এক আকাশ দূরত্ব পর্ব-১৭

0
522

#এক_আকাশ_দূরত্ব (১৭)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

– “আমি সে’ক্সুয়াল হ্যারাস-মেন্টের শিকার।”

নাজিয়া চমকে উঠল, শ্রেয়া এইসব কি বলছে? শ্রেয়ার চোখ দিয়ে ক্রমাগত পানি গড়িয়ে পড়ছে, ঠিকমতো কথা বলতে পারছে না কান্নার কারনে।

– “কে করেছে এইসব? একটাবার তার নামটা বলো। তোমার বয়ফ্রেন্ড নয় তো?”

শ্রেয়া নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বলল,
– “শাহ শান্ত এইসবের কিছুই জানে না।”
– “তাহলে?”
– “আমার অফিসের বস।”

পড়াশোনা শেষ করার পর শ্রেয়া একটা কোম্পানিতে চাকরি করতে শুরু করে, প্রথম প্রথম পার্ট টাইম করলেও এখন ফুল-টাইম জব করে। আর বর্তমানে সেই অফিসেরই এমডির পার্সোনাল সেক্রেটারী হিসাবে জব করে।নাজিয়া কিছুই বুঝতে পারছে না, সবকিছু মাথার উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। অধৈর্য হয়ে শ্রেয়াকে জিজ্ঞেস করল,

– “শ্রেয়া’দি প্লিজ সবটা খুলে বলো।”
– “আমাদের যিনি এমডি স্যার উনি আমাকে পছন্দ করতেন, আমাকে প্রোপজও করছিলেন কিন্তু আমি সরাসরি না বলে দিই এমনিতেই আবরারের সাথে আমার বিয়ের কথাটা শোনার পর থেকে অস্থির ছিলাম শান্তর কথা বাড়িতে কিভাবে বলব সবকিছু নিয়ে ঝামেলার মধ্যে ছিলাম আর সেইদিন স্যার আবারো আমাকে প্রোপজ করেন এবং আমি না বলাতে অসভ্যতামি করার চেষ্টা করেন আমি নিজেকে সামলাতে না পেরে একটা থাপ্পর দিয়ে দিই আর সেইটাই আমার জীবনের সবথেকে বড়ো ভুল।”
– “ঠিক করছ থাপ্পর দিয়েছ, আমি হলে আরো দু -চারটে দিয়ে দিতাম।”
– “মারতে পারলে তো আমিও অনেক আগেই দিতাম। কিন্তু আমি যে নিরুপমা, ওই শয়তান গোপনে আমার কিছু ভিডিও করেছে।”

শ্রেয়া আবারো ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, নাজিয়ার মনে প্রশ্ন জাগল। ভিডিও! কিন্তু কিভাবে?

– “শ্রেয়া’দি শান্ত হও, প্লিজ।”

শ্রেয়া নিজের কান্না থামানোর পর নাজিয়া বলল,
– “তোমার অফিসের বস তোমার ভিডিও করেছে? কিন্তু কিভাবে?”
– “একদিন আমাদের অফিসে একটা পার্টির আয়োজন করা হয়, সেইখানে আমরা সবাই ঠিক করি অফিস শেষ করার, অফিসের ওয়াশরুমেই চেঞ্জ করে রেডি হয়ে নেব। আর সেইদিনই আমার চেঞ্জের ভিডিও করে নেয় শয়তানটা।”
– “এইসব কবে হয়েছে?”
– “অনেকদিন আগে কিন্তু আমি এখান থেকে যাবার পর জানতে পারি বিষয়টা। ওই শয়তানটা আমাকে ব্ল্যাকমেইল করছে যদি ওর কথা শুনে ওর সাথে রাত না কাটায় তাহলে আমার ভিডিওটা ভাইরাল করে দেবে।আমাকে কয়েকবার বাজে ভাবে স্পর্শ করেছে, আমি ওর ভয়েই অফিস বন্ধ করে দিয়েছিলাম কিন্তু তারপরেও আমার পিছু ছাড়ছে না, ফোন মেসেজ করে রুমডেট করার কথা বলছে। আমি সবকিছু সহ্য করতে না পেরে সুই’সাইড করার চেষ্টা করি।”

শ্রেয়ার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে, একজন মেয়ের কাছে তার সম্মানটাই আগে। সেইখানে এইভাবে হ্যারাস-মেন্টের শিকার হতে এলে তার মন- মানসিকতার কি অবস্থা হয় সেটা একমাত্র সেই জানে। প্রতিটা ক্ষন নিজের সাথে লড়াই করছে, নিজেকে বড্ড তুচ্ছ মনে হচ্ছে।

অন্যদিকে, সবটা শোনার পর নাজিয়ার রাগে মাথা ফেঁটে যাচ্ছে। একজন অফিসের মালিক যদি এইরকম কাজ করে তাহলে মহিলা কর্মী’রা কিভাবে কাজ করবে? এর একটা বিহিত করা দরকার।

– “শ্রেয়া’দি তুমি চিন্তা করো না, ওই শয়তানকে আমি উচিত শিক্ষা দেবোই।”
– “কিন্তু নাজিয়া তুমি কিভাবে লড়াই করবে ওই লোকটার সাথে? ওরা অনেক ধনী, সমাজ ওদের কেই বিশ্বাস করবে আমাদের মতো সাধারন মানুষকে কেউ পাত্তাই দেবে না।”

শ্রেয়ার কথাতে নাজিয়াও চিন্তিত হলো, সত্যি তো ওহ একজন সাধারন মেয়ে হয়ে কিভাবে এত ধনী একজন ব্যবসায়ীকে শাস্তি দেবে! আমাদের সমাজের বহু প্রভাবশালী মানুষ আছে, যারা অন্যায় করেও কোনোপ্রকার শাস্তি না পেয়েই রাজার হালে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখনো বহু জায়গায়, বহু ক্ষেত্রে নারীদের সে’ক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের শিকার হতে হয়। লড়াই ও ন্যায় চাইতে গেলেই হয় অকালে প্রা’ন হারাতে হয়, নাহয় আবারো নির্যাতিত হতে হয়।আমরা শুধুমাত্র মুখেই বলি আমরা উন্নত হয়েছি, সমাজ উন্নত হয়েছে। কিন্তু আদৌও কি সেইসব কিছু হয়েছে! বর্তমানে রাস্তা-ঘাট, অফিস-কলেজ কোথাও মেয়েরা সেফ না, সুযোগ পেলেই কিছু নোংরা মানসিকতার মানুষ ফায়দা লুটে নিতে চাই।

শ্রেয়া হতাশ কন্ঠে বলল,

– “নাজিয়া আমরা কখনোই ওদের সাথে পারব না, ওরা ধনী, অর্থ আছে। ওরা হাজার একটা অন্যায় করলেও কেউ কিছু বলতে পারবে না, কেউ কিছু বলতে গেলেই হয় প্রা’ন হারাবে না হয় টাকার নিচে ন্যায় চাপা পড়ে যাবে।”
– “আমি সবটা বুঝতে পারছি। কিন্তু ওই লোকটার কাছ থেকে ভিডিওটা ডিলিট করা জরুরি।”
– “কিন্তু কিভাবে করবে?”
– “তুমি চিন্তা করো না, আমরা ঠিক একটা না একটা ব্যবস্থা করেই ফেলব।”

শ্রেয়া হতাশার নিঃশ্বাস ফেলল, নাজিয়াকে বিশ্বাস করতে মন চাইছে কিন্তু মস্তিস্ক বলছে কিছু লাভ নেই।কি হবে? কিভাবে ভিডিওটা ডিলিট করাবে? কিভাবেই বা শ্রেয়া আবারো স্বাভাবিক জীবনে ফিরবে?

নাজিয়া চলে যাবে বলে পা বাড়াচ্ছিল হঠাৎ একটা কথা মধে পড়ে যাওয়াতে দাঁড়িয়ে পড়ে বলল,
– “শ্রেয়া’দি শান্ত’দা কি সবটা জানে?”
– “নাহ। আমি চাই না আমার অভিশপ্ত জীবনের সাথে ওর জীবনটা জুড়ে যাক তাই ওকে সব জায়গা থেকে ব্লক দিয়েছি আর সম্পর্কটাও শেষ করে দিয়েছি।”

শ্রেয়া কথাগুলো শান্ত গলাতে বললেও কথাগুলোর মধ্যে অনেক চাঁপা কষ্ট লুকিয়ে আছে। নিজের জীবনটা এলোমেলো হয়ে গেছে বলে ভালোবাসার মানুষটির হাতটাই ছেড়ে দিচ্ছে এইটা কি কম বড়ো ত্যাগ!

– “পাগল হয়ে গেছ তুমি? শুধুমাত্র ওই কারনে সম্পর্ক শেষ করে দিয়েছ?”
– “তো কি করব? আমি ভালো করেই বুঝে গেছি ওই লোকটা আমাকে বাঁচতে দেবে না, এক আমাকে যেভাবেই হোক ভোগ করবে আর না হলে দুনিয়া থেকেই আমার নামটা মুছে দেবে। এই পরিস্থিতিতে আমি কিভাবে একটা সহজ সাধারন ছেলেকে নিজের জীবনের সাথে জড়িয়ে ছেলেটার জীবনটাকে শেষ করে দেব?”
– “শ্রেয়া’দি আবেগ দিয়ে বিচার করো না, এমনও তো হতে পারে সবটা শোনার পর সে তোমাকে হেল্প করছে?”
– “আমি কিভাবে শান্তকে কথাগুলো বলব বলতে পারো! সেইদিনের পর থেকে ওর সাথে কথা বলতে আমার লজ্জা লাগছে, নিজেকে বড্ড ছোট ছোট লাগছে। তাই সম্পর্কটা শেষ করে দিয়েছি।”

শ্রেয়ার চোখ দিয়ে পানি গড়িয়েই চলেছে। একদিকে নিজের ওহ নিজের পরিবারের মানসম্মান আর অন্যদিকে নিজের ভালোবাসা সবকিছু নিয়ে ডিপ্রশনে চলে যাচ্ছে শ্রেয়া আর তার ফলশ্রুতি সুই’সাইড করার চেষ্টা।

নাজিয়া কি বলে শ্রেয়াকে শান্তনা দেবে বুঝতে পারল না, শ্রেয়াকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। সবকিছু শোনার পর ওর নিজেরই অসহায় লাগছে, কিভাবে কি করবে সেটাই বুঝতে পারছে না আর সেখানে সবকিছুর শিকার হয়ে শ্রেয়ার কি অবস্থা!

আত্মহত্যা মানুষ এমনি এমনি করে নাহ, যখন সবকিছু হাতের বাইরে চলে যায়। দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায়, অসহায়ত্ব ঘিরে ধরে তখনই মানুষ আ’ত্মহ’ত্যা’কে বেছে নেয়। তবুও বলব, আ’ত্মহ’ত্যা কখনোই কোনো কিছুর সমাধান হতে পারে না।লড়াই করে বেঁচে থাকার নামই হলো জীবন, প্রতিটা মূহুর্তে লড়াই করতে হবে, সামনে এগিয়ে যেতে হবে।

নাজিয়া কি পারবে শ্রেয়াকে সঠিক বিচার পাইয়ে দিতে? অন্যায়-কারীকে শাস্তি দিতে!

#চলবে…

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে