এক ঝড়ো হাওয়ায় পর্ব-০২

0
6

এক_ঝড়ো_হাওয়ায়
#লেখনীতে-ইনসিয়া_আফরিন_ইমারা
#পর্বঃ০২

নীল সাদা অম্বরে সফেদ কাদম্বিনী সূর্যের হলদে-কমলা রশ্মি মেখে ভেসে বেড়াচ্ছে সুবিশাল অম্বর জুড়ে। মেঘ-সূর্যরশ্মির রঙ খেলায় নীলাম্বর হয়ে উঠেছে অত্যাধিক আকর্ষনীয়। সেই সৌন্দর্য বসুন্ধরার প্রাণী জৎগতকে করেছে বিমোহিত,মুগ্ধ। তবে এই মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দুজন মানব-মানবীর মনে দাগ কাটতে ব্যর্থ হয়। প্রত্যাশা ভ্রু সংকুচিত করে নাওয়াস কে দেখচ্ছে। দুজনের কারো মুখেই রা নেই। ফের বাতাসে মিশে পুরুষালী নিরেট স্বর।

“তুমিই সকালে আমার বন্ধুকে মে’রে ছিলে?”

প্রত্যাশার সংকুতিচ ভ্রুদ্বয় আরেকটু প্রগাঢ় হয়। পরপর মানসপটে ভাসে সকালের ঘটনা। সাথে সাথেই নাওয়াসের সাথে থাকা বাকিদের দিকে দৃষ্টিপাত করে। ওই তো ব্লু গেঞ্জি পরিহত এক ছেলের পিছে, সকালের সেই ছেলেটা মুখ লুকিয়ে আছে। প্রত্যাশা ক্যাট কণ্ঠে বলে,

“অ্যাই ছেলে এদিকে আসো।”

প্রত্যাশার বাক্যে মিন্টু হকচকায়। সে মোটেও মেয়েটার সামনে যেতে চাই না। গেলে যদি আবার থা’প্প’ড় লাগায় তখন? না না সে যাবে না। মেয়ে তো কী হয়েছে। গায়ে মেলা জোর আছে। সকালের দুটো থা’প্প’ড়ে গাল ব্যাথায় টনটন করছিলো।

“কী হলো শুনতে পাওনি? নিজের সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে আমায় শায়েস্তা করতে এসে, এখন লুকিয়ে কেন আছো?”

তন্ময় বলল,

“কী রে যা!”

“না না যাবো না। গেলে যদি আবার মা’রে। মেয়েটার হাতে মেলা জোর। আমি আর ওই হাতের থা’প্প’ড় খেতে চাই না।”

মিন্টুর বাক্য পিয়াশ ‘চ’ সূচক শব্দ করে বলল,

“একটা মেয়ের থা’প্প’ড় খেয়ে এমন লুকিয়ে আচ্ছি? সামনে না গেলে যখন নাওয়াস থা’প্প’ড় দেবে। তখন কী করবি?”

পিয়াশের কথায় মিন্টু ঢোক গেলে। তৎক্ষণাৎ কর্ণকুহের প্রবেশ করে নাওয়াসের গম্ভীর স্বরে করা আদেশ।

“মিন্টু এদিকে আয়।”

মিন্টু সুর সুর করে এগিয়ে আসে। ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে নাওয়াসের পাশে দাঁড়ায়। নাওয়াস প্রত্যাশা কে দেখিয়ে বলে,

“এই মেয়েটায় কী তোকে মে’রে ছিলো?”

মিন্টু একবার প্রত্যাশার দিকে চায়। শুকনো ঢোক গিলে কিছু বলতে নিবে তার আগে প্রত্যাশা বলে,

“হ্যাঁ আমিই মে’রে ছিলাম। তা তে কী হয়েছে?”

প্রত্যাশা বুকে হাত গুজে উক্ত বাক্যটি ব্যয় করে। নাওয়াস এবার পুর্ণদৃষ্টিতে প্রত্যাশার পানে চায়। ছিমছাম গড়নের একটি মেয়ে। কাঁধ সমান গ্লোডেন ব্রাউন স্ট্রে চুল। ডাগর ডাগর চোখ। ফোলা ফোলা গাল। খুব একটা লম্বা না। পাঁচ ফিট এক বা দুই হবে। পরনে জিন্স আর হাঁটু সমান রাউন্ড জামা। গলায় ওড়না জড়ানো। পায়ে আবার জুতো আছে। মেয়েটার মুখের বদল বাঙালি বাঙালি হলে। চেহারায় বিদেশী একটা ভাব আছে। হয়তো দীর্ঘদিন বিদেশে ছিল। নাওয়াসকে এমন করে স্ক্যান করতে দেখে প্রত্যাশা ঈষৎ বিবর্তবোধ করে। তবে তেঁজ কমায় না। বরং বাড়ায়।

“এমন অসভ্যের মতো তাকিয়ে আছেন কেন?”

প্রত্যাশার নিঃসৃত বাক্যে নাওয়াসের ধ্যান ভাঙে। প্রসঙ্গ পাল্টে বলল,

“তুমি কোন সাহসে ওর গায়ে হাত তুলেছো?”

“এবার তো শুধু থা’প্প’ড় দিয়েছি। ফারদার আমার সামনে কাউকে টিজ করলে মে’রে হাত পা ভেঙে দেবো।”

নাওয়াসের বন্ধুরা বিস্ময়ে হাঁ হয়ে যায়। এই মেয়ের সাহস কত? নাওয়াসের মুখে মুখে তর্ক করছে। নাওয়াসের চোখ মুখ শক্ত হয়ে আসে। নিরেট কণ্ঠে বলল,

“তুমি জানো আমি কে? আমার ত্রাসে পুরো শহর তটস্থ থাকে।”

“তো?”

প্রত্যাশার ভাবলেশহীন উত্তর। নাওয়াস নিজেও থতমত খায়। কিন্তু বাহিরে তা প্রকাশ করে না। পিয়াশ বলে,

“তুমি মনে হয় এই এলাকায় নতুন! তাই ওকে চেনো না।”

“আপনাদের মতো লোকদের আমার নতুন করে চেনা লাগবে না। আপনারা হলেন বড়ো লোক বাপের বিগড়ে যাওয়া ছেলে।”

“তুমি কিন্তু নিজের সীমা অতিক্রম করছো। নাওয়াস আফফান মোটেও ভালো ছেলে না। এলাকায় আমার বদনাম আছে। আমাকে রাগিও না। তোমার জন্য ভালো হবে না।”

নাওয়াসের কণ্ঠে ক্রোধ। নাওয়াসের থেকেও দ্বিগুন ক্রোধ নিয়ে প্রত্যাশা বলল,

“কী করবেন? গায়ে হাত তুলবেন? থা’প্প’ড় মা’রবেন?”

“আমি মেয়েদের গায়ে হাত তুলি না।”

“ওহ্ আচ্ছা আপনি তো সাধু পুরুষ। মেয়েদের গায়ে হাত তোলেন না। কিন্তু বন্ধু কে ঠিকই মেয়েদের টিজ করতে লেলিয়ে দেন?”

প্রত্যাশার তাচ্ছিল্য পূর্ণ কণ্ঠ স্বর।

“মুখ সামলে কথা বলো। মেয়ে বলে পার পাবে না।”

প্রত্যাশা রাগে রিতমত কাঁপছে। মেয়ে বলে তাকে হেলা করছে? তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করছে?

“আমাকে অন্যদের মতো দূর্বল মেয়ে ভাবেন না। আমি মা’রামা’রিতে রীতিমত ট্রেনড্।”

নাওয়াস তাচ্ছিল্য হাসে। বিদ্রুপের সহিত বলল,

“এখুনি আমার বন্ধুর কাছে ক্ষমা চাও।”

“চায়বো না!”

“তুমি কিন্তু ভুল করছো। ভুল লোকের সাথে লাগতে আসছো। এখনও সময় আছে। সময় থাকে নিজের ভুল শুধরে নেও।”

প্রত্যাশার মুখের আদল পরিবর্তন হয়। রহস্যময়ী হাসি ফোটে ওষ্ঠধারে। তেমন ভাবেই বলল,

“আপনি ঠিক বলেছেন। আমি ভুল করেছি।”

প্রত্যাশার হার মেনে নেওয়াই নাওয়াস বাঁকা হাসে। ওর বন্ধুরা এতক্ষণ বিস্মিত লোচনে প্রত্যাশা কে দেখছিল। এত সহজে হার মেনে নেওয়াই সেই বিস্ময়ভাব বৃদ্ধি পায়। ওরা তো ভেবে ছিলো এই মেয়ে জীবনেও ক্ষমা চাইবে। কিন্তু এত সহজে মেনে যাওয়াই ওরা অবাক হয় পরপর হেসে তন্ময় বলল,

“দেখেচ্ছিস সব চোটপাট শেষ। আমাদের ভাই হচ্ছে সিংহ। সিংহের সামনে বিড়াল যতই মিও মিও করুক। সিংহের এক গর্জনে সব ফুসকি বো’ম হয়ে যাবে।”

“তবে যাই বল ভাই মেয়ের কিন্তু সাহস আছে।”-বলল পিয়াশ।

“সাথে গায়ে জোরও আছে।”

মিন্টুর কথায় ওরা মুখ চেপে হাসে। কিন্তু সেই হাসি বেশিক্ষণ টেকে না।

“ওকে থা’প্প’ড় মে’রে আমি সত্যিই মস্ত বড়ো ভুল করেছি। কিন্তু এখন আমি আমার সেই ভুল শুধরে নেবো।”

নাওয়াস ভ্রু কুঁচকে প্রত্যাশার দিকে তাকাল তৎক্ষণাৎ বিকট শব্দে নাওয়াসে গালে প্রত্যাশা থা’প্প’ড় মে’রে দিলো। পিয়াশ,তন্ময় হতবিহ্বল, হতচকিত, বিমূঢ় বনে গেল। অক্ষিযুগল ফাঁটা ফাঁটা হয়ে আসে। এই বুঝি কোটর থেকে বেরিয়ে পড়বে। মিন্টু ভয়ে কয়েক ধাপ পিছিয়ে পিয়াশ আর তন্ময়ের পিছে লোকালো।

“আমার উচিত ছিলো ওকে না মে’রে ওর বাপ কে মা’রা। যার সঙ্গ দোষে এমন বখেছে। লজ্জা করে না? একটা মেয়ে কে টিজ করতে? আবার সেই যখন নিজের জন্য স্ট্যান্ড নিয়েছে। তখন তাকে দিয়ে ক্ষমা চাওয়াতে তৎপর হয়ে, মাঝ রাস্তায় রিঁকশা থামাতে?
তোমাদের মতো ছেলেদের জন্যই না আজ সমাজে নারীরা অনিরাপদ। তাদের পরিবার তাদের একা ছাড়তে ভয় পায়। নিজেকে ত্রাস বলো না এই শহরের? আসলে তোমরা সমাজের ঘৃণীত প্রাণী। নূন্যতম সন্মানও তোমাদের প্রাপ্য না। নেহাত আমার মুখের ওপর সংযত আছে। নয়তো তুমিও বলতাম না।মেরুদণ্ডহীন কাপুরুষ।”

নাওয়াস ক্রোধে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে নিলো। প্রত্যাশা এক মুহূর্তও দাঁড়ায় না। ত্রস্ত পায়ে প্রন্থান করে। নাওয়াস চোখ বন্ধ করে নিজেকে শান্ত করে। পিয়াশা,তন্ময়, মিন্টু নাওয়াসের মুখের দিকে চাইল। নাওয়াসের শরীর কাঁপছে। শক্ত করে মুঠো বেধে আছে। নিজের খসখসে হাতের তালুতে নখ বিধিয়ে দিচ্ছে। ওদের জন্য একটু আগের দৃশ্যটা আশ্চর্যান্বিতর থেকেও কয়েক ধাপ বেশি। এই দৃশ্য যে এক্কে বারে অসম্ভবপ্রায়। আজ অব্দি স্বপ্নে এমন দৃশ্যের সাথে ওদের কারো সাক্ষাৎ হয়নি। মিন্টু ভীতগ্রস্ত হয়ে নাওয়াসের দিকে তাকায়। সেই মুহূর্তে নাওয়ার নিজের চোখ খুলে ওর দিকেই জ্বলন্ত দৃষ্টিতে চায়। নাওয়াসের রক্তিম দৃষ্টিতে মিন্টুর আত্মা উঁড়ে যাওয়া উপক্রম হয়। কাঁপা কণ্ঠে বলে,

“আমাকে ওভাবে কেন দেখেছে ভাই?”

তন্ময় কিছু বলার জন্য হাঁ করবে তার আগেই নাওয়াস মিন্টুর কলার টেনে সামনে এনে সপাটে থা’প্প’ড় বসিয়ে দেয়। শক্ত হাতের থা’প্প’ড়ে মিন্টুর মাথা ভোঁ ভোঁ করে ওঠে। তন্ময় পিয়াশ দু কদম পিছিয়ে বলল,

“ও-ওই মেয়ের রাগ আমাদের কেন দেখাচ্ছিস?”

“তোদের বারণ করেছি না? মেয়েদের টিজ করবি না? অসন্মান করবি না? তারপরও কেন করেছিস?”

মিন্টু কাঁদো কাঁদো সুরে বলল,

“আমি তো একটু মজা করছিলাম। আমি কী জানতাম, এই মেয়ে এমন ভয়ংকর। জানলে ওকে টিজ করতাম না।”

নাওয়াস কটমট লোচনে তাকাতে মিন্টু মিইয়ে গেল। পারলে মাটিতে মিশে যাবে।

“ফারদার যদি আর কাউকে টিজ করিস, ওই মেয়ে তোর কী করবে আমি জানি না। কিন্তু আমি তোকে দুনিয়াতেই জা’হা’ন্না’ম দেখিয়ে দেবো।”

নাওয়াস বাইকে চরে বসে। হেলমেট পরতে পরতে কাঠ কণ্ঠে বলে,

“খোঁজনে মেয়েটা কে। ওর সব ডিটেলস আমার চাই। নাওয়াস আফফানকে থা’প্প’ড় মা’রার মাশুল ওকে গুনতেই হবে।”

নাওয়াস বাইকে স্টার্ট করে চলে যায়। নাওয়াস যেতেই ওরা তিনজন আটকে রাখা শ্বাস ছাড়ে।
__________

“তুমি না-কি আজকে খোলা ময়দানে এলাকার মেয়েদের জমায়েত করে,হেনস্তা করেছো?”

নাওয়াস কেবল মাত্র সিঁড়িতে এক পা দিয়েছে। সেই সময় অকস্মাৎ গম্ভীর কণ্ঠে নাওয়াসের পদযুগল থেমে যায়। ঘাড় ঘুরিয়ে সোফায় গম্ভীর মুখে বসে থাকা নিজের বাবার দিকে চায়। কামাল মাহমুদ সোফা থেকে উঠে ছেলের নিকটে আসেন। নাওয়াস চোখ মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে থাকে।

“কী হলো চুপ করে আছো কেন?”

রিনা বেগম দ্রুত পায়ে রান্নাঘর থেকে ছুটে আসেন। কামাল সাহেবের উদ্দেশ্যে বলেন,

“ছেলেটা বাইরে থেকে সবে ফিরল। দয়া করে এখন এই সব কথা বলবেন না।”

“এসেছে তো আড্ডা বাজি, বখাটেপনা করে। দিন দিন উচ্ছন্নে যাচ্ছে। এই সোসাইটিতে আমার যে একটা মান-সম্মান আছে। সেটা তুমি ভুলে গেছো। তোমার জন্য আমি রাস্তাই বের হতে পারি না।
তোমায় আমার ছেলে হিসেবে পরিচয় দিতে লজ্জা লাগে।”

“আপনাকে তো কেউ জোর করেনি আমায় ছেলে বলে পরিচয় দেওয়া জন্য। আপনার যখন এতই মানে লাগে
তখন আমাকে নিজের ছেলে হিসেবে পরিচয় দেবেন না।”

কামাল মাহমুদ হতভম্ব হয়ে যান নাওয়াসের বাক্যে। হতভম্ব কণ্ঠে বললেন,

“তবুও তুমি নিজের উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপন ত্যাগ করবে না?”

“নাহ্!”

নাওয়াসের সোজাসাপ্টা উত্তর। এপার্যায়ে কামাল মাহমুদ নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে পড়েন। রাগান্বিত কণ্ঠে বললেন,

“কেন পারবে না? কী সমস্যা তোমার? তোমার বাবার এত বড়ো একটা ব্যবসা আছে। তোমার ব্রাইট ফিউচার। নিজের হাতে কেন তুমি সেই সব নষ্ট করছো? আমি তো কখনো তোমায় কোনো অভাব বুঝতে দিইনি। তারপরেও কী কারণে তুমি বিপথে চলে গেলে?”

নাওয়াস তাচ্ছিল্য হাসে। সেভাবেই বলে,

“আপনি যদি সেটা বুঝতেন। তাহলে না আমি একজন বখাটে হিসেবে পরিচিত হতাম। আর না আমার মা আমার থেকে দূরে যেত।”

কামাল মাহমুদ চমকে ওঠেন।

“তুমি আমার কারণে বখাটে হয়েছো?”

“নিজেই উত্তর খুঁজেনিন।”

নাওয়াস প্রন্থান করে। সত্যিই কী নাওয়াসের বিপথে যাওয়া জন্য উনি দায়ি? উনি কী বাবা হিসেবে ব্যর্থ?

চলবে…

(ভুল-ত্রুটি ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিতে দেখবেন।)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে