এক ঝড়ো হাওয়ায় পর্ব-০৮

0
5

#এক_ঝড়ো_হাওয়ায়
#লেখনীতে-ইনসিয়া আফরিন ইমারা
#পর্বঃ০৮

প্রত্যাশা চোখ খোলার পর নিজেকে হসপিটালের বেডে আবিষ্কার করল। অ’জ্ঞা’ন হওয়ার আগে মুহূর্ত মানসপটে ভেসে উঠল। ঘাড়ে ব্যথা করছে। প্রত্যাশা ধীরে ধীরে ধীরে উঠার চেষ্টা করল। সেই সময় একজন নার্স এগিয়ে এসে বলল,

“আপনি উঠবেন না। আপনার শরীর দূর্বল।”

প্রত্যাশা আর ওঠার চেষ্টা করে না। নার্স ফের বলল,

“আমি আপনার পরিবারের লোকদের খবরটা জানিয়ে আসি।”

নার্সে বের হয়ে যেতে নিলে প্রত্যাশা পিছু ডেকে বলল,

“শুনুন!”

“জ্বি!”

“আমাকে যে ছেলেটা হসপিটালে নিয়ে এসেছিলো। তাকে একটু ডেকে দিবেন?”

“উনি তো আপনাকে হসপিটালে এডমিট করেই চলে গেছেন।”

প্রত্যাশা ছোট্ট করে বলল,

“ওহ্!”

“জ্বি!”

নার্স চলে যায়। প্রত্যাশা মনে মনে ঠিক করে। হসপিটাল থেকে বাড়ি ফিরে নাওয়াসকে আগে ধন্যবাদ জানাবে। আজ যদি সময় মতো নাওয়াস না আসত। তাহলে এতক্ষণে হয়তো পুলিশ ওর মৃ’ত্যু দেহ পেত। আর কালকের কাগজের শিরোনাম হয়ে যেত। প্রত্যাশা তাচ্ছিল্য হাসে। মানুষ সব কিছুতে নিজের লাভ খোঁজে। প্রত্যাশা যখন নিজের ভাবনায় মত্ত ছিলো। তখন ওর মা ছুটে এসে ওকে জড়িয়ে ধরে। কাঁন্না মিশ্রিত কণ্ঠে বলে,

“তুই ঠিক আছিস মা? তোর কিছু হয়নি তো?”

প্রত্যাশা মিনা বেগম কে শান্ত করতে বলল,

“আমি ঠিক আছি। এমন করে কান্নাকাটি করো না। তোমার শরীর খারাপ করবে।”

“তুই কী করে বুঝবি মায়ের কষ্ট?”

প্রত্যাশা হালকা হাসে। তখনই কানে আসে পূর্ব ইমামের গমগমে কণ্ঠস্বর।

“আমি আগেই সাবধান করেছিলাম তোমায়। সংযত হয়ে চলতে বলেছিলাম। কিন্তু তুমি আমার কথা শোনোনি। উল্টে প্রতিবাদ করতে গেছিলে। দেখলে তো তোমার প্রতিবাদের পরিনাম?”

প্রত্যাশা হতবাক হয় এই সময়ও তার বাবা এধরণের কথা বলছে? পূর্ব ইমাম ফের বললেন,

“আজ যদি ওরা তোমার সাথে কিছু করে দিতো। তখন কী হতো একবারও ভেবে দেখেছো? মুখ লুকানোর জায়গা পাওয়া যেত না।”

প্রত্যাশা উঠে বসল। বিস্মিত কণ্ঠে বলল,

“সিরিয়াসলি বাবা তুমি এখন এই সব কথা বলছো? ওরা তোমার মেয়ের সন্মানহানী করার চেষ্টা করেছিলো। তোমার তো ওদের পুলিশে দেওয়া উচিত।”

পূর্ব ইমাম ত্রাস স্বরে বললেন,

“খবরদার প্রত্যাশা এই ভুল করবে না। থানা পুলিশের ভিতরে যাবে না। একবার থানা পুলিশ হলে বিষয়টা সারা এলাকায় ছড়িয়ে পড়বে। এতে আমাদের সন্মানহানী হবে।
সবাই তোমার চরিত্র নিয়ে কথা বলবে। তোমার নামে কুৎসা রটাবে।”

প্রত্যাশা হতবিহ্বল হয়ে যায়। সাথে রাগও হয়। কিছু বলতে নিবে মিনা বললেন,

“তোর বাবা ঠিক বলেছে। তুই আর এই সবের ভিতরে জড়াবি না। যা হয়েছে ভুলে যা। এই ব্যাপার নিয়ে আর বেশি জল ঘোলা করার দরকার নেই।”

“মা তুমি…”

“হ্যাঁ আমি বলছি।”

প্রত্যাশা বিস্মিত বিহ্বল, বিমূঢ়। তার পরিবারের এরূপ চিন্তা ধারা প্রত্যাশা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না। প্রত্যাশা বিক্ষিপ্ত মনে বসে রইল।
.
.
.
সেই ঘটনার পনেরো দিন পার হয়ে গেছে। সেদিনের ঘটনার পর পূর্ব ইমাম প্রত্যাশাকে ঘর বন্দি করে রাখেন। প্রত্যাশার মা-ও তাতে সায় দেয়। এবং এই পনেরো দিন প্রত্যাশাকে কড়া নজরে রাখেন। পনেরো দিন অনেক বুঝিয়েও বাড়ি থেকে বের হতে পারেনি। যখন প্রত্যাশা সবার সামনে কথা দিলো, যে সে আর কোনো রকম ঝামেলায় জড়াবে না। তারপরে যেয়ে প্রত্যাশা বাড়ির বাইরে আশার অনুমতি পেল।

“আচ্ছা ঠিক আছে। আমি কথা দিচ্ছি। আমি আর কোনো দিন কোনো ঝামেলায় জড়াবো না। কোনো ধরনের প্রতিবাদ করবো না। নিজের হাত আর মুখ সামলে রাখবো…”

পূর্ব ইমামের গম্ভীর স্বর,

“বেশ,আমি তোমাকে বাহিরে যাওয়ার অনুমতি দিলাম। আশা করি বরাবরের ন্যায় তুমি নিজের কথা রাখবে।”

প্রত্যাশা গাল ভরে শ্বাস নিয়ে বলল,

“রাখবো!”
_________

পনেরো দিন পর বাইরে বের হতে পেরে প্রত্যাশা বুক ভরে শ্বাস নিলো। প্রত্যাশার নিজেকে এই মুহূর্তে মুক্ত পাখি মনে হচ্ছে। প্রত্যাশা মুগ্ধ হয়ে চারপাশ দেখছে। মনে মনে বলল,

“এমন খোলা আকাশের নিচে চলার স্বাধীনতায় তো চেয়ে ছিলাম।”

হঠাৎ প্রত্যাশার নাওয়াসের কথা মনে আসে। সেদিন নাওয়াসের জন্যই অ-তো বড়ো একটা বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছিলো। তার জন্য ওর একটা ধন্যবাদ প্রাপ্য আছে। এছাড়াও নাওয়াস দু-দুবার পিউকে বাজে পরিস্থিতি থেকে বাঁচিয়ে ছিলো। প্রত্যাশার মনে হলো নাওয়াস খারাপ নয়। সব বখাটে খারাপ হয় না। সাথে এটাও ভাবল। প্রথম দিন ওভাবে থা’প্প’ড় মা’রা ঠিক হয়নি। ক্ষমা চাওয়া উচিত। হুম একি সাথে ক্ষমা চাওয়া আর ধন্যবাদ দেওয়া, দুটোই হয়ে যাবে। প্রত্যাশা একটা রিঁকশা ডেকে উঠে বসল। নাওয়াসরা যেখানে আড্ডা দেয়। সেই জায়গার নাম বলল। কিন্তু অবাক করার বিষয় নাওয়াসদের আড্ডার জায়গাটা ফাঁকা ছিলো।

“সচারচর তো এখানে থাকে। আজ নেই কেন? আজ কী এখনও আসেনি? হবে হয়তো। বাড়ি ফেরার সময় না হয় ধন্যবাদ জানাবো।”

প্রত্যাশা ভেবেছিলো নাওয়াসদের আড্ডার ওখানে রিঁকশা থামিয়ে কথা বলবে। কিন্তু নাওয়াস না থাকায়, রিঁকশা ওয়ালাকে বুটিকে নিয়ে যেতে বলল। প্রত্যাশার ড্রেস হোম ডেলিভারিও করে। আজ প্রত্যাশার কয়েকটা ড্রেস ডেলিভারি করার আছে। কিন্তু ডেলিভাবি ম্যান ছুটিতে আছে। সেকারণে প্রত্যাশা নিজেই ডেলিভারি দিচ্ছিল। শেষ ডেলিভারি করে ফেরার সময় হুট করেই বৃষ্টি নামে। শীতের সময়ে বৃষ্টি হওয়াই প্রত্যাশা বিরক্ত হয়। রিঁকশাওয়ালা হুড তুলে দিলেন। বৃষ্টির গতি বাড়তে থাকে। প্রত্যাশা রিঁকশাওয়ালাকে জোরে বৃষ্টি নামার আগেই দ্রুত পৌঁছে দিতে বলল। হঠাৎ রিঁকশাওয়ালা থেমে যান।

“কী হলো মামা থামলেন কেন?”

“সামনে মনে হয় অ্যাকসিডেন্ট হইছে।”

প্রত্যাশা সাথে সব সময় ছাতা রাখে। ব্যাগ থেকে ছাতা বের করে নেমে আসল। ভিড় ঠেলে সামনে যেতেই প্রত্যাশা আঁতকে ওঠে। র’ক্তা’ক্ত অবস্থা নাওয়াস মাটিতে পড়ে আছে। আর পাশে বসে সমানে নাওয়াসকে ডাকছে। আর লোকের সাথে সাহায্য চাইছে। কিন্তু কেউ এগিয়ে আসছে না। বরং ফোনে ভিডিও করছে। প্রত্যাশার প্রচুর রাগ হয়। একটা বাচ্চা ছেলে সাহায্য চাইছে। যার কপাল কেটেও র’ক্ত ঝড়ছে। আর লোকজন কি-না ভিডিও করতে ব্যস্ত? প্রত্যাশা ক্রোধে হিসহিসে বলল,

“এই আপনারা কী মানুষ? একটা বাচ্চা ছেলে আপনাদের কাছে সাহায্য চাইছে। আর আপনারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিডিও করছেন?”

ভিড়ের মধ্যে থেকে একজন বলল,

“ওদের মতো বখাটেদের এমন পরিনামই হয়…”

প্রত্যাশা দ্বিগুন তেজ নিয়ে বলল,

“বখাটে বলে কী মানুষ না? আর এই বাচ্চাটা? ওর কী দোষ? ওকেও তো সাহায্য করতে পারেন।”

“আপনার যখন এতো দরদ আপনি করুন না। এই সব ঝামেলায় জড়ানোর আমাদের কোনো শখ নেই।”

“সেটা আমি করবো। আপনাদের বলা প্রয়োজন নেই। এখন যান এখান থেকে। ফ্রিতে অনেক বিনোদন নিয়েছেন। এই মুহূর্তে জায়গা ফাঁকা করুন।”

“এই চলো চলো।”

লোক গুলো চলে যায়। নিহান সমানে নাওয়াসের মুখে পানি দিচ্ছে আর ডেকে চলেছে। প্রত্যাশা গিয়ে বলল,

“নিহান আগে তোমার ভাইয়াকে হসপিটালে নিতে হবে। এভাবে নিয়ে বসে থাকলে হবে না।”

নিহান এতক্ষণ নিজেকে সামলে রেখেছিলো। কান্না করেনি। প্রত্যাশাকে দেখে কান্না করে দিলো।

“আপু প্লিজ কিছু করো। আমার ভাইয়াকে প্লিজ বাঁচিয়ে দাও। ওরা খুব মে’রেছে ভাইয়াকে…”

“শান্ত হও। তোমার ভাইয়ার কিছু হবে না।”

প্রত্যাশা নিজের ব্যাগ থেকে রুমাল বের করে নিহানের ক্ষত স্থানে দিয়ে বলল চেপে ধরে রাখতে। তারপর উঠে একটা সিএনজি ডাকলো। নিহান আর প্রত্যাশা মিলে নাওয়াসকে সিএনজিতে ওঠালো। সিএনজি ওয়ালা প্রথমে যেতে চাইনি। প্রত্যাশা যখন দ্বিগুন টাকা দেবে বলে। তখনই রাজি হয়। প্রত্যাশা একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। নাওয়াসের শরীরে অসংখ্য চোট। কপালের কাছে অনেকক্ষাণি কেটে গেছে। যা দিয়ে অনর্গল র’ক্ত পড়ছে। প্রত্যাশা নিজের স্কার্ফের এককোণা দিয়ে নাওয়াসের মাথার কাটা স্থান চেপে ধরে র’ক্তপাত কমানোর জন্য। একপল নিহানের ফ্যাকাসে মুখের দিকে চাইল। ছেলেটা নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করছে। নিহান যে নাওয়াসকে অনেক ভালোবাসে তা ওকে দেখলেই বোঝা যায়। ওর নিজের কপালও ছুড়ে গেছে। সামান্য হলেও। একবারে সামান্যও নয়। কিন্তু তবুও ছেলেটা নিজের ব্যথা উপেক্ষা করে, নাওয়াসকে নিয়ে ব্যস্ত। প্রত্যাশা চোখ ঘুরিয়ে নাওয়াসের দিকে চাইল। শ্যামবর্ণ চেহারায় কোনো উজ্জ্বলতা নেই। সকাল থেকে যার দেখা পেতে চাইছিলো। তার সাথে যে এভাবে দেখা হবে ভাবেনি। অজানা এক কারণে প্রত্যাশা বুক ভারি হয়। প্রত্যাশা কখনও কল্পনাও করেনি নাওয়াসকে এভাবে দেখবে। প্রচুর র’ক্ত বেরিয়ে গেছে। এখনও বের হচ্ছে। প্রত্যাশার বুক ঢিপ ঢিপ করে। অজানা ভয়ে বক্ষ উত্তাল হয়ে আছে।

প্রত্যাশা নাওয়াসকে হসপিটালে ভর্তি করে। নিহানকেও নার্স ব্যান্ডেজ করে দিলো। প্রত্যাশা নিহানের থেকে ওর বাড়ির নাম্বার নিয়ে, বাড়িতে জানিয়ে দিলো। কিয়ৎক্ষণ পরে এক মধ্যবয়সী মহিলা ছুটে আসেন। চোখে অশ্রু। কপালে চিন্তার ছাপ। একজন নার্সকে শুধাল,

“এখানে নাওয়াস আফফান আর নিহান মাহমুদ বলে কেউ ভর্তি হয়েছে?”

মধ্যবয়স্ক মহিলার নিঃসৃত বাক্য কর্ণকুহের প্রবেশ করতে, প্রত্যাশা ঘাড় ঘুড়িয়ে চাইলো। এগিয়ে গিয়ে বলল,

“এক্সকিউজ মি! আপনি কী নাওয়াস আর নিহানের মা?”

কারো কণ্ঠস্বরে মহিলাটি তুরন্ত পিছে ফিরল

“হ্যাঁ! কিন্তু আপনি?”

“জ্বি! আমি প্রত্যাশা। আমিই আপনাকে ফোন করেছিলাম।”

“আমার ছেলেরা কেমন আছেন? আমাকে ওদের কাছে নিয়ে চলুন।”

“আপনি শান্ত হন আন্টি। ওরা ঠিক আছে। ডাক্তার চেক করছে। আর আপনি আমাকে তুমি করে বলুন।”

নিহানের স্যালাইন চলছে। নাওয়াসের এখনও জ্ঞান ফেরেনি। তবে বিপদ মুক্ত। প্রত্যাশা স্বস্তির শ্বাস ফেলল। মনে হলো বক্ষ হতে বড়ো কোনো পাথর নেমে গেলো। প্রত্যাশার মা অনেকক্ষণ ধরে প্রত্যাশাকে কল করছে। প্রত্যাশা কল রিসিভ করছেনা।

“তোমার বাড়ি থেকে বোধহয় ফোন করছে। তুমি বরং বাড়ি চলে যাও।”

“না আন্টি প্রব্লেম নেই।”

“অনেক রাত হয়েছে। তুমি অনেকটা করেছো। এখন বাড়ি যাও।”

“কিন্তু আপনাকে একা রেখে আমি কীভাবে যাবো? যদি কোনো প্রয়োজন হয়?”

রিনা হালকা হাসেন। বললেন,

“তুমি চিন্তা করো না। কিছুক্ষণের মধ্যেই ওদের বাবা চলে আসবে। তুমি যাও।”

প্রত্যাশা কিয়ৎক্ষণ ভাবলো। সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত হতে চলল। সত্যিই এখন বাড়ি যাওয়া উচিত। তাই আর দ্বিমত করলো না। বলল,

“আচ্ছা! আপনি সাবধানে থাকবেন। নিজের খেয়াল রাখবেন। ওদের চিন্তায় নিজে অসুস্ত হবেন না।”

প্রত্যাশা ব্যাগ থেকে পানি, কেক আর বিস্কেটের প্যাকেট বের করে রিনাকে দিয়ে বলল,

“এগুলো খেয়ে নিবেন।”

রিনা পানি আর কেক,বিস্কেট নিয়ে প্রত্যাশার মাথায় স্নেহের সহিত হাত বুলিয়ে বললেন,

“তুমি খুব ভালো। আল্লাহ তোমার মনের সকল নেক আশা পূরণ করুন। ফি আমানিল্লাহ!”

বিনিময়ে প্রত্যাশা মুচকি হাসে। তারপর সেখান থেকে প্রন্থান করেন।

চলবেয়…

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে