এক চিলতে ভালোবাসা পর্ব-০১

0
241

#এক_চিলতে_ভালোবাসা
[সূচনা পর্ব ]
লেখক – শহীদ উল্লাহ সবুজ

কিছুক্ষণ আগেই ক্যান্সার ধরা পড়ছে। বাসর ঘরে নববধু, সে তো আমার অপেক্ষায় বসে আছে। কীভাবে সবাইকে বলব আমি মরণ ব্যাধি ক্যান্সারে আক্রান্ত! যেখানে নিজেই মানতে পারছিনা সেখানে পরিবারের লোকজন কীভাবে মেনে নিবে? আমিও জানতাম না এতো বড় একটা রোগে আমি আক্রান্ত। কিছুক্ষণ আগেই ডাক্তার ফোন দিয়ে জানালেন। আমি যে একটা মেয়ের সুন্দর জীবন দংশ করে দিলাম। আমি তো কখনও নিজেকে ক্ষমা করতে পারবোনা। নিজের জন্য একটুও খারাপ লাগছেনা। কিন্তু আমার পরিবার, আমার মা-বাবা। তাদের কথা ভাবতেই খুব কষ্ট হচ্ছে। কারণ আমি ছাড়া তো তাদের কেউ নেই। তারপর আবার আমার বিয়ে করা নতুন স্ত্রী। কি করব মাথায় কাজ করছেনা।

এদিকে রাত গভীর হচ্ছে। আমি এখনও বাসর ঘরে প্রবেশ করলাম না। মেয়েটা হয়তো এখনও আমার অপেক্ষায় আছে। হঠাৎ করে মায়ের ডাক শুনলাম। চোখের পানি গুলো তাড়াতাড়ি করে মুছে মায়ের দিকে ফিরলাম।

— কিরে, তুই এতো রাতে এখানে দাঁড়িয়ে আছিস তোর কি কোনো কান্ড জ্ঞান নেই? মেয়েটা একা রুমে বসে আছে, আর তুই বাহিরে দাঁড়িয়ে আছিস।

— যাচ্ছি আম্মু।

— এখনি চল আমার সাথে।

আম্মু আমার হাত ধরে নিয়ে যাচ্ছে। বলে রাখি আমাদের বিয়েটা পারিবারিক ভাবেই হয়েছে। বিয়ে ঠিক হওয়ার কিছুদিন পরে হঠাৎ করে আমার মুখ দিয়ে ব্লিডিং হচ্ছিলো। ঐরকম একটা গুরুত্ব দেয়নি প্রথমে। দুইদিন আগে আবার হলো। তারপর ডাক্তারের সাথে কথা বললাম। বিয়ের ডেট আগেই ঠিকঠাক হয়ে যায়। আমি ব্লাড পরিক্ষা করালাম। আর সেটার রিপোর্ট এসেছে মাত্র আমার হাতে। তাও অনেক দেরি করে এলো।

কিছুক্ষণের মধ্যেই আম্মু আমাকে নিয়ে বাসর ঘরের সামনে চলে এলো। এবার আমি রুমের ভিতরে প্রবেশ করলাম। সামনের দিকে তাকিয়ে দেখি আমার নতুন বউ ঘোমটা দিয়ে বসে আছে। আমি এবার দরজা ভিতর থেকে বন্ধ করে দিলাম।

এদিকে দরজা বন্ধ করার শব্দ শুনে মেয়েটা এসে আমার পায়ে সালাম করে আবার খাটের উপরে চলে যায়। মেয়েটার কাছে যেতেও বুকের ভিতর উতালপাতাল শুরু করে দিয়েছে। বাসর রাতে মেয়েটাকে কি সত্যিটা বলে দেওয়া ঠিক হবে? যদি কথা গুলো শুনে কষ্ট পায়? মাথার মধ্যে হাজারো চিন্তা এসে ভর করছে। আমি এখনও সেখানে দাঁড়িয়ে আছি।

হঠাৎ করে জয়ার ডাকে দ্যান ফিরে এলো।

— আপনি ওখানে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ভয় পাচ্ছেন নাকি আমাকে?

মেয়েটার কথা শুনে মুখে একটা মুচকি হাসি এনে আমি খাটের দিকে এগিয়ে গেলাম। তারপর খাটের উপরে এসে বসলাম।

— খাওয়া দাওয়া হয়েছে রাতে? নাকি খালি পেটে বসে আছো?

মেয়েটা লজ্জা মাখা কণ্ঠে বলল — আসলে আমার সত্যিই অনেক খিদে পেয়েছে। তখন খাবার দিয়ে গিয়েছে খেতে পারিনি।

— আচ্ছা আমি তোমার জন্য খাবার নিয়ে আসি। আর তুমি শাড়িটি পরিবর্তন করে একটা পাতলা শাড়ি পড়ে নাও। আলমারিতে রাখা আছে।

এই কথা বলে আমি বেরিয়ে গেলাম। আর এক প্লেট খাবার নিয়ে ফিরে এলাম। রুমে আসার আগে দরজার মধ্যে টোকা দিলাম। মেয়েটা ভিতরে আসতে বলল। আমি মেয়েটার দিকে খাবার এগিয়ে দিয়ে বললাম — যা পেয়েছি নিয়ে আসছি।

— আপনাকে অনেক ধন্যবাদ।

এই কথা বলে মেয়েটা খাওয়া শুরু করে। আমি তার খাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। মেয়েটাকে কী যে মায়াবী লাগছে। আমি গিয়ে খাটের উপরে বসে রইলাম। খাওয়া দাওয়া শেষ করে এবার জয়া খাটের উপরে এসে বসে।

— আচ্ছা আপনি কি মেয়েদের দেখলে লজ্জা পান বুঝি?

আমি জয়ার প্রশ্নে কিছুটা অবাক হয়ে উল্টো প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বললা — লজ্জা পাবো কেন?

— না মানে খেয়াল করলাম আপনি তখন থেকেই আমার থেকে দূরে সরে আছেন সেই জন্য বলছি।

— ওহ আচ্ছা।

— আচ্ছা আপনি কি কখনও প্রেম করছেন?

— নাহ।

— সত্যি বলছেন নাকি মিথ্যা বলছেন?

— সত্যি কথা বলছি।

— তাহলে ঠিক আছে।

— আচ্ছা তোমার কোনো বয়ফ্রেন্ড আছে থাকলে বলতে পারো। আমি তার হাতে তোমাকে তুলে দেব।

এই প্রশ্নটা করে আমি মেয়েটার দিকে তাকালাম। আমার এমন প্রশ্নে মেয়েটা হয়তো বিরক্ত হয়েছে।

— আমি কখনও হারাম রিলেশনে যাইনি। আমার তো স্বপ্ন ছিল হাসবেন্ডের সাথে প্রেম করব।

— আচ্ছা শোন, তোমাকে কিছু কথা বলার দরকার।

— জ্বি বলুন।

— আমাদের বিয়েটা পারিবারিক ভাবে হয়েছে। আমরা তো কেউ কাওকে ভালো ভাবে চিনিনা। আমাদের একজন আরেকজনকে চেনার জন্য কিছুটা সময়ের দরকার। তাই আমি চাই আমাদের মধ্যে আগে চেনাজানা হবে তারপর আমরা শারীরিক সম্পর্ক করব।

জয়া একটা মুচকি হাসি দিয়ে সহমত পোষণ করল।

— আচ্ছা তোমার কোনো স্বপ্ন আছে এই বাসর রাত নিয়ে? আমাকে বলতে পারো আমি তোমার স্বপ্ন পূরণ করার চেষ্টা করব।

— সত্যিই করবেন?

— হ্যাঁ।

— আমার ইচ্ছে করছে ফুচকা খাওয়ার। প্লিজ চলুন আমরা বাহিরে গিয়ে ফুচকা খেয়ে আসি।

— এতো রাতে?

— চলুন না প্লিজ প্লিজ।

— ওয়েট আগে দেখি আম্মু ঘুমাইছে নাকি।

এই কথা বলে আমি নিজের রুম থেকে বেরিয়ে এসে মায়ের রুমে গেলাম। দেখলাম তাঁরা ঘুমিয়ে আছে। এবার নিজের রুমে ফিরে এসে জয়াকে নিয়ে এতো রাতে বেরিয়ে এলাম। বাসা থেকে বেরিয়ে একটা রিকশা নিলাম। জয়া উঠে বসল। জয়ার পাশে বসতে খুব অস্থির লাগছে আমার। আমাদের দু’জনের পাশে কিছুটা গ্যাপ রেখে বসছি। আমার এভাবে বসতে খুব অসুবিধে হচ্ছিলো। হয়তো ব্যাপারটা জয়া লক্ষ্য করে।

— আপনি তো রিকশা থেকে পড়ে যাবেন। ঠিক করে বসুন। এতো ভয় পাওয়ার কি আছে? আমি তো আপনার স্ত্রী।

মনে সাহস এনে আমি ঠিকভাবে বসলাম। হঠাৎ করে জয়া আমাত হাত চেপে ধরে। হঠাৎ করে মনে হলো আমি কারেন্টের শর্ট খেয়েছি। আমি জয়ার হাত টা সরিয়ে দেওয়ার শক্তি পাচ্ছিনা। কিছুক্ষণ পরে আমরা একটা ফুচকা দোকানের সামনে গিয়ে নামলাম। তারপর এক প্লেট ফুচকা ওর্ডার দিলাম।

— এক প্লেট কেন? আপনি খাবেন না?

— নাহ, ফুচকা আমি খাইনা।

এবার মেয়েটা খাওয়া শুরু করলো। আমি তাকিয়ে রইলাম মেয়েটার দিকে। আর খুব আপসোস হচ্ছে ঈশ, যদি আমি সুস্থ থাকতাম! যদি আরো কিছু দিন বেঁচে থাকার সুযোগ হতো। এই মেয়েটার সুন্দর জীবন আমি শেষ করে দিলাম।

ইতিমধ্যে জয়ার খাওয়া দাওয়া শেষ হয়ে গেলো। কিছুক্ষণের মধ্যেই দু’জনে বাসায় ফিরলাম।

— শোনেন, চলুন আমরা ছাদের উপরে যাই। আকাশে আজ অনেক সুন্দর চাঁদ উঠেছে আমরা আজ এক সাথে চাঁদ দেখবো।

তারপর দু’জন ছাদের উপরে গিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। হালকা বাতাসে শরীর ঠান্ডা হয়ে আসছে। আমি মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। চাঁদের সব আলো যেনো মেয়েটার মুখের উপরে এসে পড়ছে। এ যেনো আমার সামনে দু’টি চাঁদ। মেয়েটার থেকে চোখ সরাতে পারছিনা। হঠাৎ করে মেয়েটা আমার হাত ধরে বলল,

— জানেন খুব স্বপ্ন ছিল পূর্নিমার রাতে আমার বিয়ে হবে। আমি আমার হাসবেন্ডের সাথে চাঁদ দেখবো। আপনি আমার সব ইচ্ছে পূরণ করে দিয়েছেন। আপনার মতো স্বামী পেয়ে নিজেকে ভাগ্যবতী মনে হচ্ছে।

আমি কিছু বললাম না। কি বা বলার আছে? আমি তো আর কিছুদিনের জন্য আছি। আমি তো এই সুন্দর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলেই যাবো। এসব ভাবতেও অনেক খারাপ লাগছে।

হঠাৎ করে নাকে হাত দিলাম। হাত টা সামনের দিকে আনতেই দেখি আমার পুরো হাত লাল হয়ে গিয়েছে। আমি আর দাঁড়িয়ে না থেকে তাড়াতাড়ি করে ওয়াশরুমে চলে গেলাম। ভালো ভাবে হাত মুখ ধুয়ে বেরিয়ে এলাম। রুমে এসে দেখি জয়া বসে আছে।

— কি হইছে আপনার এভাবে চলে এলেন কেন?

— তেমন কিছু হয়নি। আচ্ছা রাত অনেক হয়েছে এখন আমাদের ঘুমিয়ে পড়া দরকার।

— হুম চলুন।

এবার খাট থেকে একটা বালিশ নিয়ে নিচে বিছানা করব তখনই জয়া বলল,

— একি নিচে বিছানা করছেন কেন?

— আমি নিচে ঘুমব। তুমি খাটের উপরে ঘুমিয়ে পড়।

— আরে নিচে কেন ঘুমাবেন? খাটের উপরে ঘুমতে পারেন আমার কোনো সমস্যা হবে না।

— সমস্যা হতে কতক্ষণ? একটা ছেলে একটা মেয়ে এক বিছানায় থাকলে নিজেকে কন্ট্রোল করে কতক্ষণ রাখা যাবে?

মেয়েটা একটা হাসি দিয়ে বলল — আপনি তো আমার হাসবেন্ড সমস্যা কি?

— কোনো সমস্যা নাই। আমার ঘুম পাচ্ছে আমি ঘুমব।

এই কথা বলে আমি নিচে বিছানা করে বালিশে মাথা রাখলাম। মেয়েটাও খাটের উপরে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। এদিকে আমার চোখে ঘুম নেই। আমার কি ঠিক হচ্ছে? মেয়েটাকে তো সত্যি টা বলে দেওয়ার উচিৎ ছিল। বললে হয়তো আজকে আর মেয়েটার মিষ্টি হাসি আমি দেখতেই পারতাম না। কেন জানি মেয়েটাকে কাছে পেয়ে বেঁচে থাকার ইচ্ছেটা বেড়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমার কি আর সেই কপাল আছে? আমি তো আর সামান্য কিছুদিনের মুসাফির মাত্র। সবাইকে ছেড়ে চলে যাবো। মা-বাবাকে কীভাবে বলব তোমাদের ছেলে তোমাদের একা করে দিয়ে চলে যাবে? বুকের ভিতরটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। চোখ দিয়ে টপটপ করে অঝোর ধারা বৃষ্টি নামছে।

কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম নিজেও জানিনা। হঠাৎ করে বুকের উপরে ভারী কিছু অনুভব করে চোখ খুলে তাকালাম। চোখ খুলতেই আমি চমকে উঠলাম।

চলবে?

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে