আমাদের থাকার ঘর ছিল একটা। মা বাবা একদিন সেই ঘরের মধ্যেই এক কোণায় ছোট্ট একটা চৌকি বসিয়ে দিলো। ঘরে একটা জামা কাপড় রাখার আলনা ছিল, সেই আলনাটা দিয়ে চৌকিটাকে আড়ালও করে দিলো।
মা’র কাছে যখন আমি জানতে চাইলাম, ‘এই চৌকি দিয়ে কী হবে মা?’ মা বলল, ‘এই চৌকিতে এখন থেকে তুমি ঘুমাবা।’
আমি বললাম, ‘কেন? ওখানে ঘুমাব কেন আমি?’ মা তখন বলল, ‘ছেলেরা বড় হয়ে গেলে তাদের আর মা বাবার সাথে ঘুমাতে হয় না। আলাদা বিছানায় ঘুমাতে হয়।’
আমি বললাম, ‘আমি কি তাহলে বড় হয়ে গেছি মা?’ মা বলল, ‘অবশ্যই তুমি বড় হয়ে গেছো। দেখি তোমার কয়টা দাঁত?’
আমি বড় হয়ে যাওয়ার খুশিতে গদগদ হয়ে গেলাম। আমার ঘুমানোর ঠিকানা হলো নতুন চৌকিতে। দাঁত সেদিন দেখাইনি মা’কে, কারণ আমার দাঁতে পোকা ছিল।
প্রায় দিনই লক্ষ্য করতাম আমার মা এবং বাবার মধ্যে এটা ওটা নিয়ে ঝগড়া হচ্ছে। কী নিয়ে ঝগড়া হচ্ছে, সেটা আমি বুঝতাম না। কারণ আমি তো তখন নতুন নতুন বড় হয়েছি। নতুন নতুন বড় হওয়ার সময় মানুষ সবকিছুই বোঝে না। তাই তারা বোঝার চেষ্টাও করে না। তবে এই নতুন বড় হওয়া ছেলেটার খারাপ লাগতো খুব। কারণ তার মায়ের মত আর কোনো মা নেই। যে মা খাবার সময় ভাত কম পড়ে গেলে বলতো, আমার ক্ষিদে নেই। বলেই সে অল্পকিছু ভাত প্লেটে নিয়ে বাকি ভাতটুকু আমার আর বাবার প্লেটে তুলে দিত। আমার মা তো অনেক ভালো। আমার মা কখনো আমাকে মারতো না। তবে মার খেতো। বাবার হাতে।
বাবার একবার প্রচণ্ড জ্বর হলো। মা সে রাতে সারারাত বাবার মাথায় জলপট্টি করে দিল। লুকিয়ে লুকিয়ে হয়তো কাঁদলোও। কারণ পরদিন দেখি মায়ের চোখ দুটো টকটকে লাল। মাকে বললাম, ‘মা তোমার চোখ দুটো লাল কেন?’ মা বলল, ‘কষ্ট পেলে চোখ লাল হয়ে যায়।’ আমি বললাম, ‘তোমার কি খুব কষ্ট?’ মা বলল, ‘হ্যাঁ।’ আমি ‘বললাম, তোমার কিসের কষ্ট মা?’ মা বলল, ‘বা-রে, জ্বর হয়ে তোর বাবার কষ্ট হচ্ছে না?’ আমার বললাম, ‘কষ্ট তো বাবার হচ্ছে। কিন্তু তোমার চোখ লাল কেন?’ মা বলল, ‘আপন মানুষেরা কষ্ট পেলে নিজের চোখ লাল হয়।’ আমি বললাম, ‘বাবা কি তোমার আপন মানুষ?’ মা আর কোনো উত্তর দিল না। হেসে দিল একগাল। মাকে বললাম, ‘মা আমার চোখ লাল হয় না কেন?’ মা বলল, ‘তুই তো ছোট মানুষ। যখন বড় হবি, তখন আপন কেউ কষ্ট পেলে তোর নিজেরও চোখ লাল হয়ে উঠবে।’ আমি ঠোঁট উল্টিয়ে বললাম, ‘তুমি না বললে আমি বড় হয়েছি। তাহলে আমাকে ছোট বলছো কেন আবার?’ মা তখন হাসতে হাসতে বলল, ‘বড় হয়েছিস। যখন আরও বড় হবি। যখন আপনজনের কষ্টটা বুঝতে শিখবি, তখন তোর চোখও লাল হবে।’ আমি বললাম, ‘ও আচ্ছা।’
কিছুদিন পরে বাবা আমাদের ঘরের পাশেই আরো একটা ঘর বানানো শুরু করলো। যারা ঘর বানায় তাদের আমরা ছুতার বললাম। ছুতার এসে সপ্তাহ খানেক লাগিয়ে আমাদের নতুন একটা ঘর বানিয়ে দিয়ে গেল। ঘর বানানোর সময় মাকে বললাম, ‘এই ঘরে কে থাকবে মা?’ মা বলল, ‘কে আবার! তুই থাকবি।’ আমি বললাম, ‘আমার তো একটা চৌকি আছেই।’ মা বলল, ‘ছেলেরা যখন বেশি বড় হতে থাকে, তখন তাকে মা বাবা’র ঘর ছেড়ে আলাদা ঘরে থাকতে হয়।’ আমি খুশি হয়ে বললাম, ‘ও আচ্ছা।’
আমি তখনও আমার ওই নতুন ঘরে যাইনি। মা বাবার ঘরের ওই কোণার চৌকিতেই ঘুমাই। একদিন গভীর রাতে আমার ঘুম ভেঙে গেল! মা এসে আমার ঘুম ভাঙালো। আমি বললাম, ‘কী হয়েছে মা?’ মা বলল, ‘ওঠ, আজ থেকে তুই আমার সাথে ঘুমাবি। দুই মা বেটা এক সাথে ঘুমাব। ভালো হবে না?’ আমি বললাম, ‘তাহলে বাবা ঘুমাবে কোথায়?’ মা বলল, ‘তোর বাবা আর কোনোদিন আমাদের সাথে ঘুমাবে না।’ আমি বললাম, ‘কেন?’ মা বলল, ‘তোর বাবা আজ থেকে ঐ নতুন ঘরে ঘুমাবে।’ আমি বললাম, ‘তাহলে তুমি আমাকে বলেছিল কেন, ঐ ঘর আমার ঘর? মা কোনো জবাব দিল না। মাকে বললাম, ‘মা তুমি কি কাঁদছ? তোমার চোখ লাল কেন? তোমার আপন মানুষ কি আবার কষ্ট পেয়েছে? বাবার কি আবার জ্বর এসেছে মা? বাবার কী হয়েছে?’ মা সেদিন রাতে আর একটা কথাও বলেনি। শুধু কেঁদেছে।
মায়ের চোখে সেই প্রথম আমি পানি দেখেছি। শুধু পানি না, ফুঁপিয়ে বাচ্চা মেয়েদের মত কাঁদতে দেখেছি। মা সারারাত আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেছিল সে রাতে। আমি ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মায়ের কোলেই।
পরদিন সকালেই বাবা আমাকে নতুন ঘরে নিয়ে গেল। নতুন ঘরে ঢুকেই দেখি একটা মেয়ে লাল টুকুটুকে শাড়ি পরে বসে আছে। আমাকে দেখে সে কোলে নিতে চাইলো। আমি গেলাম না। বাবা বলল, আজ থেকে এটা তোমার ছোট মা। তোমার ছোট মাকে ছোট মা বলে ডাকবা, ঠিক আছে? আমি কিছু বললাম না। এক দৌড়ে আমি আমার মায়ের কাছে চলে এলাম।
.
.
২০ বছর পার হয়ে গেছে। এখন মা আর আমি আমার নিজের ফ্ল্যাটে থাকি। বাবা কোথায় আছে জানি না। জানতে চাইও না আর।
এক রাতে কারো কান্নার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল আমার! আমি দরজা খুলে দেখি মা বেলকনিতে দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে হু হু করে কাঁদছে। আজ আকাশে বড্ড জোছনা। এই জোছনা কি সুখের জোছনা? নাকি শোকের? ভালোবাসার? নাকি ঘৃণার? আজ বড় হয়েও এই ব্যাপারটা মেলাতে গিয়ে তালগোল পাকিয়ে ফেললাম। আমি নিঃশব্দে দরজা লাগিয়ে নিজের রুমে চলে এলাম।
সকালে নাস্তা করার জন্য ডাইনিং টেবিলে বসে আছি। মা নাস্তা দিতে দিতে হঠাৎ আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোর চোখ দুটো লাল কেন বাবা?’
আমি বললাম, ‘ও কিছু না মা। আপন মানুষেরা কষ্ট পেলে নিজের চোখ লাল হয়।’ 🙂
– “এক জোড়া লাল চোখ”
©_দুষ্টছেলে?