#এক_আকাশ_দূরত্ব (১৬)
#তানজিলা_খাতুন_তানু
শ্রেয়ার সুই-সাইড করার খবর তড়িৎ গতিতে ছড়িয়ে পড়ল। মেয়েটা হঠাৎ করেই এইরকম সিদ্ধান্ত কেন নিয়েছে, সেটাই কেউ বুঝতে পারছে না।
আবির ও আবরার খবর পাওয়া মাত্রই রওনা দিয়েছে, নাজিয়াও যেতে চাইছিল কিন্তু প্রানকে নিয়ে এতটা পথ জার্নি করা সম্ভব না তাই যেতে পারেনি। আবিরের মা কান্নাকাটি করছেন, উনি শ্রেয়াকে নিজের মতো ভালোবাসেন তার এইরকম কথা শুনে প্রচন্ড ভেঙে পড়েছেন। নাজিয়া ওনাকে সামলাচ্ছে।
আবির ও আবরার শ্রেয়ার বাবা-ভাইয়ের সাথে কথা বলে জানতে পারল কিছুদিন থেকেই শ্রেয়ার মন খারাপ ছিল, সারাদিন মনমরা করে বসে থাকত কেউ কিছু জিজ্ঞেস করলে কিছুই বলত না।কাল রাত্রিরে কিছু না খেয়েই নিজের ঘরে দরজা আটকে দিয়েছিল, পাশেই ওর ছোটভাইয়ের রুম। সে ঘর থেকে চাঁপা কান্নার আওয়াজ শুনতে পাই সাথে কিছু একটা পড়ে যাবার আওয়াজ পেয়ে শ্রেয়ার ঘরের দরজায় টোকা মারে। অনেকক্ষণ হয়ে যাবার পরেও দরজা না খুললে সন্দেহ হয়, বাবা মাকে ডেকে দরজা ভাঙার পর দেখা যায় শ্রেয়া ঘুমের ওষুধ সাথে আরো অনেককিছুর ট্যাবলেট খেয়ে সুইসাইড করার চেষ্টা করেছে। তড়িঘড়ি করে হসপিটালে ভর্তি করানো হয়, ডাক্তাররা ওয়াশ করে ওষুধ গুলো বার করে দিয়েছে এখন শ্রেয়া কিছুটা স্বাভাবিক।
শ্রেয়ার জ্ঞান ফিরেছে। আবরার ওর সাথে একা দেখা করতে চাই, সব কথা শুনে ও আন্দাজ করতে পারছে কেন শ্রেয়া এই কাজটা করেছে।
আবরার শ্রেয়ার পাশে বসে বলল,
– “শ্রেয়া।”
শ্রেয়া কোনো উত্তর দিলো না, আবরার শ্রেয়ার কপালে হাত বুলিয়ে বলল,
– “কিরে কথা বলবি না আমার সাথে?” আচ্ছা তুই এতবড়ো সিদ্ধান্ত কিভাবে নিলি বল তো? একটাবার নিজের পরিবারের কথা চিন্তা করলি না।”
শ্রেয়া ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। আবরার শ্রেয়ার মাথাতে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল,
– “সুই-সাইড করতে গিয়েছিলিস! জানিস না আত্মহ’ত্যা মহা পা-প।”
– “তো কি করতাম আমি!”
শ্রেয়া কেঁদে উঠল। নিজের মনের কষ্টগুলোকে নিজের মধ্যে রাখতে রাখতে হাঁপিয়ে উঠেছে, আর পারছে না।
– “শ্রেয়া কি হয়েছে বোন আমার সবকিছু আমাকে বল।”
শ্রেয়া নিজেকে সামলে নিল, চোখের পানিটা মুছে নিয়ে বলল,
– “আমার কিছু হয়নি আমি ঠিক আছি। তুমি যাও।”
তারপরেও আবরার শ্রেয়াকে কয়েকবার জিজ্ঞেস করল কিন্তু ওহ উত্তর দিল না। আবরার ব্যর্থ হয়ে ফিরে গেল। কেবিনের বাইরে আসতেই আবির জিজ্ঞেস করল,
– “কিরে কিছু জানতে পারলি?”
আবরার ঘাড় নাড়িয়ে না বলল, আবির হতাশা হল। পরক্ষনেই কিছু একটা মনে পরতেই বলল,
– “একজনই পারবে শ্রেয়ার কাছ থেকে সত্যিটা জানতে।”
– “কে?”
– “নাজিয়া।”
– “কিন্তু ওহ কিভাবে আসবে?”
– “সেইসব চিন্তা তুই করিস না, আমি সবটা দেখছি।”
আবির কথাটা বলে চলে গেল, আবরার নাজিয়াকে ফোন করে এদিকের খবর দিল। বাড়িতে সবাই চিন্তা করছিল শ্রেয়াকে নিয়ে, শ্রেয়া ঠিক আছে এইটা জানার পর সবাই স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
– “মামনি শ্রেয়ার জ্ঞান ফিরেছে, এখন ওহ ঠিক আছে।”
– “যাক আলহামদুলিল্লাহ ভালো। কিন্তু মেয়েটা হঠাৎ করে এইরকম করল কেন বলত?”
– “জানি না, কিছুই বুঝতে পারছি না।”
সবার মনেই একটা প্রশ্ন শ্রেয়া ঠিক কি কারনে এতবড়ো একটা সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছিল?
—-
আবির ওর মামাকে বুঝিয়ে শ্রেয়াকে ওদের বাড়িতে নিয়ে যাবার জন্য রাজি করিয়েছে। যদিও এইটার জন্য ওকে কম কাঠ-খড় পোড়াতে হয়নি, শ্রেয়ার বাবা এই অবস্থায় মেয়েকে অন্য কোথাও পাঠাতে রাজি নয় আর আবিরও কিছুতেই ছাড়বে না। ওহ শ্রেয়াকে নিয়ে তবেই যাবে, এই সময়ে শ্রেয়াকে একা থাকতে দেওয়া মানেই বিপদ। আর তার থেকেও বড়ো কথা, শ্রেয়ার হঠাৎ এইরকম কাজের কারন কি সেইটা জানতে হবে।
৩দিন পর,
আজ আবির ও আবরার শ্রেয়াকে নিয়ে ওদের বাড়িতে ফিরছে। শ্রেয়ার বোন আসার কথা ছিল কিন্তু ওর পরীক্ষা তাই আসতে পারেনি শ্রেয়া একাই যাচ্ছে।
শ্রেয়া আগের থেকে একদম চুপচাপ হয়ে গেছে, কারোর সাথেই কথা বলছে না। আবির আর আবরার ওকে হাসানোর অনেক চেষ্টা করে চলেছে, কিন্তু ওহ হাসছে না। ‘যার মনেই সুখ নেই তার মুখে কি হাসি আসে?’
শ্রেয়াকে দেখা মাত্রই আবিরের মা আদরে আদরে ভরিয়ে দিলেন, মেয়েটা সবেমাত্র মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে এটা কি কম বড়ো কথা।
– “শ্রেয়া মা তুই ঠিক আছিস তো?”
শ্রেয়া মেকি হেসে বলল,
– “চলছে।”
নাজিয়া দাঁড়িয়ে শ্রেয়াকে পর্যবেক্ষণ করে চলেছে, মেয়েটার মুখে সেই আগের মতো চাঞ্চল্যতা, লাবন্য কোনটাই নেয়। কিরকম একটা শুকিয়ে গেছে, কিন্তু কেন?
শ্রেয়াকে রেস্ট নিতে বলে নাজিয়া নিজেদের ঘরে আসতেই আবরার পেছন দিক থেকে ওকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে নাক ঘষলো।
– “ছাড়ো, ফ্রেশ হবে তো।”
– “হবো, কিন্তু আগে মাইন্ড ফ্রেশ করি।”
– “এইভাবে কে মাইন্ড ফ্রেশ করে?”
– “আমি করি। কারন তুমি আমার মানসিক শান্তি, তোমাকে জড়িয়ে ধরলে যে পরিমান শান্তি লাগে আর অন্য কিছুতে লাগে না। (নাজিয়ার কাধে হালকা দাঁত বসিয়ে বলল, ‘বুঝলে বউ।”
– “আহ্, লাগল তো।”
আবরার শয়তানি হেসে বলল,
– “এতেই লাগছে!!”
– “দিনকে দিন শয়তান হয়ে যাচ্ছো। যাও ফ্রেশ হমে আসো, আমি খাবারের ব্যবস্থা করি।”
– “শ্রেয়া কোথায়?”
– “রুমে আছে।”
– “ওর দিকে একটু খেয়াল রেখ, আর তোমাকেই কিন্তু ওর মুখ থেকে সত্যিটা জানতে হবে।”
– “কিন্তু আমি কি পারব!”
– “পারতে তোমাকে হবেই।একটা মানুষের কথাবার্তা, ব্যবহার দিয়ে অন্য মানুষের ভেতরকার সবকিছুই জানা যায়, তুমি ওরসাথে আগের মতো বন্ধুর মতো মেশো দেখবে ওহ ঠিক বলবে।”
– “শ্রেয়া ‘দি আগের থেকে বদলে গেছে।”
– “হুমম, সময় ও পরিস্থিতি মানুষকে বদলে দেয়।”
– “হুম।”
—
আজ শ্রেয়ার এই বাড়িতে আসার দুইদিন, নাজিয়া সবসময়ে ওর কাছে কাছেই থাকে। গল্প করে কিন্তু এইসব বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতে পারে না, মেয়েটা আবারো যদি ডিপ্রেশনে চলে গিয়ে কিছু করে ফেলে তো তখন হিতে-বিপরীত হয়ে যাবে। কিন্তু আর কতদিনই বা এইভাবে চলবে? নাজিয়া ঠিক করল আজকে যেভাবেই হোক শ্রেয়ার কাছ থেকে সত্যিটা জানবে।
নাজিয়া শ্রেয়ার রুমের দরজায় নক করল, শ্রেয়া বারান্দায় বসে আপন-মনে কি ভেবে চলেছে। দরজায় টোকা মারার শব্দ ওর কান পর্যন্ত পৌঁছায়নি।নাজিয়া দরজাটা ঠেল দিয়ে দেখল খোলা আছে, ধীর পায়ে ভেতরে ঢুকে দেখল শ্রেয়া বারান্দায় বসে আছে। নাজিয়া শ্রেয়ার পাশে বসে বলল,
– “শ্রেয়া ‘দি।”
আচমকা ডাকে শ্রেয়া থতমত খেয়ে যায়, পাশে তাকিয়ে দেখল নাজিয়া বসে আছে ওর পাশে।
শ্রেয়া মেকি হেসে বলল,
– “তুমি কখন আসলে?”
নাজিয়া শ্রেয়ার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে উল্টে প্রশ্ন করল, – “কাঁদছ কেন?”
শ্রেয়া নিজের চোখে হাত দিয়ে দেখল পানি, পুরানো কথাগুলো ভাবতে ভাবতে কখন যে চোখের কোনে পানি জমা হয়েছে সেটা বুঝতে পারেনি। চোখটা ভালো করে মুছে নিয়ে বলল,
– “কই কাঁদি’নি তো। অনেকক্ষণ এইদিকে তাকিয়ে ছিলাম তাই হয়তো।”
– “আমার কাছে মিথ্যা বলে লাভ নেই, আযি জানি তোমার বড়ো কিছু একটা হয়েছে, নাহলে এতবড়ো একটা সিদ্ধান্ত তুমি নিতে না।”
শ্রেয়া চুপ করে আছে। নাজিয়া আবারো বলতে শুরু করল,
– “শ্রেয়া ‘দি নিজের মনের কথাগুলো, কষ্টগুলো আমার সাথে শেয়ার করো দেখবে হালকা লাগবে।”
শ্রেয়া ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে নাজিয়াকে জড়িয়ে ধরল। শ্রেয়া কেঁদেই চলেছে নাজিয়া ওকে শান্তনা দিচ্ছে নানান ভাবে,
– “শ্রেয়া’দি বলো কে কি বলেছে, কি হয়েছে কেন তুমি সুই-সাইড করার মতো এতটা নিকৃ’ষ্ট কাজের সিদ্ধান্ত নিলে? বলো আমাকে…
শ্রেয়া ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে বলল,
– “আমি সে’ক্সুয়াল হ্যারাস-মেন্টের শিকার।”
#চলবে…..
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।