এক আকাশ দূরত্ব পর্ব-১০

0
546

#এক_আকাশ_দূরত্ব (১০)
#তানজিলা_খাতুন_তানু

আজকে শ্রেয়া আবিরদের বাড়িতে আসব, কেন হঠাৎ করেই ডেকে পাঠানো হয়েছে সেটা শ্রেয়ার অজানা। মামনি কথামতো চলে এসেছে।

– ‘আসসালামু আলাইকুম মামনি, কেমন আছো?’
– ‘ওমা আলাইকুমুস সালাম। আর ভালো! তুই কেমন আছিস?’
– ‘কেন! কি হয়েছে?’
– ‘তোকে পরীক্ষা দিতে হবে।’

শ্রেয়ার ভ্রু কুঁচকে গেল। ওকে আবার কি পরীক্ষা দিতে হবে!

– ‘কি পরীক্ষা!’
– ‘এই বাড়ির যোগ্য বউ হবার পরীক্ষা।’
– ‘কিন্তু আমি তো এখনো এই বাড়ির বউ হয়নি!’
– ‘তার জন্যই তো পরীক্ষা দিতে হবে।’
– ‘মানে?’

শ্রেয়ার সবকিছু মাথার উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে। আবিরের মা সবকিছু বুঝিয়ে বলতে শ্রেয়ার মাথায় হাত, একটা বাচ্চাকে কীভাবে সামলাবে ওহ! তার উপর আবার এই সংসার! ওর এখন মনে হচ্ছে এখানে না আসলেই বরং ভালো হতো।

– ‘দ্যাখ শ্রেয়া তোকে সবকিছু পারতেই হবে, আমার মানসম্মানের প্রশ্ন এইটা। তুই পারবি তো মা!’

মামনির মুখের দিকে তাকিয়ে শ্রেয়া আর কিছু বলতে পারল না, ঘাড় নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে দিল। কিন্তু মনে মনে ভয়েই শেষ, যে মেয়ে কুটোটি নাড়ে না সে কিভাবে একটা সংসারের দায়িত্ব নেবে!

অনেক মেয়েই থাকে যারা বিয়ের আগে সংসারের কোনো কাজ করে না, কিন্তু বিয়ের পর গুছিয়ে সংসার করে। তখন নিজের সংসার, নিজেকেই করতে হবে কিছুই করার থাকে না। সেখানে দাঁড়িয়ে শ্রেয়া একজন অবিবাহিত মেয়ে, এই সংসারটাও ওর নিজের নয় ওহ কি পারবে সবকিছু গুছিয়ে নিতে!

—-

আবিরের মা প্রান’এর ব্যাপারে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়েছে শ্রেয়াকে। নাতির দায়িত্ব শ্রেয়ার উপরে দিয়ে উনি কিছুটা স্বস্তি পেয়েছেন, বয়সকালে এত ধকল নেওয়া যায় নাকি!

শ্রেয়া প্রান’কে দুধ খাওয়াতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে। ওহ কিছুতেই খেতে চাইছে না, খালি কান্না করে দিচ্ছে।

– ‘দূর এইভাবে হয় নাকি! কি করবো আমি? মামনিকে ডাকব! তাই ডাকি না হলে একে খাওয়াব কিভাবে?

শ্রেয়া আবিরের মাকে ডেকে আনেন প্রানকে খাওয়ানোর জন্য। প্রথম প্রথম এইরকম হতেই পারে ভেবে আবিরের মা কিছু বললেন না, শ্রেয়াকে দেখিয়ে দিলেন কিভাবে খাওয়াতে হয়।

অন্যদিকে…

আজ নাজিয়ার পরীক্ষা শেষ হয়ে গেছে। অদ্ভুত ভাবে প্রতিটা পরীক্ষা দিনই সেই টোটো ওয়ালা’টা ওর জন্য রাস্তায় অপেক্ষা করত, বিষয়টা প্রথম দুইদিন কাকতালীয় ভাবে নিলেও পরে নাজিয়া র মনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। আর সেই সন্দেহের বশেই লোকটিকে চেপে ধরতেই নাজিয়া আসল সত্যিটা জানতে পারে।

– ‘এই আপনি সত্যি করে বলুন তো, আপনাকে রোজ কে আসতে বলে?’
– ‘আরে ম্যাডাম আমাকে কে বলবে, আমি তো রোজ এই রাস্তা দিয়েই যায় আর আপনাকে নিয়ে যায়।’
– ‘দেখুন আমার সাথে মিথ্যা বলার চেষ্টা করবেন নাহ আপনি যদি সত্যি এই রাস্তা দিয়ে রোজ যাতায়ত করতেন তাহলে আমি বাদে অন্য কাউকে টোটোতে তুলতেন কিন্তু না আপনি প্রতিদিন শুধুমাত্র আমাকেই নিয়ে যান সত্যি বলুন? সত্যি না বললে আপনার নামে পুলিশ কেস করবো আমি।’

অনেক ভয় দেখানোর পর লোকটি মুখ খোলে,
– ‘আসলে ম্যাডাম একটা স্যার আমাকে টাকা দিয়ে বলেছে আপনাকে প্রতিদিন ঠিকমতো পৌঁছে দিতে। তাই ..

নাজিয়ার ভ্রু কুঁচকে যায়। কোন ছেলে কাজটা করেছে ভাবতেই প্রথমেই আবরারের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠে। নিজের মোবাইল ঘেঁটে আবরারের একটা ছবি লোকটির সামনে ধরে বলল,
– ‘এই কি সে?’
– ‘হুম।’

নাজিয়ার কাছে সবকিছু স্পস্ট হয়ে যায়। রাগে ফোঁসফোঁস করতে করতে হোস্টেলে ফিরে এসে আবরারকে কল লাগায়। দুই-বার রিং হবার পরেও আবরার কলটা রিসিভ করেনা দেখে নাজিয়ার রাগটা আরো বেড়ে যায়। কিছুক্ষন পর, আবরার ঘুরিয়েকল করে। নাজিয়া কলটা রিসিভ করেই চেঁচিয়ে উঠে,

– ‘এই আপনি আমাকে কি পেয়েছেন বলুন তো?’

আচমকা আক্রমনে আবরার হকচকিয়ে যায়। ফোন কানে নিয়ে এই কথা কেউ আশা করে না, তাও আবার প্রিয় মানুষটার কাছ থেকে। কোথায় বলবে ভালো আছেন! তাই না চেঁচামেচি করছে! আবরারের এই মুহূর্তে নিজেকেই সবথেকে অসহায় মনে হলো, এহ কাকে ভালোবাসল!!

– ‘কি হলো চুপ করে আছেন কেন? আপনি কি আমাকে একটু শান্তিতে থাকতে দেবেন না নাকি?’
– ‘আরে এতো চেঁচামেচি করছ কেন? আমি কি করেছি!’
– ‘আপধি কেন আমার যাতায়তের জন্য গাড়ি ঠিক করে দিয়েছেন? আমি কি আপনাকে বলেছি একবারো!’
– ‘কিছু কথা বলতে হয় না, নিজ থেকেই করে দিতে হয়।’
– ‘দেখুন আপনি কিন্তু আপনার লিমিট ক্রস করছেন। আপনার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই, আগে তবুও ছিলেন দিদির দেবর কিন্তু সেই সম্পর্কটাও আজ মৃত। তাই আমার বিষয়ে নাক গলানোর চেষ্টা করবেন না।’
– ‘নাজু প্লিজ আমাকে বোঝার চেষ্টা করো, আমি তোমাকে…

নাজিয়া আবরারকে পুরো কথাটা বলতে না দিয়ে বলল,
– ‘আমার ধৈর্যের পরীক্ষা নেবেন না মিস্টার আবরার আহমেদ, অনেক সহ্য করেছি কিন্তু আর নয়। আমার ব্যাপারে আপনাকে ভাবতে হবে না, আমি আমার জন্য যথেষ্ট। রাখছি, যোগাযোগ করার চেষ্টাও করবেন না।’

নাজিয়া কল কেটে দিতে আবরারকে ব্লক করে দেয়। এই দূরত্ব কি আদৌও মিটবে!

দিন এগিয়ে যেতে লাগল। আবরার বাড়ি ফিরে এসেছে, এতেই আবিরের মা ভীষন রকমের খুশি। শ্রেয়া রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে প্রান’কে সামলাতে। ইদানিং প্রান রাতের দিকে প্রচন্ড কান্না করছে, শ্রেয়া সারারাত ঠিকমতো ঘুমাতে পারছে না তার জন্য সারাদিন ঘুমে ঢলতে থাকে, মেজাজ খিটখিটে হয়ে যায়। আবিরের মা প্রচন্ড চিন্তায় পড়ে গেছেন সবকিছুর মধ্যে, ওনার মনে প্রশ্নের উদয় হয়েছে শ্রেয়া কি আদৌ পারবে ওনার সংসারটাকে আগলে রাখতে!

আবরার এক কাপ কফি বানিয়ে শ্রেয়ার সামনে ধরল। ঘুমে ঝিমিয়ে যাওয়া শ্রেয়া কফি দেখে কিছুটা খুশি হয়ে যায়।

– ‘থ্যাঙ্কস, এইটার দরকার ছিল।’
– ‘তোযার সাথে একটা কথা ছিল।’
– ‘কি কথা!’
– ‘তোমার বয়ফ্রেন্ড তোমার সাথে দেখা করতে চাইছে।’

শ্রেয়া সবেমাত্র কফিটাই চুমুক দিয়েছিল আবরারের কথাতে সেটাতেই বিষম লেগে গেল। চোখ মুখ লাল হয়ে উঠেছে, চমকানোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

– ‘আমার বয়ফ্রেন্ড মানে?’
– ‘আমি সব জানি। আমার কাছে কিছু লুকাতে হবে না। ‘

শ্রেয়ার মুখটা ছোট হয়ে যায়। ভালোবাসায় কখনোই কারোর হাত থাকে না সেটা মন থেকে আসে। শ্রেয়ার বিয়ে ঠিক করা আছে জেনেও সে অন্য কাউকে ভালোবাসে এইটা সকলের কাছে অন্যায় কিন্তু ওর কাছে!

– ‘দ্যাখো শ্রেয়া তুমি যেমন অন্য কাউকে ভালোবাসো আমিও তেমন অন্য কাউকে ভালোবাসি। ভালোবাসায় কারোর হাত থাকে না, সেটা হয়ে যায়। এই বিয়েটা হলে আমরা কখনোই সুখী হতে পারবে না, আর কিভাবেই বা সুখী হবো বলো যেখানে আমাদের মনে অন্য কারোর বাসস্থান।’
– ‘কিন্তু আবরার আমাদের পরিবারকে কিভাবে সেটা বোঝাবে বলো! বাবা মা তো আমার কথাই শুনতে চাইছে না, তাদের এক কথা তারা মামনিকে কথা দিয়েছে সেই কথা তারা যেকোন মূল্যে রাখবে। এমনকি আমাকে কসম দিয়েছে, যাতে আমি এই বিয়েটা করি।’

শ্রেয়া ডুকরে কেঁদে উঠল, নিজেকে আজকাল বড্ড অসহায় লাগে। না পারছে ফ্যামিলিকে বুঝিয়ে ভালোবাসার মানুষটাকে আপন করে নিতে আর না পারছে সবকিছু সহ্য করতে। ফ্যামিলির জেদের কাছে হার মেনে নিজের জীবনটাকেই কিরকম একটা করে ফেলেছে। যেখানে মত থাকে না সেখানে জোর করে ভালো থাকার কতই বা অভিনয় করবে!

আবরার শ্রেয়াথ দিকটা বুঝতে পারল, সেও তো ওই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। শ্রেয়ার ভালোবাসার মানুষটা তো তবুও ওর পক্ষে আছে কিন্তু ওর! সে তো বুঝেও না বোঝার অভিনয় করে আরো দূরে চলে যাচ্ছে। দুজনের মধ্যেকার দূরত্বটা আরো বিরাট আকার ধারণ করছে।

– ‘আমি তোমার দিকটা সবটাই বুঝতে পারছি। তুমি চিন্তা করো না, সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। ‘
– ‘কি ঠিক হবে?
– ‘শ্রেয়া তুমি হয়তো ভুলে গেছ মা কিন্তু তোমাকে পরীক্ষা করানোর জন্য এইখানে নিয়ে এসেছে। আর তোমার কি মনে হয় তুমি পাশ করতে পারবে!’

শ্রেয়া আমতা আমতা করে বলল,
– ‘সংসারটা হয়তো গুছিয়ে নিতে পারব কিন্তু প্রান’কে কিভাবে সামলাব সেটাই বুঝতে পারছি না।’
– ‘চিন্তা করো না, তুমি নিজের মতো সামলাও। মা নিজেই এই বিয়ে ভেঙে দেবে।’
– ‘মামনি বিয়ে ভাঙবে! কিভাবে?’
– ‘সেটা সময় বলবে। তুমি চিন্তামুক্ত থাকো, আমি তোমার বড়ো ভাইয়ের দায়িত্বে তোমার ভালোবাসার মানুষটির সাথে তোমার বিয়ে দিয়ে দেব।’

শ্রেয়ার মুখে হাসি ফুটে উঠল। মনে হলো বুকের উপর বড়ো কোনো পাথরের বোঝা নেমে গেছে। আবরারও মৃদু হাসল, এইবার ওর ভালোবাসার মানুষটিকে মানাতে পারলেই শান্তি।

#চলবে…

ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে