?”
নাওয়াস বিরস মুখে বলল,
“বিগত এক সপ্তাহ যাবত্র প্রত্যাশা আমার সাথে কোনো যোগাযোগ করছে না।”
নাওয়াসের উত্তরে সবাই চমকিত একে অন্যের দিকে চায়। তন্ময় বলে,
“হয়তো উনি ব্যস্ত আছেন।”
পিয়াশ সায় দিয়ে বলল,
“হ্যাঁ! শুনেছিলাম ডিজাইনারদের না-কি অনেক আর্ট-টাট করতে হয়। যার জন্য নাওয়া খাওয়া সব ভুলে যায়। প্রত্যাশাও তেমনই হয়তো কোনো আর্ট নিয়ে ব্যস্ত আছে।”
“উঁহু্! বিষয়টা এতো সহজ না।”
নাওয়াসের উত্তরে মিন্টু মুখ ফুঁলিয়ে বলল,
“ভাই আপনি অনেক বদলে গেছেন। ওই মাইডারে পাইয়া আপনি আমাদের আর পাত্তা দেন না। যত ব্যস্তই থাকেন না কেন,ওই আপনারে ডাকলে আপনি সব ফালাই থুইয়া ছুইটা চইলা যান। ঠিক যেমন প্রেমিক তার প্রেমিকার জন্য ছুটে যায়…”
মিন্টুর কথায় নাওয়াস চমকে ওঠে। পরক্ষণে ধমকে বলে,
“এই সব কী কথা? খবরদার আর কখনও এই ধরনের কথা বলবি না। তোরা যেমন আমার বন্ধু প্রত্যাশাও আমার বন্ধু। তোদের কিছু হলে যেমন আমি ছুটে আসি। ওর জন্যও যায়। বুঝেছিস?”
মিন্টু কাচুমাচু ভঙ্গিতে মাথা নাড়ায়।
প্রত্যাশা আজ সাতদিন পর চার দেওয়ালের মধ্যে থেকে বের হলো। উদ্দেশ্যে নাওয়াসের কাছে যাওয়া। প্রত্যাশা জানে নাওয়াস কোথায় আছে। তাই রিঁকশা ওয়ালাকে সেখানে নিতে বলে। প্রত্যাশা এই সাতদিন নিজেকে ঘর বন্দি করে নিয়ে ছিলো। আর তাও নাওয়াসের কারণে। সেদিন নাওয়াসের ফোন একটি মেয়ে ধরায় প্রত্যাশার রাগ হয়। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে কেন তার এই রাগ? কেন সে সহ্য করতে পারছে না। মেয়েটা নাওয়াসের আশেপাশে থাকবে। কেন সে এই বিষয়টা মানতে পারছেনা? কেন?কেন?কেন? এই প্রশ্নের উত্তরে প্রত্যাশার মন বলেছিল,
“তুমি নাওয়াসের প্রেমে পড়েছো। তোমার নারী প্রেমিকা সত্তার ঈর্ষা হচ্ছে। আর তাই অন্য নারীকে নিজের, প্রিয় পুরুষের আশপাশেও মানতে পারছো না।”
প্রিয় পুরুষ শব্দটিতে প্রত্যাশা বিমূর্ত বনে যায়। নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করে নাওয়াস তার প্রিয় পুরুষ? সেকারণেই প্রত্যাশা ইচ্ছে করে নাওয়াসকে এড়িয়ে চলে। নিজের মনকে পরীক্ষা করতে। ভুলে যেতে পারে কি-না দেখেতে। ভুলা তো দূরের কথা আরও বেশি মনে পড়েছে। নাওয়াস ওর খোঁজে বুটিকে গেছিলো। সেকথাও প্রত্যাশার অজানা নয়। প্রত্যাশা নিজের মনকে নানা ভাবে পরীক্ষা করে। তখন পিউ এসে জানায় নাওয়াস না-কি পিউয়ের কাছে ওর খোঁজ করছিলো। সেই মুহূর্তে প্রত্যাশা প্রচুর খুশি হয়। প্রত্যাশা মনের সকল সংশয় দূর হয়ে যায়। ওতো আর বাচ্চা না। যে কোনটা কিসের অনুভূতি তা বুঝবে না। এটা যে পৃথীবির সবচেয়ে সিগ্ধ পবিত্র অনুভূতি। ভালোবাসার অনুভূতি। আর এই অনুভূতি সূচনা হয়েছিলো পিউয়ের স্কুলের ফাংশনের দিন। প্রত্যাশা রিঁকশায় বসে এই সব ভাবচ্ছিল। প্রত্যাশা ঠিক করে নাওয়াসকে নিজের অনুভূতির কথা জানিয়ে দিবে। প্রত্যাশা নাওয়াসের থেকে কিছুটা দূরে রিঁকশা থামায়। রিঁকশার ভাড়া মিটিয়ে ত্রস্ত পায়ে নাওয়াসের দিকে এগিয়ে আসে। প্রত্যাশাকে প্রথমে তন্ময় খেয়াল করে। নাওয়াসের উদ্দেশ্যে বলে,
“ভাই প্রত্যাশা!”
তড়িৎ নাওয়াস সামনে তাকায়। সামনে তাকিয়ে প্রত্যাশাকে দেখে নাওয়াস অন্তঃকরণে ঝড়োয়া হাওয়া থেমে যায়। এই সাতদিন মেয়েটা সাথে যোগাযোগ না হওয়াই, নাওয়াসের অভন্ত্যরে ঝড়ের সৃষ্টি হয়। প্রত্যাশাকে দেখে সেই ঝড় থেমে গেলেও। নাওয়াসের কঁপালে ভাঁজের সৃষ্টি হয়। সব সময় পরিপাটি হয়ে থাকা মেয়েটাকে আজ ভিষণ অগোছালো লাগছে। চোখের নিচে কালচে দাগ। বা গালো একটা লাল ব্রণ। চুল গুলো ঠিক মতো আঁচড়ানো না। এমন এলোমেলো অবস্থাতেও মেয়েটার সৌন্দর্য চুল পরিমান কমেনি। বরং বেড়েছে কয়েকাংশে। প্রত্যাশা নাওয়াসের মুখো মুখি দাঁড়ায়। নাওয়াস প্রশ্ন করে,
“তুমি এতদিন কোথায় হারিয়ে ছিলে? কত কল করেছি তোমার খেয়াল আছে? এভাবে হুট করে গায়েব হয়ে যাওয়ার মানে কী?”
“আমি গায়েব হলে তোমার কী?”
নাওয়াসের ললাটে ভাঁজ পরে। সহসাই শুধাল,
“কী হয়েছে তোমার? তুমি সেদিনও ফোনে কেমন অদ্ভূত ব্যবহার করলে। কোনো প্রব্লেম হলে আমায় বলো।”
নাওয়াসের নরম কণ্ঠ। প্রত্যাশা অপলক নাওয়াসের চিত্ত পানে চেয়ে আছে। ধীম স্বরে বলে,
“প্রেম রোগ হয়েছে আমার!”
নাওয়াস ভরকায়। ভরকানো কণ্ঠে বলল,
“কীহ্?”
প্রত্যাশা নিজের কণ্ঠে সকল মাধুর্যতা এনে বলল,
“যখন একটা মেয়ে একটা ছেলের একটুখানি দর্শন পাওয়ার জন্য, সারা শহর তাকে খোঁজে। সেই ছেলের আশেপাশে থাকতে তার দিকে বন্ধুত্বরের হাত বাড়ায়। তাকে নিয়ে ভাবতে থাকে। সেই ছেলের দুঃখে ব্যথিত হয়। তার ভালো মন্দ নিয়ে ভাবতে থাকে। একজন ছেলেকে বিশ্বাস করে, গন্তব্যহীন তার বাইকে করে শহর ঘুরে। নির্দ্বিধায় নিজের মনের সব কথা বলে। নিজের অন্তরের সকল সুখ-দুঃখ ভাগ করে। নিজেকে একদম খোলা বইয়ের মতো, তার সামনে মেলে ধরে। এগুলো একটা মেয়ে কখন করে জানো? যখন মেয়েটা নিজের মনকুটিরে ছেলেটার জন্য অনুভূতির বাসা বুনে।”
প্রত্যাশা থামে। নাওয়াসের দৃষ্টিতে বিভ্রম। অবাকতা। যা প্রত্যাশাতে নিবদ্ধ। প্রত্যাশা নাওয়াসের চোখো চোখ রেখে বলে,
“আমি তোমাকে ভালোবাসি নাওয়াস। সত্যিই ভালোবাসি। আমি জানি না আমার মনে এই অনুভূতি কবে, কখন আর কীভাবে সৃষ্টি হলো। তবে এই অনুভূতির সূচনা হয়েছিলো, পিউয়ের স্কুলের ফাংশনের দিন।”
নাওয়াস চমকায়, থমকায়, বিস্ময়ে কথা বলতে ভুলে যায়। পিয়াশ,তন্ময়,মিন্টুর চোখে একরাশ বিস্ময়। ফাঁটা নেত্রে ওরা প্রত্যাশাকে দেখতে থাকে। তাদের কাছে প্রত্যাশার এহেন কথা একবারে অপ্রত্যাশিত ছিলো। কসমিক কালেও যারা এই কথা ভাবেনি। আজ কিনা তা বাস্তবে,ওদের চোখের সামনে হচ্ছে? বিষয়টা ভাবতেই ওদের অক্ষিকটোর হতে বেরিয়ে মাটিতে লুটোপুটি খাওয়ার উপক্রম হয়। নাওয়াসের সম্বিৎ ফিরে। বিস্ময় ভাব কাটিয়ে অত্যন্ত ঠাণ্ডা স্বরে বলল,
“দেখো প্রত্যাশা তুমি আমার বন্ধু। খুব ভালো একজন বন্ধু। যার জন্য আমি আমার জীবনের মূল্যবান অনেক কিছু ফিরে পেয়েছি। এটা যেমন আমি কখনোই অস্বীকার করতে পারবো না। তেমনই তোমাকে বন্ধু ছাড়া, অন্য কিছু ভাবতেও পারবো না।”
প্রত্যাশার বক্ষ ধ্বক করে ওঠে। রন্ধে রন্ধে বিষ ছড়িয়ে পরে। প্রত্যাশা ভেবেছিলো নাওয়াসও হয়তো ওকে নিয়ে কিছু ফিল করে। তাই তো ওর প্রতি এতো কেয়ার করে। ওকে নিয়ে চিন্তা করে। কিন্তু নাওয়াসের দৃঢ় কণ্ঠে প্রত্যাশার ভাবনা ভুল প্রমাণিত হয়। নাওয়াস ফের বলে,
“আমাদের বন্ধুত্বরের সম্পর্কটাকে আমি শ্রদ্ধা করি। তোমাকে আমি নিজের বন্ধু ছাড়া,কখনও অন্য নজরে দেখিনি। আশা করবো। তোমার মনে তৈরি হওয়া এই ভ্রম,শীঘ্রই তুমি কাটিয়ে উঠবে। এবং এই ভ্রম কাটিয়ে আবার আগের মতো হয়ে যাবে।”
নাওয়াস নিঃসৃত ভ্রম শব্দে, প্রত্যাশার মনে হয় ওর কানে কেউ গরম শিশা ঢেলে দিচ্ছে। নিজের অনুভূতি এরূপ নাম সে মানতে পারে না। দাঁড়িয়ে থাকা শক্তি হারিয়ে ফেলে। কোনো মতে গলা হতে শব্দ টেনে এনে।
কম্পিত কণ্ঠে বলল,
“আই আ’ম স্যরি!”
প্রত্যাশা আর দাঁড়ায় না। প্রন্থান করে। প্রত্যাশার পুরো শরীর কাঁপছে। অক্ষিযুগলে টলমলে সমুদ্র। সব সময় শক্ত থাকা মেয়েটা নাওয়াসের প্রত্যাখ্যান মানতে পারে না। ভেঙে গুরিয়ে যায়। নিজের দূর্বলতা দেখাতে চাইনা। তাই সেখান থেকে দ্রুত চলে আসে। প্রত্যাশার টলমলে চোখ নাওয়াসের চোখের আড়াল হয়না। নাওয়াসের মনে প্রশ্ন জাগে,প্রত্যাশা কী কান্না করছে? পিয়াশ,তন্ময় মিন্টুও প্রত্যাশার অশ্রু সিক্ত আঁখিযুগল দেখেছে। কখনও প্রেম না করলেও। প্রত্যাশার অনুভূতি যে কোনো ভ্রম নয় তা ওদের বুঝতে অসুবিধা হয় না। এমনকি ওরাও এটায় ভাবতো নাওয়াস আর প্রত্যাশা একে অন্যকে ভালোবাসে। পিয়াশ বলল,
“ভাই আপনি কী সত্যিই প্রত্যাশাকে ভালোবাসেন না?”
পিয়াশের কণ্ঠে নাওয়াসের ধ্যান ছোটে। নাওয়াস পিয়াশের দিকে চাইল। সন্দিহান হয়ে জিজ্ঞেস করল,
“মানে?”
“প্রত্যাশার মন খারাপ হলে ওর মন ভালো করতে আপনি কেন মরিয়া হোন? কেন প্রত্যাশাকে কোনো ছেলে খারাপ কথা বলে আপনার রাগ হয়? আর কেনই বা প্রত্যাশার কথাতে আপনি পরিবর্তন হলেন? নিজের উগ্র জীবন ছেড়ে দিলেন?”
“কারণ ও আমার খুব ভালো বন্ধু হয়।”
“আমরাও তো আপনার বন্ধু হয়। আমরা যদি বলি ভাই আপনি বিয়ে করে নিন। আপনি কী শুনবেন আমাদের কথা?”
নাওয়াসের চোখ মুখ কঠিন হয়ে যায়। শক্ত স্বরে বলে,
“বিয়েটা কোনো মজার বিষয় না। এটা সারা জীবনের প্রশ্ন। এমন করে এই সব সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় না।”
“এটা সারা জীবনের প্রশ্ন বলে আপনি আমাদের কথা রাখতে পারলেন না। সিদ্ধান্ত নিতে পারলেন না। কিন্তু প্রত্যাশার এক কথায়, আপনি নিজের গোটা জীবন পরিবর্তন করে ফেললেন। দায়িত্ববান হয়ে উঠলেন। একবারও ভাবার প্রয়োজনবোধ করেনি। এটা কী ভালোবাসা না?”
তন্ময় বলে,
“আপনি যদি প্রত্যাশাকে ভালো না বাসেন। তাহলে এই সাতদিন ওর সাথে কথা না হওয়াই এমন ছোটফোট কেন করছিলেন? এত উত্তলা কেন ছিলেন? কেন কোনো কাজে মন দিতে পারেননি? এমন কী প্রত্যাশা রাগ করেছে বলে,নিজের পিএ অব্দি পাল্টে দিলেন। কেন? এগুলোর কারণ কী শুধুই বন্ধুত্ব?”
এবার সাহস করে মিন্টুও বলল,
“আর সব কিছুতে প্রত্যাশাকে সবার আগে কেন রাখেন? ওর গুরুত্ব আপনার কাছে সব কিছুর উর্ধ্বে কেন। অফিসের জরুরি মিটিং এর মধ্যেও প্রত্যাশা কল করলে বিলম্বহীন কল ধরেন? গুরুত্বপূর্ণ মিটিং রেখে প্রত্যাশার কাছে ছুটে যান? এগুলোর পিছনে কারণ কী?”
পিয়াশ,তন্ময়,মিন্টুর প্রশ্নে নাওয়াস বাক্যহীন হয়ে যায়। ওদের প্রশ্নের উত্তর করতে পারে না। উল্টে নিজ মনে নিজেই প্রশ্ন করে,
“সত্যিই তো এগুলো আমি কেন করি? শুধুই কী প্রত্যাশা আমার খুব ভালো বন্ধু তাই? না-কি আমিও ও-কে…”
নাওয়াস কোনো উত্তর পায় না। নাওয়াসের সব কিছু এলোমেলো লাগে। নাওয়াস আর এক মুহূর্ত ওখানে থাকে না। বাইকে চেপে বসে।
.
.
.
রাতে নাওয়াস অন্যমনস্ক হয়ে খাবার খায়। কামাল মাহমুূদ ভাবেন অফিসের বিষয় নিয়ে চিন্তিত। তাই ঘাটান না। তবে রিনা মন বলে নাওয়াসের অন্য কিছু হয়েছে। সেই যে দুপুরের আগে ফিরল। তারপর আর কোথায়ও যায়নি। অফিসে জয়েন করার পর থেকে, শুক্রবারের দিনটা নাওয়াস বন্ধুদের জন্য বরাদ্দ রাখে। কিন্তু আজ যাওয়া ঘণ্টা দুয়েকের মাঝেই ফিরে আসে। নাওয়াস চোখ মুখ দেখেও ওনার ভালো লাগে না। মনের খচখচানি দূর করতে, নাওয়াসের কক্ষের সামনে আসে। দরজা হালকা ভেড়ানো ছিলো। সেই ফাঁক গলিয়ে লাইটের ক্ষীণ আলো বাইরে আসছে। যা দেখে রিনা বুঝলেন,ঘরে লাইট এখনও জ্বলছে। এর মানে নাওয়াস জেগে আছে। উনি আস্তে করে দরজা খুললেন। নাওয়াস রুমের মধ্যে একটা রোকিং চেয়ার আছে। সেখানে চোখ বন্ধ করে বসে আছে নাওয়াস। রিনা ভিতরে প্রবেশ করে। স্নেহের সহিত হাত নাওয়াসের মাথায় রাখে। অকস্মাৎ স্পর্শে নাওয়াস কিঞ্চিৎ চমকায়। চোখ মেলে রিনা কে দেখে সোজা হয়ে বসে।
“আপনি?”
রিনা অপ্রস্তুত হয়। আশপাশে এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে বলল,
“তুমি কী কোনো বিষয় নিয়ে চিন্তিত আছো?”
নাওয়াস অবাক হয়। অবিশ্বাস্য নেত্রে রিনা দিকে চেয়ে বলল,
“তেমন কোনো ব্যাপার না। অফিসের বিষয়…”
“তুমি অফিসের বিষয় নিয়ে চিন্তিত নও,সেটা আমি জানি। তুমি যদি বলতে না চাও, তবে বলো না।”
নাওয়াস অবাক হয়। জিজ্ঞাস করে,
“আপনাকে কে বলল আমি অন্য বিষয়ে চিন্তিত?”
রিনা হালকা হাসেন। বললেন,
“মায়েরা সন্তারের মুখ দেখেই বুঝতে পারে তাদের মনে কী চলছে। তুমি কোনো বিষয় নিয়ে সংশয়ে ভুগচ্ছ। তবে সেই সংশয়ের কিনারা করতে পারচ্ছো না।”
রিনা থেমে আবার বলে,
“কিছু সংশয়ের সুরাহ একা একা করা যায় না। অন্যের সাহায্য লাগে।”
নাওয়াসের কানের কাছে রিনা বলা কথাটা বাজে, ‘মায়েরা সন্তারের মুখ দেখেই বুঝতে পারে তাদের মনে কী চলছে।’
পরপর নাওয়াসের মানসপটে প্রত্যাশার সেদিন হসপিটালে বলা কথাগুলো ভাসে। ‘উনি তোমায় পেটে ধারণ না করলেও, আত্মায় ধারণ করেছেন।’
রিনা চলে যেতে নিলে নাওয়াসের নিঃসৃত বাক্যে থমকে যায়।
“মা আমার কাছে একটু বসবে?”
রিনা তুরন্ত পিছে ফিরে নাওয়াসের আনন পানে চায়। নাওয়াস ফের বলে,
“ছোটো বেলা যেমন তোমার কোলে মাথা নিয়ে হাত বুলিয়ে,ঘুম পাড়িয়ে দিতে তেমন করে আজ ঘুম পাড়িয়ে দিবে?”
রিনা চোখ ছলছল করে ওঠে। এই সম্বোধনটা শোনার জন্য কত অপেক্ষা করেছেন। আজ যেনো উনি মা হওয়ার আসল আনন্দ পেলেন। এক প্রকার ছুটে এসে নাওয়াসের চোখ মুখে হাত বুলিয়ে বললেন,
“কী বললে ডাকলে? আবার বলো?”
“মা!”
রিনা হুঁহ করে কান্না করে দেন। নাওয়াস রিনাকে খাটে বসিয়ে রিনার সামনে হাঁটু ভেঙে বসে সিক্ত কণ্ঠে বলল,
“আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি তাই না? বিশ্বাস করো আমার তোমার প্রতি কখনও কোনো অভিযোগ ছিলো না। নিহানের প্রতিও না। আমি কারো মায়ার জড়াতে চাইনি। ভয় পেতাম তোমাদের কাছে গেলে, যদি তোমরাও হারিয়ে যাও। সেই কারণেই তোমাদের দূরে সরিয়ে রেখে ছিলাম। আমাকে ক্ষমা করে দিও। আমি খুব খারাপ ছেলে। এতদিন তোমার ভালোবাসাকে অবহেলা করেছি। কষ্ট দিয়েছি। খুব খারাপ আমি।”
নাওয়াসও কান্না করে।
“একদম আমার ছেলেকে খারাপ বলবি না। আমি জানি তুই আমাদের কতটা ভালোবাসিস। দূর থেকে সব সময় আমাদের আগলে রেখেছিস। তোর বাবাকে,আমাকে,নিহানকে আমাদের সবাইকে আগলে রেখেছিস। সবটা জানি আমি।”
রিনা থেমে আবার বলেন,
“নিহানের শরীর খারাপ হলে তুই সারারাত ওর ঘরের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতি। আমি ঘুমিয়ে পড়লে ওর কাছে আসতি। বিজনেসের কারণে কতবার তোর বাবার ক্ষতি করতে চেয়েছে লোকে। তাদের থেকে তুই, তোর বাবাকে রক্ষা করেছিস। নিহান হওয়ার সময় যখন আমি অসুস্থ ছিলাম। তখন তুই আমার খেয়াল রাখতি। আমার সুবিধা অসুবিধার খেয়াল রাখতি। সব সময় আড়াল থেকে আমাদের যত্ন নিয়েছিস।”
নাওয়াস বিস্মিত কণ্ঠে বলল,
“তুমি কী করে জানলে?”
“আমি যে মা হয়। আমি জানবো না আমার সন্তানকে?”
নাওয়াস রিনা কোলে মাথা গুজে। মা ছেলের এই মুধুময় মুহূর্তের নীরব সাক্ষি হয়ে থাকেন কামাল মাহমুদ আর নিহান। কামাল মাহমুদের চোখেও আজ খুশির অশ্রু চিক চিক করে। ঠোঁটে প্রশান্তি হাসি নিয়ে, মা-ছেলেকে নিজেদের মতো রেখে গেলেন। মনে মনে নিজের মৃ’তা স্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞ প্রকাশ করেন। তাকে ক্ষমা করার জন্য। এবং নাওয়াসের মতো একটা সন্তান দেওয়ার জন্য।
চলবে…
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন।)