#এক_আকাশ_দূরত্ব
#তানজিলা_খাতুন_তানু
(২)
সকালের খাবার টেবিলে আবিরের মা বললেন,
– ‘আবরার বাবা শ্রেয়া আসবে, ওকে স্টেশন থেকে একটু নিয়ে আয় তো।’
শ্রেয়া আসল কারনটা কেউ না বুঝলেও নাজিয়ার বুঝতে অসুবিধা হলো না। তবুও সেইদিকে কান না দিয়ে নিজের কাজ করতে লাগল, বিষয়টা ওদের পারিবারিক ব্যাপার ওর নাক না গলানোই ভালো।
– ‘মা হঠাৎ করে শ্রেয়া কেন?’
– ‘অনেকদিন আসেনি তাই আমিই আস্তে বললাম। যা না বাবা নিয়ে আয় না।’
আবরার বিরক্ত হলো, শ্রেয়া ওর মামাতো বোন কিন্তু ওহ মোটেও পছন্দ করেনা মেয়েটাকে। কিরকম একটা গায়ে পড়া মেয়ে, আবরারের একদম সহ্য হয় না। কিন্তু মায়ের কথা ফেলতে পারল না, বিধায় বিরক্ত মুখে স্টেশনে যাবার জন্য রেডি হতে গেল।
রেডি হয়ে নীচে থামতেই আবির বলল,
– ‘ভাই একটা কাজ করে দিবি।’
আবরারের বিরক্ত মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। সকাল সকাল সবাই পেয়েছেটা কি?
– ‘কি বলো।’
– ‘নাজুকে একটু নামিয়ে দিতে পারবি।’
– ‘কোথায়?’
– ‘আসলে ওকে এখানে নিয়ে চলে এসেছি কিন্তু ৩মাস পর ওর পরীক্ষা। এতদূর থেকে টিউশন পড়তে পারবে নাহ তাই কাছেই ভর্তি করিয়ে দেব। আমিই যেতাম আমার একটু কাজ পড়ে গেছে তাই।’
আবরার কিছু বলতে যাবে তার আগেই ওর মা বলল,
– ‘ওকে একাকেই চলে যেতে বল। ওহ গেলে শ্রেয়া আসবে কিভাবে?’
ইতিমধ্যেই ওইখানে নাজিয়া উপস্থিত হয়েছে। আবিরের মায়ের কথা শুনে বুঝতে পারল, আবির ওকে আবরারের সাথে পাঠানোর প্ল্যান করছে আর ওনাদের মা সেটা নিয়ে আপত্তি প্রকাশ করছেন। নাজিয়া আবিরের কাছে গিয়ে বলল,
– ‘আবিরদা আমি একাই চলে যেতে পারব। তুমি চিন্তা করো না। আমি আসছি।’
নাজিয়া চলে যেতে যাবে তার আগেই আবরার এক ধমক দিলো,
– ‘এই মেয়ে তোমাকে পাকামো করতে কে বলেছে?’
আবরারের ধমক শুনে ওর্ দিকে সবাই চোখ ছোট ছোট করে তাকায়। আবিরের মা বিরক্ত হয়ে উঠেছেন, কিছু একটা বলতে যাবে তার আগে আবরার বলল,
– ‘মা আমি বাইক নয় গাড়ি নিয়ে যাচ্ছি। তাই ওনাকে নিয়ে যেতে আমার কোনো প্রবলেম হবে না। দাদা তুমি চিন্তা করো না, ওনাকে ভর্তি করিয়ে সাথে করেই বাড়ি ফিরবো। আসছি।’
নাজিয়ার হাতটাকে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বেড়িয়ে গেল। আবির সেইদিকে পাত্তা না দিলেও আবিরের মা ক্ষোভে ফেটে পড়লেন। আর নাজিয়া? সে তো এতদিন পর ভালোবাসার মানুষটির স্পর্শে কেঁপে উঠেছে, নাজিয়ার কাঁপন অনুভব করে আবরার মৃদু হেসে মনে মনে বলল,
– ‘মুখে যতই অস্বীকার করো না কেন? আজও তুমি আমাকেই ভালোবাসো। কি কারনে তুমি আমার থেকে দূরে চলে গেছো আমি জানি না,তবে এইবার আমি তোমাকে আপন করে নেবেই। জাস্ট ওয়েট এন্ড ওয়াচ।’
আবরার নাজিয়ার হাত ছেড়ে গাড়ি বের করতে চলে যায়। নাজিয়া এখনো ঠাঁই দাঁড়িয়ে আছে, কিছুক্ষন আগের ঘটনা মনে পড়তেই নিষিদ্ধ অনুভূতিগুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। নাজিয়া নিজের মনকে শাসন করে বলল,
– ‘ না নাজু আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়লে হবে না। তোকে স্ট্রং থাকতে হবে, তোর আর আবরারের মধ্যে কিছু হওয়া অসম্ভব। তোর কাছে আবরার মানে ‘এক আকাশ দূরত্ব’।’
আবরারের হর্নে নাজিয়ার ধ্যান ভাঙে। পেছনে বসতে গেলে আবরার ধমক দিয়ে বলে,
– ‘এই আমি কি তোমার ড্রাইভার নাকি। চুপচাপ সামনে এসে বসো।’
– ‘পারবো না।’
– ‘দ্যাখো নাজিয়া আমাকে রাগাবে না একদম। চুপচাপ এসে বসো।’
কথাটা নাজিয়ার বুকে গিয়ে লাগল। আবরারের মুখে নাজিয়া ডাকটা কখনোই আশা করেনি, কিন্তু ওই তো বলেছিল নাজু না ডাকতে তাহলে এত কষ্ট হচ্ছে কেন?
নাজিয়া চুপচাপ সামনের সিটে বসে সিটবেল্টটা বেঁধে নিল। বিষয়টিতে আবরার বিরক্ত হলো, ওর তো ইচ্ছা ছিল সিটবেল্ট বেঁধে দেবার ফাঁকে নাজিয়ার চুলের ঘ্রান নেবে কিন্তু মেয়েটা সব ঘেঁটে দিয়েছে। আবরার মুখ গোমড়া গাড়ি চালাতে লাগল। নাজিয়া আড়চোখে আবরারের মুখের অবস্থা দেখে মিটমিট করে হাসতে লাগল। নাজিয়ার হাসি দেখে আবরার ধমক দিয়ে বলল,
– ‘এই হাসছো কেন?’
ধরা পড়ে গিয়ে নাজিয়া মুখটা কাঁচুমাচু করে বলল,
– ‘কই না তো আমি হাসিনি।’
– ‘খবরদার মিথ্যা বলবে না। তোমার প্রতিটা পদক্ষেপ আমার জানা, চোখ বন্ধ করে বলে দিতে পারি তুমি কি করছো।’
নাজিয়ার গা বেয়ে শীতল বাতাস বয়ে গেল। আজ কতদিন পর মানুষটির কাছাকাছি তবুও দুজনের মাঝে কত দূরত্ব। আবরার নাজিয়াকে রাগানোর জন্য বলল,
– ‘মা মনে হয় শ্রেয়াকে আমার বিয়ের জন্য আনছে। মা কিন্তু শ্রেয়াকে খুব পছন্দ করে।’
আবরার ভেবেছিল কথাটাই নাজিয়া রিয়াক্ট করবে কিন্তু কিছুই হলো না, কথার বিনিময়ে নাজিয়া মেকি হাসল। আবরারের রাগে মাথা ফেটে যাচ্ছে, নাজিয়ার নিরবতা যতটা না পোড়াচ্ছে, তার থেকে বেশি পোড়াচ্ছে নাজিয়ার মুখের নকল হাসি। ওদের দুজনের সম্পর্ক বলতে কিছুই ছিল না, দুজন দুজনকে কখনোই ভালোবাসি বলেনি। তবে দুজনের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক ছিল, আর যেটা এতটাই গভীর যে একে অপরের প্রতিটা পদক্ষেপ মুখ দেখেই বুঝতে পারে।
**
আবরার রাগ নিয়ে কঠিন একটা সিদ্ধান্ত নিল। মনে মনে বলল,
– ‘আমাকে আর শ্রেয়াকে কাছাকাছি দেখেও তুমি কতটা ঠিক থাকতে পারো আমিও দেখব। তোমার আর আমার মাঝের এক আকাশ দূরত্ব আমি ঘোচাবোই প্রমিস মাই লাভ।’
আবরার নাজিয়াকে কোচিং এর সামনে নামিয়ে দিয়েই গাড়ি নিয়ে চলে গেল। নাজিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলল, ওহ আশা করেছিল আবরার ওর সাথে আসবে। নাজিয়া কোচিং এর হেডের রুমে ঢুকবে, কোথা থেকে আবরার এসে ওর পাশে দাঁড়িয়ে পড়ল। ওহ চমকে উঠল, আবরারকে দেখে নিজের অজান্তেই মুখে হাসি ফুটে উঠল।
আবরার ভেতরে গিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে বলল,
– ‘ওহ নাজিয়া ওর ভর্তির জন্যই আমার দাদা আবির ফোন করেছিল।’
– ‘তাহলে তুমিই নাজিয়া তাই তো।’
– ‘জ্বি।’
– ‘বসো তোমরা।’
উনি কথা বলে নাজিয়াকে ভর্তি করিয়ে নেন। তারপরে ওরা দুজন বেরিয়ে আসে, নাজিয়া কাঁচুমাচু করে বলল,
– ‘আপনি শ্রেয়া’দিকে আনতে চলে যান। আমি বাড়ি ফিরে যাচ্ছি।’
– ‘বাড়ি থেকে বের হবার সময়ে কথাটা কি কান পর্যন্ত পৌঁছায় নি?’
– ‘আমি স্টেশনে গিয়ে কি করবো?’
– ‘জানি না চুপচাপ চলো।’
নাজিয়া ফোস করে নিঃশ্বাস নিয়ে আবরারের পাশে বসে পড়ল। এই গরমে স্টেশনে মানুষের ভীড় দেখে ঢোক গিললো আবরার, ছোট থেকেই ভীড় অপছন্দ করে আর আজকে এই ভীড় ঠেলে শ্রেয়াকে আনতে যেতে হচ্ছে অসহ্য।
শ্রেয়া আবরারকে দেখা মাত্রই জড়িয়ে ধরল। আবরার নিজের রাগকে কন্ট্রোল করে শ্রেয়াকে সরিয়ে দিল, ইচ্ছা করছে মেরে গাল লাল করে দিতে। সামনে নাজিয়া দাঁড়িয়ে সবটা দেখে ফোঁস করে শ্বাস ফেলল, আশা করেছিল আবরার শ্রেয়াকে একটা থাপ্পর দেবে কিন্তু সেইসব না হয়ে উল্টে আবরার শ্রেয়ার সাথে মিষ্টি হেসে কথা বলতে শুরু করল।
– ‘কিরে শ্রেয়া কেমন আছিস?’
– ‘আমি তো ভালো আছি তুমি কেমন আছো? কতদিন পর তোমাকে দেখলাম, ইশ্ আগের থেকে কত রোগা হয়ে গেছো।’
নাজিয়া চোখ ছোট ছোট করে করে আবরারের দিকে তাকাল। আবরার আগের তুলনায় রোগা হয়ে গেছে ঠিকই তবে এখন আগের থেকে বেশি কিউট লাগছে। আর এই মেয়ে এমন করে বলছে যেন রোগা কাঠ হয়ে গেছে অসহ্য।
আবরার শুকনো কাশি দিলো, এই চেহারা দেখে কত মেয়ে প্রেমের প্রস্তাব দেই আর এই মেয়ে এই চেহারার অপমান করছে। আচ্ছা ওহ কি দেখতে এতটাই খারাপ, এই কারনেই কি নাজিয়া ওকে পাত্তা দেয় না। ভাবতেই মুখটা ফ্যাকাশে হয়ে গেল আবরারের।
আবরারের মুখের রং বদলে যেতে দেখে নাজিয়ার পেট ফেটে হাসি পাচ্ছে, কিন্তু এখন কিছুতেই হাসা যাবে না। তাই কোনোরকমে হাসি আটকে বলল,
– ‘আমি গাড়িতে গিয়ে বসছি আপনারা আসুন।’
কথাটা বলে নাজিয়া গাড়ির কাছে চলে গিয়ে হাসতে শুরু করল। হ্যান্ডস্যাম মানুষকে রোগা বললে তার মুখের অবস্থা কিরকম হয় সেটা আবরারকে না দেখলে কখনোই বুঝতে পারত না।
– ‘শ্রেয়া বাড়ি চলো।’
– ‘চলো।’
ওদেরকে গাড়ির দিকে আসতে দেখে নাজিয়া হাসি থামিয়ে ভালো মেয়ের দাঁড়িয়ে রইল। আবরার ড্রাইভার সিটে বসতেই নাজিয়া পেছনের সিটে গিয়ে বসে পড়ল, আর শ্রেয়া সামনে। আবরার নাজিয়ার দিকে রাগী লুক নিয়ে তাকাল কিন্তু ওহ সেইদিকে পাত্তা না দিয়ে ফোনে টুকটুক করতে লাগল।
বাড়িতে যাওয়া মাত্রই আবরারের মা শ্রেয়াকে নিয়ে মাতামাতি শুরু করে দিলেন।
– ‘কতদিন পর আসলি। এতোদিনে মামনির কথা মনে পড়ল।’
– ‘তোমাকে সবসময়েই মনে পড়ে। কিন্তু সবমিলিয়ে আসা হয়ে উঠে না।’
– ‘হুমম সব বুঝি। এখন ফ্রেশ হবি চল।
– ‘হুম।’
আবরারের মা শ্রেয়াকে নিয়ে চলে যেতেই আবরার নাজিয়াকে বলল,
– ‘তুমি তখন পেছনে বসলে কেন?’
– ‘তো কি করব?’
– ‘দূর তোমার সাথে কথা বলাই বেকার।’
– ‘সেটা আজকে জানলেন বুঝি।’
– ‘তুমি না বড্ড ফাজিল হয়ে গেছো।’
– ‘কে বললো।’
– ‘আমি বলছি।’
– ‘আপনার আমাকে নিয়ে বেশি চিন্তা করতে হবে না, আপনি বরং শ্রেয়া’দিকে নিয়ে ভাবুন।’
কথাটি বলেই নাজিয়া নিসার কাছে চলে গেল।
আবরার নাজিয়ার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে বিরবির করে বলল,
– ‘এই পাগলির পাল্লায় পড়ে আমি নিজেই না পাগল হয়ে যায়।’
নিসা নিজের ঘরে বিছানায় আধশোয়া হয়ে বই পড়ছে।
– ‘দিদি কি করছিস?’
– ‘এই তো বই পড়ছি। তো কোচিং এ ভর্তি হলি?’
– ‘হ্যাঁ।’
– ‘শ্রেয়া এসেছে।’
– ‘হুম।’
– ‘এইবার মনে হয় মা ভাইয়ের বিয়েটা দিয়েই দেবে।’
– ‘ভালো তো। একটা বিয়ে খেতে পারব।’
– ‘নাজিয়া একটা সত্যি কথা বলবি?’
– ‘কি বল।’
নিসার কথা শুনে নাজিয়া চমকে উঠে।
#চলবে…