#এক_ঝড়ো_হাওয়ায়
#লেখনীতে-ইনসিয়া_আফরিন_ইমারা
#পর্বঃ০৩
বড়ো এবং বেশ পুরনো একটি কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে নাওয়াস ও তার বন্ধুরা বসে আছে। এখান থেকে কিছু দূরেই একটা চা-য়ের দোকানও আছে। নির্জন জায়গা। আশেপাশে দুয়েকটা বাড়ি আছে। তাও দূরে দূরে। এখানে লোকসমাগম কম বিধায় নাওয়াস দিনের বেশির ভাগ সময় এখানেই থাকে। এটা মূলত নাওয়াসদের আড্ডার জায়গা। মিন্টু তিন কাপ চা নিয়ে আসে। প্রথমে নাওয়াস কে দিলো। নাওয়াস চা নিয়ে এক চুমুক বসিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,
“মেয়েটার ব্যাপারে খোঁজ নিয়েছিস?”
“কোন মেয়ে?”-শুধাল তন্ময়।
“কালকের ওই মেয়েটা!”
মিন্টু সবে মাত্র চা-য়ে এক চুমুক দিয়েছিলো। কালকের ওই মেয়েটার কথা শুনে প্রথমেই মানসপটে থা’প্প’ড়ের দৃশ্য ভেসে ওঠে। সাথে সাথে মিন্টুর গলায় চা আটকে যায়। মিন্টু কেঁশে ওঠে। তন্ময় মিন্টুর পিঠে চাপ দিয়ে বলে,
“আরে আস্তে তোর চা কে নিয়ে যাচ্ছে না।”
মিন্টু নিজেকে সামলে বলে,
“ভাই ওই মেয়ের খবর নিয়ে কী করবেন? কী দরকার শুধু শুধু ওর খবর নেওয়ার? ছেড়ে দিন না। দেখা গেল খবর নেওয়ার জন্য, এসে আবার থা’প্প’ড় মা’রবে। আমি ওই মেয়ের থা’প্প’ড় আর খেতে চাই না। বাবা কী সাংঘাতিক জোর গায়ে। আপনি নিজেও তো খেয়েছেন ব…”
কথায় কথায় মিন্টু বেশি বলে ফেলেছে। বুঝে,নিজেই নিজের মুখ চেপে ধরে। নাওয়াস ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে মিন্টুর দিকে তাকিয়ে আছে। এই বুঝি চোখের অনল দিয়ে ভস্ম করে দেবে। মিন্টু শুষ্ক ঢোক গেলে। নাওয়াসের থেকে দু হাত দূরে চলে যায়। থড়বড় করে বলে,
“একটু লাগেনি। মেয়েদের হাতে লাগে নাকি। ওদের হাত তো কমল হয়। তুলার মতো নরম হয়। লাগে তো ছেলেদের হাতে। একদম ইটে মতো। না লোহার মতো, না না পাথরের মতো। যেমন আপনার হাতে লেগেছিলো। আমি তো বধির হতে হতে বেঁচে গেছি।”
তন্ময় মাথা চাঁপড়াই। এই ছেলেটা এত বাজে বকে। যার জন্যই ঝাড় খায় বেশি। নাওয়াসকে ওরাও ভয় পায়। তবে মিন্টু একটু বেশিই পায়। আর ভয়ে উলটো পালটা বেশি বলে। নাওয়াসের রাগ বাড়ে। মিন্টু কে এক রাম ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দেয়। নাওয়াসের ধমকে মিন্টুর হাত থেকে চায়ের কাপ ছুটে যায়। কাঁচের গ্লাস নিচে পড়ে ঝনঝনিয়ে ভেঙে যায়। নাওয়াস ওর দিকে এগোতে গেলেই পিয়াশ আসে।
“মেয়েটার খবর নিয়ে এসেছি।”
পিয়াশের নিঃসৃত বাক্যে নাওয়াস থেমে যায়। নাওয়াস থেমে যাওয়া মিন্টু গাল ভরে শ্বাস টানে। একপলক মিন্টুকে দেখে নিয়ে, ক্ষীণ কণ্ঠে বলে,
“বল!”
“মেয়েটার নাম প্রত্যাশা ইমাম। পূর্ব ইমামের মেয়ে।”
নাওয়াস পিয়াশকে হাতের ইশারায় থামিয়ে দিলো। নিরেট কণ্ঠে বলল,
“ওষুধ ব্যবসায়ী পূর্ব ইমাম?”
“হুম!”
নাওয়াস তন্ময়ের দিকে কঠিন দৃষ্টি নিক্ষেপ করতে তন্ময় ভরকে যায়। নাওয়াস দাঁতে দাঁত পিষে বলে,
“তুই জানিস আমি মিথ্যে পছন্দ করি না। তারপরও কেন বলেছিলি মেয়েটা কে খুঁজে পাসনি। পূর্ব ইমামের মেয়ে ছোটো?”
“ভভাই বিশ্বাস করেন আমি মিথ্যে বলিনি। আমি সত্যিই জানি না রাতা-রাতি কীভাবে, পূর্ব ইমামের এত বড়ো মেয়ে হয়ে গেলো। আআমি তো শুধু পপিউ কে চিনি। আপনার ভাইয়ের সাথেই পড়ে।”
“ও সত্যি বলছে। প্রত্যাশা ইমাম বিদেশে ছিলো বিগত পাঁচ বছর ধরে। প্রত্যাশা বিদেশে যাওয়ার পর, পূর্ব ইমাম ওই পাড়ায় আসেন। উনি কখনও নিজের বড়ো মেয়ের কথা কাউকে বলেননি। বিধায় অনেকই জানেনা যে ওনার আরও একটা মেয়ে আছে।”
পিয়াশের ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর নাওয়াস থেমে যায়। চা-য়ের কাপ রেখে বাইকে উঠে বসে। হেলমেট পরে বাইক স্টার্ট করবে। সেই সময় চা-ওয়ালা কাপ নিতে আসে। চা-ওয়ালা নিঃসৃত বাক্যে নাওয়াস থেমে যায়। ভ্রু কুঁচকে চায়।
“হায় হায়! তোমরা আবার আমার চায়ের কাপ ভাঙচ্ছো? একেই চা খাইয়া ট্যাহা দেওনা। তার ওপার দুদিন পরপর চা-য়ের কাপ ভাঙাই ফেলাও। আল্লাহ তোমার যত অবিচার গরীবের ওপারেই করান লাগে?”
লোকটা আহাজারি করতে থাকে। নাওয়াসকে থেমে যেতে দেখে ওরা তিন জন ঢোক গিলে একে অন্যের দিকে তাকায়। ইশায়ার চা-ওয়ালাকে সরিয়ে নিয়ে যেতে বলে। পিয়াশই বলে,
“আরে চাচা থামেন। একটা কাপের জন্য কেউ এমন করে। আমি আপনাকে নতুন কাপ কিনে দেবো। চলেন চলেন।”
“তোমাগো আমি বিশ্বাস করি না। তোমরা হইলা মিথুক। প্রতিদিন বিনা পয়সায় চা খাও। আর কও আজ দিমু কাল দিমু। এমনে কইরা আমার মতো গরীবের হোক মা’রো। আল্লাহ তোমাগো কোনো দিন ভালা করবো না। গরীবের চোখের পানি বৃথা যায় না।”
নাওয়াস হেলমেট খুলে বাইক থেকে নেমে বয়সষ্ক লোকটার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। জিজ্ঞেস করে,
“ওরা আপনাকে চা-য়ের দাম দেয়না?”
“নাটক করো? তুমিই তো ওদের মাথা। তোমার পথেই তো ওরা চলে। তোমার লিগাই তো ওদের এত সাহস। তোমার লোক কইয়া আমাগো মতো কত গরীবের থেকে বিনে পয়সায় জিনিস লইয়া যায়।”
নাওয়াস তপ্ত শ্বাস ছাড়ে। ওদের দিকে একবার তাকিয়ে বলল,
“আপনি আমাকে বলুন আপনার কত টাকা হয়েছে। আমি সব পরিশোধ করে দিবো।”
লোকটা একবার নাওয়াস কে দেখে এক বছরের হিসেব করে বলল। নাওয়াস লোকটার পাওনার থেকে বেশি টাকা দিলো। তারপর বাইকে উঠে ওদের উদ্দেশ্যে গমগমে স্বরে বলল,
“আজকের মধ্যেই সবার টাকা পরিশোধ হয়ে যাওয়া চাই।”
ওরা ঝটপট মাথা নাড়িয়ে সম্মতি দিলো। নাওয়াস বাইক নিয়ে চলে গেল। ওরা এতক্ষণে আটকে রাখা দম ছাড়ল।
__________
আশেপাশে থেকে মাগরিবের আজান ভেসে আসছে। পিউ স্কুল ছুটির পর কোচিং করে। সামনে বোর্ড পরীক্ষা তাই রোজ কোচিং করাই। শীতের আমেজ চলে আসায়, বেলা আগের তুলনায় ছোটো হয়ে গেছে। মাগরিবের আযান এখন ছয়টার আগেই দেয়। পিউয়ের স্কুল ছুটি হতে হতে বিকেল হয়ে যায়। তারপর সেখান থেকে কোচিং এ যায়। সন্ধ্যে হয়ে আসায় প্রত্যাশা পিউকে নেওয়ার জন্য এসেছে। মোটা-মুটি অনেকেই চলে গেছে। পিউ আর নিহান ছাড়া সবাই চলে গেছে। পিউকে পূর্ব ইমামের নিতে আসার কথা থাকলেও উনি আসেননি। প্রায় অনেকক্ষণ অপেক্ষা করছে পিউ। সন্ধ্যে নেমে আসায় একা দাঁড়াতেও ভয় পাচ্ছে। নিহান কে নেওয়ার জন্য আজকে নাওয়াস এসছে। নাওয়াস নিহানকে বাইকে উঠতে বলে। নিহান বাইকে উঠতে নিয়ে পিউ কে দেখে শুধায়,
“তুই বাড়ি যাবি না?”
অকস্মাৎ কণ্ঠ স্বরে পিউ চমকে ওঠে। নিহান কে দেখে বুকে ফু দিলো। ছোট্ট করে বলল,
“বাবা এখনও নিতে আসেনি।”
নাওয়াস ভ্রু কুঁচকে নিহান কে দেখে। গম্ভীর কণ্ঠে বলে,
“নিহান তুমি কী আসবে?”
নিহান তুরন্ত নাওয়াসের কাছে গিয়ে বলল,
“ভাইয়া ওকে এখনও কেউ নিতে আসেনি।”
নাওয়াস ভ্রু কুঁচকে বলে,
“তো?”
“ও একা একা থাকবে? দেখো না আশেপাশে কোনো লোকজন নেই। সন্ধ্যেও হয়ে গেছে যদি কোনো বিপদে পড়ে?”
নাওয়াস একপলক পিউয়ের দিকে চাইল। মেয়েটা বারবার সতর্ক দৃষ্টিতে আশেপাশে দেখছে। ব্যাগটাও বুকের সাথে শক্ত করে ধরে আছে। নাওয়াস বাইক স্ট্যান্ড করল। নিজেও নেমে দাঁড়ালো। পিউ আড়চোখে একবার ওদের দেখল। পরপর সাইডে আরও একটু সরে দাঁড়ালো। নাওয়াসের সম্পর্কে এলাকার সকলেই অবগত। পিউও জানে। নিহান নাওয়াসের ভাই হওয়াই, নিহানকেও কম বেশি সবাই চেনে। নিহান পিউয়ের ক্লাসমেট। পূর্ব ইমাম পিউ কে কড়া কণ্ঠে বারণ করেছে, নিহানের সাথে মিশতে। মনে মনে ভাবে,
“এরা এখানে দাঁড়িয়ে কেন আছে?”
পিউ দোয়া দরুদ পড়তে শুরু করে। পিউয়ের দোয়া দরুদ পড়ার মধ্যে প্রত্যাশা এক প্রকাশ ছুটে আসে।
“স্যরি স্যরি। আমার আসতে লেট হয়ে গেছে। তুই ঠিক আছিস তো? মা হঠাৎ করে বলল বাড়ি ফেরার সময় তোকে সাথে করে নিয়ে আসার জন্য। আমি তো দূরে ছিলাম। তাই আসতে লেট হয়ে গেছে।”
প্রত্যাশা সাফায় দিতে কথা গুলো বলে দম নিলো। প্রত্যাশাকে দেখে পিউয়ের জানে পানি আসে। প্রত্যাশা কে জড়িয়ে ধরে বলে,
“আমি খুব ভয় পেয়ে গেছিলাম।”
প্রত্যাশা হালকা হেসে বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে বলে,
“ধুর বোকা মেয়ে। ভয়ের কী আছে? শোন তুই যত ভয় পাবি লোকে ততো তোর ভয়ের সুযোগ নেবে। তাই কখনও ভয় পাবি না। বরং শক্ত হবি। কেউ তোকে একটা আঘাত করতে চাইলে, তুই তাকে পাল্টা দুটো আঘাত করবি। বুঝেছিস?”
পিউ হ্যাঁ সূচক ঘাড় নাড়ায়। নাওয়াস কপাল ভাঁজ করে এতক্ষণ প্রত্যাশার কথা শুনচ্ছিল। প্রত্যাশার মনে হয় কেউ ওর দিকে তাকিয়ে আছে। প্রত্যাশা সামনে তাকাতেই নাওয়াসকে দেখতে পায়। নাওয়াসকে দেখা মাত্রই প্রত্যাশার চোখ মুখ শক্ত হয়ে যায়।
“পিউ চল।”
প্রত্যাশা পিউকে নিয়ে চলে যেতে নিবে নিহান এগিয়ে এসে বলে,
“আপনি পিউয়ের আপু?”
নিহানের প্রশ্নে প্রত্যাশা একটু অপ্রস্তুত হয়। হাসার চেষ্টা করে বলে,
“হুম!”
“আমি নিহান পিউয়ের সাথেই পড়ি। এরপর থেকে পিউকে একটু তাড়াতাড়ি নিতে আসবেন। জায়গাটা বিশেষ ভালো না।”
নিহানের বিজ্ঞদের মতো কথা বলায় প্রত্যাশা শুধায়,
“তুমি কী আমার বোনকে প্রহরা দিচ্ছিলে?”
“নাহ্ মানে ওই আরকি! একা দাঁড়াবে যদি বিপদ হয়। তাই আমি আর ভাইয়া দাঁড়িয়ে ছিলাম।”
প্রত্যাশা স্মিত হেসে নিহানের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
“থ্যাঙ্ক ইয়্যু! তুমি অনেক দায়িত্ববান ছেলে। এরকমই থেকেও। কারো মতো বখে যেও না।”
শেষোক্ত কথাটা যে নাওয়াসের উদ্দেশ্যে ছিলো সেটা নাওয়াসের বুঝতে বেগ পেতে হয়। নিহান নিজেও বোঝে। সাফায় দিতে বলতে চাই,
“আমার ভাইয়া অনেক ভা…”
“নিহান চলে আসো! দেরী হচ্ছে।”
নিহানের বাক্য সম্পূর্ণ হওয়ার আগেই নাওয়াস গম্ভীর স্বরে ডাকে। নিহান দেখে নাওয়াস বাইকে উঠে গেছে। কথা না বাড়িয়ে, নিহান বিদায় নিয়ে চলে যায়। পিউ বলে,
“আপু তুমি ওদের সাথে কথা কেন বললে?”
প্রত্যাশা ভ্রু কুঁচকে বলে,
“কেন?”
“বাবা মানা করেছে ওর সাথে মিশতে।”
“কেন মানা করেছে?”
“ওর ভাইয়া তো বখাটে। সেই জন্য।”
“শোন পিউ কারো ভাই বখাটে মানে, যে সেও খারাপ এমনটা নাও হতে পারে। আর তাছাড়া একজনের দোষে অন্যদের শাস্তি দিতে নেই। খারাপ ব্যবহার করতে নেই। নিহান।কিন্তু আজ তোর সাহায্য করেছে। এমন নির্জন জায়গায় তোর সঙ্গ দিয়েছে। তোর উচিত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা।
কারো ভাই বা পরিবারের কেউ খারাপ বলে তুই তাকেও খারাপ বলবে,এড়িয়ে যাবে। এটা মোটেও ভালো বিষয়টা। এতে অপর মানুষটা কষ্ট পাবে। এমনটা আর করবি না ওকে?”
“আচ্ছা!”
“এখন বাসায় চল। মা চিন্তা করবে।”
চলবে…
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন।)