#এক_ঝড়ো_হাওয়ায়
#লেখনীতে-ইনসিয়া_আফরিন_ইমারা
#সূচনা_পর্ব
#জনরা_রোমান্টিক_সামাজিক
বখাটে নাওয়াস আফফানের সাঙ্গপাঙ্গদের নাকি একটা মেয়ে পি’টিয়েছে। মুহূর্তেই সেকথা এলাকায় ছড়িয়ে গেলো। কিয়ৎক্ষণ পূর্বে এই খবর নাওয়াস আফফানের কানে এসে পৌঁছেছে। নাওয়াস আফফান দেশের নামকরা নিউজ পত্রিকার মালিকের একমাত্র ছেলে। লোকে বলে বড়ো লোক বাপের বিগড়ে যাওয়া ছেলে। রাগ যেনও তার নাকের ডগায় থাকে। শহরের কারো সাহস নেই তার সামনে রা করার। সাহস হবেই বা কী ভাবে। বাপের হাত যে অনেক লম্বা। দেশের বড়ো বড়ো সব রাঘব বোয়ালদের সাথে ওঠা বসা। বাপের আদরের দুলাল। অতি আদরে বাঁদর হওয়ার বদলে বখাটে হয়ে গেছে। যে নাওয়াস আফফানের ত্রাসে পুরো শহর তটস্থ থাকে। সেই নাওয়াস আফফানের সাঙ্গপাঙ্গদেরকে-ই নাকি কেউ পাব্লিক প্লেসে পি’টিয়েছে। তাও আবার একটা মেয়ে। এই খবরটা যেন আলোর বেগে ছড়াছে। অনেকে সেই মেয়ের সাহসের বাহ্বা দিচ্ছে। খবরটা পাওয়ার পর থেকেই নাওয়াসের মেজাজ তুঙ্গে উঠে গেছে। নাওয়াস মেয়েদের থেকে যোজন যোজন দ্রুত বজায় রাখে। তবে এইবার সেটা পারছে না। তার বন্ধুদের গায়ে আঘাত করার স্পর্ধা করেছে। সেই হাত নাওয়াস ভে’ঙ্গে গুড়িয়ে দিবে। হোক সেটা কোনো মেয়ে।
“মেয়েটা কে চিনিস?”
“নাহ্! এর আগে কখনও এই এলাকায় দেখিনি।”
“দেখলে চিন্তে পারবি?”
“হ্যাঁ পারবো।”
“তন্ময়!”
নাওয়াসের ডাকে তন্ময় এগিয়ে আসে। তন্ময় এগিয়ে আসতে নাওয়াস বলে,
“ওই এলাকার যত মেয়ে আছে। তাদের সবাই কে বিকেলে, খোলা খেলার মাঠে জমায়েত করবি। একটা মেয়েও যেন বাদ না পরে।”
“আচ্ছা!”
.
.
.
“তুমি নাকি আজ রাস্তায় মা’রা মারি করেছো?”
বুটিক থেকে সবেই বাড়ি ফিরেছে প্রত্যাশা। বাড়ির মেইন ফটক পার না হতেই, বাবার গুরুগম্ভীর স্বরে করা প্রশ্নে থেমে যায়।
“তোমাকে কিছু জিঙ্গেস করেছি।”
“তোমার লোকেরা অলরেডি তোমাকে খবরটা জানিয়েই দিয়েছে। শুধু শুধু আমায় কেন জিঙ্গেস করছো?”
“এটা আমেরিকা না। এখানে আমার একটা মান-সন্মান আছে। লোকে যদি জানে তুমি রাস্তার বখাটেদের সাথে মা’রামা’রি করেছো। তাহলে সবাই ছিঃ ছিঃ করবে।”
প্রত্যাশা এবার নিজের বাবার দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায়। শান্ত কণ্ঠে বলল,
“ওই বখাটে গুলো তোমার মেয়েকে টিজ করেছিলো।”
“এড়িয়ে গেলেই পারতে। মা’রপিট করার তো কোনো প্রয়োজন দেখচ্ছি না?”
“ওরা আমাকে টিজ করেছিলো। আর তুমি সেটা এড়িয়ে যেতে বলছো?”
“হ্যাঁ যাবে। ভুলে যেওনা তুমি একটা মেয়ে। সমাজে চলতে হলে, মেয়েদের সব সময় চুপ থাকতে হয়। মেনে নিতে হয়।”
প্রত্যাশা কিংকর্তব্যবিমূঢ় বনে যায়। বিস্মিত স্বরে বলে,
“কেউ আমায় বুলিং করবে? অপমান করবে। আর আমি সেই সব কিছু চুপচাপ হজম করবো?”
“হ্যাঁ করবে! তোমার ভালোর জন্যই বলছি। এরপর থেকে তুমি একা বাইরে যাবে না। গার্ড থাকবে তোমার সাথে।”
“আই অ্যাম স্যরি। তোমার কথা আমার পক্ষে মানা সম্ভব না।”
পূর্ব ইমাম এবার রেগে যান। গলার স্বর চওড়া করে বলেন,
“তুমি যে ওদের গায়ে হাত দিয়েছো। ওরা যদি এখন প্রতিশোধ নিতে চাই? তোমার সাথে কিছু করে দিলে? তখন কী হবে? পারবে এই সমাজে মুখ দেখাতে?”
বাবার এহেন কথায় প্রত্যাশা বাক্য রুদ্ধ হয়ে যায়। পরপর নিজের স্বর উচিয়ে বলে,
“নিজেকে প্রটেক্ট করতে জানি আমি। আর রইলো তোমার সমাজ। আমি তাদের মন জুগিয়ে চলতে বাধ্য নয়। আমার সাথে কেউ অন্যায় করলে, সেই অন্যায়ের যোগ্য জব্বাব আমি দেবো।”
” প্রত্যাশা!”
পূর্ব ইমাম হুংকার ছুড়লেন। সেই হুংকারে ড্রয়িং রুমে উপস্থিত মিনা এবং পিউ কেঁপে উঠে। বাপ-মেয়ের ঝগড়া এতক্ষণ যাবত্র নীরব দর্শকের মতো দেখচ্ছিলেন মিনা। ব্যাপারটা বেশি হয়ে যাচ্ছে দেখে তিনি বললেন,
“আপনি শান্ত হোন। এত উত্তেজিত হবে না। আমি ওকে বোঝাচ্ছি।”
“নিজের মেয়েকে ভালো করে বুঝিয়ে দিও,এটা ওর বিদেশ না। সব কিছু ওর মর্জি মতো হবে না। এই সমাজে থাকতে হলে চোখ মুখ বন্ধ করে থাকতে হবে।”
নিজ বাক্য শেষ করে পূর্ব ইমাম প্রন্থান করেন। প্রত্যাশা চোখ মুখ লাল হয়ে গেছে রাগে। প্রত্যাশা বাবার মেয়েদের নিয়ে এমন নিম্ন মানুসিকতা কিছুতেই মানতে পারছে না। মিনা মেয়ের কাছে এগিয়ে আসে। কিছু বলার জন্য হাঁ করতে নিবেন। তৎক্ষণাৎ নিরেট কণ্ঠে প্রত্যাশ বলল,
“আমাকে এই নিয়ে কিছু বলতে আসবে না।”
প্রত্যাশ হনহন করে নিজের ঘরের দিকে চলে গেলো। মিনা অসহায় ভাবে সেই দিকে তাকিয়ে রইলেন। বাপ-মেয়ের দ্বন্দ্বে তিনি ক্লান্ত। পাঁচ বছর আগে বিদেশে যাওয়া নিয়ে, সেই যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়েছিলো। তার রেশ যেন এখনও রয়ে গেছে। মিনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ছোটো মেয়ের ভীতগ্রস্ত মুখ দেখলেন। মেয়ের ভয় কাটাতে ঘরে নিয়ে গেলেন।
প্রত্যাশা ঘরে এসে রাগে ফোঁসফোঁস করছে। একেই তখন ওই বখাটে গুলোর বাজে ব্যবহারে মেজাজ খারাপ হয়েছিলো। তার ওপর বাবার এরূপ ব্যবহার। মাস খানেক হবে প্রত্যাশা আমেরিকা থেকে ফ্যাশন ডিজাইনিং এর কোর্স কমপ্লিট করে দেশে এসেছে। ছোটো থেকেই ইচ্ছে ছিলো ডিজাইনার হওয়ার। বিদেশ থেকে কোর্স করার। কিন্তু প্রত্যাশার বাবা পূর্ব ইমামের এই দুয়েতেই ছিলো ঘোর আপত্তি। তিনি চেয়ে ছিলেন মেয়ে বিয়ে করাতে। দেশে থেকেই কোনো রকমে গ্রাজুয়েট পাশ করাতে। কিন্তু প্রত্যাশা জেদ করে বিদেশে যায়। তিনি প্রায় খরচ পাঠাতে লেট করতেন। এমন নয় যে ওনার সামর্থ্য নেই। আসলে উনি ইচ্ছাকৃত এমনটা করতেন। যাতে প্রত্যাশা কোর্স কমপ্লিট না হয়। সেই জন্যই প্রত্যাশা পার্ট টাইম জব করে। তা দিয়ে নিজের খরচ চালাতে শুরু করে। সে ব্যাপারে পূর্ব ইমাম যখন জানতে পারেন। বিষয়টা তখন ওনার মানে লাগে। মেয়ের প্রতি ওনার মনে চাপা ক্ষোভ তৈরি হয়। তারপর থেকেই এত বিবাধ। কয়েক বছর কেউ কারো সাথে কথাও বলেননি। এক বছর আগে প্রত্যাশা আমেরিকাতে নিজের বুটিক হাউজ খোলে। এখন প্রত্যাশা সেই বুটিক হাউজ বাংলাদেশে করতে চাই।কয়েক মাস জায়গায় ঠিক করাতে কেটে গেছে। আজ বুটক হাউজের ওপেনিং ছিলো। সকালে সেখানেই যাচ্ছিলো। তখন কয়েক জন বখাটে গান গেয়ে টিজ করছিলো। প্রত্যাশাও চুপ না থেকে ওদের থা’প্প’ড় দিয়েছিলো। পরপর বেশ কয়েকটা থা’প্প’ড় মে’রে খান্ত হয়েছিলো। ভবিষ্যৎ এরূপ কাজ না করার জন্য হুমকিও দিয়ে এসেছে। সেটাই কেউ রং মশলা মাখিয়ে পূর্ব ইমাম কে বলেছে প্রত্যাশা রাস্তায় মা’রপিট করেছে। যা নিয়েই একটু আগে বাবার সাথে প্রত্যাশার তর্ক হলো।
প্রত্যাশার বাবা পূর্ব ইমাম একজন ঔষধ ব্যবসায়ী। রাজধানী সহ, দেশের বিভিন্ন স্থানে ওনার ঔষধ কম্পানি আছে। প্রত্যাশারা দুই বোন। প্রত্যাশা বড়ো। এবং পিউ ছোটো। দশম শ্রেনীতে অধ্যানয়রত। মাসখানেক আগেই প্রত্যাশার পড়াশোনা শেষ হয়েছে। পূর্ব ইমাম সে-কালে ধারণা নিয়ে চলেন। ওনার কাছে মান-সন্মান, সমাজ বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এমন কি তিনি ভাবেন মেয়েদের বাইরে কাজ করার প্রয়োজন নেই। মেয়ে মানুষ বিয়ে করে সংসার করবে ব্যস। প্রত্যাশার মা মিনা অত্যন্ত শান্ত প্রকৃতির। স্বামীর মুখের ওপরে রা করেন না।
_________
গোধূলি বেলা। নীল-সাদা অম্বরে ঝাঁক বেঁধে পাখি উড়ে চলেছে। থেকে থেকে বাতাসের তালে গাছের পাতা নেঁচে উঠছে। সেই নাঁচের সাথে ভেসে যাচ্ছে শিউলি ফুলের ঘ্রাণ। মনোমুগ্ধকর বিকেল। সেই মনোমুগ্ধকর পরিবেশ কিছু মানুষের নিকট আতঙ্কে পরিনত হয়েছে। নাওয়াসের লোক এলাকার সব মেয়েদের জড়ো করেছে। সকলে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে নতমস্তকে দাঁড়িয়ে আছে। নাওয়াস নিজের বাইকে বসে সিগারেট ফুঁকছে। নিকোটিনের সাদা-কালো ধোঁয়া হাওয়াতে মিশে, বিশুদ্ধ বায়ুকে দূষিত করছে। সাথে ছড়িয়ে দিচ্ছে দমবন্ধকর বিদঘুটে গন্ধ।
“ভাই এলাকার সবাই রে নিয়ে এসছি।”
“মিন্টু!”
“জ্বি ভাই!”
“তোদের কে যে মেয়ে মে’রে ছিলো। সে এদের মধ্যে আছে কিনা দেখ?”
নাওয়াসের বাক্য শেষ হতেই মিন্টু সব মেয়েদের দেখতে থাকে।
কিন্তু এই মেয়েদের মধ্যে সেই মেয়ে কে পায় না। যে ওদের মে’রে ছিলো। উদাস হয়ে ফিরে এলো নাওয়াসের কাছে এসে বলল,
“এদের মধ্যে ওই মেয়ে নেই ভাই।”
“শিওর!”
“জ্বি ভাই!”
নাওয়াস এবার তন্মায়ের দিকে তাকালো। নাওয়াসের দৃষ্টিতে তন্ময় ভরকে গেল। থতমত গলায় বলল,
“সব মেয়ে কে এনেছি ভাই। একটা বাড়ির মেয়েও বাদ দেয়নি। শুধু পূর্ব ইমামের বাড়ি বাদ। ওনার মেয়ে তো ছোটো ক্লাস ১০ এ পড়ে।”
নাওয়াসের সুচালো দৃষ্টি তন্ময়ের রীতিমত ঘাম ছুটে যাচ্ছে। না জানি ওই মেয়ের রাগ ওর ওপরে ঝেরে দেয়। ভয়ে ভয়ে ফের বলল,
“আমার মনে হয় মেয়েটা এই এলাকার না।”
নাওয়াসের নিরেট চোয়াল দেখে তন্মায় শুকনো ঢোক গিলে। বাকিদের ইশারা করে সাফায় গায়তে। পিয়াশ বলল,
“মিন্টু তো বলেছিলো মেয়েটাকে আগে কখনও দেখেনি। সত্যিই হয়তো মেয়েটা এই এলাকার না।”
নাওয়াস গম্ভীর স্বরে বলল,
“এই এলাকায় নেই। অন্য কোনো এলাকায় তো নিশ্চয়ই আছে। আশেপাশের এলাকা ভালো করে খোঁজ। ওই মেয়েকে আমার চাই।”
নাওয়াস নিজের বাক্য সমাপ্ত করে বাইকে উঠে বসে। বাকিরাও যে যার মতো বাইকে উঠে। তন্ময় আর পিয়াশ এক বাইকে শিমুল আর মিন্টু এক বাইকে ওঠে। সকলে বাইক ঘুরিয়ে নেই। মাঠ থেকে বেরিয়ে যায়। মেয়ে গুলো এতোক্ষণ শ্বাস আটকে দাঁড়িয়ে ছিলো। ওরা যেতেই মেয়ে মুখ ভরে শ্বাস নিলো। মাঠ থেকে কিছু দূর আসতে মিন্টু চেঁচিয়ে উঠে।
“ভাই ওই তো! ওই মাইয়াডা আমারে মা’রছিলো।”
অকস্মাৎ মিন্টুর চিৎকারে সকলে বাইক থামায়। নাওয়াস ভ্রু কুঁচকে পিছনে চাইলো। নিরেট স্বরে বলল,
“কোথায়?”
“ওই যে ওই রিঁকশাটায়।”
নাওয়াস বাইক ঘুরিয়ে নিলো। বাকিরাও তাই করলো। বাইকের স্পিড বাড়িয়ে দিলো। সহসা রিঁকশা সামনে গিয়ে বাইক থামালো। হুট করে রিঁকশার সামনে বাইক থামায়। রিঁকশাওয়ালা সজরে ব্রেক করে। যার ফলে প্রত্যাশা সামনের দিকে ঝুঁকে যায়। পড়ে যেতে নিয়ে রিঁকশা ধরে নিজেকে সামলে নেয়। তবে এভাবে বাইক থামানোর জন্য প্রত্যাশার রাগ হয়।
“ওই মিয়া ওই? সমস্যা কি হ্যাঁ? রাস্তা কী কম পড়ে গেছে? না-কি রাস্তাটা আপনার পৈতৃকসম্পত্তি? যে এভাবে রাস্তার আটকেছেন! রাস্তা ছাড়ুন।”
নাওয়াস প্রত্যুত্তর করে না। কোনো উত্তর না পেয়ে প্রত্যাশা রাগ তরতর করে বেরে যায়।
“কি হলো সরুন!”
এপর্যায়ে নাওয়াস মাথা থেকে হেলমেট খুলল। দুদিকে মাথা নাড়িয়ে চুলে ব্যাকব্রাশ করে। রিঁকশায় বসা রমনীর দিকে দৃষ্টিপাত করে। প্রত্যাশা ভ্রু কুঁচকে তাকালো। নাওয়াস কে দেখে রিঁকশাওয়ালা রিঁকশা রেখে পালিয়ে গেলো। রিঁকশাওয়ালা কে পালিয়ে যেতে দেখে প্রত্যাশা অবাক হয়।
“আরে মামা দাঁড়ান! কই যান?”
রিঁকশাওয়ালা শুনলে তো। তৎক্ষণাৎ কর্ণকুহরে প্রবেশ করে মোটা পুরুষালি কণ্ঠ স্বর।
“নাওয়াস আফফান যেখানে থাকে, সেখানে ওরা দাঁড়ায় না।”
প্রত্যাশার কপালে ভাঁজ পড়ে। বাইকে বসা ছেলেটাকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে নিলো। শ্যামবর্ণ গায়ের রং। মাথা ভর্তি ঘন কালোচুল। গাল ভর্তি এলোমেলো দাঁড়ি। গলায় চেইন। হাতে ব্রেসলেট আর ঘড়ি। সাদা টি-শার্টের ওপর ব্ল্যাক শার্ট। শার্টের সব বোতাম খুলে রাখা। একপলক দেখে প্রত্যাশা বুঝে যায় এটা একটা বখাটে।
চলবে…