‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️
||পর্ব~৬৬||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা
৯৯.
“আপনার মেয়েকে খাওয়াতে পড়াতে তো যেকোনো বড়লোকের ছেলে পারবে কিন্তু ভালোবাসা দিয়ে রাজরানী করে রাখতে শুধুমাত্র এই রাজই পারবে।”
মুম্বাইয়ের একটা বেশ বড়ো এপার্টমেন্টের মাঝামাঝি ফ্লোরে অবস্থিত নিজের ঘরের ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে, কোয়েল কথাটা মনে মনে আওড়াচ্ছিলো। নিজে রোজগরের দ্বারায় সে তাঁর মা’কে এখানে রেখেছে যাতে আশীষবাবু ওনার নাগাল না পায়। দরজায় ‘ঠকঠক’ শব্দ পেয়ে পিছন ঘুরলো। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলেই সে আবার ব্যালকনিতে চলে আসতে নিলে, তাঁর হাতে পিছন থেকে টান অনুভব করে। সে পিছন না ফিরে নিজের জায়গায় স্থির হয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে থাকে।
__আমি জানি অভিমান করে আছো তুমি আমার উপরে। কিন্তু এখনও অনেক কিছু জানা বাকি আছে তোমার।
কোয়েল: আরো কি কি তুমি আমার থেকে লুকিয়ে গেছো রাজ, বলবে আমাকে?
রাজ: হম, বলার জন্যেই তো এখানে এসেছি আমরা।
কোয়েল: মিস্টার ব্যানার্জীকে এখানে কেন নিয়ে এসেছো? এটা আমার আর আমার মায়ের ফ্ল্যাট রাজ। আমার থেকে পারমিশন না নিয়ে তুমি ওনাকে এখানে নিয়ে আসতে পারো না।
রাজ: আমার কথাটা যদি পুরো শোনো তাহলে তোমার এই মনোভাব নিমিষে দূর হয়ে যাবে। উনি তোমার বাবা কোয়েল, এভাবে ওনাকে দূরে সরিয়ে রাখাটা ঠিক হচ্ছে না।
কোয়েল: এতো কিছু ঘটে যাওয়ার পরও তুমি এটা বলছো রাজ?
রাজ: হ্যাঁ কারণ….
ফ্ল্যাশব্যাক………………
রাজ: আগেরদিন আমাকে নিজের ঘরে ডেকেছিলেন আর আজ নিজে আমার বাড়িতে এসেছেন। কি ব্যাপার মিস্টার ব্যানার্জী? আরো কিছু কি বলা বাকি আছে?
আশীষবাবু: বলা তো বাকি আছেই কিন্তু তার সাথে আমার একটা রিকুয়েস্ট আছে তোমার কাছে।
রাজ: আমার কাছে রিকুয়েস্ট? ঠিক শুনছি তো আমি?
আশীষবাবু মাথা নুইয়ে ফেললে রাজের মনেও কিছু প্রশ্নের সঞ্চার হয়। তৎক্ষণাৎ রাজ জিজ্ঞেস করে বসে,
রাজ: টিনাকে দিয়ে আপনিই আমার আর কুহুর মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি করার চেষ্টা করেছিলেন তাই না?
আশীষবাবু: ঠিকই ধরেছো কিন্তু এর পিছনে একটা অন্য কারণ আছে।
রাজ: শুনি, কি এমন কারণ।
রাজ বেশ ঠান্ডা মাথায় কথা বলছে আশীষবাবুর সাথে যেটাতে আশীষবাবু একটু অবাকই হচ্ছেন। উনি ভেবেছিলেন রাজ হয়তো উত্তেজিত হয়ে পড়বে প্রশ্নের উত্তরটা শুনে কিন্তু না। রাজ তো একদম শান্ত হয়ে বসে আছে। বেশি কিছু না ভেবে উনি বলতে শুরু করলেন,
আশীষবাবু: এটা সত্যি যখন প্রথম তুমি আমার কাছে কোয়েলকে বিয়ে করতে চেয়েছিলে তখন আমি একটুও খুশি হইনি। আমি ভেবেছিলাম তুমি কি ও’কে আদৌ ভালোবাসো? হতেই পারে এটা তোমার আবেগ। আর ভালো না বাসলে তো খুশিও রাখতে পারবে না। তাই আমি তোমাকে ওর জন্য নিজেকে প্রমাণ করতে বলি, এতে দুটো দিকের সত্যতা যাচাই করা হতো। এক, তোমাদের দুজনের প্রতি দুজনের ভালোবাসা কতটা সত্যি আর দুই, তোমাদের সম্পর্কে ঠিক কতটা জোর আছে।
রাজ: আচ্ছা? তো কি প্রমাণ পেলেন? (শব্দবিহীন হালকা হেসে)
আশীষবাবু: তোমাকে যখন আমি অক্লান্ত পরিশ্রম করতে দেখেছিলাম শত বাঁধা আসার পরেও তখন তোমার ব্যাপারে ভাবা বন্ধ করে কোয়েলকে নিয়ে ভাবতে শুরু করি। ওর জন্য ইচ্ছা করেই বিয়ের সম্বন্ধ আনতাম এটা দেখার জন্য ও কি বলে। কোয়েল যখন একটার পর একটা সম্বন্ধ নাকচ করতে থাকলো তখন আমিও থেমে যাই আর তোমার ফেরার অপেক্ষা করতে থাকি। আমি জানতাম তুমি ফিরে এসে কোনো না কোনোভাবে কোয়েলকে মানাবে, এত পরিশ্রম তো ওর জন্যই করেছিলে।
রাজ: আর ঠিক সেই বুঝেই আপনি আমাদের আলাদা করার জন্যে টিনাকে ইউস করলেন তাই তো?
আশীষবাবু: (হেসে) তোমাদের আলাদা করার জন্য না। তুমি নিশ্চই জানো কোয়েলের ট্রাস্ট ইস্যুস আছে? যদিও সেটা আমার জন্যেই তাও জানো তো?
রাজ: হ্যাঁ, প্রথম থেকেই।
আশীষবাবু: হম, আমিও তোমাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝিটা করিয়েছিলাম খুবই সহজ একটা বিষয় নিয়ে যেটা নিয়ে সামান্য ভাবলেই হয়তো বোঝা যাবে। আমি এটাই দেখতে চেয়েছিলাম তোমার সাথে টিনার কি রকম সম্পর্ক, তুমি টিনাকে কি চোখে দেখো আর কোয়েল তোমাদেরকে একসাথে দেখে কেমন রিয়াক্ট করে। মাথা ঠান্ডা করে বিষয়টা নিয়ে ভেবে দেখে নাকি তোমাকে দূরে ঠেলে দেয় অবিশ্বাস করে। এমনটা করতে গিয়ে আমি আবারও তোমার ওর প্রতি ভালোবাসা আর তোমার বুদ্ধির প্রমাণ পাই। জানো? আমি তখন খুব ভেঙে পরেছিলাম যখন জানতে পেরেছিলাম তুমি নিজে থেকেই টিনাকে কাছে টেনে নিয়েছো আর কোয়েলও সেসব দেখে তোমাকে দূরে ঠেলে দিয়েছে। প্রথমবারের মতো মনে হচ্ছিলো জিতে গিয়েও হয়তো হেরে গেলাম। কিন্তু টিনা যখন পরে আবার ফোন করে জানালো যে তুমি ইচ্ছা করেই প্ল্যান বুঝতে পেরে উল্টো প্ল্যান করেছিলে তখন বেশ আনন্দই পেয়েছিলাম। কিন্তু আমার এই প্ল্যানের সাথে পরেশ বা সৌভিকের প্ল্যানের কোনো যোগসূত্র ছিলো না।
রাজ: আপনি এগুলো সেদিন কেন বললেন না? আপনি তো আমাদের ভালোর জন্যই এমনটা করেছিলেন। কোয়েল এগুলো শুনলে এভাবে আপনাকে ভুল বুঝে চলে যেতো না মিস্টার ব্যানার্জী।
রাজ উত্তেজিত হয়ে উঠে দাঁড়ালে আশীষবাবু হেসে উঠে দাঁড়ালেন। রাজের দু কাঁধে নিজের হাত রেখে বললেন,
আশীষবাবু: আমার ধারণা সব সময় ভুল প্রমাণ করাই হয়তো তোমার কাজ। আমি ভেবেছিলাম টিনার বিষয়ে আমার হাত ছিলো জেনে তুমি রিয়াক্ট করবে এখন দেখছি সবটা জেনে আমার ভালোর জন্য তুমি রিয়াক্ট করছো।
রাজ: এটা কোনো হাসির বিষয় নয় মিস্টার ব্যানার্জী। এখন আমি বুঝতে পারছি আপনি কেন আমাকে নিজের বাড়িতে ডেকে নিয়ে গেছিলেন। আপনি আমাদের কথাগুলো রেকর্ড করছিলেন তাই না? কিন্তু কোয়েল নিজেই এসে পড়ায় সেটা বুঝে গিয়ে আপনি ইচ্ছা করে আমাকে উস্কিয়েছেন যাতে আমি সবটা স্বীকার করি আর কোয়েল সেটা শুনতে পায়। তাহলে এইগুলো কেন বললেন না মিস্টার ব…
আশীষবাবু: আহা, বাবা! এবার থেকে বাবা বলে ডাকবে। আমি চাইনি কোয়েল পুরো বিষয়টা জানুক। এসব জানিয়েও হয়তো আমি কখনওই ওর মনে জায়গা করতে পারবো না। তাই না জানানোই ভালো। শুধু আমার একটাই রিকুয়েস্ট তোমার কাছে, তুমি আমাকে ওর কাছে নিয়ে যাবে? ও মুম্বাইতে রয়েছে, ও..ওর সাথে ওর মা’ও
রাজ: নিয়ে যাবো। আমি নিয়ে যাবো আপনাকে। আপনি জানেন আপনি কোয়েলের কাজ অনেকটা সোজা করে দিয়েছেন?
আশীষবাবু: মানে?
রাজ: মানে কোয়েলও একটা সুযোগ খুঁজছিলো আমার কাছ থেকে আমার চলে যাওয়ার কারণটা শোনার। আপনি বিয়ের কথা বলায় ও রাজি হয়েছিল যাতে আমি এই শুনে ওকে গিয়ে সবটা বলি।
আশীষবাবু: আচ্ছা, তোমার ফেরার পর পরেশ তোমাকে ব্ল্যাকমেইল করেছে তাই না?
রাজ: হ্যাঁ। উনি এটাই বলতেন যে আমি বাড়াবাড়ি করলে আপনাকে জানিয়ে কোয়েলকে আমার থেকে দূরে করে দেবেন। কিন্তু আমার মনে হয় উনি আপনার প্ল্যান সম্পর্কে জেনে গেছিলেন তাই সেদিন সৌভিককে পাঠিয়েছিলেন।
আশীষবাবু: আমারও তাই মনে হয়। যা হয়েছে ভালোর জন্যই হয়েছে। তুমি যদি সেদিন আমার প্ল্যান বুঝে অভিনয়টা না করতে তাহলে হয়তো ওই সৌভিক কখনো উচিত শিক্ষা পেতো না। আর কোয়েলও নিজের ভুল বুঝতে পারতো না।
রাজ: (হেসে) কোয়েল নিজের ভুল আগেই বুঝেছিল মি..বাবা। ও বুঝে আমার কাছে আসবে তাঁর আগেই সৌভিক এসে ও’কে আটকে দেয়। আপনার এই কাজের জন্য ওর মন থেকে এই ট্রাস্ট ইস্যুটা একটু হলেও দূর হয়েছে। ও বুঝতে পেরেছে সবসময় চোখের দেখা সত্যি হয় না। আপনি আমাদের সম্পর্কে বিশ্বাসের প্রমাণ নিতে গিয়ে ভালোই করেছেন।
রাজের কথা শেষ হলে আশীষবাবু মলিন হেসে বিড়বিড় করতে শুরু করেন।
আশীষবাবু: এটা যদি আরো আগে পারতাম তাহলে হয়তো মেয়েটাকে হারাতাম না আর না’ই ওর…
রাজ: আপনার বাইরে কোনোরকম কোনো সম্পর্ক ছিলো না তাই না?
রাজের প্রশ্নে আশীষবাবু বেশ চমকে ওঠেন। সেটা দেখে রাজ হাসলে আশীষবাবু আমতা আমতা করতে লাগলেন। রাজ আশীষবাবুকে বসিয়ে বললো,
রাজ: আমিও একজন বিজনেসম্যান বাবা। এরকম অনেক সময় হয় অন্য কোম্পানি নিজেদের লাভের জন্য আমাদের বদনাম করতে চায়। এতে ওরা প্রজেক্টও পাবে বড়ো কোম্পানির সাথে আর আমাদের দূর্নামও হবে। আপনার সাথেও এটাই হয়েছিল শুধু আপনি সঠিক সময় বুঝতে পারেননি আর সে সময় হয়তো আপনাকে ব্ল্যাকমেইল করা হচ্ছিলো। তাই আন্টির সাথে খারাপ ব্যবহার করেছিলেন। ঠিক বললাম তো?
আশীষবাবু: তুমি এসব কি করে..?? তোমার সাথেও কি..??
রাজ: হয়েছে, আমার সাথেও এমন হয়েছে। একটা মেয়ে আমাদের কোম্পানিতে আমার পি.এ. হয়ে এসেছিলো। সবসময় আমার কাছাকাছি থাকার চেষ্টা করতো, যেটা আমার ঠিক লাগেনি। তাই আমি ওর আমার কাছাকাছি থাকার সুযোগটা কাজে লাগিয়েই ওর ব্যাপারে খবর নেওয়া শুরু করি। জানতে পারি ও আমাদের রাইভাল কোম্পানির হয়ে কাজ করছে, আমার কাছাকাছি এসে ইনফরমেশন লিক করার চেষ্টা করছিল চলতি প্রজেক্টের। আসলে কি বলুন তো? আমার সারা হৃদয় আর মস্তিষ্ক জুড়ে একজনেরই বসবাস। তাই আমি কখনো কোনো মেয়ের সাথে কথা বলা তো দূর, সংস্পর্শে যেতেও সাতবার ভাবি।
আশীষবাবু রাজের দু-হাত ধরে তুলে দাঁড় করালেন। তারপর রাজকে জড়িয়ে ধরলেন যাতে রাজ অবাকের সাথে খুশিও হলো।
আশীষবাবু: আমার মেয়েটাকে সারাজীবন নিজের রাজরানী করে রেখো। আমি তাহলে আজ আসি? আদিকে এসব বিষয়ে জানিওনা প্লিজ।
রাজ: ঠিক আছে।
রাজের কথা শেষ হতেই কলিংবেল বেজে ওঠে আর আদিত্য,মৌমিতা সেখানে প্রবেশ করে।
ফ্ল্যাশব্যাক এন্ড……………………….
কোয়েল সব শুনে চুপচাপ নীচের দিকে তাকিয়ে চোখের জল ফেলছে। রাজ কোয়েলের চোখ মুছিয়ে কোয়েলকে বুকে টেনে নিতেই কোয়েল রাজের বুকে মাথা রেখে ফোঁপাতে শুরু করে। কিছুক্ষণ পর বলে,
কোয়েল: তুমি ইচ্ছা করেই আমাকে বা দাভাইকে আগে থেকে কিছু জানাওনি তাই না? ভেবেছিলে ওনার সাথে কথা বলে নিজেই সবটা মিটিয়ে নেবে।
রাজ: হ্যাঁ, আমি চাইনি তুমি আরো দূরে সরে যাও মানুষটার থেকে। কিন্তু উনি চেয়েছেন তোমাকে সবটা জানাতে। আমি পুরো বিষয়টা না জানালেও তুমি আর মা যে ওনাকে ভুল বুঝেছিলে এটা ঠিক জানাতাম।
__এতো মহান হতে কিন্তু তোকে কেউ বলেনি রাজ?
রাজ দরজার কাছে থেকে আদিত্যের গলার স্বর পেলো। সেও সবটা শুনেছে দরজা লক না করায় সেটা ওর কথা শুনেই রাজ বুঝতে পারলো। আদিত্য রাজের কাছে এলে রাজ আদিত্যের কাঁধে হাত রেখে বলে,
রাজ: আমি চাই সবটা ঠিক হয়ে যাক আদি। এখন আর কোনো মনমালিন্য না রেখে সবটা মিটিয়ে নেওয়াটাই বেটার। বায় দ্য ওয়ে, কুহুজান! তোমার ওই সেকেন্ড হ্যান্ড উড বি হাজবেন্ড কোথায়?
রাজের প্রশ্ন শুনে কোয়েল একটা ঢোঁক গেলে। আদিত্য আর মৌমিতা কিছু বুঝতে না পেরে একসাথে জিজ্ঞেস করে ওঠে,
আদিত্য, মৌমিতা: মানে?
রাজ: বাহবা, কি মিল! যাই হোক, মানেটা হলো যার সাথে তোর বোন বিয়ে করবে বলে রাজি হয়েছে সে অলরেডি একজনের উড বি। তাই সেকেন্ড হ্যান্ড বললাম। আসলে ও প্ল্যান করেছিলো আমার থেকে কথা বার করবে আর আমি ঠিক ওর বাবাকে রাজি করিয়ে নেবো সো ও’কে বিয়ে করতে হবে না। তাই রাজি হয়েছিল এর উপর যখন দেখলো ওরই চেনা বন্ধু, যার সাথে একটা ডান্স কম্পিটিশনে আলাপ হয়েছিলো তখন ও আমাকে আরো একটু জ্বালানোর ফন্দি এঁটে ফেললো। তাই জন্যেই তোদের রিসেপশনের দিন চিপকে ছিলো।
রাজ শেষের কথাটা কোয়েলের দিকে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে, দাঁতে দাঁত চেপে বললে কোয়েল ঘাবড়ে গিয়ে আমতা আমতা করে বলে,
কোয়েল: ইয়ে, কো..কোথায় চিপকে ছি..ছিলাম?
মৌমিতা: তোমরা ঝগড়া পরে করবে। এখন ডাইনিং এ চলো কাকাই আর কাম্মা অপেক্ষা করছে।
ডাইনিং রুমে এসে ওরা সবাই উপস্থিত হলে আশীষবাবু আর মৃন্ময়ীদেবীর মুখে হাসি দেখলে সবাই অবাক আর খুশি দুটোই হয়। ওরা বুঝতে পারে আশীষবাবু মৃন্ময়ীদেবীকে সবটা বুঝিয়ে বলার ফলে ওদের মধ্যেও মিটমাট হয়ে গেছে। আশীষবাবু এবার একটু ইতস্তত বোধ করতে করতেই কোয়েলকে জিজ্ঞেস করলো,
আশীষবাবু: আমি কি এবার তোমাদের সাথে থাকতে পারি?
কোয়েল সবার দিকে গম্ভীর ভাবে তাকিয়ে মাথা নামিয়ে নিলে সবাই বেশ চিন্তায় পরে যায়।
কোয়েল: তোমার ইচ্ছা বাবা!
আশীষবাবু কোয়েলের মুখ থেকে বাবা ডাকটা শুনে আপ্লুত হয়ে রাজের দিকে তাকালে রাজ একটা চোখ টিপ দিয়ে হাসে। আশীষবাবু ওদের দিকে এগিয়ে গিয়ে কোয়েলকে জড়িয়ে ধরলে কোয়েলও ওনাকে স্যরি বলে। এরপর উনি কোয়েলের হাত রাজের হাতের উপর রেখে রাজকে বলেন,
আশীষবাবু: আমার মেয়ের দায়িত্ব তোমার হাতে তুলে দিলাম। আগে যেমন নিজের কথা রেখেছো এইবার সারাজীবন নিজের কথা রাখতে হবে। আমার মেয়েকে নিজের রাজরানী করে রাখতে হবে। পারবে তো?
রাজ কোয়েলের দিকে একঝলক তাকিয়ে নিয়ে আশীষবাবুর দিকে তাকিয়ে বলেন,
রাজ: পারবো।
আশীষবাবু হেসে চলে যেতে নিলে রাজ আশীষবাবুকে ডেকে বলে,
রাজ: ও শ্বশুরমশাই! এত আনন্দে কালকের ফ্লাইট বুক করতে ভুলবেন না জানো। চটপট আমাদের দুজনের ফ্লাইটটা বুক করে নিন।
আদিত্য: কিসের ফ্লাইট আমার আর মৌয়ের জন্য?
কোয়েল: তোমাদের আর মৌয়ের জন্য মানে?
মৌমিতা: রাজদা আমাদের রিসেপশনে গিফট হিসেবে নর্থ সিকিমের ট্রিপ বুক করে দিয়েছে।
রাজ: ওটা তো বুক করা এটা হলো আমার নেক্সট প্রজেক্ট যেটা শ্বশুরমশাইয়ের সাথেই। উনি চাইলেন বলেই তো তোদের রিসেপশনে এন্ট্রিটা মারতে পেরেছি। আঙ্কেল এখন বাইরে রয়েছেন ওনার বাইরের কোম্পানিগুলো সামলাচ্ছেন। এখানকার কোম্পানি, প্রজেক্ট সামলানোর দায়িত্ব আমার।
আশীষবাবু: চিন্তা করো না ফ্লাইট বুক করা হয়ে গেছে আমার।
রাজ: বাহ! তাহলে সেই খুশিতে আপনিও একটু প্রেম করুন আর আমাদেরকেও করতে দিন।
কোয়েল: (চোখ রাঙিয়ে, ধমক দিয়ে) রাজ!
রাজ: যাহ বাবা, ভুল কি বললাম?
কোয়েল: তোমাকে তো আমি…দাঁড়াও দেখাচ্ছি তোমার মজা।
কোয়েল ফুলদানি হাতে নিতেই রাজ এদিক ওদিক দৌঁড়াতে শুরু করলো। ওদের কান্ড দেখে সবাই হাসছে এদিকে রাজও হাসছে আর দৌঁড়াচ্ছে। একটা সময় রাজ ইচ্ছা করেই কোয়েলের ঘরে ঢুকে যায় আর কোয়েল ঘরে ঢুকলে কায়দা করে দরজা লক করে দেয়।
কোয়েল: দরজা লক করলে কেন?
রাজ: ওই যে বললাম, প্রেম করবো!
রাজ এক টানে কোয়েলকে নিজের কাছে টেনে নেয়। কোয়েলকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে ওর ঠোঁটজোড়া নিজের অধীনে নিয়ে নেয়।
১০০.
সাত বছর পর,
__ও পিপি তোমাতে তি সুন্দল লাগছে।
কোয়েল: তাই নাকি তিতির সোনা? আমাকে সুন্দর লাগছে? পছন্দ হয়েছে তোমার?
তিতির: খুউউব! (দু-হাত ছড়িয়ে) কিন্তু তুমি তি আমাদেল ছেড়ে চলে যাবে? (কাঁদো কাঁদো মুখ করে)
কোয়েল: (তিতিরকে জড়িয়ে ধরে) যেতে তো আমাকে হবেই তিতির সোনা। বাট পিপি কথা দিচ্ছে পিপি মাঝে মধ্যেই তিতির সোনার সাথে দেখা করবে, এত্ত এত্ত চকলেট দেবে আর আদর করবে।
তিতির: পমিস?
কোয়েল: পাক্কা প্রমিস।
মৌমিতা: কোয়েল! তুই এবার ওদেরকে প্রশ্রয় দেওয়াটা বন্ধ কর। তুই বন্ধ করলেই রাজদা বন্ধ করবে।
কোয়েল: উফ থাম তো। খালি চিল্লাস তুই। যা, আরেকজনকে নিয়ে আয়।
মৌমিতা: তোর সাজ তো কমপ্লিট, আমি যাচ্ছি দেখি আমারজন কি করছেন। আদৌ সামলাতে পারছেন কি না।
মৌমিতা নিজের ঘরে ঢুকে দেখলো আদিত্য তাঁদের ছোট্ট ছেলেকে কুর্তা পাঞ্জাবি পরিয়ে দিয়ে বিছানায় বসিয়ে রেখেছে। আর নিজে হাঁটু গেড়ে বসে জুতো পড়াচ্ছে। মৌমিতাকে দেখতেই ছেলেটি আস্তে করে নেমে ছুটে এসে মৌমিতার পা জড়িয়ে ধরলে মৌমিতা নীচে বসে জিজ্ঞেস করলো,
মৌমিতা: কি হয়েছে তাতাই?
তাতাই: (কাঁদো কাঁদো গলায়) পিপি চলে যাবে? আমি যেতে দেবো না পিপিতে।
মৌমিতা: (কোলে নিয়ে) পিপি বলেছে, মাঝে মধ্যেই তাতাই আর তিতির সোনার সাথে দেখা করে অনেক আদর করবে আর এত্ত এত্ত চকলেট দেবে। তাই মন খারাপ করতে না।
তাতাই: তত্যি?
মৌমিতা: (হেসে) একদম সত্যি।
তাতাই মৌমিতাকে জড়িয়ে ধরে ওর কাঁধে মাথা রাখলে আদিত্য মৌমিতার কাছে এসে বলে,
আদিত্য: ওদের দুজনের খেলার সাথী এনে দিলে মনে হয় ওরা আর ওর পিপিকে অতো মিস করবে না। তাই না?
তাতাই: খেলাল তাথী? (মাথা তুলে খুশি হয়ে)
মৌমিতা: চুপ! এসব কিছু হবে না।
আদিত্য হেসে ঠোঁটে আঙুল রেখে ইশারা করলে মৌমিতা চোখ রাঙায়। সেই দেখে আদিত্য মুখ ভার করে নিলে মৌমিতা মৃদু হেসে তাতাইয়ের মাথাটা নিজের কাঁধে চেপে ধরে আদিত্যের কাছে এগিয়ে ওর ঠোঁটে ঠোঁট ছোঁয়ায়। তৎক্ষণাৎ সরে এসে বলে,
মৌমিতা: বিয়ের লগ্ন শুরু হবে তাড়াতাড়ি কোয়েলের ঘরে যাও পিঁড়ি ধরতে হবে।
মৌমিতা হেসে বেরিয়ে যেতে নিলে আদিত্য মৌমিতার হাত টেনে বাঁধা দিয়ে মৌমিতার কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায় আর তাতাইয়ের মাথায় ঠোঁট ছুঁয়ে কোয়েলের ঘরে চলে যায়।
তাতাই আর তিতির! ভালো নাম, আদ্রিশ এবং আদ্রিশা। আদিত্য আর মৌমিতার যমজ ছেলে মেয়ে, বয়স মোটে দুবছর। মৌমিতার তেইশ বছরে এম.এ. কমপ্লিট হওয়ার পর পরেই জানতে পারে সে মা হতে চলেছে। এদিকে কোয়েল নিজের এম.এ. কমপ্লিট করে নিজের পায়ে দাঁড়ায় একটা ভালো জায়গায় জব করে আর রাজ নিজের ব্যবসায় আরো উন্নতি করার পর বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। আদিত্যও এখন নিজের বাবার ব্যবসাটা পুরো সামলাচ্ছে সেই সাথে নিজের ব্যবসাও আছে,নিজের স্বপ্নপূরণ করেছে সে। আশীষবাবুর সাথে কোয়েল এবং মৃন্ময়ীদেবী দুজনের সম্পর্ক স্বাভাবিক হয়ে গেছে। বরং এখন সব থেকে ভালো আছেন মৃন্ময়ীদেবী আর আশীষবাবু একসাথে। আজ রাজ ও কোয়েলের শুভ বিবাহে সবাই যেমন একত্রিত হয়েছে আপনারাও এসে যোগ দিন। সবাইকে আমন্ত্রণ জানিয়ে এখানেই গল্পের ইতি টানলাম।
সমাপ্ত