#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_আগস্ট_২০২০
#ছোটগল্প_একা
#ক্যাটাগরি_স্যাড_এন্ডিং
#লেখা_ফাহমিদা_আঁখি
আধঘণ্টা যাবত আমি এবং আমার বান্ধবী নন্দিতা, বাসস্টপে দাঁড়িয়ে আছি। তবুও বাস আসার নাম নেই। নন্দিতা খুব বিরক্ত হচ্ছে। বিড়বিড় করে বাসের ড্রাইভারকে বকা দিয়ে তার গুষ্ঠি উদ্ধার করছে। কিন্তু আমার তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। আমার উৎসুক চোখদুটো তখন, এদিকওদিক কাউকে খুঁজে বেড়াচ্ছিল। আর ঠিক তখনই দেখতে পেলাম, চায়ের স্টলের পাশে দাঁড়িয়ে আছে সেই ছেলেটি। যে রোজ আমার কলেজ ছুটির পর, এখানে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। আর একটু পরপর আড়চোখে আমাকে দেখে। ছেলেটিকে দেখে আমার ঠোঁটে হাসি ফুটল। কেন, তা আমি জানি না। নন্দিতা আমার দৃষ্টি অনুসরণ করে বলল,
-কী ব্যাপার বল তো? ওই ছেলেটা বারবার তোর দিকে তাকাচ্ছে কেন?
আমি কিছু না বুঝার ভান করে বললাম,
-কোন ছেলেটা?
নন্দিতা আমার দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে বলল,
-আমাকে কি তুই বোকা মনে করিস? আমি জানি, ওই ছেলেটা রোজ এখানে তোর জন্য দাঁড়িয়ে থাকে। বল ঠিক কি না?
নন্দিতার চোখকে ফাঁকি দেয়া কঠিন। তাই হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে বললাম,
-হুম।
নন্দিতা মুচকি হেসে, আমার বাহুতে হালকা ধাক্কা দিয়ে বলল,
-কি সুন্দরী, ডুবে ডুবে জল খাওয়া হচ্ছে?
আমি লজ্জা পেয়ে বললাম,
-যাহ!, কী যে বলিস না। তুই যেমন ভাবছিস, তেমন কিন্তু নয়। ছেলেটি রোজ এখানে দাঁড়িয়ে থাকে। আর আড়চোখে আমাকে দেখে। আমি শুধু সেটা উপভোগ করি। এর বাহিরে আর কিছুনা।
নন্দিতা আমার দিকে বেশ অবাক চোখে তাকালো। ইতোমধ্যে বাস চলে আসায়, আমরা আর কথা না বাড়িয়ে বাসে উঠতে গেলাম। তখনই কেউ একজন ডেকে উঠলো,
-বিভাবরী?
আমি চমকে পেছন ফিরে তাকাতেই দেখলাম, সেই ছেলেটি। আমাকে পেছন ফিরতে দেখে, হঠাৎ ছেলেটি আমার দিকে একটা নীল রঙের খাম এগিয়ে দিল। বিস্ময়ে আমার তখন কোনো হুস ছিল না। মন্ত্রমুগ্ধের মতো আমি ছেলেটির দিকে তাকিয়ে ছিলাম। আর ভাবছিলাম, কারো গলার স্বর বুঝি এত সুন্দর হয়? নন্দিতা আমাকে তাড়া দিয়ে বলল,
-বিভা, তাড়াতাড়ি কর। এক্ষুণি বাস ছেড়ে দেবে।
তখনো আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। নন্দিতা আবারও আমাকে তাড়া দিয়ে বলল,
-বিভা, নিয়ে নে খামটা। দেরি হয়ে যাচ্ছে তো।
এতোক্ষণে নন্দিতার কথা আমার কর্ণকুহরে প্রবেশ করলো। আমি হাত বাড়িয়ে খামটা নিয়ে এক মুহূর্তেই বাসে উঠে পড়লাম। আমার খুব ইচ্ছে করছিল, একবার পেছন ফিরে দেখি, ছেলেটি এখনো কি আমার পানে চেয়ে আছে?
বাড়ি ফেরার পর, একছুটে নিজের ঘরে গিয়ে কোনোমতে দরজা বন্ধ করে দিলাম। আমার বুকটা দুরু দুরু কাঁপছিল। ভয়ে, উত্তেজনায় আমি ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে যাচ্ছিলাম। হাতের মুঠোয় ধরে রাখা এই নীল খামের ভেতরে কী আছে? ভালোবাসার চিঠি? নন্দিতা তো তেমনটাই বলছিল। আর দেখার জন্যও খুব জোর করছিল। কিন্তু আমার কেমন সংকোচ হচ্ছিল।
খামের ভেতরে একটা ধবধবে সাদা কাগজ খুব যত্নে ভাঁজ করে রাখা। আমি ভাঁজ খুলে দেখলাম, তাতে লেখা___
“বিভাবরী,
তোমাকে রোজ দেখি। আর বুকের ভেতর তোমার জন্য শতশত অনুভূতি জমিয়ে রাখি। এই অনুভূতির নাম কী জানো? এই অনুভূতির নাম ভালোবাসা। তুমি কি আমার জমিয়ে রাখা সেই অনুভূতির ডাকে সাড়া দেবে? সাড়া দেবে বিভাবরী?
ইতি
তোমার উত্তরের অপেক্ষায়
সেই ছেলেটি
চিঠিটা পড়ে আমার সারা শরীরে কাঁপন শুরু হলো। এমন সময় মায়ের গলা শুনতে পেলাম।
-বিভা, তোর হাতে ওটা কী?
আমি চমকে উঠলাম। মায়ের প্রশ্নে আমার গলা শুকিয়ে গেল। তৎক্ষণাৎ চিঠিটা মায়ের চোখের আড়াল করে ক্ষীণ স্বরে বললাম,
-কই, কিছু না তো।
মা আমাকে কিছুক্ষণ গোয়েন্দার মতো পর্যবেক্ষণ করে বলল,
-কলেজ থেকে ফিরে ফ্রেশ না হয়ে, দরজা বন্ধ করে বসে আছিস কেন? তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে খেতে আয়। টেবিলে খাবার দিয়েছি সেই কখন!
মা চলে গেল। আমি যেন হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।
সারারাত আমার ঘুম এলো না। আধো ঘুমে আধো জাগরণে শুধু সেই ছেলেটির কথাই ভাবতে লাগলাম।
পরদিন সকালবেলা, আমার যখন ঘুম ভাঙলো, তখন ঘড়িতে নয়টা বেজে কুড়ি মিনিট। আমি ধড়ফড়িয়ে বিছানায় উঠে বসলাম। এত বেলা হয়ে গেছে। অথচ আমাকে কেউ ডাকেনি কেন? আমি এখন কলেজে যাব কী করে? ঘর থেকে বের হতেই মা বলল,
-বিভা, তোকে আজ কলেজে যেতে হবে না। যা তুই ফ্রেশ হয়ে নে। পারলে গোসলটাও সেরে ফেল। আর ভালো দেখে একটা জামা পরবি।
মায়ের কথা আমি কিছুই বুঝলাম না। সব আমার মাথার ওপর দিয়ে গেল। আমি বললাম,
“এখনই জয়েন করুন আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে।
আর নিজের লেখা গল্প- কবিতা -পোস্ট করে অথবা অন্যের লেখা পড়ে গঠনমূলক সমালোচনা করে প্রতি সাপ্তাহে জিতে নিন বই সামগ্রী উপহার।
আমাদের গল্প পোকা ডট কম ফেসবুক গ্রুপে জয়েন করার জন্য এখানে ক্লিক করুন
-মা, আজ হঠাৎ আমি কলেজে যাব না কেন? আর তুমি এসব কী বলছো? ভালো দেখে একটা জামা পরবো মানে?
-যা বললাম, তাই কর। তোর এত প্রশ্নের উত্তর আমি এখন দিতে পারবো না। সময় হলেই সব জানতে পারবি।
আমার মনের ভেতর খচখচ করতে লাগলো। কলেজে যেতে না পারায় অস্থিরতায় ছটফট করতে লাগলাম।
বেলা এগারোটা নাগাদ আমি জানতে পারলাম, আমাকে পাত্রপক্ষ দেখতে আসছে। আমার অস্থিরতা আরও বেড়ে গেল। কী করবো কিছুই বুঝতে পারছি না। এরমধ্যেই পাত্রপক্ষ এসে হাজির। ক্ষাণিক পরে, আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমাকে পাত্রপক্ষের সামনে হাজির করানো হলো। চোখের পলকে সবটা কেমন বদলে যেতে লাগলো।
পাত্রপক্ষ আমাকে পছন্দ করেছে। আর আজকেই তারা বিয়ে পড়িয়ে বউ নিয়ে বাড়ি ফিরতে চায়। আমার বাবা তাদের এই প্রস্তাবে এক কথায় রাজী হয়ে গেলেন। বাবা খুব রাগী এবং একগুঁয়ে স্বভাবের মানুষ। বাড়ির কেউ তার মতের বিরুদ্ধে যেতে পারে না। এমনকি মাও নন। তবুও আমি মাকে কাকুতিমিনতি করে বললাম,
-মা, তুমি বাবাকে একবার বলো, আমি এখন বিয়ে করতে চাই না। প্লিজ! একবার বাবাকে বলো।
মা আমার কথায় কান না দিয়ে বলল,
-মেয়ে হয়ে যখন জন্মেছিস। তখন বিয়ে তো করতেই হবে। তা একটু আগে হোক কিংবা পরে। আর তোর বাবাকে বলার কথা বলছিস? তুই তো জানিস, তোর বাবা কেমন। সে নিজের সিদ্ধান্তে অনড়। তাই তুই আর অমত করে অশান্তি করিস না। আমরা আগেই খবর নিয়ে দেখেছি। ছেলে খুব ভালো। ঢাকায় চাকরি করে। দেখিস, তুই খুব সুখী হবি।
আমার বুক ভেঙ্গে কান্না এলো। কেউ আমার মন বুঝল না। নিজের ভেতরটা কেমন অনুভূতি শূন্য মনে হলো। কী করবো আমি? এখন আমার কী করা উচিত? পালিয়ে যাব? কিন্তু কোথায় যাব? তাছাড়া পালিয়ে গেলে বাবার সম্মানের কী হবে?
ধীর পায়ে নিজের ঘরে গিয়ে, বইয়ের ভাঁজে লুকিয়ে রাখা সেই চিঠিটা হাতে নিয়ে কুটিকুটি করে ছিঁড়ে জানালা দিয়ে উড়িয়ে দিলাম। আমার মনের মাঝে লুকানো অনুভূতিগুলো আমি আমার মনের মাঝেই চিরদিনের জন্য কবর দিয়ে, পরিবারের সিদ্ধান্ত মেনে নিলাম। নিজের মনকে প্রবোধ দিলাম এই ভেবে যে, মানুষের জীবনে সব চাওয়া পাওয়া কখনো পূরণ হয় না।
সেদিন রাতেই আমার বিয়ে হয়ে গেল। বিদায়বেলায় মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন। আমার ভেতরটা তখন অন্তঃসার শূন্য। চেষ্টা করেও দু’চোখে একফোঁটা জল আনতে পারলাম না।
বিয়ের প্রথম রাতেই আমার স্বামী আমাকে বললেন,
-শোনো, এ বাড়িতে আমার বাবা-মা যা বলবেন, সেটাই তোমাকে মেনে চলতে হবে। এই কথাটা খুব ভালো করে মনে রাখবে। তাদের কখনো অসম্মান করবে না।
আমি বুঝতে পারলাম, আমার স্বামী বাবা-মার খুব একনিষ্ঠ এবং বাধ্য ছেলে। আমি তার কথা মেনে নিলাম। আমার অতীত অনুভূতি ভুলে আমি তাকে নিয়ে ভাবতে শুরু করলাম। তার কী ভালোলাগে, কী ভালোলাগে না এসব নিয়ে মেতে উঠলাম। কিন্তু দিনশেষে, সে পাশে থাকলেও আমি সেই আমার কাছেই পড়ে রইলাম। তার মনের কাছে পৌঁছাতে পারলাম না। আমার চারপাশ নিঃসঙ্গতায় ছেয়ে যেতে লাগলো।
আমার স্বামী খুব গম্ভীর স্বভাবের একজন মানুষ। সে কখনো আমার সঙ্গে হেসে কথা বলে না। উল্টো আমাকে হাসতে দেখলে বলে, ‘এভাবে হাসছো কেন? এ বাড়িতে এসব হাসাহাসি কেউ পছন্দ করে না।’ তার কথা শুনে আমার হাসি কর্পূরের মতো উবে যেত। আর কখনো হয়তো আমার হাসির শব্দ কেউ শুনতে পাবে না।
চাকরি সূত্রে আমার স্বামীকে ঢাকায় থাকতে হয়। মাঝেমাঝে ছুটিতে আসে। কিন্তু তার ছুটিতে আসা আমার একাকীত্ব দূর করতে পারে না। বেশিরভাগ রাত পার করি না ঘুমিয়ে। কারণ, ঘুম আসতেই চায় না। কখনো যদি ঘুমিয়েও যাই, মাঝরাতে হঠাৎ জেগে উঠি। তখন জানালা খুলে আকাশ পানে চেয়ে থাকি। আর আমার ঘুমন্ত স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলি, ‘এমন জ্যোৎস্না প্লাবিত রাতে কেউ এভাবে ঘুমিয়ে কাটায়?’ ঘুম থেকে তাকে জাগিয়ে তুলে যদি বলি,
-চলুন না একটু ছাদে যাই।
তিনি বিরক্ত হয়ে বলেন,
-রাতের বেলা ছাদে গিয়ে কী হবে? অদ্ভুত কথাবার্তা। ঘুমাও এখন।
আমি তাকে কিছুতেই বুঝাতে পারি না, আমার একাকীত্বের কথা।
একদিন তাকে বললাম,
-আমার এখানে খুব একলা লাগে। আমি কি আপনার সঙ্গে ঢাকায় গিয়ে থাকতে পারি না?
তিনি আমার কথায় কপালে ভাঁজ ফেলে বললেন,
-একলা লাগার কী আছে? তুমি তো এখানে একা থাকো না। মা আছেন, বাবা আছেন।
আমার সব চাওয়া পাওয়া তার যুক্তির কাছে হার মেনে যায়।
মাস খানিক পর, আমার বড় ভাই প্রথমবার আমার শ্বশুরবাড়িতে এলো। বিয়ের সময় সে বিদেশে ছিল। থাকলে হয়তো আমার জীবনটা এমন হতো না। কতগুলো বছর পর তাকে দেখতে পেলাম। আনন্দে আমার চোখে পানি এসে গেল। সে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলল,
-কেমন আছিস বিভা?
আমি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম। ভাইয়া আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল,
-এই পাগলি, কাঁদছিস কেন?
আমি অভিমানী গলায় বললাম,
এতদিন পর আমার কথা মনে পড়লো? তুমি তো আমাকে ভুলেই গেছো।
ভাইয়া হেসে বলল,
-ভুলেই যদি যেতাম, তাহলে আজ তোকে দেখতে এলাম কেন?
তারপর ভাইয়া, আমার হাতে একটা বড় প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বলল,
-এই নে, তোর বিয়ের উপহার। বিয়ের সময় তো ছিলাম না। তাই আজ দিলাম।
আমি প্যাকেটটা হাতে নিয়ে বললাম,
-কি আছে এতে?
-তোর প্রিয় বইগুলো।
এ কথা শুনে খুশিতে আমি আত্মহারা হয়ে গেলাম। এরমধ্যেই আমার স্বামী এবং আমার শ্বশুরমশাই এসে হাজির হলেন। ভাইয়ার সঙ্গে তারা কুশল বিনিময় করলেন। তারপর আমার শ্বশুর নিজের ঘরে যাওয়ার আগে আমার স্বামীর উদ্দেশ্যে বললেন,
-হাসান, বউমাকে বলে দিও। এ বাড়ির মেয়ে, বউরা ওসব গল্প, উপন্যাসের বই টই পড়ে না।
আমি বুঝতে পারলাম, তিনি পরোক্ষভাবে কথাগুলো আমাকে বলে গেলেন। আমরা ভাইবোন মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম। ভাইয়া হয়তো বুঝতে পারলো, এ বাড়িতে আমি কেমন আছি। ঠিক কতটা ভালো আছি। মুখ ভার করে সে বইগুলো নিয়ে চলে গেল। হয়তো আর কখনো এ বাড়িতে আসবে না। আমার মনটা বিষণ্ণতায় ভরে গেল।
কিছুদিন পর, আমার বান্ধবী নন্দিতা এলো আমাকে দেখতে। আমি ভাবতেই পারিনি, নন্দিতা আমাকে এভাবে চমকে দেবে। ওকে পেয়ে ক্ষণকালের জন্য আমি আমার একাকীত্ব ভুলে গেলাম। নন্দিতা এখন বিবাহিত। আমার বিয়ের কিছুদিন পরেই ওর বিয়ে হয়ে যায়। বিবাহিত জীবন নিয়ে দুজনে বেশ গল্পসল্প করলাম। বেশিরভাগ ওই বলল। আমি শুধু শুনে গেলাম। ওর স্বামী ওর প্রতি খুব যত্নশীল। ওকে ছাড়া এক মুহূর্ত চলতে পারে না। এক কথায় ওকে চোখে হারায়। আমার হঠাৎ সেই ছেলেটির কথা মনে পড়লো। যে বাসস্টপে আমাকে দেখার জন্য রোজ দাঁড়িয়ে থাকতো। আমার একবার ইচ্ছে হলো, নন্দিতাকে বলি, সেই ছেলেটিকে আর কখনো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিল কি না। কিন্তু বলতে পারলাম না। নন্দিতা হয়তো সেসব কথা ভুলেই গেছে।
নন্দিতা চলে গেল। ও চলে যাবার পর, আমার শাশুড়ি মা বললেন,
-মেয়েটা হিন্দু না কি?
তার কথা বলার ধরণ দেখে বুঝলাম, নন্দিতার এ বাড়িতে আসা তিনি পছন্দ করেননি। আমি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম।
বাবা-মা আমার অমতে বিয়ে দিয়েছিল বলে, বিয়ের পর আমি একদিনের জন্যও বাবার বাড়িতে যাই নি। কিন্তু এ বাড়িতে আমার মন আর টিকতে পারছিল না। তাই সবার অনুমতি নিয়ে বাবার বাড়িতে চলে এলাম। আমাকে দেখে বাবা-মার চোখ থেকে অানন্দ অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। ভাইয়া বাড়িতে নেই। আবারও বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। আমি চুপচাপ নিজের ঘরে গেলাম। ঘরে গিয়ে দেখলাম, ভাইয়ার দেওয়া বইগুলো আমার বুকশেলফ এ সুন্দর করে সাজানো। আমি পরম আবেশে সেগুলো ছুঁয়ে দেখলাম। একসময় এই বইগুলোই ছিল আমার বন্ধু, আমার অবসরের সঙ্গী। হঠাৎ কেউ আমার মাথায় হাত রাখলো। আমি তাকাতেই দেখলাম, মা। মা আমাকে বলল,
-কেমন আছিস মা?
আমি জানালার দিকে তাকিয়ে বললাম,
-জানি না মা। ও বাড়িতে আমার নিজেকে খুব একলা লাগে।
-প্রথম প্রথম সব মেয়েরই এমন হয়। কিছুদিন পর দেখবি সব ঠিক হয়ে গেছে।
-ও বাড়িতে উচ্চস্বরে কথা বলা বারণ, প্রাণ খুলে হাসা বারণ। এভাবে কি থাকা যায় বলো?
মা আমাকে বুঝানোর স্বরে বলল,
-সব পরিবারেরই নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম থাকে। পরিবারের সদস্য হিসেবে তোর এসব মেনে চলা কর্তব্য। তাহলেই সংসারের শান্তি বজায় থাকবে। তাছাড়া তোর শ্বশুরবাড়িই তো এখন তোর নিজের বাড়ি।
আমি মাকে আর কিছু বললাম না। শুধু মনে মনে বললাম, ‘যে বাড়িতে সবাই থাকা সত্ত্বেও নিজেকে একলা লাগে, সেই বাড়ি কী করে নিজের বাড়ি হয় মা?
বাবার বাড়িতে থাকাকালীন আমি বুঝতে পারলাম, আমি মা হতে চলেছি। তখন আমার মনে হলো, এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ হলাম আমি। আমার মা হবার সংবাদ শুনে আমার স্বামী, শ্বশুরবাড়ির লোকজন কতটা খুশি হয়েছে, তা আমি জানি না। শুধু জানি, এবার আমার একলা থাকার পালা শেষ হবে। আমি আমার অনাগত সন্তানের উদ্দেশ্যে বললাম, ‘শুনছিস, তুই আমার একলা প্রহরের সঙ্গী হবি। তোর ছোট ছোট হাতের আঙুলের পরশে ভুলে যাব জীবনের সব নিঃসঙ্গতা, নির্জনতার কথা।’
এক একটা দিন কেটে যেতে লাগলো। আর আমি অনুভব করতে লাগলাম, আমার ভেতরে ধীরে ধীরে বেড়ে উঠছে এক নতুন প্রাণ। মনে মনে বললাম, আর তো মাত্র কটা দিন। তারপর আমার একাকীত্ব দূর হবে। কিন্তু একদিন, আমার পেটে প্রচণ্ড ব্যথা শুরু হলো। ডেলিভারির তখনো অনেক দেরি। প্রচণ্ড ব্যথায় আমি জ্ঞান হারালাম। আর যখন আমার জ্ঞান ফিরলো, তখন জানতে পারলাম, আমি এক মৃত সন্তানের জন্ম দিয়েছি। এ কথা আমার বিশ্বাস হলো না। অদূরে দাঁড়িয়ে আমার মা তখন নীরবে চোখের জল ফেলছিল। আমি চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে বলতে লাগলাম, ‘হে পরম করুণাময়, তুমি আমার জীবনের বিনিময়ে আমার সন্তানকে কেন বাঁচিয়ে রাখলে না? ওকে ছাড়া আমি যে আবারও একলা হয়ে গেলাম।’
সন্তান হারানোর শোকে আমি যখন বিপর্যস্ত। তখনো আমার স্বামীকে আমার পাশে পেলাম না। আমাদের মাঝে দূরত্বটা আরও দ্বিগুণ হলো। আমি অনুভব করলাম, আমি আমার চিবুকের কাছেও বড্ড একা। হয়তো জীবনের বাকী প্রহরগুলোও আকাশের ওই নিঃসঙ্গ নক্ষত্রের মতো কাটাব একা একা।
সমাপ্ত