এক চিলতে ভালোবাসা পর্ব-০৪ এবং শেষ পর্ব

0
183

#এক_চিলতে_ভালোবাসা
[চতুর্থ ও শেষ পর্ব ]
লেখক – শহীদ উল্লাহ সবুজ

পুরো হাসপাতাল স্তব্ধ হয়ে আছে আমার মৃত্যুর কথা শুনে। বাবা যেনো নিজের ভাষা হারিয়ে ফেলছে। মা তো অজ্ঞান হয়ে পড়ছে। জয়া পাথর হয়ে আছে। ডাক্তার বাবাকে বলল — শক্ত হোন।

এই কথা বলে ডাক্তার চলে গেলো। তার তো আর কিছু বলার নেই। এবার সবাই অঝোরে কান্না করতে শুরু করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার লাশ নিয়ে যাওয়া হয় বাড়িতে। বাড়িতে আজ অনেক মানুষের আগমন ঘটেছে। আম্মু আর আব্বুকে অনেকেই সান্ত্বনা দিচ্ছে। জয়া প্রচুর কান্নাকাটি করছে।

এবার আমার লাশ নিয়ে যখন বাসা থেকে বের হবে তখনই হঠাৎ করে আমার ফোন বেজে ওঠে। ফোনের শব্দ শুনে আমার ঘুম ভেঙে যায়। তখন বুঝতে পারলাম এতক্ষণ যা হয়েছে সেটা আমার স্বপ্ন ছিল। আমার পুরো শরীর ঘেমে একাকার হয়ে গিয়েছে। আমি দেরি না করে ফোন রিসিভ করলাম। ফোন হাতে নিয়ে দেখি ডাক্তারের নাম্বার আমি ফোন রিসিভ করলাম।

— হ্যালো।

— সবুজ, তোমার সাথে আমার কিছু কথা ছিল।

— আপনি তো আমাকে কাল কল দিতে পারতেন দিনে।

— হ্যাঁ কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আগে থেকে জানিয়ে দেওয়া দরকার। দেখো তোমার লাইফ রিক্স রয়েছে। আমি চাইনা আমার ভাতিজীর জীবন এভাবে শেষ হয়ে যাক। তুমি খুব ভালো একটা ছেলে। আমি চাইনা তোমার সাথে খারাপ কিছু হোক।

— আচ্ছা বলুন কি বলবে?

— তুমি তোমার বাসায় সব টা জানাও। আর আমি তোমার রিপোর্ট আবার চেক করেছি। তোমার ক্যান্সার দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। আমি চাই তুমি হাসপাতালে চলে আসো খুব তাড়াতাড়ি। যে ভাবেই হোক আমি তোমাকে সুস্থ করার চেষ্টা করব। বাকিটা আল্লাহর হাতে। কিন্তু তুমি আমার উপর ভরসা করতে পারো।

— আচ্ছা আমি আপনার সাথে কাল কথা বলব এ বিষয় নিয়ে।

— ঠিক আছে।

এই কথা বলে ফোন কেটে দিয়ে পাশে তাকাতেই দেখি জয়া আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম জয়া যে আমার পাশে শুয়ে আছে। জয়াকে তাহলে সব শুনে নিয়েছে?

— এতো রাতে আপনি কার সাথে কথা বলছিলেন? আর কাকে কি জানানোর কথা বলছেন?

যাক জয়া তাহলে কিছু শুনেনি।

— আমার অফিসের কলিগ কল দিয়েছে, কবে জইন করব সেটা জানার জন্য।

— ওহ আচ্ছা।

তারপর দু’জনেই ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে হঠাৎ করে আমার নিশ্বাস ভারী হয়ে উঠে। আমি যেনো নিশ্বাস নিতে পারছিনা। যেনো বুকের উপরে কেউ বসে আছে এমন মনে হচ্ছে। হঠাৎ করে নাক মুখ দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। তাহলে কি এবার আমার স্বপ্ন সত্যি হতে চলছে? আমি নাক মুখ ডেকে নিলাম। কিন্তু উঠে দাড়ানোর শক্তি নেই। রুমে একটা মানুষ নেই যে কাওকে ডেকে দেব। চিৎকার করার শক্তি ও আমি পাচ্ছিনা। হঠাৎ করে জয়া রুমে আসে। আমাকে চটপট করতে দেখে আমার কাছে চলে আসে।

— কি হইছে আপনার?

আমার পুরো চোখ ইতিমধ্যে ঝাপসা হয়ে এসেছে। চোখে অন্ধকার দেখতে শুরু করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার চোখ বন্ধ হয়ে গেলো।

যখন চোখ খুল্লাম তখন নিজেকে হাসপাতালের বেডের উপরে আবিষ্কার করলাম। চোখ খুলে দেখি সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আব্বু আম্মুর চোখে পানি। আর হতাশ নয়নে আমার দিকে তাকিয়ে আছে আমার প্রিয়তমা স্ত্রী। সবাই হয়তো এতক্ষণে সব জেনে গিয়েছে।

বাবা আমার মাথায় হাত ভুলিয়ে দিয়ে বলল,

— তুই নিজেকে কেন এতো কষ্ট দিচ্ছিস বাবা? আমাদের তো সত্যিই টা জানাতে পারতি। আমাদের জন্য নিজের এতো বড় অসুখ লুকিয়ে রেখেছিস। তোর কিছু হয়ে গেলে আমার কি নিয়ে বাঁচব বল?

— বাবা আমার কিছু হবে না। চিন্তা করনা তোমরা। আমি ঠিক হয়ে যাবো।

আম্মু আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে শুরু করে। আম্মুর কান্না দেখে আমি আর নিজের চোখের পানি আঁটকে রাখতে পারলাম না। এই মানুষ গুলোকে ছেড়ে আমার চলে যেতে হবে? এবার ডাক্তার ফিরে আসে আমাকে দেখার জন্য। ডাক্তার আর কেউ না জয়ার চাচ্চু।

— এখন কি অবস্থা তোমার?

— আলহামদুলিল্লাহ।

— আজ রাতে তোমার অপারেশন হবে। ইনশাআল্লাহ তুমি ঠিক হয়ে যাবে।

আমি কিছু বললাম না।

ডাক্তার চলে গেলো। দেখতে দেখতে রাত হয়ে গেলো। এখনও জয়ার আমার সাথে কথা বলতে আসেনি। হয়তো রাগ করে আছে। কিন্তু জয়ার সাথে একবার আমার কথা বলা খুব দরকার। আমি আব্বুকে বললাম — আব্বু জয়া কথায়?

— মেয়েটা সকাল থেকে না খেয়ে আছে। এখনও কিছুই খায়নি। সারাক্ষণ কান্না করছে।

— ওরে একটু ডেকে দাও শেষ বারের মতো একটু কথা বলি।

— এভাবে বলিস না। আমি ডেকে দিচ্ছি।

এবার জয়া আমার কাছে আসে। কেবিনে এখন আমি আর জয়া ছাড়া কেউ নেই। মেয়েটা কান্না করতে করতে চোখ লাল করে ফেলছে।

— খাওয়া দাওয়া করলে না কেন? অসুস্থ হয়ে গেলে আমার মা-বাবার খেয়াল কে রাখবে? জয়া সরি। আমাকে পারলে ক্ষমা করে দিয়ো। দেখো আমি তোমার জীবন নষ্ট করতে চাইনি। আমি জানতাম না যে আমি এতো বড় একটা রোগে আক্রান্ত। নাহলে আমি তোমার সুন্দর জীবন এভাবে শেষ করে দিতাম না। আমাকে ক্ষমা করে দিয় পারলে।

— আপনার মতো মানুষ পাওয়া ভাগ্যের ব্যপার। আপনার মতো মানুষ কয় জনের কপালে থাকে?আমি পেয়েছি। এটাই আমার ভাগ্য। যে মানুষ নিজের কথা না ভেবে অন্যকে নিয়ে ভাবে তার তোর কোনো ভুল থাকেনা।

— জয়া একটা শেষ কথা বলতে চাই। আমি আসলেই তোমাকে ভালোবাসি। আমার তোমাকে কাছে পাওয়ার খুব ইচ্ছে ছিল। সব ইচ্ছে তো আর পূরণ হয়না। আমার টাও না হয় হলোনা।

— আমিও আপনাকে ভালোবাসি। আপনার কিছু হবেনা। আপনি ঠিক হয়ে যাবেন।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাকে অপারেশন রুমে নিয়ে যাওয়া হয়। তারপর আমার আর কিছু মনে নাই।
সবাই কান্না করছে সবুজের জন্য। সবুজের আম্মু নামাজ পড়ে ছেলের জন্য দোয়া করছে। আর বাবা পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ভিতরে অপারেশন চলছে। ভিতরে কি হচ্ছে কেউ জানেনা। জয়া অঝোরে কান্না করছে। জয়ার মা-বাবা এসে তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছে।

এদিকে ডাক্তার অপারেশন শেষ করে বাহিরে আসতেই সবাই ডাক্তারের ছুটে আসে।

— ডাক্তার আমার ছেলে কেমন আছে? ও ঠিক আছে তো?

ডাক্তার কোনো কথা বলছেনা।

এবার ডাক্তারের কাছে এসে বলল — চাচ্চু কথা বলছ না কেন? উনি ঠিক আছে তো?

— আপনারা চিন্তা করবেন না। আসলে আমার যেমনটা ভেবেছিলাম ঐরকম মারাত্মক প্রকারে যায়নি। অপারেশন সাকসেস হয়েছে। এখন সবুজ সুস্থ আছে। কিছুক্ষণ পরেই ওকে কেবিনে নিয়ে যাওয়া হবে। ভালো মানুষদের সাথে কখনও খারাপ কিছু হয়না।

জয়া ডাক্তারকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে শুরু করে।

— আরে বোকা মেয়ে কান্না করছিস কেন? সবুজ কয়েকদিনের মধ্যেই পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাবে। কিছু দিন খেয়াল রাখিস।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার জ্ঞান ফিরে আসে। তখন নিজেকে কেবিনের মধ্যে আবিস্কার করলাম। সবাই আমার জ্ঞান ফিরে আসতে দেখে অনেক খুশি।

কিছুদিন পরে আমাকে বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। আর কিছুদিনের মধ্যেই আমি সুস্থ হয়ে যাই। এ কয়দিন জয়া আমার অনেক সেবাযত্ন করছে।

আমি রুমে বসে আছি তখন জয়া আমার কাছে আসলো।

— জয়া একটা কথা বলার ছিল।

— কি কথা?

— আমাদের তো এখনও বাসর সম্পুর্ন হয়নি। আজকে বাসর টা সম্পুর্ন করে ফেলি।

জয়া কিছুটা লজ্জা পেয়ে বলল — অনেক দুষ্ট হয়ে গেছেন তাইনা। কিছুই হবে না এসব।

— কি বলো। আমাদের তো বাচ্চাকাচ্চার পড়াশোনার ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে।

আমার কথা শুনে জয়া খিলখিল করে হাসতে হাসতে আমার বুকে মাথা রেখে বলল — এখন কোনো বাচ্চা নই। আগে আমরা লাইফ ভালো ভাবে ইঞ্জয় করব। তারপর বাচ্চা।

— ঠিক আছে। তাহলে আজকে রাতে হবে কিন্তু।

জয়া লজ্জা পেয়ে চলে গেলো। আমি বাহিরে গিয়ে ফুল কিনে এনে রুমটা সাজিয়ে নিলাম। রাত হয়ে গেলো সবাই ঘুমিয়ে পড়ছে। জয়া এবার একটা লাল শাড়ী পড়ে আসলো। জয়াকে একদম নতুন বউয়ের মতো লাগছে।

এবার আমি জয়াকে খাটের উপরে বসিয়ে দিয়ে বললাম — তাহলে শুরু করি।

মেয়েটা লজ্জায় পুরো লালা হয়ে আছে। এবার আমি জয়ার কপালে একটা চুমু খেলাম। তারপর যা হলো তা আর বলা যাবেনা সিগ্রেট। যদিও বিবাহিত রা বুঝবে, আর অবিবাহিত রা বুঝতে হলে বিয়ে করে নিয়েন। (হাহাহা)

দু’জন হারিয়ে গেলাম ভালোবাসার অতলে। তারপর থেকে খুব ভালো ভাবেই কাটতে থাকে জয়া আর সবুজের নতুন জীবন।

সমাপ্ত।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে