#এক_ঝড়ো_হাওয়ায়
#লেখনীতে-ইনসিয়া আফরিন ইমারা
#পর্বঃ০৫
তীব্র বর্ষণের পর মুহূর্তে প্রকৃতি হয়ে ওঠে মনোমুগ্ধকর। ভেজা মাটির গন্ধে আশপাশ মোঁ মোঁ করে। প্রত্যাশা বুটিককে যাবে। আজ নতুন ড্রেসের কালেকশন আসবে। বুটিককে প্রচুর কাজ আছে। বৃষ্টির কারণে এমনিতেই অনেকটা দেরী হয়ে গেছে। তারপর রিঁকশা বা সিএনজি কোনোটায় পাচ্ছে না। নিজের হাত ঘড়িতে সময় দেখে নিলো। প্রায় ত্রিশ মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তবুও কোনো রিঁকশা বা সিএনজির দেখা মেলেনি। উপায়ান্ত না পেয়ে প্রত্যাশা হাঁটা শুরু করে। একা একাই বিড়বিড় করে বলে,
“দরকারের সময় একটা রিঁকশা বা সিএনজি পাওয়া যায় না। অথচ যখন লাগে না। তখন এসে জিজ্ঞেস করবে, মামা যাবেন। অসহ্য।”
প্রত্যাশা রিঁকশাওয়ালাদের গুষ্টি উধার করতে করতে হাঁটছিলো। একটা রিঁকশা দেখতে পেয়ে থামানোর জন্য দাঁড়ালো প্রত্যাশা। হঠাৎ চার-পাঁচটা দ্রুতগামি বাইক ওর পাশ ঘেষে চলে যায়। বৃষ্টির কারণে রাস্তার ছোটো ছোটো গর্তে ময়লা পানি জমে আছে। সেই সমস্ত পানি ছিটকে প্রত্যাশার গায়ে পড়ে। পায়ের পাতা থেকে হাঁটুর উপোরিভাগ পর্যন্ত কাঁদা পানিতে মেখে গেছে। অকস্মাৎ ঘটনায় প্রত্যাশা হতভম্ব হয়ে গেছে। বড়ো বড়ো চোখে একবার নিজেকে অবলোকন করে। বাইক গুলোর দিকে তাকালো। দ্রুতগামী বাইকের মধ্যে প্রথম দুটো বাইকের, একটা বাইক পিচ রাস্তায় ছিটকে পড়ে। পরপর পিছের তিনটে বাইক তাদের নিকট বাইক থামায়। পড়ে যাওয়া বাইকের লোক দুজনকে তুলে, বেধম পেটাতে শুরু করে। প্রত্যাশা চমকায়। ত্রস্ত পায়ে এগিয়ে যায়। সামনে এগিয়ে যেতেই নাওয়াস আর ওর সাঙ্গপাঙ্গদের নজরে পড়ে। নাওয়াস আর ওর সাঙ্গপাঙ্গদের দুজন ছেলেকে মা’রতে দেখে প্রত্যাশার মাথায় র’ক্ত চড়ে যায়। নাওয়াস একজনের কলার টেনে মাটি থেকে তুলল। ঘুষি মারতে নিবে, তৎক্ষণাৎ হাতে টান অনুভব হয়। এখানে প্রত্যাশাকে দেখে মিন্টু,পিয়াশ,তন্ময় অবাক হয়। মিন্টু তো প্রত্যাশাকে দেখা মাত্রই লুকিয়ে পড়ে। নাওয়াস পিছে ফিরতে প্রত্যাশাকে দেখতে পায়। প্রত্যাশাকে দেখা মাত্র নাওয়াসের পোক্ত চোয়াল আরও শক্ত হয়ে আসে।
“দিন দুপুরে গুণ্ডামি করতে লজ্জা করে না?”
“হাত ছাড়ো!”
নাওয়াসের নিরেট চোয়াল। প্রত্যাশা নাওয়াসের কথা সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করল। নিজের মতো বলতে লাগল।
“একজন মানুষ হয়ে, অন্য আরেকজন মানুষকে কেউ এভাবে মা’রে? আপনার মধ্যে কী বিন্দু মাত্র দয়া-মায়া নেই?”
নাওয়াস রাগে হিতাহিত জ্ঞান শূন্য হয়ে পড়ে। দিকবেদিক ভুলে প্রত্যাশার থেকে নিজের হাত ঝাটকা মে’রে ছাড়িয়ে নিলো। আকস্মিক পুরুষালি ঝাটকাই প্রত্যাশা দু-পা পিছিয়ে যায়। রাস্তায় পড়ে থাকা ইটের টুকরোতে পা লেগে মাঝ রাস্তায় পড়ে যায়। নাওয়াসের এভাবে ধাক্কা দেওয়ায় প্রত্যাশা হতভম্ব হয়ে যায়। নাওয়াস রাগে দন্তে দন্ত পিষে বলল,
“না নেই। আমার কোনো দয়া- মায়া নেই। আমার মতো বখাটেদের দয়া-মায়া থাকে না।”
নাওয়াস ছেলেটা কে ধাক্কা মে’রে ফেলে দিলো। বাইকে বসে রাগে চটে সেখান থেকে প্রন্থান করল। প্রত্যাশার বিস্ময় ভাব কাটে আশ-পাশের মানুষের কানাকানিতে। রাস্তার মাঝে ছোটো খাটো একটা জটলা পাকিয়ে গেছে। প্রত্যাশা নিজেকে সামলে উঠে দাঁড়ায়। রাস্তায় জমায়েত উৎসুক লোকেদের উদ্দেশ্যে ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলে,
“তামাশা দেখা শেষ হয়েছে?”
প্রত্যাশার ঝাঁঝাল বাক্যে ভিড় কমে গেল। প্রত্যাশা একটা রিঁকশা দেখে রিঁকশায় চড়ে বসল। আজ আর বুটিকে গেল না। বরং বাড়ি ফিরে গেল। বাড়িতে ঢুকতেই পূর্ব ইমামের মুখোমখি হতে হলো। প্রত্যাশা মনে মনে বলে,
“আজকের দিনটায় খারাপ। নিশ্চয়ই বাবা ওকে এখন কথা শোনাবেন।”
প্রত্যাশার ভাবনা শেষ হওয়ার আগেই পূর্ব ইমাম ধমকে ওঠেন।
“কী শুরু করেছো তুমি? আমার মান-সন্মান ধুলোয় না মিশেনো পর্যন্ত কী তুমি খান্ত হবে না?”
স্বামী চিৎকারে মিনা বেগম ছুটে আসেন। মেয়েকে বাড়িতে দেখে যতটা না অবাক হোন। তার থেকেও বেশি অবাক হোন মেয়ের কাঁদায় মাখামাখি অবস্থায়। ধীম স্বরে শুধান,
“কী হয়েছে?”
“কী হয়নি বলো। আজ আবার ওই বখাটেদের সাথে মা’রা’মা’রি করেছে।”
“বাবা আমি মা’রামা’রি কর…”
প্রত্যাশার কথা সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই পূর্ব ইমাম ধমকে ওঠেন।
“চুপ কর!”
প্রত্যাশা ফের হাঁ করতে নিলে মিনা বেগমের ইশারায় চুপ হয়ে যায়। পূর্ব ইমাম প্রত্যাশাকে কড়াকড়া আরো কিছু বাক্য শুনিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে যান। উনি বের হতেই প্রত্যাশা মুখ ফুলিয়ে বলে,
“বিয়ে করার জন্য আর লোক পাওনি? এই খচ্চর লোকটাকেই পেয়ে ছিলে?”
মিনা বেগম চোখ রাঙিয়ে বলেন,
“প্রত্যাশা উনি তোমার বাবা হয়।”
“ধুর..”
প্রত্যাশা ধুপ ধাপ পা ফেলে চলে যায়।
.
.
.
নিহান টিফিন খেতে নিয়েছিলো মাত্র। তখন একজন ছেলে এসে বলল,
“ভাই আমার না আজ টিফিন আনা হয়নি। তোর থেকে খেতে পারি?”
নিহান হাসি মুখে বলল,
“কেন পারবি না। অবশ্যই পারবি। আয় বস।”
নিহান ছেলেটাকে বসার জায়গা করে দিলো। ছেলেটা একটা স্যান্ডউইচ খেয়ে নিলো। আরেকটাই আছে। তা দেখে বলল,
“এটাও খাবো?”
নিহান স্যান্ডউইচ খাওয়ার জন্য সবে হাতে নিয়েছিলো। বন্ধুর কথায় স্যান্ডউইচ এগিয়ে দিলো হেসে বলল,
“নে!”
ছেলেটা স্যান্ডউইচ খাওয়া শেষে উঠে দাঁড়াল বলল,
” আমি তো দুটোই খেয়ে নিলাম। তুই কী খাবি?”
“সমস্যা নেই! আমি কিছু কিনে খেয়ে নিবো।”
“থ্যাংঙ্ক’স রে! আমার অনেক খিদে পেয়েছিলো।”
ছেলেটা চলে গেল। নিহান পকেট হাতরে দেখলো টাকা নেই। সকাল থেকে অনেকে প্রয়োজন বলে নিয়ে ছিলো। নিহান হাসলো। এই সব কিছু পিউ এতক্ষণ দূরে দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করেছে। নিহান উঠে চলে যেতে নিলে, কেউ ওর দিকে টিফিন বক্স বাড়িয়ে দেয়। হাতের মালিককে দেখে নিহান কিঞ্চিৎ চমকায়। চমিকত সুরে বলে,
“পিউ!”
“তুমি আমার সাথে খাবার শেয়ার করবে?”
নিহান কিয়ৎক্ষণ পিউয়ের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে। মস্তিষ্কের নিউরন কথাটা ধরতেই বিস্মিত হয়। নিজের বিস্ময় ভাব রেখেই তুরন্ত বলে,
“না না! তার প্রয়োজন নেই। তুই খা।”
পিউ নিহানের মুখো মুখি বেঞ্চে বসে বলল,
“কেন প্রয়োজন নেই? তুমি না বলেছিলে আমি তোমার বন্ধু হয়? তাহলে বন্ধুর সাথে টিফিন শেয়ার করতে প্রব্লেম কোথায়? নাকি তুমি আমায় সত্যি সত্যি বন্ধু ভাবো না?”
নিহান যেন বড়ো সড়ো ধাক্কা খেলো। বিস্মিত লোচনে পিউকে দেখে বলল, “বন্ধু?”
“হ্যাঁ আমি আর তুমি। আজ থেকে আমরা বেস্ট ফ্রেন্ড। আমাকে আবার তোমার ধান্দাবাজ বন্ধুের মতোন ভেবো না। যারা শুধু নিয়েই খা’লাস। আমি পিওর, লয়াল ফ্রেন্ড।”
পিউয়ের নিঃসৃত বাক্যে নিহান বলল,
“আমি তোর টিফিন শেয়ার করতে পারি। তবে একটা শর্তে।”
“কী শর্ত?”
“তোকে আমায় তুই সম্বোধন করতে হবে। বন্ধু হলে পাক্কাওয়ালা বন্ধু হতে হবে।”
পিউ হেসে বলল,
“ওকে ডান! এখন ঝটপট খাওয়া শুরু কর। আজ টিফিন আমার আপু বানিয়ে দিয়েছে। আপু কিন্তু দারুণ রান্না করে। বিশেষ করে আপুর বানানো নুডুলস আমার সব থেকে প্রিয়।”
“ওকে পিওর পিউ!”
বলেই নিহান হেসে ফেলল। নিহানের সাথে পিউও হাসে।
__________
রাত নয়টার সময় নাওয়াস বাড়ি আসে। নিজের রুমে ঢুকে গায়ের শার্টটা খুলে রাখে। ওয়াশরুমে ঢুকতে নিবে। তখন রিনা আসেন। ধীরুজ কণ্ঠে বলে,
“এখনও ফ্রেশ হওনি? ফ্রেশ হয়ে নিচে আসো। আমি খাবার দিয়েছি।”
“আমি খাবো না। বাইরে থেকে খেয়ে এসেছি। আপনারা খেয়েনিন!”
নাওয়াসের নিরেট স্বর। রিনা আহত হয়। ম্লান কণ্ঠে বলল,
“নিহান তোমার সাথে খাবে বলে, অপেক্ষা করে ছিলো।”
নাওয়াস কোনো প্রত্যুত্তর করে না। রিনা দীর্ঘ শ্বাস ত্যাগ করেন। আজ অব্দি উনি নাওয়াসকে বুঝে উঠতে পারেনি। নাওয়াসের সাথে ফ্রি হওয়ার কম চেষ্টা করেননি। কিন্তু হতে পারেননি। ছোটো বেলায় যদিও একটু কাছে ঘেষতে পারতেন। বড়ো হওয়ার পর সেটাও পারেন না। ছোটো বেলায়ও নাওয়াস একা একা থাকত। কারো সাথে মিশতো না। এমন কী নিহানের সাথেও না। নিহান বড়ো ভাই বলতে পা’গল। কিন্তু নাওয়াস ওর সাথে ঠিক করে কথাই বলে না। ছোটো ভাই বলে কাছে ডেকে আদর করে না। দিন দিন কেমন এগুয়ে,জেদী হয়ে গেছে। এখন তো বখেই গেছে। ওনার মনে হয় নাওয়াস ওনাকে পছন্দ করেন না। হয়তো সৎ মা সেই জন্যই। আর নিহান ওনার ছেলে বলেই নিহানকেও, নিজের কাছে যেতে দেয়না। মাঝে মাঝে রিনার এটাও মনে হয় উনি মা হিসেবে ব্যর্থ। ওনার কারণেই নাওয়াস এমন বখে গেছে। রিনা মলিন মুখে চলে যেতে নিলে, নাওয়াসের নিঃসরণকৃত বাক্যে থেমে যান।
“আপনি খাবার দিন। আমি হাত মুখ ধুয়ে আসছি।”
রিনার মুখটা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। খুশি মনে ঘাড় নেড়ে চলে যান। নাওয়াস সচারচর ওনাদের সাথে ডিনার করে না। করতে চাই না। ভুল-ভবিষ্যৎ কখনো-সখনো করে। তাই আজ নিহান বলেছিলো নাওয়াসের সাথে খাবে। যদিও রিনা বলেছিলো নাওয়াস রাজি হবে না। কিন্তু নিহান দৃঢ়তার সহিত বলেছিলো,
“তুমি দেখো ভাইয়া আজ আমাদের সাথেই খাবে।”
মনে মনে কথা গুলো ভেবে রিনা মুচকি হাসেন।
পিউ আজকেও প্রত্যাশার সাথে ঘুমাতে এসেছে।
“আপু জানো আজ কী হয়েছে?”
প্রত্যাশা বিছানা গোছাছিলো। পিউয়ের কথায় কাজ করতে করতেই বলল,
“না বললে কী করে জানবো?”
পিউ বোকা হেসে বলল,
“আজ সকালে যখন আমি স্কুলে যাচ্ছিলাম। তখন আমাদের পাশের এলাকার দুজন বখাটে আমায় উত্যক্ত করছিলো।”
প্রত্যাশা আতঙ্কিত হয়ে বলল,
“কীহ্! কে তোকে উত্যক্ত করেছে? তোর সাথে কিছু করেনি তো?”
“আরে আপু থামো। আগে আমার কথা শুনো। আমাকে যখন ওরা উত্যক্ত করছিলো, তখন সে দিক দিয়ে নাওয়াস ভাইয়া যাচ্ছিল। আমায় বিরক্ত করতে দেখে ওদের পিটিয়ে ছিলো।
পরে তো ওরা নাওয়াস ভাইয়ার হাত থেকে পালিয়ে যায়। তখন নাওয়াস ভাইয়াও ওদের পিছু ধাওয়া করে।”
পিউয়ের কথায় প্রত্যাশার সকালের ঘটনা সরণ হয়। মনে মনে আওড়ায়,
“সকালে কী নাওয়াস ওই জন্যই ছেলে গুলো কে মা’রছিলো?”
চলবে…
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন।)