একরাত্রির গল্প – লেখা: মাহমুদা মিনি

0
768

#গল্পপোকা_ছোটগল্প_প্রতিযোগিতা_আগস্ট_২০২০
গল্প: একরাত্রির গল্প
ক্যাটাগরি: রোমান্টিক
লেখা: মাহমুদা মিনি
.
প্রচণ্ড শীতে প্রকৃতির মতোই কাজলা পাড়ের মানুষের দেহগুলোও জীর্ণ হয়ে পড়েছে। গ্রাম্য কুটিরগুলো যেন সকাল-সন্ধ্যা হিমেল বাতাসে থরথর করে কাঁপে। সন্ধ্যা বা ভোরে যখন কুয়াশা নদীর বুক দিয়ে সাপের মতো এঁকেবেঁকে ভেসে বেড়ায় তখন জনজীবন থমকে পড়ে। বিশেষ দরকার ছাড়া কেউ তখন ঘর ছেড়ে বেরোতে চায় না। কিন্তু তখনও নদীপাড়ের হতদরিদ্র মানুষগুলোকে কাজের সন্ধানে বেরোতে হয়। গায়ের ছেড়া পোশাক আর খালি পায়ে লাগা শীতকে তখন মানুষগুলো দাঁতে চেপে সহ্য করে নেয়।

মাগরিবের আজান পড়তেই সফির তার একমাত্র ছেঁড়া সোয়েটারটা পরে নিয়ে, গামছা দিয়ে মাথা পেচিয়ে খালি পায়ে ঘর থেকে বেরোতে গেল। ওকে বেরোতে দেখে মা চিৎকার করে বলল,
“এই সন্ধ্যে বেলা কনে যাচ্ছিস বাজান? চারদিকে সাপখোপের আস্তানা। ওদিকে তোর আব্বার অবস্থাডাও ভালো না, উনার কাশি উঠিছে।”
সফির হাতদুটো এক করে তালুতে কয়েকটা ঘষা দিয়ে দাঁতে-দাঁত চেপে বলল,
“জেলেপাড়ায় যাত্রার দল আইছে মা। আমি হাশমতগের সাতে তাই দেখতি যাচ্চি। পুহাতের আগে চইলে আসবানি।চিন্তা করিস নে।”
সফিরের মা খাদেজা বেগম আবারও উচ্চস্বরে বলে উঠলো,
“কতবার কইছি ওসব যাত্রা দেখতি যাতি হবে না। কিডা শোনে কার কতা! এদিকি বাপ যায়-যায়, আর ছাওয়ালে যাত্রা দেকতি যাচ্ছে!”

সফির তার মায়ের কথায় বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে বাড়ির বাইরে বেরিয়ে গেল। এই জগতে তার যক্ষায় আক্রান্ত বাবা আর এই মা ছাড়া কেউ নেই। নদীতে জাল ফেলে আর পরের ক্ষেতে মজুরি খেটেই তার জীবিকানির্বাহ চলে। তার মা ঘরে বসে ঝুড়ি, চালন বোনে, সেসব বিক্রি করেও সংসারের খরচ কিছুটা চলে। তবে সফিরের মা একটু মুখরা। অকারণে সারাদিন সফির আর ওর বাবাকে গালমন্দ করে। অবশ্য সফির নিজেও জানে তার মায়ের এই অহেতুক মেজাজের কারণ। তিনি চান সফির বিয়ে করুক। সংসার করুক। কিন্তু বিয়ের বয়স হয়ে গেলেও সফিরের কোনো মেয়েকেই পছন্দ হচ্ছে না।

হাশমতের বাড়ির সামনে এসে বড় পুকুরটার সামনে দাঁড়াতেই সফিরের গায়ে কাঁপুনি দিলো। উত্তর দিকের মাঠ থেকে দমকা বাতাস এসে সরাসরি তার গায়ে লাগছে। অগত্যা সে শীত সহ্য করতে হাতের আঙ্গুলগুলো মুঠো পাকিয়ে হাশমতকে ডাক দিলো। বাড়ির ভেতর থেকে জবাব আসলো যে হাশমত অনেক আগেই দলবলসহ জেলে পাড়ায় চলে গিয়েছে।

সফির হতাশ হয়ে পড়লো। সে ভেবেছিল হাশমতের ব্যাটারিচালিত টর্চ লাইটের আলোয় দিব্যি যাত্রার স্থানে পৌঁছানো যাবে। চারদিকে যে সাপের উপদ্রব! কিন্তু সে আশার গুড়ে বালি পড়তেই চারদিকের অন্ধকার পরখ করে নিয়ে কাঁচা রাস্তা ধরে সামনে এগোতে থাকলো।

গুনগুন করে একটা গান ধরে আনমনে হাঁটতে-হাঁটতে সে জেলেপাড়ায় পৌঁছে গেল। হ্যাচাকের আলো দেখে ফাঁকা মাঠের মতো জায়গাটাতে গিয়ে সে এদিক-ওদিক তাকালো। জায়গাটার মাঝখানে একটা স্টেজ মতো সাজানো হয়েছে। চারদিকে পর্দার বেষ্টনী, মাথার উপর খোলা আকাশ। এতক্ষণ একটানা হাঁটাতে গা গরম হয়ে গিয়েছে। ওদিকে যাত্রা শুরুর প্রস্তুতি চলছে। তাই সে বেশ উচ্ছ্বাসিত হয়ে হাশমতকে খুঁজতে শুরু করলো। অবশেষে হাশমতকে স্টেজের কাছে এক কোণায় বসে বিড়ি টানতে দেখা গেল। সফির একগাল হেসে ওর পাশে গিয়ে বসতেই হাশমত বলল,
“শুনিচিস সফু? ইবার যে পালা হবে তাতে নায়িকা কিডা? নায়িকা হলো সুরমা। সে নাকি বড়-বড় সব পালা করিছে। দেখতিও হেব্বি সুন্দরী। আমার তো পালা দেহার জন্যি তর সচ্ছে না।”
সফির হঠাৎ চমকে উঠে বলল,
“কী নাম কলি? সুরমা? দেখতি সুন্দরী?”
হাশমত গভীর আগ্রহের সাথে নানান কথা বলে গেল। কিন্তু সফির সেদিকে ভ্রুক্ষেপও করলো না। ওর মনটা কেমন আনচান করছে। এই নামটা যে বড় চেনা…

যাত্রাপালা শুরু হয়ে গেল। বেহুলা-লক্ষ্মীন্দরের পালা চলছে। বেহুলা প্রথমে মুখ ঢেকে রেখেছিল, হঠাৎ মুখের সামনে থেকে আঁচল সরাতেই সফির আঁৎকে উঠল। তার বুকের ভেতর হাতুড়ির ঘা পড়তে থাকলো। হাশমতরা তখন সুরমার অভিনয়ে চোখ বড় বড় করে ফেলেছে। পালা দেখতে আসা সমস্ত দর্শক যখন বেহুলার শোক দেখে অশ্রুপাত করছে ঠিক তখনই সফির সবার অলক্ষ্যে ওখান থেকে সরে পড়লো।

খানিকটা দূরে একটা খোলা জায়গাতে এসে সে হাত-পা ছড়িয়ে দিয়ে বসে পড়লো। এখন মাথার উপর মস্ত আকাশটা ছাড়া তার সাথে আর কেউ নেই। তার মুখটা নিচের দিকে ঝুলে পড়েছে। হৃৎস্পন্দন কমেনি, বরং ক্রমশ বাড়ছে।

এই সেই সুরমা। যার বাড়ি সাত ক্রোশ দূরে। সফিরের ফুফু বাড়ির পাশেই ওর বাড়ি ছিল। সফির তখন ফুফুবাড়িতেই থাকতো। সাত বছর আগে সে ফুফুবাড়ি থেকে একেবারে চলে এসেছিল, ফেলে এসেছিল সুরমাকে। অবশ্য সুরমাই একদিন তাকে ডেকে বলেছিল যে সে আর সফিরের মতো সহায়-সম্বলহীন ছেলের জন্য অপেক্ষা করতে পারবে না। সে তার বাবার পছন্দের ছেলেকে বিয়ে করে নিবে। সফির যেন তার সুখের পথে বাধা না হয়।

তারপর আর ওদের দেখা হয়নি। আজ হঠাৎ সাতবছর পর দেখা। অবশ্য সুরমা তো আর তাকে দেখেনি। যাত্রা না দেখলেও কী এক টানে যেন সফির যাত্রার স্থানের আশেপাশে অস্থিরভাবে ঘুরঘুর করতে থাকলো।

যাত্রা শেষ হতেই সে স্টেজের পেছনদিকের পথে গিয়ে দাঁড়ালো। একটা ঘোমটা দেওয়া মহিলার অবয়ব তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখেই সে কাশি দিলো। মহিলা চমকে উঠে থমকে দাঁড়ালো। সফির কাঁপাকাপা গলায় বলল,
“আমি সফু।”
মহিলাটি আচমকা সফিরের মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়ে ভীত কণ্ঠে বলল,
“মাঝি? তুমি কেবা আছো?”
সফির কী বলবে তা ভেবে কুলকিনারা না পেয়ে বলল,
“আছি বেশ। তুমি কিরাম আছো?”
সুরমা বলল,
“চলো হাঁটতি-হাঁটতি কতা কই। আমি তারিক জুয়াদ্দারের বাড়ি থাকবো। বাড়িটা তো চেনো?”
“হু, চিনি। চলো।”
“তা মাঝি, বিয়েশাদি করছো নাই?”
সফির একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,
“ঘর-সংসার আমার দ্বারা হবে নারে সুরু। তোমার খবর কও। বিয়ে কইরে তো শহরে গিছিলে শুনিছিলাম। তারপর তুমি যাত্রার দলে কেন? বর কনে?”
এতক্ষণে সুরমার আটকে রাখা কান্না আর বাঁধ মানলো না। সে আঁচল চাপা দিয়ে হু হু করে কেঁদে ফেললো। তারপর কিছুক্ষণ দুজনে চুপচাপ হাঁটলো। রাতের নিস্তব্ধতা পেরিয়ে সুরমার মৃদু কান্নার আওয়াজ সফিরের ঠিক বুকে এসে লাগছে। তবে এতে সে কষ্টের বদলে সুখ অনুভব করছে। সেই সুরমা, আজ এই নির্জন রাতে তার সাথে কয়েক কদম হাঁটছে। এ কী কম বড় প্রাপ্তি?

কিছুদূর এগিয়ে সুরমা বলতে থাকলো,
“ঐ মিনশে আমারে বিয়ে কইরে শহরে নিয়ে গিছিল। তারপর এক যাত্রার দলের কাছে বেইচে দিয়ে আমারে তালাক দিয়ে কোথায় যেন চইলে গেছে। আর কোনোকালে খোঁজ নেয়নি। আমি সেই যাত্রাদল থেকে পলাইয়ে আইসে এই নতুন দলে যোগ দিছি। আব্বা-মা বাড়ি উঠতি দেয়নি, খাবোটা কী?”
সফিরের বুকচিরে আরেকটা বড় দীর্ঘশ্বাস বেরোলো। সে বলল,
“মন খারাপ করো না। সবই তো কপালের লিখন। তোমার-আমার কিছু করার ছিল না।”
সুরমা চোখমুখ মুছে বলল,
“এসব আমার পাপের ফল। আমি তোমারে ঠকাইছিলাম। বড় লোকের ছেলে দেইখে তোমারে কষ্ট দিছিলাম, তার উপযুক্ত ফল পাইছি। এহন আমার কোনো পথ খুলা নেই। আমি এহন যাত্রার ভাড়াটে নায়িকা। মানুষির মনোরঞ্জন করি।”
সফির আচমকা অন্ধকারে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো। সুরমার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে খপ করে ওর ডানহাতটা শক্ত করে চেপে ধরে বলল,
“তুমি আমার হবা সুরু?”
সুরমা জবাব দেবার আগেই আহ্ বলে চিৎকার করে মাটিতে বসে পড়লো। তারপর চিৎকার করে বলল,
“আমারে সাপে কাটিয়ে মাঝি। আমি আর বাঁচবো না। শেষবারের মতো ক্ষমা করে দিও।”

রাত প্রায় শেষের দিকে।
সফির নদীর পাড় বেয়ে সুরমার একটা হাত জাপটে ধরে ওকে ওর বাড়ির দিকে নিয়ে আসছে। সুরমার গায়ে তখন যাত্রাদলের দামী একটা বেনারসি। তবে সাপে কাটার পর ধুলোবালি লেগে তার সাজ একেবারে নষ্ট হয়ে গিয়েছে। নদীপাড়ের তীব্র শীতল বাতাসেও সফির আর কাঁপছে না, ওর কলিজাও কাঁপছে না। সে তার গামছাটা মাথা থেকে খুলে বহু আগেই সুরমার মাথা ঢেকে দিয়েছে। তীব্র শীত উপেক্ষা করে তার জীর্ণ দেহের শুষ্ক ঠোঁটে একচিলতে হাসি লেগেই আছে। সুরমা হঠাৎ একটা ঘাট দেখে দাঁড়িয়ে বলল,
“মাঝি? আমি একটু হাতমুখ ধোবো? আমারে সম্ভবত বিশ্রী দেখাচ্ছে!”
সফির হেসে বলল,
“তুমি এখনও সুন্দরী আছো সুরু।”

সুরমা মৃদু হেসে মুখ ধুতে বসে গেল। সে সাপে কাটার পরের ঘটনা মনে করে হাসছে। ঐ তো রোগা-পটকা শরীরের মানুষটা! সে ঐ রাতে সুরমাকে কোলে তুলে নিয়ে ওঝার বাড়ি অব্দি কী করে ছুটেছে এটা ভেবেই সে অবাক হচ্ছে। মানুষটা আজও তাকে বড় ভালোবাসে। তাই তো ওঝাবাড়ি থেকে ফেরার পথে হুজুরের কাছে গিয়ে তাকে বিয়ে করে নিয়েছে। সুরমা আপত্তি করেছিল, তবে মানুষটা শোনেনি। সে নাকি সমাজের তোয়াক্কা করে না!…

হাতমুখ ধুয়ে সুরমা স্বামীর সাথে শ্বশুরবাড়ির দিকে হাঁটতে শুরু করলো। সে জানে না যে ওবাড়িতে তার জন্য কী অপেক্ষা করছে, তারা মেনে নিবে কিনা, সমাজ কী বলবে! তবে সে এটা জানে যে এই মানুষটা তাকে কখনও ফেলবে না। তার প্রমাণ সে সাপে কাটার পরই পেয়েছে।

হঠাৎ বাড়ির কাছাকাছি এসে সফির থমকে দাঁড়ালো, তারপর কুয়াশার ভেতর দিয়ে হারিয়ে গেল। মিনিটখানেক পর হাতে একটা টকটকে শিমুল ফুল নিয়ে এসে সুরমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল,
“আমি তোরে বড় ভালোবাসি সুরু। কখনও সমাজের ভয়ে, লোকলজ্জার ভয়ে আমারে ছাইড়ে যাবি না তো?”
সুরমা মানুষটার পাগলামি দেখে খিলখিল করে হেসে উঠে বলল,
“থাক। বুড়োকালে আর ঢং করতি হবে না। আমি আর কোথাও পালাচ্ছি না। ইবার আর সত্যিকারের ভালোবাসারে হাইরে যাতি দেবো না। তোমার সুরু তোমারই হলো। বাড়ি চলো তো!”

কাজলা নদী এবং নদীপাড় তখন আরেকটা সুখী মানুষের উচ্ছ্বাসিত হাসির সাক্ষী হলো। যুগ-যুগ ধরে বয়ে চলা কাজলার বুকে স্মৃতি হয়ে বাঁধা পড়লো আরেকটা নতুন প্রেমকাহিনী…
.
সমাপ্ত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে