#এক_ঝড়ো_হাওয়ায়
#লেখনীতে-ইনসিয়া আফরিন ইমারা
#পর্বঃ১১
কামাল মাহমুদ এখন পুরোপুরি বিপদ মুক্ত। ঔষুধের ফলে ঘুমাচ্ছেন। নাওয়াস ডাক্তারের সাথে অনুমতি নিয়ে কামাল মাহমুদ একবার দেখে আসে। আজ একমাস পর বাবাকে দেখছে। তাও কিনা এমন অবস্থায়? কামাল মাহমুদকে এভাবে দেখে নাওয়াসের বক্ষঃস্থলে র’ক্ত ক্ষরণ হয়। যতোই হোক মানুষটা তার বাবা হয়। নাওয়াস আর থাকতে পারে না। তুরন্ত পায়ে কক্ষ ত্যাগ করে।
হসপিটাল থেকে বেরিয়ে বাইরে চলে আসে। একটি ফাঁকা জায়গায় দাঁড়ায়। আঁখি হতে দুফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ে। কাধে কারো স্পর্শে নাওয়াস নিজের চোখের পানি মুছে ফেলে। সে চাইনা নিজের দূর্বলতা কাউকে দেখাতে। চোখ মুখ শক্ত করে পিছে ফিরে। নাওয়াস ভেবেছিলো পিয়াশ বা তন্ময় হবে। কিন্তু প্রত্যাশাকে দেখে কিঞ্চিৎ অবাক হয়। নিজের হাত ঘড়িতে সময় দেখে। আটটা বাজে। শীতের সময় আটটা মানে অনেক রাত। প্রত্যাশা এখনও হসপিটালে থাকায় নাওয়াস শুধায়,
“তুমি? বাড়ি যাওনি?”
“নাহ্!”
প্রত্যাশা কথা বলতে বলতে নাওয়াসের পাশাপাশি এসে দাঁড়ায়। আকাশের দিকে দৃষ্টিপাত করে। আকাশে চাঁদের অস্বস্তি না থাকলেও, অসংখ্য তাঁরা আকাশ জুড়ে নিজেদের বিস্তার লাভ করেছে।
“কেন?”
“এমনি!”
নাওয়াস আর কিছু বলে না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। কিয়ৎক্ষণ পর নীরাবতা কাটিয়ে নাওয়াস তার চিরপরিচিত নিরেট স্বরে বলে,
“থ্যাংঙ্ক’স! তোমার কারণে আমার বাবা বড়ো বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছেন।”
প্রত্যাশা হালকা হাসে। তারপর বলে,
“উঁহু্! আমি শুধু মাধ্যম মাত্র। ওনাকে আল্লাহ রক্ষা করেছেন।”
আবারও দুজনের মাঝে নীরাবতা চলে। এবার প্রত্যাশা বলে,
“জানো মানুষের জন্মের আগেই তার মৃ’ত্যু লেখা হয়। কখন কোন মানুষ কোন রোগে অথবা অ্যাকসিডেন্টে মা’রা যাবে। এগুলো সব আগে থেকেই নির্ধারণ করা থাকে।”
প্রত্যাশা থামে শ্বাস নিয়ে ফের বলে,
“জন্ম,মৃ’ত্যু’র মালিক আল্লাহ তায়ালা। এখানে মানুষের কোনো হাত থাকে না। এটা সম্পূর্ণ হায়াতের ব্যাপার। কারো মৃ’ত্যু’র জন্য নিজেকে কিংবা অন্য মানুষকে দায়ি করা, বোকামো ব্যতিত কিছু না।”
নাওয়াস ভ্রু কু্চকে প্রত্যাশার দিকে চাইলো। সহসাই শুধাল,
“কী বলতে চাইছো?”
“তোমার মায়ের মৃ’ত্যু সম্পূর্ণ আল্লাহ পদত্ত। ওনার হায়াত ও-তো টুকুই ছিলো। এখানে তোমার বাবার কোনো দোষ নেই। আল্লাহ চেয়েছিলেন বিধায় ওনার মৃ’ত্যু ঘটেছিলো।”
নাওয়াসের চোখ মুখ শক্ত হয়ে আসে। প্রত্যাশা পুনরায় বলে,
“আজ যদি তোমার বাবার হায়াত না থাকতো। ওনার যদি ভালো মন্দ কিছু হয়ে যেত। আর তার দায় যদি তোমাকে দেওয়া হতো তাহলে?”
নাওয়াস চমকায়। বিস্মিত কণ্ঠে বলে,
“আমাকে?”
প্রত্যাশা স্মিত হাসে।
“তোমার বাবার ব্রেইন স্টোকের কারণ কী জানো?”
নাওয়াস চুপ থাকে।
“স্ট্রেস! তুমও বাড়ি ছাড়ার পর উনি মানুসিক ভাবে ভেঙে পড়েন। দুশ্চিন্তা, হতাশায় ভোগেন। নিজেকে তোমার মায়ের মৃ’ত্যু’র জন্য দোষী মনে করেন। আর তার পরিনতি সরূপ ওনার মস্থিষ্কের স্নায়ুতে চাপ পড়ে।”
নাওয়াস স্তব্ধ, বিহ্বল। এতক্ষণ বিষয়টা সে ভাবেনি। মনে মনে আওড়াই,
“বাবা আমার জন্য স্টোক করেছে? বাবার এই অবস্থার জন্য আমি দায়ি?”
প্রত্যাশা হয়তো নাওয়াসের মনের অবস্থা বোঝে। তাই বলে,
“তোমার বাবার এই অবস্থার জন্য তুমি দায়ি নও। এটা ওনার ভাগ্যে লেখা ছিলো। ঠিক যেমন তোমার মায়ের ভাগ্যে ম’রণ ব্যাধি ক্যান্সার লেখা ছিলো। রোগ-ব্যাধি, বিপদ-আপদ সব কিছুই আল্লাহর তরফ থেকে আসে। ঠিক যেমন সুখ আসে। কিন্তু কী জানো তো?
আমরা মানুষরা বড্ড বোকা হয়। এটাই বুঝিনা দুঃখ আমাদের জীবনের পরীক্ষার জন্য আসে। আর সুখ সেই পরীক্ষার ফলাফল। আমরা দুঃখ আকঁড়ে সুখ গুলো হেলা করি…”
প্রত্যাশা এবার নাওয়াসের দিকে চাইল। নাওয়াস প্রত্যাশার দিকেই চেয়েছিলো। চোখে চোখ রেখে প্রত্যাশা বলে,
“দুঃখ গুলো আকঁড়ে না থেকে সুখ আকঁড়ে ধরো। তোমার একটা সুন্দর পরিবার আছে। বাবা আছে,ভাই আছে। একজন মা আছেন। যিনি তোমায় পেটে ধারণ না করলেও, নিজের আত্মায়, অস্বস্তিতে ধারণ করেছেন।
এখনও সময় আছে। তুমি একা নও নাওয়াস। তোমার সুখী পরিবার আছে। যেই সুখ তোমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। তার হাত ধরো। বিশ্বাস করো, তোমার জীবনে কোনো আক্ষেপ থাকবে না। আল্লাহ কোনে শূন্যস্থান রাখেন না। তোমার জীবনেও রাখেননি। সময় থাকতে যদি না বোঝো। হেলা করো। তাহলে এই সুখ গুলো আর থাকবে না। তখন তুমি সত্যিই একা হয়ে যাবা। চাইলেও আর কাউকে পাবে না। তখন কিন্তু আফসোস করে কূল পাবে না…”
প্রত্যাশা নিজের কথা বলে সেখান থেকে প্রন্থান করে। নাওয়াস প্রত্যাশার বলা প্রতিটা কথা ভাবে। নাওয়াসের ভিতরের সত্তা হঠাৎ বলে ওঠে,
“দেরী হওয়ার আগে ফিরে এসো নাওয়াস। নিজের ভুল ধারণা থেকে বেরিয়ে দেখো। সত্যিই তুমি একা নও। তোমার সুন্দর একটা পরিবার আছে। যারা তোমাকে ভালোবাসে। যারা তোমার অপেক্ষায় পথ চেয়ে আছে। তুমি ব্যতিত সেই পরিবার অসম্পূর্ণ…”
.
.
.
ঘড়ির কাটা যখন নয়টা পেরিয়েছে সেই সময় প্রত্যাশা বাড়িতে প্রবেশ করে। প্রত্যাশা বাড়ি ঢোকার সময় সদর দরজা খোলা পেয়ে, কিঞ্চিৎ অবাক হয়। প্রত্যাশার অবাকতার রেশ না কাটতেই পূর্ব ইমামের ভারিক্কি স্বরে ছোড়া প্রশ্ন কর্ণকুহরে প্রবেশ করে।
“কোনো ভদ্র বাড়ির মেয়ে, এত রাত করে বাড়িতে ফেরে?”
সহসাই প্রত্যাশার ভ্রু সংকুচিত হয়। হাত ঘড়ি দেখে বলল,
“মাত্র সাড়ে নয়টা বাজে। ঢাকা শহরের এটা সন্ধ্যের সমান।”
পূর্ব ইমাম রেগে গেলেন। হুংকার করে বলেন,
“তুমি আমাকে শেখাবে কোনটা রাত আর কোনটা সন্ধ্যে?”
অকস্মাৎ হুংকারে প্রত্যাশা হতভম্ব হয়। প্রত্যাশা বুঝে পায়না। হঠাৎ পূর্ব ইমাম রেগে কেনো গেলো। প্রত্যাশা বলল,
“বাবা আমি কাজ করি। কাজের জন্য অনেক সময় লেট হয়। এর আগেও তো আমি আটটার পরে বাড়ি এসেছি। হ্যাঁ আজ আটটার বেশি বেজে গেছে। এতে এতো রিয়াক্ট করার কী আছে? আমি তো আর কোনে বাচ্চা নয়। যে রাতে রাস্তা হারিয়ে ফেলবো।”
“দিন দিন সভ্যতা, ভদ্রতা সব ভুলে যাচ্ছো।”
“এখানে অসভ্যতার কী আছে?”
প্রত্যাশার প্রশ্নে পূর্ব ইমাম আরও বেশি রেগে যান। বলেন,
“তোমার কারণে আজ আমার মাথা নিচু হয়ে গেলো।”
পূর্ব ইমামের নিঃসৃত বাক্যে প্রত্যাশা কিংকতর্ব্যবিমুঢ় হয়ে যায়।
“আমি কী করলাম?”
“তুমি যদি রাত করে বাড়ি না আসতে, তাহলে আমাকে পাত্র পক্ষের সামনে অপমানিত হতে হতো না।”
প্রত্যাশা চমকিত বলে,
“পাত্র পক্ষ মানে?”
“আজ তোমাকে দেখতে পাত্র পক্ষ এসেছিলো। কিন্তু তুমি কী করলে দেরী করে বাড়ি ফিরলে। তুমি জানো ওদের সামনে আমি কতটা অপমানিত হয়েছি?”
প্রত্যাশা বিস্মিয়ে কথা বলতে ভুলে যায়। পরপর চোখ মুখ শক্ত হয়ে আসে। কাঠ কণ্ঠে বলে,
“এখানে তো আমার কোনো ভুল নেই। তুমি আমাকে না জানিয়ে পাত্র পক্ষ এনেছিলে। যার সম্পর্কে আমি বিন্দু মাত্র অবগত ছিলাম না। তার দায় তুমি আমাকে দেবে না। এখানে সম্পূর্ণ তোমার ভুল। আর তাই তুমি অপমানিত হয়েছো।”
প্রত্যাশার কাঠ কণ্ঠে ছোড়া বানীতে পূর্ব ইমাম বিহ্বল বনে যায়।
“তুমি আমার দিকে আঙ্গুল তুলছো? তোমার এত বড়ো স্পর্ধা?”
প্রত্যাশাও এবার রেগে যায়। বলে,
“হ্যাঁ তুলছি। তুমি তুলতে বাধ্য করছো। আমি অবাক না হয়ে পারছি না। তুমি আমায় না জানিয়ে আমার বিয়ে জন্য ছেলে দেখছো? লাইক সিরিয়াসলি?”
“তোমাকে জানানোর প্রয়োজন বোধ করিনি।”
“তুমি আমার বিয়ের জন্য সম্বোন্ধ দেখছো। আর তুমি বলছো আমাকেই জানানোর প্রয়োজন বোধ করনি?”
“না করিনি! কারণ আমি তোমার বাবা হয়। তোমার জীবনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার আমার আছে।”
“নাহ নেই। তুমি নিজের মতামত রাখতে পারো। কিন্তু তোমার কোনো সিদ্ধান্ত, তুমি আমার ওপর চাপিয়ে দিতে পারো না।”
পূর্ব ইমান বিস্ময়ভূত হয়ে বললেন,
“কী বললে তুমি? তোমার জীবনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত, নেওয়া অধিকার আমার নেই? তুমি ভুলে যাচ্ছো আমি তোমার বাবা হয়। তোমাকে জন্ম আমিই দিয়েছি।”
“জন্মদিয়েছো বলে তুমি আমার সাথে, যা খুশি করতে পারো না। আমি কোনো পুতুল নয়।”
পূর্ব ইমাম গলার স্বর দ্বিগুন চওড়া করে বললেন,
“পারি একশো বার পারি! সব সময় সবকিছুর ওপর তোমার জেদ চলবে না। এবার আমি যা বলবো তাই হবে। আমি তোমার বিয়ে দেবো। আর তোমাকেও বিয়ে করতে হবে। ব্যস, এটাই আমার শেষ কথা।”
প্রত্যাশা নিজেকে সামলায়। রাগ নিয়ন্ত্রণ করে ঠাণ্ডা স্বরে বলে,
“আমি তো বলছি না আমি বিয়ে করবো না। আমি বিয়ে করবো। কিন্তু এখন না। আমি এখন বিয়ে করার জন্য প্রস্তুত নয়।”
“এখন করবে না তো কখন করবে? নিজের বয়স দেখেছো? চব্বিশ পার করে গেছো। পঁচিশ পেরিয়ে গেলে তোমার আর বিয়ে হবে? তুমি যদি বিদেশে না যেতে। এতো দিনে তোমার সুন্দর একটা সংসার থাকতো। তা না করে তুমি বিদেশে গেলে। কী সব ডিজাইন কোর্স করলে। এগুলো সময় নষ্ট ছাড়া কিছু না। শুধু শুধু বিয়ের বয়স পার করলে।”
প্রত্যাশা স্তব্ধ, বিমূর্ত বনে যায়। বিমূর্ত কণ্ঠে বলে,
“বাবা তুমি এসব কী বলছো? শুধুমাত্র বিয়ে সংসার একটা মেয়ের জীবনের লক্ষ্য হতে পারে না। আজকের যুগে দাঁড়িয়ে,তুমি এই ধরনের কথা বলছো?”
“তুমি আমাকে যুগ দেখাতে এসো না। মেয়ে হয়ে জন্মেছো। বিয়ে, সংসার করবে। তা না তুমি বাইরে কাজ করবে। আমি এতদিন তোমার জেদ মেনে নিয়েছি। কিন্তু আর না। তোমার এই উগ্রপন্থী জীবন আমি আর মানবো না। অতিস্বত্বর আমি তোমার বিয়ে দেবো।”
পূর্ব ইমাম নিজ বাক্য শেষ করে,চলে যান। প্রত্যাশা হতচেতন হয়ে পূর্ব ইমামের প্রন্থান পথে চেয়ে রয়। মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে,
“মা এসব কী? তুমি বাবাকে কিছু বলবে না?”
মিনা প্রত্যাশার নিকট এগিয়ে আসে। মাথা হাত বুলিয়ে মোলায়েম স্বরে বলেন,
“দেখ মা বিয়ে এক না একদিন করতেই হবে। তুই আর তোর বাবার অবাধ্য হোস না। মানুষটা তোকে নিয়ে বড্ড দুশ্চিন্তায় থাকেন।”
“মা তুমিও এমন কথা বলছো? একবার আমার দিকটা ভেবে দেখছো না? আমি বিয়ের জন্য মানুসিক ভাবে প্রস্তুত নয়। আমার সময় প্রয়োজন। এত বড়ো একটা সিদ্ধান্ত আমি এভাবে হুট করে নিতে পারবো না।”
“তোর বাবা তোর জন্য পাত্র দেখছে। আর পাত্র দেখলেই বিয়ে হয়ে যায় না। ততোদিনে তুইও সময় পেয়ে যাবি। এই নিয়ে আর ঝামেলা করিস না। উনি তো তোর বাবা হন। উনি কী তোর খারাপ চাইবেন? কোনো বাবা-মা কী তার সন্তানের খারাপ চাই?”
“আমি সেটা বলিনি মা! কিন্তু…”
“আর কোনো কিন্তু না। তোর পছন্দ না হলে আমরা তো আর জোর করে বিয়ে দেবো না। এখন যা হাত মুখ ধুয়ে নে। আমি খাবার দিচ্ছি।”
মিনা চলেন যান প্রত্যাশা মনে মনে বলে,
“তুমি যায় বলো মা। আমি বাবাকে খুব ভালো করে চিনি। বাবার যদি ছেলে পছন্দ হয়। বাবা আমার মতামতের কোনো গুরুত্ব দেবে না। জোর করে হলেও আমার বিয়ে দেবে।”
চলবে…
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন।)