একদিন তুমিও ভালোবাসবে পর্ব-৬১+৬২+৬৩

0
1686

‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️
||পর্ব~৬১||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা

৯২.
কোয়েল আমাদের বাংলোতে থেকেই পরীক্ষা দেওয়া শেষ করলো। আমাদের পরীক্ষা শেষ হয়েছে দুদিন হলো। আজকে থেকে আবার ভার্সিটি যাওয়া শুরু করবো আমরা। যেদিন কোয়েল এ বাড়িতে এসেছিলো সেদিন রাতে আদি রাজদার সাথে কথা বলে নিয়েছিলো কিন্তু সবটা ঠিক হয়েছিল কি? সবটা ঠিক হলে রাজদা এড়িয়ে চলতেন না আদিকে। আমি যেমন এটা লক্ষ্য করেছি, আদি এটা খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পারছে। কিন্তু স্বীকার করেছে না আমার কাছে। যতবার জিজ্ঞেস করছি, “সত্যি কি সব ঠিক আছে?” উত্তরে বলছে, “হ্যাঁ ঠিক আছে।”

কোয়েল: এতো কি আকাশ-পাতাল ভাবছিস বল তো? চল দাভাই ওয়েট করছে তো।

মৌমিতা: আব, তোর রাজদার সাথে কথা হয়েছে?

কোয়েল: হ্যাঁ কথা হয়েছে। বললো তো আসবে আজকে ভার্সিটিতে। হঠাৎ ওর কথা জিজ্ঞেস করছিস? কিছু কি হয়েছে?

মৌমিতা: তোর মনে হয় রাজদা আদির সাথে স্বাভাবিক হয়ে গেছেন?

কোয়েল: এতটা তাড়াতাড়ি কি স্বাভাবিক হওয়াটা সম্ভব বলে মনে হয় তোর? আমার তো মনে হয় না আর সেটা হয়ওনি। রাজ চেষ্টা সবটা ভুলে মানিয়ে নেওয়ার। ও দাভাইয়ের কথাগুলো মনে করতে চায় না জানিস তো? কারণ ওই কথাগুলো ওকে ভীষণ কষ্ট দেয়। ওর দুর্বল জায়গাটায় আঘাত করে ফেলেছে দাভাই, তাও আবার আমার জন্যে। আমি যদি রাজকে বোঝার চেষ্টা করতাম তাহলে হয়তো এসব কিছুই হতো না।

মৌমিতা: নিজেকে অপরাধী মনে করিস না কোয়েল। সময় সবটা ঠিক করে দেবে দেখিস। কথায় আছে জানিস তো? “টাইম হিলস!” আদি পুরো বিষয়টা আমার থেকে এড়িয়ে যেতে চাইছে। তাই জন্যেই তোকে জিজ্ঞেস করে সিওর হলাম।

কোয়েল: আগের দিন এই নিয়ে কথা হচ্ছিলো আমার সাথে। মন খারাপ ছিলো বলে আমাকে ডেকে ছিলো, আমি যাওয়ার পর ও নিজে থেকেই কথাটা তুলেছিলো। আশা করছি ও খুব তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক হয়ে যাবে কারণ আমার সাথে শেয়ার করে অনেকটা হালকা হয়েছে।

আমি কিছু বলতে যাবো তাঁর আগেই আদির হাঁক শুনতে পেলাম বাইরে থেকে। আমি আর কোয়েল একে অপরেরদিকে তাকিয়ে হেসে বাইরে বেরিয়ে গেলাম। বাইরে বেরোতেই আমি আর কোয়েল রাজদাকে দেখে দাঁড়িয়ে গেলাম। রাজদা হেসে কিছুক্ষণ কথা বলার পর আদিকে নিজে থেকে জড়িয়ে ধরলো। আমি ঠিক দেখছি কি না প্রমাণ নিতে কোয়েলের দিকে তাকালাম পরিবর্তে কোয়েলও হতবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালো। বাপ রে! এত তাড়াতাড়ি কথা মিলে যাবে কে জানতো? সেদিন আদি নিজে থেকে রাজদাকে জড়িয়ে ধরে ছিল, রাজদা নিজে থেকে ধরেননি। আজ এই দৃশ্য দেখে ভীষণ ভালো লাগছে।

আদিত্য: ভিতরে আধ ঘন্টা দাঁড়িয়েছিলে এখন বাইরে এসে দাঁড়িয়ে আছো। যাওয়ার ইচ্ছা না থাকলে বলো, আমি আর রাজ চলে যাচ্ছি।

রাজ: আমাদের আজকে ক্লাস এগিয়ে দিয়েছে সো তাড়াতাড়ি যেতে হবে।

কোয়েল: আহা! এতই যখন তাড়া তো এসেছো কেন নিতে? আসতে বলেছি নাকি? এই মৌ চল তো, আমরা একাই চলে যাবো।

আদিত্য: বইন থাম! ঝগড়া না করে চল এখন।

আদি কোয়েলকে টেনে নিয়ে যাওয়ার সময় কোয়েল রাজদাকে মুখ ভেংচি দিয়ে চলে গেলো। আমি আর রাজদা দুজনেই হেসে গাড়ির দিকে এগোলাম। ভার্সিটিতে পৌঁছে রাজদা আর আদি দুজনে নিজেদের ক্লাসের দিকে ছুট লাগালো। আমরাও পাস সাবজেক্টের ক্লাস করতে চলে গেলাম। ক্লাস শেষ করে আমি আর কোয়েল ক্যান্টিনে দেখা করতেই দেখলাম ভার্সিটির অনেকে বসে আড্ডা দিচ্ছে আর তার মধ্যে জিয়া ও তার সাঙ্গ-পাঙ্গরাও উপস্থিত। সেই দেখে কোয়েল আমাকে বললো,

কোয়েল: মৌ, চল এখান থেকে। যেভাবে গোল মিটিং বসিয়েছে মনে হয় নিশ্চই কোনো গন্ডগোল পাকাবে।

মৌমিতা: রণিতও আছে ওদের সাথে, দেখেছিস?

কোয়েল: দেখেছি বলেই যেতে বলছি। চল।

কোয়েল আমার হাত ধরে টেনে বাইরে নিয়ে যেতে শুরু করলো রণিত পিছন থেকে দৌঁড়ে এসে আমাদের সামনে দাঁড়ায়।

মৌমিতা: কি চাই?

রণিত: তোমাকে চাই মৌ ডার্লিং! (মৌমিতার দিকে এগিয়ে এসে)

মৌমিতা: (পিছিয়ে গিয়ে) ডোন্ট ক্রস ইউর লিমিট রণিত।

রণিত: বাহ রে! আমি চাইলে “ডোন্ট ক্রস ইউর লিমিট” আর আদিত্যদা চাইলে “অলওয়েজ ওয়েলকাম”? এমনটা তো ঠিক না মৌ ডার্লিং! (বাঁকা হেসে)

কোয়েল: জাস্ট শাট ইউর মাউথ রণিত। অসভ্যতামির ও একটা লিমিট থাকে?

জিয়া: তুই অন্তত সভ্যতা অসভ্যতা নিয়ে জ্ঞান দিস না কোয়েল। তোকে এসব মানায় না। নিজে কি অসভ্যতামি করে বেড়াচ্ছিস সেটা আগে বল।

কোয়েল: আচ্ছা? আমি অসভ্যতামি করেছি? তা কি করেছি শুনি একটু? আমার তো মনে পড়ছে না আমি একেকদিন একেক ছেলের সাথে ঘুরে বেরিয়েছি বলে, যেটা তোর কাজ।

জিয়া: (হেসে) তুই তো আমার থেকেও জঘণ্য কাজ করেছিস। যাকে এতদিন নিজের দাদা হিসাবে চালাতিস, আজকাল তাঁর সাথে রাত কাটাচ্ছিস এক বাড়িতে। এটা কি তোর বান্ধবীকে আদির হাতে তুলে দেওয়ার পুরস্কার?

কোয়েল: মাইন্ড ইউর ল্যাঙ্গুয়েজ জিয়া! (চিৎকার করে)

জিয়া: আরো জোরে! আরো জোরে চিৎকার কর। আমি তো চাই ভার্সিটির সবাই জানুক তোদের দুই বান্ধবীর চরিত্র সম্পর্কে। (পিছন ফিরে সবার উদ্দেশ্যে) সো গাইজ! এতদিন যারা ভাবছিলিস/ভাবছিলে আমাদের মৌমিতা খুব শান্ত-শিষ্ট ভদ্র মিডিল ক্লাস ফ্যামিলির মেয়ে তাঁদের জন্য আমার করুণা হচ্ছে। কারণ আমাদের সকলের প্রিয় মৌমিতা মিডিল ক্লাস ফ্যামিলির লোভী একটা মেয়ে যার নজর ছিলো আমাদের ইউনিয়ন হেড আদিত্যের উপর, ওর টাকার উপর। তাই তো রাতও কাটিয়ে ফেললো পরীক্ষার আগে। আমার কথা বিশ্বাস না হলে ওকেই জিজ্ঞেস করে নিন, ও পরীক্ষাটা কার বাড়িতে থেকে দিয়েছে। আর কোয়েল? ওর কথা তো আগেই জানালাম আপনাদের। ওই হেল্প করেছে মৌমিতাকে আদিত্যের কাছে পৌঁছাতে তাই তো আদিত্য ওকে পুরস্কার দিয়েছে। আদিত্যেরই তো লাভের লাভ হয়েছে, একসাথে দুটো মেয়েকে পেয়ে গেছে। আমি তো আগেই বলেছিলাম এই গরীব ঘরের মেয়ে গুলো টাকার লোভী হয়। কিন্তু মৌমিতাকে দেখে জানতে পারলাম ওরা টাকার জন্য নিজেকেও বিক্রি করতে পারে ছে….

জিয়ার কথা শেষ হওয়ার আগেই কেউ জিয়ার গালে সজোরে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো। হঠাৎ হওয়ার ফলে জিয়া ভারসাম্য হারিয়ে হুমড়ি খেয়ে ক্যান্টিনের চেয়ারের উপর পরলো। সোজা হয়ে দাঁড়াতেই দেখলো আদিত্য রাগে রীতিমতো ফুঁসছে। আদিত্যদের ক্লাস শেষ হওয়ার পর রাজ একটু নিজের দরকারে বেরিয়ে যায় আর আদিত্য ক্যান্টিনের দিকে এসে কারণ ও জানতো কোয়েল আর মৌমিতা ক্যান্টিনে থাকবে। রাজকেও কাজ শেষ করে ক্যান্টিনেই আসতে বলেছিলো কিন্তু আদিত্য ভাবেনি ওকে এসবের সম্মুখীন হতে হবে।

আমি জিয়ার কথাগুলো শুনে চোখ মুখ খিঁচে বন্ধ করে নিজের কান্না আটকানোর চেষ্টা করছিলাম সেসময় একটা আওয়াজ শুনে চোখ খুলে তাকালাম। আদিকে আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমি আর নিজেকে আটকাতে পারলাম না, শব্দ করেই কেঁদে দিলাম। আদি আমার দিকে ফিরে দু-হাত আমার গালে রেখে, চোখের জল মুছিয়ে বললো,

আদিত্য: এই চড়টা তোমার আর কোয়েলের ওকে মারা উচিত ছিলো। ও এতগুলো আজে বাজে কথা বলছিলো আর তোমরা শুনছিলে? বলতে পারলে না তোমার আর আমার সম্পর্কটা কি? ছুটি তুই? তুই কেন চুপ করেছিলি? ফাইন! আমিই বলবো সবাইকে।

আদিত্য আমাকে ছেড়ে জিয়ার কাছে গিয়ে জিয়ার বাহু টা শক্ত করে ধরলো। চোয়াল শক্ত করে, দাঁতে দাঁত চেপে বললো,

আদিত্য: খুব শখ না তোর সবাইকে জানানোর। চল, তোর মনের ইচ্ছা আমি পুরণ করছি। “সব” জানাবো আজকে আমি। তোরাও আয়।

৯৩.
আদিত্য জিয়াকে নিয়ে টানতে টানতে ভার্সিটির মাঠে এনে উপস্থিত হলো। জিয়াকে ধাক্কা মেরে ছেড়ে দিয়ে আদিত্য পিছন ফিরে দেখলো সবাই আসছে। সেটা দেখে জিয়ার দিকে বাঁকা হাসলেই জিয়া একটা শুকনো ঢোঁক গেলে।

আদিত্য: কি হলো জিয়া? এভাবে ঘামছিস কেন তুই? ভয় পেয়ে গেলি নাকি?

জিয়া: ভ..ভয় পাবো কেন? আমি য..যা বলেছি সত্যি বলেছি। ভয় প..পাবো কেন?

আদিত্য: ওহ রিয়েলি? কনফিডেন্স ভালো, ওভার কনফিডেন্স ভালো না জানিস তো?

আদিত্য যেই দেখলো সবার সাথে মৌমিতা আর কোয়েলও এসে ওর পাশে দাঁড়িয়েছে তখনই সবার উদ্দেশ্যে বলতে শুরু করলো,

আদিত্য: জিয়া জানো তোদের কি বলেছে? আমি সবটাই শুনেছি, শুধু দেখছিলাম জিয়া কতটা নীচে নামতে পারে। তুই কোয়েলের নামে কি বললি জিয়া? কোয়েল অসভ্যতামি করেছে তাঁর সাথে যাকে কিনা এতদিন ও নিজের দাদা বলতো রাইট? সব সত্যি জানার পরও তুই কীভাবে এই এত বড়ো নোংরা কথাটা বলতে পারলি বলবি প্লিজ? তুই খুব ভালো ভাবেই জানিস কোয়েল আমার আপন খুড়তুতোবোন হয়। (জোর দিয়ে) তোর বাবা না আমার কাকাই, আশীষ ব্যানার্জীকে জমের মতো ভয় পায়। সেটা জানিস নিশ্চই? তার মেয়েকে আজকে সকলের সামনে অপমান করেছিস তুই, আশীষ ব্যানার্জীর মেয়েকে।

আদিত্যের কথা শুনে জিয়া সবার দিকে তাকাচ্ছে আর নিজের আঙুল কচলাচ্ছে ভয়ে ভয়ে। আদিত্য এবার মৌমিতার পাশে দাঁড়িয়ে বললো,

আদিত্য: মৌকে তুই বদনাম করছিলি ও আমার বাংলোতে রাত কাটিয়েছে তাঁর জন্য। খোঁজ যখন নিয়েছিলি তখন একটু ভালো ভাবে খোঁজ নেওয়া উচিত ছিলো তোর আর তোর রণিতের।

আদিত্য রণিতের কলার ধরে নিজের সামনে এনে দাঁড় করালো যাতে রণিত আরো বেশি ঘাবড়ে গেলো। আদিত্য একহাতে রণিতের কলার আর আরেক হাতে মৌমিতার হাত শক্ত করে ধরে, জোর দিয়ে বললো,

আদিত্য: মৌ নিজের অধিকারে আমার বাংলোতে ছিলো। স্ত্রীয়ের অধিকারে আমার সাথে রাত কাটিয়েছে। ওর নাম মৌমিতা ব্যানার্জী! ওয়াইফ অফ আদিত্য ব্যানার্জী! ডটার ইন ল্য অফ আকাশ ব্যানার্জী! হু ইজ দ্য মেম্বার অফ আওয়ার ইউনিভার্সিটি ডিরেক্টর বোর্ড। তাই ওর দিকে আঙুল তোলার আগে এই ভার্সিটির সবাই জানো এই কথাগুলো মনে রাখে।

কথা শেষ করেই আদিত্য মৌমিতার হাত ছেড়ে রণিতের মুখে ঘুষি মেরে দিলো আর রণিত উপুড় হয়ে নীচে পড়লো।

আদিত্য: বউ হয় ও আমার! তাই নিজের যোগ্যতা বুঝে কথা বলা উচিত ছিলো তোদের। আগের বার ওর দিকে খারাপ ভাবে হাত বাড়িয়েছিলি তাই তোর হাত ভেঙে ছিলাম এই বার তোর জিভটা টেনে ছিড়ে নেবো আমি।

এই বলে আদিত্য এগোতে গেলেই মৌমিতা এসে আদিত্যের হাত ধরে নেয়। আদিত্য রাগী চোখে মৌমিতার দিকে তাকালে মৌমিতা না বোধক মাথা নেড়ে সকলে উপস্থিত আছে এখানে সেটার ইশারা করে। চিল্লাচিল্লির কারণে যাদের ক্লাস হচ্ছিলো তাঁরা সমেত ম্যাম, স্যাররাও বেরিয়ে এসেছেন। এটা দেখে আদিত্য থেমে গিয়ে জিয়ার দিকে তাকায় দেখে, জিয়া আহত দৃষ্টি নিয়ে ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে। মৌমিতাকে নিয়ে জিয়ার দিকে এগিয়ে গিয়ে আদিত্য বলে,

আদিত্য: তোদের মনে হতেই পারে আমি মৌকে বাঁচানোর জন্য মিথ্যে বলছি তাই দুটো প্রমাণ এখন দিচ্ছি।

এই বলে আদিত্য মৌমিতার বাঁ হাত থেকে হোয়াইট কালারের ব্যান্ডটা টান মেরে খুলে ফেললো যেটা ও নিজের কব্জিতে পড়েছিলো। এরপর ওর তুলে দেখিয়ে বললো,

আদিত্য: এটাকে নোয়া বলে জানিস নিশ্চই? এটা বিবাহিত মেয়েরাই পরে। বিবাহিত মেয়েদের সবথেকে বড় উদাহরণ এটা, যা তোরা কোনোদিন টের পাসনি।

এবার যত্ন সহকারে আদিত্য মৌমিতার চুলের রবার ব্যান্ডটা খুলে দিয়ে, কয়েকটা চুল উল্টে দিয়ে মৌমিতার সামনে থেকে সরে দাঁড়িয়ে বললো,

আদিত্য: এই যে ওর মাথায় আমার নামের সিঁদুর। হঠকারিতায় আমাদের বিয়েটা হওয়ায় আমি বারণ করেছিলাম ওকে আমার স্ত্রী হিসাবে পরিচয় না দিতে আর শুধুমাত্র সেই জন্যেই ও আজকে এতো কটূ কথা শুনেও প্রতিবাদ করেনি। আমি ভুল করেছিলাম ওকে বারণ করে তাই আমি সেটা শুধরে নিলাম প্রতিবাদ করে। চিন্তা করিস না, সামনেই আমাদের গ্র্যান্ড রিসেপশন। ইউনিভার্সিটির সবার ইনভিটেশন রইলো। সাথে আমার কথাগুলো জানো মনে থাকে, আমার স্ত্রী আর আমার বোনের উপর জানো একটা আঁচড়ও না আসে। আসলে, রণিতের থেকেও খারাপ অবস্থা করবো আমি তাঁর। তাছাড়া কোয়েল কার আমানত সেটা নিশ্চই মনে করিয়ে দিতে হবে না?

আদিত্য কথাটা বলতেই কয়েকজন ছেলে ভয়ে শুকনো ঢোঁক গিললো। যা দেখে আদিত্যসহ মৌমিতা আর কোয়েলও মৃদু হাসলো। আদিত্য ওদের উদ্দেশ্যে বললো,

আদিত্য: ঠিক এই ভয়টাই দেখতে চাই আমি সবসময়। আর জিয়া! রাজ এখানে নেই তোর ভাগ্য ভালো, নাহলে এতক্ষণে চড়ের চোটে অজ্ঞান হয়ে যেতিস। তোর ফ্রেন্ড সৌভিকের অবস্থা জানিস তো?

জিয়া কথাটা শুনেই চমকে উঠে তাকালো আদিত্যের দিকে। আদিত্য সেটা দেখে বাঁকা হেসে বললো,

আদিত্য: তুই ওদের দুজনকে বদনাম করতে চেয়েছিলি তাই না? তাঁর পরিবর্তে আমি চাইলেই এখন তোর আর রণিতের ব্যক্তিগত কিছু সুন্দর সুন্দর ছবি যেগুলো রণিত তোকে ব্ল্যাকমেইল করবে বলে তুলেছিল টাকার জন্য, সেগুলো ফাঁস করে দিতে পারি সবার সামনে। তাছাড়া তোর আদরের সৌভিকদা! ওর সাথে তোর ঠিক কি রকম দাদার সম্পর্ক, সেটার প্রমাণ ও আমি সবাইকে দিতে পারি। তা দেবো নাকি?

আদিত্য বেশ জোরেই কথাগুলো বলেছে যাতে সবাই শুনতে পায়। জিয়া এসব শুনে আদিত্যের পা ধরতে গেলেই আদিত্য সরে আসে।

আদিত্য: আমার পা ধরার অধিকারও তোর মতো একটা নোংরা মানসিকতার মেয়ের নেই। তোকে নিজের বান্ধবী হিসাবে ক্ষমা করেছি বারবার কিন্তু তুই যে এটার যোগ্য নস সেটা বুঝিয়ে দিলি আজকে।

আদিত্য মৌমিতা আর কোয়েলের হাত ধরে ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে গেলো। ইউনিভার্সিটি থেকে বেরোতেই দেখলো রাজ গাড়ি নিয়ে আসছে। রাজ এসে আদিত্যের গাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে নেমে জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে”। এর উত্তরে সবাই একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি শুরু করলো, কি বলবে ভেবে।

‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️
||পর্ব~৬২||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা

৯৪.
আদিত্য: মৌ তুমি যেমন ভাবছো জিয়া তেমন মেয়ে নয়। ও অতটাও খারাপ না।

মৌমিতা: বাহবা, দুদিনে জিয়ার প্রতি এতো ভালোবাসা তোমার?

আদিত্য: মৌ প্লিজ! আমাকে জিয়ার সাথে কথা বলতে দাও। অলওয়েজ সব কিছুতে আমাকে এভাবে আটকানোর কোনো মানে হয় না। আমি মনে করি এই জন্যেই জিয়া কাজগুলো করেছে স আমাকে যেতে দাও ওর কাছে।

মৌমিতা: আমার তোমার সাথে জরুরী কথা আছে তাই তুমি এখন আমার সাথে যাবে।

আমি আদিকে টেনে নিয়ে জিয়ার সামনে থেকে চলে এলাম। আদি আমার আর ওর রিসেপশনের আগে একটা পার্টি থ্রো করেছে যেখানে আমার ক্লাসমেটস আর ওর ক্লাসমেটসরাসহ আরো অনেকে উপস্থিত ইউনিভার্সিটির। পার্টি চলাকালীন হুট করেই জিয়া আমার সামনে এসে দাঁড়ায় আমি ওকে এড়িয়ে এগিয়ে যেতেই দেখি আদি জিয়ার দিকে তাকিয়ে এদিকেই আসছে। তাই আমি নিয়ে চলে গেলাম ওকে অন্যদিকে। আদির সাথে কথা বলে, একপ্রকার ঝগড়া করে আমি এসে বার সাইডে বসলাম। কিছুক্ষণ পর আমার পাশে এসে জিয়া এসে বসলো।

মৌমিতা: কি ব্যাপার বল তো জিয়া? তুই কেন আমার আগে পিছে ঘুরছিস বলবি? আগের দিনের অপমান কি কম হয়ে গেছে?

জিয়া: দেখ, আমি জানি আমি ভুল করেছি। আসলে কোয়েলের সাথে আমি অনেকবার কথা বলার চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি। ওর বাবা যদি এসবের ব্যাপারে জানতে পারে তাহলে কোনোভাবেই আমাকে আর এই ইউনিভার্সিটিতে পড়তে দেবে না। প্লিজ, প্লিজ তুই কোয়েলকে একটু বোঝা যাতে অন্তত আমাকে এই ইউনিভার্সিটিতে পড়তে দেয়। প্লিজ! আমি আর কখনও তোদের ত্রিসীমানায় আসবো না।

মৌমিতা: ওহ, তো এইজন্য আমার পিছনে ঘুর ঘুর করছিস তুই? নিজের স্বার্থ ছাড়া কখনও কিছু বুঝিস না তুই, এটা আমি ভুলেই গেছিলাম।

আমি কথাটা বলে কোয়েলের কাছে চলে এলাম। কোয়েলকে এসে জিয়ার কথাগুলো বলতেই কোয়েল বললো,

কোয়েল: আচ্ছা, এই ব্যাপার? চল দেখি ও কি বলে।

আমি আর কোয়েল জিয়ার কাছে আসতেই দেখি জিয়া দুটো ড্রিংকের গ্লাস নিয়ে বসে আছে। আমি গিয়ে জিয়ার পাশে বসতেই জিয়া আমার হাতে ড্রিংকের গ্লাসটা দিয়ে আমাকে বললো,

জিয়া: তুই এটা নে। এক্ষুনি ওয়েটার দিয়ে গেলো, আমি কোয়েলের সাথে কথা বলে আসছি।

জিয়া উঠে কোয়েলের সাথে কথা বলতে শুরু করলে আমি আমার পার্স থেকে একটা ছোটো মুড়ানো কাগজ বার করলাম, যাতে একটা পাউডার আছে। আস্তে করে সেটা খুলে জিয়ার ড্রিংকের গ্লাসটাতে একটু মিশিয়ে দিলাম। এদিকে কোয়েল জিয়ার সাথে কথা বলে ওকে ব্যস্ত রেখেছে। আমি ইশারা করে দিতেই কোয়েল জিয়ার কথায় রাজি হয়ে গেলো আর জিয়া আমার পাশে এসে বসলো।

জিয়া: তোর ড্রিংক শেষ?

মৌমিতা: হ্যাঁ। কিন্তু আমার মাথাটা না কেমন জানো ঝিমঝিম করছে।আমি একটু ওয়াশরুম থেকে আসছি হ্যাঁ?

কোয়েল: আমি যাচ্ছি তোর সাথে, চল।

কথা শেষ করে আমি উঠে কোয়েলের সাথে ওয়াশরুমে চলে আসলাম। আড় চোখে দেখলাম জিয়ার ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি।

জিয়া: (গ্লাসে চুমুক দিয়ে) এইবার বুঝবে আসল অপমান কাকে বলে, যখন সবার সামনে আদির বউ মাতলামি করে ওর সন্মান ধুলোয় মিশাবে। (বাঁকা হেসে)

__আমি কি একটু বসতে পারি এখানে?

জিয়া পাশে তাকিয়ে দেখলো রাজকে। আঁতকে উঠলো জিয়া রাজকে দেখে। সেই দেখে রাজ বললো,

রাজ: জিয়া রিল্যাক্স! আমি এমনিই বসতে চেয়েছিলাম। তোর প্রবলেম থাকলে ইটস ওকে, আমি চলে যাচ্ছি।

জিয়া: না না। আমার কোনো প্রবলেম নেই। তুমি ব..বসতে….

রাজ: আরে জিয়া সাবধানে। কি করছিস?

জিয়া উঠে রাজকে আটকাতে গেলে জিয়ার মাথাটা হুট করেই ঘুরে যায় আর ও পরে যেতে নিলে রাজ ধরে নেয়। রাজ জিয়াকে বসিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করে,

রাজ: তুই ঠিক আছিস তো?

জিয়া: হ্যাঁ, মাথাটা একটু ঘুরছে।

রাজ: ড্রিংকটা বেশি করে ফেলেছিস হয়তো।

জিয়া: বায় দ্য ওয়ে রাজ। আমি তোমাকে কিছু বলতে চাই। আসলে আমি সেদিন রাগের বশে কোয়েলকে অনেক আজে বাজে কথা বলে ফেলেছি। কি করবো বলো? আমি তো আদিকে ভীষণণণণ ভালোবাসি তাই মৌমিতার সাথে ওকে মেনে নিতে পারিনা। (মাতাল কণ্ঠে)

রাজ: এটাই তো জিয়া। তুই যদি মৌমিতাকে সরানোর চেষ্টা না করে নিজের বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে আদির সাথে থাকতে পারলে আজ আদি তোর হতো।

জিয়া: ম..মানে? তুমি কি বলছো? ড্যাডের বিরুদ্ধে কেন যাবো? ড্যাড তো আদিকে পছন্দ করে।

রাজ: তোর বাবা কোনোকালেই আদিকে পছন্দ করতো না। তোর জন্য মেনে নিয়েছিলো শুধু। তুই তো জানিস আদি বরাবর সত্য, ন্যায়ের পথে থাকতে ভালোবাসে যেখানে তোর বাবা পুরো বিপরীত। এই নিয়েই আদি ভালোভাবে তোর বাবাকে বলেছিলো যে এসব ছেড়ে দিতে। কিন্তু তোর বাবা আদিকে খুব বাজে ভাবে অপমান করে তাড়িয়ে দিয়েছে।

জিয়া: কি? ড্যাড এরকম করেছে?

রাজ: হ্যাঁ, তাই জন্যেই তো আদি মৌমিতাকে একসেপ্ট করতে বাধ্য হয়েছে। আদি ভেবেছিলো তুই ওকে সাপোর্ট করবি।

জিয়া: আ..আমি তো জ..জানতামই না ব্যাপারটা।

রাজ: এখন তো জানলি। এখন যদি তুই আমাকে তোর বাবা কি কি কাজে জড়িত সেটা বলিস তাহলে আমি আদিকে সেটা বলবো। ওকে বোঝাবো যাতে ও মৌমিতাকে ডিভোর্স দিয়ে দেয়। এমনিতেও ও মৌমিতার সাথে হ্যাপি নেই, সবটা তোর বাবার উপর রাগ করে করেছে। তুই নিজের চোখেই দেখেনে।

রাজের কথায় জিয়া সামনে তাকাতেই দেখলো আদিত্য আর মৌমিতার মধ্যে ভালোই কথাকাটাকাটি চলছে। সেই দেখে জিয়া চোখ টানতে টানতে রাজকে বললো,

জিয়া: আ..আমি জ..জানি! আমি সব জানি। ড..ড্যাড কি কি ক..কাজে জড়িত সব জ..জানি…

এক এক করে জিয়া রাজকে সব বলতে শুরু করলো। পরেশবাবুর কোথায় কোম্পানি আছে আর সেখানে কি কি দুর্নীতি হয়। এছাড়া কীভাবে পরেশবাবু স্মাগলিং এর কাজে যুক্ত হয়েছিলেন সব। রাজ সবটা শুনে নিজের ফোনের রেকর্ডারটা অফ করে দিলো তারপর আদিত্যকে ফোন করলো। আদিত্যকে ফোন করতেই আদিত্য,মৌমিতা আর কোয়েল এসে দাঁড়ালো। দেখলো জিয়া রাজের কাঁধে মাথা রেখে ঢুলছে। কোয়েল গিয়ে সাথে সাথে জিয়ার মাথাটা তুলে চেয়ারটা ঘুরিয়ে ডেস্কে শুয়ে দিলো।

কোয়েল: নেশার ঘোরেও মেয়ে গায়ে পরা স্বভাব গেলো না। হুহ, যত্তসব!

আদিত্য: সো? পুলিশকে কল করেদি?

কোয়েল: না না। আমাদের যেই প্রুফের দরকার ছিলো তা আমরা পেয়ে গেছি যখন, তখন এভাবে সবার আনন্দ নষ্ট করে কোনো লাভ নেই।

রাজ: তাহলে কি করতে চাইছো?

কোয়েল: কি আবার? পরেশবাবুর বাড়ি গিয়ে জিয়াকে পৌঁছে দিয়ে আসি আর ওনাকেও মামাবাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দি? ভালো হবে না?

আদিত্য: গ্রেট আইডিয়া!

রাজ: যাই বলিস, বউদির আইডিয়াটা কিন্তু জাস্ট ফাটাফাটি। এতে সবাই আনন্দও করতে পারলো আবার আমাদের কাজ হাসিলও হয়ে গেলো।

আদিত্য: বউটা কার দেখতে হবে না? (মৌমিতাকে একহাতে আগলে)

মৌমিতা: আমি শুধু ভাবছি, আজকের দিনেও জিয়া আমাকে হেনস্থা করতে চেয়েছিল। ভাগ্যিস রাজদা দেখে কোয়েলকে মেসেজ করেছিলেন যে, জিয়া আমার ড্রিংকে নেশার ওষুধ মিশিয়েছে।

কোয়েল: যা হয় ভালোর জন্যই হয়। ওর নিজেরই ডাবল ডোজ হয়ে গেছে, তাই জন্যেই তো কাজ তাড়াতাড়ি হয়েছে।

আদিত্য: যাই হোক, আমি এবার অ্যানাউন্সমেন্ট করে সবাইকে ইনভাইট করে পার্টিটা শেষ করে দিই?

রাজ: ইয়াহ অফকোর্স।

আদিত্য মৌমিতাকে নিয়ে পার্টির মধ্যমণি হয়ে উঠলো। রাজ আর কোয়েলও ওদের সাথে গেলো। ওরা অ্যানাউন্সমেন্ট করুক, আমরা প্ল্যানিংটা জেনে আসি চলুন।

ফ্ল্যাশব্যাক………………………….

আদিত্য মৌমিতা আর কোয়েলের হাত ধরে ইউনিভার্সিটি থেকে বেরিয়ে গেলো। ইউনিভার্সিটি থেকে বেরোতেই দেখলো রাজ গাড়ি নিয়ে আসছে। রাজ এসে আদিত্যের গাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে নেমে জিজ্ঞেস করলো, “কি হয়েছে”। এর উত্তরে সবাই একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি শুরু করলো, কি বলবে ভেবে।

রাজ: কি রে সবাই এভাবে একে অপরের মুখ দেখছিস কেন?

আদিত্য: আমি বলছি।

আদি রাজদাকে একটু সাইডে নিয়ে গিয়ে আস্তে আস্তে ডিটেইলসে সবটা বলতে শুরু করলো। কোয়েল হুট করে আমার হাত শক্ত করে চেপে ধরলে আমি ওর মুখে দিকে তাকালাম। বেচারি ভয়ে একবারে চুপসে গেছে। সৌভিকদার কথাটা মনে করে আমিও একটা বড়ো সরো ঢোঁক গিললাম। আদির বলা শেষ হতেই আদির মুখটাও থমথমে হয়ে গেলো রাজদার নীরবতা দেখে। রাজদা শার্টের হাতা ফোল্ড করতে শুরু করলেন এবার। আদি রাজদাকে সেই দেখে কিছু বলতে যাবে তাঁর আগেই রাজদা লাফিয়ে গাড়ির বনেটের উপর উঠে বসে, আদির পিঠে জোরে একটা চাপর মারলেন।

রাজ: আরি সাবাস! গ্র্যান্ড রিসেপশনের আগে তো তুই গ্র্যান্ড অ‌্যানাউন্সমেন্ট করে ফেললি। (হেসে)

রাজদার এতো শান্ত ভাব দেখে অবাক হওয়ার সাথে সাথে স্বস্তি পেলাম। আদি হেসে বললো,

আদিত্য: প্ল্যানিং তো শুধু অ‌্যানাউন্সমেন্টের ছিলো, সেটা যে গ্র্যান্ড হয়ে যাবে ভাবিনি।

মৌমিতা: প্ল্যানিং ছিলো মানে?

রাজদা: মানে আদি আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছিলো এই বিষয়টা সবাইকে জানাবে। আর তোমাকেও সারপ্রাইজ দেবে।

মৌমিতা: মানে আদি যেগুলো বললো কিছুক্ষণ আগে সেগুলো সত্যি?

আদিত্য: নাহ আমি তো শুধু শুধু ঢ্যাঁড়া পেটালাম সবার সামনে তাই না? (রেগে)

কোয়েল: আরে দাভাই চটছিস কেন? মৌ সারপ্রাইজটা হজম করতে পারেনি। এমন একটা পরিস্থিতিতে হয়েছে ব্যাপারটা তাই হয়তো।

আদিত্য: এখনই হজম করতে না পারলে হবে, আগে তো অনেক কিছু হজম করতে হবে।

আদি দুষ্টু হেসে আমার দিকে তাকিয়ে চোখ টিপ দিলে আমি একটা শুকনো ঢোঁক গিলি চোখ বড়ো বড়ো করে। কোয়েল আর রাজদা যে হাসলেন আমার রিয়াকশন দেখে সেটা আমি আড় চোখে লক্ষ্য করলাম। এদিকে আদিও ঠোঁট কামড়ে হাসছে।

মৌমিতা: নির্লজ্জ! (বিড়বিড় করে)

আদিত্য: রাজ! কোথায় গেছিলিস তুই?

রাজ: আমার অফিসের একটা ফাইল আনতে। বায় দ্য ওয়ে, ডেট ফিক্সড কবে করেছিস।

আদিত্য: এই তো রবিবার।

রাজ: তার মানে আর পাঁচদিন পর? আজকে তো সোমবার।

কোয়েল: দাভাই, নিমন্ত্রণ নেওয়ার জন্য দিন গুনছে।

আদিত্য: ওকে আবার নিমন্ত্রণ করতে হবে নাকি?

রাজ: যাবার হলে তো নিমন্ত্রণ নেওয়ার আশা করবো। যেখানে আমাকে মানায় না সেখানে আমি গিয়ে কি করবো?

রাজ ইচ্ছা করেই কথাটা বলেছে সবার রিয়াকশন দেখার জন্য। কথাটা শুনতেই আদিত্য মাথা নামিয়ে নেয় আর মৌমিতা, কোয়েলেরও মুখটা কালো হয়ে যায়। সেই দেখে রাজ হেসে দিয়ে বলে,

রাজ: এতো সিরিয়াস হওয়ার কিছু নেই আমি মজা করছিলাম। আসলে, আমার মনে হয় না আমি সেদিন থাকতে পারবো বলে। আমাকে কাজের থ্রু তে একটু বাইরে যেতে হবে।

আদিত্য: (তাচ্ছিল্য হেসে) এড়িয়ে যাওয়ার জন্য কথাটা বলে সান্তনা দিচ্ছিস তাই না?

রাজ: আমি জানতাম মজাটা করার পর তুই এটাই বলবি তাই প্রমাণটা নিয়ে এসেছি।

রাজদা বনেট থেকে নেমে গাড়ির ভিতর থেকে ফাইলটাআদির হাতে ধরিয়ে বললো,

রাজ: এই দেখ, টিকিট কবে বুক করা। তুই আমাকে আজকে সকালে জানালি আর টিকিট বুক আমি এক সপ্তাহ আগে করে রেখেছি। একটা ইম্পরট্যান্ট মিটিং আছে ভাই। নেক্সট প্রজেক্টের জন্য ডিল ফাইনাল হবে আমাকে যেতেই হবে নাহলে কোম্পানির লস হবে।

আদিত্য: ঠিক আছে দ্যান আমি ডেট পিছিয়ে দিচ্ছি। তাহলেই তো হয়ে যায়।

রাজ: না হয় না। আমি কবে ফিরবো তাঁর কোনো ঠিক নেই।

কোয়েল: মানে?

রাজ: মানে হতে পারে ডিল ফাইনাল হওয়ার পর ওখানকার ব্রাঞ্চে থেকেই আমাকে প্রজেক্ট কমপ্লিট করে ফিরতে হলো। যতক্ষণ প্রজেক্ট সাকসেসফুল হবে, আমি আসতে পারবো না সেক্ষেত্রে। তুই যেভাবে আজকে সবার সামনে বিষয়টা বলেছিস তাতে আমার মনে হয় না দেরী করা ঠিক হবে বলে তাই প্লিজ আমার জন্য তোদের রিসেপশনটা ডিলে করিস না।

আদিত্য: তুই আমার রিসেপশনে থাকবি না এটা আমি মানতে পারছিনা কিছুতেই রাজ। ইটস ইম্পসিবল।

মৌমিতা: রাজদা, আপনি না থাকলে আমাদের কি করে ভালো লাগতে পারে? আমার ননদিনীর কি ভালো লাগবে বলুন?

কোয়েল: ও কখনও ভেবেছি আমার ভালো লাগা-না লাগা নিয়ে? বাদ দে, ওকে এসব বলা বেকার। ও ভাবে না আমার কথা।

কোয়েল তেজ দেখিয়ে ওখান থেকে চলে গেলে আমি অসহায় ভাবে রাজদার দিকে তাকাই। আদিও ভীষণ আপসেট হয়ে রয়েছে বোঝা যাচ্ছে।

রাজ: আচ্ছা এভাবে আপসেট হোসনা আমি ট্রাই করছি কোনো ভাবে মিটিংটা পোস্টপন করা যায় কি না। বাট আমি বলবো আশা না রেখে তোরা রিসেপশনটা সেরে ফেল। কুহুকে আমি মানিয়ে নেবো। আদি, তুই তো বুঝবি বল আমার সিচুয়েশনটা?

আদি কোনোরকম ভাবে হ্যাঁ বোধক মাথা নেড়ে ওখান থেকে চলে গেলে রাজদা আমাকে বলেন,

রাজ: আদিকে প্লিজ একটু বুঝিও? আমার মনে হচ্ছেনা আমি আর পোস্টপন করতে পারবো বলে মিটিংটা। কারণ আমার বস নেই দেশে, উনি নিজে আমাকে ডিলটা সাইন করতে বলেছেন। এক্সামের জন্য পোস্টপন করেছিলেন মিটিংটা এরপর আর করবেন কি না বুঝতে পারছি না।

মৌমিতা: আপনি চেষ্টা করুন, আমিও দেখছি ওকে বোঝানো যায় কি না।

রাজ: সে তো ঠিক আছে কিন্তু এই “আপনিটা” তুমি কখন হবে? (হেসে)

মৌমিতা: উমম..আমাদের রিসেপশনে আসলে আর..

রাজ: আর?

মৌমিতা: আর আমার একটা প্ল্যান আছে। পরেশবাবুর এগেইনস্টে প্রুফ কালেক্ট করার জন্য।

রাজ: কি প্ল্যান?

মৌমিতা: আমার আদির রিসেপশনের আগে একটা পার্টির আয়োজন করবো। সেখানে আমার আর আদির ক্লাসমেটসরা থাকবে। জিয়াও থাকবে। সেখানে জিয়াকে নেশা করাতে হবে তারপর তুমি ওর কাছে গিয়ে বলবে আদিকে ওর বাবা পছন্দ করে না, ওনার কাজে বাঁধা দেওয়ার জন্য অপমান করেছেন। তাই আদি আমাকে মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে নাহলে জিয়া যদি ওর বাবার এগেইনস্টে প্রুফ দেয় তাহলে আদি ওকেই মেনে নেবে।

রাজ: আইডিয়াটা বেশ ভালো। আদি আর কোয়েলকে জানাতে হবে তো?

মৌমিতা: চলুন।

ফ্ল্যাশব্যাক এন্ড……………………………….

‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️
||পর্ব~৬৩||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা

৯৫.
রাত এগারোটা নাগাদ পরেশবাবু নিজের বাড়িতে, ড্রয়িংরুমে চিন্তিত হয়ে বসে আছেন। তাঁর আদরের মেয়ে জিয়া, এখনও বাড়ি ফেরেনি তাই। জিয়াকে ফোন করেও তিনি যোগাযোগ করতে পারেননি। পরে মনেপরেছে পার্টিতে থাকলে পার্টির আওয়াজে কীভাবে শুনতে পাবে। এইসব চিন্তার মাঝেই কলিংবেল বেজে উঠলে পরেশবাবু তড়িঘড়ি করে কাজের লোককে দরজা খুলতে বলে নিশ্চিন্ত হয়ে সোফায় বসেন। তাঁর ধারণা, জিয়া এসে পরেছে কিন্তু দরজা খুলতেই তিনি রেগে উঠে দাঁড়ালেন।

পরেশবাবু: তুমি? তুমি এখানে কি করছো আদিত্য?

আদিত্য: শুধু আমি নই…

রাজ: আমরাও আছি সাথে।

রাজ আদিত্যের পাশ থেকে বেরিয়ে এলো। ওরা দুজন ভিতরে চলে আসতেই মৌমিতা আর কোয়েল জিয়াকে ধরে ধরে ভিতরে নিয়ে এলো। জিয়া মৌমিতা ও কোয়েলের কাঁধে দু-হাত দিয়ে ভর করে আছে। এই অবস্থায় জিয়াকে দেখে পরেশবাবু বললেন,

পরেশবাবু: কি করেছো তোমরা আমার মেয়ের সাথে? কি অবস্থা এটা ওর?

আদিত্য: আপনার মেয়ের সাথে আমাদের আলাদা করে কিছুই করতে হয়নি। ও নিজেই নিজের পাতা ফাঁদে পা দিয়েছে। অনেক সাধ করে মৌমিতাকে নেশা করাতে গিয়ে নিজে নেশায় মত্ত হয়ে গেছে। এতে অবশ্য আমাদের সুবিধাই হয়েছে।

পরেশবাবু: তোমাদের সুবিধা মানে?

__মানে টা আমরা বোঝাচ্ছি মিস্টার সেন!

পরেশবাবু আদিত্যের পিছনে তাকিয়ে দেখলেন পুলিশ এসে হাজির হয়েছেন। ওনাদের দেখে উনি জিয়ার দিকে তাকালে কিছুটা আন্দাজ করতে পেরে ঘামতে শুরু করলেন।

রাজ: কি ব্যাপার? হঠাৎ করে ঘামছেন কেন এভাবে? গরম লাগছে নাকি মিস্টার সেন?

আদিত্য: এখনই এতো গরম লাগলে কীভাবে হবে? এখনও তো কিছুই হলো না।

পুলিশ: ইউ আর আন্ডার অ্যারেস্ট মিস্টার সেন। আপনার বিরুদ্ধে স্মাগলিং এবং ব্যবসার ও রাজনীতির ক্ষেত্রে সমস্ত দুর্নীতির প্রমাণ আমরা পেয়ে গেছি।

আদিত্য নিজের হাতে থাকা ফোনের রেকর্ডার অন করতেই পরেশবাবু জিয়ার কন্ঠ শুনতে পেলেন। যা ভেবেছিলেন তাই হয়েছে জিয়াই সবটা নেশার ঘোরে বলে ফেলেছে। শুধু ওনার না, ওনার সাথ যে সৌভিক, রণিত এবং রণিতের বাবা দিয়েছে সেটাও বলে ফেলেছে জিয়া। অগত্যা হাজতবাস ছাড়া এখন কপালে কিছুই নেই ওনার। পুলিশ ওনাকে হ্যান্ডকাফ পরিয়ে নিয়ে যাবে তাঁর ঠিক আগের মুহূর্তে পরেশবাবু রাজকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

পরেশবাবু: তোমার এই হাসি বেশিদিন চিরস্থায়ী হবে না।

এই একটা বাক্য বলার পর রাজের হাসি মলিন হয়ে যেতেই পরেশবাবুর ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো। কিন্তু সেটাও স্থায়ী হলো না কারণ রাজ আবারও হাসছে। এর ফলে পরেশবাবু বেশ অবাক হলেন তাই দেখে রাজ বললো,

রাজ: আমার হাসি নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না মিস্টার সেন। এই হাসি মলিন হবে নাকি আরো বেশি চওড়া হবে সেটা আপনি খবর পেয়ে যাবেন। না পেলে আমি নিজে গিয়ে আপনার কাছে খবরটা সরবরাহ করবো। চিন্তা একদম করবেন না। যান, ধীরে সুস্থে হাঁটা ধরুন।

পরেশবাবু মাথা নামিয়ে চলে গেলেন পুলিশের সাথে। আদিত্য রাজের পিছনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,

আদিত্য: কি ব্যাপার বল তো? প্রত্যেকবার উনি তোকে কিছু না কিছু বলে যান। কিসের শত্রুতা তোর সাথে ওনার?

রাজ: বাদ দে। চল বাড়ি চল হেব্বি টায়ার্ড লাগছে, আমার কাল সকালের ফ্লাইট।

রাজের ফ্লাইটের কথা শুনে বাকি তিনজন একে অপরের মুখ চাওয়া চাওয়ি করে রাজের দিকে তাকালো। আদিত্য করুন ভাবে জিজ্ঞেস করলো,

আদিত্য: পোস্টপন করতে পারিসনি? যেতেই হবে?

রাজ অসহায় ভাবে হ্যাঁ বোধক মাথা নারলে উপস্থিত তিনজন নিরাশ হয়। কোয়েল আর মৌমিতা কাজের লোককে বলে দেয় যাতে জিয়াকে নিজের ঘরে রেখে আসে আর সকালে যা যা হয়েছে তা বলে দিতে। তারপর চারজন বেরিয়ে আসে জিয়ার বাড়ি থেকে আর ফিরে যায়। সকাল হতেই আদিত্য, মৌমিতা আর কোয়েল রাজকে সি অফ করতে আসে এয়ারপোর্টে। রাজ সবাইকে হাসি মুখে বিদায় জানিয়ে,কোয়েলের কপালে ভালোবাসার পরশ দিয়ে এয়ারপোর্টের ভিতরে চলে যায়। ফিরে আসার সময় কোয়েল আর আদিত্য দুজনেই বেশ চুপচাপ থাকে সেই দেখে মৌমিতার নিজেকে ভীষণ অসহায় মনে হয়। কি বলবে বুঝতে না পেরে নিজের মতো করে বসে থাকে।

দুদিন পর,
আজ আদিত্য আর মৌমিতার রিসেপশন। দেখতে দেখতে দুদিন কেটে যায়নি। আদিত্য আর কোয়েলের মন খারাপের সাথে এই দুদিন কেটেছে। মৌমিতা শুধু দুজনকে সামলিয়েছে “মেনে নিতে হবে” কথাটুকু বলে। যাই হোক, আজ আদিত্য ভীষণ ব্যস্ত। নিজের বাবার সাথে সবটা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সামলাচ্ছে সে। কোয়েলের মন খারাপ থাকলেও সে হাসি মুখে নিজের জেম্মা অর্থাৎ আদিত্যের শ্বাশুড়ীর সাথে হাতে হাতে কাজ করে দিচ্ছে। আদিত্য আর ওর বাবা আকাশবাবু মৌমিতা, আদিত্যের মা এবং কোয়েলকে কিছু বলতে এলে এমন সময় উপস্থিত হলো এক ব্যক্তি। আকাশবাবু তাঁর দিকে এগিয়ে গিয়ে তাঁকে দেখে বলে উঠলেন,

আকাশবাবু: আশীষ, তুই এসে পড়েছিস? তোর আসার কথাই জানাতে এসেছিলাম তোর বৌদিকে।

আশীষবাবু: আমি এসেই বরং জানিয়ে দিলাম। তোকে আর কষ্ট করতে হলো না। তা নতুন বউমা কোথায়?

আশীষবাবুর কথা শুনে আমি এগিয়ে গেলাম মাথায় শাড়ির আঁচল টেনে। ওনার সামনে গিয়ে ওনাকে নমস্কার করতেই উনি আমাকে হাসি মুখে আশীর্বাদ করলেন। আদি এসে ওনাকে প্রণাম করতে নিলে উনি আদিকে বাঁধা দিয়ে বুকে টেনে নিলেন। এরপর আমাদের দুজনকে একসাথে দাঁড় করিয়ে দুটো প্যাকেট আমাদের হাতে তুলে দিলেন। আমরা হাসিমুখে সেটা গ্রহণ করলাম।

আশীষবাবু: আমি যেমন আদির কাকাই তেমন তোমারও কাকাই। গাই আমাকে একদম আপনি আজ্ঞে করার প্রয়োজন নেই।

আমি হেসে ওনার কথায় সম্মতি দিতেই উনি কোয়েলের দিকে তাকালেন। কোয়েল অন্যদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে ভাবলেশহীন হয়ে। উনি ধীর পায়ে কোয়েলের দিকে এগোলে আমি আদির দিকে তাকাই। আদি বেশ চিন্তিত হয়ে তাকিয়ে আছে সেদিকে। কাকাই এগিয়ে গিয়ে আস্তে করে কোয়েলকে জিজ্ঞেস করলো,

আশীষবাবু: ভালো আছো?

কোয়েল: হম।

আশীষবাবু: পরীক্ষা কেমন দিয়েছো?

কোয়েল: ভালো।

কোয়েল একবারও তাকায়নি কাকাইয়ের দিকে। উত্তর শুনে বোঝা যাচ্ছে সে ইচ্ছুক নয় কথা বলতে তাই আর কাকাই কথা না বাড়িয়ে মাথা নীচু করে নিলো দেখলাম।

আকাশবাবু: তুই এসেছিস ভালোই হয়েছে। আমি আর আদি হিমশিম খাচ্ছিলাম সব সামলাতে। এসে একটু আমাদের হেল্প কর।

মিতা দেবী: সে কি? সবে তো এলো ঠাকুরপো। একটু রেস্ট নিক তারপর হেল্প করবে। ঠাকুরপো তুমি বসো, আমি তোমার জন্যে চা করে আনছি।

আদিত্য: ড্যাড তুমি কাকাইয়ের সাথে বসো। আমি দেখে নিচ্ছি কিছুক্ষন।

মৌমিতা: হ্যাঁ মা, আপনিও বসুন, গল্পগুজব করুন। আমি চা করে আনছি আপনাদের জন্য।

৯৬.
বিউটিশিয়ানরা আমাকে সাজিয়ে দিলে, কোয়েল গয়নাগুলো পরিয়ে দেয়। তারপর আমাকে নিয়ে গিয়ে স্টেজে বসিয়ে দেয় যেখানে আমার আর আদির বসার জায়গা। ওখানে বসে আমি আদিকে খুঁজতে লাগলাম। খুঁজে না পেলে উঠে দাঁড়িয়ে একটু এদিক ওদিক দেখতে শুরু করি।

আদিত্য: আমাকে খুঁজছো?

আচমকা নিজের পাশে ওর গলার আওয়াজ পেয়ে আমি একটু ঘাবড়ে যাই। ওর দিকে তাকাতেই দেখি ও হাসছে।

মৌমিতা: কোথায় ছিলে?

আদিত্য: ড্যাডের গেস্টরা আসতে শুরু করেছে তাই দেখা করতে গেছিলাম। কিছুক্ষণ পরেই আসবে তোমার সাথে দেখা করতে।

আদির কথা শেষ হতেই ওর ফোন এলো আর ও আমাকে বলে অন্যদিকে চলে গেলো। একটু পরে ও ফিরে এলো মা আর বাবাকে নিয়ে। আমি গিয়ে মা বাবাকে জড়িয়ে ধরলাম। মা বাবার সাথে কিছুক্ষণ কথা বলার পর যার সাথে আদি আলাপ করাতে এলো তাঁকে দেখে আমি কিছুটা চমকে উঠলাম। এটা তো আমার সেই জেঠুর মেয়ে মানে আমার দিদি যাঁর বিয়েতে আমাকে আমার শ্বশুরমশাই আর শ্বাশুড়ীমা পছন্দ করে ছিলেন।

আদিত্য: মৌ, ও আমার বন্ধু আর এটা ওর ওয়াইফ। তুমি চেনো নিশ্চই?

মৌমিতা: দিভাই!

আমি দিভাইকে জড়িয়ে ধরলাম। মনে প্রশ্ন থাকলেও এই মুহূর্তে আদিকে কিছু জিজ্ঞেস করলাম না। ওরা গিফ্ট দিয়ে চলে গেলে আমি গিয়ে আমার জায়গায় একটু বসলাম। আবার একজন গেস্ট আসলে আমি উঠে দাঁড়াতেই অনুভব করলাম আমার ব্লাউজটা ঢিলে লাগছে। হাসি মুখে কুশল বিনিময় করতে করতেই মনে মনে বললাম,

মৌমিতা: আমার সঙ্গেই এমন হতে হয় সব সময়? ইশ, এই মুহূর্তে কোয়েলও নেই আর আমার হাতের কাছে ফোনও নেই। আদিও মনে হয় ওদিকটায় গেছে। কি করি এখন?

আমি গিয়ে চুপচাপ নিজের জায়গায় বসে সুযোগ বুঝে পিঠে হাত দিতেই বুঝলাম হ্যাঁ, আমার সন্দেহই ঠিক। চেইনটা নেমে গেছে। কি করবো ভাবছি এমন সময় ফটোগ্রাফার বলে উঠলেন,

__ম্যাম, স্যারকে ডাকুন ফটোশুট করতে হবে তো?

আদিত্য: ডাকার দরকার নেই। আমি এসে গেছি।

আদি এসে আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই আমার পিছনে গিয়ে দাঁড়ালো। টের পেলাম ওর হাতের স্পর্শ আমার পিঠে। হঠাৎ করেই পুরোনো কথা মনে পড়লো। সেই সময় আদি আমার কানের কাছে এসে বললো,

আদিত্য: কি? কিছু মনে পরলো নাকি?

মৌমিতা: (অবাক হয়ে) তুমি..??

আদিত্য: আজ্ঞে হ্যাঁ। আমিই আপনার চেইন লাগিয়ে দিয়েছিলাম সবার অগোচরে আর তাঁর বদলে তুমি আমার গায়ে জুস ফেলে দিয়েছিলে।

আদি আমাকে ছেড়ে দিলে আমি ওর দিকে ঘুরে গেলে ও আমার কোমরে দু-হাত রাখে।

মৌমিতা: তুমি তখন আমাকে দেখেছিলে?

আদিত্য: হ্যাঁ কিন্তু তোমার আমাকে দেখার আগেই সরে গেছিলাম। চেইন লাগানোর সময় দেখতে পায়নি, যখন ধাক্কা লেগেছিলো তখন দেখেছিলাম। তোমার ড্রেস দেখেই চিনে ছিলাম। এরপর রেজিস্ট্রি ম্যারেজ হওয়ায় আর খেয়াল করিনি। তারপর ফুলশয্যার দিন তো…

মৌমিতা: (আদিত্যর ঠোঁটে আঙ্গুল রেখে) থাক না সেসব কথা।

আদিত্য: (হালকা হেসে) ভার্সিটিতে যখন ঠিকভাবে দেখলাম তখনই চিনে ফেলেছিলাম। আমার বন্ধুর বিয়ে ছিলো আর আমি বরযাত্রী ছিলাম।

মৌমিতা: আর আমার জেঠুর মেয়ের বিয়ে ছিলো।

আদিত্য: জানি! ড্যাড বলেছে আজকে। (কপালে কপাল ঠেকিয়ে)

এইসব ছোটো ছোটো মুহূর্তের ছবিগুলো সব এক এক করে ফ্রেমবন্দি করছে ফটোগ্রাফার। ফটো সেশন শেষ হতেই আদিত্যের পরিবারের সবাই মিলে এক হলেন। কথা বলতে বলতে হঠাৎই আশীষবাবু বললেন,

আশীষবাবু: দাদা, আমি একটা কথা ভাবছিলাম।

আকাশবাবু: কি বিষয়ে?

আশীষবাবু: আসলে, ব্যাপারটা আমার মেয়েকে নিয়ে।

কথাটা শুনে কোয়েল তাকালো আশীষবাবুর দিকে তাকিয়ে। আশীষবাবু তা বুঝতে পারলেন আড় চোখে। তাই আকাশবাবুকে বললেন,

আশীষবাবু: আমার বন্ধু আমাকে একটা প্রস্তাব দিয়েছে। ওর বাড়ির বউমা করতে চেয়েছে আমার মেয়েকে। ছেলেটা বেশ ভালো, আমার বন্ধুর বিজনেস ওই সামলাচ্ছে এখন। আমরা একসাথে কাজও করেছি, তাই বলতে পারছি ছেলেটা বেশ ভালো।

আশীষবাবু যে এমন কিছুই বলতে চলেছেন তা আন্দাজ করতে পেরেছিল সবাই কারণ এটাই প্রথমবার নয়। গত এক-দু বছরের মধ্যে আগেও অনেকবার উনি কোয়েলের বিয়ের প্রসঙ্গে কথা বলতে চেয়েছেন। বিয়ে উনি কোয়েলের প্রাপ্ত বয়স হলেই দেবেন কিন্তু এখনই যদি সব দেখা শোনা করা থাকে তাহলে ওনার মতে ভালো হয়।

__আমি কি আসতে খুব দেরী করে ফেললাম?

কেউ কিছু বলবে তার আগেই পিছন থেকে এই প্রশ্নটা কানে ভেসে এলে সবাই পিছনের দিকে ফিরে তাকায়। আদিত্য হেসে এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে রাজকে! কোয়েলও খুশি হয়ে এগোতে নিলে কিছুক্ষণ আগের ঘটনা মনে করে থেমে যায়। করুন ও অসহায় ভাবে একবার নিজের বাবার দিকে তাকায়, আরেকবার রাজের দিকে তাকায়।

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে