এক চিলতে ভালোবাসা পর্ব-০৩

0
229

#এক_চিলতে_ভালোবাসা
[তৃতীয় পর্ব ]
লেখক – শহীদ উল্লাহ সবুজ

জয়া দরজা খুলতেই দরজার ওপাশে থাকা লোকটাকে দেখে আমি বেশ অবাক হলাম। কারণ লোকটা আর কেউ উনি ডাক্তার সাহেব। আমি বুঝতে পারছিনা এই ডাক্তার এখানে কেন এলো? আমার খোঁজে নাকি অন্য কোনো ব্যাপার আছে?

হঠাৎ করে জয়া ডাক্তারকে জড়িয়ে ধরে বলল,

— চাচ্চু কেমন আছো?

— আমি ভালো আছি।

— আমি কিন্তু তোমার সাথে খুব রাগ করছি। তোমাকে কতো করে বলছি বিয়েতে থাকার জন্য। তুমি তাও এলে না।

— আসলে মা হাসপাতালে কাজের অনেক চাপ ছিল। তাই আসতে পারিনি। যখন শুনলাম তুই এলি আমি আর দেরি করলাম না। চলে এলাম।

এতক্ষণে ক্লিয়ার হলাম। কিন্তু মনের ভিতর একটা ভয় কাজ করছে ডাক্তার তো আমাকে দেখলেই চিনে ফেলবে। আর যদি সবাইকে বলে দেয়? আমি মনে মনে অনেকটা ঘাবড়ে গেলাম। যদি ডাক্তার সবাইকে সব সত্যি বলে দেয় তাহলে তো অনেক বড় ঝামেলায় হয়ে যাবে। আমি চাইনা এখন কেউ আমার অসুস্থতার ব্যাপারে জানুক।

— কিরে মা তোর হাসবেন্ড কোথায়? জামাইয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিবিনা।

— ভিতরে আসো চাচ্চু।

এবার জয়া ডাক্তারকে আমার সামনে নিয়ে আসে। ডাক্তার আমাকে এখানে দেখে অবাক হলো। ডাক্তার হয়তো ভাবতেও পেরেনি আমাকে এখানে দেখতে পাবে। আমি যে ভয়টা পাচ্ছিলাম সেটা হলো না।

জয়া বলল — চাচ্চু উনি আমার হাসবেন্ড।

আমি ডাক্তারকে সালাম করলাম। ডাক্তার সালামের উত্তর নিয়ে বলল — জয়া তুই একটু বাহিরে যা জামাইয়ের সাথে আমার কিছু কথা আছে।

— ঠিক আছে আমি গিয়ে তোমাদের জন্য নাস্তা রেডি করি। কথা শেষ করে তাড়াতাড়ি এসো তোমরা।

— ঠিক আছে।

জয়া চলে গেলো। ডাক্তার আমার কাছে এসে বলল।

— তাহলে আমার ভাতিজীর সাথে তোমার বিয়ে হলো? ওকে বলছ তুমি যে ক্যান্সারে আক্রান্ত?

— না।

— ওহ।

— আমি এখনও কাওকে বলনি।

— দেখো আমার মনে হয় সবাইকে সব টা বলে দেওয়া উচিৎ। আর তোমার হাসপাতালে ভর্তি হওয়া দরকার। দেখো তোমার সাথে জয়ার জীবন জড়িয়ে আছে।

— চিন্তা করবেনা। জয়ার কোনো ক্ষতি হতে আমি দেবনা। মেয়েটা অনেক ভালো। আর ওর সাথে এখনও আমার ফিজিক্যাল সম্পর্ক হয়নি। আমি জেনেশুনে কারোর জীবন নষ্ট করার মতো ছেলে নই।

— কিন্তু তবুও এই সমাজ তো জানে তোমরা বিবাহিত। এসব বলে কোনো লাভ নাই। আমি যেটা বলছি তুমি সেটা করার চেষ্টা করবে। রোগ টা ক্রমশ বাড়বে আগে থেকে চিকিৎসা না করালে।

— আমি কোনো সমস্যা দেখলে আপনাকে অবশ্যই জানিয়ে দেব।

— ঠিক আছে। চলো এখন নাস্তা করতে যাই।

এবার দু’জনে নাস্তা করতে চলে গেলাম। খাওয়া দাওয়া শেষ করে নিজের রুমে ফিরে এলাম।

কিছুক্ষণ পরে জয়া রুমের মধ্যে এসে দরজা বন্ধ করে দিয়ে আমার কাছে এলো।

— আপনাকে আমি খাটের উপরে ঘুমাতে বলার পরেও সোফায় কেন গিয়েছেন?

আমি নিশ্চুপ,

— আমাকে যখন আপনার পছন্দ না আমাকে কেন বিয়ে করতে গেলেন? বিয়ের আগেই তো বলতে পারতেন আমাকে আপনার পছন্দ না।

কি বলব আমি বুঝতে পারছিনা। মেয়েটা অনেক বেশি রেগে আছে। আমিও কিছু বলছিনা দেখে রাগ করে রুম থেকে বের হয়ে গেলো। আমি খাটের উপরে চুপচাপ বসে রইলাম। বিকেল হতেই আমি আর জয়া আমাদের বাসায় চলে গেলাম। মেয়েটা সারা রাস্তা আমার সাথে কোনো কথা বলেনি। বাসায় এসেও চুপচাপ হয়ে আছে। আমি একাই আমার রুমে বসে আছি তখন আম্মু আমার কাছে এসেছে।

— কিরে বউমার সাথে কি তোর কোনো কিছু নিয়ে ঝামেলা হইছে?

— না তো।

— তাহলে বউমা এতো চুপচাপ হয়ে আছে কেন?

— জানিনা। হয়তো মা-বাবার জন্য মন খারাপ হইছে ঠিক হয়ে যাবে।

রাতের খাবার খেতে গেলাম। সবাই খাবার টেবিলে বসে আছে। জয়ার দিকে তাকিয়ে দেখি সে চুপ হয়ে আছে। আমিও কোনো কথা না বলে খাবার খেয়ে নিজের রুমে চলে এলাম। জয়া কিছুক্ষণ পরে রুমে এলো। কোনো কথা বা বলে খাটের উপরে শুয়ে পড়ে। মেয়েটাকে এভাবে দেখে আমারও ভালো লাগছেনা। ভাবলাম মেয়েটার জন্য ফুচকা নিয়ে আসি তাহলে হয়তো রাগ কিছুটা হলেও কমবে। যেই ভাবা সেই কাজ। বেরিয়ে পড়লাম বাসা থেকে কিছুক্ষণের মধ্যেই ফুচকা নিয়ে ফিরে এলাম। জয়ার কাছে আসতেই দেখি মেয়েটা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না করছে।

— জয়া তুমি বাচ্চাদের মতো কান্না করছ কেন?

— আমি কান্না করলে আপনার কি?

— আরে কান্না থামাও দেখ কি নিয়ে আসছি তোমার জন্য।

— আমার কিছু দরকার নেই।

— আরে আগে দেখো না কি এনেছি তারপর বলবে।

জয়া এবার আমার দিকে তাকিয়ে তারপর সে ফুচকার দিকে তাকিয়ে সাথে সাথে উঠে বসে পড়ে। মেয়েটা ফুচকা দেখে খুশি হয়ে প্রথমবারের মতো জড়িয়ে ধরে। তারপর আমার থেকে ফুচকা নিয়ে খাওয়া শুরু করে। ফুচকা দেখে সে হয়তো ভুলেই গিয়েছে সব রাগ অভিমান।

— শুনেন আপনি আজকে থেকে আমার সাথেই ঘুমাবেন বলে দিলাম। যদি ভুল করেও অন্য কোথাও যান তাহলে আপনার খবর আছে।

— আচ্ছা ঠিক আছে।

দেখলাম জয়া একটা দড়ি নিয়ে আমার হাত বেধে নিজের হাত ও বেধে দিল। আমি ওর পাগলামি দেখে মুচকি মুচকি হাসছি। কিছুক্ষণের জন্য ভুলেই গিয়েছে আমি আর বেশিদিন নেই। খুব ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে বলি আমার পাগলি বউটা। তাকে কাছে টেনে নিতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু আমার কি আর সেই সুযোগ আছে? কিছু সময়ের জন্য কেন আমি তার সুন্দর জীবন শেষ করে দেব? এসব ভাবতেই নিজেকে শান্ত রাখলাম। এবার দু’জনে ঘুমিয়ে পড়লাম।

হঠাৎ করে আমার নাক দিয়ে র*ক্ত পড়তে শুরু করে। কাশির সাথেও র*ক্ত বের হচ্ছে। আমার নিশ্বাস যেনো বন্ধ হয়ে আসছে। আমি নিশ্বাস নিতে পারছিনা। হঠাৎ করে জয়া আমার এমন অবস্থা দেখে কান্নাকাটি শুরু করে।

— কি হইছে আপনার?

— আমি নিশ্বাস নিতে পারছিনা। আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে।

জয়া চিৎকার দিয়ে মা-বাবাকে ডেকে নিয়ে আসে। মা-বাবা আমার এমন অবস্থা দেখে অঝোরে কান্না করতে শুরু করে। আব্বু হাসপাতালে ফোন দিয়ে এম্বুল্যান্স পাঠাতে বলে। এদিকে আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে। চোখেমুখে অন্ধকার দেখছি। আম্মু আমার মাথায় হাত ভুলিয়ে দিচ্ছে।

— বাবা আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর তোর বাবা হাসপাতালে ফোন দিয়েছে।

— আম্মু। আমাকে তোমরা ক্ষমা করে দিয়ো। আমি হয়তো তোমাদের একা করে দিয়ে চলে যাবো।

— কি বলছিস এসব আবল তাবল? তোর কিছু হবেনা বাবা। আমরা আছি তোর পাশে।

— আম্মু আব্বু কই।

আমার কথা শুনে আব্বু আমার কাছে আসে।

— বাবা তোর কিছু হবেনা। চিন্তা করিস না।

— শুনো বাবা। আমার সময় ফুরিয়ে এসেছে। তুমি মায়ের খেয়াল রেখো। আর জয়াকে তার বাসায় পৌছে দিয়। আমি মেয়েটার সুন্দর জীবনটা নষ্ট করে দিলাম।

— কি বলছেন এসব আপনি? আপনার কিছু হবে না।

ইতিমধ্যে এম্বুল্যান্স বাসার সামনে চলে আসে। কয়েকজন এসে আমাকে নিয়ে গাড়িতে তুলে। তারপর একটা অক্সিজেন মাস্ক আমাকে পড়িয়ে দেয়। বাবা আমার মাথার পাশে বসে আছে। জয়া আর আম্মু অঝোরে কান্না করছে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা হাসপাতালে পৌছে গেলাম। আমাকে কেবিনে সিফট করা হলো। ডাক্তার আমাকে ভালো ভাবে পরিক্ষা করে বের হয়ে গেলেন।

আব্বু ডাক্তারের কাছে এসে বলল — ডাক্তার আমার ছেলে ঠিক আছে তো?

ডাক্তার নিশ্চুপ,,

— ডাক্তার কথা বলুন প্লিজ। আমার ছেলে ঠিক আছে তো?

— দেখুন অনেক দেরি করে ফেলছেন আপনারা। নিজেকে শক্ত রাখার চেষ্টা করুন। হাসপাতালে নিয়ে আসার আগেই আপনার ছেলে মারা গেছে। আমাদের হাতে আর কিছু করার নেই। সরি।

ডাক্তারের কথা শুনে সবাই স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেনো এখানে কোনো মানুষ নেই। পুরো হাসপাতাল স্তব্ধ হয়ে গেছে। ছেলে হারানোর শোকে পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বাবা।

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে