এক আকাশ দূরত্ব পর্ব-৩২

0
519

#এক_আকাশ_দূরত্ব (৩২)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

– “এই নাজিয়া বার্থ সার্টিফিকেটটা দ্যাখ সব ঠিক আছে কিনা।”

নাজিয়া সার্টিফিকেটটা হাতে নিয়ে দেখতে লাগল। বেবির নাম “আনহা আহমেদ”। নামটা আবরার ঠিক করেছে দুইজনের নাম মিলিয়ে। নাজিয়ার কোনো আপত্তি ছিল নাহ তাই এই নামটাই সার্টিফিকেটে দেওয়া হয়েছে।

প্রান বাবার গলা জড়িয়ে ধরে বলল,
– “বাবা ওইটা কি?”
– “ওটাকে বার্থ সার্টিফিকেট বলে।”
– “বাথ সারফিকেট কি?”
– “তুমি ছোট এইসব বুঝবে না।”

কিন্তু প্রান নাছোড়বান্দা, সে জেনেই ছাড়বে ওইটা আসলে কি। নাজিয়া মৃদু হেসে বলল,
– “প্রান সোনা আমার কাছে আসো। আমি বলছি এইটা কি।”

প্রান ওর বাবার কোল থেকে নেমে নাজিয়ার‌ পাশে বসে পড়ল।

– “বলো।”
– “বার্থ সার্টিফিকেট মানে হলো, যেখানে তোমার বেবি ডলের নাম, জন্মানোর তারিখ লেখা থাকে।”
– “আমারও আছে?”
– “হুমম।”

প্রান চুপ করে কিছু একটা ভাবল তারপর জিজ্ঞেস করল,
– “মাম্মাম মা মানে কি? আমাকে সবাই জিজ্ঞেস করে মায়ের কথা।”
– “তুমি কি বলো?”
– “আমি বলি আমার মা নেই, ওই আকাশের তারা হয়ে গেছে। কিন্তু কেউ বিশ্বাস করে না সবাই বলে আমি নাকি মিথ্যা বলি, তুমিই নাকি আমার মা। কিন্তু তুমি তো আমার মাম্মাম মা না।”

নাজিয়া প্রানকে নিজের বুকের সাথে চেপে ধরল। চোখ ছলছল করছে, আবিরের চোখটা জ্বালাপোড়া করছে। ছেলের মুখে ওইসব শুনে দাঁড়িয়ে থাকার অবস্থাতে থাকল না, নাজিয়ার ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।

প্রান কিছু বুঝল না, চুপচাপ নাজিয়ার গায়ের সাথে লেপ্টে থাকল। নাজিয়া নিরবে চোখের পানিটা মুছে নিয়ে, প্রানের কপালে চুমু দিয়ে বলল,
– “যখন কেউ তোমাকে মায়ের কথা জিজ্ঞেস করবে, তখন তুমি বলবে আমার একটা মা আকাশের তারা হয়ে গেছে আর একটা মায়ের কাছে আমি থাকি যাকে আমি মাম্মাম বলে ডাকি।বুঝলে!”
– “তারমানে তুমিও আমার মা?”

নাজিয়াকে আবারো প্রানকে জড়িয়ে ধরে বলল,
– “হুমম বাবা আমিই তোর মা।”

আবির বিছানায় বসে প্রানের কথাগুলো ভেবে চলেছে। নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছে, নিজেকে বাবা বলতে ও নিসাকে মা বলতে না শেখালেই হয়তো ভালো হতো। ছেলেটা এইভাবে দ্বিধায় ভুগত না।

আবির নিজের ফোনে নিসার একটা ছবি বার করে বলল,
– “খুব মজায় আছো তাই না! দেখছ ছোট প্রানও নিজের অজান্তে তোমার উপস্থিতি চাইছে, তুমি আমাদের ছেড়ে না গেলেও পারতে…

আবির দীর্ঘশ্বাস ফেলল। দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিছুই করার নেয়, মানুষটা এমন জায়গায় চলে গেছে যেখান থেকে চাইলেও ফেরত নিয়ে আসা যায় না। আবিরের মা চেয়েছিলেন ছেলের একটা গতি করার, আবিরকে পুনরায় বিয়ে দেবার চেষ্টা করেছিলেন। নাজিয়া আবিরের দিকটা বিবেচনা করে ওনার সাথে সহমত প্রকাশ করেছিলেন কিন্তু আবরার একমত হতে পারেনি এই নিয়ে নাজিয়ার সাথে কিছুটা ঝামেলাও লেগেছিল…

– “আমি তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না, তুমি কি বলতে চাইছ দাদা আর একটা বিয়ে করলেই সুখে থাকবে?”
– “সুখে থাকবে এইটার গ্যারান্টি তো দিতে পারব না, তবুও একটা চেষ্টা।”
– “যেখানে গ্যারান্টি দিতে পারবে না, সেখানে কথা বাড়ানোর কোনো দরকার নেয়। আর নাজিয়া তুমি কিভাবে রাজি হচ্ছো আমি সেটাই বুঝতে পারছি না, তুমি তো দাদা ভাবির ভালোবাসার সাক্ষী তাহলে…

নাজিয়া একটা হতাশার নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
– “হ্যাঁ আমি জানি দিদি আর আবিরদা একে অপরকে ঠিক কতটা ভালোবাসত। যেখানে বিয়ের পর বেবিনা হলে সমস্যার তৈরি হয় সেখানে আবিরদা এতগুলো বছর দিদিকে কোনো কথা না বলে, কোনরকমের ঝামেলা না করে সবকিছু মানিয়ে নিয়ে ছিল। দিদির চলে যাওয়াটা আবিরদা এখনো মেনে নিতে পারেনি, এখনো মনে মনে দিদিকেই ভালোবাসে। কিন্তু জীবন তো কোনো গল্প না, যেখানে একা একা সারাটাজীবন কাটিয়ে দেব। প্রতিটা মানুষেরই একটা সঙ্গীর দরকার হয়, আর আবিরদার বয়সই বা কত এখনো গোটা জীবনটা পড়ে আছে। ওনার একটা সঙ্গী দরকার তাই আমি আর মা সিদ্ধান্ত নিয়েছি আবিরদার বিয়ে করাব।”

– “যা ইচ্ছা তাই করো, তবে আমি কখনোই দাদার পাশে অন্য কাউকে মেনে নিতে পারব না।”
– “আরে তুমি এইরকম বললে দাদাকে রাজি করাব কিভাবে?”
– “সেটা তোমাদের ব্যাপার।”

আবিরকে অনেক চেষ্টা করেও রাজি করানো যায়নি। যদিও এই দায়িত্বটা সম্পূর্ণ আবিরের মায়ের ছিল, নাজিয়া কখনোই আবিরকে দ্বিতীয় বিয়ের কথা বলতে পারবে না। হ্যাঁ ওহ চায় আবিরের একজন সঙ্গী হোক, কিন্তু নিজের বন্ধুর মতো দিদির জায়গায় অন্য কাউকে মেনে নেওয়াটা খুব একটা সহজ বিষয় নয়। সবটা শুনে বুঝে আবিরের বিয়ে দিতে চাইলেও বেহায়া মন যে সেটা কিছুতেই মানতে চায় না, দিদির সংসার, ভালোবাসার মানুষটার উপরে অন্যকারোর অধিকার বিষয়টা ভাবলেই কিরকম একটা ব্যথা অনুভব হয় বুকের ভেতর। আবার একজন মায়ের চিন্তাকে ফেলে দিতেও পারে না।

আবিরকে রাজি করানোর জন্য ওর‌ মা সবরকমের চেষ্টাই করেছেন কিন্তু ফলাফল ব্যর্থ। আবির সোজাসুজি জানিয়ে দিয়েছিল,

– “যদি কখনো কাউকে দেখে আমার মনে হয়, আমি তার সাথে সারাজীবন থাকতে পারব তখন আমি নিজে এসে তোমার কাছে বিয়ের কথা বলব প্রমিস।”

আবিরের মা হতাশ হয়ে বললেন,
– “সেই দিনটা কি আদৌও আমি দেখতে পারব?”

আবির মৃদু হেসে উত্তর দিল,
– “জানি না।”

নিসাকে ছাড়া আবির বড্ড একা তবে সেই একাকিত্ব দূর করার জন্য নতুন সঙ্গীর প্রয়োজন নেয়, নিসার সাথে কাটানো স্মৃতিগুলোই যথেষ্ট। নিসার স্মৃতিগুলো আঁকড়ে ধরে আবির বেঁচে আছে, আর বাকি দিনগুলো এইভাবেই কাটিয়ে দেবে অসুবিধা কি! আর যদি কখনো কাউকে ভালো লেগে যায়, তখন না হয় ভাবা যাবে এখন এইসব বন্ধ থাকুক।

আবির চলে যাবার আগে মায়ের উদ্দেশ্যে একটা কথা বলল,
– “আর একটা কথা, আমাকে সেকেন্ড বার বিয়ে নিয়ে কিছু বললে আমি এই বাড়ি ছাড়তে বাধ্য হবো।”

আবিরের মা আতকে উঠলেন, ছেলে এইসব কি বলে?

– “কোথায় যাবি তুই?”
– “বিদেশ চলে যাবো, আর ফিরব না।”

আবিরের মা আর সাহস করেননি ছেলেকে ঘাটানোর। ওনার ছেলেরা বড্ড জেদি, জেদের বশে কিছু একটা সিদ্ধান্ত নিলে সেটার পরির্বতন হয় না। উনি শেষবয়সে ছেলেদের ছেড়ে থাকতে চাননা, তাই চুপ করে গেলেন।

তারপর থেকে বাড়িতে আবিরের বিয়ে নিয়ে কোনরকমের কথা উঠেনি। এতে আবির আবরার দুজনেই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে।

প্রান নাজিয়া বুকে থাকতে থাকতেই ঘুমিয়ে পড়েছে। নাজিয়া ওকে শুইয়ে দিয়ে ফোনটা হাতে নিতেই শ্রেয়ার ফোন ঢুকল।

– “কেমন আছো?”
– “এইতো চলছে, তোমার।”
– “হুমম ভালো। বেবি কেমন আছে?”
– “ভালো।”
– “আবরার, আবিরদা, প্রান, মামনি সব কোথায়।”
– “আবরার অফিসে, আবির‌দা, মামনি রুমে আছে আর প্রান এইমাত্র ঘুমাল। তোমাদের পুঁচকে টা কেমন আছে কি করছে?”
– “ওর বাবার কাছে আছে। বাবা গো কি দুষ্টু হয়েছে কি বলব।”
– “বাচ্চারা একটু হয়।”
– “আমাদের প্রান কিন্তু গুড বয় বলো।”
– “হ্যাঁ, সে আর বলতে।”

নাজিয়া ও শ্রেয়া গল্প করতে লাগল। শ্রেয়া ও শান্তর ছেলে শাওন ৩বছরের। প্রচন্ড দুষ্টু, সারাটাদিন ওর পেছনেই ছুটতে ছুটতে শ্রেয়া শেষ।

দুজনে কথা বলার একটা পর্যায়ে শ্রেয়া বলল,
– “আজ একটু শপিং করতে গিয়েছিলাম, সেখানে হাসিবের সাথে দেখা হয়েছিল।”
– “ওহ্।”
– “জানো তোমার কথা জিজ্ঞেস করছিল, আমি বললাম তোমার মেয়ে হয়েছে তারপর ওহ কিছু না বলেই চলে গেল। কেসটা ঠিক বুঝলাম না।”
– “বাদ দাও তো। আচ্ছা হাসিব বিয়ে করেছে?”
– “না।ওকে বিয়ের কথা জিজ্ঞেস করতে ওহ হেসে বলল, ‘যাকে ভালোবেসে বিয়ে করতে চেয়েছিলাম সে অন্যকারোর ছিল তাই আর বিয়ে করা হয়নি।’ জানো কথাটা শুনে খুব অবাক হয়েছিলাম, ওর মতো ছেলেও কাউকে ভালোবেসেছে আর তারজন্য এখনো বিয়েও করেনি!”

নাজিয়ার অস্বস্তি হচ্ছে। শ্রেয়া কথাগুলো না বুঝলেও ওর কাছে কোনো কিছুই অস্পষ্ট নয়। হাসিব যে ওর কথাই বলেছে সেটা শিওর, নাজিয়ার ভীষন মায়া হলো মনে মনে ভাবল,
– “আমরা সবসময়ে ভুল জিনিসটাকেই আমাদের জীবনে বেছে নিই, তারজন্য আমাদের আজীবন আফসোস করতে হয়।”

কয়েকদিন অফিসে না যাবার জন্য আবরারের অনেক কাজ জমা হয়ে গিয়েছিল, সেইগুলো করতে গিয়ে ফিরতে অনেকটা রাত হয়ে গেছে। আবিরের মা নাজিয়াকে জোর করে খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছেন আর নিজে আবরারের জন্য অপেক্ষা করতে থাকেন।

সারাটাদিন খাটুনির পর বাড়ি ফিরে প্রিয় মানুষটার দেখা সকলেরই আশায় থাকে। আবরারও নাজিয়াকে আশা করছিল কিন্তু মাকে দেখে কিছুটা অবাক হলো।

– “মা তুমি?”
– “হুমম। নাজিয়ার এইসময়ে বেশি রাতজাগা ঠিক না, তাই ওকে খাইয়ে ঘুম দিয়ে দিয়েছি। তুই ফ্রেশ হয়ে আয়, একসাথে খাবো।”

আবরার কাজের চাপে একপ্রকার ভুলতেই বসেছিল নাজিয়া অসুস্থ। তাই তো দরজায় ওকে আশা করে বসেছিল। আবরার নিজের ঘরে ঢুকতে চোখটা আটকে গেল বিছানায়। দুইদিকে দুইজনকে নিয়ে নাজিয়া ঘুমাচ্ছে, আবরার মৃদু হাসল। জীবন সুন্দর।

#চলবে…

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে