এক অভিমানীর গল্প পর্ব- ০১

1
5711

এক অভিমানীর গল্প
পর্ব- ০১
লেখা- অনামিকা ইসলাম।

রুমভর্তি মানুষের সামনে ঠাস করে চড় বসিয়ে দিল বাঁধন মায়ার গালে। একে তো সারাদিনের অভুক্ত, তার উপর আবার চড়। তাল সামলাতে পারে নি মায়া। গালে হাত দিয়েই সোফায় বসে পরে সে। রুমে উপস্থিত মানুষজন আস্তে আস্তে যে যার বাসায় চলে যেতে শুরু করে।
এই মুহূর্তে মায়ার অবস্থান বাঁধনের খাটে। নিশ্চুপ মায়া খাটের এককোণে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। আর বাঁধন তারই পাশে। কিছুক্ষণ নিরবতা চলে দু’জনের মাঝে। বেশ কিছুক্ষণ পর নিরবতা ভেঙে মুখ খুলে বাঁধন। প্রশ্ন করে মায়াকে, কি? কি মনে করো তুমি নিজেকে? চুপিসারে মাথা নিচু করে আছে মায়া। বাঁধন ওর প্রশ্নের কোনো উত্তর না পেয়ে আরো জোরালো কন্ঠে বলে উঠে, চুপ করে আছো কেন? জবাব দাও। এভাবে আর কত? আমি যে আর পারছি না। পাগল হয়ে যাচ্ছি। এবার তো একটু শান্তি দাও! মানুষের মত বেঁচে থাকতে দাও। মায়া তখনো চুপ। মায়ার এই মৌনতা মেনে নিতে পারছে না বাঁধন। আর পারছে না বলেই আরো জোরে হুংকার দিয়ে উঠে সে- ” তোমার মত বয়সের/তোমার থেকেও ছোট এমন হাজারো মেয়ে আছে যারা শান্তিতে স্বামীর সংসার করছে। ওরা যদি পারে তবে তুমি কেন পারো না? কেন পারো না ৮,১০টা মেয়ের মত সংসার করতে? কেন আমার জীবনটাকে এভাবে শেষ করে দিচ্ছ ?” শেষ কথাটা শুনে অশ্রুভেঁজা চোখে বাঁধনের দিকে তাকাই মায়া। হয়তো এখনি কেঁদে দিবে। কিন্তু নাহ! মায়া কাঁদল না। শুধু খাট থেকে একটু নড়েচড়ে বসল। আর বাঁধন?!!! ওর রাগটা তখনো ছিল। ও জানে ও যদি এ রুমে থাকে মায়াকে আরো উল্টাপাল্টা কথা শুনিয়ে দিতে পারে। কিন্তু ও সেটা চাচ্ছে না। চাচ্ছে না বলেই ও সোজা রুম থেকে বের হয়ে বাহিরে চলে যায়। বাঁধন চলে যাওয়ার পর ধীরপায়ে মায়া বারান্দায় চলে যায়।

ঘন্টাখানেক পর বাসায় আসে বাঁধন। রাগটা এতক্ষণে সম্পূর্ণ চলে গেছে ওর। নিজেকে সম্পূর্ণ কন্ট্রোলে নিয়ে এসেছে ও। বাঁধন বুঝতে পারে রাগের বশবর্তী হয়ে ও কতটা জঘন্যভাবে আঘাত করেছে মায়াকে। যার চোখের একফোঁটা জল দেখলে পাগল হয়ে যেতাম, দিশেহারা হয়ে যেতাম, আজ তাকে খুব নির্মমভাবে আঘাত করলাম। অনেক কটুকাব্য শুনিয়ে দিলাম। যেই আমি ওর এই পাগলামীর প্রেমে পরে ভালোবেসেছিলাম ওকে, সেই আমি আজ এই পাগলামীর জন্য ওকে আঘাত করলাম? ওর মনে কষ্ট দিলাম? কি করে পারলাম আমি এতটা নির্দয় হতে? বাসায় ঢুকে উন্মাদ বাঁধন মায়াকে এদিক, ওদিক খুঁজে বেড়াচ্ছে। এ রুম, ওরুম, বাথরুম, কিচেন। সব, সব জায়গায় খুঁজ করেছে বাঁধন মায়ার। কোথাও মায়াকে খুঁজে পায়নি। নিচের তলায় ভাবীর কাছে গিয়েছে কি? আমি কি দেখে আসব নিচে? দেখেই আসি একবার।ছাঁদ থেকে খুঁজে এসে বাঁধন নিচতলায় ওর মামাত ভাই-ভাবির বাসায় খুঁজ করে। নাহ, এখানেও আসেনি। তবে কোথায় গিয়েছে ও? দিশেহারা বাঁধন দোতলায় ছুটে আসে আবারও। রুমটা ভালো করে খুঁজে কি মনে করে যেন বারান্দায় যায় সে। ওখানেই আবিস্কার করে বাঁধন তার স্ত্রী মায়াকে। বাঁধন চলে যাওয়ার পর হয়তো খুব করে কেঁদেছে, তারপর এখানে হেলান দিয়ে বসেই ঘুমিয়ে পরেছে। চোখের কোণে জমে থাকা অশ্রুকণা তারই জানান দিচ্ছে। কোনো কথা না বলে কোলে করে বাঁধন মায়াকে বিছানার কাছে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দেয়। তারপর কপালে আলতু করে চুমুর পরশ এঁকে দেয়।ফ্যানটা চালিয়ে গায়ে পাতলা চাদর টেনে দেয়।
বারান্দার গ্রিল ধরে একদৃষ্টিতে বাহির পানে তাকিয়ে আছে বাঁধন। চোখের কোণে জমে থাকা জলগুলো চিকচিক করছে ওর। আনমনে বাহিরের দিকে তাকিয়ে নিজে নিজেকেই গালি দিচ্ছে বাঁধন। এ আমি কি করলাম? সামান্য কারণে ওর গায়ে হাত তুললাম? ইচ্ছে হচ্ছে হাতটাকে ক্ষত-বিক্ষত করে দিতে।
সারারাত ছটফট যন্ত্রণায় কাটিয়ে মাঝ রাত্রে ঘুমানোর জন্য বিছানায় যায় বাঁধন। হাতে ভর দিয়ে ঘুমন্ত মায়ার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে বাঁধন। এভাবে রাত্রি কাটিয়ে শেষ রাত্রিতে ঘুমের দেশে তলিয়ে যায় বাঁধন।
ভোরের দিকে ঘুম ভেঙে যায় মায়ার। ঘুম ভাঙলে নিজেকে আবিষ্কার করে বাঁধনের খাটে। পাশেই বাঁধন শুয়ে। ঘুমন্ত বাঁধনের দিকে একবার তাকিয়ে বাঁধনের হাতটা আস্তে আস্তে মায়া ওর উপর থেকে সরিয়ে ফেলে। বিছানা থেকে উঠার সময় মাথাটা কেমন চক্কর দিয়ে উঠে। দাঁড়াতে চেয়েও বসে পরে বিছানায়। মনে করার চেষ্টা করে কি হয়েছিল রাত্রে। মায়ার খুব ভালো করেই মনে পড়ে যায় গত রাত্রের ঘটনা।
প্রতিদিনকার মত সেদিনও বাঁধনের চেম্বার থেকে ফিরতে দেরী হয়। আর এতেই রেগে গিয়ে বাঁধনের রুমের খাটের নিচে লুকিয়ে পরে মায়া বাঁধনকে শায়েস্তা করার জন্য। এদিকে বাঁধন? অফিস থেকে এসে দরজা খোলা পেয়ে ব্যাগটা রুমে রেখে ওয়াশরুমে চলে যায় বাঁধন। ওয়াশরুম থেকে ফিরে এসে তোয়ালে দিয়ে হাতমুখ মুছতে মুছতেই বাঁধন মায়াকে ডাকে। মায়ার সাড়া না পেয়ে ও রুমে যায়। কিন্তু ঐ রুমে তো মেহমান শুয়ে আছে। এভাবে দরজা ফাঁকা রেখে কোথায় গেল তাহলে ও? প্রথমে ছাদ, বারান্দা, কিচেন, বাথরুম তারপর উপরতলা, নিচতলার প্রতিটি বাসা হন্যে হয়ে খুঁজতে থাকে বাঁধন। যতই সময় অতিবাহিত হচ্ছিল বাঁধন ততই পাগল হয়ে যাচ্ছিল। উন্মাদের মত চিৎকার করতে করতে বাঁধন ওর মায়াকে ডাকতে থাকে। বাঁধনের চিৎকারে উপরতলা, নিচতলার সব ভাড়াটিয়ারা এসে হাজির হয়। উপস্থিত হয় বাঁধনের আপন মামাতো ভাই এবং ভাবি। যাদের ফ্ল্যাটে বাঁধন থাকে। সবার মুখেই শুধু এক কথা, কোথায় গেছে এই পাগলী? এ তো শহরের কিচ্ছু চিনে না। আচ্ছা, ঝগড়া হয়ছিল নাকি তোমাদের মাঝে? বাঁধন তুই কি মায়ারে কিছু বলছিস? মানে কোনো কারনে ওর সাথে রাগ দেখায়ছিস? একেকজনের একেক প্রশ্ন। পারছিল না বাঁধন। চেঁচিয়ে উঠে বলে, আমি কিচ্ছু জানিনা। আমার মায়াকে চাই, মায়া। ওকে ছাড়া আমার চলবে না। খাটের নিচে বালিশ পেতে শুয়েছিল মায়া। বাঁধনের কথা শুনে ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠল ওর। হাসি হাসি মুখে ভাবছে, ঠিকই আছে। আচ্ছা জব্দ হয়েছে ব্যাটা। মায়া এবার বেরিয়ে পর। সময় হয়েছে তোর ব্যাটা বজ্জাতের সামনে নিজেকে হাজির করার। সবাই যখন একে অপরের সাথে কথা বলছে মায়া তখন একটু একটু করে খাটের নিচ থেকে মাথা বের করে উঁকি দেয় ওর বাঁধনের দিকে। উপস্থিত জনতার চোখ বড় বড় হয়ে যায় খাটের নিচের দিকে তাকিয়ে। বাঁধনের দৃষ্টিও সেদিকে যায়;

চলবে……..

1 মন্তব্য

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে