এক আকাশ দূরত্ব পর্ব-৩১

0
554

#এক_আকাশ_দূরত্ব (৩১)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

রাত ১০টা। হঠাৎ করেই নাজিয়ার পেইন শুরু হয়, যন্ত্রনায় এদিক ওদিক করতে থাকে। আবরার ল্যাপটপে অফিসের কিছু কাজ করছিল, নাজিয়াকে উশখুশ করতে দেখে ওর কাছে গিয়ে দৌড়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল,

– “কি হয়েছে নাজু, ইউ ওকে?”

নাজিয়া কথা বলার মতো অবস্থায় নেই, যন্ত্রনায় চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। আবরারের হাতটাকে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে কোনমতে আটকে আটকে বলল,
– “আমার খুব কষ্ট হচ্ছে।”

আবরার ঢোক গিলল। নাজিয়ার এই অবস্থা দেখে নিজের কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। নিজেকে কোনোরকমে সামলে আবিরের নম্বরে কল দিল। আবির সবেমাত্র অফিস থেকে ফিরে বিছানায় গা এলিয়েছে, বাড়িতে থেকে আবরারের ফোন পেয়ে কিছুটা অবাক হলো। ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরতেই আবরার বলল,

– “দাদা তাড়াতাড়ি আমাদের ঘরে আয়, নাজিয়ার পেইন উঠেছে।”

আবির কোনরকমে বিছানা থেকে উঠে আবরারের ঘরের দিকে দৌড় দিল। নাজিয়া আবরারের হাতটাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে, আবির আবরারকে বলল,

– “আমি গাড়ি বার করছি, তুই নাজু’কে নিয়ে এখুনি আয়। আমাদের হসপিটালে যেতে হবে।”
– “হুমম।”

আবির যেতে গিয়েও কিছু একটা ভেবে দাঁড়িয়ে পড়ল। পেছন ফিরে আবরারকে বলল,
– “তুই উঠ, মাকে গিয়ে বল আমরা হসপিটালে যাবো। তারপর গাড়ি বার কর, আমি নাজু’কে নিয়ে যাচ্ছি।”

আবরার ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি জানাল। নাজিয়ার হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ঘরের বাইরে চলে গেল। আবির নাজিয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
– “আর একটু ধৈর্য ধর। আল্লাহ তায়ালা কে ডাক সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।”

নাজিয়া কিছু বলতে পারল না, চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। আবিরের সেই বীভৎস দিনের কথা মনে পড়ছে বারবার, বাচ্চা প্রসবের সময়েই নিসাকে হারিয়েছে। আবির নাজিয়াকে হারাতে চায় না, বারবার দোয়া করছে যাতে নাজিয়া ও বেবি দুজনেই সুস্থ থাকে।

আবরার এলোমেলো ভাবে মায়ের ঘরে ঢুকল। ওকে এইভাবে দেখে মা ও বাবা দুজনেই চমকে উঠলেন। মা আবরারের কাছে গিয়ে বলল,

– “আবরার বাবা কি হয়েছে? তোকে এইরকম লাগছে কেন!”

আবরার নিজের কান্না কোনোরকমে আটকে রেখে, মাকে জড়িয়ে ধরে বলল,
– “মা নাজিয়ার পেইন উঠেছে। আমরা হসপিটালে যাচ্ছি, দোয়া করো।”

আবরার আর কিছু বলতে পারল না, চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল। আবিরের মা আতকে উঠলেন, নাজিয়ার প্রেগন্যান্সি নিয়ে সবাই স্বাভাবিক ভাব করলেও নিসার ব্যাপারটার পর থেকে সবার কাছেই ওইটা একটা আতকের ব্যাপার। মনে মনে আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করেন বললেন,

– “আল্লাহ তুমি নাজিয়াকে সুস্থ রেখো। ওর কিছু হলে আমার আবরার শেষ হয়ে যাবে।”

আবিরের মা নাজিয়ার সাথে আবরারের বিয়ে হবার পর বুঝেছিলেন, ওরা একে অপরকে ঠিক কতটা ভালোবাসে। আবরার নাজিয়া একে অন্যকে ছাড়া অসম্পূর্ণ।

আবরার মা-বাবার কাছে দোয়া চেয়ে গাড়ি বের করতে চলে গেল। আবিরের মা নাজিয়ার ঘরের দিকে যাচ্ছিলেন কিন্তু তার আগেই আবির নাজিয়াকে নিয়ে চলে আসে। আবির যাবার আগে বলে,

– “মা আমরা গেলাম দোয়া করো। আর প্রানকে দেখে রেখো।”

রাতটা সকলের কাছেই আতঙ্কের। জায়নামাজে দাঁড়িয়ে সকলের একটাই দোয়া নাজিয়া ও বেবি দুজনেই যেন সুস্থ থাকে। আবির নিজেকে সামলে আবরারকে সামলাতে ব্যস্ত। ছেলেটা বড্ড ভেঙে পড়েছে।

রাত পেরিয়ে ভোর হলো। ফজরের আযান দিচ্ছে, তখন এক নার্স এসে বলল,
– “কনগ্রাচুলেশন, আপনাদের প্রেসেন্টের মেয়ে হয়েছে।”

আবরার বসা থেকে উঠে জিজ্ঞেস করল,
– “আমার ওয়াইফ কেমন আছেন?”
– “উনিও সুস্থ আছেন, চিন্তার কিছু নেয়।”

আবির ও আবরার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। আবির নিজের মা ও নাজিয়ার মাকে ফোন করে খুশির খবরটা জানিয়ে দিল। আবরার তখনও চুপচাপ বেঞ্চে বসে আছে, অনুভূতিটা’কে কিভাবে নেবে সেটাই বুঝতে পারছে না।

আবিরের খেয়াল হলো, ইসলাম ধর্ম অনুসারে সদ্য জন্মানো বাচ্চার কানে আযান দিতে হয়। আবির নার্সকে বলে বেবিকে নিয়ে আসতে বলল, তারপর ছোট সোনাটার কানে আযান দিয়ে আবরারের কোলে তুলে দিল।

– “মেয়েকে কোলে নিয়ে দ্যাখ, কেমন হয়েছে।”

আবরার কাঁপা হাতে ছোট পুতুলটাকে নিজের বুকে আঁকড়ে ধরল। ছোট ছোট হাত-পা, আবরার মেয়ের কপালে চুমু দিয়ে বলল,

– “মাকে অনেক কষ্ট দিয়েছ, আর দিও না কেমন। একদম গুড গার্ল হবে কিন্তু।”

আবির‌ ফিক করে হেসে দিল আবরারের বাচ্চা বাচ্চা কথায়। ছেলেটা এখনো বড়ো হলো না।আবরার মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে বসে রইল।আর‌ আবির চারিদিকে ছোটাছুটি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।

সকাল না হতে হতেই হসপিটালে সবাই হাজির। প্রান ঘুম থেকে ওঠা থেকে মাম্মামের কাছে যাবার বায়না করেই চলেছে, বাধ্য হয়েই ওকে সঙ্গে নিয়ে আসতে হয়েছে। সবাই নাজিয়ার মেয়েকে আদর করতে ব্যস্ত, তখন প্রান ব্যস্ত নাজিয়াকে নিয়ে। নাজিয়ার সারামুখে চুমু দিয়ে বলল,

– “মাম্মাম তুমি এখানে কেন? জানো আমি যখন তোমাকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না তখন কতটা ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।”
– “আমি এখানে তো একটা প্রিন্সেসকে আনতে এসেছি।”
– “প্রিন্সেস! কোন প্রিন্সেস মাম্মাম?”

নাজিয়া মুচকি হেসে ওর মায়ের কোল থেকে ছোট প্রিন্সেসকে নিয়ে বলল,
– “এই সেই প্রিন্সেস। লিটল প্রিন্সেস।”

প্রান চোখ গোল গোল করে তাকাল। ওর কাছে সদ্য জন্মানো বেবীটাকে পুতুলের মতো লাগল,
– “বেবি ডল।”

নাজিয়া হেসে দিল। ছেলের প্রিন্সেস নামটা পছন্দ হয়নি, তাই নিজেই নাম দিয়ে দিল বেবি ডল।

– “মাম্মাম আমাকে দাও না বেবি ডলকে।”
– “আচ্ছা তুমি বসো একটুও নড়াচড়া করবে না কিন্তু। আমি বোনকে দিচ্ছি।”

প্রান বুঝল না, তাই ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল,
– “বোন কে?”
– “এই তো বোন।”
– “নাহ এইটা আমার বেবিডল।”
– “আচ্ছা তাই বেবি ডল, এখন চুপ করে বসো‌ আমি কোলে দিচ্ছি।”

বেবিটাকে প্রানের কোলে দিতেই বেচারী কেঁদে উঠল। প্রানের মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে যায়, বেবি ডল এইরকম করল কেন?

– “মাম্মাম বেবি ডল আমার কোলে এসে কাঁদল কেন? ওর কি আমাকে ভালো লাগেনি!”
– “না বাবা সেইরকম কিছু না। ওহ ছোট তো তাই এইরকম কাঁদছে।”

প্রান মুখটা কালে করে বলল,
– “ওহ।”

যেহেতু নাজিয়ার নরমাল ডেলিভারি হয়েছে তাই ২দিন পরেই রিলিজ করে দিলো। নাজিয়ার মা ওকে নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন কিন্তু আবিরের‌ মা রাজি হননি। উনি ওনার নাতনী, বউমাকে ছেড়ে কিছুতেই থাকবেন না অগত্যা নাজিয়ার মা মেয়ের কাছে কিছুদিন থাকার সিদ্ধান্ত নেন।

নাজিয়া বিছানায় আধশোয়া হয়ে মেয়েকে ঘুম পাড়াচ্ছে, আর তার পাশে বসে প্রান ওদেরকে দেখছে।

– “কি দেখছ?”
– “দেখছি তুমি বেশি সুন্দর না বেবি ডল বেশি সুন্দর।”
– “তা কি দেখলে?”

প্রান কিছুক্ষণ ভাবার ভান করে বলল,
– “আমার মাম্মাম ইজ বেস্ট।”

নাজিয়া মুচকি হাসল, প্রানের মুখেও হাসি। সেইসময়ে আবির নাজিয়ার সাথে দেখা করতে এসেছিল, মূহুর্তটা দেখে থমকে দাঁড়াল। মা ও দুই সন্তানের সুন্দর মুহূর্তটা চোখ ভরে দেখল। নিসা বেঁচে থাকলে ওর জীবনটাও এইরকম সুন্দর সাজানো গোছানো হতো কিন্তু আফসোস তার কিছুই হয়নি।

প্রানের চোখ পড়ে আবিরের দিকে, বিছানা থেকে উঠে বাবা বলে দৌড়ে কোলে উঠে পড়ে। প্রান আবিরকে বাবা বলেই ডাকে, নাজিয়া ও আবরার প্রানকে নিজের সন্তানের মতো বড়ো করে তুললেও আবির কিংবা নিসাকে নিজেদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে চায়নি। তাই ছোট থেকে নাজিয়াকে মাম্মাম, আবরারকে পাপা, আবিরকে বাবা এবং নিসাকে মা বলতে শিখিয়েছি। ওরা কেউই চায়না, প্রান নিজের পরিচয় নিয়ে সংকোচে থাকুক। ওরও জানার অধিকার আছে ওর মা বাবা কে। যখন ক্লাসে ওকে কেউ ওর বাবা মা কথা জিজ্ঞেস করে উত্তরে ওহ বলে,
– “আমার বাবা আছে, মা নেই। কিন্তু আমার পাপা, মাম্মাম আছে।”

ছোট প্রান এখনো বোঝে না মা বাবা কাকে বলে, কাদের বলে।এখন নাজিয়া ও আবরারকে ছাড়া কিছুই বোঝে না কিন্তু যেদিন বড়ো হয়ে যাবে সেদিনও কি নাজিয়া ও আবরারের প্রতি একই ভালোবাসা থাকবে?

#চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে