একদিন তুমিও ভালোবাসবে পর্ব-৪৩+৪৪+৪৫

0
1737

‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️
||পর্ব~৪৩||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা

৬৪.
“আমার ভিনদেশী তারা
একা রাতেরি আকাশে
তুমি বাজালে একতারা
আমার চিলেকোঠার পাশে”

ট্রেইন ছুটে চলেছে তার নিজ গতিতে রাতের অন্ধকারে ভেদ করে। রাতে সবাই খাওয়া-দাওয়া সেরে নিয়ে ঘুমাতে যাবে এমন সময় আদিত্য জানায়, সে আর রাজ রাত জাগবে কারণ চুরি হওয়ার একটা ভয় থেকেই যায়। এই শুনে বাদ বাকি অনেকে বলে ওঠে তাঁরাও রাত জাগতে চায়। শুধু শুধু কি আর রাত জাগা যায়? তাই সবার বায়না আদিত্যকে গান গেয়ে শুনাতে হবে। আমিও বেশ খুশি হলাম কথাটা শুনে কারণ ওনার নাচ তো দেখেছি এবার গানটাও শোনা হবে। সবার জোরাজুরিতে উনি রাজি হন আর ওনার হাতে গিটার তুলে দেওয়া হয়।

“ঠিক সন্ধ্যে নামার মুখে
তোমার নাম ধরে কেউ ডাকে
মুখ লুকিয়ে কার বুকে
তোমার গল্পো বলো কাকে”

আমার রাত জাগা তারা
তোমার অন্য পাড়ায় বাড়ী
আমার ভয় পাওয়া চেহারা
আমি আদতে আনাড়ী

আমার আকাশ দেখা ঘুড়ি
কিছু মিথ্যে বাহাদুরি (x2)
আমার চোখ বেধে দাও আলো
দাও শান্ত শীতল পাটি

রাতের আকাশে যে চাঁদ উঠেছে তা জানলা দিয়ে দেখা যাচ্ছে, ভালো মানিয়েছে পরিবেশ আর পরিস্থিতির সাথে গানটা। আমি বেশ উপভোগ করছিলাম মুহূর্তটা জানলা থেকে বাইরের দিকে তাকিয়ে। আদিত্য ওইদিকের সিটে বসে গান গাইছিলেন যেখানে শুধু একা থাকা যায়। হঠাৎ করেই আমি আমার খুব কাছে ওনার গলার স্বর শুনতে পাই। তাই মাথা ঘরাই এদিকে আর দেখি উনি আমার পাশে এসে বসেছেন। আমার দিকে তাকিয়ে গাইলেন,

“তুমি মায়ের মতই ভালো
আমি একলাটি পথ হাটি
আমার বিচ্ছিরি এক তারা
তুমি নাও না কথা কানে”

উনি আমার দিকে তাকিয়ে গাইলেন কেন গানের এই অংশটা? আমি সাত পাঁচ না ভেবে উঠে যেতে নিলেই উনি আমার হাত ধরে ফেলেন,

“তোমার কিসের এতো তাড়া
সে রাস্তা পার হবে সাবধানে”

আমাকে বসিয়ে দিয়ে চোখের ইশারায় আমাকে পাশে বসে থাকতে বলেন। আমি সবার দিকে তাকাতেই দেখি সবাই কেমন ভাবে জানো আমার দিকে তাকিয়ে আছি তাই ওদের থেকে চোখ ফিরিয়ে আমি আবার বাইরের দিকে তাকাই আর উপভোগ করতে থাকি মুহূর্তটা।

“তোমার গায় লাগেনা ধুলো
আমার দু’মুঠো চাল-চুলো (x2)
রাখো শরীরে হাত যদি
আর জল মাখো দুই হাতে
প্লীজ ঘুম হয়ে যাও চোখে
আমার মন খারাপের রাতে

আমার রাতজাগা তারা
তোমার আকাশ ছোয়া বাড়ি (x2)

আমি পাইনা ছুঁতে তোমায়
আমার একলা লাগে ভারী… (x2)”

গান শেষ হলে সবাই আস্তে আস্তে হাততালি দিতে থাকে। এই বগিটাতে শুধু আমাদের স্টুডেন্টরাই আছে তাই আর অসুবিধা হয়নি। এরই মাঝে আমার চোখ হঠাৎ করেই জিয়ার দিকে পরে। জিয়া দেখি আমার এদিকে তাকিয়ে আছে কিন্তু আমার দিকে নয়, আদিত্যের দিকে। আমি আদিত্যের দিকে তাকালে দেখি উনি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। এবার বুঝলাম এই জন্য জিয়া এমন চোয়াল শক্ত করে এদিকে কেন তাকিয়ে আছে। আমি আদিত্যের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলে আদিত্য বলে ওঠে,

আদিত্য: এই রাজ! এবার তোর টার্ন।

সবাই এবার রাজদার দিকে তাকালে দেখে রাজদা চোখ বন্ধ করে বসে আছে। তাহলে কি রাজদা ঘুমিয়ে পরেছেন?

আদিত্য: বেশি সেয়ানাগিরি করিস না ভাই আমার। তোর এইসব চালাকি আমার সাথে চলবে না। চুপচাপ নকশা বন্ধ করে গিটারটা ধর। তুই ধরবি নাকি আমি উঠবো?

আদিত্যের হুমকি শুনতেই রাজদা ঝটপট চোখ খুলে বললো,

রাজ: আমাকে ছেড়ে দে ভাই, এসব গান টান অনেক আগে ছেড়ে দিয়েছি আমি। এখন গান গাইলে লোকে বুঝতে পারবে না গান গাইছে নাকি গরুতে ডাকছে। (অসহায় মুখ করে)

রাজদার কথা শুনে আমরা সবাই হেসে ফেললাম। তবে আদিত্য তো নাছোড়বান্দা সে রাজদাকে দিয়ে গান গাওয়াবেই। আদিত্য উঠে রাজদার কানে কানে কিছু একটা বললো,

আদিত্য: বলে মানালি মানলো না। তাহলে একবার গান গেয়ে মানা, দেখ মানে কি না? (চোখ টিপ দিয়ে)

আদিত্য এসে আমার পাশে বসলে আমি চোখের ইশারায় জিজ্ঞেস করি রাজদাকে কি বললেন। আদিত্য শুধু হেসে আমায় বলেন,

আদিত্য: ওকে রাজি করানোর মন্ত্র।

আমি আর কিছু বললাম না কারন ইতিমধ্যে রাজদা গিটারে সুর তুলেছে। কোয়েল আমার মুখোমুখি বসে আছে কিন্তু বাইরের দিকে তাকিয়ে। আমার মনে হয় রাজদা গান শুরু করলেই কোয়েল ঠিক তাকাবে।

“তুমি না ডাকলে আসবো না
কাছে না এসে ভালোবাসবো না
দুরত্ব কি ভালোবাসা বাড়ায়?
নাকি চলে যাওয়ার বাহানা বানায়?”

যা ভেবেছিলাম তাই, রাজদা গান শুরু করতেই কোয়েল একবার রাজদার দিকে তাকায়। এরপর আমার সাথে চোখে চোখ পরে গেলে আবার বাইরের দিকে তাকায়। হুহ! আমাকে জ্ঞান দিচ্ছিলো এতদিন, এখন নিজে অবুঝ হয়ে বসে আছে।

“দূরের আকাশ নীল থেকে লাল
গল্পটা পুরনো,
ডুবে ডুবে ভালোবাসি
তুমি না বাসলেও আমি বাসি,
ডুবে ডুবে ভালোবাসি
তুমি না বাসলেও আমি বাসি।”

“এটাকি ছেলেখেলা আমার এই স্বপ্ন নিয়ে
চাইলে ভেঙে দেবে গড়ে দেবে ইচ্ছে হলে,
আমি গোপনে ভালোবেসেছি,
বাড়ি ফেরা পিছিয়েছে
তোমায় নিয়ে যাবো বলে।”

কোয়েল: (মনে মনে– ভেবেছে টা কি? আমাকে গান গেয়ে ভালোবাসার কথা বললে মেনে নেবো? ইমপ্রেস হয়ে যাবো? বয়েই গেছে আমার। এত সহজে ওকে মেনে নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। এতগুলো দিন কষ্ট পেয়েছি তাঁর খেসারত তো দিতেই হবে বাচ্চু! দেখি তুমি আর কি কি করো আমার জন্য।)

“একবার এসে দেখো,
এসে বুকে মাথা রেখো
বলে দেবো চুলে রেখে হাত।”

“দূরের আকাশ নীল থেকে লাল
গল্পটা পুরোনো,
ডুবে ডুবে ভালোবাসি
তুমি না বাসলেও আমি বাসি,
ডুবে ডুবে ভালোবাসি
তুমি না বাসলেও আমি বাসি।”

রাজদা গান শেষ করলে আমরা হাততালি দি। আমি বলি,

মৌমিতা: যাই বলো রাজদা, গরুর ডাকটা বেশ ভালোই ছিলো কিন্তু। (হেসে)

আমার টোন করায় রাজদা হেসে মাথা চুলকালো। এভাবেই গল্প করতে করতে আমাদের সময় কাটলো আর ভোর হয়ে এলো। আমরা সবাই নিজেদের জিনিসপত্র নিয়ে রেডি হতে লাগলাম। এন.জি.পি. ঢুকতেই বেশ ঠান্ডা লাগছে। কিছু সময় পর ট্রেইন থামলে আমরা সবাই এক এক করে নেমে পরি আর সাথে আসা স্যার ম্যাডামদের কথা মতো স্টেশনে অপেক্ষা করতে থাকি ট্রেন আসার। ট্রেইন আসার পর আমরা আবার ট্রেইনে উঠে বসে পরি আর প্রায় আট ঘণ্টা পর দার্জিলিং পৌঁছাই। তারপর স্যার, ম্যামদের কথা মতো হোটেলের উদ্দেশ্যে রওনা দিই। হোটেলে এসে ঠিক হয় একটা রুমে দুজন থাকবে তাই আমি আর কোয়েল একটা রুম নি আর ওদিকে আদিত্য আর রাজদা একটা রুম নেয়।

কোয়েল: রুমটা হেব্বি সুন্দর তাই না মৌ? আমার যা মনে হয় ব্যালকনি দিয়ে পাহাড় দেখা যাবে। (খুশি হয়ে)

মৌমিতা: কিন্তু এখন তো বিকেল হয়ে গেছে তাই চল ফ্রেশ হয়ে নিই। কালকে সকাল সকাল বেড়াবো।

কোয়েল: উহুহুহু!

কোয়েল ঠান্ডায় কাঁপার একটিং করলে আমি হেসে ফেলি সাথে ও’ও। আমরা ফ্রেশ হয়ে নিতেই আদিত্য আসেন আমাদের ঘরে আর বলেন,

আদিত্য: এখনই সাজিয়ে নে নিজেদের জিনিস কাবার্ডে। কিছুক্ষন পর টিফিন করে নিয়ে বাগানে বসবো সবাই।

মৌমিতা: আপনি বামটা নিয়ে যান। মাথা যন্ত্রনা করলে কাজে লাগবে।

আদিত্য: ব্ল্যাক কফি খেয়ে নিয়েছি আমি। তোমার কাছে রাখো আমার লাগলে নিয়ে যাবো। আমার কাছে থাকলে হারিয়ে যাবে।

মৌমিতা: ঠিক আছে।

আদিত্য চলে গেলে আমি কোয়েলের দিকে তাকালে দেখি ও আমার দিকে তাকিয়ে চোখ ছোট ছোট করে মুচকি হাসছে। আমি ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করি,

মৌমিতা: কি হয়েছে এভাবে তাকিয়ে আছিস কেন?

কোয়েল: প্রেম তো জমে ক্ষীর দেখছি। (বেডে শুয়ে)

মৌমিতা: হুহ!

আমি মুখ ঘুরিয়ে নিলে কোয়েল জোরে হেসে দেয় ফলে আমিও হেসে ফেলি। আমরা গল্প করতে থাকি ব্যালকনিতে গিয়ে। কোয়েল এখন বেশ স্বাভাবিক হয়েছে তাই জিজ্ঞেস করি….

‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️
||পর্ব~৪৪||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা

৬৫.
আমি মুখ ঘুরিয়ে নিলে কোয়েল জোরে হেসে দেয় ফলে আমিও হেসে ফেলি। আমরা গল্প করতে থাকি ব্যালকনিতে গিয়ে। কোয়েল এখন বেশ স্বাভাবিক হয়েছে তাই জিজ্ঞেস করি….

মৌমিতা: আচ্ছা রাজদা কোথায় থাকে? এতদিন হলো রাজদার সম্পর্কে কিছুই জানতে পারলাম না। খুব কম কথা বলেন উনি সবার সাথে, এমন কেন?

কোয়েল আমার প্রশ্ন শুনে সামান্য হেসে চুপ করে রইলো। কিছুক্ষণ পর বললো,

কোয়েল: রাজের কেউ নেই আদিত্যদা ছাড়া, আমার জানা মতে।

মৌমিতা: মানে? (অবাক হয়ে)

কোয়েল: হ্যাঁ। ও অনাথ আশ্রমে মানুষ। জ্ঞান হওয়ার পরে ও, অনাথ আশ্রমটি যে চালান তাঁকেই বাবা ভাবতো। উনি রাজকে বলেননি প্রথমে যে ওর বাবা-মা নেই। রাজের পড়াশোনায় আগ্রহ ছিলো বলে উনি নিজের খরচায় রাজকে স্কুলে ভর্তি করেন। রাজ স্কুলে আসলে প্রথম প্রথম চুপচাপই থাকতো, যেমনটা তুই বললি খুব কম কথা বলে।

মৌমিতা: তাহলে ওনার সাথে পরিচয় কীভাবে?

কোয়েল: বলছি। আদিত্যদাও খুব একা থাকতে ভালোবাসতো ছোটো থেকে। মনের মতো বন্ধু নাহলে কথা বলতো না। একদিন রাজ স্কুলের মাঠে একপাশে চুপ করে বসে ছিলো। তখন কিছু সিনিয়ররা ওর দিকে বল ছুঁড়ে মারে। রাজ কিছু না বলে বল ফিরিয়ে দিয়ে চলে যেতে নিলে ওকে ধাক্কা মেরে ওরা ফেলে দেয়। তখন আদিত্যদা এসে ওকে তুলতেই ওরা আদিত্যদাকে দেখে কোনো কথা না বাড়িয়েই কেটে পরে। আগাগোড়াই আদিত্যদাকে সবাই খুব মেনে চলে কারণ আদিত্যদার রাগটা সাংঘাতিক। এরপর রাজ আদিত্যদাকে থ্যাংক ইউ বলে ক্লাসে চলে যায়। সেদিন রাজের গায়ে নাকি প্রচুর জ্বর ছিলো তবুও সে এসেছিল পড়া বোঝার জন্য কারণ কিছুদিন পর থেকে পরীক্ষা ছিলো আর ওর কোনো টিচার ছিলো না যে ওকে পড়া বোঝাবে। আদিত্যদা রাজকে ধরে তোলার সময় সেটা বুঝতে পেরেছিল। তখন তো বোঝেনি ওটা জ্বর, বুঝেছিল গাটা ভীষণ গরম।

মৌমিতা: তারপর?

কোয়েল: তারপরের দিন রাজ যখন নিজের মতো করে বেঞ্চে বসেছিলো টিফিন টাইমে তখন আদিত্যদা রাজের পাশে গিয়ে বসে আর নিজের টিফিন এগিয়ে দিয়ে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দেয়। রাজ প্রথমে চুপ করে থাকলেও পরে তা স্বীকার করে। রাজ টিফিন আনতো না, ওর কোনো টিচারও ছিলো না কারণ অনাথ আশ্রমটা যে চালাতো তার স্ত্রী রাজকে পছন্দ করতেন না। তাই সে স্কুলে ভর্তি করে দিলেও এইসব দিকগুলো অতটাও দেখতে পারতো না। এক বছর ওভাবেই চলে যায়, রাজ আর আদিত্যদা যখন ফাইভে ওঠে তখন আদিত্যদা জোর করে রাজের সাথে ছুটির সময় ওকে ছাড়তে যায়। সেদিনই জানতে পারে রাজ অনাথ আশ্রমে মানুষ। সেটা দেখার পর আদিত্যদা আর কথা না বলে চলে আসে নিজের বাড়ি।

মৌমিতা: উনি নিশ্চই কিছু একটা ভেবে রেখেছিলেন রাজদার জন্য, তাই না?

কোয়েল: (হেসে) হম। আঙ্কেলের সাথে কথা বলে রাজকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসে আদিত্যদা। আঙ্কেল অনাথ আশ্রমের মালিকের সাথে কথা বলতেই উনি রাজি হয়ে যান। আঙ্কেল তো রাজকে দত্তক নিতে চেয়েছিলেন কিন্তু অনাথ আশ্রমের মালিকটা ওনাকে বলে যে এটা রাজকে জিজ্ঞেস করে করা উচিত কারণ ওর বাবার পদবী ও এতদিন ব্যবহার করেছে।

মৌমিতা: মানে? রাজদার বাবা মায়ের খোঁজ উনি জানতেন?

কোয়েল: হ্যাঁ। আসল ঘটনা এখানেই! সেইদিন আঙ্কেলকে উনি জানান যে রাজ ওনার বন্ধুর ছেলে। রাজের মায়ের যেদিন লেবার পেইন উঠেছিল সেদিন রাজের বাবা ওনাকে দেখতে হসপিটালে যাওয়ার সময় গাড়ি একসিডেন্ট করেন। ওনাকে হসপিটালে ভর্তি করলে উনি বলেন যে রাজকে আর ওনার স্ত্রী কে জানো ওনার বন্ধু একটু দেখে রাখেন এবং তারপরেই মারা যান। রাজের বাবার একসিডেন্ট এর খবর রাজের মাকে দেওয়া হয়নি যাতে উনি কোনো শোক না পান। কিন্ত শেষ রক্ষা করা যায়নি রাজের জন্মের পরেই রাজের মা মারা যান আর রাজকে অনাথ আশ্রমে নিয়ে আসেন।

মৌমিতা: কে এই অনাথ আশ্রমের মালিক?

কোয়েল: সৌভিকদার বাবা।

মৌমিতা: কি? (অবাক হয়ে)

কোয়েল: হ্যাঁ। সুরেশ আঙ্কেল! এই কারণেই সৌভিকদা রাজকে পছন্দ করে না একদম।

মৌমিতা: তুই এগুলো কীভাবে জানলি?

কোয়েল: আদিত্যদাই বলেছে যখন বড়ো হয়েছি। রাজ নিজেও জানে পুরো বিষয়টা। ও যখন জানতে পেরেছে তখনই বলে দিয়েছে নিজের বাবার পদবী পরিবর্তন করবে না। রাজ আদিত্যদার বাড়িতে চলে এলে রাজের বই খাতা সব কিছুই আঙ্কেল কিনে দিতো। নিজের ছেলের মতোই ভালোবাসেন রাজকে আঙ্কেল আন্টি আর আদিত্যদা ভাইয়ের মতো। কি না করেছে আদিত্যদা ওর জন্যে ছোটো থেকে? এর প্রতিদান হিসেবে ও কি করলো? হুট করেই কাওকে কিছু না জানিয়ে চলে গেলো। (রেগে)

মৌমিতা: তুই তো বলেছিলি আদিত্যর থেকে তোর খোঁজ নিতো রাজদা। তাহলে উনি কি সব জানতেন?

কোয়েল: আমি জানি না। আমি কিছুই বুঝতে পারি না, কিছুতেই হিসেব মেলাতে পারি না এই বিষয়ে। রাজ যখন একটু বড় হয় মানে এইটে ওঠে, তখন থেকেই টিউশনি শুরু করে আর নিজের বইখাতার খরচ নিজে চালাতে থাকে। যেদিন থেকে বুঝতে শিখেছে, জ্ঞান হয়েছে এসব বিষয়ে সেদিন থেকেই ও আদিত্যদার হেল্প ছাড়া চলার চেষ্টা করতে শুরু করে। হয়তো ওর এটাই মনে হয় যে আদিত্যদা ওকে দয়া করছে সেইজন্যেই হয়তো অকৃতজ্ঞের মতো চলে গেছিলো। ভালোবাসাটা কখনো বোঝার চেষ্টা করেনি। (রেগে মুখ ফিরিয়ে)

মৌমিতা: কোয়েল প্লিজ! এভাবে না জেনে আজে বাজে কথা বলিস না। যদি উনি অকৃতজ্ঞই হতেন তাহলে ফিরে আসতেন না কোনদিনও। হতেই তো পারে উনি বাধ্য হয়েছেন কাওকে কিছু না জানাতে? পরিস্থিতির কারণে আমরা অনেক সময় নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু কাজ করতে বাধ্য হই। এক্ষেত্রেও হয়তো সেটাই আর এমনটাই যদি হয়ে থাকে তাহলে পরে তুই নিজেকে ক্ষমা করতে পারবি তো? (কোয়েলকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে)

কোয়েল: (মৌমিতাকে জড়িয়ে ধরে) তাহলে ও কেন এভাবে ছেড়ে চলে গেছিলো বল? ওর ধারণা নেই আমি কতটা কষ্ট পেয়েছি এই চারটে বছর। এখন যখন ফিরে এসেছে তখনও কিছুই বলছে না। ও যতদিন আমাকে সত্যিটা না জানাচ্ছে ততদিন আমি ওকে একসেপ্ট করবো না।

আমি কোয়েলের কথা শুনে ওকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

মৌমিতা: একসেপ্ট করবি না মানে? রাজদা তোকে প্রপোজ করেছে?

কোয়েল: হ্যাঁ। ট্রেইনে…

মৌমিতা: যখন রাজদার কাছে গেছিলি ওঠার সময় তাই তো?

কোয়েল: (হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লো)

মৌমিতা: দেখ, নিজের মনের কথাটা যখন জানিয়েছে তখন সব সত্যিটাও ঠিক জানাবে। হয়তো শুধু সময়ের অপেক্ষা করছে, সঠিক সময়ের। এসব নিয়ে মন খারাপ না করে ঘরে আয়।

আমি কোয়েলকে একটু একা থাকতে দিয়ে ঘরে চলে এলাম। ওর নিজেকে একটু সময় দেওয়ার প্রয়োজন এখন।

কোয়েল: (মনে মনে– ও তো আজকে বললো যে ও বাধ্য ছিলো আর আগে বলেছিল সময় আসলে ও সবটাই জানাবে। শুধু অপেক্ষা করতে সময়ের কিন্তু এর কত অপেক্ষা করবো আমি? আর কত?)

কোয়েল ঘরে চলে আসে কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকার পর। কোয়েল ঘরে আসার কিছুক্ষণ পরেই আদিত্য বলেন যে টিফিন করে নিতে। আমরা টিফিন করতে এলে দেখি রাজদা নেই। আদিত্যকে জিজ্ঞেস করতেই উনি বলেন,

আদিত্য: জানি না। খাবে না বললো দ্যান বাগানে বসবো বললাম তখনও না করে দিলো। কি জানি কি হয়েছে আমি আর কোনো কথাই বলবো না ওর সাথে।

আদিত্য রেগে চলে গেলে আমি কোয়েলের দিকে তাকাই আর কোয়েল একটি নিশ্বাস ফেলে রাজদার ঘরের দিকে চলে যায়।

‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️
||পর্ব~৪৫||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা

৬৬.
কোয়েল রাজদের ঘরে এসে দেখে রাজ চুপচাপ বসে আছে সোফায়। কোয়েলের বিষয়টা বেশ আজব লাগে, মনে প্রশ্ন আসে এভাবে কে রাজ বসে আছে? কোয়েল এগিয়ে গিয়ে রাজের পাশে বসে জিজ্ঞেস করে,

কোয়েল: টিফিনের জন্য নীচে যাওনি কেন?

রাজ: এমনি, ভালো লাগছে না কিছু খেতে।

কোয়েল: সকাল থেকে সিগারেট ছাড়া তেমন কিছুই খাওনি তুমি আমি খুব ভালো ভাবেই জানি। সেই গত বিকেল থেকে দেখছি সিগারেটের পর সিগারেট খেয়ে চলেছো ঠিকভাবে কোনো খাওয়ার খাচ্ছো না। চলো কিছু একটু খেয়ে নেবে চলো।

কথাটা বলে কোয়েল রাজের হাত ধরে উঠে যেতে নিলে রাজ কোয়েলের হাতটা শক্ত করে ধরে নিজের জায়গাতেই বসে থাকে। কোয়েল রাজের দিকে তাকালে রাজ ইশারায় কোয়েলকে বসতে বলে।

রাজ: আমি ভাবিইনি তুই আসবি আমাকে ডাকতে।

কোয়েল: কি হয়েছে? কি নিয়ে চিন্তা করছো তুমি এত?

রাজ একটু অবাক হয় কোয়েলের প্রশ্নে সেটা বুঝতে পেরে কোয়েল বলে,

কোয়েল: এত অবাক হবার কিছু নেই। তোমার মুখ দেখলে যে কেউ বুঝে যাবে কিছু একটা হয়েছে।

রাজ: (মুচকি হেসে) যে কেউ না! যে ভালোবাসে সেই বুঝেছে আর আজীবন বুঝবে।

রাজের কথা শুনে কোয়েল মুখ ফিরিয়ে নিলে রাজ বেশ চিন্তিত সুরে বলে,

রাজ: বউদি আর তুই অলওয়েজ একসাথে থাকবি ওকেই?

কোয়েল: (রাজের দিকে বড়ো চোখ করে তাকিয়ে) পরেশবাবু আবার কিছু প্ল্যান করছে নাকি জিয়া? ওহ ওরা দুজন তো একই।

রাজ: আমার কেমন জানো মনে হচ্ছে শুধু ওরা দুজন না আরো কেউ আছে। (মনে মনে– আমি খুব ভালো ভাবেই জানি কে আছে। কিন্তু আমি সেটা তোমাকে জানাতে পারবো না, আদিকে তো না’ই। জানি না কি হতে চলেছে আর যেটা হতে চলেছে সেটা কীভাবে সামাল দেবো সেটাও বুঝতে পারছি না।)

কোয়েল: কাকে সন্দেহ করছো তুমি? সৌভিকদা?

রাজ ভ্রু কুঁচকে তাকায় কোয়েলের দিকে আর কিছু একটা ভেবে কোয়েলকে বলে,

রাজ: জিয়া আসার পর থেকে সৌভিকের সাথেই রয়েছে প্লাস ও ক্ষমাও চেয়েছে। এখন তো আমি সিওর কিছু একটা প্ল্যানিং জিয়া করছে, খুব সাবধান।

কোয়েল: মৌ নিজেই পুরো বিষয়টা সম্পর্ক ফলো করেছে আর আমাকে কিছুক্ষণ আগে জানালো। জিয়া যখন ক্ষমা চেয়েছে খটকাটা তখনই লেগেছে মৌয়ের তাছাড়া বাদ বাকি পুরোটা সময় জিয়া ওদের নজরে নজরে রেখেছিলো।

রাজ: হম, বুঝতে পেরেছি। কথাটা আদিও জানে।

কোয়েল: আদিত্যদা তোমার উপর রেগে আছে।

রাজ: (সামান্য হেসে) জানি কিন্তু বিশ্বাস কর আমার কিচ্ছু খেতে ইচ্ছা করছে না। আসলে আমি ঠিক করে ঘুমাতে পারিনি তাই খেতে মন চাইছে না। এটা অলওয়েজ হয় আমার সাথে।

কোয়েল: তাই বলে কিচ্ছু খাবে না?

রাজ: খেয়ে নেবো। ভাবছি এখন তো সবে সন্ধ্যে সাতটা। আমি নাহয় রাতে সবার সাথে ডিনার করতে যাবো নীচে।

কোয়েল: ঠিক আছে তাহলে তুমি রেস্ট নাও।

রাজ: হম, ভীষণ টায়ার্ড লাগছে।

কোয়েল উঠবে তখনই রাজ কোয়েলের হাতটা শক্তকরে ধরলো আবার। কোয়েল রাজের চোখের দিকে তাকালেই রাজ নিচের দিকে তাকিয়ে বলে,

রাজ: খুব বড় কিছু একটা হতে চলেছে। (কোয়েলের দিকে তাকিয়ে) আমাদের সবাইকে সব কিছুর জন্য সব দিক থেকে প্রিপেয়ার থাকতে হবে।

কোয়েল ঘাবড়ে গেলো কথাটা শুনে যা কোয়েলের চোখে মুখে প্রকাশ পাচ্ছে।

রাজ: আমাদের সবাইকে একে অপরের প্রতি বিশ্বাস রেখে চলতে হবে, এক থাকতে হবে। যাতে কোনো কিছুই আমাদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টি করতে না পারে, আমাদের আলাদা করতে না পারে।

কোয়েল শুধু হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়ে। রাজ একটা নিশ্বাস ফেলে উঠে যায় আর কোয়েলও বেরিয়ে নিচে চলে আসে।

মৌমিতা: কি রে? রাজদা এলো না?

কোয়েল প্রথম থেকে সবটা বললে মৌমিতাও চুপ করে যায়।

কোয়েল: আদিত্যদাকে সবটা জানাতে হবে মৌ।

মৌমিতা: আমি জানিয়ে দেবো। তাছাড়া রাজদা তো আছেনই। আমি যাচ্ছি ওনাকে ঘুরতে যাওয়ার বিষয়টা বলতে।

আমি কোয়েলকে বলে চলে আসি ওনাকে বলতে। উনি সবটা শুনে রাজদার উপর আর রাগ করে থাকতে পারেননি। সবাই টিফিন সেরে নিলে উনি আমাকে আশপাশটা একটু ঘুরে দেখতে বলেন আর আমি বেরোই। কোয়েল ঘরে আমাদের জিনিসপত্র গোছগাছ করছে। আমাদের গেস্ট হাউসটা বেশ সুন্দর জায়গায়। গেস্ট হাউস থেকে বেরিয়ে কিছুটা হাঁটলেই রাস্তা যেখান দিয়ে গাড়ি চলাচল করছে। অন্ধকার হয়ে এলেও স্ট্রীট লাইট থাকার কারণে সব দেখা যাচ্ছে। আমি রাস্তার উপর উঠে রেলিংয়ের কাছে আসি। আশেপাশে গাছ থাকলেও উপর থেকে নীচে দেখলেই কেমন ভয় লাগছে, বেশ গভীর খাদটা। আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর ঘুরে গেস্ট হাউসের দিকে ঘুরতে নিলেই দেখি একটা বাচ্চা বল নিয়ে খেলছে। হুট করে বলটা হাত ফসকে মাঝ রাস্তায় চলে গেলে বাচ্চাটি ওই বলের কাছে চলে যায়। খেয়াল করে না ওর পিছনে বড়ো একটা গাড়ি আসছে।
.
.
.
আদিত্য: মৌমিতাআআ!!

মৌমিতা বাচ্চাটাকে রাস্তার মাঝখানে দেখেই ছুট লাগায়। জোরে দৌঁড়ে গিয়ে সাথে সাথে বাচ্চাটাকে জড়িয়ে ধরে ওইপাশে পরে যায় কিন্তু বাচ্চাটা কোলে থাকায় বাচ্চাটার গায়ে আঁচও লাগেনি। মৌমিতা যখন বাচ্চাটাকে বাঁচানোর জন্য দৌঁড়ে যায় তখন সে সময় আদিত্যও সেখানে উপস্থিত হয় মৌমিতাকে খুঁজতে খুঁজতে। মৌমিতাকে ওভাবে পরে যেতে দেখে আদিত্যও পরি কি মরি করে ছুটে চলে যায় মৌমিতার কাছে। চোখের নিমিষে পুরো ঘটনাটা ঘটে যায়। ইতিমধ্যে লোক জড়ো হয়ে গেছে মৌমিতার আশেপাশে। মৌমিতা বাচ্চাটাকে ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়াতে নিলে দাঁড়াতে পারে না। ততক্ষনে বাচ্চাটিকে তাঁর মা-বাবা কোলে নিয়ে নিয়েছে।

আদিত্য: ঠিক আছো তুমি? কোথায় লেগেছে দেখাও আমাকে।

মৌমিতা: আপনি এখানে কি করছেন? আমি ঠিক আছি।

আদিত্য: একদম চুপ! হাত দেখাও।

উনি হুট করেই ভিড়ের মাঝ থেকে বেরিয়ে এসে আমার পাশে এসে বসলে আমি অবাক হয়ে যাই। আমাকে ধমক দিয়ে চুপ করিয়ে দিয়ে উনি আমার হাতটা আলতো করে টেনে নিয়ে দেখেন কুনুইটা ছোঁড়ে গেছে বাজে ভাবে। হালকা ক্রিম কালারের চুড়িদারের প্যান্টটা হাঁটুর কাছে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। যার ফলে কোনো সন্দেহ নেই হাঁটুতেও কেটে গেছে। আদিত্য এসব দেখে আমার দিকে একটা রাগী লুক দেন। আমি কিছু বলতে গিয়েও না বলে চুপচাপ মাথা নীচু করেনি।

__ওনাকে পাশে একটু নিয়ে এসে বসান, আমরা জল আনছি।

আদিত্য: দরকার নেই। এখান থেকে একটুখানি আমাদের গেস্ট হাউস। চলে যেতে পারবো। থ্যাংক ইউ!

__থ্যাংক ইউ তো আমাদের বলা উচিত। উনি আজকে না থাকলে আমার ছেলেটার যে কি হতো। অনেক ধন্যবাদ।

মৌমিতা: না না, ধন্যবাদ দিয়ে ছোটো করবেন না প্লিজ। আমি ঠিক…

আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই আদিত্য আমাকে কোলে তুলে নিলেন। সবাই আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে এই দেখে ওনাকে কিছু বলতে যাবো কিন্তু সাহস পেলাম না। উনি হাঁটা ধরলেন আমাকে নিয়ে গেস্ট হাউসের দিকে তাই আমিও আলতো করে ওনার গলাটা জড়িয়ে ধরলাম। এইবার বেশ জ্বালা জ্বালা করছে কাঁটা জায়গাগুলো।

মৌমিতা: নামিয়ে দিন এখানে আমাকে নাহলে ভার্সিটির সবাই খারাপ ভাববে।

অনেক সাহস নিয়ে কথাটা বলেই ফেললাম কিন্তু উনি আমার কথার কর্ণপাত না করেই এগিয়ে যাচ্ছেন। আমার একদম ভালো লাগছে না ব্যাপারটা। ওখানে সবার মাঝে জিয়া আছে, ও যদি এমনটা দেখে তাহলে কি মেনে নেবে? এমনিতেই আসার সময় থেকে আমি ওকে লক্ষ্য করেছি কিন্তু এটা ওনাকে বোঝাই কীভাবে এখন?

মৌমিতা: আপনি আমার কথাটা শুনুন, এরকম করবেন না। জিয়া দেখলে…

কথা বলতে বলতে সামনে তাকাতেই দেখি গেস্ট হাউসের গেটের কাছে জিয়া আর সৌভিকদা দাঁড়িয়ে আছেন। যেটার ভয় ছিলো সেটাই হয়ে গেলো। উনি আমাকে নিয়ে ভিতরে ঢুকে বাইরে বসার সোফাতে বসাতেই স্যার ম্যাডামরা সবাই এগিয়ে এলেন।

আদিত্য: স্যার! ম্যাম! প্লিজ ডক্টরকে কল করুন।

মৌমিতা: সামান্য কেটে যাওয়ার জন্য ডক্টর লাগবে…না মানে একটু ছোঁড়েই তো গ..গেছে তাই।

উনি এত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন যে আমি কথা বলার মাঝেই আটকে গেছিলাম তারপর যেকোনো প্রকারে কথাটা শেষ করলাম।

কোয়েল: কি করে হলো এসব?

আদিত্য: কথা পরে হবে আগে ওর ট্রিটমেন্ট করতে হবে। ভালোই রক্ত বের হচ্ছে। তুই মেডিসিন নিয়ে…ছাড় আমিই আনছি।

আদিত্য নিজেই ছুটলো মেডিসিন আনতে। সত্যি বলতে গেলে ছোঁড়ে যায়নি, কেটেই গেছে অনেকটা। সারা শরীর কেমন জানো ব্যাথা করতে শুরু হয়েছে ক্ষত জায়গাগুলোর সাথে সাথে। আদিত্য কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে আমার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লেন। সযত্নে আমার ক্ষত জায়গাটা পরিষ্কার করে উনি আমার হাতের কুনুইটা ব্যান্ডেজ করে দিতে দিতে কোয়েলকে বললেন,

আদিত্য: আমি ওকে ঘরে দিয়ে আসছি ডক্টরকে কল করে। তুই ওর হাঁটুটা পরিষ্কার করে দ..দিস।

কথাটা বলেই আদিত্য বেরিয়ে গেলেন। ওনার চোখে জল! আমি কি ঠিক দেখলাম? হ্যাঁ, ঠিকই দেখেছি কারণ কোয়েলকে কথাটা বলতে গিয়ে ওনার গলা স্বর কেঁপে গেছিলো। উনি আমার এই অবস্থা দেখে যেভাবে পাগলামি করলেন সবার সামনে, কাওকে কিছু করার সুযোগ পর্যন্ত দিলেন না এইসব জিয়া দেখেছে দূর থেকে দাঁড়িয়ে তা আমি দেখতে পেয়েছি। আদিত্য উঠে দাঁড়াতেই ও সরে গেছে।

কোয়েল: এইবার কিন্তু সবাই ব্যাপারটা লক্ষ্য করলো মৌ। আদিত্যদা তোর প্রতি যে কতটা কনসার্ন এটা সবার চোখে পরেছে সেই আসার সময় থেকে। (মুখ টিপে হেসে)

মৌমিতা: এটা ভালো বিষয় নয় কোয়েল। জিয়াও পুরো ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছে, আমার কিছু ঠিক লাগছে না। (চিন্তার সুরে)

কোয়েল কিছু বলার আগেই আদিত্য আমার সামনে এসে আমাকে দাঁড়ানোর সুযোগ না দিয়ে নিজেই আমার দিকে ঝুঁকে আমাকে কোলে তুলে নেন।

আদিত্য: ডক্টর আসছেন আমি রিসেপশনে বলে দিয়েছি তুই তাড়াতাড়ি ঘরে আয় কোয়েল, প্লিজ।

আদিত্য ঘরে এসে আমাকে বেডে বসিয়ে চলে যেতে নিলে আমি ওনার হাত ধরে জিজ্ঞেস করি,

মৌমিতা: আপনি আমার উপর রেগে আছেন?

আদিত্য: সেই অধিকার আমার নেই।

ওনার কথাটা শুনে আমার খারাপ লাগলো। উনি চলে যেতে নিলে আমি বেড থেকে নামার জন্য পা ভাঁজ করতেই ব্যাথায় কুঁকিয়ে উঠলাম। আদিত্য তা দেখতে পেয়ে জোরে ধমক দিয়ে উঠলেন,

আদিত্য: নামতে বলেছি তোমাকে আমি?

উনি এতটাই জোরে, রেগে কথাটা বলেছেন যে আমি কেঁপে উঠেছি। নিজের অজান্তেই চোখে জল চলে এসেছে। ছলছল চোখে ওনার দিকে তাকালেই উনি কেমন জানো দমে যান। চোখ বন্ধ করে মুখ অন্যদিকে ফিরিয়ে নেন কিছুক্ষণের জন্য। তারপর বলেন,

আদিত্য: ডক্টর দেখে যাওয়ার পর আমি কথা বলবো তোমার সাথে। কোয়েল আসার আগে নড়বে না এক পা।

ঝড়ের গতিতে বেরিয়ে গেলেন! কি সাংঘাতিক পরিমাণ রেগে আছেন তা আমি ভালোই টের পেলাম। এখন! ব্যাপারটা মেনে নেওয়া অস্বাভাবিক নয়। কারণ উনি এই কয়েকদিনে প্রতিটা মুহূর্তে আমাকে বুঝিয়েছেন উনি আমাকে ভালোবাসেন। আজকে আমার সাথে ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনাটা আমাকে সাহায্য করলো ওনার ভালোবাসায় বিশ্বাস আনতে। ওনার জায়গায় আমি থাকলেও এমন রিয়াক্ট করতাম কারণ হারিয়ে যাওয়ার ভয়! আমাকে হারিয়ে ফেলার ভয়েই কি রেগে আছেন উনি?

কোয়েল: মৌ! আস্তে আস্তে আমাকে ধরে ওঠ। তোর হাঁটুটা ভালোই কেটেছে কারণ চুড়িদারের প্যান্টটা দেখ, লাল হয়ে গেছে জায়গাটা জুড়ে। আদিত্যদা খুব বকবে তাড়াতাড়ি ব্যান্ডেজ না করলে। কি রে? মুখটা এমন শুকনো কেন? ব্যাথা পেয়েছিস সেইজন্য নাকি বর বকেছে কোনটা?

কোয়েলের কথা শুনে কেঁদেই ফেললাম। কোয়েল সেই দেখে জড়িয়ে ধরলে পুরো ঘটনাটা ওকে খুলে বলি।

কোয়েল: স্বাভাবিক আদিত্যদার রাগ করাটা। কিন্তু তুইও তো ভুল কিছু করিসনি।

মৌমিতা: ওনাকে কে বুঝাবে এটা?

কোয়েল: তুই! আবার কে? এখন চল ওয়াশরুমে।

কোয়েল আমাকে ধরে ধরে ওয়াশরুমে নিয়ে গেলো। পায়ের পাতাতেও চোট লেগেছে তাই হাঁটতে সমস্যা হচ্ছে। ইশ, ডক্টর বাবু জানো এমন একটা ওষুধ দেয় যাতে আমি এক নিমিষে ফিট হয়ে যাই আর কালকে ঘুরতে বেরোতে পারি।

৬৭.
আদিত্য ঘরে এসে ব্যালকনিতে চলে যায় চুপচাপ কারণ ঘরে রাজ ঘুমাচ্ছে। কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনার কিছুই জানেনা সে। আদিত্যও এর রাজকে ডাকেনি কারণ মৌমিতার কাছ থেকে সবটাই শুনেছে সে। আদিত্য ব্যালকনিতে একভাবে বাইরের দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ আগের ব্যবহারের কথাটা মনে পরলো যেটা মৌমিতার সাথে করেছে। সাথে সাথেই আদিত্য নিজের ডানহাতের দুটো আঙুল দু-চোখের কোণে চেপে ধরে চোখ বন্ধ করে নিলো। চোখ বন্ধ করতে ভেসে উঠলো সেই দৃশ্য যেখানে মৌমিতা একটুখানির জন্য বেঁচে গেছে গাড়ির সামনে পরতে পরতে। এক মুহূর্তের জন্য আদিত্যের পুরো পৃথিবীটা সেই সময় যেমন থমকে গেছিলো।এখনও ঘটনাটা মনে করতে তার ব্যতিক্রম হলো না। আদিত্য চোখ খুলে জোরে একটা নিশ্বাস নিলো উপরের দিকে মুখ করে।

রাজ: কি হয়েছে? এতো টেন্সড লাগছে কেন তোকে?

আদিত্য কাঁধে হাতের স্পর্শ পেয়ে পিছন ফিরে রাজের দিকে তাকালো। রাজের প্রশ্ন শুনে তার উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলো,

আদিত্য: তুই উঠে পরলি কেন? সবে তো ঘুমাতে গেছিলি।

রাজ: সেটা নিয়ে চাপ নেই আমি এখন গিয়ে শুলে আবার ঘুমিয়ে পরবো। ঘুমটা ভাঙতেই দেখলাম তুই এখানে। কি হয়েছে?

আদিত্য নীচের দিকে তাকিয়ে আস্তে করে বললো,

আদিত্য: আজ আমি সারাজীবনের মতো মৌকে হারিয়ে ফেলতে বসে ছিলাম।

রাজ জানো ভুলে গেলো কেমন রিয়াকট করা উচিত কথাটা শুনে। কিছুক্ষণ আগেই তো সে সাবধান করেছিল কোয়েলকে আর এখনই এমন কথা বলছে আদিত্য? কি এমন হয়ে গেলো কিছু সময়ের মধ্যে? ভাবছে রাজ।

রাজ: কি হয়েছে তুই আমাকে খুলে বল।

আদিত্য প্রথম থেকে সবটা বললে রাজ একটু স্বস্তি পায়। সে ভেবেছিলো হয়তো জিয়া কিছু করেছে কিন্তু সেটা নয়। দুর্ভাগ্যবশত একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। আদিত্যকে আপসেট দেখে রাজ আদিত্যকে জড়িয়ে ধরে। সাথে সাথেই আদিত্য রাজকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কাঁপা কণ্ঠে বলে,

আদিত্য: আরেকটু হলেই আমি ওকে হ..হারিয়ে ফেলতাম। বিষয়টা মনে পরলেই আমার বুকের ভিতরটা ম..মোচড় দিয়ে উঠছে।

রাজ: তুই বউদির কাছে যা এখন। ডক্টর এসে গেছে মে বি, কি বলছে দেখ। আর বউদিই বা কি করতো? চোখের সামনে একটা বাচ্চাকে মরতে দিতে তো পারতো না তাই না? (আদিত্যকে সোজা করে বুঝিয়ে বললো)

আদিত্য: আমি জানি ওর কোনো দোষ নেই কিন্তু আমি নিজের মনকে বোঝাতে পারছি না। আমি ওকে নিজের মনের কথাটাও ঠিক ভাবে জানিয়ে উঠতে পারলাম না আর এখনই ওকে হারিয়ে ফেলতে বসেছিলাম আমি। মরে যাবো ইয়ার ওর কিছু হলে আমি!(ছলছল চোখে)

রাজ: তোকে আমি বললাম তো এসব কথা ভাবা বন্ধ করে আর বউদির কাছে যা। বউদির সাথে সময় কাটালে দেখবি তোর এই ভয়টা কেটে যাবে। সব ঠিক আছে আদি, সামলা নিজেকে।

আদিত্যের চোখে জল দেখে রাজের খারাপ লাগলেও একটু ভালোও লাগছে কারণ আদিত্য কাওকে এতটা পরিমাণ ভালোবাসবে এটা ধারণার বাইরে ছিল রাজের। রাজ বোঝানোর পরে আদিত্য বললো,

আদিত্য: তুই গিয়ে ঘুমা, আমি যাচ্ছি।

রাজ: রাগ করে চিল্লাস না জানো আর।

আদিত্য হ্যাঁ বোধক মাথা নেড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে রাজ গিয়ে বেডে বসে পিছন দিকে মাথা হেলিয়ে চোখ বন্ধ করে নেয়, তখনই….

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে