#এক_আকাশ_দূরত্ব (৮)
#তানজিলা_খাতুন_তানু
নাজিয়া আবরারের রুমে গিয়ে ওর বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। এই মূহুর্তে আবরার ছাড়া অন্য কোনো বিশ্বস্ত স্থান খুঁজে পেল না। আচমকা এইরকম হওয়াতে আবরার চমকে যায়, ব্যস্ত হয়ে জিজ্ঞেস করে,
– ”কি হয়েছে? এইভাবে কাঁদছ কেন?’
– ‘আবির-দা।’
– ‘দাদার কি হয়েছে? বলো আমাকে!’
– ‘আবির’দা দিদিকে এতটা কেন ভালোবাসত! এত ভালো না বাসলে তো কষ্টটা কম পেত। দিদি তো চলে গেছে কিন্তু আবির’দাকে পুরো শে-ষ করে দিয়েছে আমি আর সহ্য করতে পারছি না। ‘
আবরার চুপ করে থাকল, নিসার চলে যাওয়াটা ওদের কাছে যতটা না কষ্টের তার থেকে দ্বিগুন কষ্টের আবিরকে ছন্নছাড়া অবস্থায় দেখা। মৃত মানুষ এবং জীবিত থেকে মরার মতো বেঁচে থাকার মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। মানুষগুলো না পারে প্রানভরে নিঃশ্বাস নিতে আর না পারে সবকিছুর মায়া ত্যাগ করে চলে যেতে, সবকিছু সহ্য করে তিলে তিলে শেষ হয়ে যায়।
নাজিয়া কিছুক্ষন কান্নাকাটি করার পর শান্ত হয়। ওকে শান্ত হতে দেখে আবরার বলে,
– ‘তোমার এক্সাম কবে?’
– ‘জানি না, এক্সাম দেব না আমি।’
– ‘পাগলামী বন্ধ করো, এক্সাম না দিলে তোমার একটা বছর নষ্ট হয়ে যাবে। আর এইটাই তো তোমার শেষ, প্লিজ নিজের লাইফটাকে নষ্ট করো না।’
– ‘আপনি কথাটা কিভাবে বলছেন? আমার এইরকম অবস্থাতে আমি কিভাবে এক্সাম দেব!’
আবরার নাজিয়ার দুই গালে হাত রেখে নরম গলায় বলল,
– ‘দ্যাখো নাজিয়া আমরা কেউই অমর নয়, আমাদের সকলেই মরতে হবে কেউ আগে কিংবা কেউ পরে। ভাবি আমাদের সকলের প্রিয় ছিল, ওনার মৃত্যুটা আমাদের কারোর জন্যই স্বাভাবিক ভাবে মেনে নেওয়া সম্ভব নয় কিন্তু দ্যাখো তাতে কি আমাদের জীবনটা থেমে গেছে! সময় কিন্তু এগিয়ে চলেছে, আর তাতে আমাদেরও তাল মিলিয়ে চলতে হবে। প্লিজ নাজিয়া এক্সামটা দাও তুমি.
নাজিয়া আবরারের বলা কথাগুলো চুপ করে শুনে চলেছে, দুজন দুজনের চোখের দিকে তাকিয়ে ভালোবাসার আদানপ্রদান করতে ব্যস্ত। নিজেদের মনের না বলা কথাগুলো প্রকাশ করতে ব্যস্ত তখনি কারোর পায়ের শব্দ শোনা যায়, আবরার নাজিয়ার থেকে কিছুটা দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। হয়তো ওরা শুধুমাত্র কথাই বলছিল কিন্তু কেউ দেখলে খারাপ ভাববে, আর আবরার চাই না নাজিয়ার দিকে কেউ আঙুল তুলুক।
কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ওই ঘরের দরজায় আবরারের মা দাঁড়াল। নাজিয়া আর আবরারকে একসাথে এক রুমে থাকতে দেখে মনে মনে বেজায় বিরক্ত হলেন।
– ‘আবরার!’
– ‘জ্বি মা বলো।’
– ‘আমার রুমে আসো কথা আছে।’
আবরারের মা আর দাড়ালেন না। কথাটা বলেই স্থান ত্যাগ করলেন, আবরার মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল আর নাজিয়া তাচ্ছিল্যের হাসল।
আবরার মায়ের রুমে এসে দেখল তিনি গম্ভীর হয়ে বসে কিছু একটা ভেবে চলেছেন। পাশেই আবরারের বাবা ও চিন্তিত হয়ে বসে আছেন।
– ‘মা আমাকে ডেকেছিলে?’
– ‘হ্যাঁ আসো।’
আবরারের মা আবরারের মুখের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে বললেন,
– ‘কথাটা বললে হয়তো তুই আমাকে খারাপ ভাববি, ভুল বুঝবি কিন্তু কি জানিস মা বাবা কখনোই সন্তানদের খারাপ চাই না।’
– ‘কি বলতে চাইছ সেটা বলো।’
– ‘নাজিয়াকে ওর বাড়ি ফিরে যেতে বল।’
আবরার চমকে উঠল। মায়ের কাছ থেকে এই কথাটা শুনবে সেটা আশা করেনি, কিছু বলতে যাবে তার আগে উনি বললেন,
– ‘দ্যাখ আবরার নাজিয়া একটা অবিবাহিত যুবতী মেয়ে আগে বউমার বোন হিসাবে এই বাড়িতে ছিল, বউমার সাথে ছিল তাতে আমাদের কোনো আপত্তি ছিল না। কিন্তু এখন বউমা নেই সমাজের পাঁচটা মানুষ পাঁচ ধরনের কথা বলছে সেগুলো আমাদের শুনতে ভালো লাগছে না, তুই ওকে চলে যেতে বল।’
– ‘বাহ মা বাহ। যখন ভাবি ছিল তখন নাজিয়ার সাথে আমাদের সম্পর্ক ছিল আর এখন ভাবি নেই তো সম্পর্ক শেষ? আর দাদা যে নাজিয়াকে নিজের ছোটবোনের মতো ভালোবাসে সেটা বুঝি কোনো সম্পর্ক না! তার কোনো দাম নেই তোমার কাছে?’
– ‘আবরার তুই আমাকে ভুল বুঝছিস, বাড়িতে একটা যুবতি মেয়ে তারপর তোরা দুটো ছেলে আছিস আশেপাশের মানুষ বিষয়টা ভালো চোখে দেখছে না। ‘
– ‘সমাজের মানুষের মানসিকতা বদলানোর দায় আমাদের নয়। আর আমরা তো কোনো অন্যায় করছি না তাহলে কেন মেনে নেব!’
আবরারের রাগ বেড়ে চলেছে, এই সমাজ- সমাজের মানুষের জন্য মানুষকে কতকিছু সহ্য করে যেতে হয়। কেউ তোমার উপকার করবে না কিন্তু অপকার ঠিক করবে।
আবরারের বাবা এতক্ষন চুপ করে ছিলেন, ছেলের রেগে যাওয়া দেখে তিনি মুখ খুললেন,
– ‘আবরার তোর মায়ের সাথে আমিও এই বিষয়টিতে একমত।’
আবরার বাবার কথা শুনে হতাশ হলো, কিন্তু কিছু বলল না রাগে চুপ করে রইল।
– ‘দ্যাখ নাজিয়া একজন যুবতী মেয়ে, এইভাবে অন্য কারোর বাড়িতে থাকাটা দৃষ্টিকটু লাগে। ওর মা বাবাও চাইছে ওকে নিয়ে যেতে কিন্তু নাজিয়ার পরিস্থিতি দেখে কিছু বলতে পারছেন না আমরা কেউই ওকে সরাসরি কিছু বলতে পারছি না, তাই তোর সাহায্য চাইছি।’
আবরার কি উত্তর দেবে ভেবে পেল না। ঠান্ডা মাথায় কিছুক্ষণ ভাবার পর মা বাবার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল,
– ‘বাবু কোথায় থাকবে?’
আবরারের মা বাবা একে অপরের মুখের দিকে তাকাল, সত্যি তো নাজিয়া যদি এই বাড়ি থেকে চলে যায় তাহলে বাবু কোথায় থাকবে? আবরারের মা বললেন,
– ‘আমাদের নাতি আমাদের বাড়িতেই থাকবে।’
– ‘ঠিকাছে চাই হোক। আমি নাজিয়াকে দুইদিনের মধ্যে ওই বাড়িতে ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা করছি তোমরা চিন্তা করো না।’
আবরার বেরিয়ে যেতে গিয়ে মা বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে রহস্যময় হাসি দিলো। মাথাতে অনেককিছু ঘুরছে, সবকিছু ঠিকঠাক হলে হয়।
নাজিয়া বাড়ি ফিরে গেছে আজ দুইদিন, সেইদিন আবরারকে আর কিছু বলতে হয়নি নাজিয়া নিজেই বাড়ি ফেরার কথা জানিয়েছিল। বুঝেছিল ওর বাড়িতে থাকা নিয়ে কিছু একটা প্রবলেম হচ্ছে, কি দরকার নিজের কারনে অন্যের ঝামেলা করার। নাজিয়া ফেরার সময়ে আবিরকে যথেষ্ট পরিমানে বুঝিয়ে এসেছে আর আবরারকে বলেছে সবাইকে দেখে রাখতে। নাজিয়া চেয়েছিল প্রান’কে নিয়ে আসতে কিন্তু আবরারের মা সরাসরি জানিয়ে দিয়েছেন তিনি প্রান নাজিয়ার সাথে যেতে দিতে রাজি নয়, প্রান আহমেদ বাড়িতেই থাকবে। নাজিয়া শূন্য হাতে ফিরেছে, বাড়ি ফিরে খুব কেঁদেছিল তারপর কিছুটা শান্ত হয়েছে মা বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে।
আবরারের মা সদ্য জন্মানো প্রানকে সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। বয়সের সাথে সাথে শরীরের শক্তিও কমে গেছে, সাথে ধৈর্য শক্তিও।
– ‘কি গো আবিরের মা নাতিকে কেমন সামলাচ্ছে?’
স্বামীর কথাতে আবিরের মা মেকি হেসে বললেন,
– ‘এখন আর কি বাচ্চা সামলানোর বয়স আছে নাকি! তোমার নাতিকে সামলাতে গিয়ে হিমশিম খেতে হচ্ছে আমাকে।’
– ‘এখন তোমার নাতি! আর যখন নাজিয়া ছেলেটাকে নিয়ে যেতে চাইল তখন তো আমার নাতি আমার কাছে থাকবে বলে আটকে দিলে।’
কিছুটা বিরক্ত হয়ে কথাটা বললেন আবিরের বাবা, নাজিয়া চলে যাবার পর থেকে প্রান ঠিকমতো খাওয়া দাওয়া করছে না এইরকম চলতে থাকলে দুধের শিশুটা কিভাবে বাঁচবে!
– ‘তুমি কি বলতে চাইছ আমার নাতিকে আমি ওই বাইরের মেয়ের হাতে তুলে দেব!’
– ‘আবিরের মা ভুলে যেও না নাজিয়া কিন্তু নিসার বোন, বোনের ছেলের উপরে ওর কিন্তু অধিকার আছে।’
– ‘মায়ের থেকে মাসির দরদ বেশি।’ (মুখ বেঁকিয়ে বললেন)
– ‘নিসা থাকলে নাজিয়া যদি এই আদর-দরদ দেখাত তখন কথাটা বললে সাজত কিন্তু এখন এইসব কথা বলার কোনো মানে হয় না। তুমি কিন্তু অযথা নাজিয়ার নামে উল্টোপাল্টা বলছো।’
– ‘ওই বাইরের মেয়ের জন্য তোমাদের কত দরদ আর আমাকে তোমাদের ভালো লাগে না তাই তো।’ (ন্যাকা কেঁদে)
আবিরের বাবা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, স্ত্রী এতটা অবুঝ কেন বুঝতে পারলেন না। মনে মনে স্ত্রীকে শিক্ষা দেবার একটা পরিকল্পনা করলেন।
#চলবে…