‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️
||পর্ব~৫৫||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা
৮২.
চোখ খুলতেই নিজেকে আবিষ্কার করলাম বেডে। উঠে বসতেই দেখলাম আদি স্টাডি টেবিলে বসে, স্টাডি ল্যাম্প জ্বালিয়ে এখনও পড়ছে। আমি নিজের ফোনটা হাতে নিয়ে দেখলাম মাঝরাত, ৩টে বাজে। আমিও তো ওর সাথেই পড়ছিলাম কিন্তু মাঝে একটু ঝিম এসেছিলো তাই হয়তো চোখ লেগে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তখনই হয়তো ও আমাকে এনে বেডে শুইয়ে দিয়েছে। আমি আমার ওড়নাটা ঠিক করে বেড ল্যাম্প জ্বালিয়ে আদিকে কিছু বলবো তাঁর আগেই আদি লিখতে লিখতে বললো,
আদিত্য: উঠে পরলে কেন? শুয়ে পরো, অনেক রাত হয়ে গেছে।
মৌমিতা: হ্যাঁ কিন্তু তুমি শোবে না? অনেকটা রাত হয়ে গেছে আর পড়তে হবে না। এইবার শুতে আসো।
আদিত্য: উহুম, এখন শুলে টপার পজিশন তো দূর টায় টায় পাস করবো হয়তো। আর এটা ড্যাড যদি জানে আমাকে ঠেঙিয়ে বাড়ি থেকে বিদায় করে দেবে। তখন নিজে খাবো কি আর তোমাকে খাওয়াবো কি?
আমি ওর কথা শুনে হেসে দিতেই ও কিঞ্চিৎ হেসে বললো,
আদিত্য: আজ তোমার জন্যেই আমার এই অবস্থা।
মৌমিতা: এই, এই! একদম আমাকে ব্লেইম করবে না। তোমাকে কি আমি পড়তে মানা করেছিলাম নাকি? (রেগে)
আদিত্য: তোমার চিন্তা আমার পড়াশোনাকে ল্যাং মেরে মাথা থেকে ভাগিয়ে দিয়েছিলো। তুমি এসেই আমাকে নিজের প্রেমে ফেলেছো, সারাক্ষণ তোমার চিন্তাই করতাম। আমি যদি আগের আদিত্য ব্যানার্জী থাকতাম যে কি না কোনো মেয়েকে পাত্তা দিতো না তাহলে তো এই অবস্থা হতো না আমার। আগে কোনো মেয়ে পারেনি বাট তুমি পেরেছো সো দোষটা তোমার।
আমার রাগ হলো আবার ভালোও লাগলো কিন্তু ভালো লাগাটাকে চেপে রেখে রাগটাই মেলে ধরলাম।
মৌমিতা: ওহ হো, এখন সব দোষ আমার কি?
আদিত্য: আজ্ঞে। এখনও দেখো, তুমি আমাকে পড়তে দিচ্ছো না।
মৌমিতা: (গাল ফুলিয়ে) ঠিক আছে আমি চলে যাচ্ছি আমার রুমে। তাহলে তো আর তোমাকে ডিসটার্ব করার কেউ থাকবে না।
আদিত্য: এক পা বেড থেকে মাটিতে পড়লে ঘরে বসে এক্সাম দিতে হবে। সেটা চাইলে তুমি যেতে পারো। আমার কোনো প্রবলেম নেই।
আমি বেড থেকে পা রাখার আগেই আদিত্যের দাঁতে দাঁত চাপা কথা শুনে তড়িঘড়ি পা গুটিয়ে নিলাম। ও আমার দিকে না তাকিয়েই কথাটা বলেছে লিখতে লিখতে। আমি আর কথা বাড়ালাম না। সত্যি এখানে আসার পর ৬ মাস ওর আমাকে রক্ষা করতে, আমার খেয়াল রাখতেই কেটে গেছে। ইশ, অনেক চাপ পরে গেছে মনে হয়। থাক এখন আর তাহলে কথাটা বলবো না।
আদিত্য: মাথার মধ্যে যেটা ঘুরঘুর করছে সেটা বলতে পারো আমাকে। এতক্ষন যখন বকবক শুনতে পারলাম এখনও পারবো।
মৌমিতা: (ভ্রু কুঁচকে মনে মনে– কি বাজে ছেলেরে বাবা! কথায় কথায় কীভাবে টোন কাটছে দেখো? একটু কি ভালো ভাবে কথা বলা যায় না নাকি? পড়া শুরু করার আগে কত মিষ্টি মিষ্টি কথা বলছিলো, আর এখন দেখো? পরীক্ষা চলে গেলে এর শোধ তুলবো আমি। একটাও কথা বলবো না তখন, বাজে ছেলে একটা!) ইয়ে..বলছিলাম, কোয়েলকেও নিয়ে আসলে হতো না? সৌভিকদার কু-দৃষ্টি যে কেটে গেছে তা তো নয় তাই না?
আদিত্যের পেন থেমে, হাত থেকে পড়ে গেলো আমার কথাটা শুনে। মুখটাও বেশ থমথমে হয়ে গম্ভীর হয়ে গেছে, এতক্ষন যেই স্বস্তিটা ছিলো তা নেই।
আদিত্য: ও’কে আসতে বলিনি মনে করছো? অনেকবার বলেছি কিন্তু কোনো কথাই কানে তুললো না। ওর জেদ, ও কিছুতেই আসবে না এই বাড়িতে।
মৌমিতা: কিন্তু কেন? এই বাড়িতে তো ও এসেছে আমার সাথে।
আদিত্য এইবার নিজের রাউন্ড চেয়ারটা আমার দিকে ঘুরিয়ে বললো,
আদিত্য: কাকাই এই বাড়িতে আছে এখন।
ওর কথা শুনে আমি চোখ বড় বড় করে অবাক ভাবে ওর দিকে তাকিয়ে আছি। কাকাই এই বাড়িতে আছে মানে? কি বলতে চাইছে ও? তাহলে মা আমায় কিছু জানালেন না কেন?
আদিত্য: আই নো তুমি শকড। আসলে কাকাই নেই, কাকাইয়ের জিনিসপত্র আছে। কাকাই আজকে ফেরেনি বাড়িতে কারণ আমি জানিয়েছিলাম কোয়েলকে আর তোমাকে এখানে নিয়ে আসবো। দুদিন আগেই কাকাই দেশে ফিরেছে। ড্যাডের সাথে নাকি সবটা মিটিয়ে নিয়েছে তাই ড্যাড বলেছে এই বাড়িতে থাকতে। কিন্তু আমার সেটা মনে হয় না।
মৌমিতা: তোমার সেটা মনে হয় না কেন? তুমি কি আরো কোনো কারণ আন্দাজ করছো?
আদিত্য: হুঁ? হম। ব্যাপারটা অন্য এটা আমি সিওর। কারণ কাকাইয়ের ঠিক করার হলে তো আরো আগেই করতে পারতো, হঠাৎ এখনই কেন? ছুটিও হয়তো কিছু আন্দাজ করেছে তাই এতবার বলার পরেও এলো না।
মৌমিতা: তাহলে এখন কি করবে? আমার কেন জানি না খুব চিন্তা হচ্ছে আদি। ও’কে এভাবে একা রেখে আসতে মন মানছিলো না আমার। আগের ব্যাপারটা অন্য ছিলো।
আদিত্য: আগের ব্যাপার কিছু অন্য ছিলো না মৌ। সৌভিকের নজর প্রথম থেকেই ছুটির উপর, সেই ছোটো থেকে। ও কোনোকালেই সেফ ছিলো না এখন তো আরোই নেই। কেন যে আমাদের কথা শোনে না আমি বুঝি না। বরাবর নিজের যেটা মন চেয়েছে সেটাই করে এসেছে। (টেবিলে বারি মেরে)
আমি আদিকে উত্তেজিত হতে দেখে উঠে ওর কাছে চলে গেলাম। ওর কাঁধে দু-হাত রেখে বললাম,
মৌমিতা: এখন মাথা ঠান্ডা রেখে কি করলে ঠিক হবে সেটাই ভাবতে হবে আমাদের।
আদিত্য: কি আবার হবে? হসপিটালে একটা বেড বুক করে রাখতে হবে।
মৌমিতা: (ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে) কিহ? হসপিটালে বেড বুক করে রাখবে? মানে, কেন? কার জন্য? আমি তো কিছুই বুঝলাম না তোমার কথার মানে।
আদিত্য: (বাঁকা হেসে) সৌভিকের জন্য আবার কার জন্য? তুমি রাজকে চেনো না মৌ। সৌভিক যেমন সুযোগ খুঁজছে ছুটির ক্ষতি করার ঠিক তেমন রাজও একটা ছুতো খুঁজছে ওকে হসপিটালে পাঠানোর। দেখোনি, আমাকে মারতে এসেছিলো সেই সময় ও কতটা রিয়াক্ট করেছিলো?
মৌমিতা: হ্যাঁ। কিন্তু রাজদা সৌভিকদার ক্ষতি করলে তো ওনারও ক্ষতি। পুলিশ কেস হয়ে যাবে তো?
আদিত্য: (হেসে) পুলিশের পরোয়া তুমি আর ছুটি করতে পারো আমরা করিনা। আমরা ইউনিয়নের আছি, সেই প্রথম থেকেই ওসব পুলিশ দেখে এসেছি। ওদের আবার কেউ ভয় পায় নাকি? হাতে নোট গুঁজে দিলেই চুপ করে যাবে।
মৌমিতা: তুমি এরকম করেছো তার মানে? (রেগে)
আদিত্য: হ্যাঁ রণিতের কেসেই তো…আব ইয়ে মানে…
সত্যিটা স্বীকার করার পর আদি যখন বুঝলো আমি ওর দিকে তাকিয়ে আছি তখন আমার দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করতে লাগলো। আমি ওর থেকে সরে গিয়ে বেডে বসে বললাম,
মৌমিতা: আমি এগুলোএকদম পছন্দ করিনা আদি। কি দরকার কাওকে এভাবে মারার? এসব না করলে তো আর পুলিশকে ঘুষ খাওয়াতে হয় না? তোমরাও যদি এসব করো তাহলে ওদের আর তোমাদের মধ্যে পার্থক্যটা কোথায়? আমার মনে হয় না কোয়েলও এসব সাপোর্ট করবে বলে।
আদিত্য: এটাই তো ভয়। তাও ভালো, তুমি তো তেমন কিছু রিয়াক্ট করলেনা কিন্তু ছুটি তো…
মৌমিতা: কি? কোয়েল কি? ক্লিয়ার করে বলো।
আদিত্য: তোমাকে ডিটেইলস তো এখন বোঝাতে পারবো না জাস্ট এটুকু বলব ছুটি এই জিনিসগুলো একদম পছন্দ করে না। ও এসব টের পেলে রাজের সাথে কথা বলাই বন্ধ করে দেবে আর এটাই রাজের কাছে সব থেকে বড়ো ক্ষতি। তাই জন্যেই রাজ চুপ করে আছে নাহলে কবেই খবর করে দিত সৌভিকের। ওইসব পুলিশ, নেতা-মন্ত্রী কেউ কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। রণিতের এগেইনস্টে যেমন অনেক অভিযোগ আছে তেমন সৌভিকের এগেইনস্টেও আছে। পুলিশও ওঁৎ পেতে রয়েছে স্ট্রং প্রুফের জন্য যাতে ওদের হাজতে ঢোকানো যায়।
মৌমিতা: তাই বলে মারবে? স্ট্রং প্রুফ থাকলে একবারে আইনের হাতে তুলে দাও, তোমরা কেন আইন হাতে নিতে যাবে?
আদিত্য: যখন রণিত তোমার হাত ধরে ছিলো তখন তুমি কেন ও’কে কেন চড় মেরেছিলে? মাথা ঠিক ছিলো না তাই জন্য তো? ঠিক তেমন আমাদের জীবনের গায়ে কোনো আঁচ লাগলে, কেউ ক্ষতি করতে চাইলে আমাদের মাথা ঠিক থাকে না। তখন আমরা তাদের জীবনটাও কেড়ে নিতে পারি আমাদের জীবনের দিকে হাত বাড়ানোর অপরাধে।
আদি কথাটা বলতে বলতে বেডের কাছে এসে বেড ল্যাম্প অফ করে দিলো। তারপর নিজের ডেস্কে ফিরে গিয়ে বললো,
আদিত্য: ঘুমিয়ে পরো, অনেক রাত হয়ে গেছে।
আমি ওর কথা শুনে কিছু বলার জন্য খুঁজেই পেলাম না। শব্দ না করেই একটু হাসলাম আর তারপর শুয়ে পড়লাম। ওর দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে চোখটা লেগে এলো। শুধু কিছুক্ষণ পর কপালে কাওর স্পর্শ অনুভব করেছি, আর কিছু মনে নেই।
৮৩.
মাঝরাতে হঠাৎ করেই কোয়েলের ঘুমটা ভেঙে গেলো। নিজের পড়ার টেবিলে থেকে মাথা তুলে চোখ কচলে দেখলো জানলার পর্দাগুলো উড়ছে। অর্থাৎ বাইরে হাওয়া ছেড়েছে। কোয়েল উঠে জানলার কাছে গিয়ে জানলাটা বন্ধ করতেই দেখলো হস্টেলের বাইরে একটা গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। গাড়িটা দেখে কোয়েল চোখ কচলে নিলো কারণ গাড়িটা ওর চেনা।
কোয়েল: রাজের গাড়ি এতো রাতে এখানে কি করছে? গাড়ির কাঁচগুলোও তো তোলা, কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। আলো জ্বললে বুঝতাম কেউ ভিতরে জেগে আছে। সেটাও তো নেই। হতেই পারে এটা অন্যকাওর গাড়ি? তাহলে তো ফোন করে রাজকে বেকার ডিস্টার্ব করা হবে এতো রাতে। কি যে করি?
কোয়েল বেশ কিছুক্ষণ উঁকি ঝুঁকি করার পর মনস্থির করলো রাজকে ফোন করবে কারণ রাজেরও তো পরীক্ষা। হয়তো ও’ও রাত জেগে পড়ছে তাছাড়া ওর তো অফিসের কাজও থাকে। একটা ফোন করাই যায়, না ধরলে আর করবে না। কোয়েল রাজকে কল করে দু-চারবার রিং হতেই রাজ কল রিসিভ করে বললো,
রাজ: পড়া শেষ কুহুজান?
কোয়েল: উহুম, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম এখনও বাকি আছে তাই। তুমি জেগে আছো যে?
রাজ: আমাকে তো জেগে থাকতেই হবে। আমার কুহুজানের জেদের উপর কি আজ অবধি কেউ কথা বলতে পেরেছে? তাই জেগে থাকতে হচ্ছে। তাছাড়া আমারও তো পরীক্ষা কুহুজান।
কোয়েল: (জানলার কাছে গিয়ে) তারমানে আমার হস্টেলের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িটা তোমারই?
রাজ: (জানলার কাঁচ নামিয়ে) দেখতে পাচ্ছো আমায়?
কোয়েল দেখলো ওর প্রশ্ন শেষ হতেই গাড়ির কাঁচটা নেমে গেলো। একটু দূরে হওয়ায় রাজের মুখটা হালকা দেখতে পেলো কোয়েল। কিন্তু এটা যে রাজ সেটা ভালোই বোঝা যাচ্ছে। কোয়েল এবার রাগ দেখিয়ে বললো,
কোয়েল: মাথাটা কি পুরো খারাপহয়ে গেছে তোমার? এতো রাতে এখানে কি করছো তুমি? বাড়ি যাও নিজের আর শুয়ে পরো।
রাজ: তোমার একটা জেদ মেনে নিয়েছি মানে যে সব জেদ মেনে নেবো এটা ভাবার ভুল করো না। যেখানে প্রশ্ন তোমার নিরাপত্তা নিয়ে সেখানে আমি কাওর কথা শুনবো না। জানলাটা বন্ধ করে, দরজা ভালো ভাবে দিয়ে চুপচাপ গিয়ে ঘুমাবে। গট ইট? (কড়া সুরে)
রাজের এরকম কড়া গলায় আদেশ শুনে কোয়েল চুপ করে গেলো। সব সময় সবারসহ এই মানুষটার উপর নিজের জেদ খাটাতে পারলেও এই মানুষটা যখন জেদ ধরে তখন কোয়েলের আর কিছু করার থাকে না। তার মধ্যে প্রসঙ্গ যখন কোয়েলের নিরাপত্তার সেখানে তো কোয়েলের জেদ মানার কোনো প্রশ্নই নেই। এখন এই বিষয়টা কোয়েলের হাতে নেই তাও নরম গলায় একটা চেষ্টা করলো।
কোয়েল: ভোর হয়ে যাবে কিছুক্ষণ পর। এখন চলে গেলে হয় না?
রাজ: কি বললাম আমি কিছুক্ষণ আগে?
কোয়েল: যাচ্ছি। কিন্তু তুমি কখন যাবে তাহলে?
রাজ: যখন আমার মনে হবে আর কোনো বিপদ নেই তোমার তখন। নাও গো!
কোয়েল রাজের কথামতো অসহায় মুখ করে জানলাটা বন্ধ করে দরজাটা ভালো মতো বন্ধ আছে কি না চেক করে নিলো। তারপর বেডে উঠে বই নিয়ে বসতেই কোয়েলের ফোন বেজে উঠলো। দেখলো রাজ ভিডিও কল করেছে, হেসে কল রিসিভ করতেই ওপাশে রাজকে দেখলো।
কোয়েল: আচ্ছা আমার জন্যে না হয় তুমি আছো বাট তোমার জন্য তো কেউ নেই রাজ। তুমি এতো রাতে একা আছো, যেও যদি সেটার সুযোগ নিয়ে তোমার ক্ষতি করে? (চিন্তিত হয়ে)
রাজ: বাহবা! তুমি আমার চিন্তা করো?
কোয়েল: বাজে কথা একদম বলবে না। আমি কি জানতাম নাকি তুমি এরকম কিছু করবে?
রাজ: জানলে আদির সাথে যেতে বুঝি?
কোয়েল চুপ করে থাকলে রাজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আশ্বাস দিয়ে কোয়েলকে বলে,
রাজ: কিচ্ছু হবে না আমার চিন্তা করো না। ঘুমিয়ে পরো এখন কারণ কালকে তোমাকে ভার্সিটি যেতে হবে। আমি দিয়ে আসবো আর আমিই নিয়ে আসবো ওকেই?
কোয়েল: হম। নিজের খেয়াল রাখবে।
কোয়েল ফোন রেখে চুপচাপ শুয়ে পড়লো কিন্তু কেন জানো মনটা খুব কু ডাকছে। মনে হচ্ছে কিছু একটা হতে চলেছে। রাজের এখানে থাকার পরিণাম সাংঘাতিক কিছু হবে না তো? সাংঘাতিক হলে কতটা সাংঘাতিক হবে এটা আন্দাজ করতে পারলে হয়তো কোয়েল রাজকে বাড়ি পাঠিয়ে দিতো যে করে হোক। ওর কি উচিত ছিলো রাজকে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া? কিন্তু আদৌ কি কিছু খারাপ হতে চলেছে, সাংঘাতিক হতে চলেছে? যাতে হয়তো ওদের জীবনের সমীকরণটাই বদলে যাবে? নাকি এসব নিছকই ভুল ধারণা কোয়েলের? জানতে পারবেন আগামী পর্বে।
‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️
||পর্ব~৫৬||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা
৮৪.
সকালে কোয়েলের ঘুম ভাঙতেই কোয়েল লাফ দিয়ে উঠে বসলো। ফোনটা নিয়ে দেখলো সকাল সাতটা বাজে। তাড়াতাড়ি করে উঠে জানলার কাছে গিয়ে জানলাটা খুলে রাজের গাড়িটা খুঁজতে থাকলো কোয়েল। নাহ, কোথাও রাজের গাড়িটা দেখা যাচ্ছে না।
কোয়েল: কখন বাড়ি গেছে কে জানে? আচ্ছা ও বাড়ি গেছে তো নাকি…ধুর ধুর! কি যে আজে বাজে ভাবছিস তুই কোয়েল। পুরো মাথাটাই গেছে তোর। যাই ফ্রেশ হয়ে ও’কে একটা মেসেজ করবো।
কোয়েল এই বলে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসে। ফোন হাতে নিয়ে মেসেজ করতে যাবে তার আগেই দেখে রাজ মেসেজ করে রেখেছে। মেসেজে লেখা, “আমি নটার সময় হস্টেলের বাইরে চলে আসব, রেডি হয়ে থাকবে।”
কোয়েল দেখলো মেসেজটা কিছুক্ষণ আগের করা। তাই রিপ্লাই হিসেবে প্রশ্ন করলো, “কখন বাড়ি গেছো?”
কোয়েল মেসেজ করতেই সেটা সিন হয়ে গেলো মানে রাজ হোয়াটসঅ্যাপে ওর চ্যাট খুলেই বসে ছিলো। রাজ রিপ্লাই করলো, “কিছুক্ষণ আগে। তিরিশ মিনিট মতো হয়েছে।”
কোয়েল এবার সঙ্গে সঙ্গে রাজকে ফোন করলো। রাজ ফোন রিসিভ করতে না করতেই কোয়েল বলা শুরু করলো,
কোয়েল: কি গো তুমি? সারারাত ওভাবে গাড়ির মধ্যে বসেছিলে? ঠিকভাবে ঘুমাও পর্যন্তনি। এইগুলো তোমার পাগলামি জানো তো? আমি তো হস্টেলের মধ্যে ছিলাম, কি এমন ক্ষতি হতো আমার? বরং তোমার ক্ষতি হয়ে যেতে পারতো। তুমি কেন…
রাজ: আচ্ছা বাবা শান্ত হও। কুল কুহু কুল! আমি একদম ঠিক আছি ওকে? এতটা ভয় পাওয়ার কি আছে আর আমার কে ক্ষতি করবে? জিয়ার বাবা? কিচ্ছু করতে পারবে না রিল্যাক্স।
কোয়েল: এতোটাও ওভার কনফিডেন্স ভালো না রাজ। যা ইচ্ছা করো, আমি কিচ্ছু বলবো না আর।
কোয়েল ফোন রেখে দিয়ে বেডের উপর নিজের থেকে দূরে ছুড়ে ফেললো ফোনটাকে। মাথার মধ্যে জানো আগুন জ্বলছে ওর। সারাদিন এবার রাজ অফিসের কাজ করবে তারপর আবার সন্ধ্যা থেকে পড়তে বসবে। এর মধ্যে যদি একটু না ঘুমায় তাহলে যে শরীরটা খারাপ করবে সেটা বুঝতে চাইছেনা। সামনেই পরীক্ষা, তার মধ্যে শরীর খারাপ হলে কি হবে ভেবে দেখেছে? এইসব ভেবেই মাথা গরম হয়ে আছে কোয়েলের যার কারণে রাজ ফোন করলেও সেটা দেখার পরও ধরছে না ফোনটা। রাগের চোটে ফোনটা সাইলেন্ট করে দিয়ে বালিশ চাপা দিয়ে দিলো কোয়েল।
সকাল ৮টা বেজে ৩০ মিনিট,
কোয়েল ধীরে সুস্থে রেডি হতে শুরু করে। এখন মাথাটা একটু ঠান্ডা আছে কারণ কিছুক্ষণ আগেই মৌমিতা আর আদিত্য ফোন করে ও’কে বুঝিয়েছে। ফোনটা জেনারেল মোড করে কোয়েল রেডি হয়ে নেয়। ৯টা বাজার কিছুক্ষণ আগেই কোয়েল বেরিয়ে যায় হস্টেল থেকে। বেরিয়ে নিজের ডান দিকে তাকাতেই দেখে বেশ কিছুটা দূরে রাজের গাড়ি দাঁড়িয়ে।
কোয়েল: রাজের গাড়ি এখানে? তার মানে ও চলে এসেছে? কই আমাকে তো মেসেজ করলো না?
কোয়েল কথাটা ভেবে আস্তে আস্তে রাজের গাড়ির দিকে এগিয়ে যায় কিন্তু গাড়িতে কাওকে দেখতে পায় না। যেহেতু জায়গাটা নির্জন তাই হঠাৎই কোয়েল আশে পাশে থেকে একটা মেয়েলি গলার স্বর পায়। চারিদিকে তাকাতেই দেখে আরেকটু এগিয়ে একটা গলি মতো আছে। খুব সম্ভবত, ওখানে থেকেই আসছে আওয়াজটা। কোয়েল আস্তে আস্তে গলিটার দিকে এগিয়ে যেতেই দুটো মানুষকে দেখে স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে যায়। কোয়েলের সাথে সাথে কোয়েলের দৃষ্টিও তাদের উপর স্থির। পুরোপুরি ভাবলেশহীন হয়ে কোয়েল সামনের দিকে তাকিয়ে রাজের বুকে অন্য একটা মেয়েকে দেখছে। মেয়েটাকে চেনে ভালো মতো, সেদিন পার্কের মেয়েটা মানে টিনা। শুধু যে মেয়েটা রাজের বুকে মাথা রেখে রাজকে জড়িয়ে ধরে আছে তা নয়, রাজও জড়িয়ে ধরে আছে মেয়েটাকে সযত্নে। রাজ টিনাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে ওর দিকে হেসে ওর চোখের জল মুছিয়ে দেয়।
রাজ: আমি তোমার চোখে আর কোনোদিন জল দেখতে চাই না। আমি আছি তো? আমি সবসময় তোমাকে আগলে রাখবো।
এইবার রাজ নিজেই টিনাকে বুকে টেনে নেয় হেসে আর কোয়েল সেটা দেখে নিজের দুহাত মুষ্টিবদ্ধ করে চোখ বন্ধ করে নিলে টিনার মুখে নিজের নাম শুনতে পায়। চোখ খুলে দেখে রাজ ভয়ভীত হয়ে ওর দিকে তাকিয়ে আছে। রাজ কোয়েলের দিকে এক পা বাড়াতেই কোয়েল এক-পা, দু-পা করে পিছতে পিছতে নিজের চোখের জল মুছে দৌঁড়ে চলে যায় ওই জায়গা থেকে। কোয়েলের পিছন পিছন রাজও ছুট দিলে টিনা গলি থেকে বেরিয়ে রাজের গাড়ির সামনে দাঁড়ায়। তারপর লুকিং গ্লাসে চোখের জল মুছে নিয়ে, নিজের মুখটা একটু দেখে বাঁকা হাসে।
এদিকে, কোয়েল নিজের হস্টেলের গেটের সামনে এসে দেয়ালে এক হাত ভর দিয়ে সমানে ফোঁপাতে থাকে। সেই সময় রাজ এসে কোয়েলের পিছনে দাঁড়ালে কোয়েল তা টের পায় আর নিজের চোখের জল মুছে হাঁটতে নেয়।
রাজ: (কোয়েলের হাত ধরে) এভাবে দৌঁড়ে এলে কেন তুমি? আমার কথাটা তো শুনবে নাকি?
কোয়েল এক ঝটকায় নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে রাজের দিকে ফিরে বললো,
কোয়েল: কথা তো দূর তোমার মুখটাও দেখতে চাই না আমি। এভাবে আমাকে না ঠকালে তোমার চলছিলো না তাই না?
রাজ: আগে আমার পুরো কথাটা তো শোনো।
কোয়েল: বললাম তো আমার কিচ্ছু শোনার নেই। এইজন্যই তোমাদের ছেলেদের আমি বিশ্বাস করতে চাই না। একসাথে দু-তিনটে মেয়ে না হলে তোমাদের তো চলেই না।
রাজ: কোয়েল মাইন্ড ইউর ল্যাংগুয়েজ! (জোরে) একটা মেয়ের নামে বদনাম করছিস তুই এটা বলে। নিজে একটা মেয়ে হয়ে কি করে এসব বলছিস তুই?
কোয়েল: তোমার মত একটা ছেলেকে চোখের সামনে দেখেছি তাই বলছি। বাহবা, যতজনকে রাখো সবার জন্যই দরদ আছে বুঝি? যাক, শুনে বেশ ভালো লাগলো। তা তোমার ফুর্তির পাত্রী হিসাবে আমি কত নম্বর…
কোয়েলের কথা শেষ হওয়ার আগেই রাজ সজোরে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিল কোয়েলের গালে। কোয়েল গালে হাত দিয়ে চুপ করে থাকলে রাজ নিজেই ধাতস্থ হয়, বুঝতে পারে সে একটা ভুল করে ফেলেছে। রাজের চোখ ছলছল করে ওঠে। কোয়েলের দু-গালে নিজের হাত রাখতে গেলেই কোয়েল পিছিয়ে গিয়ে ভেজা চোখ নিয়ে রাজের দিকে তাকায়। যার ফলে রাজের বুকের ভিতরটা চিনচিন করে ওঠে। কোয়েল হাঁটা শুরু করলে রাজ নিজের মাথা নীচের দিকে নামিয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়। বড়ো একটা নিশ্বাস নিয়ে জোর পায়ে হাঁটা দেয় কোয়েলের পিছনে।
রাজ: কুহু! কুহু আমার কথাটা শোনো একবার। আমি তোমার গায়ে হাত তুলতে চাইনি। কুহু প্লিজ!
কোয়েল রাজের একটা কথাও শুনছে না নিজের মনে হেঁটে চলেছে। একসাথে অনেকগুলো পুরোনো ঘটনা বলা যায় পুরোনো ভয় কোয়েলের সামনে এসে উপস্থিত হয়েছে যেগুলো ও কখনোই রাজের থেকে আশা করেনি। রাজকে সবার থেকে অন্য ভেবে শেষমেষ ভুল করলো কোয়েল? এটাই মাথায় ঘুরছে কোয়েলের সমানে। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ করেই রাজ কোয়েলের হাত ধরে টান মেরে নিজের কাছে নিয়ে আসে।
রাজ: একবার আমার কথাটা…
ঠিক যতটা জোরে, যতটা দ্রুত রাজ কোয়েলকে নিজের কাছে নিয়ে এসেছিলো তার থেকেও বেশি জোরে, দ্রুত কোয়েল রাজের বুকে দু-হাত দিয়ে ধাক্কা মেরে রাজকে সরিয়ে দেয়।
কোয়েল: আমার কাছে আসার চেষ্টাও করবে না তুমি। আমার এতদিনের ধারণাটাই বদলে দিয়েছো তুমি। এক নিমিষে আমার ভালোবাসা ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছো।
রাজ: কুহু প্লিজ…
রাজ আবারও কোয়েলের কাছে এসে কোয়েলকে বোঝানোর চেষ্টা করতে যায় কিন্তু কোয়েল আবার ধাক্কা মেরে রাজকে দূরে সরিয়ে বলে,
কোয়েল: আর কোনোদিনও আমার সামনে আসবে না।
কোয়েল চলে যেতে রাজি হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। নিজের দু-হাত নাকের দুপাশে চোখের কোণে এনে চোখের জলটা মুছে নেয়।
রাজ: আমি ওকে কিছুতেই হারাতে পারবো না। আই ক্যান্ট লিভ উইদআউট হার!
রাজ উঠে দাঁড়ায় আর দৌঁড়ে কোয়েলের যতটা সম্ভব কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।
রাজ: কুহু প্লিজ কাম ব্যাক! আমি বাঁচবো না তোমাকে ছাড়া। এভাবে আমাকে একা করে দিয়ে যেও না প্লিজ! আমার ভুল হয়ে গেছে এর জন্য তুমি আমার কাছে থেকে আমাকে যা শাস্তি দেবে আমি মাথা পেতে নেব। কিন্তু আমাকে ছেড়ে যাওয়ার মতো শাস্তি দিয়ো না আমি শেষ হয়ে যাবো। আই লাভ ইউ সো মাচ কুহু!
রাজ চিৎকার করে কথাগুলো বলে দেয় কোয়েলকে আটকাতে ব্যর্থ হয়ে। দু-চোখের কোণ দিয়ে এখনও জল গড়াচ্ছে রাজের। এদিকে রাজের আর্তনাদসহ ডাক আর উপেক্ষা করতে পারছে না কোয়েল, বুক ফেঁটে কান্না আসছে। রাজের কথাগুলো শুনে এবার বাধ্য হয়ে পিছন ফিরে তাকায় কোয়েল আর কিছু বলতে গিয়েও থেমে যায়। কারণ রাজ গাড়ি যাওয়ার মাঝরাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে কোয়েলের দিকে তাকিয়ে। একদিক দিয়ে গাড়ি যাচ্ছে আর একদিক দিয়ে গাড়ি আসছে, মাঝে দাঁড়ানোর জায়গা। কোয়েল সেই দাঁড়ানোর জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে কারণ একদিক পার হয়ে ও চলে এসেছে নিজের কথা শেষ করে। কিন্তু রাজ পার হয়ে আসেনি। হঠাৎ করেই কোয়েলের চোখ যায় অপরদিক থেকে বেশ কয়েকটা গাড়ি একসাথে আসছে দ্রুত গতিতে কিন্তু সেদিকে রাজের কোনো হুঁশ নেই। সে করুন ও অসহায় দৃষ্টি নিয়ে কোয়েলের দিকে চেয়ে আছে। কোয়েল শুধু রাজের দিকে তাকিয়ে একটা চিৎকার দেয় জোরে….
‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️
||পর্ব~৫৭||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা
হঠাৎ করেই কোয়েলের চোখ যায় অপরদিক থেকে বেশ কয়েকটা গাড়ি একসাথে আসছে দ্রুত গতিতে কিন্তু সেদিকে রাজের কোনো হুঁশ নেই। সে করুন ও অসহায় দৃষ্টি নিয়ে কোয়েলের দিকে চেয়ে আছে। কোয়েল শুধু রাজের দিকে তাকিয়ে একটা চিৎকার দেয় জোরে.. রাজের নাম করে। রাজের কোনো পরিবর্তন নেই রাজ এখনও একভাবেই তাকিয়ে আছে কোয়েলের দিকে। কোয়েল দৌঁড়ে রাজের কাছে আসতে নিলে রাজের ঠোঁটের কোণে এক চিলটে হাসি ফুটে ওঠে। কোয়েল রাজের কাছে গিয়ে রাজের বুকে ধাক্কা দিতে নিলে রাজ শক্ত করে কোয়েলের হাত দুটো ধরে নেয় ফলে দুজনেই পিছন দিকে পরে যায়। পরে যাওয়ার ফলে রাজের হুঁশ এলো ও মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলো।
কোয়েল: কোথায় লেগেছে দেখি? উঠে দাঁড়াও।
রাজ উঠে দাঁড়িয়ে কোয়েলের দিকে করুন চোখে তাকায়। বুকের বাম দিকে হাত রেখে বলে,
রাজ: এখানে।
কোয়েল সাথে সাথে মুখ গম্ভীর করে নিয়ে বলে,
কোয়েল: আমি আসছি আমার দেরী হয়ে যাচ্ছে।
রাজ আর আটকায় না কোয়েলকে। কোয়েল রাস্তা পার হয়ে চলে যায় ভার্সিটির উদ্দেশ্যে। কোয়েল যেতেই রাজ উল্টো পথে হাঁটা ধরে নিজের গাড়ির কাছে পৌঁছোয়। এদিক ওদিক দেখে নিয়ে গাড়ি নিয়ে ভার্সিটিতে চলে যায়। ভার্সিটিতে ঢুকতেই দেখে আদিত্য আর মৌমিতা বসে কথা বলছে। রাজ মাথা নত করে ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।
৮৫.
কোয়েল ক্লাসে না গিয়ে ভার্সিটিতে এসে কমন রুমে কিছুক্ষণ বসে থাকে। কিছুতেই নিজেকে শান্ত করতে পারছে না ও। মাথায় এটাই ঘুরছে কীভাবে রাজ এটা করতে পারে? একজাগায় স্থির হতে পারছে না কোয়েল, একবার দাঁড়াচ্ছে, একবার বসছে তো একবার হাঁটছে। অস্বস্তিতে পরে কোয়েল নিজের ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে যায় ভার্সিটি থেকে, বেরিয়ে চলে যায় ভার্সিটি থেকে কিছুটা দূরে থাকা পার্কটায়। ওখানে গিয়ে দেখে তেমন কেউ নেই। যেহেতু সকাল বেলা বেশিরভাগ স্টুডেন্টদের ক্লাস চলছে আর না হয় দুপুরে ক্লাস তাই বেশ নির্জন। কোয়েল একটা বেঞ্চে চোখ মুখ ঢেকে বসে পরলো। সাথে সাথে তখনকার দৃশ্য ভেসে উঠলো ওর বন্ধ চোখের অন্ধকারে। পুরো ঘটনাটা চোখে ভাসানোর পর কোয়েল ঝট করে সোজা হয়ে বসে।
কোয়েল: এক মিনিট! রাজ নিজে থেকে টিনাকে জড়িয়ে ধরেছিলো। কিন্তু রাজ তো কখনো কোনো মেয়ের সংস্পর্শে যায়নি। ছোটো থেকেই দেখেছি সেটা আমি আর চার বছর পরেও। যখন জিয়া ওকে জড়িয়ে ধরেছিলো তখন ও খুব বিরক্ত হয়েছিল যেটা ওর মুখ দেখেই বোঝা গেছিলো। আমার পারমিশন ছাড়া আমাকেই কখনও টাচ করেনি ও তাহলে টিনাকে কেন নিজে থেকে জড়িয়ে ধরলো? ওদের মধ্যে কি তাহলে আগে থেকে প্রেমের সম্পর্ক আছে? নাকি সম্পর্কের নাম টা অন্য? নাকি কোনো ফাঁদ…?
কোয়েল আরেকটু ভাবা শুরু করলো। ঠিক ভাবা না বলা যেতে পারে, মনে করা শুরু করলো। কিছু একটা মনে পড়তেই কোয়েল লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো আর উত্তেজিত হয়ে বললো,
কোয়েল: এক্সাক্টলি! ও তো দার্জিলিং এ থাকাকালীন আমাকে বলেছিল সামনে বড়ো কিছু হতে চলেছে তার জন্য আমাদের চারজনকে একে অপরের প্রতি বিশ্বাস রাখতে হবে। তাহলে কি এটা পরেশবাবুর ষড়যন্ত্র?
কোয়েলের মনে একটা আশার আলো সঞ্চার হলেও পরক্ষণে তা নিভে যায়। কোয়েল নিজে থেকে আবারও বলে ওঠে,
কোয়েল: কিন্তু ওই গলির মধ্যে ওরা কি করছিলো? ওরকম ফাঁকা একটা জায়গায় ওরা… আমি মনে হয় একটু বেশিই পজিটিভ ভাবছি। যা চোখে দেখেছি সেটা…সেটা, সেটা তো সত্যি নাও হতে পারে। উফ! মাথাই কাজ করছে না আমার। একবার নেগেটিভ চিন্তা ধারা আসছে তো একবার পজিটিভ! ধুর বাবা।
কোয়েল আবার বেঞ্চে বসে পরে চুপ করে। তখন মনে পরে রাজের বারবার কোয়েলকে আটকানোর চেষ্টা, কিছু বলার চেষ্টা। রাজ এতটাই আকুল হয়ে উঠেছিল কোয়েলকে কিছু বলতে যে কখন মাঝরাস্তায় এসে দাঁড়িয়ে পড়েছিল সেটাই হুঁশ ছিলো না। কথাটা মনে আসতেই কোয়েল উঠে দাঁড়িয়ে চোখ মুছে বললো,
কোয়েল: নাহ। এভাবে চোখের দেখার উপর বিশ্বাস করে ওর কথা না শোনাটা ঠিক হয়নি। যদি মিথ্যে বলার চেষ্টা করে তাহলে আমি ঠিকই বুঝতে পারবো তাই আমার ওর কথা শুনতে হবে আর সেটা এক্ষুনি!
কোয়েল মনস্থির করে আগে এগোতে নিলেই ওর হাতে পিছন দিক থেকে টান পরে। কোয়েল ঝট করে পিছন ফিরে তাকায় কারণ এটা রাজের স্পর্শ নয়, অন্য কোনো পুরুষালী স্পর্শ।
কোয়েল: সৌভিকদা তুমি?
৮৬.
আদি নিজের মেজাজের উপর ভারসাম্য হারিয়ে সজোরে একটা থাপ্পড় বসিয়ে দিলো রাজদার গালে। রাজদা চুপচাপ নিজের হাত মুঠো করে নীচের দিকে তাকিয়ে আছেন। সকালে যা যা ঘটেছে সবটা জানতে পেরেই আদি এই কাজটা হঠকারিতায় করে বসলো, তাও আবার ভার্সিটিতে অনেকের মাঝে। আমি আদিকে আটকাতে যাবো তার আগেই আদি আবার রাজদার কলার ধরলো কিন্তু তাও রাজদা তাকাননি ওর দিকে। ও বলতে শুরু করলো,
আদিত্য: সাহস কি করে হলো তোর ভুল কাজ করার পরেও আমার বোনের গায়ে হাত তোলার? এইজন্যে আমি তোর হাতে আমার বোনকে তুলে দিয়েছি? বল?
রাজদা চুপ করে আছেন কোনো কথা বলছেন না দেখে আমি আদিকে বললাম,
মৌমিতা: আদি ছেড়ে দাও। সবাই দেখছে।
আদিত্য: দেখুক! সবাই এতদিন আমার বন্ধুত্ব দেখেছে,ওর প্রতি ভালোবাসা দেখেছে এখন ওর প্রতি আমার রাগ আর ঘৃণাটা দেখবে। কি মনে করিস তুই নিজেকে? যখন ইচ্ছা ছেড়ে চলে যাবি, যখন ইচ্ছা ফিরে আসবি আর তারপর তোকে মেনে নিলে আমার বোনের জীবনটা নিয়ে খেলবি? আসলে তোর দোষ না, দোষটা আমার যে আমি তোকে বিশ্বাস করেছিলাম। ছোটো থেকে তোকে এতটা ভালোবেসেছিলাম যেটার যোগ্যই না তুই!
আমি আদিত্যের কথা শুনে অবাক হয়ে রাজদার দিকে তাকালে দেখলাম উনিও তাকিয়েছেন, এতক্ষনে। আদিকে আমি থামতে বললে ও আরও বলতে শুরু করে,
আদিত্য: না তুই আমার ভালোবাসার যোগ্য ছিলিস আর না তুই ছুটির ভালোবাসার যোগ্য! ভালোবাসা তো দূর তুই ওরই যোগ্য না। ইনফ্যাক্ট তুই কাওরই ভালোবাসার যোগ্য নস। ফ্রড একটা! আমার ভুল ছিলো এতদিন পর তোর ফিরে আসার পরেও তোকে বিশ্বাস করা। ভাগ্যিস আমার ভুলটা ভেঙে গেলো নাহলে কে গ্যারেন্টি দিতো যে তুই এরপরেও ছেড়ে চলে যাবি না। তুই তো অনাথ, কোনো ঠিকানাই তো নেই তোর…
মৌমিতা: আদি! অনেক বলে ফেলেছো তুমি। মাথার ঠিক আছে কি নেই তোমার? কোথায় দাঁড়িয়ে কথা বলছো, কাকে বলছো, কি বলছো কোনো ধারণা আছে নাকি সব লোপ পেয়েছে? কোয়েল নিজেকে নিজে ফুর্তির পাত্রী বলেছিল তাই গায়ে হাত তুলেছেন রাজদা এটা বুঝতে পারোনি? বাচ্চা তুমি?
আমি রেগে চিৎকার করে কথা গুলো বললে আদি থেমে যায়। চারপাশটা দেখে নিয়ে রাজদার দিকে তাকালে দমে যায় আদি। রাজদা একভাবে ওর দিকে তাকিয়ে আছেন। আদির দমে যাওয়া দেখে তাচ্ছিল্য হেসে এবার বলে উঠলেন,
রাজ: বলা শেষ?
মৌমিতা: রাজদা ওর মাথার ঠিক নেই তাই..
রাজ: না না। ঠিক আছে। আমি এসবেরই যোগ্য। অপমান, লাঞ্ছনা-বঞ্চনার, লোকের দয়া এসব ছাড়া অনাথরা আর কিসের যোগ্য বলতে পারো? আসলে “আদিত্য” ছোটো থেকে আমাকে প্যাম্পার করায় নিজের যোগ্যতাটা ভুলে বসে ছিলাম। আজ সেটা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ।
রাজদা পিছন ফিরে চলে যেতে যেতে হঠাৎ করেই দাঁড়িয়ে পড়েন। আমি যেহেতু ওনার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে ছিলাম তাই দেখতে পেলাম উনি নিজের পকেট থেকে ফোন বার করে কিছু একটা দেখলেন তারপর ছুটে ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে গেলেন। আমি এবার আদির দিকে তাকাতেই দেখলাম ও এখনও রাজদার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছে।
মৌমিতা: সিরিয়াসলি আদি? নিজের ছোটবেলার বন্ধুকে এভাবে তাঁর দুর্বল জায়গা নিয়ে কথা শোনাতে পারলে তুমি? তুমি নিজে থেকে রাজদার দিকে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলে, রাজদা কিন্তু আসেননি। নিজে এত মাথায় উঠিয়ে আজ এভাবে আছড়ে ফেলে দিলে মাটিতে কোনো কিছু না বুঝেই? খোঁটা দিলে একটু সাহায্য করেছিলে বলে? ছিঃ! আরে বাবা তোমরাই তো বলেছিলে একে অপরের উপর বিশ্বাস রাখতে তো আজ সেটার কথা মাথায় এলো না?
আদি আমার কথা শুনে চমকে উঠে আমার দিকে তাকালো তারপর নিজেই নিজের মুখে হাত রাখলো।
মৌমিতা: মনে পরে তুমিও একদিন জিয়াকে আই লাভ ইউ বলেছিলে? অঙ্কিত কোয়েলকে জড়িয়ে ধরায় কোয়েল যে ওকে দূরে সরিয়ে দিয়েছিল তাও কিন্তু নয়। তুমি বাধ্য হয়ে করেছিলে আর কোয়েল সান্তনা দেওয়ার জন্যে। রাজদা নিজে থেকে জড়িয়ে ধরেছে বলে কথা শোনালে, ভাবলে না এর পিছনেও কোনো কারণ থাকতে পারে? এটা ভাবলে না একটা মানুষ নিজে যেচে আমাদের কথাগুলো কেন বলতে আসবে যদি সে ভুল করে? ফ্রড হয়? আমি সিওর রাজদা হয়তো এসব করার পিছনের কারণটাই জানাতে এসেছিলেন যেহেতু কোয়েল কোনো কথা শোনেনি। ভেবেছিলেন নিজের ছোটোবেলার বন্ধু বুঝবে। কিন্তু ভাবেনি এত সুন্দর করে বুঝবে। আমি একটা বাইরের মেয়ে হয়ে যে কি না কদিন হলো এসেছি সে বুঝে গেলাম আর তোমরা? লজ্জা লাগছে আমার ছিঃ!
আমি চোখের জল মুছে রাজদা যেদিকে গেছে সেদিকে ছুটলাম। না জানি কোথায় গেলেন এভাবে পরি কি মরি ছুটে।
চলবে।