এক আকাশ দূরত্ব পর্ব-৩৩ এবং শেষ পর্ব

0
640

#এক_আকাশ_দূরত্ব (৩৩ এবং শেষ)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

সময় এগিয়ে চলেছে। দেখতে দেখতে কেটে কেটে অনেকগুলো বছর।ঘড়ির কাঁটায় ১২টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে আহমেদ ভিলার সমস্ত লাইট জ্বলে উঠল, একসাথে সবাই মিলে চেঁচিয়ে উঠল,

– “হ্যাপি অ্যানিভার্সারি।”

হ্যাঁ আজ নাজিয়া ও আবরারের ২৫তম বিবাহ বার্ষিকী। ওদেরকে কিভাবে সারপ্রাইজ দেবে সেটা ভাবতে ভাবতেই ছোটদের ১মাস কেটে গেছে কখন বুঝতেই পারেনি। আজকে সকালেও প্ল্যান নিয়ে প্রান আর আনহার মধ্যে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লেগে গিয়েছিল। কিছুদিন আগেই প্রান ২৫বছর ছুঁলো আর আনহার ১৯রানিং ২০ অর্থাৎ বুড়ি হবে হবে হচ্ছে।

আনহা একটা কেক নিয়ে এসে বলল,
– “মা বাবা চলো কেক কাটবে।”

ওরা কেক কাটতে যাবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল তার আগেই প্রান আরো একটা কেক নিয়ে হাজির। ওদের পথ আটকে বলল,
– “মাম্মাম পাপা আমার আনা কেক কাটবে, তুই ওইটা নিয়ে ফট।”

আনহা মুখ ভেংচি দিয়ে বলল,
– “তুই ওইটা নিয়ে ফট। বললেই হলো নাকি! আমি আগে এনেছি তাই আমার কেকটাই কাটা হবে তুমি যাও তো এইখান থেকে।”

বাকিরা হতাশার নিঃশ্বাস ফেলল। এত সুন্দর একটা মুহূর্তেও এদের ঝগড়া করতে হবে! এরা বড়ো হলেও এদের ঝগড়া শুনলে মনে হবে এরা বাচ্চা, ক্লাস টু থ্রিতে পড়ে।

পরিস্থিতি জটিল হতে দেখে শাওন আবরার ও নাজিয়ার কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলল,
– “আঙ্কেল আন্টি তোমার থামাও নাহলে কিন্তু এখুনি বিশ্বযুদ্ধ লেগে যাবে।”

নাজিয়া আনহাকে ধমক দিতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিল কিন্তু তার আগে আবরার ওর হাত ধরে থামিয়ে দিয়ে বলল,
– “আমরা দুজনে দুজনের কেকই কাটব। এখন ঝগড়া না করে কেকগুলো রেখে দাও।”

আনহা ভেংচি দিয়ে কেকটা রেখে দিল, প্রান রাগী চোখে তাকিয়ে বলল,
– “এই তুই কথায় কথায় ভেংচি কাটিস কেন? আমি বলেছি না আমার সামনে ওইসব করবি না!”
– “আমার মুখ আমি যা ইচ্ছা করব।”

প্রান রাগে কটমট করে তাকাল যার অর্থ অনুষ্ঠানটা শেষ হোক তোর খবর করে ছাড়ব। আনহা ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে সামনের চুলগুলো ফু দিয়ে উড়িয়ে দিল, যেটাতে প্রানের রাগ আকাশ ছুঁলো। কিন্তু এখন সবার‌ সামনে ওকে কিছু করতে পারবে না তাই চুপ করে রইল।

আবরার- নাজিয়া দুজনের আনা কেকটাই কাটল, তারপর দুজন দুজনকে খাইয়ে দিল। আবরার সকলের উদ্দেশ্যে বলল,
– “কেকগুলো খেয়ে যে যার রুমে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়বে নাহলে কালকের পার্টি ক্যান্সিল।”

সবাই না বলে চেঁচিয়ে উঠল। একসাথে এতজনের আওয়াজে নাজিয়া আবরার কানে হাত দিতে বাধ্য হলো।

– “আরে আসতে কান খারাপ হয়ে যাবে।”
– “আমরা এখুনি গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ছি, তোমরা প্লিজ কালকের পার্টিটা ক্যানসিল করার কথা ভাববেও না।” (আনহা)
– “ঠিকাছে।”

আনহা সবাইকে নিজের আনা কেকটা কেটে দিল শুধুমাত্র প্রানকে বাদ দিয়ে। সেইম একই কাজটা প্রানও করল। এদের এতো ঝামেলা কেন?

আবরার ও নাজিয়া রুমের বারান্দায় গিয়ে বসল। বিয়ের এতগুলো বছর পেরিয়ে গেল বুঝতেই পারল না, সময় কীভাবে কেটে যায়।

নাজিয়া আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,
– “২৫বছর হয়ে গেল!”
– “আমার‌ বিশ্বাসই হয় না এতগুলো বছর কাটিয়ে দিলাম, ২৫টা বছর একসাথে পথচলা। ছেলেমেয়েগুলো কত বড়ো হয়ে গেল তাই না।”
– “হুমম। আমরা বয়স্ক হয়ে গেলাম, মা, আঙ্কেল আন্টি সবাই আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন, ছেলে মেয়ে গুলো বড়ো হয়ে গেল সবটা কিরকম বদলে গেছে তাই না! ”
– “সময় যে কারোর জন্য থেমে থাকে না।”

নাজিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

– “কিন্তু আবিরদার জীবন থমকে গেছে, সেই দিদিতেই আটকে আছে। এতগুলো বছরে কাউকেই আর তার পছন্দ হলো না।”
– “ওইটা তো মাকে থামিয়ে রাখার জন্য বলেছিল। দাদা কখনোই ভাবির মায়া থেকে বের হতে পারবে না, ওদের গল্পটা ‘এক আকাশ দূরত্ব’ এর অনেক ভালোবাসা, মায়া কিন্তু তবুও কেউ কাউকে ছুঁতে পারবে না। আজীবন স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে থাকবে, হয়তো এটাকেই নিঃস্বার্থ ভালোবাসা বলে।”

নাজিয়া কিছু না বলে আবরারের কাঁধে মাথা রাখল। নিসার অনুপস্থিতি ওদের কষ্ট দেয়, কাঁদায় ঠিকই কিন্তু একটা কথা অস্বীকার করা যায় না নিসার অনুপস্থিতি না ঘটলে নাজিয়া -আবরারের গল্পটা কখনোই পূর্নতা পেত না। নাজিয়া নিজের দিদির সংসার বাঁচানোর জন্য আবরারের সাথে দূরত্ব বাড়িয়েই যেত হয়তো একসময়ে শ্রেয়ার সাথে আবরারের বিয়েটাও হয়ে যেত।‌ সবকিছু অন্যরকম হতো, হয়তো ভালো কিংবা খারাপ। যা কিছু হয় ভালোর জন্যই হয়, সবকিছুর পেছনেই কিছু না কিছু কারন থাকে। যেটা হয়তো আমাদের মেনে নিতে কষ্ট হয়, তবে সেইটাই আমাদের জীবনে সুখ নিয়ে আসে।

আবির নিসার স্মৃতি আঁকড়ে ধরেই এতগুলো বছর কাটিয়ে দিল। প্রান সবকিছুই জানে, ওর কাছে কোনকিছুই অজানা না।এতে ওর কোনো আফসোস নেয়, নাজিয়া ওকে মাতৃস্মেহে বড়ো করে তুলেছে ষ, কখনো মায়ের অভাব বুঝতে দেয়নি এইটাই কম কি!

আবিরের মা, নাজিয়ার মা বাবা দুজনেই মারা গেছেন। পুরানো প্রজন্ম বলতে একমাত্র আবিরের বাবাই বেঁচে আছেন। উনিও সারাটাদিন নিজের ঘরে বসেই কাটিয়ে দেন, কখনো সখনো প্রানের‌ সাথে আড্ডায় বসেন নিজেদের পুরানো দিনগুলো নিয়ে। প্রান বিষয়গুলো খুব এনজয় করে। আনহাও দাদুর সাথে আড্ডায় বসে, ওর আড্ডার টপিক থাকে আবরার নাজিয়া, আবির নিসার প্রেমকাহিনী। এইগুলো আবার প্রানের ঠিক পোষায় না, তাই দুজন আলাদা আলাদা ভাবে আড্ডায় মেতে উঠে।

——

নাজিয়া ভাবনার মাঝে বলল,
– “এই প্রান আর আনহাকে নিয়ে কি করব বলো তো! দুজন আগে তো এইরকম ছিল না, এখন এইরকম করে কেন?”
– “আমিও তো সেইটাই বুঝি না। দিনকে দিন একে অপরের শত্রু হয়ে উঠছে।”
– “হুমম।”

কিছুদিন আগে পর্যন্ত প্রান ও আনহার মাঝে সবকিছু স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু গত ১বছর যাবত দুইজন দুইজনকে একটুও সহ্য করতে পারে না, একটুতেই ঠোকাঠুকি লেগেই থাকে দুজনের মধ্যে। এটা নিয়ে বড়োদের দুশ্চিন্তার শেষ নেয়। ওরা যে হারে যুদ্ধ শুরু করে তাতে চিন্তা না করে উপায় আছে?

—-

সবাই নিজেদের রুমে চলে গেলেও প্রান ও আনহা থেকে যায়। দুজন দুজনের দিকে ভয়ঙ্কর ভাবে তাকাচ্ছে, ঠিক যেমন দুটো বিড়াল লড়াই করার আগে প্রস্তুতি নেয় ঠিক সেইরকম।

আনহা নিজের কেকের অবশিষ্ট অংশটা হাতের মধ্যে নিয়ে প্রানের সারা মুখে লাগিয়ে দিল, প্রানও কম যায় না আনহার মুখেও কেকের অবশিষ্ট অংশটা লাগিয়ে দিল। বর্তমানে দুজনেই কেক মেখে ভূত। দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল।

– “তোকে পুরোই পেত্মী লাগছে।”
– “আর তোমাকে পুরো ভূত লাগছে।”

প্রান ফোন বার করে আনহার কয়েকটা ছবি তুলে নিল,
– ‘এইগুলো তোকে ট্যাগ করে পোষ্ট করব।”

আনহা রেগে কটমট করে তাকাল। ওর কাছে ফোন না থাকায় প্রানের ছবি তুলতে পারল না, নাহলে ওকে মজা দেখাত।

– “আর ক্যাপশন দেব, কেক চুরি করে খেতে গিয়ে ধরা পড়ে যাবার পর অবস্থা।”

আনহা আঙুল উঁচিয়ে বলল,
– “দ্যাখো ভালো হবে না। আমি কিন্তু তোমাকে আনফ্রেন্ড করে ব্লক করে দেব।”

প্রান আনহার আঙুলটাকে ধরে বলল,
– “এই সাহসটা দেখানোর চেষ্টাও করিস না, তাহলে..
– “কি?”

প্রান বাঁকা হেসে বলল,
– “শখের আইডিটাই আর খুঁজে পাবি না।”

আনহা কিছু বলল না, কারন প্রান কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার ওর কাছে একটা আইডি হ্যাক করা কিংবা নষ্ট করা কোনো ব্যাপার না। কিন্তু আনহা তো এতটা সহজে ছেড়ে দেবার পাত্রী না, প্রানের পায়ে প্যারা দিয়ে দিল ।

– “আহ্, এইটা তুই কি করলি?”
– “আনহা দূর্বল নয় ওকে।যে আমাকে দূর্বল ভাববে তার অবস্থা এর থেকেও খারাপ হবে মাইন্ড ইট।”

আনহা ভাব নিয়ে চলে গেল, প্রান করুন চোখে নিজের পায়ের দিকে তাকাল। তারপর বিরবির করে বলল,
– “জংলী বিড়াল কোথাকার।”

আনহা নিজের রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে দেখতে লাগল।‌ নিজেকে অসুন্দর কিংবা অপছন্দ করার কোনো কারনই খুঁজে পেল না।
নিজের প্রতিবিম্বের উপর হাত বুলিয়ে বলল,
– “আমাকে কেন এতটা অপছন্দ করো প্রান! আমি তো তোমার প্রতি দূর্বল ছিলাম কিন্তু তুমি কি করলে! আমার দূর্বলতাটাকে ঘৃনায় পরিনত করতে বাধ্য করলে। একসময়ে যাকে আমি নিজের জীবনে চাইতাম, আজ তার সাথেই প্রতিনিয়ত ঝগড়া করি, তার মুখটাও দেখতে চাই না। এইসব তো হবার কথা ছিল না! কিন্তু হয়েছে, তোমার আর আমার মাঝে এখন ‘এক আকাশ দূরত্ব’ যে দূরত্বটা তুমি নিজের হাতে তৈরি করেছ। আর এই দূরত্ব কখনোই মিটবে না…

#সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে