এক আকাশ দূরত্ব পর্ব-২৯

0
500

#এক_আকাশ_দূরত্ব (২৯)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

– “আপনি!”

হাসিব মৃদু হেসে ওদের দিকে আগিয়ে গেল। নাজিয়া ও শ্রেয়া একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করছে, হাসিবের আগমন কেউই আশা করেনি।

– “অবাক হলে‌ আমাকে দেখে! অবাক হবারই কথা, আসলে আমিই বিনা নেমন্তন্নে চলে এসেছি।”

বিনা নেমন্তন্নে‌ চলে এসেছে! নাজিয়া ও শ্রেয়ার বিস্ময়ে মাত্রা আরো কিছুটা বাড়ল, হাসিব এইখানে কেন এসেছে! আবার কিছু ঝামেলা করবে না তো!

ওদের মনোভাব বুঝতে পেরে‌ হাসিব মৃদু হেসে বলল,
– “ভয় পাবার কিছু নেই। একজনের কথাতে ভেতরের ভালো মানুষটাকে বদলে ফেলে আবার খারাপ মানুষ হয়ে উঠতে পারিনি।”

নাজিয়ার ঠোঁটের কোনে মৃদু হাসি ফুটে উঠল, শ্রেয়া অবাক চোখে হাসিবের দিকে তাকিয়ে আছে। হাসিব শ্রেয়ার হাতে গিফটের একটা প্যাকেট দিয়ে বলল,
– “আমার তরফ থেকে ছোট একটা উপহার, আর নতুন জীবনের শুভেচ্ছা রইল দোয়া করি ভালো থেকো।”

শ্রেয়া গিফটটা নিয়ে মৃদু হাসল। হাসিব নাজিয়ার হাতে একটা প্যাকেট দিয়ে বলল,
– “এটা তোমার জন্য, সুখে থেকো আজীবন।”

নাজিয়া হাসিবের দিকে তাকাল, দুজনের চোখাচোখি হলো। হাসিবের চোখে নাজিয়া স্পষ্ট কিছু দেখতে পাচ্ছে যেটা ওর জন্য নিষিদ্ধ। নাজিয়া তাড়াতাড়ি নিজের চোখটা সরিয়ে নিল, হাসিব ব্যথাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল,
– “আসছি ভালো থেকো।”

হাসিব চলে গেল।‌নাজিয়া ও শ্রেয়া অন্য গেস্টদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। হাসিব যাবার পথে পেছনে ফিরে নাজিয়ার হাসিমুখের দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলল,
– “তোমার হাসির কারন হতে চেয়েছিলাম কিন্তু পারিনি। তোমার দুঃখের কারন হয়ে নিজেকে অপরাধী বানাতে চাই না। আমার জীবন সবটুকু সুখ উপরওয়ালা তোমাকে দিক, ভালো থেকো নাজিয়া।”

—–

অবশেষে সেই ক্ষন। আবরার-নাজিয়া ও শান্ত -শ্রেয়া মুখোমুখি বসে আছে কিন্তু মাঝখানে চাদর টানা। দুই ছেলেই একেবারে ভদ্র হয়ে আছে, বউদের দেখার কোনরকমের চেষ্টা করছে না। শ্রেয়া একটু নার্ভাস হয়ে আছে সেইজন্য নাজিয়া ওর হাতটাকে শক্ত করে ধরে বসে আছে।

কাজিসাহেব প্রথমে শ্রেয়া ও শান্তর বিয়ে পড়াতে শুরু করলেন। শ্রেয়াকে কবুল বলতে বলার সময়ে বাঁধা হয়ে দাঁড়াল হেনা ও ওর‌ টিম।

– “শান্ত’দা আমাদের দাবি না মানলে শ্রেয়া’দি কবুল বলবে না।”

আবির ওদেরকে ধমক দিয়ে বলল,
– “এই এখন সর, আগে বিয়েটা মিটুক তারপর সব হিসাব নিকাশ করবি।”

ধমক খেয়ে হেনা ও ওর টিম মুখটাকে কাঁচুমাচু করে ফেলে, এখন বেশি বাড়াবাড়ি করতে যাওয়া মানেই বড়োদের কাছে ধমক খাওয়া তাই চুপ থাকাটাই শ্রেয়।

শান্ত ও শ্রেয়ার বিয়ে পড়ানোর পর, দ্বিতীয়বারের মতো নাজিয়া ও আবরারের বিয়ে পড়ানো হয়। অনেক ঝড় পেরিয়ে শান্ত ও শ্রেয়া একে অপরের সঙ্গে বেঁধে যায়, ভালো থাকুক ভালোবাসার।

বিয়ের সময়ে বড়ো অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিতে পেরে হেনার টিমের মাথায় আরো কিছু শয়তানি বুদ্ধি চলছে। অনুষ্ঠান শেষ হবার পর বাসর রাতের জন্য শ্রেয়া ও নাজিয়াকে নিজেদের ঘরে রেখে দিয়ে আসে। শান্ত নিজের ঘরের দিকে পা বাড়াতেই ওর উপর আক্রমন হয় হেনা ও ওর সঙ্গপাঙ্গদের।

– “জিজু এখুনি ২০হাজার টাকা দাও, নাহলে এইখানে দাঁড়িয়ে রাত কাটাও।”
– “দ্যাখো শ্যালিকারা আমি গরীব মানুষ এত টাকা কোথায় পাবো!”
– “নাটক কম করে তাড়াতাড়ি দিয়ে দে।”

কন্ঠস্বরের মালিককে দেখে সবার‌ চোখ কপালে। আবরার! শান্ত অবাক হয়ে বলল,
– “আবরার তুই?”
– “হ্যাঁ। তোর বউ আমার থেকে টাকা হাতিয়েছিল, এখন আমি তোর থেকে হাতাব।”
– “তুই না আমার বন্ধু! আর বন্ধু হয়ে এইরকম করবি?”
– “এখন আমি তোর শ্যালক। তাই আমাকে আমার প্রাপ্যটা বুঝিয়ে দে।”

শান্ত বুঝল এদের থেকে ছাড় পাওয়া কষ্টের বিষয়। কিন্তু এতগুলো টাকা ওর কাছে এখন নেয়।

– “এতোগুলো টাকা আমার কাছে নেই তো।”
– “তোর কার্ডটা আমার কাছে জমা দে, যখন টাকা দিবি তখন কার্ড পাবি।”

শান্ত ভাবল আবরার ওকে বাঁচানোর জন্য এইরকম করছে, তাই খুশিমনে কার্ডটা আবরারের হাতে দিয়ে দিল। আবরার শয়তানি হেসে বলল,
– “টাকা না দেওয়া পর্যন্ত কার্ড আমার, ওই তোরা ওকে ছেড়ে দে।”

শান্তকে ছেড়ে দিল কিন্তু আবরারকে কি আদৌও ছাড়বে!
হেনা কোমড়ে হাত দিয়ে বলল,
– “খবরদার আমাদের সাথে চালাকি করার চেষ্টা করবে না, ফলটা কিন্তু ভালো হবে না।”

আবরার ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে দরজা আটকে দিতেই ওদের টনক নড়ল।

– “এই আবরার’দা তো চলে গেল সবকিছু নিয়ে।না পেলাম শান্তদার টাকা আর না আবরার’দার টাকা।”

এতবড়ো ধোঁকাবাজী! হেনা রাগে গজগজ করতে করতে চলে যায়, বাকিরাও ভীষন ক্ষেপে গেছে আবরারের উপর। সুযোগ পেলে বেচারার খবর আছে।

আগামীকাল বৌভাতের অনুষ্ঠান, তারপরের দিন মেয়েরা নিজেদের বাপের বাড়ি ফিরবে আর বাকিরাও নিজেদের বাড়ি চলে যাবে।

শ্রেয়া শান্তকে সালাম করতে গেলে শান্ত সালাম করতে দেয়নি, কারন ইসলামে পা ছুঁয়ে সালাম করা নিষিদ্ধ। শ্রেয়াকে নিজের বুকে আগলে নিয়ে বলল,
– “স্ত্রীর স্থান স্বামীর হৃদয়ে। আর পা ছুঁয়ে সালাম করতে নেয় এইটা জানো না!”
– “হুমম ভুল হয়ে গেছে।”

শান্ত শ্রেয়ার কপালে ভালোবাসার চুম্বন দিয়ে বলল,
– “ভুলগুলো শুধরে নেবার দায়িত্ব নিলাম আমি, কথা দিলাম আমাদের মাঝে কখনো ভুল বোঝাবুঝি আসতে দেব না। সবসময়ে আগলে রাখব।”

শ্রেয়া শক্ত করে জড়িয়ে ধরল শান্তকে। অনেকটা লড়াই করার পর শান্তকে নিজের করে পেয়েছে, কখনোই হারাতে চায় না। শান্তও শ্রেয়াকে আগলে নিয়ে বলল,

– “তোমার সাথে মিশে যেতে চাই, দেবে কি সেই অধিকার।”

শ্রেয়ার সম্মতি পেয়ে শান্ত আর অপেক্ষা করল না। ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে দিতে থাকল ভালোবাসার মানুষটিকে। ভালো থাকুক শান্ত ও শ্রেয়া।

অন্যদিকে, বিয়ের শাড়ি, সাজগোজ পাল্টে সাধারন একটা সুতির শাড়ি পড়ে নাজিয়া বিছানায় বসে ঢুলছে। নাজিয়ার অবস্থা দেখে আবরারের চোখ কপালে, বউকে বউ সাজে দেখবে তা না বউ গিন্নি সাজে সজ্জিত হয়ে বসে আছে।

– “এই নাজু।”

নাজিয়া ধরফর করে সোজা হয়ে বসল। আবরারকে সামনে দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
– “ওহ তুমি আমি ভেবেছিলাম কে না কে।”
– “তোমার সাজের এই দশা কেন?”
– “প্রচুর কষ্ট লাগছিল। মনে হচ্ছিল দম ফেঁটে যাবে তাই চেঞ্জ করে নিয়েছি। ভালো করেছি না!”

আবরার মুখটা ফ্যাকাশে করে বলল,
– “হ্যাঁ খুব ভালো করেছো। কত শখ করেছিলাম বউকে বউ সাজে দেখব। আমার বউকে আমি ছাড়া সবাই দেখেছে।”

নাজিয়া এতক্ষনে আবরারের বিষয়টা বুঝল। মজা নেবার জন্য বলল,
– “বিয়েতে অনেক ছবি তুলেছি, ওইখান থেকে দেখে নিও।”

আবরার মুখটা কালো করে বলল,
– “বউও মজা নিচ্ছে, কি যুগ আসলো।”

নাজিয়া খিলখিল করে হেসে উঠল। আবরার নাজিয়ার হাসিমাখা মুখের দিকে তাকিয়ে তৃপ্তির হাসি দিল, মেয়েটার মুখে এইরকম হাসি আজীবন লেগে থাকুক।

নাজিয়া হাসি থামিয়ে ভ্রু কুঁচকে বলল,
– “কি দেখছ!”
– “আমার হ্যাপিনেসকে।”

নাজিয়া মৃদু হেসে আবরারের বুকে মাথা রাখল। আবরার পরম যত্নে নিজের প্রিয়তমাকে আগলে নিয়ে চুলে ঠোঁটের পরশ দিয়ে বলল,
– “ভালোবাসি।”

৭দিন পর,

বৌভাত, বাপের বাড়ি ঘুরে আসার পর নাজিয়া পুরোপুরি সংসারে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। প্রান আগের থেকে দূরন্ত হয়েছে, আবিরের মা নাতির সাথেই সারাটা দিন কাটান।

নাজিয়া রান্নাঘরে ছিল, তখনি শাশুড়ির কন্ঠস্বর শুনতে পেল,
– “এই নাজি দ্যাখ তোর ছেলে আমাকে মে’রে রাখছে না।”

নাজিয়া বসার ঘরে এসে দেখল প্রান আবিরের মায়ের চুলগুলো নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে খেলা করছে আর হাসছে। নাজিয়া তাড়াতাড়ি প্রানকে সরিয়ে আনলো, আবিরের মা প্রান ফিরে পেলেন।

– “বাবু দিদুন হয় তো এইরকম কেউ করে!”

প্রান কি বুঝল কে জানে, নাজিয়ার মুখে হাত বোলাতে বোলাতে হাসতে লাগল।

আবরার অফিস থেকে ফিরতে নাজিয়া পানি এগিয়ে দিল।

– “প্রান কোথায়?”
– “ঘুমাচ্ছে। জানো তোমার ছেলে আজ কি করেছে!”
– “কি করেছে?”
– “মামনির চুল ধরে মেরেছে। সাহস কত হয়েছে দেখছ।”

আবরার নাজিয়াকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে বলল,
– “মায়ের মতো গুন্ডা হয়েছে।”
– “এই আমি গুন্ডা।”
– “না তো আমার বউ গুন্ডা।”

নাজিয়া কিছু বলতে গিয়েও ফিক করে হেসে ফেলল। আবরারও মৃদু হেসে নাজিয়ার কাঁধে নাক ঘষলো।

#চলবে…

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে