#এক_আকাশ_দূরত্ব (৩০)
#তানজিলা_খাতুন_তানু
কয়েকদিন থেকে নাজিয়ার শরীরটা বড্ড খারাপ, কিছুই খেতে পারছে না, আর খেলেও বমি বমি লাগছে। প্রানকে স্কুলের জন্য রেডি করাতে করাতে নাজিয়ার বমি বমি ভাব লাগে দৌড়ে ওয়াশরুমে চলে যেতে প্রানও পেছন পেছন যায়।
– “মাম্মাম তোমার কি হয়েছে!”
নাজিয়া কিছু বলতে পারে না তার আগেই গড়গড় করে বমি করে দেয়। ৫বছরের প্রান প্রচন্ড ভয় পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে বাইরে চলে আসে।
আবিরের মা প্রানকে কাঁদতে কাঁদতে আসতে দেখে চিন্তিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
– “কি রে কাঁদছিস কেন?”
– “দিদুন মাম্মামের শরীর খারাপ বমি করছে তুমি তাড়াতাড়ি চলো।”
প্রানের কথা শুনে আবিরের মা দ্রুত নাজিয়ার ঘরে আসেন। বমি করার পর নাজিয়ার শরীর অনেকটা নেতিয়ে পড়েছে, উনি ওর চোখেমুখে পানি দিয়ে বিছানায় বসিয়ে দিলেন। অভিজ্ঞ চোখে কিছু একটা আন্দাজ করতে পারছে তবে নাতির সামনে কিছু বললেন না।
– “তুই বিছানায় শুয়ে রেস্ট নে, উঠার দরকার নেয় ওদিকটা আমি সামলে নেব।”
– “কিন্তু মামনি!”
– “কোনো কিন্তু না, চুপচাপ শুয়ে থাক।আর প্রান তুই তোর মাম্মামের কাছে থাক, দেখবি বিছানা থেকে না উঠে।”
প্রান ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। আবিরের মা ঘর থেকে চলে যেতে প্রান নাজিয়াকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেয়।
– “কি হয়েছে আমার প্রানের! কাঁদছ কেন?”
– “তোমার কষ্ট হচ্ছিল তাই না!”
– “না বাবা কিছু হয়নি। তুমি কান্না থামাও নাহলে কিন্তু মাম্মামের সত্যি সত্যি কষ্ট হবে এইবার।”
প্রান চটপট কান্না থামিয়ে চোখ মুছে বলল,
– “না আমি কান্না থামিয়েছি।”
নাজিয়া ছেলের কান্ডে ফিক করে হেসে ফেলল। প্রান শান্তশিষ্ট একটা বাচ্চা যদিও দুষ্টুমি করে তবে নাজিয়ার খুব বাধ্য ছেলে।
সন্ধ্যায় আবরার অফিস থেকে ফিরলে আবিরের মা বললেন,
– “কাল নাজিয়াকে নিয়ে একবার ডাক্তারের কাছে যাস তো।”
– “কেন? ওহ ঠিক আছে তো!”
– “হুমম, সেটা দেখার জন্যই যেতে বলেছি।”
আবরার ওনার কথা না শুনে দৌড়ে নিজের ঘরে ঢুকল। তখন নাজিয়া প্রানকে পড়াচ্ছে। নাজিয়াকে সুস্থ দেখে কিছুটা স্বস্তি পেল।
– “প্রান।”
প্রান দৌড়ে আবরারের কোলে উঠে যায়।
– “বাবাই।”
আবরার প্রানের গালে চুমু দিয়ে বলল,
– “একটু দিদুনের কাছে যাও তো সোনা, মাম্মামের সাথে আমার একটু দরকার আছে।”
প্রান বাধ্য ছেলের মতো ঘর ছাড়তে আবরার নাজিয়ার পাশে বসে বলল,
– “শরীর ঠিক আছে তো!”
– “হুমম।”
– “সত্যি করে বলো! মা কেন কাল ডক্টরের কাছে যেতে বলল?”
– “একটু বমি হয়েছে, হয়তো অ্যাসিডিটি হয়ে গিয়েছিল।”
আবরার কিছু না বলে নাজিয়াকে জড়িয়ে ধরল। বিয়ের ৫বছরে আবরারের ভালোবাসার কোনরকমের পরির্বতন হয়নি, উল্টে ভালোবাসা আরো বেড়েছে, পাগলামী বেড়েছে। এককথায় আবরার নাজিয়াকে এখনো চোখে হারায়।
পরেরদিন,
আবরার নাজিয়াকে নিয়ে একজন মহিলা ডক্টরের কাছে এসেছে। নাজিয়া আসতে চাইছিল না, শাশুড়িমা জোর করে পাঠিয়েছেন এমনকি কোন ডক্টরের কাছে যাবে এটা উনিই ঠিক করে দিয়েছেন।
নাজিয়া একাই ভেতরে ডক্টরের সাথে কথা বলছে, আবরারকে বাইরে বসতে বলা হয়েছে।নাজিয়া ডক্টরের কাছে গিয়ে নিজের সমস্যাগুলো বলার পর উনি জিজ্ঞেস করলেন,
– “আপনার পিরিয়ড নিয়মিত হচ্ছে?”
– “নাহ, কয়েকমাস একটু প্রবলেম হচ্ছে।”
– ” আপনাদের বিয়ে কতদিন হলো।”
– “৫বছর।”
ডক্টর কিছুটা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
– “বিয়ের এতবছর হয়ে গেছে আপনারা বেবি নেননি কেন?”
নাজিয়া উশখুশ করে বলল,
– “একচুয়ালী ডক্টর…
– “পার্সোনাল কিছু?”
– “না আসলে আমার বোন মারা যাবার পর তার ছেলেকে আমি মানুষ করতে শুরু করি। তার কেয়ারের জন্য আমরা বেবি নিইনি।”
ডক্টর কিছুটা চিন্তিত স্বরে বললেন,
– “তাহলে হয়তো আপনার জন্য বিষয়টা একটু রিস্কের আছে।”
– “কেন ডক্টর?”
– “আপনি প্রেগন্যান্ট।”
নাজিয়া চমকে উঠল। একটা মেয়ের প্রেগন্যান্সির খবরটা তার জন্য কতটা আনন্দের সেটা একমাত্র সেই জানে। নাজিয়ার মুখের এক্সপ্রেশন দেখে ডক্টর আর কিছুই বলতে পারল না, একজন মেয়ে হয়ে তার বুঝতে অসুবিধা হলো না নাজিয়ার অনুভূতিটা।
ডক্টর একজনকে বলল আবরারকে ভেতরে পাঠানোর জন্য। আবরার ভেতরে আসতে ডক্টর মৃদু হেসে বলল,
– “কনগ্রাচুলেশন মিস্টার। আপনি বাবা হতে চলেছেন।”
সেইম একই অনুভূতি আবরারেরও কিন্তু সেই ভয়ঙ্কর দিনের কথা মনে পড়তেই আবরার আঁতকে উঠল। নাজিয়ার হাসিমাখা মুখের দিকে তাকাতেই ওর বুকটা ধ্বক করে উঠছে। হাসিমাখা মুখটায় হঠাৎ অমাবস্যার ঘন কালো মেঘ দেখে ডক্টর কিছূটা অবাক হলেন,
– “কি হলো মিষ্টার! আপনি খুশি হননি?”
আবরার ঢোক গিলল, একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে চাইছে। ওহ কিছুতেই নাজিয়াকে হারাতে চাইনা।
– “ডক্টর আমরা বেবি চাই না।”
নাজিয়া ও ডক্টর দুজনেই চমকে উঠলেন। সদ্য পিতা হবার সংবাদ পেয়ে কোনো বাবা যে এইরকম সিদ্ধান্ত নিতে পারে এইটা ওনার ধারনার বাইরে ছিল। আবরারের প্রতি ওনার ক্ষোভের সৃষ্টি হলো।
– “আপনি এইসব কি বলছেন? ভেবে বলছেন তো!”
নাজিয়া এখনো শকের মধ্যে আছে, একটার পর একটা ধাক্কা সামলাতে কষ্টকর হয়ে উঠেছে। একটু আগে মা হবার খবর পেয়ে খত খুশি ছিল আর এখন আবরার এইসব কি বলছে!
আবরার নিজের জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
– “আমি ভেবেচিন্তেই বলছি।”
নাজিয়া ফুঁসে উঠল,
– “এই তুমি এইসব কি বলছো! আমাদের প্রথম সন্তান আসছে আর তুমি বলছো ওকে আমাদের চাইনা! পাগল হয়ে গেছো তুমি?”
– “হ্যাঁ পাগল হয়ে গেছি। একটা সন্তানের জন্য আমি ভাবির মতো তোমাকে হারাতে দিতে পারব না।দাদার মতো জীবন আমার চাই না। আমার তোমাকে চাই।”
নাজিয়া আর কিছু বলতে পারল না, ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। ডক্টর কিছুই বুঝতে পারছে না, একবার নাজিয়া আর একবার আবরারের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। আবরারের চোখের কোনে পানির উপস্থিতি জানান দিচ্ছে নাজিয়ার প্রতি ভালোবাসা ঠিক কতটা।
– “আপনারা প্লিজ শান্ত হন। অসুবিধা না থাকলে আমার সাথে সবটা শেয়ার করতে পারেন।”
আবরার কিছু বলল না। নাজিয়া কান্না থামিয়ে বলল,
– “আমার দিদি আর ওর দাদা হাসবেন্ড ওয়াইফ। ডেলিভারির সময়ে দিদি মারা যায়, সেই কারনে ওহ আমাকে বেবি নিতে দিতে চাই না।”
ডক্টর অবাক হলেন। এখনকার যুগে যেখানে বাচ্চা না হলে পরিবারের অশান্তি হয় সেখানে স্ত্রীর লাইফ রিস্ক আছে বলে বেবি নিতে চাইছে না, এইরকম ভালোবাসা পাওয়া সত্যি ভাগ্যের ব্যাপার।
– “দেখুন মিষ্টার জন্ম মৃত্যু বিধাতার হাতে লেখা। আপনি আপনার স্ত্রীর লাইফ রিস্কের জন্য বেবি নিতে চাইছেন না, বেবিটাকে ন’ষ্ট করে দিতে চাইছেন। বাবা হয়ে সন্তানকে শে’ষ করে দিতে আপনার কষ্ট হবে না!”
আবরার উত্তর না দিয়ে দুই হাত দিয়ে মুখ ঢেকে দিল। বাবা হবে শুনে কতটা খুশি হয়েছে সেটা কাউকে বোঝাতে পারবে না, কিন্তু ওহ নাজিয়ার লাইফ রিস্ক নিতে চাই না।
– “উপরওয়ালার উপর বিশ্বাস রাখুন সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে।বাড়ি যান, স্ত্রীর ঠিকমতো যত্ন নিন ইনশাআল্লাহ্ আপনার স্ত্রী সন্তান উভয়েই সুস্থ থাকবে।”
– “আসছি।”
আবরার নাজিয়াকে নিয়ে বেরিয়ে গেল। ডক্টর মনে মনে ওদের জন্য দোয়া করলেন, ওনার কাছে অনেক প্রেসেন্টই আসেন তবে আবরার ও নাজিয়ার মতো কাপল জীবনে খুবই কম দেখেছেন। ভালো থাকুক আবরার, নাজিয়া ও ওদের সন্তান।
আবরার নাজিয়াকে নিয়ে একটা ফাঁকা জায়গায় আসে। দুজন দুজনকে অনেককিছুই বলতে চাইছে কিন্তু অদৃশ্য দেয়াল বারবার আটকে দিচ্ছে। আবরার অনেকক্ষণ ধরে চেষ্টা করার পর সমস্ত দেয়াল সরিয়ে নাজিয়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। নাজিয়াও আঁকড়ে ধরল আবরারের শার্ট। বেশকিছুক্ষন সময় কেটে যাবার পর নাজিয়া নিজের ঘাড়ে পানির অস্তিত্ব অনুভব করল, বুঝতে অসুবিধা হলো না আবরার কাঁদছে।
– “সরি নাজিয়া। জানি তুমি আমার কথা শুনে কষ্ট পেয়েছে। জানো যখন শুনলাম আমি বাবা হবো, ঠিক কতটা খুশি হয়েছি বোঝাতে পারব না। কিন্তু যখনি সেই বীভৎস দিনের কথা মনে পড়ে যায় আমার সাহস হয়নি তোমাকে ওই অবস্থায় দেখার, তাই হুট করে ওই কথা বলে ফেলেছি প্লিজ আমাকে মাফ করে দাও। কথা দিচ্ছি আমি থাকতে তোমার আর আমাদের সন্তানের কিছু হবে না।”
আবরার ওর নিজের কথা রেখেছে। ৯টা মাস নাজিয়ার আদর যত্নের কোনো অভাব হয়নি। দুটো মা, দুটো বাবা, দাদা, স্বামী সবার আদর যত্নে আছে নাজিয়া ও নাজিয়ার অনাগত সন্তান। আবরার নাজিয়ার সামনে নিজেকে খুব শক্ত দেখায় কিন্তু ভেতরে ভেতরে প্রতিনিয়ত টেনশান করে চলেছে, উপরওয়ালার কাছে প্রতিনিয়ত নাজিয়া ও সন্তানের সুস্থতা কামনা করছে।
#চলবে…
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।