এক আকাশ দূরত্ব পর্ব-০১

0
970

#এক_আকাশ_দূরত্ব
#পর্ব_১
#তানজিলা_খাতুন_তানু

“এতগুলো বছর এই বাড়িতে না আসার কারনটা কি নাজিয়া?”

আরবার এর প্রশ্নে নাজিয়া চমকে উঠল। আনমনে ছাদে দাঁড়িয়ে প্রকৃতিবিলাসে ব্যস্ত ছিল তখনি আগমন ঘটে আরবারের। নাজিয়া একপলক তাকিয়ে চোখটা ততক্ষনাত সরিয়ে নেয়, এই মানুষটির দিকে তাকানোর অধিকার যে ওর নেই।

– ‘কি হলো নাজু বলো।’
– ‘আমাকে নাজু বলে না ডাকলেই খুশি হবো। এই নামটা আমার ব্যক্তিগত আপন মানুষদের জন্য।’
– ‘আমি কি তোমার আপন নয়?’
– ‘না।’

আরবার চমকে উঠল। নাজিয়ার মুখ থেকে এইরকম কথা কখনোই আশা করেনি, আরো কিছু বলবে তার পূর্বেই নাজিয়া ছাদ থেকে চলে যায়। আরবার হতভম্বের মতো দাঁড়িয়ে রইল।

নাজিয়াকে ওর পছন্দ সেই দাদার বিয়ের দিন থেকেই। বিয়ের গেটে দাঁড়িয়ে কি ঝগড়াটাই না করেছিল ভাবলেই হাসি পাই। সময়ের সাথে দুজনের মাঝে ভালো বন্ধুত্ব গড়ে উঠে কিন্তু হঠাৎ করেই নাজিয়া আরবারের সাথে সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দেই এমনকি এই বাড়িতে আসাও বন্ধ করে দেই। আরবার অনেক চেষ্টা করেও নাজিয়ার সাথে কথা বলতে পারেনি, নাজিয়া সেই সুযোগ দেয়নি। পড়াশোনার নাম করে দূরে হোস্টেলে চলে যায়, আরবার ওহ নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। তবে মনের মাঝে নাজিয়ার জন্য অনুভূতি আগের মতোই রয়ে গেছে। তাই তো নাজিয়ার আসার খবর পেয়ে সব কাজ ফেলে বাড়িতে ছুটে এসেছে।

নাজিয়া ছাদ থেকে নেমে সোজা নিসার ঘরে যায়। নিসা কিছু একটা নিয়ে গাল ফুলিয়ে বসে আছে, আর ওর বর আবির রাগ ভাঙানোর চেষ্টা করছে। ওদের কান্ড দেখে নাজিয়া ফিক করে হেসে দিল। ওদের দুজনের ভালোবাসাটা দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়, দুজন দুজনের প্রতি কতটা কেয়ারিং।

– ‘কি হলো জিজুজী কি নিয়ে মান অভিমান চলছে?’
– ‘দ্যাখ না নাজু তোর দিদি এখন ফুচকা খাবে বলছে, ওইটা এখন ওর পক্ষে ভালো নয় সেটাই বোঝানোর চেষ্টা করছি কিন্তু মহারানির রাগ হয়ে যাচ্ছে।’ (হতাশ কন্ঠে)
– ‘দিদি কি শুরু করেছিস তুই।‌ আবিরদা তো ঠিক বলেছে, এখন এইসব খাওয়া ঠিক নয়।’
– ‘তুই নাজু তোকে আনা হয়েছে আমার দেখাশোনা করার জন্য ওর চামচা গিরি করার জন্য নয়।’ (রাগ নিয়ে)

দিদির কথার পরিপ্রেক্ষিতে নাজিয়া ফোস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে আবিরের দিকে তাকাল। সেও করুন চোখে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। নিসার প্রেগন্যান্সি চলছে, বিয়ের ৫বছর পর প্রথমবারের মতো প্রেগন্যান্ট হয়েছে। ডক্টররা খুব সাবধানে থাকতে বলেছে তাই তো আবির নিসার দেখাশোনার জন্য নাজিয়াকে এই বাড়িতে নিয়ে এসেছে। দিদির শারিরীক অবস্থা,আবিরের রিকুয়েস্ট সবটা দেখে নাজিয়া না করতে পারেনি একপ্রকার বাধ্য হয়েই এই বাড়িতে এসেছে।‌ নাহলে কখনোই এই বাড়ি মুখো হবার ইচ্ছা ছিল না, কিন্তু বিধাতা হয়তো অন্যকিছু ভেবে রেখেছে।

– ‘দিদি দ্যাখ আমরা তো ভালোই চাই বল। আর তুই যদি এইরকম করিস তো তাহলে আমি আজকেই বাড়ি চলে যাবো আর কখনো এই বাড়িতে আসব না।’ (রাগ দেখিয়ে)

নাজিয়ার কথাতে নিসা কিছুটা শান্ত হলো। চারবছরে অনেক বলেও নাজিয়াকে এইবাড়িতে আনতে পারেনি, আজ ওর কারনেই এই বাড়িতে আবারো এসেছে।

– ‘ঠিক আছে লাগবে না আমার।’
– ‘এই তো আমার সোনা দিদি।’

আবির মুচকি হাসল। নিসা আর নাজিয়ার সম্পর্কটা স্ট্রং, আর নিসাকে মানিয়ে নেবার ক্ষমতা একমাত্র নাজিয়ার আছে। নাজিয়া ঠিক কোনো না কোনো ভাবে নিসাকে প্রতিটা বিষয়ে মানিয়ে নেয়, আর এই সুযোগের সৎ ব্যবসার করে আবির।

আবির আর নিসার লাভ ম্যারেজ। আর এই বিয়েটার মূখ্য ভূমিকা পালন করেছিল নাজিয়া, প্রতিটা বিষয়ে আবিরকে হেল্প করছে। ওর কারনেই আবির আর নিসা দুজন একসাথে তাই তো আবির নাজিয়াকে নিজের বোনের মতো ভালোবাসে।

– ‘এই নাজু অনেকদিন তোর হাতে রান্না খাইনি, আজকে তুই রান্না করবি প্লিজ?’

আবিরের কথা বলার ধরন দেখে নিসা আর নাজিয়া ফিক করে হেসে দিলো। নাজিয়া আবিরকে ক্ষ্যাপানোর জন্য বলল,

– ‘দিদি দেখছিস আবিরদা বউয়ের হাতের থেকে শালির হাতের রান্না বেশি পছন্দ করছে। কি ব্যাপার জিজুজী।’ (ভ্রু নাচিয়ে)

– ‘কিছুই না শালিকা, অনেকদিন হলো তোর হাতের রান্না খাইনি তাই বললাম। আর সত্যি কি জানিস তোর দিদি না তোর মতো রান্না করতে পারে না।’
– ‘দেখেছিস দিদি আবিরদা কি বলছে?’
– ‘তা তো দেখতেই পাচ্ছি। বুঝেছি আমাকে আর ভালোবাসে না।’
– ‘আহা গো আমার বউটার রাগ হয়েছে বুঝি।’ (ন্যাকা স্বরে)

ওদের কান্ড দেখে নাজিয়া হাসতে হাসতে শেষ। দরজায় দাঁড়িয়ে নাজিয়ার প্রানখোলা হাসি দেখতে ব্যস্ত।

**

নিসার চোখ পড়ে দরজায় দাঁড়িয়ে থাকা আবরারের দিকে। আবরার একধ্যানে এইদিকেই তাকিয়ে আছে, নিসা মুখে হাসি ফুটিয়ে বলে উঠে,

– ‘আরে ভাই ওইখানে দাঁড়িয়ে আছো কেন? ভেতরে আসো।’

নিসার কথা শুনে আবির আর নাজিয়া দুজনেই দরজার দিকে তাকাল। আবরারকে দেখে নাজিয়ার মুখের হাসি উধাও হয়ে গেল।

নিসা আবরারকে ভেতরে আসতে বলতেই নাজিয়া উশখুশ করতে লাগল। নাজিয়ার উশখুশানি বুঝতে পেরে আরবার বলল,

– ‘না ভাবি ঠিক আছে, আসলে তোমার শরীর কেমন আছে সেটাই জিজ্ঞেস করতে এসেছিলাম।’
– ‘ভালোই করেছ, ভেতরে এসো তো দেখি সবাই মিলে একটু আড্ডা মারি।’

নিসার কথার উপরে কিছু বলতে না পেরে আবরার ভেতরে গিয়ে বসল। উঠে চলে গেলে খারাপ দেখায় তাই বাধ্য হয়েই নাজিয়াকে বসে থাকতে হচ্ছে।

– ‘তা ভাই এতদিন পর বাড়িতে ফিরলে, এইবার এইখানে থাকবে তো!’

নাজিয়া একটু চমকে উঠল। নিসার কথার অর্থটা ঠিক বুঝে উঠতে পারল না।

আবরার একপলক নাজিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,
– ‘দেখি কি হয়। কাজ পড়লেই আবারো ছুটতে হবে।’
– ‘এইভাবে আর কতদিন?’

আবির বিরক্ত হয়ে কথাটা বললো। আবরার কথাটির কোনো উত্তর দিলো না দেখে নিসা বলল,
– ‘ভাই বলি কি এইবার বিয়ে করে সংসারটা গুছিয়ে নাও। মায়ের ওহ বয়স হচ্ছে তো।’

– ‘বিয়ে তো করতেই চাই কিন্তু তোমার আদরের বোন তো আমাকে পাত্তাই দিচ্ছে না।’

মনের কথাটা মনেই থেকে গেল, মুখ ফুটে আর বলতে পারল না। কথাটা অন্যদিকে ঘোরানোর জন্য বলল,

– ‘আমার বিয়ে নিয়ে পড়লে কেন তোমরা।’
– ‘কেন গো তোমার বিয়ে নিয়ে কিছূ বলতে বারন নাকি?’
– ‘আরে না। ভাবি তোমার বোনের ওহ তো বয়স হচ্ছে তার বিয়ে নিয়ে তো কেউ কথা বলছো না তো।’

নাজিয়া ফোস করে উঠল, এইখানে আর বসে থাকা সম্ভব নয়। তাই কাজের বাহানা দিয়ে উঠে দাঁড়াল।

– ‘আমি রান্নাঘরে যায় রাতের রান্নাটা করতে হবে।’

কাউকে কিছু বলতে না দিয়েই নাজিয়া চলে গেল।‌নিসা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

– ‘মেয়েটা কেমন যেন হয়ে গেছে।’

আবরার বারবার ভেবেও বুঝে উঠতে পারছে না নাজিয়ার এই পরিবর্তনের কারন। আর না নাজিয়াকে জিজ্ঞেস করলে ওহ নিজে থেকে কিছু বলছে।

রাতে খাবার টেবিলে,

নাজিয়া কয়েকটা পদ রান্না করে খাবার টেবিলে সুন্দর করে সাজিয়ে দিলো। তারপরে সকলে ডেকে খেতে বসালো। নিসা খেতে বসতে চাইছিল না, নাজিয়ার জোড়াজুড়িতে খেতে বসতে বাধ্য হয়েছে। সবাইকে খেতে বসিয়ে নাজিয়া খাবার সার্ভ করে দিচ্ছিল তখনি নিসার শাশুড়ি বললেন,

– ‘আজকে খাবারটা খেতে পারব তো?’

ওনার এইরকম কথাতে নাজিয়ার মনটা খারাপ হয়ে গেল। উনি যেভাবে বলছেন এতটাও খারাপ রান্না করে না নাজিয়া। আবির নাজিয়ার গোমড়া মুখের দিকে তাকিয়ে বলল,
– ‘মা খাবারটা আগে খাও তারপরে না হয় বলো।’

আবির কথার উপরে আর কিছুই বলতে পারলেন না, এখন কথা বলা মানেই নিজের মনের অব্যক্ত কথাগুলো প্রকাশিত হয়ে যাওয়া আর সেটা এখন কিছুতেই করা যাবে না।

সবাই চুপচাপ খেতে লাগল, আবিরের মা খাবারটা মুখে দেওয়ার আগে সকলের দিকে তাকালেন। সকলেই বেশ তৃপ্তি করে খাচ্ছে বিশেষ করে ওনার স্বামী যিনি কিনা ওনার রান্নাতেও খুঁত ধরেন। সেই মানুষটা তৃপ্তি করে খাচ্ছে! আবিরের মা খাবারটা মুখে তুলে অবাক হয়ে গেলেন, সত্যি খাবারটা অতুলনীয়।

আবিরের বাবা খাওয়া শেষ করে হাসি মুখে বললেন,
– ‘এখন থেকে মাঝেমধ্যেই আমাকে রেঁধে খাওয়াতে হবে কিন্তু। আমি কিন্তু তোমার রান্নার ফ্যান হয়ে গেছি।’

নাজিয়ার মুখে তৃপ্তির হাসি ফুটে উঠল। তখন আবির বলল,
– ‘নাজু সত্যি খুব ভালো রান্না করে, আমি আগেও খেয়েছি তাই তো আজকে ওকে রাঁধতে বললাম।’

সকলের প্রশংসায় আবিরের মায়ের মুখটা রাগে লাল হয়ে গেল। নিজের মনে মনে বলল,
– ‘কখনো তো আমার রান্নায় এইরকম করে গুনগান করোনি কেউ। আজকে এই বাইরের মেয়ের রান্নার এত প্রশংসা।’

কোনো একটা কারনে নাজিয়াকে দুচোখে সহ্য করতে পারেনা আবিরের মা‌। নাজিয়া এই বাড়িতে এসে থাকবে এটাতে ওনার ঘোর আপত্তি ছিল কিন্তু ছেলে আর স্বামীর কাছে হার মেনে নিতে হয়েছে। তাই আচার আচরণে বারবার নাজিয়াকে বুঝিয়ে দিতে চাইছে ওর এই বাড়িতে থাকাটাই ওনার আপত্তি আছে।

নাজিয়া সব বুঝেও চুপ করে আছে, আবিরকে কথা দিয়েছে দিদির ডেলিভারির আগে কোনোভাবেই দিদিকে একা ছাড়বে না। নাজিয়াকে এই বাড়িতে আনার জন্য কম কাঠখড় পোড়ায়নি আবির। একরোখা,জেদি নাজিয়াকে মানাতে অনেকটাই কষ্ট করেছে আবির। তবে নাজিয়াকে এই বাড়িতে নিয়ে আসার পেছনে কি শুধুই নিসার দেখাশোনা নাকি আরো কিছু?

#চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে