#এক_আকাশ_দূরত্ব (৩)
#তানজিলা_খাতুন_তানু
– ‘নাজু তুই কি আবরারকে পছন্দ করিস বা করতিস?’
নাজিয়া চমকে উঠল। নিসার জানা বা সন্দেহ করার কথা নয় বিষয়টিতে, নাজিয়া কখনোই এমন কিছু করেনি যেটাতে আবরারের প্রতি ওর অনুভূতি প্রকাশিত হয়। তাহলে নিসা কিভাবে কথাটা বলছে?
– ‘এইসব তুই কি বলছিস?’
– ‘না আমার মনে হলো তাই জিজ্ঞেস করলাম। সত্যি বল না বোন।’
– ‘নারে দিদি সেইরকম কিছু না। তোর দেবর আমার সাথে একটু মজা করতো এইটাই যা।’
– ‘সত্যি তো।’
– ‘হুম।’
দুই বোন আড্ডাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। নিসার শাশুড়ি মা শ্রেয়ার জন্য অনেক রকমের পদের রান্না নিজে হাতে করছে, নাজিয়া সাহায্য করতে চাইলে সরাসরি না বলে দিয়েছে তাই থাকা না বাড়িয়ে নাজিয়া নিজের বরাদ্দকৃত ঘরটিতে বসে ফোন ঘাটছিল। তখনি ওর ক্লোজ ফ্রেন্ড হিরক ভিডিও কল করে, নাজিয়াও রিসিভ করে কথা বলতে থাকে। কথার একটা পর্যায়ে হিরক বলে উঠে,
– ‘এই নাজু তুই আগের থেকে কিউট হয়ে গেছিস। ইচ্ছা করছে খেয়ে নিতে।’
নাজিয়া চোখ বড়ো বড়ো করে তাকিয়ে আছে, হিরক এই কথাটা বলবে কখনোই আশা করেনি। অন্যদিকে হিরক কথাটা বলে অস্বত্বিতে পড়ে যায়, নাজিয়াকে দেখতে দেখতে এতটাই বিভোর হয়ে গিয়েছিল যে কখন কথাটা বলে ফেলেছে সেইদিকে খেয়ালই নেই।
– ‘কি বললি তুই!’
– ‘দূর একটু মজাও বুঝিস না তুই।’
নাজিয়া আর কথা বাড়ায় না, হিরকের কথাটা শোনার পর থেকে প্রচন্ড অস্বস্তি হচ্ছিল তাই কাদের বাহানায় ফোনটা রেখে দেই।
– ‘দিদি ডাকছে, ফোনটা রাখছি পরে কথা হবে।’
– ‘আচ্ছা।’ (মনখারাপ করে)
নাজিয়া কলটা কেটে উঠে বসতেই দরজায় টোকা পড়ে, দরজার দিকে তাকিয়ে দেখল আবরার পকেটে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
– ‘আপনি এইখানে কি করেন?’
– ‘না দেখতে এলাম ভাবির বোনের কান্ড।’
নাজিয়ার ভ্রু কুঁচকে গেল। কথাটার মানে বুঝতে না পেরে বলল,
– ‘মানে?’
– ‘ভাবি জানে কি তার বোন ছেলেদের সাথে ভিডিও কলে কথা বলে?’
– ‘আমার ফ্রেন্ডের সাথে আমি কথা বলতেই পারি, তাতে কাউকে জানানোর কি আছে?’
নাজিয়া বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বিরক্ত হয়ে কথাটা বলল। এমনিতে হিরকের কথাটা শুনে কেমন যেন এলোমেলো লাগছে।
– ‘শুধুমাত্র কথা বললে কিছুই নয় কিন্তু অন্যকিছু করলে তো ভাবিকে জানাতেই হচ্ছে।’
– ‘এই আপনি কি মিন করতে চাইছেন?’
– ‘তোমার ফ্রেন্ড তোমাকে কি বলেছে সবটাই আমি শুনেছি। আর এই কথাটা কে কাকে বলতে পারে সেটাও আমার জানা।’ (রাগী গলাতে)
– ‘কি শুনেছেন আপনি?’
আবরার উত্তর না দিয়ে নাজিয়ার কাছাকাছি গিয়ে বলল,
– ‘অন্য কেউ তোমাকে নিয়ে ওইরকম কথা বলবে কেন?’
– ‘আরে কি বলেছে সেটাই তো বূঝতে পারছি না।’
আবরার রেগে গেল। নাজিয়া বাম হাতটা ধরে নিজের দিকে টেনে নিয়ে বলল,
– ‘সত্যি বুঝতে পারছ না, নাকি নাটক করছো?’
– ‘সত্যি বুঝতে পারছি না। আর আমার হাতটা ছাড়ুন, আমার অস্বস্থি হচ্ছে।’
– ‘আমি স্পর্শ করলেই তোমার অস্বস্তি হয়। অন্য কোনো ছেলে স্পর্শ করলে, সুন্দর কমেন্ট করলে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকলে তোমার খুব ভালো লাগে তাই না।’ (রাগ নিয়ে একটু জোরেই কথাটা বললো)
নাজিয়া প্রচন্ড রাগ নিয়ে আবরার দিকে তাকায়, কিন্তু তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে যায়। আবরারের ফর্সা মুখশ্রী রাগে লাল হয়ে আছে, সবথেকে আকর্ষনীয় লাগছে নাকটা ইচ্ছা করছে একটু টেনে দিতে। এখন নাজিয়ার ইচ্ছা করছে হিরকের বলা কথাটি আবরারকে বলে দিতে।
– ‘এই আমি কিছু বলছি।’ (নাজিয়াকে নাড়িয়ে দিয়ে)
নাজিয়ার ধ্যান ভাঙতেই বলল,
– ‘ছাড়ুন আমাকে।’
আবরার নাজিয়াকে ছেড়ে দিয়ে বলল,
– ‘ওই ছেলের সাথে বেশি মেলামেশা করবে না।’
– ‘কেন?’
– ‘তুমি জানো না, একটা ছেলে কখন একটা মেয়েকে এইরকম কথা বলে? না জানলে আমিই বলে দিচ্ছি ছেলেটি তোমাকে পছন্দ করে, আমি স্পষ্ট দেখেছি ছেলেটি তোমার দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে ছিল।’
আবরার দাঁতে দাঁত চেপে কথাগুলো বলল। রাগে শরীর জ্বলে যাচ্ছে ওর, তখনের দৃশ্যটা মনে পড়লেই রাগ হচ্ছে প্রচন্ড পরিমানে। কথাটা শুনে নাজিয়াও চমকে উঠল, হিরক ওকে পছন্দ করে কথাটা ভাবতেই মাথাটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। তবুও আবরারকে বুঝতে না দিয়ে বলল,
– ‘পছন্দ করে তো কি হয়েছে!’
আবরার নাজিয়াকে আবারো নিজের কাছে টেনে নিলো। দুজন দুজনের নিঃশ্বাস স্পর্শ করছে, আবরার নাজিয়ার কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,
– ‘আমাদের মাঝে হাজার দূরত্ব থাকলেও তুমি শুধুই আমার। আর আমি আমার জিনিসের উপরে অন্যকারোর নজর সহ্য করব না, তাই ওই ছেলের থেকে দূরত্ব বজায় রাখবে নাহলে ফলটা খুব একটা ভালো হবে না। মাইন্ড ইট।’
**
নাজিয়া তম মেরে দাঁড়িয়ে আছে, আবরারের কথাগুলো কানে বেজে উঠছে বারবার।
– ‘কি বলে গেল ওহ!’
নাজিয়া কিছুতেই কাজে মন বসাতে পারছে না। আবরারের কথাগুলো বারবার মনে পড়ে যাচ্ছে। নাজিয়া রান্না করতে গিয়ে দেখল আবরারের মা শ্রেয়ার সাথে বসে গল্প করছে। নাজিয়াকে দেখা মাত্রই শ্রেয়া বলল,
– ‘আরে নাজিয়া কোথায় যাচ্ছো? আসো না বসে গল্প করি।’
– ‘আসলে শ্রেয়াদি দিদির জন্য কিছু রান্না করতে হবে, আমি রান্নাটা করে তোমার সাথে গল্প করছি।’
নাজিয়া রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ল। শ্রেয়া ওর মামনি বলল,
– ‘মামনি মেয়েটা বেশ লক্ষি তাই না।’
আবিরের মা মুখ বাঁকিয়ে বললেন,
– ‘বেশি মাথায় তুলবি না একদম। কয়েকদিন দিদির বাড়িতে আছে কদিন পর চলে যাবে আর তুই এই বাড়ির বউ হবি। তোকে শক্ত হাতে সবকিছু সামলাবে।’
– ‘মানে?’
শ্রেয়া কিছুই বুঝল না। আবিরের মা নিজের মনে মনেই বকবক করতে লাগলেন, শ্রেয়া একটু বিরক্ত হলো তবে কিছুই বলল না। নাজিয়া দিদির জন্য স্যুপ করে নিসাকে দিয়ে আসে। তারপরে বসার ঘরে এসে বলল,
– ‘শ্রেয়া দি কি খাবে বলো। আমি করে দিচ্ছি।’
শ্রেয়া কিছু বলতে যাবে তার আগে আবিরের মা বলল,
– ‘দরকার নেই। শ্রেয়া এখুনি আবরারের সাথে ঘুরতে বের হবে। তুমি তোমার কাজে যাও।’
কথাটা শোনার পর নাজিয়ার একমুহুর্ত ওইখানে দাঁড়িয়ে থাকতে মন চাইল না, চলে যেতে যাবে তার আগে শ্রেয়া বলল,
– ‘মামনি নাজিয়াও আমাদের সাথে যাক না। দারুন মজা হবে।’
– ‘কিন্তু…
– ‘প্লিজ।’
– ‘মা নাজুও যাক না, একটু ঘুরে আসবে।’ (আবির)
আবিরের মা সামনাসামনি কিছু বলতে না পারলেও ভেতরে ভেতরে ফুঁসতে লাগলেন। নিরবতা সম্মতির লক্ষণ দেখে শ্রেয়া নাজিয়াকে বলল রেডি হয়ে আসতে। আবিরের মায়ের মত নেই বুঝতে পেরে নাজিয়া বলল,
– ‘শ্রেয়া দি তুমি যাও না,আমি গিয়ে কি করবো?’
– ‘কোনো কথা নয়, রেডি হয়ে নাও। আচ্ছা চলো আমি তোমাকে রেডি করিয়ে দেব।’
শ্রেয়া নাজিয়াকে টেনে নিয়ে চলে গেল। আবিরও নিজের কাজে চলে যায়, আর আবিরের মা রাগে ফুঁসতে লাগলেন।
শ্রেয়া নাজিয়ার বারন সত্ত্বেও সরকারি ব্লু রঙের সালোয়ার কামিজের সাথে হাল্কা সিম্পল মেকাপ করিয়ে সাজিয়ে দিলো।
– ‘দ্যাখো কেমন লাগছে?’
নাজিয়া আয়নার দিকে তাকাল, কতদিন পর সাজগোজ করলো। এখন তো ঠিকমতো আয়নার সামনেই দাঁড়ানো হয়না, নিজের খেয়াল রাখা হয়না অথচ একটা সময়ে এই সাজ-গোজ কতটা ভালোবাসত, নিজের পেশা হিসাবে নিতে চেয়েছিল সবটা এখন অতীত। কিছু কিছু গল্প, ইচ্ছা সময়ের সাথে সাথে ফিকে হয়ে যায়।
নাজিয়া কে একভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে শ্রেয়া বলল,
– ‘কি হলো বলো।’
– ‘সুন্দর লাগছে।’
– ‘পাগলি।’
– ‘এইবার যাও রেডি হয়ে আসো।’
– ‘হুম।’
শ্রেয়া মুচকি হেসে নিজে রেডি হতে চলে গেল। নাজিয়া আবারো আয়নার নজর রাখল, নিজেকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল। তখনি পেছন থেকে আবরার বলে উঠল…
– ‘বউ বউ লাগছে।’
ঘোরলাগা চেনা কন্ঠস্বরে নাজিয়ার গোটা শরীর কেপে উঠল। বউ ডাকটা বুকের মাঝে অজানা কম্পনের সৃষ্টি করছে, নাজিয়ার বড্ড লজ্জা লজ্জা লাগছে।
– ‘লজ্জায় তো একেবারে টমেটো হয়ে যাচ্ছো।’
– ‘এই আপনি চুপ করবেন।’
– ‘কেন কেন? আমি কি কারোর নাম ধরে বলেছি নাকি।’
– ‘আপনাকে আমি…
– ‘কি বলো, শুনি আমি।’
– ‘ধ্যাত।’
নাজিয়া বিরক্ত হয়ে ঘরের বাইরে চলে যেতে যাবে আবরার ওর হাত টেনে নিজের কাছে নিয়ে এসে বলল,
– ‘একদিন না একদিন তো আমার বউ হয়েই আসবে তাহলে এত লজ্জা পাওয়ার কি আছে।’
– ‘আমি আপনাকে বিয়ে করবো না, সেইখানে বউ হবার কথা আসছে কোথা থেকে?’
– ‘হবে হবে সব হবে।’
আবরার শিষ বাজাতে বাজাতে চলে যায়। নাজিয়া ভেবে পাইনা কি করবে, এইভাবে চলতে থাকলে নিজের মনকে শাসন করে রাখতে পারবে না কিছুতেই।
শ্রেয়ার ডাকে নাজিয়া বাইরে আসে। তারপর তিনজন মিলে বেরিয়ে পরে ঘোরাঘুরির জন্য। শ্রেয়া আর নাজিয়া পেছনে বসেছে, আর আবরার সামনে ড্রাইভার গাড়ি ড্রাইভ করছে। আবরার ইচ্ছা করেই ড্রাইভার নিয়েছে, ওহ ভালো করেই জানে নাজিয়া ওর পাশে বসবে না, শ্রেয়া বসবে তার থেকে ভালো ওরা দুজনেই পেছনে বসুক।
গাড়ি চলেছে নিজ গতিতে শ্রেয়া প্রশ্ন করছে, আবরার উত্তর দিচ্ছে আর নাজিয়া চুপচাপ ওদের কথোপকথন শুনে চলেছে।
– ‘আবরার আমরা তো ঘুরতে বের হলাম ঠিকই কিন্তু কোথায় যাবো।’
আবরার কিছু একটা ভেবে বলল,
– ‘প্রিন্সেপ ঘাট। একসাথে অনেকগুলো কাজ হয়ে যাবে।’
– ‘কিরকম!’
– ‘হাওড়া ব্রিজ, হুগলি নদী এন্ড নৌকা চড়াও হয়ে যাবে।’
শ্রেয়া লাফিয়ে উঠল, ছোট থেকেই নৌকা চড়তে ওর দারুন লাগে। কিন্তু নাজিয়া ঢোক গিলল, ছোট থেকেই পানি জিনিসটাকে খুব ভয় পাই তারপরে নৌকা সোজা হার্টএট্যাক করবে। নাজিয়ার ভীতু মুখটা দেখে আবরার বাঁকা হেসে মনে মনে বলল,
– ‘আমিও দেখব কিভাবে আমাকে এড়িয়ে চলো।’
#চলবে…
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।