একদিন তুমিও ভালোবাসবে পর্ব-৪৯+৫০+৫১

0
1900

‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️
||পর্ব~৪৯||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা
৭১.
মৌমিতা কাঁদতে কাঁদতে ঘরে চলে এলে কোয়েল তা দেখে ঘাবড়ে যায়। মৌমিতার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে,

কোয়েল: কি হয়েছে মৌ? তুই তো সব ঠিক করতে গেছিলি তাহলে?

আমি কোয়েলকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললাম। কোয়েলকে সবটা জানাতেই কোয়েল আমাকে সোজা করে বললো,

কোয়েল: তুই কি পাগল হয়ে গেছিস মৌ? তুই জানিস যখন রাতে যন্ত্রণায় তুই কাতরাচ্ছিলি তখন আদিত্যদা সারারাত তোর পাশে বসে ছিলো। এর আগে ভার্সিটি কম্পিটিশনে ও তোর সাথে পারফর্ম করতে চেয়েছিল বাট জিয়ার জন্য পারেনি। একসিডেন্ট হওয়া সত্বেও তোকে হ্যারাস যাতে না হয় তোর কপি ফেরত দিয়ে জিয়াকে শাস্তি দিয়েছে, আমাকে বলেছে তোর খেয়াল রাখতে নিজের কথা না ভেবে। ভার্সিটিতে তোকে জিয়ার থেকে অলওয়েজ গার্ড করে রাখার চেষ্টা করেছে। তুই’ই বল, তোদের ফুলশয্যার রাতের পর থেকে আজ অবধি আদিত্যদা তোর সাথে খারাপ ব্যবহার করেছে? এখানে আসার পরেও তোকে সবসময় দেখে রেখেছে, পাগলের মতো করছিল যখন তোর একসিডেন্ট হলো। আর কি করবে মৌ? আর কি করলে তুই বিশ্বাস করবি যে আদিত্যদা তোকে ভালোবাসে? আজকেও ও তোকে স্ত্রীর মর্যাদা দিতো সবার সামনে বাট তুই সুযোগ দিসনি। মানুষ কিন্তু নেশার ঘোরে সত্যি কথাই বলে মৌ। এইবার কিন্তু তোকে পস্তাতে হবে। যেই শাস্তিটা তুই আদিত্যদাকে দিচ্ছিস ও সেটা ডিজার্ভ করে না।

মৌমিতা: আমি দিতে চাই না কোনো শাস্তি! (চিৎকার করে কেঁদে) আমি ওনাকে কোনো শাস্তি দিতে চাই না। ওনাকে কষ্ট দেওয়ার কথা আমি ভাবতেও পারিনা কারণ আমিও কষ্ট পাই উনি কষ্ট পেলে। আমি সবটা ঠিক করতেই তো গেছিলাম কিন্তু আমি জানি না আমার কি হয়ে গেলো। আমি কেন ওনাকে এসব বললাম সেটাই আমি বুঝতে পারছি না। না আমি ওনাকে দূরে সরাতে পারছি আর না কাছে টেনে নিতে পারছি।

আমি জোরে কেঁদে উঠলে কোয়েল আমাকে বলে,

কোয়েল: একবার আদিত্যদার চোখের দিকে তাকাস মৌ! দেখবি তোর মনে যা যা ভয়, সংশয় আছে তা আপনে আপ মিটে যাবে। যা আদিত্যদার কাছে, নেশার ঘোরে কিছু যদি করে বসে তখন নিজেকে ক্ষমা করতে পারবি না।

মৌমিতা: ক..কিন্তু আমি যদি আবার ওনাকে কষ্ট দিয়ে ফেলি?

কোয়েল: তুই কাছে না গেলে আরো বেশি কষ্ট পাবে। সবটা ঠিক করে নেওয়ার সময় এসে গেছে মৌ।

আমি হ্যাঁ বোধক মাথা নেড়ে বেরোতে যাবো এমন সময় রাজদা ঘরে ঢুকলো। আমি রাজদাকে জিজ্ঞেস করলাম,

মৌমিতা: ওনাকে দেখেছেন?

রাজ: আদি আপসেট হয়ে গেস্ট হাউস থেকে বেরিয়ে গেছে, একা থাকতে চায় বলে।

আমি আর অপেক্ষা না করে দৌঁড়ে বেরিয়ে গেলাম গেস্ট হাউস থেকে। গেস্ট হাউস থেকে বেরিয়ে রোডে উঠলাম ভয়ে ভয়ে কারণ সত্যি যদি নিজের কোনো ক্ষতি করে বসেন? তখন তো আমি জীবনেও নিজেকে ক্ষমা করতে পারবো না। আমি রোড ধরে সোজা হাঁটতে হাঁটতে রোডের ধারে রেলিং ঘেষে একটা বসার জায়গা দেখতে পেলাম।

মৌমিতা: উনি বলেছিলেন আরেকটু এগিয়ে গেলে রাস্তার পাশেই একটু বড় জায়গা আছে যেখানে বসার জায়গা আছে। জায়গাটা ভিউ দেখার জন্য। উনি কি ওখানেই..?

কথাটা মাথায় আসতেই আমি হাঁটার গতি বাড়ালাম। হাঁটতে হাঁটতে জায়গাটা পৌঁছাতেই দেখলাম কেউ একজন জায়গাটায় বসে আছে। না, না! একজন না দুজন। আমি আরেকটু এগিয়ে গেলাম, গলার স্বর পেতে লাগলাম। এটা তো জিয়ার গলার স্বর আর জিয়া তো সারাক্ষন ওনার পিছনেই ঘুরঘুর করে। ইচ্ছা করে এগিয়ে গিয়ে ঠিক ওদের পিছনে দাঁড়ালাম। শুনলাম,

জিয়া: আদি, আদি প্লিজ! কেন এভাবে বসে আছো তুমি? ওই একটা মিডিল ক্লাস মেয়ের জন্য এভাবে মন খারাপ করে বসে থাকবে?

আদিত্য: জিয়া প্লিজ! প..প্লিজ আমি তোকে রিকুয়েস্ট করছি তুই চলে যা এখন। আমার একদম ভালো লাগছে না কিছু। আমাকে একটু একা থাকতে দে।

আদিত্যের কথা শুনে জিয়া আরেকটু ঘেষে বসলো আদিত্যের দিকে। আদিত্য একদম নিস্তেজ হয়ে বসে আছে আর সেটার সুযোগই হয়তো জিয়া আজ নিতে চাইছে।

জিয়া: আমি আছি তো আদি, আমি সবসময় তোমার পাশে আছি। তুমি মন খারাপ করে থাকলে আমার একটুও ভালো লাগে না। ওই মিডিল ক্লাস মেয়েটা (আদিত্য জিয়ার দিকে তাকালে ভয় পেয়ে) ম..মানে মৌমিতা! ও কতো সহজে তোমাকে কষ্ট দিয়ে দিলো কিন্তু আমি? আমি পারিনা তোমাকে কষ্টে থাকতে দেখতে কষ্ট দেওয়া তো দূরের কথা। আই লাভ ইউ আদি! আই লাভ ইউ স..

জিয়া কথাটা বলতে বলতে আদিত্যের কাঁধে মাথা রাখতে যাচ্ছিলো ঠিক সেই সময় আমি আর সহ্য করতে না পেরে ওদের সামনে গিয়ে জিয়াকে টেনে তুলে সজোরে একটা থাপ্পর বসিয়ে দিলাম জিয়ার গালে। আমাকে ওখানে দেখে উনিও উঠে দাঁড়ালেন হতবাক হয়ে। রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে আমি ওনার দিকে তাকালে উনি মাথা নীচু করে নেন আমি জিয়ার দিকে তাকাই। ও গালে হাত দিয়ে আমার দিকে তাকালে আমি ওকে বলি,

মৌমিতা: অনেক বাড়াবাড়ি সহ্য করেছি তোর আর নয়। আদিত্য যখন বলেছেন উনি একা থাকতে চান তাহলে কেন তুই ওনার কাছে আসার চেষ্টা করছিলি? তোর কি মনে হয় ওনাকে নেশা করিয়ে তুই ওনার কাছে আসতে পারবি? হাহ! এতোটাও নেশায় উনি নেই যে তোর আর আমার মধ্যের পার্থক্য বুঝতে পারবেন না। আর বারবার ওনার সামনে আমাকে ছোট করলেই আমি ছোট হয়ে যাবো না জিয়া, এটা বুঝতে তোর আর কতদিন সময় লাগবে?

জিয়া: তুই আমার গায়ে হাত তুললি? (দাঁত কিড়মিড় করে)

মৌমিতা: হ্যাঁ, আমি তো তোর মত ক্রিমিনাল নই তাই পাহাড় থেকে ধাক্কা মারার চেয়ে একটা চড় মেরেছি। একটা কথা মাথায় ভালো ভাবে ঢুকিয়ে নে, আজকের পর থেকে জানো তোকে আমি ওনার ত্রিসীমানায় না দেখি। বুঝেছিস? প্রবলেম আমাদের মধ্যে, ওটা আমরা মিটিয়ে নেবো তুই থার্ড পারসন হয়ে ঢোকার চেষ্টা করিস না ফল ভালো হবে না। যা এখান থেকে, যা বলছি!

শেষের কথাটা জোর দিয়ে বলতেই জিয়া একবার আদিত্যের দিকে তাকালো তারপর আমার দিকে তাকিয়ে ফুঁসতে ফুঁসতে ওখান থেকে চলে গেলো। আমি সাথে সাথে পিছন ফিরলে দেখি আদিত্য এখনও মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি ওনার দিকে এগিয়ে গেলে উনি চলে যেতে নেন আর আমি বাঁধা দেই। তাও আমার দিকে তাকাননি এখনো। আমি আস্তে আস্তে ওনার কাছে এগিয়ে গিয়ে আলতো ভাবে ওনাকে জড়িয়ে ধরে বলি,

মৌমিতা: আমি তখন ওভাবে আপনাকে কিছুই বলতে চাইনি। ওই কথাগুলো আমি আপনাকে জিজ্ঞেস করতাম কিন্তু অন্য সময় অন্যভাবে। আমার ভুল হয়ে গেছে, স্যরি!

আদিত্য: হম। ঠিক আছে। রাত হয়ে গেছে গেস্ট হাউসে…

মৌমিতা: আই লাভ ইউ!

আমি ওনার “হম” শুনে মাথা তুলে আনার দিকে তাকাই। কথার মাঝেই বলেদি আমার কথা। সেটা শুনে এই প্রথম উনি আমার চোখের দিকে তাকান, অবাক ভাবে। আমি লজ্জা পেয়ে আবার ওনার বুকে মুখ গুঁজি। উনি আলতো করে আমার দু-গালে হাত রেখে আমাকে সোজা করে আমার চোখে চোখ রেখে উনি জিজ্ঞেস করেন,

আদিত্য: তুমি, তুমি সত্যি আমাকে….?

মৌমিতা: হ্যাঁ, ভালোবাসি আমি আপনাকে। সেই প্রথম থেকে আপনি আমাকে, আমাদের সম্পর্ক না মানলেও আমি মেনেছি। আপনার জীবনে যেমন আমি প্রথম ভালোবাসা, আমার জীবনেও আপনি প্রথম ভালোবাসা। শুধু বলতে পারিনি আমি আপনাকে কিছু সংশয়ের জন্য। যেটা কিছুক্ষন আগে আপনি মিটিয়ে দিয়েছেন।

আদিত্য: আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছো?

মৌমিতা: অনেক আগেই।

আদিত্য আর কিছু না বলে আমার কপালে কপাল ঠেকালে আমি চোখ বন্ধ করেনি। কিছুক্ষণ বাদে উনি মাথা সোজা করলে আমি ওনার চোখে চোখ রাখি। উনি বলেন,

আদিত্য: আমি আর তোমাকে কোনোরকম অভিযোগ করার সুযোগ দেবো না মৌ। আমি তোমার সাথে সারাটা জীবন থাকতে চাই। পারবো না তোমাকে ছাড়া থাকতে। প্লিজ, যেও না আমাকে ছেড়ে। (কাঁপা কণ্ঠে)

মৌমিতা: আমিও আপনার সাথেই সারাজীবন থাকতে চাই। কোথাও যাবো না আমি আপনাকে ছেড়ে।

আমি ওনার চোখে আমার জন্য স্পষ্ট ভালোবাসা দেখতে পাচ্ছি, আমাকে হারিয়ে ফেলার ভয় দেখতে পাচ্ছি। ওনার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে কখন যে উনি আমার এতটা কাছে চলে এসেছেন বুঝতে পারিনি। ওনার নিশ্বাস আমার মুখে পড়তেই টের পেলাম, উনি আমার কতটা কাছে। চোখ সরাতে চেয়েও কেন জানো চোখ সরাতে পারছি না আমি, একটা মায়ায় আটকে গেছে হয়তো। উনি ধীরে ধীরে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আমার ঠোঁট স্পর্শ করলেন আর মুহূর্তেই আমার শরীর দিয়ে একটা শিহরণ বয়ে যাওয়ায় আমি চোখ বন্ধ করে ওনার হাত খামচে ধরলাম।

আদিত্য মৌমিতার কোমর এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। মৌমিতার ঠোঁটজোড়া পুরোপুরি নিজের আয়ত্তে নিয়ে নিল। মৌমিতাও পারছে না আদিত্যকে আটকাতে কিংবা বলা উচিত চাইছে না আটকাতে। কিছুক্ষণ মৌমিতা আবেশে চোখ বন্ধ করে আদিত্যের ভালোবাসা অনুভব করার পর নিজেও আদিত্যকে সাড়া দিলো। এক হাত আদিত্যের চুলের ভিতর প্রবেশ করিয়ে আরেক হাতে আদিত্যের কাঁধ শক্ত করে ধরলো। আদিত্য মৌমিতার সাড়া পেয়ে উত্তেজিত হয়ে মৌমিতাকে পিছিয়ে নিয়ে রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়ালো। এখন তাঁরা ব্যস্ত একে অপরকে ভালোবাসতে, ঠোঁটের স্বাদ গ্রহণে।

৭২.
কোয়েল মৌমিতার পিছনে যেতে চাইলেও রাজ তাঁকে যেতে বাঁধা দেয়। কোয়েল কিছু জিজ্ঞেস করবে তাঁর আগেই ঘরের দরজা বন্ধ করে দিয়ে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায় রাজ কোয়েলকে নিয়ে। কোয়েল রাজকে সরানোর চেষ্টা করলেও পারে না। রাজ চুপচাপ শুধু কোয়েলের দিকে একভাবে তাকিয়ে থাকলে কোয়েলের ভীষণ অস্বস্তিবোধ হতে শুরু করে।

কোয়েল: কি হচ্ছে টা কি রাজ? এভাবে কেন আটকে রেখেছো আমাকে?

রাজ: আর কত অপেক্ষা করাবে? (অসহায় ভাবে)

কোয়েল: দূরে সরে যাও আমার থেকে। নেশা করে আমার কাছে আসার সাহস কি করে হলো তোমার? (রেগে)

রাজ: সরে যাবো, সারাজীবনের মতো সরে যাবো। শুধু একটাবার আমার প্রশ্নের উত্তর হিসেবে এই কথাটা আমার চোখে চোখ রেখে বলো। আমি দুরে সরে যাবো তোমার থেকে আর কোনোদিন ফিরে আসবো না।

কোয়েলের বুকটা “ধুক!” করে উঠলো রাজের কথাটা শুনে। তবুও ভাবলেশহীন হয়ে রইলো, কোনো সাড়া দিলো না রাজকে। রাজ কোয়েলের দিকে আরেকটু ঝুঁকে বললো,

রাজ: আমি এখনও বলছি আমি বাধ্য ছিলাম। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সারাজীবনের জন্য ভালোবাসার মানুষকে কাছে পেতে গেলে ক্ষনিকের দুরত্ব সহ্য করতে হয়। তুমি একা না আমিও কষ্ট পেয়েছি তোমার সাথে সাথে। এরপরেও যদি তোমার আমাকে কষ্ট দেওয়ার হয় তাহলে আমাকে বলো, আমি সরে যাবো তোমার জীবন থেকে। এতে আমি কষ্ট পেলেও তোমার সামনে থেকে অবহেলার কষ্ট পাওয়ার থেকে একটু হলেও কম কষ্ট পাবো। তোমার যদি আমাকে শেষ করার হয় তাহলে একবারে শেষ করে দাও, এভাবে তিলে তিলে শেষ করো না। আমি আর পারছি না এতো কষ্ট সহ্য করতে, হাঁপিয়ে গেছি ছোটো থেকে একের পর এক কষ্ট সহ্য করতে করতে। হাঁপিয়ে গেছি আমি!

রাজ কথা শেষ করে কোয়েলের কাঁধে কপাল ঠেকালো। কোয়েল এখনও নীরবে নীচের দিকে তাকিয়ে আছে। রাজ একটা নিশ্বাস নিয়ে সরে আসতে নিলে কোয়েল রাজের বুকে মাথা এলিয়ে দেয়, রাজের কোমরের কাছে শার্টটা শক্ত করে ধরে। মৃদু হাসে রাজ, হেসে কোয়েলের কোমর ধরে কাছে টেনে ওর কাঁধে মুখ গুঁজে দেয়। ধীরে ধীরে কোয়েলের দু-হাত রাজের পিঠে আবদ্ধ হয়। রাজ সোজা হলেও কোয়েল রাজকে ছাড়ে না, তাই রাজ কোয়েলের মুখটা সোজা করে কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে নিজের কপাল ঠেকায় চোখ বুজে।

কোয়েল: ত..তুমি আর যাবে না তো আমাকে ছেড়ে? (কান্নামিশ্রিত কণ্ঠে)

রাজ: মাথাতেও আনিনা এই কথাটা আমি। নিজের প্রাণপাখিটা যদি নিজের সাথে না থাকে তাহলে কীভাবে বাঁচবো আমি? তোমাকে সারাজীবনের মতো নিজের করবো দেখেই তো দূরে থাকার কষ্টটা সহ্য করেছি। আই লাভ ইউ কুহু!

কোয়েল: আই লাভ ইউ মোর!

রাজ নিজের বাহুবন্ধনের দ্বারা বুকের কাছে কোয়েলকে শক্তভাবে চেপে ধরে। কোয়েলও রাজের বুকেই মুখ গুঁজে থাকে চুপচাপ।

‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️
||পর্ব~৫০||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা

৭৩.
সকাল বেলা কোয়েলের ঘুম ভাঙতেই কোয়েল ঘুম ঘুম চোখে চারিদিকে তাকায়। নিজেকে বেডে দেখে ওর মনে পরে ও রাতে তো রাজের সাথে ছিলো আর এটা তো রাজের ঘর না। কোয়েল উঠে বসে রাতের কথা মনে করতেই একটু লজ্জা পায়।

কোয়েল: তাহলে কি রাজ আমাকে ঘরে দিয়ে গেছে? (লাজুক হেসে)

কোয়েল হেসে পাশে তাকাতেই যখন জায়গাটা ফাঁকা দেখে তখন মৌমিতার কথা মনে পরে ওর। গত রাতে যেভাবে ছুটে বেরিয়ে গেছিলো তারপর থেকে তো আর কোনো খোঁজ নেই। কোয়েল তাড়াতাড়ি উঠে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে রাজের ঘরে চলে গেলো। রাজের ঘরে ঢুকতেই দেখলো রাজ উপুড় হয়ে ঘুমাচ্ছে। কোয়েল রাজকে ঘুমাতে দেখে ওর পাশে গিয়ে বসলো আর আলতো করে ওর চুলে হাত দিলো। রাজ নড়ে উঠলেই কোয়েল হাত সরিয়ে নেয়।

কোয়েল: (মনে মনে– এখন কি ওকে ডাকাটা ঠিক হবে? ইশ! এভাবে কাঁচা ঘুমটা ভাঙ্গানো ঠিক হবে না। আমি বরং একাই যাই ওদের খুঁজতে।)

কথাটা ভেবে নিয়ে কোয়েল উঠতে গেলে রাজ কোয়েলের হাত ধরে রেখে কোয়েলের কোলে নিজের মাথা তুলে দেয়। তারপর কোমর দু-হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলে,

রাজ: এট্টু হাত বুলিয়ে দাও না। (বাচ্চাদের মতো করে)

এত শত চিন্তার মাঝেও কোয়েলের হাসি পেয়ে যায় রাজের এরকম কথা শুনে। কোয়েল রাজের এমন আবদার উপেক্ষা করতে না পেরে রাজের চুলে বিলি কেটে দিতে শুরু করে। কিছুক্ষণ পর আস্তে করে রাজকে ডাকতে শুরু করে কোয়েল।

কোয়েল: রাজ, রাজ? শুনছো?

রাজ: উম, বলো।

কোয়েল: মৌ আর আদিত্যদা এখনও গেস্ট হাউসে ফেরেনি।

কোয়েলের কথাটা শুনে রাজ ঝট করে চোখ খুলে সাথে সাথে উঠে বসে। কোয়েলও একটু ঘাবড়ে যায় রাজকে এভাবে উঠে বসতে দেখে।

রাজ: শিট! কালকে রাতে তো আদি ড্রাংক ছিলো?

কোয়েল: তুমিও!

রাজ কোয়েলের কথা শুনে চোখ নীচে নামিয়ে নিলো। কপালে দু-আঙুল রগড়ে কোয়েলকে কিছু বলতে গেলে কোয়েল রাজকে থামিয়ে বললো,

কোয়েল: তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে নাও, ওদের খুঁজতে বের হবো। আমি আমাদের ঘরে আছি।

বলে এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে কোয়েল বেরিয়ে গেলে রাজ অসহায় দৃষ্টির সাথে কোয়েলের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। তারপর বেশি না ভেবে তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হতে চলে গেলো কারণ দেরী করলে কোয়েল আরো রেগে যাবে। ফ্রেশ হয়ে এসে রেডি হয়ে নিয়ে কোয়েলকে সাথে করে গেস্ট হাউস থেকে বেরিয়ে গেলো রাজ। এখনও কেউ ওঠেনি ওদের ভার্সিটির।

কোয়েল: কোথায় খুঁজবো বলো তো ওদের? যদি একসাথে না থাকে তাহলে তো আরো সমস্যা।

রাজ: (মনে মনে– একসাথে না থাকলে আদির অবস্থা কেমন এটা ভেবেই আমার ভয় লাগছে। এটা কোয়েলকে বললে ও আরো টেনশান করবে, না থাক। কিছু বলবো না এখন।)

কোয়েল: কি হলো, কি ভাবছো?

রাজ: (চমকে উঠে) হ্যাঁ? না কিছু না। আদি রোডে উঠেছিল সো রোড ধরেই আমাদের যাওয়া উচিত কারণ এখানে রোডের ধারে রেলিং ঘেষে অনেক বসার জায়গা আছে।

কোয়েল: আচ্ছা।

এদিকে,
হঠাৎ করেই মৌমিতার ঠান্ডা বেশি লাগায় সে জড়োসড়ো হতে শুরু করে আর এমন সময় মৌমিতাকে কেউ পরম যত্নে নিজের বুকে ভালো মতন আগলে নেয়। আবেশের বশে মৌমিতাও তাঁকে জড়িয়ে ধরে কিন্তু কিছুক্ষণ পর ঘুমের রেশ একটু কাটতেই মৌমিতা চোখ মেলে ভালো ভাবে তাঁকায়।

মৌমিতা: আদিত্য? আমি, আমি সারারাত ওনার বুকে এভাবে এখানে ঘুমিয়েছি? (চারিদিক দেখে)

মৌমিতার রাতের কথা মনে পরলে লজ্জায় কুঁকড়ে যেতে শুরু করে। আদিত্যের বুকেই সে মুখ লুকায়। তখনই,

আদিত্য: তো আমি ছাড়া এখানে কে আছে শুনি?

আমি ওনার গলার স্বর শুনে ওনার দিকে তাকালে উনিও আমার দিকে তাঁকায় আর মুচকি হাসে। আমি চোখ নীচে নামিয়ে নিয়ে লাজুক ভাবে জিজ্ঞেস করলাম,

মৌমিতা: আপনি কখন উঠেছেন?

আদিত্য: সকাল হতেই ঘুম ভেঙে গেছে। তাই একটু আশেপাশের পরিবেশটা উপভোগ করছিলাম…উইথ মাই ওয়াইফ! (মৌমিতার কানে আস্তে করে)

ওনার কথাটা কানে আস্তেই আমার চোখ বন্ধ হয়ে গিয়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো। আমি কি বলবো ভেবে না পেয়ে উঠে যেতে নিলে উনি আমাকে আরো শক্ত করে ধরে ধমক দিয়ে উঠলেন।

আদিত্য: আমি উঠতে বলেছি?

মৌমিতা: ইয়ে..ফিরবো না গ..গেস্ট হাউসে? রাতে তো ফিরিনি। কোয়েল, রাজদা হয়তো চিন্তা করছে।

আদিত্য কিছু বলতে যাবে তাঁর আগেই পিছন থেকে আওয়াজ এলো,

রাজ: ও যদি আমাদের কথা ভাবতো তাহলে তো হয়েই যেতো। কয়েক মাস ধরে ওর মাথায় শুধু মৌমিতা নামটাই মোঁ মোঁ আর ভোঁ ভোঁ করছে।

রাজ আর কোয়েলকে একসাথে আসতে দেখলে আদিত্য আমাকে ছেড়ে দেয় আর আমি দূরে সরে এসে উঠে দাঁড়াই। ইশ! কি লজ্জার ব্যাপার। বলেছিলাম আগে ছাড়তে কিন্তু না, শুনলেন না আমার কথা।

কোয়েল: বলি তোদের কি ঠান্ডা লাগে না? এই শীতে সারারাত এভাবে কাটিয়ে দিলি? (বিস্ময় নিয়ে)

আদিত্য কোয়েলের কথা শুনে হুট করেই দাঁড়িয়ে আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললেন,

আদিত্য: আমি ছিলাম তো ওকে গরম রাখার জন্যে। (মুচকি হেসে)

ওনার কথা শুনে আমি কি রিয়াকট করবো বুঝে উঠতে পারছি না। এটা কোনো উপায় হলো সবাইকে সবটা জানানোর? উফ, পুরোই নির্লজ্জ।

রাজ: আচ্ছা? এই ব্যাপার?

আদিত্য: ইয়েস! তোরা এতো সকাল সকাল কি করছিস?

রাজ এবার আদিত্যের কথা শুনে বাঁকা হেসে পিছন থেকে একহাতে কোয়েলের কোমর জড়িয়ে ধরে আরেক হাত কোয়েলের গলা হয়ে কাঁধে রাখে। কোয়েল একটু চমকে গেলে রাজ কোয়েলর কাঁধে চিবুক রেখে হেসে বলে,

রাজ: এই একটু তোদের খোঁজার বাহানায় প্রেম করতে বেরিয়েছি। তোদের খোঁজা তো হয়ে গেলো এইবার প্রেম করার পালা।

আমি আর আদিত্য হেসে একে অপরের দিকে তাকালাম কিন্তু কোয়েল পরেছে আমার পরিস্থিতিতে। কোয়েল চোখ রাঙিয়ে রাজদার দিকে তাকালে,

রাজ: ছল্লি!

রাজদা বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে কোয়েলের ঘাড়ে মুখ গুঁজে ফেলে। সেই দেখে কোয়েলও হেসে ফেলে। আমি আস্তে করে বলি,

মৌমিতা: কি কিউট!

হুট করে সাথে সাথে আদিত্য আমার গালে ঠোঁট ছুঁয়ে দিলে আমি ওনার দিকে অবাক চোখে তাকালে উনি বলেন,

আদিত্য: আমিও! (বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টে)

আমি নিজের হাসি চেপে রেখে কিছু বলতে যাবো তাঁর আগেই কোয়েল বলে উঠলো,

কোয়েল: ঠিক আছে এইবার আমাদের ফেরা উচিত কারণ স্যার ম্যাডামরা যদি জানতে পারেন তাহলে…

রাজ: তাহলে কি? বলবো ঘুম থেকে উঠে সকালের ভিউ দেখতে বেরিয়েছি। সিম্পল! আমি এখন গেস্ট হাউস যাচ্ছি না ব্যাস।

আদিত্য: ঠিক আছে তোরা থাক, আমরা ফ্রেশ হয়ে এসে তোদের জয়েন করছি। ততক্ষণ একটু তুইও প্রেম করেনে আমিও করে নিচ্ছি। (চোখ টিপ মেরে)

রাজ: একদম।

আদিত্য: চলো বউ।

মৌমিতা: ধ্যাৎ!

আমি ওনার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে চলে এলাম। লজ্জার মাথা খেয়ে বসে আছেন লোকটা। উনি আমার পিছন পিছন এসে আমাকে বুকে আগলে নেন হাসতে হাসতে। এদিকে কোয়েল রাজকে বলে,

কোয়েল: অসভ্য ছিলে জানতাম, তা নির্লজ্জটা কবে হলে শুনি? (রেগে)

রাজ: কথায় কথায় এত রাগ দেখাও কেন? একটু ভালোবেসে বলতে পারো তো নাকি? (আদুরে গেলে)

কোয়েল: আহা! শখ কম না। ছাড়ো এবার আমাকে।

রাজ: ছাড়ার জন্য তো ধরিনি কুহু! একবার যখন ধরেছি তখন মৃত্যুর আগে অবধি ছাড়বো না।

কোয়েল: রাজ প্লিজ, কিসব আজে বাজে কথা…

কোয়েল কথাটা বলতে গিয়েও আটকে গেলো কারণ রাজ কোয়েলের ঘাড়ে নাক ঘষে আলতো করে নিজের ঠোঁটের ছোঁয়া দিচ্ছে। কোয়েল চোখ বন্ধ করে একটা নিশ্বাস নিয়ে জোর করে রাজের থেকে দূরে সরে এসে বললো,

কোয়েল: এটা রাস্তা ইডিয়ট!

লজ্জা পেয়ে কোয়েল গিয়ে সামনে থাকা বেঞ্চে বসে পরলে রাজ বাঁকা হেসে নিজের চুলটা একটু নাড়িয়ে কোয়েলের পাশে গিয়ে বসে।

৭৪.
আমি গেস্ট হাউসে ফিরে ওনাকে নিজের ঘরে জোর করে পাঠিয়ে ফ্রেশ হতে চলে এসেছি। বেশ কিছুক্ষণ ধরে শাওয়ার নেওয়ার পর চুল মুছতে মুছতে বের হতেই আদিত্যকে আমার ঘরে দেখে আমি চমকে উঠি।

মৌমিতা: আপ…

আদিত্য এক মুহূর্তে আমার কাছে এসে, আমাকে নিজের সাথে মিশিয়ে আমার মুখ চেপে ধরলেন। কিছুক্ষণ আমাকে ভালো করে পর্যবেক্ষণ করার পর আমার মুখের থেকে হাত সরিয়ে আমার কপালে ঠোঁট ছুঁয়ালে আমি চোখ বন্ধ করেনি।

আদিত্য: এখন থেকে আপনি না। শুধু তুমি! আপনি শুনলে আমি তোমার সাথে কথা বলবো না। আর আমাকে আদি বলে ডাকবে ওকেই?

কথা শেষ করেই উনি আমার গালে ঠোঁট ছোঁয়ালে, আমি মৃদু কেঁপে উঠলাম। সোজা হয়ে উনি আমার দিকে উত্তরের আশায় তাকালে আমি নীচের দিকে তাকিয়ে হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লাম। অর্থাৎ আপনি বলবো না আর আদি বলে ডাকবো। উনি আমার কানের নীচ দিয়ে হাত প্রবেশ করিয়ে আমার মুখ তুলে জিজ্ঞেস করলেন,

আদিত্য: এতো সকালে এতক্ষন শাওয়ার নেওয়ার কি দরকার ছিলো? (সামান্য রেগে)

মৌমিতা: এমনিই। সারারাত ঠিক করে ঘুম হয়নি তাই মাথাটা একটু ধরেছিল।

আদিত্য: মাথা তো আমার ধরে রয়েছে। (আস্তে করে)

মৌমিতা: তা ধরবে না কেন? ওইসব ছাইপাশ ওভাবে গিললে তো হবেই।

উনি আমার দিকে করুন ভাবে তাকিয়ে বললেন,

আদিত্য: ট্রাস্ট মি, আমি ইচ্ছা করে খাইনি। সবাই এতো জোর করলো আমাকে আর রাজকে যে আমরা বাধ্য হয়ে ছিলাম। এতদিন পর সবাই জোর করছিলো সো…

মৌমিতা: তাই বলে অতটা? আমি একদম পছন্দ করি না ড্রিংক করা। (অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে)

আদিত্য: আ’ম স্যরি! আর হবে না। (মৌমিতার কানের কাছে আস্তে করে)

আমি ওনার কাছ থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে সরে আসতে চাইলেও পারি না। উনি আমাকে পিছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলে আমি বলি,

মৌমিতা: ক..কি করছেন টা কি? ছ..ছাড়ুন।

আদিত্য: কি বললাম আমি কিছুক্ষণ আগে? (বেশ রেগে)

আমি জিভ কাটলাম আদিত্যের কথা শুনে। ভুল করে ওনাকে আপনি বলে সম্বোধন করে ফেলেছি।

মৌমিতা: আসলে এতদিনের অভ্যেস তো তাই ভুল হয়ে গেছে। স্যরি!

আদিত্য: উম, ভুল যখন করেছো দ্যান পানিশমেন্ট তো পেতে হবে তাই না?

মৌমিতা: (কাঁচুমাচু মুখ করে) পানিশমেন্ট?

আদিত্য আমার কথা শুনে বাঁকা হেসে আমার ঘাড়ে মুখ গুঁজলেন। আমাকে আরো শক্ত করে নিজের কাছে টেনে নিয়ে আমার ঘাড়ে আলতো স্পর্শে ঠোঁট ছোঁয়াতে শুরু করলে আমার বুঝতে বাকি রইলো না উনি কি চাইছেন। ওনার স্পর্শ পেয়ে আমার নিশ্বাস ভারী হয়ে আসলে আমি দু হাতে নিজের জামা মুঠ করে ধরি। অনুভব করি ওনার নিশ্বাস ও আমার মতই ভারী হয়ে এসেছে। ওনার উষ্ণ নিশ্বাস নিজের কাঁধে এবং শীতল ছোঁয়া নিজের শরীরে পেতেই আমি নিজেই ঘুরে গিয়ে ওনাকে জড়িয়ে ধরি চোখ বন্ধ করে। উনি আমার মুখটা দু হাতের মাঝে আগলে, সামনে এনে কপালে ঠোঁট ছোঁয়ান। আমি চোখ মেলে ওনার চোখে চোখ রাখতেই উনি আমার ঠোঁটে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ান আর আমি আবেশে চোখ বুজে ওনার শার্ট খামচে ধরি।

বেশ কিছুক্ষণ পর,
আদিত্যকে জড়িয়ে ধরে স্থির ভাবে ওনার কাঁধে মাথা রেখে আছি দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থাতেই। এখন মনে হচ্ছে আরো আগে ওনাকে মেনে নিলে, আমার শান্তির জায়গাটা আরো আগে পেয়ে যেতাম। আমি ওনাকে ডাকতে গিয়েও থেমে গেলাম। মুচকি হেসে ডাকলাম,

মৌমিতা: আদি! কোয়েল আর রাজদা আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। ছাড়ো এবার আমাকে। (আদিত্যের ঘাড়ে মুখ গুঁজে)

আদিত্য আরো শক্ত করে আমাকে জড়িয়ে ধরলে আমি বুঝতে পারি আমার কথা শুনে খুশিতেই আমাকে জড়িয়ে ধরেছে। ও আস্তে করে আমার কানের কাছে বললো,

আদিত্য: ওদেরকে ওদের মতো টাইম স্পেন্ড করতে দাও আর আমাদেরকে আমার মতো। আমি চাইছি না এখন কাওর সাথে তোমাকে শেয়ার করতে। (কাঁধে নাক ঘষে)

আমি কিছু বলতে গিয়েও বললাম না, থেমে গেলাম। ওর সাথে যতটা বেশি সময় কাটাবো ততো বেশি ভালো হবে সেটা আমাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে।

‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️
||পর্ব~৫১||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা

৭৫.
আমি আর আদি আমাদের ঘরের ব্যালকনিতে থাকা দোলনায় বসে আছি। আদি আমাকে এক হাতে আগলে, বুকে জড়িয়ে নিয়ে বসে আছে। আমারও ইচ্ছা করছে না ওর বাহুবন্ধন থেকে মুক্ত হতে কিন্তু অনেকটা সময় পেরিয়ে গেছে আমরা একসাথে রয়েছি। কোয়েল হয়তো ফিরে আসবে এক্ষুনি। সেই ভেবে আমি মাথা তুলে একটু দূরে সরে আসার চেষ্টা করলেই আদি আমাকে আরো শক্ত করে ধরে। আমি আদুরে কণ্ঠে বলি,

মৌমিতা: আর কতক্ষণ এভাবে থাকবো আদি? কোয়েল চলে আসবে তো এবার। ছাড়ো আমাকে।

আদির কোনো সাড়াশব্দ পেলাম না তাই মাথা তুলে তাকাতেই দেখলাম ও চুপচাপ স্থির দৃষ্টি নিয়ে সামনে তাকিয়ে আছে। আমি ওর দিকে তাকিয়ে থেকেই একটু জোর দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

মৌমিতা: কি হয়েছে? কি নিয়ে ভাবছো?

আদিত্য: হম?

আদি আমার চোখে চোখ রেখে মুচকি হেসে কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালো ফলে আমার ঠোঁটের কোণেও হাসি ফুটে উঠলো।

আদিত্য: এটাই ভাবছি যে…

মৌমিতা: যে?

আদিত্য: যে কত তাড়াতাড়ি তোমাকে নিজের কাছে নিয়ে আসা যায়। (হেসে)

মৌমিতা: মানে?

আদিত্য: (কানে কানে) মানে এটাই যে আমি আর তোমার থেকে দূরে থাকতে পারছি না।

আমি আদির কথা শুনে ওর বুকে মুখ গুঁজে লাজুক স্বরে বললাম,

মৌমিতা: ধ্যাৎ! তুমি মিথ্যে বলছো। অন্য কিছু নিয়ে চিন্তা করছো তুমি, আমি জানি। বলবে না আমায়?

আমি মাথা তুলে প্রশ্নটা করতেই ওর মুখে চিন্তার ছাঁপ পরে গেলো আবার। আস্তে করে বললো,

আদিত্য: জিয়ার কথা ভাবছি।

মৌমিতা: ও আচ্ছা তো তুমি ওকে মিস করছো? সত্যি তো কালকে বেচারি কত কাছে ছিলো তোমার কিন্তু আমার জন্য…যাই হোক তাহলে আমি ওকে ডেকে দেবো?

আমি ঠোঁট কামড়ে হাসি চেপে কথাগুলো বললে আদি আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে শান্ত দৃষ্টিতে। আমি ভ্রু উঁচিয়ে ওকে আরেকবার জিজ্ঞেস করতেই ওর চোয়াল শক্ত হতে শুরু করে আর নিশ্বাস দ্রুত। কিন্ত মুখে একটাও কথা বলছেন না তাই আমি ভাবলাম হয়তো বলাটা ঠিক হয়নি কথাটা।

মৌমিতা: আরে, রাগ করছো কেন? মজা করছিলাম আমি। (হাসার চেষ্টা করে)

আদি ঝট করে উঠে গেলো আমাকে ছেড়ে আর ব্যালকনির রেলিং ধরে দাঁড়ালো। আমি অসহায় ভাবে কিছুক্ষণ বসে থেকে ওকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললাম,

মৌমিতা: আমি সত্যি মজা করছিলাম আদি। স্যরি!

আদি আমার হাত ছড়িয়ে আমার দিকে ঘুরে নীচের দিকে তাকিয়ে বললো,

আদিত্য: ঘরে যাচ্ছি আমি।

মৌমিতা: (ওর হাত ধরে আটকে) আদি প্লিজ, স্যরি বলছি তো? আমি সত্যি মজা করেছি, বিশ্বাস করো।

আদিত্য: (তাচ্ছিল্য হেসে) তুমি তো নিজেই আমাকে বিশ্বাস করতে পারনি এখনও তারপরেও বিশ্বাসের কথা বলছো?

মৌমিতা: কে বললো আমি তোমাকে বিশ্বাস করিনা?

আদিত্য: করো না দেখেই বলতে পারলে কথাটা। ইউ নো আমি যতই ড্রাংক থাকি না কেন অন্য কোনো মেয়ের কাছাকাছি যাওয়ারর কথা ভাবতেও পারিনা সেখানে সুযোগ নেওয়া তো…

আদি কথাটা বলতে গিয়ে আটকে গেলে আমি ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলি,

মৌমিতা: আমি সত্যিই মজা করেছি আদি। নিজের চাইতেও বেশি বিশ্বাস করি আমি তোমায়। তোমাকে হার্ট করার কোনো ইচ্ছা ছিলো না আমার আ’ম স্যরি!

আমি জড়িয়ে ধরলেও আদি আমাকে জড়িয়ে ধরেনি প্রথমে কিন্তু ধীরে ধীরে আমার পিঠে হাত রাখলে আমি স্বস্তি পাই। এভাবে হঠাৎ করে আমার কথাটা বলা উচিত হয়নি।

আদিত্য: মে বি জিয়াই প্ল্যান করে আমাকে ড্রিংক করিয়েছে, যাতে আমার কাছে আসতে পারে।

আমি আদির কথা শুনে সোজা হয়ে একটু বিস্ময় নিয়ে ওর দিকে তাকাই আর জিজ্ঞেস করি,

মৌমিতা: তোমারও তাই মনে হয়? আমারও এটাই প্রথমে মনে হয়েছে।

আদিত্য: হম, আমি কালকে রাতেই জিয়াকে যখন তুমি কথাটা বলেছো তখনই খেয়াল করেছি। ওর মাথায় কিছু না কিছু তো চলছে কিন্তু সেটা কতটা পরিমাণ সাংঘাতিক এটাই আন্দাজ করতে পারছি না। আমার সিক্সথ সেন্স বলছে ও আমাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি করার চেষ্টা করছে। তাই জন্যেই বললাম, আমাদের মধ্যে যদি বিশ্বাসটাই না থাকে তাহলে…

মৌমিতা: আমি বলছি তো আমি তোমাকে বিশ্বাস করি, নিজের থেকেও বেশি বিশ্বাস করি। (ছলছল চোখে)

আদি আমাকে নিজের কাছে টেনে নিয়ে বললো,

আদিত্য: আই ক্যান্ট লুজ ইউ মৌ! আই ক্যান্ট। ইফ আই লুজ ইউ দ্যান আই উইল ডাই। (কাঁপা কণ্ঠে)

মৌমিতা: শশশ! আমাদের কেউ আলাদা করতে পারবে না আদি।

ওর চোখে আমাকে হারানোর তীব্র ভয় দেখতে পাওয়ায় আমি ওকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। ভাবিনি কোনোদিন যেই মানুষটা একদিন আমাকে নিজের জীবনেই চায়নি, সেই মানুষটারই জীবন হয়ে উঠেছে আজ আমি। আমাকে হারানোর ভয়টা তাঁর মধ্যে এতটাই তীব্র যে আমাকে চোখের আড়াল করতে চায় না সে তার জন্যে নিজের জীবন বাজি রাখতেও রাজি সে। আজ মনে হচ্ছে, ভাগ্যিস বাবা-মার কথা রেখেছিলাম নাহলে এতো ভালোবাসা আমি পেতাম না। ভালো কিছু পেতে গেলে হয়তো একটু কষ্ট, একটু অপেক্ষা করতে হয়।

৭৬.
কোয়েল একটা ঢালু, সবুজ ঘাসভরা মাটিতে পা লম্বা করে বসে আছে আর দূরের উঁচু, মেঘে ঢাকা পাহাড় দেখছে। সূর্য রশ্মি কোয়েলের শরীরে এসে পড়লে তা আলোকছটায় পরিণত হচ্ছে। রাজ দূরে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে তুলতে কোয়েলের উপর ক্যামেরা আনতেই এই দৃশ্য দেখে হতবাক হয়ে যায়। ঘাসের উপর সূর্য রশ্নি পড়ায় যেমন সেগুলো চিকচিক করছে, উজ্জ্বল লাগছে ঠিক তেমন কোয়েলও একটা নক্ষত্রের মতো ঝলঝল করছে। সেইসময় মৃদু শীতল হাওয়া কোয়েলের শরীর ছুঁয়ে দিলে কোয়েল চোখটা বন্ধ করে, মুখ উঁচু করে তা অনুভব করে। তৎক্ষণাৎ এই মুহূর্তটা ক্যামেরা বন্দী করে নেয় রাজ আর কোয়েলের দিকে এগিয়ে যায়। কোয়েলের কাছে গিয়ে কোনো শব্দ না করে কোয়েলের কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরে রাজ।

কোয়েল: কি হলো? এভাবে এসে শুয়ে পড়লে যে?

রাজ: এমনি। তুমি একা একা বসে আছো তাই কোম্পানি দিতে এলাম।

কোয়েল: হুহ!

কোয়েল রাজের কাছ থেকে রাজের ক্যামেরাটা নিয়ে নেয়। প্রথম যেই ছবিটা দেখতে পায় সেটাই কোয়েলের কিছুক্ষণ আগের মুহূর্তে তোলা ছবি। কোয়েলের নিজেরও বেশ পছন্দ হয় ছবিটা তাই সামান্য হাসে। আস্তে আস্তে অন্য ছবিগুলো দেখতে দেখতে থাকে ও। রাজ হঠাৎ করে, ঘুরে কোয়েলের পেটে মুখ গুঁজলে কোয়েল একটু নড়েচড়ে বসে। আস্তে করে রাজের চুলে হাত রেখে বলে,

কোয়েল: আর কতক্ষণ থাকবো? এবার আমাদের ফেরা উচিত তাই না?

রাজ: উঁহু, পরে।

কোয়েল: নাহ রাজ, অনেকক্ষণ একসাথে আছি আমরা। এইবার আমাদের ফেরা উচিত। ব্রেকফাস্ট এর টাইম হয়ে গেছে তো?

রাজ ঝট করে উঠে বসে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বলে,

রাজ: আমার সাথে থাকতে আর ভালো লাগছে না বললেই হয়। ঘুরিয়ে বলার কিছু ছিল না এতে। (অভিমানের সুরে)

কোয়েল: আরে, আমি সেটা কখন বললাম? আমি এটা বলতে চাইনি রাজ, শুধু শুধু ভুল বুঝছো আমায় তুমি। উফ!

রাজ: (তাচ্ছিল্য হেসে) এতোটুকুতেই বিরক্ত তুমি, কদিনই বা আমাকে সহ্য করতে পারবে তুমি?

কোয়েল অবাক হয়ে যায় রাজের ব্যবহারে। সে কিছুই বুঝতে পারছে না। কোয়েল ভাবেইনি রাজ এই সামান্য কথাটাকে এভাবে ঘুরিয়ে ধরবে। কিন্তু এখন বুঝতে যখন পেরেছে তখন জমরাজের মান ভাঙানো তো লাগবেই। তাই কোয়েল রাজের বাহু একহাতে জড়িয়ে ওর কাঁধে মাথা রেখে বললো,

কোয়েল: এখন যদি না ফিরি তাহলে সবার সাথে ঘুরতে কীভাবে বের হবো রাজ? তোমার আর আদিত্যদার উপর তো সব দায়িত্ব, তোমরা যদি না যাও তাহলে কি করে হবে? আমি সেইভেবেই কথাটা বলেছি। এতো সেনসিটিভ কবে থেকে হলে তুমি? হম?

রাজ কোয়েলের কথা শুনে কোয়েলের দিকে মুখ ঘুরিয়ে ওর চোখে চোখ রেখে বলে,

রাজ: যেদিন তোমার থেকে দূরে গেছি সেদিন থেকে। তোমাকে চোখের আড়াল করতে মনই চায় না, মনে হয় সবসময় নিজের কাছে আগলে রাখি।

রাজের এমন কথা শুনে কোয়েলের চোখ ছলছল করে ওঠে। একটা চাপা কষ্ট নিয়ে যে রাজ কথাটা বলেছে তা অনুভব করতে পেরেছে কোয়েল। এখন সে বুঝতে পারছে তাঁর সাথে সাথে রাজও কষ্ট পেয়েছে। কোয়েল বেশিক্ষণ রাজের চোখে চোখ রাখতে না পেরে চোখ নামিয়ে নিলে, রাজ কোয়েলের কাছ থেকে নিজের বাহু ছাড়িয়ে কোয়েলকে বুকে আগলে নেয়।

কোয়েল: রাজ, গতকাল রাতে কারা তোমাদের জোর করেছিলো ড্রিংক করার জন্যে?

রাজ: ওই তো আমাদের ক্লাসমেটরা। কেন?

কোয়েল: আমার কেমন জানো মনে হচ্ছে ব্যাপারটা ইচ্ছা করে করা কারণ আমি সৌভিকদাকে দেখেছি তোমাদের ক্লাসমেটদের সাথে কথা বলতে। হয়তো ও শিখিয়ে দিয়েছে?

রাজ: হতে পারে কারণ ওরা খুব ভালো ভাবে জানে আমি বা আদি কেউই ড্রিংক করিনা। বাট এতে লাভটা কি হলো ওদের? বরং আমাদেরই লাভ হলো। (হেসে)

রাজ কোয়েলকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলে কোয়েল রাজের কথার মানে বুঝতে পারে। ভেবে দেখে রাজ ভুল কিছু বলেনি তাই ও নিজেও হাসে। আরো কিছুক্ষণ গল্প করে, সময় কাটিয়ে ওরা গেস্ট হাউস ফিরে আসে। গেস্ট হাউসে ফিরে এসে চলে যায় যে যার নিজের ঘরে।

কোয়েল: এই মৌ! শোন না? কই তুই?

আমি ব্যালকনিতে বসে ফোন ঘাটছিলাম, বলা ভালো আদির সাথে চ্যাট করছিলাম তখন কোয়েলের গলার আওয়াজ পেলাম। উঠে ঘরে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

মৌমিতা: কি হয়েছে বল।

কোয়েল: তোকে আমার কিছু বলার আছে কালকে রাতের ব্যাপারে।

মৌমিতা: হম, হম শুনবো তো। কি করে আমার বান্ধবীর মন গললো জানতে হবে তো নাকি।

কোয়েল: (লাজুক হেসে) উফ! সেটা না, ধুর তুইও না।

মৌমিতা: বাহবা! লজ্জা দেখো মেয়ের। (হেসে) আচ্ছা বল কি বলবি।

কোয়েল: জানিস কালকে রাতে রাজ আর আদিত্যদাকে জোর করে ড্রিংক করিয়েছে ওদের ক্লাসমেটরা?

মৌমিতা: হম জানি। জিয়ার কাজ হতে পারে এটা কারণ কালকে রাতে জিয়া ওর সাথে ছিলো যখন ও বেরিয়ে গেছিলো গেস্ট হাউস থেকে। আমি গিয়ে দেখি জিয়া ওর কাছে আসার চেষ্টা করছে ওর বারবার বারণ করা সত্বেও। তাই আদিও বলছিলো এটা ওর কাজ হতে পারে।

কোয়েল: শুধু জিয়া না, সৌভিকদাও আছে এই বিষয়ে জড়িত। কারণ আমি দেখেছিলাম সৌভিকদাকে রাজ আর আদিত্যদার ক্লাসমেটদের সাথে কথা বলতে সবার আড়ালে।

মৌমিতা: তারমানে ওরা চেষ্টা করছে আমাদের ক্ষতি করার। খুব সাবধানে থাকতে হবে আমাদের।

কোয়েল: জিয়া না হয় আদিত্যদাকে ভালোবাসে তাই তোর ক্ষতি করতে চায়। পরেশবাবু জিয়ার বাবা, জিয়ার কষ্টের জন্য আদিত্যদাকে দায়ী করে এবং নিজের অপমানের বদলা নেওয়ার জন্য আদিত্যদার ক্ষতি করতে চায়। এতদূর অবধি ঠিক আছে কিন্তু রাজ? রাজের ক্ষতি কেন করতে চায় পরেশবাবু? শুধু আদিত্যদার সাথ দিয়েছে তাই? আচ্ছা সেটাই মেনে নিলাম। সৌভিকদার কি লাভ এসবে জড়িয়ে? ও কেন ওদের সাথে যোগ দিয়েছে? ওর তো কোনো রাগ থাকার কথা না তোদের উপর কারণ ও এতোটাও জিয়াকে প্রায়রিটি দেয় না। ও তো খুব স্বার্থপর আমার জানামতে।

কোয়েলের কথাগুলো একদম যুক্তিযুক্ত। কিছুদিন আগে যখন কোয়েল রাজদার সম্পর্কে বলছিল সেই কথাগুলো মনে করে আমি ওকে বললাম,

মৌমিতা: তুই তো বলেছিলি রাজদার উপর সৌভিকদার একটা ক্ষোভ আছে, হয়তো সেটা থেকেই…?

কোয়েল: হতে পারে কিন্তু সেদিন পরেশবাবু রাজকে কি বলেছিলেন তা আজও রাজ বলেনি।

মৌমিতা: ধৈর্য রাখ কোয়েল। সবে তোদের সম্পর্কটা ঠিক হয়েছে এক্ষুনি এসব চিন্তা করে ঘেঁটে ফেলিস না বিষয়টা। সময় দে রাজদাকে, নিজেদের সম্পর্ককে। একটু সহজ ফীল করা রাজদাকে দেখবি সব নিজে থেকেই বলে দেবেন। আর তুই তো ছোটবেলা থেকে ওনাকে চিনিস, এখন আবার সবথেকে কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিস। তোকে বলবে না তো কাকে বলবে?

কোয়েল শুধু হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ে। এরপর আমরা সবাই ব্রেকফাস্ট করে নিয়ে সবাই মিলে একসাথে আড্ডা দিয়ে দুপুরের খাওয়া-দাওয়া সেরেনি। তারপর রেডি হয়ে একটু ঘুরতে বের হই। বেড়ানোর পর থেকে আদি আমার সাথেই আছে, এক মিনিটের জন্য আমাকে ছেড়ে কোথাও যায়নি। আর এইসবই যে জিয়া নজরে রেখেছে তা আমার নজর এড়ায়নি। ওদিকে কোয়েল এসে আমাকে বললো ওকে আর রাজদাকে সৌভিকদা নজরে রেখেছে যেটা জানার পরেই রাজদা রেগে গেছেন। তাই ও গেছে রাজদার পিছনে। একটা পাথরে হেলান দিয়ে এসব ভাবছিলাম, এসব ভাবনার মাঝেই পিছন থেকে আদিত্য আমার গলা জড়িয়ে ধরলো দু-হাত দিয়ে। কানের কাছে এসে আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো,

আদিত্য: কি ভাবছো এত? আমার কথাও তো ভাবতে পারো মাঝে মধ্যে এমন মন দিয়ে?

মৌমিতা: (হেসে) ইশ! বয়েই গেছে আমার তোমার কথা ভাবতে।

আদিত্য: আচ্ছা তাই? তারমানে এখন আমি কেউ না?

মৌমিতা: (নিজেকে ছাড়িয়ে) আজ্ঞে না, কেউ না।

আদিত্য: তাহলে তো কেউ হয়ে উঠতে হচ্ছে…

কথাটা বলেই ও আমাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। আমি চোখ বড়ো করে ওর দিকে তাকালেও ও কোনো পাত্তা দিলো না। আমি নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করতে নিলেই ও বললো,

আদিত্য: লাভ নেই, পারবে না আমার থেকে নিজেকে ছাড়াতে।

মৌমিতা: আশেপাশে কতো লোক আছে দেখেছো? ভার্সিটির কেউ দেখলে কি ভাববে বলো তো? ছাড়ো আমায়।

আদিত্য: ভার্সিটির সবাই জানে তোমার আমার সম্পর্কে। আমার বউয়ের সাথে যা ইচ্ছা তাই করবো আমি, কে কি বলবে? হম? আমি চাইলে তোমার কথা বলাটাও এক্ষুনি বন্ধ করে দিতে পারি, সেটাই চাইছো?

আমি ওর কথা শুনে না বুঝতে পেরে ভ্রু কুঁচকালেই ও দুষ্টু হেসে আমার ঠোঁটের দিকে তাকায় আর আমি সাথে সাথে না বোধক মাথা নাড়ি। কিন্তু ও সেসব না শুনে আমার ঠোঁটের দিকে এগোতে নিলেই ওর হাতের বাঁধন একটু আলগা হয়ে যায় আর সেই ফাঁকেই আমি ওকে ধাক্কা দিতে ও দূরে সরে যায়।

__কি রে তোরা এখানে কি করছিস? স্যার, ম্যাডাম ডাকছে তো আদিত্যদাকে।

আমাদের ভার্সিটি থেকে আমার সমবয়সী একজন স্টুডেন্টকে আসতে দেখেই আমি ওকে দূরে সরিয়ে দিয়েছি। ও যে এতে রেগে গেছে তা ওই ছেলেটার কথায় কোনো উত্তর না দেওয়াতেই বুঝতে পেরেছি। ছেলেটা কথাটা জানিয়ে চলে গেলে আদিও চলে যেতে নেয় কিন্তু আমি ওর হাত ধরে বলি,

মৌমিতা: আমি বলেছিলাম কেউ দেখে নিলে কি হবে। ওকে আসতে দেখেই সরিয়ে দিয়েছি তোমায়, স্যরি!

আদিত্য: ইট’স ওকে। আমারও বোঝা উচিত সবসময় সবার মন থাকে না। তুমি হয়তো চাওনি আমি তোমার কাছে যাই। আমারই ভুল হয়েছে পারমিশন না নিয়ে কাছে যাওয়াটা, আর হবে না এমন স্যরি!

মৌমিতা: কি বলছো এসব? আমি কেন চাইবো না তুমি আমার কাছে থাকো হম? (আদির গালে হাত রেখে)

আদিত্য: চাওনা তাই জন্যেই তো আমাকে ছুটে আসতে হয় তোমার কাছে বারবার। তুমি একবারও প্রয়োজন মনে করো না আমার কাছে যাওয়ার। (অভিমান করে)

হে ভগবান! এই ছেলেটা এত্ত অভিমান করে আছে আর আমি টেরও পাইনি? ভাগ্যিস কিছুক্ষণ আগে ঘটনাটা ঘটলো নাহলে তো টেরই পেতাম না। কিন্তু ওই তো আমাকে চোখের আড়াল করছে না, আমি আরকি যাবো ওর কাছে? বোঝাতে হবে ওকে এটা।

মৌমিতা: আচ্ছা তুমি কি আমাকে একটুখানির জন্যেও একলা ছেড়েছো? একলা ছাড়োনি দেখেই তো আমি কোনো সুযোগ পাইনি। তুমি আমার চোখের আড়াল হলে আমি যেতাম, যাইনি সেদিন রাতে? তুমি আমাকে চোখের আড়াল করেছো তারপর থেকে?

আদিত্য: নো, বিকজ আই লাভ ইউ! বাট ইউ ডোন্ট লাভ মি। (মুখ ঘুরিয়ে)

ওর কথাটা শুনে কিছুক্ষণের জন্য একপলকে ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর সাথে সাথে উত্তর দিলাম,

মৌমিতা: আই অলসো লাভ ইউ আদি! (আলতো করে গালে ঠোঁট ছুঁয়ে)

আমি ওর গালে ঠোঁট ছুঁয়েই বুকে মাথা রাখতেই ও আমাকে জড়িয়ে ধরলো। যাক, ভাঙানো গেলো তাহলে বাবুর রাগ।

৭৭.
কোয়েল: রাজ প্লিজ, এতো মাথা গরম করো না তুমি। আমি তো বললাম ও আমাদের উপর নজর রাখছিলো শুধু আমার উপর ন…

কোয়েল কথাটা বলতে গিয়েও থেমে গেলো রাজের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেখে। সৌভিকের যেমন রাগ আছে রাজের উপর তেমন রাজেরও রাগ আছে সৌভিকের উপর। সেটা কোয়েল জেনেও যে কেন রাজকে কথাটা বলতে গেলো এটাই এখন কোয়েল ভেবে পাচ্ছে না। রাজ তো আর বাচ্চা নয় যে কোয়েল যা বোঝাবে তাই বুঝবে। কোয়েল কথাটা বলার পর রাজ নিজেই লক্ষ্য করেছে সৌভিকের চাহুনির উপর। সৌভিকের নজর কোয়েলের উপরেই ছিলো। নজর বললে ভুল হবে, বলা উচিত কুনজর। এটা কোয়েল নিজেও ভালোভাবে জানার পরও কি করে সৌভিকের হয়ে কথা বলছে রাজ বুঝতে পারছে না, আরো মাথা গরম হয়ে যাচ্ছে যার জন্য।

রাজ: আমাকে একা ছেড়ে দাও কুহু। নাহলে আমি কি বলতে কি বলে ফেলবো আর তুমি কষ্ট পাবে যেটা আমি চাই না। প্লিজ, লিভ মি অ্যালোন। (ফুঁসতে ফুঁসতে)

কোয়েল: আমি কোথাও যাবো না তোমাকে একা ছেড়ে। (কাছে গিয়ে)

রাজ: প্লিজ কথাটা শোনো আমার। এখন আমার মাথার ঠিক নেই।

কোয়েল: তাই জন্যেই তো তোমার কাছে থাকবো। এই অবস্থায় আমি তোমাকে একা ছেড়ে গেলে তুমি সৌভিকদার ক্ষতি করে দিতে দু-বার ভাববে না। এমন হলে…

রাজের মাথাটা জানো আরো গরম হয়ে গেলো কোয়েলের কথাটা শুনে। কোয়েলকে কথা শেষ করতে না দিয়েই রাজ যেই গাছটার কাছে ছিলো সেই গাছটার সাথেই কোয়েলকে চেপে ধরে বললো,

রাজ: এতো কেন ভাবছিস তুই সৌভিকের ব্যাপারে? কে হয় ও তোর যার জন্য ওর এত চিন্তা করছিস? আমার থেকে বেশি ও জরুরি তোর কাছে যার জন্য ওর কথা ভাবছিস এখন?

কোয়েল: নাহ রাজ তেমন কিছু না।

রাজ: ছাড়, বুঝে গেছি যা বোঝার। ভাববি নাই বা কেন? আমি তো একটা অনাথ, সৌভিকের বাবার দয়াতেই বেঁচে আছি। আর সৌভিক? ও তো বড়লোক তাই না। ওর সাথে থাকলেই তোর সব উইস ফুলফিল হবে। আমি তো তোর যোগ্যই না ইনফ্যাক্ট আমি কোনো কিছুরই যোগ্য না। (কোয়েলকে ছেড়ে দূরে এসে)

কোয়েল সাথে সাথে রাজকে পিছন থেকে হ্যাঁচকা টানলে রাজ তাল সামলাতে না পেরে কোয়েলের অনেকটা কাছে চলে যায় আর গাছটা ধরে। কোয়েল রাজের চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করে,

কোয়েল: তোমার আমাকে এমন মেয়ে মনে হয় যে কি না শুধু টাকা ভালোবাসে?

কোয়েলের কথাটা শুনে রাজ মাথা নীচু করে নেয়। বুঝতে পারে সে রাগের মাথায় ভুল বলে ফেলেছে। এই জন্যেই তো বলেছিল সে কোয়েলকে যাতে চলে যায় এখন এখান থেকে। কোয়েল চলে না গিয়ে বরং এমন একটা কথা বললো যাতে রাজের মাথাটা আরো গরম হয়ে গেলো। কোয়েল রাজের উত্তর না পেয়ে রাজের দু-গালে হাত রেখে নিজের দিকে রাজের চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বললো,

কোয়েল: এখন তুমি যদি এখানে কোনো সিনক্রিয়েট করো তাহলে সেটা কি ঠিক হবে? এমনিতেই আমরা জানি না ওরা কি প্ল্যান করছে। হতেই তো পারে এটাই ওদের ফাঁদ, তোমাকে রাগানো দ্যান তুমি ওদের কাছে গেলে তোমার ক্ষতি করা? হতেই পারে এটা রাজ। এখন আমাদের মাথা গরম করলে চলবে না সে যাই করুক না কেন ওরা।

রাজ: তোর আইডিয়া নেই সৌভিক কতো মেয়ের জীবন নষ্ট করেছে এইভাবে। এসব জেনে আমি কীভাবে তোর উপর ওর মতো একটা ছেলের কুনজর পড়তে দিই? তুই শুধু আমার আর তোর উপর নজর দেওয়া থেকে নিয়ে শুরু করে সবকিছুর অধিকার শুধু আমার।

রাজ কোয়েলের কোমর ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে, কোয়েলের চোখে চোখ রেখে কথাগুলো বলে। ফলে, কোয়েলের কিছুক্ষণ যে পরিমাণ খারাপ লেগেছিল তাঁর দ্বিগুন পরিমাণ ভালো লাগা কাজ করছে এখন। রাজের চোখ রাগে লাল হয়ে ছলছল করছে। সবুজ মণির চোখগুলো লাল বর্ণ ধারণ করলে ভয় লাগার কথা কিন্তু কোয়েলের ভয় লাগছে না, কষ্ট হচ্ছে। রাজের কষ্টটা সে অনুভব করতে পারে। রাজের মধ্যে থাকা চাপা কষ্টটা আজ বেরিয়ে এসেছে। রাজের চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়লেই কোয়েল সেটা মুছে দিয়ে রাজকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলে,

কোয়েল: কে বলেছে তুমি অনাথ রাজ? আমি আছি তো? আমি সবসময় তোমার সাথে ছিলাম, আছি আর থাকবো, তোমার ছায়া হয়ে! তাছাড়া এই কথাটা দাভাই শুনলে কি হবে ভাবতে পারছো? আর কখনো নিজেকে অযোগ্য মনে করবে না রাজ।

কোয়েল সোজা হয়ে রাজের চোখে চোখ রাখলে রাজ কোয়েলের কোমর পেঁচিয়ে নিজের কাছে টেনে নিয়ে আসে আবার।

কোয়েল: আমি মনে করি না তুমি কাওর থেকে কম। কাওর দয়ায় তুমি বেঁচে নেই রাজ। তুমি নিজের জোরে বেঁচে আছো। আমি কি জানি না তুমি এর জন্যে কতটা পরিশ্রম করেছো ছোটো থেকে? নিজের পরিশ্রমের জোরে আজ তুমি এই জায়গায় নাকি কাওর দয়ায়। আমার বিশ্বাস এই চার বছরে তুমি নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছো যেটা আমি সবসময় চেয়েছিলাম।

কোয়েলের কথায় রাজের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে উঠলে কোয়েল বোঝে সে ঠিক কথাই বলেছে। এতে ওর নিজের মনেও শান্তি পায়। এইভেবে যে কিছু তো সূত্র পেলো রাজের চলে যাওয়ার কারণ হিসেবে। রাজ কোয়েলের কপালে কপাল ঠেকালে,

কোয়েল: আর কখনও নিজেকে অনাথ বলবে না রাজ। কেন এমন বলো? আমি মরে গেছি? আমি মরে গেলেও…

কোয়েলের মুখের কথা মুখে রেখে দিয়েই রাজ কোয়েলের ঠোঁটজোড়া নিজের ঠোঁটের ভাঁজে নিয়ে নিলো। কোয়েল প্রথমে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে থাকলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝে যায়, মরে যাওয়ার কথা আসার কারণেই রাজ এমন আক্রমনাত্মক হয়ে উঠেছে। রাজ এক হাতে কোয়েলের কোমর জড়িয়ে আরেক হাত দিয়ে কোয়েলের মাথাটা আরো কাছে টেনে আনলে কোয়েল আবেশে চোখ বুজে নেয়। গাছটার মধ্যে পুরোপুরি হেলান দিয়ে একহাত রাজের কাঁধে রেখে অন্য হাত রাজের চুলের ভিতর প্রবেশ করিয়ে রাজকে ধীরে ধীরে আঁকড়ে ধরে। এর ফলে রাজের উন্মাদনা আরো বেড়ে যায়। ভালোবাসার প্রথম স্পর্শটা ওরা দুজনেই পুরোপুরি উপভোগ করতে চায় তাই রাজও ধীরে ধীরে নিজের আক্রমণাত্মক ভাব কমিয়ে, রাগ, অভিমান সব মিটিয়ে কোমলতায় নেমে আসে।

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে