এক আকাশ দূরত্ব পর্ব-২১

0
474

#এক_আকাশ_দূরত্ব (২১)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

– “মেয়েটার নাম ছিল শ্রেয়া। জানো খুব ভালো ছিল,কি সুন্দর ব্যবহার কিন্তু হঠাৎ করে কোথায় হারিয়ে গেল কে জানে।”

শম্পা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নাজিয়া বলল,
– “যোগাযোগ করার চেষ্টা করোনি?”
– “করেছিলাম কিন্তু পায়নি।”
– “ওহ্।”

তারপর শম্পা আর নাজিয়া দুজনেই নিজেদের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। নাজিয়ার একটা সাইনের দরকার ছিল, তাই হাসিবের কেবিনে টোকা মারল।

– “মে আই কাম ইন স্যার।”
– “হ্যাঁ নাজিয়া এসো, তোমার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।”
– “আমার জন্য! কিন্তু কেন?”
– “অফিস শেষে আমার সাথে একটু বের হতে পারবে?”
– “কেন স্যার?”
– “একচুয়ালী আমি তোমাকে কিছু কথা বলতে চাই।”

নাজিয়া কিছুক্ষন চুপ করে থাকার পর বলল,
– “ওকে স্যার।”
– “তাহলে সবাই অফিস থেকে চলে যাবার পর তুমি আর আমি বের হবো একসাথে।”
– “আচ্ছা।”

অফিস শেষে সবাই বেরিয়ে যায়। নাজিয়া কাজ আছে এই বাহানায় অফিসে হাসিবের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে, হাসিব কেবিন থেকে বেরিয়ে নাজিয়ার ডেস্কের কাছে এসে বলল,
– “চলো তাহলে।”
– “চলুন।”

গাড়িটা একটা বিলাসবহুল ফাইভস্টার হোটেলের সামনে থামল। হাসিব নাজিয়াকে নিয়ে ভেতরে গেল, নাজিয়া চারিদিকে ঘুরে ঘুরে দেখছে সেটা দেখে হাসিব বলল,
– “জায়গাটা পছন্দ হয়েছে?”
– “হুমম খুব সুন্দর জায়গা।”
– “আচ্ছা বলো কি খাবে।”
– “আপনি যা খাবেন তাই খাবো।”

হাসিব মৃদু কন্ঠে বলল,
– “তাহলে একটা ছোটখাটো হয়ে যাক!”

ওর কথার অর্থ নাজিয়া বুঝল না, তাই ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করল,
– “মানে?”
– “আরে মজা করে বললাম। খাবে নাকি মদ!”
– “ছিঃ এইসব আবার মানুষ খায় নাকি!”

হাসিব অভিজ্ঞ মানুষদের মতো করে বলল,
– “তাহলে কি আমি মানুষ না!”
– “না সেটা কেন হতে যাবেন? আমি তো বলেছি যারা মদ খায় তারা মানুষ না। এইসব আমার একদম পছন্দ না।”
– “আচ্ছা তাহলে আজ থেকে সব বাদ।”
– “কি!!”
– “আজ থেকে আমি আর কোনোরকমের নেশা করব না, প্রমিস।”

নাজিয়া চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে রইল‌ হাসিবের দিকে, ওহ কি ভুল কিছু শুনছে!

– “আপনি আমার কথা শুনবেন কেন?”
– “বিকজ আই লাভ ইউ।”

নাজিয়ার বিস্ময়ে মুখটা হাঁ হয়ে গেল।

– “স্যার আপনি এইসব কি বলছেন?”
– “স্যার না শুধু হাসিব, তোমার হাসিব।আমি সত্যি তোমাকে ভালোবাসি। তোমাকে দেখার পর থেকে আমি আর কোনো কিছুতে মন বসাতে পারছি না, নিজেকে কেমন পাগল পাগল লাগছে।”
– “স্যার আপনি এইসব কি বলছেন? আপনি অফিসের বস আর আমি সাধারন একজন কর্মচারী।”
– “ভালোবাসা কি স্ট্যাটাস দেখে হয়?”

নাজিয়া কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলল,
– “আমি ভেবে আপনাকে সিদ্ধান্ত জানাব, আজ আসি।”

হাসিবকে আর কিছু বলতে না দিয়ে নাজিয়া তড়িৎ বেগে উঠে চলে গেল। হাসিব একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
– “নাজিয়া আমাকে এক্সসেপ্ট করবে তো!”

নাজিয়া আড়ালে এসে প্রানভরে শ্বাস নিল। এতক্ষন মনে হচ্ছিল বাঘের ডেরায় বসে আছে, আর ক্ষুধার্ত বাঘকে বলছে আমাকে‌‌ খাবি! নাজিয়া হাসিবের কথাগুলো বিরবির করছিল আর মুখ ভেংচি কাটছিল তখনি পেছন থেকে ওকে কেউ জড়িয়ে ধরে, আচমকা এইরকম হওয়াতে প্রচন্ড রকমের ভয় পেয়ে চেঁচাতে যাচ্ছিল। আবরার নাজিয়ার মুখটা চেপে ধরে বলল,
– “আরে বউ আমি, আমাকে কি গনপিটুনি খাওয়াতে চাও নাকি!”

নাজিয়া কনুই দিয়ে আবরারের পেটে একটা ঘুষি দিয়ে বলল,
– “এইভাবে কেউ আচমকা ধরে! আমার তো এখুনি হার্ট এ্যাটাক হয়ে যেত।”
– “কিছু হতো নাহ, আমি আছি তো।”

নাজিয়া আবরারকে জড়িয়ে ধরল। আবরার নিজের স্ত্রীর চুলে ঠোঁট ছোঁয়ালো, আজ ৮দিন পর দুজনের দেখা হলো তাই একটু ইমোশনাল হয়ে পড়েছে দুজন।

– “এই ছাড়ো এইটা পাবলিক প্লেস।”
– “ছাড়তে ইচ্ছা করছে না তো।”
– “চলো বাড়ি চলো।”
– “হুমম চলো।”

নাজিয়া ও আবরার ফ্ল্যাটে আসে। গত একমাস ধরে ওরা এই ফ্ল্যাটেই আছে, ফ্ল্যাটটা শান্তর। দরজায় কলিং বেল বাজাতেই শ্রেয়া দরজা খুলে দিল।

নাজিয়া ভেতরে যেতে যেতে বলল,
– “প্রান কি করছে?”
– “এইমাত্র ঘুমাল। বাবা তোমার ছেলেকে সামলাতে আমাকে হিমশিম খেতে হচ্ছে।”

নাজিয়া মৃদু হাসল। শ্রেয়া ওকে আর আবরারকে পানি এগিয়ে দিল।

– “আবরার তুমি কখন আসলে?”
– “বউকে ছেড়ে আর কতদিন থাকব তাই চলে এসেছি।”

শ্রেয়া মলিন কন্ঠে বলল,
– “আমার কারনে তোমাদের কত কি সহ্য করতে হচ্ছে। সবকিছুর জন্য আমি দায়ী তাইনা।”

আবরার শ্রেয়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
– “ধূর পাগলি তোর জন্য আমাদের কিছুই সহ্য করতে হচ্ছে না। আর বোনের জন্য এইটুকু করতে না পারলে আমরা কিসের দাদা!”
– “নাজিয়া ওই লোকটার আশেপাশে থাকছে আমার খুড ভয় লাগছে, ওহ যদি নাজিয়ার কিছু ক্ষতি করে দেয় তো!”

আবরার মলিন হাসল, চিন্তা তো ওরও হচ্ছে কিন্তু কিছু করার নেয় হাসিবকে মাত দিতে হলে এইভাবেই দিতে হবে।

নাজিয়া শ্রেয়াকে আশ্বাস দিয়ে বলল,
– “চিন্তা করো না আমার কিছু হবে না। তুমি বরং শান্ত’দার রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করো, ছেলেটা কিন্তু এখনো তোমার উপরে অভিমান করে আছে।”
– “কি রাগ ভাঙাব, আমার সাথে তো‌ ঠিকমতো কথাই বলে না।”
– “রাগ অভিমান বেশি বাড়তে দিস না, সম্পর্কটা দূর্বল হয়ে পড়বে।”

শ্রেয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
– “চেষ্টা তো করছি কিন্তু শান্ত তো আমার সাথে কথাই বলছে না, কিভাবে কি করব!”
– “চেষ্টা করতে থাক, ঠিক হয়ে যাবে।”

নাজিয়া ফ্রেশ হয়ে প্রানকে জড়িয়ে শুয়ে পড়ল। এই সবকিছুর মাঝে ছোট প্রানকে সময় দিতে পারছে না, সারাদিন শ্রেয়ার কাছেই প্রান থাকে।

১মাস আগে বাড়ির সবাইকে অনেক কষ্টে বুঝিয়ে নাজিয়া এইখানে আসে। আবিরের মা কিছুতেই রাজি ছিলেন না, বাধ্য হয়ে নাজিয়া ওনাকে সবটা বলেন। উনি নাজিয়াকে এত বড়ো রিস্ক নিতে বারবার বারন করেন, কিন্তু সবকিছু ঠিক করা হয়ে গিয়েছিল ফেরার কোনো পথ নেয়। নাজিয়া ও শ্রেয়া শান্তর ফ্ল্যাটে থাকতে শুরু করে, নাজিয়া শান্তকে শর্ত দেয় ওহ যতদিন এই ফ্ল্যাটে থাকবে ততদিন শান্ত এইখানে আসতে পারবে না। শান্ত অবাক হয় এইরকম কথা শুনে, তারপর ভাবে হয়তো নাজিয়া ভয় পাচ্ছে তাই আর কথা বাড়ায় না রাজি হয়ে যায়।

আবরার প্রতি সপ্তাহে নাজিয়ার কাছে আসে, আবিরও মাঝেমধ্যে দেখা করে যায়। আর নাজিয়ার পেছনে একজন গার্ড সবসময়ে থাকে, সে সবকিছু আপডেট শান্তকে জানায়।প্ল্যানমতোই সবকিছু আগিয়ে চলেছে, দেখা যাক সামনে কি হয়।

আবরার ফ্রেশ হয়ে এসে দেখল নাজিয়া প্রানকে জড়িয়ে ধরে শুয়ে আছে। কি সুন্দর একটা মুহূর্ত, মা ছেলের ভালোবাসার দৃশ্য। আবরার দৃশ্যটা ক্যামেরাবন্ধি করে নেয়।

– “এই কি করছো তুমি?”
– “মা ছেলের সুন্দর মুহূর্তটা ক্যামেরাবন্ধি করে নিলাম।”
– “দেখি দাও।”

আবরার নিজের ফোনটা নাজিয়ার দিকে বাড়িয়ে দিল, নাজিয়া ছবিটাকে ভালো করে দেখতে লাগল।

– “কি সুন্দর হয়েছে, আমাকে পাঠিয়ে দাও তো ফোনের ওয়ালপেপার করব।”

আবরার মজা করে বলল,
– “আমার সবকিছুতেই প্রান ভাগ বসিয়ে দিচ্ছে।”

নাজিয়া চোখ পাকিয়ে বলল,
– “ওইটুকু একটা বাচ্চার সাথে হিংসুটেপনা করতে লজ্জা লাগে না!”
– “ছেলেকে হিংসা করব, এতটাও খারাপ বাবা আমি না।”

নাজিয়া হঠাৎ করেই আনমনা হয়ে গেল, নিসা থাকলে সবকিছু অন্যরকম হতো। হয়তোবা নাজিয়া আর আবরার এক হতো না, প্রান ওর‌ নিজের বাবা মায়ের কাছেই থাকত।

– “এই কি ভাবছ?”
– “দিদি থাকলে সবকিছু অন্যরকম হতো তাই না!”

আবরার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
– “হয়তো। তবে মনখারাপ করো না, যেটা হয় আমাদের ভালোর জন্যই হয়।”
– “হুমম।”

আবরার নাজিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলল,
– “এখন চুপ, আমি ঘুমাব বড্ড টার্য়াড।”

নাজিয়া মৃদু হেসে আবরারের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকল।

***
আজকে অফিসে নাজিয়া একটু ভয়ে ভয়েই এসেছে। হাসিবের মুখোমুখি হতে হবে, এবং উত্তরটা দিতে হবে। নাজিয়া তো ওর উত্তর বলবে, কিন্তু তারপর কি হবে?

ভয়টাকে সত্যি করে পিওন জানাল হাসিব নাজিয়াকে ডাকছে। নাজিয়া নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে হাসিবের কেবিনে গেল।

– “কেমন আছো?”
– “আলহামদুলিল্লাহ ভালো আপনি?”
– “আলহামদুলিল্লাহ। তা কালকের উত্তরটার কথা কিছু ভাবলে?”
– “আসলে স্যার….

#চলবে…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে