‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️
||পর্ব ৬৪||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা
কেউ কিছু বলবে তার আগেই পিছন থেকে এই প্রশ্নটা কানে ভেসে এলে সবাই পিছনের দিকে ফিরে তাকায়। আদিত্য হেসে এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে রাজকে! কোয়েলও খুশি হয়ে এগোতে নিলে কিছুক্ষণ আগের ঘটনা মনে করে থেমে যায়। করুন ও অসহায় ভাবে একবার নিজের বাবার দিকে তাকায়, আরেকবার রাজের দিকে তাকায়।
আদিত্য: আব, রাজ তুই আমার সাথে ওদিকে চল। তোকে আমার কিছু বন্ধুদের সাথে দেখা করাবো।
বুঝতে পারলাম আদি পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য রাজদাকে নিয়ে চলে গেলো। ওরা চলে যেতেই কাকাই বাবাকে জিজ্ঞেস করলো,
আশীষবাবু: দাদা, তোমার কি মত বললে না তো?
আকাশবাবু: দেখ এখানে আমি আর কি বলবো? তুই কোয়েলের বাবা, তুই যা করবি ওর ভালোর জন্যই তো করবি। এখন কোয়েল মা কি চাইছে এটাই বড়ো কথা।
কাকাই কোয়েলের দিকে তাকালে কোয়েল চুপ করেই থাকে। সেই দেখে আমি বলে উঠি,
মৌমিতা: এটা নিয়ে না হয় পরে…
কোয়েল: আমি রাজি।
আমার কথা শেষ হওয়ার আগে যে কোয়েল এমন কিছু বলবে সেটা ভাবিনি আমি। সবার সামনে কোয়েলকে কিছু বলতেও পারছি না। কোয়েল নীচের দিকেই তাকিয়ে আছে একভাবে। কাকাইয়ের দিকে তাকাতেই দেখলাম কাকাইও অবাক হয়েছে। আমি কোয়েলকে একটু দূরে সরিয়ে নিয়ে আস্তে করে বললাম,
মৌমিতা: কি বলছিস এসব তুই? মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি তোর?
কোয়েল: যা বলেছি ঠিকই বলেছি। আমি রাজি! (জোরে)
কোয়েল এটুকু বলেই চলে গেলো। সবাই হাসিমুখে এই বিষয়ে কথা বলতে শুরু করলে আমি আদিকে মেসেজ করে দিলাম জানো এক্ষুনি আমার সাথে দেখা করে রাজদাকে সঙ্গে নিয়ে। কিছুক্ষণ পর, ওরা আসলে আমি সাথে সাথে বলে উঠি,
মৌমিতা: কোয়েল বিয়েতে মত দিয়েছে।
আদিত্য: হোয়াট? ওর কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি?
রাজ: বুঝলাম না। কি ব্যাপারে কথা বলছিস তোরা?
আমি রাজদাকে সবটা খুলে বলতেই রাজদা কেমন জানো নিস্তেজ হয়ে গেলেন। এমন সময় কাকাই আমাদেরকে ডেকে দেখালেন,
আশীষবাবু: আদি! দেখ তোর বোন কত খুশি। ওর সাথেই আমি বিয়ে ঠিক করেছি কোয়েলের। আজ ওদের প্রথম দেখা কে বলবে?
আমরা কাকাইয়ের ইশারা অনুযায়ী তাকিয়ে দেখলাম কোয়েল একটা ছেলের সাথে হেসে হেসে কথা বলছে। আমরা বেশ অবাক হলাম কাকাইয়ের কথা শুনে। আমাদের সাথে সাথে কাকাইও অবাক হয়েছে। সেটা না হয় মেনে নিলাম কিন্তু কাকাইকে খুব একটা খুশি মনে হচ্ছে না, এমন কেন?
রাজ: আদি, বউদি আমি আসছি।
আমাদের ঘোর কাটলো রাজদার কথায়। আমাদেরকে কোনো প্রতিক্রিয়া করার সুযোগ না দিয়েই রাজদা বেরিয়ে গেলো। আদিওগেলো না রাজদার পিছনে। শুধু আস্তে করে বললো,
আদিত্য: সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে নিজেই সারপ্রাইজ হয়ে যাবে ভাবেনি হয়তো।
মৌমিতা: তুমি কোয়েলের সাথে একবার কথা বলো। ও আমাকে কিছুই বলেনি। (আস্তে করে)
আদি আমাকে সম্মতি জানালো। কিছুক্ষণ পর আদি, গেস্টদেরকে বাবা আর কাকাইকে ম্যানেজ করতে বললো। ও অন্যদিকে গেলে বুঝলাম কোয়েলের সাথে কথা বলতেই গেছে তাই আর কিছু জিজ্ঞেস করলাম না।
৯৭.
আদিত্য: তুই রাজকে ব্লক করেছিস কেন ছুটি? তুই কি করতে চাইছিস বলবি আমাকে?
কোয়েল: বিয়ে!
আদিত্য: রাজ ব্যতীত অন্যকাওকে বিয়ে করার কথা ভাবছিস তুই? দেখ ছুটি, এটা লাইফের অনেক বড়ো একটা ডিসিশন।সামান্য কারণে রাজের উপর অভিমান করে এতো বড়ো ভুলটা করিস না তুই।
কোয়েল: সামান্য অভিমান দাভাই? এতদিনেও তোমার প্রানপ্রিয় বন্ধুর সময় হয়নি আমাকে জানানোর যে, সে চার বছর আগে কোথায় গেছিলো, কেন গেছিলো। কি বলবো আমি মিস্টার সেনকে? এটাই যে, আমি এমন একজনকে বিয়ে করতে চাই যে কি না আমাকে চার বছর আগে কোনো কিছু না বলেই উধাও হয়ে গেছিলো? তখন উনি যদি উল্টে আমাকে প্রশ্ন করেন, কি সিওরিটি আছে যে সে ভবিষ্যতে তোমাকে এভাবে একা করে যাবে না? এর কি উত্তর দেবো আমি, তুমি আমাকে বলতে পারো? অনেক অপেক্ষা করেছি দাভাই! অনেক! আর পারবো না। তোমার বন্ধুর যদি আমাকে নিজের করার হতো তাহলে সে এভাবে এতদিন হাত গুটিয়ে বসে থাকতো না। ও যখন আমাকে চায় না তাহলে আমি কেন শুধু শুধু অপেক্ষা করব? বলে দিও তোমার বন্ধুকে আমি ওকে মুক্তি দিয়ে দিলাম, সারাজীবনের মতো।
কোয়েলের চোখ দিয়ে অনবরত জল গাল গড়িয়ে পড়ছে। কোয়েলের কথাগুলো সত্যি, যুক্তিযুক্ত তাই আদিত্যও কোনো উত্তর দিতে পারছে না। কোয়েলের কাছে গিয়ে আদিত্য ওকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
আদিত্য: এতে তো তুই নিজেকে শাস্তি দিচ্ছিস ছুটি। তুই যে রাজকে ছাড়া ভালো থাকবি না এটা তুই নিজেও ভালো ভাবে জানিস। বিয়ে করাটা কি খুব জরুরী? তুই তো আ…
কোয়েল: দাভাই প্লিজ! আমার যা ডিসিশন নেওয়ার সেটা আমি নিয়ে নিয়েছি। পারলে তোমার বন্ধুকে গিয়ে বলো, আমাকে পেতে হলে, আমাকে অর্জন করে নিতে আর নাহলে ঠিক এভাবেই জানো সময়ের অপেক্ষা করতে করতে আমাকে অন্যকাওর হয়ে যেতো দেখে।
আদিত্য আর কিছু না বলে চলে এলো সে স্থান ছেড়ে। কি করে বলবে এই কথাগুলো সে রাজকে? তবুও আদিত্য রাজকে ফোন করে জানার চেষ্টা করলো যে সে এখন কোথায়। সেন্টারেই আছে নাকি বেরিয়ে গেছে কিন্তু এ কি? রাজের ফোন তো সুইচ অফ বলছে।
আদিত্য: রাজের ফোন সুইচ অফ বলছে কেন? আবার কিছু করে বসবে না তো রাগের বশে? খবর কীভাবে নেবো এখন আমি ওর?
আমি আদিকে খুঁজতে এসে দেখলাম ও চুপ করে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে। ওর পাশে এসে দাঁড়িয়ে ওর কাঁধে হাত রাখতেই ও আমার দিকে তাকালো। বেশ চিন্তিত লাগছে ওকে দেখে তাই জিজ্ঞেস করলাম,
মৌমিতা: কি হয়েছে আদি? কোয়েল কি বললো?
আদি আমাকে পুরো ঘটনা বলতেই আমি ওকে আশ্বাস দিয়ে বললাম,
মৌমিতা: রাজদাকে এখন একটু একা থাকতে দাও। আমি তোমাকে বলছি রাজদা নিজের কোনো ক্ষতি করবে না।
আদিত্য: হম, সেটা তো আমারও মনে হচ্ছে মাঝে মধ্যে। কিন্তু আবার ভয় পাচ্ছি পাগলটা যদি কিছু ঘটিয়ে ফেলে? ওর পাগলামি সম্পর্কে কোনো ধারণা নেই তোমার মৌ।
মৌমিতা: রাজদা যার জন্য পাগলামি করে সেই মানুষটা অন্যকাওর হয়ে যাবে সেটা কি মেনে নেবে বলে মনে হয় তোমার? চলো ওদিকে, সবাই খুঁজছে তোমায়।
আমি আদিকে বুঝিয়ে নিয়ে এলাম ঠিকই কিন্তু চিন্তা তো আমারও হচ্ছে। কি হতে চলেছে ভবিষ্যতে কিছুই বুঝতে পারছি না। সব ঠিক হবে তো আদৌ?
রাতে,
আমি নিজের ঘরে, ফুল দিয়ে সাজানো বিছানায় বসে আছি। অপেক্ষা করছি আদির জন্য। পাশ ফিরে তাকাতেই যখন আমার আর আদির নাম গোলাপের পাপড়ি দিয়ে লেখা দেখলাম বিছানার মধ্যখানে তখন আস্তে করে বিছানা থেকে নেমে দাঁড়ালাম। যেই লম্বা ফুলগুলো ঝুলছে সেগুলোই হাত ছোঁয়াতেই চোখের সামনে ছয়/সাত মাস আগের ঘটনা ভেসে উঠলো। ঠিক এভাবেই সবটা সাজানো ছিলো, সুন্দর করে। কিন্তু আদি আসা মাত্রই সবটা কেমন জানো ধ্বংসাবশেষে পরিণত হয়েছিলো। কত সহজে এই বিয়ে, আমাকে অস্বীকার করেছিলো। বারণ করেছিলো আমি জানো নিজেকে ওর স্ত্রী হিসেবে কাওকে পরিচয় না দিই। আর আজ দেখো! সেই মানুষটাই আমাকে চোখে হারায়। নিজে থেকে সবার সামনে নিজের স্ত্রীর পরিচয় দিয়ে আজ আমাকে নিজের মর্যাদা দিতে চলেছে। পরিস্থিতি কতো তাড়াতাড়ি বদলে যায় তাই না? ভাবতেই অবাক লাগে।
আদিত্য: এতো কি ভাবছো যেআমার উপস্থিতিও টের পাচ্ছো না? হম?
এতটা কাছ থেকে আদির স্বর কানে আসতেই ভাবনার জগৎ থেকে বেরিয়ে এলাম। বুঝতে পারলাম ও আমাকে পিছন থেকে নিজের বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে নিয়েছে। আমি কোনো উত্তর না দিয়েই লাজুক হাসলাম। আদি আমাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিলেও ওর দিকে তাকালাম না,আজ বোধ হয় একটু বেশিই লজ্জা লাগছে আমার ওর চোখে চোখ রাখতে।
আদিত্য: কি ভাবছিলে এতো? আগের কথা?
মৌমিতা আস্তে করে নিজের মাথা নাড়িয়ে সায় দিলে আদিত্য মৌমিতার মুখটা তুলে কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো। তারপর কপালে কপাল ঠেকিয়ে বললো,
আদিত্য: আমি আর আমার নিজের ভুলের কথাটা মনে করতে চাই না। সবটা নতুনভাবে শুরু করতে চাই, থাকবে তো আমার পাশে? পারবে না সবটা ভুলে সারাজীবনের জন্য আমার সাথ দিতে?
মৌমিতা: পারবো। আমি মৃত্যুর আগে অবধি তোমার পাশেই থাকবো আদি।
আদিত্য: ছেড়ে যাবেনা তো আমায়? আই ক্যান্ট লিভ উইদআউট ইউ।
মৌমিতা আদিত্যের বুকে মাথা রেখে ওকে আলতো করে জড়িয়ে ধরে বললো,
মৌমিতা: যেখানে আমিই পারবো না তোমাকে ছেড়ে থাকতে সেখানে কীভাবে ছেড়ে যাবো তোমায়?
আদিত্য হেসে মৌমিতার কাঁধে মুখ গুঁজে বললো,
আদিত্য: আই লাভ ইউ!
মৌমিতা: আই লাভ ইউ টু!
আদিত্য মৌমিতাকে সোজা করে ওর ঠোঁটজোড়া নিজের ঠোঁটজোড়া দ্বারা বন্দি করে নিলো। একহাত দিয়ে কোমরটা জড়িয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো মৌমিতাকে। মৌমিতাও ধীরে ধীরে নিজের জড়তা কাটিয়ে আদিত্যের চুলের ভাঁজে হাত প্রবেশ করিয়ে আরেক হাত দিয়ে আদিত্যের বাহু আঁকড়ে ধরলো।
পরেরদিন সকালে,
কোয়েল নিজের ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেরোচ্ছে এমন সময় দেখলো আশীষবাবু বসে আছেন ড্রয়িং রুমে খবরের কাগজ নিয়ে। কোয়েল তা দেখেও পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলে আশীষবাবুই জিজ্ঞেস করেন,
আশীষবাবু: ইউনিভার্সিটি যাচ্ছো?
কোয়েল: হ্যাঁ।
আশীষবাবু: আচ্ছা। সাবধানে যেও।
কোয়েল কোনোমতে মাথাটা নেড়ে ওখান থেকে বেরিয়ে যায়। বেশ কিছুক্ষণ পর মৌমিতা আর আদিত্যও নেমে আসে। আর বেরিয়ে যায় ভার্সিটির উদ্দেশ্যে। আকাশবাবুও অফিসের উদ্দেশ্যে রওনা দিলে মিতা দেবী রান্নার লোককে কাজ বুঝিয়ে দিয়ে নিজের ঘর গোছাতে চলে যান। সবাই যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লে আশীষবাবু একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলেন। উনি চুপচাপ সোফায় বসে নিজের হাত ঘড়িতে বারবার সময় দেখছেন। জানো কাওর জন্য অপেক্ষার প্রহর গুনছেন।
আশীষবাবু: সময় তো হয়ে গেলো। এখনও এলো না যে?
__আমি কখনও কথার খেলাফ করি না মিস্টার সেন।
‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️
||পর্ব~৬৫||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা
৯৮.
__আমাকে নিজের ঘরে নিয়ে এলেন যে? ড্রয়িং রুমে বসে কথা বলতে ভয় লাগছিলো নাকি?
আশীষবাবু: আমি কখনো কাওর থেকে ভয় পাইনি রাজ। এখনও পাইনা।
রাজ: আপনার মেয়েকে হারানোর ভয় ও পাননা বলতে চাইছেন?
রাজের প্রশ্ন শুনে আশীষবাবু মাথা নামিয়ে নীচের দিকে তাকিয়ে কিঞ্চিৎ হাসলেন। হেসে রাজের দিকে তাকিয়ে উত্তর দিলেন,
আশীষবাবু: তোমার মনে হয় কোয়েল আমাকে বাবা হিসেবে মানে? ও’কে আমি অনেকদিন আগেই হারিয়ে ফেলেছি। আমার কাছে এখন হারানোর মত কিছুই নেই।
রাজ: নিজের দোষে আপনি ও’কে হারিয়ে ফেলেছেন মিস্টার ব্যানার্জী। যাই হোক, আমাকে কেন ডেকেছেন এখানে? কি প্রয়োজন আমায় আপনার?
আশীষবাবু: প্রয়োজন আমাকে তোমার নাকি তোমার আমাকে? তুমি জানো না কোয়েলের বিয়ে ঠিক করেছি আমি?
রাজ: হ্যাঁ তো? বিয়ে ঠিক করেছেন, দিয়ে তো দেননি। আর যে আমার সম্পদ তাঁকে আপনি এতো সহজে অন্যকাওর হাতে তুলে দিতে পারবেন ভাবলেন কি করে? আমি তো আপনাকে সেই অধিকার দিইনি। এছাড়া আপনি খুব ভালো ভাবে জানেন এখন আমার ক্ষমতা সম্পর্কে। আমি আর আগের মতো দুর্বল নেই। বলুন, কি জন্যে ডেকেছেন কাজের সূত্রে নাকি এসব বলতে?
আশীষবাবু: আমি খুব ভালোভাবেই জানি তুমি কে। তোমাকে কাজের সূত্রে আমি ডাকিনি এখানে। ডেকেছি এটা জানতে…তুমি, তুমি কেন হুট করে আমার মেয়েকে ছেড়ে গেছিলে? ভবিষ্যতে যে তুমি আবারও ওভাবে আমার মেয়েকে ছেড়ে যাবেনা তাঁর কি নিশ্চয়তা আছে?
মুহূর্তেই রাজের মুখমন্ডলে গম্ভীরতা এসে ভর করলো। নিজের চলে যাওয়ার কারণটা চোখ বন্ধ করতেই ভেসে উঠলো। চোয়াল শক্ত করে বললো,
রাজ: আপনার জন্যে! শুধুমাত্র আপনার জন্যে আমি সবটা ছেড়ে চলে গেছিলাম মিস্টার ব্যানার্জী। আপনি আমাকে বাধ্য করেছিলেন কোয়েলের লাইফ থেকে সরে যেতে। সেই সময় থেকেই আপনি ওর জন্যে বড়লোক ছেলে খুঁজছিলেন তাই আমি সেই খবর পেয়ে আপনার কাছে ওর হাত চাইলে আপনি আমাকে অপমান করেছিলেন। বলেছিলেন ও’কে খুশি রাখার, ভালো রাখার মুরোদ নাকি আমার নেই। যদি আমি নিজেকে ওর জীবন থেকে না সরিয়েনি তাহলে আপনি ও’কে নিয়ে চলে যাবেন অনেক দূরে। এতটা দূরে যে আমি ওর নাগাল পাবো না, চোখের দেখাটাও দেখতে পাবো না। আপনি বলেছিলেন কোয়েলকে অর্জন করতে হলে আমাকে নিজেকে প্রমাণ করতে হবে। সাফল্য অর্জন করতে হবে কিন্তু বিনা কাওর সাহায্যে, এই ব্যাপারে কাওকে কিছু না জানিয়ে। শুধুমাত্র এইজন্যই আমি আদিকেও কিচ্ছু জানাতে পারিনি মিস্টার ব্যানার্জী! ওদের দুজনকেই কষ্ট দিয়েছি আর নিজেও কষ্ট পেয়েছি। কিন্তু এর আমি এমনটা হতে দেবো না। কোয়েল আমার ছিলো, আমার আছে আর আমারই থাকবে।
রাজ চুপ করে গেলো কথাগুলো বলে। কিছুক্ষণ নীরব থেকে একটু দম নিয়ে বললো,
রাজ: আমি পেরেছি আমার কথা রাখতে। আমি সেদিন ওখানে দাঁড়িয়ে বলে গেছিলাম আমি নিজেকে গড়ে তুলবো। নিজের ভাগ্য নিজে তৈরী করবো কর্মের দ্বারা। এখন আপনি যেই জায়গায় দাঁড়িয়ে আমিও ঠিক সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে মিস্টার ব্যানার্জী। অনেক চেষ্টা করেছিলেন আপনি আমাকে দমানোর। আমি যেই যেই জায়গায় কাজ করা শুরু করেছিলাম, সব জায়গায় দিয়ে আপনি আমাকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষে হয়নি। ভগবানের দূতের মতো একজন এসে আমার পাশে দাঁড়িয়েছিলো। আমার যোগ্যতা অনুযায়ী নিজের কোম্পানিতে কাজ দিয়েছিলো। আমার মনে হয়েছিলো আমি পারবো না।কিন্তু উনি আমার মনে সাহস জুগিয়ে বলেছিলেন যে আমি পড়াশোনাও করবো আর এই কাজও। বয়স কম তো কি হয়েছে ঠিক শিখে যাবো, শিখতে হবে কারণ আমাকে তো সাফল্যের সাথে সাথে নিজের ভালোবাসাকেও অর্জন করতে হবে। উনি এসবের পাশাপাশি আমাকে দিয়ে বিজনেসের কোর্স করানো শুরু করেছিল। আজ তাঁরই কোম্পানির সব দায়িত্ব আমার কারণটা জানেন? আমি, আমি দিনরাত নিজের পরিশ্রম দিয়ে কোম্পানিটাকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়েছি এই চার বছরে যাতে আপনার সাথে কম্পিট করতে পারি। সেটাও পেরেছি আমি! আপনার মেয়েকে খাওয়াতে পড়াতে তো যেকোনো বড়লোকের ছেলে পারবে কিন্তু ভালোবাসা দিয়ে রাজরানী করে রাখতে শুধুমাত্র এই রাজই পারবে।
রাজের শেষ কথাটা শুনে আশীষবাবু বেশ অনেকটা প্রশস্ত করলেন নিজের ঠোঁটজোড়া। রাজ যেটা দেখে কিছুটা অবাক হলো কিন্তু এর চাইতেও বেশি অবাক হলো যখন আশীষবাবু বললেন,
আশীষবাবু: হ্যাঁ রাজ! তুমি যা বলেছো একদম ঠিকই বলেছো। তুমি যাওয়ার পরে আমিই তোমার খোঁজ রেখেছিলাম যাতে তুমি যেখানে যেখানে কাজের জন্য যাবে সেখান থেকে জানো তোমাকে প্রত্যাখ্যান করা হয়। প্রত্যেকেই আমার কথা শুনেছিল তাঁর কারণ ওরা অনেক বড়ো অংকের টাকা পেয়েছিলো এই কাজের জন্য। আসলে, আমি চাইনি কোয়েলকে তোমার হাতে তুলে দিতে কখনও। তাই এসব….
আশীষবাবু কথা শেষ করার পূর্বেই অনেক জোরে কাঁচ ভাঙার আওয়াজ পেলেন। রাজও সেই শব্দটা পেতেই উঠে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরে তাকায়। এরপর রাজ ঘাবড়ে গেলেও আশীষবাবু নির্বিকার হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। একটা ছোট্ট নিশ্বাস ফেলে বলেন,
আশীষবাবু: ভিতরে আসতে পারো কোয়েল মা।
রাজ আশীষবাবুর কথা শুনে আশীষবাবুর দিকে তাকিয়ে ভয়ভীত চোখ নিয়ে কোয়েলের দিকে তাকায়। নিজের মনে মনে কিছু একটা ভেবে আশীষবাবুর দিকে আবারও তাঁকায়। মনে মনে বলে ওঠে,
রাজ: এটা আপনি ঠিক করলেন না মিস্টার ব্যানার্জী। সব ঠিক হতে যাচ্ছিল যখন তাহলে কেন আবার সবটা শেষ করে দিলেন?
এদিকে, কোয়েল স্থির ভাবে তাকিয়ে আছে ওদের দুজনার দিকে। সে নিজের ক্লাসের একটা বই বাড়িতে ফেলে যাওয়ায় ফিরে এসেছিল। যখন ঘরে যাচ্ছিলো তখন মিতা দেবী বলেন যাতে আশীষবাবুর ঘরে চা, আর একটা জুসের গ্লাস পৌঁছে দিতে। জুসের গ্লাসটা আশীষবাবুর অতিথির জন্য। ট্রে হাতে নিয়ে কোয়েল ঘরে ঢুকবে তাঁর আগেই সে রাজের কন্ঠস্বর শুনতে পায় আর দাঁড়িয়ে যায়। দরজাটাও খোলা ছিলো যাতে রাজের শরীরের পিছন দিকটা বসা অবস্থায় কোয়েল দেখতে পাচ্ছিলো। কোয়েল দাঁড়িয়ে যায় সেই মুহূর্তেই রাজের কথাগুলো শুনে।
রাজ: কুহু, আমার কথাটা শোনো…
কোয়েল নিজের হাত উঠিয়ে রাজকে থামার নির্দেশ দেয়। তারপর আস্তে আস্তে পিছিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। রাজ কোয়েলের পিছনে যেতে নিলে আশীষবাবু রাজের কাঁধে হাত রেখে আটকান আর বলেন,
আশীষবাবু: ও’কে একা ছেড়ে দাও। আমার মেয়ে নিজেকে একা সামলাতে জানে।
রাজ: আপনি ও’কে একা কীভাবে রাখতে হয় সেটা জানেন দেখেই ও নিজেকে একা সামলাতে জেনেছে। কিন্তু আমি ও’কে আর একা থাকতে দিতে চাই না।
রাজও বেরিয়ে যায় বাড়ির থেকে কিন্তু কোয়েলকে কোথাও খুঁজে পায় না। আদিত্যকে কল করলেও সে বলে কোয়েল নেই ভার্সিটিতে। রাজ হতাশ হয়ে ফিরে যায় নিজের বাড়ি কারণ কোয়েল এখনও ওকে ব্লক করে রেখেছে সব জায়গা থেকে।
দুদিন পর,
ঘটনাটার দুদিন কেটে গেছে কিন্তু এখনও আদিত্য বা মৌ আশীষবাবু আর রাজের মধ্যে কি কথা হয়েছে এবং কোয়েল কি শুনেছে সে সম্পর্কে কিছু জানেনা। আর না জানে রাজ কোথায় আছে। সেদিন যে রাজ কোয়েলের খবর নিয়েছিলো সেটাই শেষ, এই দুদিনে রাজের খোঁজ পায়নি আদিত্য। কিন্তু সেটার রাজের থেকে, অন্যের মাধ্যমে সে ঠিক রাজের খোঁজ বার করেছে। কারণ রাজকে জানাতে হবে, কোয়েল মুম্বাই চলে যাচ্ছে। জানার মধ্যে এটুকুই জানে শুধু আদিত্য আর মৌ। তাই তাঁরা রওনা দিয়েছে রাজের আস্তানার উদ্দেশ্যে।
মৌমিতা: যেই ঠিকানাটা পেয়েছো সেটা ঠিক তো আদি?
আদিত্য: ঠিক হতে বাধ্য ঠিকানাটা। যার থেকে পেয়েছি সে রাজের ঠিকানা না জানলে আর কেউ জানতে পারবে…
আদি কথা বলতে বলতে থেমে গেলো কারণ ঠিকানা অনুযায়ী ওদের সামনে রয়েছে একটা বিল্ডিং কমপ্লেক্স। বিল্ডিং কমপ্লেক্স তাই বড়ো তো হবেই সাথে সুন্দরও। আদির মতো আমিও বেশ হতবাক হয়ে বসে আছি। রাজদা এখানে থাকে? এতবড়ো আর সুন্দর একটা বিল্ডিং কমপ্লেক্সে?
মৌমিতা: আমরা ভুল করছি না তো?
আদিত্য: সেটা তো ভিতরে গেলেই জানা যাবে। লেটস গো।
আদি আর আমি কমপ্লেক্সে ঢুকে গাড়ি গ্যারেজে পার্ক করে লিফটে উঠে গেলাম। ঠিকানা অনুযায়ী সিকস্থ ফ্লোরে আসতেই একটা দরজার নেম প্লেটে দেখলাম রাজদার নাম। আদি গিয়ে ডোরবেল বাজাতেই একজন দরজা খুললো।
__কাকে চাইছেন?
আদিত্য: আমি রাজের বেস্ট ফ্রেন্ড হই, আদিত্য ব্যানার্জী। ওর সাথেই দেখা করতে এসেছি।
__আব, আচ্ছা ভিতরে আসুন।
আদি আর আমি স্বস্তির একটা নিশ্বাস ফেলে ভিতরে প্রবেশ করলাম। ভিতরে প্রবেশ করতেই ডাইনিং রুমে কাকাইকে রাজদার সাথে বসে থাকতে দেখে অবাক হয়ে গেলাম। আমাদের মতো ওরাও আমাদের দেখে অবাক হয়ে উঠে দাঁড়ালেন।
রাজ: উফ শ্বশুরমশাই! আপনি সবসময় আমাকে এভাবে ফাঁসিয়ে দেন কেন বলুন তো? (কানের কাছে আস্তে করে)
আশীষবাবু রাজের কথা শুনে রাজের দিকে বড়ো বড়ো চোখ করে তাকিয়ে হনহনিয়ে বেরিয়ে যান। যা দেখে রাজ বেকুবের মতো সেদিকেই তাকিয়ে থাকে। রাজ মনে মনে এখন ভাবছে আদিত্যকে কি বলবে।
আদিত্য: এটা তোর নিজস্ব ফ্ল্যাট?
রাজ: নাহ তো! আমি ভাড়া থাকি। (মজা করে)
আমি রাজদার কথা শুনে হেসে দিলে আদি আমার দিকে রাগী চোখে তাঁকায় যা দেখে আমি চুপ করে যাই।
আদিত্য: কাকাই কেন এসেছিলো এখানে?
রাজদা আদির কথা শুনে সোফায় আরাম করে বসে বলে,
রাজ: ঘোড়ার মতো দাঁড়িয়ে না থেকে বস। আর তোর কাকাইকেন এখানে এসেছিল সেটা তোর কাকাইকেই জিজ্ঞেস করিস। আমার মতো গরীবের বাড়িতে ওনার পায়ের ধূলো পড়েছে ঠিক কি কারণে সেটা উনিই বলতে পারবে। যাই হোক কি খাবি বল? ধুর তোকে জিজ্ঞেস করে লাভ নেই, বৌদি কি খাবে বলো?
আদিত্য: (রাজের পাশে বসে) রাজ তুই এতটা রিল্যাক্স হয়ে কীভাবে বসে আছিস? তুই জানিস কোয়েল মুম্বাই চলে গেছে?
রাজ: হ্যাঁ তো তুই আমাকে বাসি খবর দিতে এসেছিস? গেছে তো ভালো করেছে, একটু হাওয়া খেয়ে আসুক। এতে হাওয়া বদলও হবে আর খাওয়াও হবে। সামু কাকা! দুটো স্ট্রং কফি আর একটা কোল্ড ড্রিংক নিয়ে এসো।
এইবার তো আমিও অবাক হয়ে যাচ্ছি আদির সাথে সাথে। রাজদার ব্যবহার দেখে আমি আর আদি একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলে রাজদা নিজের ফোন নিয়ে বসেন। আমি আর আদি সেই ফাঁকে একবার চারিপাশটা চোখ বুলিয়েনি। বেশ সুন্দর করে সাজানো চারিদিকটা। ইতিমধ্যে কফি আর কোল্ডড্রিংক এসে গেলে রাজদা কফি মগ হাতে নিয়ে ফোনের দিকে তাকিয়েই বলে,
রাজ: বাড়ি ফিরে লাগেজ প্যাক করে ফেল। আজ সন্ধ্যের ফ্লাইট মুম্বাই যাওয়ার।
রাজদার কথা শুনে আমি আর আদি খুশি হয়ে একে অপরের দিকে তাকিয়ে হাসলে রাজদাও আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসে। কিন্তু রাজদার মুখটা বেশ শুকনো লাগছে। তাঁর মুখে হাসিটা দেখে বেশ ভালোই লাগছে এখন। আগে তো কোয়েলের কাছে পৌঁছাই তাহলেই সবটা জানা যাবে।
চলবে।