‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️
||পর্ব~৪০||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা
৬০.
আদিত্য: ওঠো, আর কতক্ষন দাঁড়িয়ে থাকবে?
মৌমিতা: আপনারা মাথাটা না পুরোপুরি খারাপ হয়ে গেছেন জানেন তো? (বিরক্ত হয়ে)
আদিত্য: হ্যাঁ, তোমার জন্যেই। (আনমনে)
মৌমিতা: কি?
আদিত্য: আরে এতক্ষন দাঁড় করিয়ে রেখেছো আমার মাথা ব্যাথাটা বেড়ে পাগল হয়ে যাচ্ছি। (কথা ঘুরিয়ে)
মৌমিতা: হুহ!
বাংলো থেকে বেরোতেই দেখি কোয়েল দাঁড়িয়ে আছে আদিত্যের সাথে। আদিত্য গাড়িতে আমাদের লাগেজ তুলছে। আমি ওখানে গিয়ে দাঁড়াতেই কোয়েল আমাকে চোখ টিপ দিয়ে গাড়িতে উঠে যায় আর আদিত্য ড্রাইভারকে বেরিয়ে যেতে বলে। আমি আদিত্যকে কিছু জিজ্ঞেস করতে গেলেই উনি আমাকে ইশারা করেন ওনার বাইকের দিকে। এই কান্ড দেখে আমি অবাক। গাড়ি থাকতে বাইক কেন? উনি বাইকে উঠলেও আমি মুখে বিরক্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি।
আদিত্য: আসবে নাকি আমি চলে যাবো? আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না।
আমি আর কিছু না বলে বাইকে উঠে বসলাম। আমরা বসতেই দেখলাম মা আর হরি কাকা দরজায় এসে দাঁড়িয়েছেন। আমি ওদের হাত দেখাতেই আদিত্য বাইকে স্টার্ট দেন। কিছুটা যেতেই আমি জিজ্ঞেস করি,
মৌমিতা: এটা ঠিক হচ্ছে না। ভার্সিটিতে পৌঁছলে সবাই যদি আমাদের একসাথে দেখে তো কি ভাববে?
আদিত্য: এক্ষুনি যদি এই বলো তাহলে পরে কি করবে? আর ভার্সিটির সবাই কি ভাববে না ভাববে সেটা আমি বুঝে নেবো।
মৌমিতা: (মনে মনে– সত্যি মাথাটা কি খারাপ হয়ে গেলো নাকি? আমার তো এবার নিজেরই ভয় লাগছে। কি করবেন উনি আবার?)
একটা শুকনো ঢোঁক গিলে ওনার কাঁধটা শক্ত করে ধরে বসলাম। না জানি কি করবেন। ধুর! মা কালকে রাত্রে ওনাকে কথাগুলো না বললেই পারতেন। কেমন জানো মনে হচ্ছে কিছু একটা ভয়ানক হতে চলেছে। ভার্সিটি পৌঁছনোর একটু আগে দেখলাম একটা বড়ো ভলভো বাস দাঁড়িয়ে আছে। সেটাকে ক্রস করে আমরা ভার্সিটিতে ঢুকছি সে সময় সবাই আমার দিকে হা করে তাকিয়ে আছে, ঠিক যেমনটা হবে আমি ভেবেছিলাম। আদিত্য বাইক থামালে আমি নেমেই অন্যদিকে হাঁটা দিতে গেলে আদিত্য আমার হাত ধরে আটকে রাখেন।
আদিত্য: কোয়েল! (জোরে)
আদিত্যের কথা শুনে কোয়েল ছুটে চলে এলো। কোয়েল আসতেই উনি আমার হাত ছেড়ে দিলেন।
কোয়েল: বলো।
আদিত্য: তুই এখানেই ওর সাথে থাক। আমি আসছি।
আদিত্য চলে যাবেন এমন সময় কোয়েল আমতা আমতা করে আদিত্যকে জিজ্ঞেস করেন,
কোয়েল: শোনো না! একটা কথা ছিলো।
আদিত্য: বল, জলদি।
কোয়েল: আব, রাজ কোথায়?
আদিত্য: (শান্ত ভাবে) ও মনে হয় যাবে না।
কোয়েল: কি? (উত্তেজিত হয়ে)
আদিত্য: তাই তো মনে হয়। যাওয়ার হলে তো আমাদের সাথেই আসতো কারণ ও তো আমার বাংলোতেই থাকে।
মৌমিতা: হ্যাঁ, রাজদা তো ছুটিতেও বাংলোতে ছিলেন না। কেন তুই জানিস না?
কোয়েল: আমি কি করে জানবো? আমাকে তো ও কিছুই জানায় না। (মাথা নিচু করে)
আদিত্য: মে বি ওর অফিসের কাজ পরে গেছে। আমি আসছি ওকেই?
আদিত্য আমাকে কোয়েলকে সামলানোর ইশারা করে দৌঁড়ে চলে গেলো ওদিকে। কোয়েল চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলে আমি ওর কাঁধে হাত রাখি। হাত রাখতেই কোয়েল আমার দিকে হেসে জিজ্ঞেস করলো,
কোয়েল: তারপর, ছুটি কেমন কাটালি?
মৌমিতা: ভালো। অনেকদিন পর বাবা-মার সাথে সময় কাটালাম। তাছাড়া উনিও তো ছিলেন প্রথমদিন আর নিয়ে আসার দিন। (লাজুক হেসে)
কোয়েল: ওওওও, তা তোর তো বলা উচিত খুউউব ভালো কেটেছে। (টোন কেটে)
মৌমিতা: চুপ কর তো। খালি বেশি বোঝে। এইবার বল, তোর কেসটা কি?
কোয়েল: আ..আমার আবার কিসের কেস?
মৌমিতা: রাজদার খবর তুই জানিস না?
কোয়েল: আমাকে না জানালে কি করে জানবো?
মৌমিতা: জানার চেষ্টা করেছিস?
কোয়েল: (তাচ্ছিল্য হেসে) রোজ একবার করে ফোন করেছি আর সেটার রিপ্লাই এসেছে, “আই অ্যাম বিজি রাইট নাও, আই উইল কল ইউ ব্যাক লেটার!” সেই কল ব্যাকটা আর আসেনি আমার কাছে এখনও অবধি। হাহ! ছাড় এসব আর চল বাসের দিকে।
কোয়েল আমাকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ওদিকে চলে গেলে আমি ছুটে ওকে ধরে বলি,
মৌমিতা: কোনো বিপদ হয়নি তো? (চিন্তিত ভাবে)
কোয়েল: এটা আমিও প্রথমে ভেবেছিলাম কিন্তু যে কলের রিপ্লাই করতে পারে, আচ্ছা মানলাম সেটা অন্য কেউও করতে পারে কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় যে অনলাইনে থাকতে পারে তার কি বা বিপদ হবে? বললাম তো বাদ দে এসব।
আমি বুঝলাম কোয়েলের মনটা খারাপ তাই আর রাজদার প্রসঙ্গ তুলে কথা না বাড়ানোটাই ভালো। কিন্তু রাজদা কাজটা মোটেও ঠিক করলো না। একবার আদিত্যের সাথে কথা বলবো? উনিও তো রাজদার প্রসঙ্গটা এড়িয়েই গেছেন গতকাল থেকে। হয়তো উনিও রেগে আছেন রাজদার উপর। কি করবো বুঝতে না পেরে কোয়েলের সাথে গিয়ে দাঁড়ালাম। আদিত্য ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন বাসে সবাইকে তুলতে। বাসে করে আগে হাওড়া যাবো তারপর সেখান থেকে ট্রেন।
কোয়েল: এই মৌ? তোর ড্রেসটা তো হেব্বি সুন্দর। কবে কিনলি?
মৌমিতা: আমি কিনিনি, আজকে সকালে আদিত্য পরতে বললেন। (লাজুক ভাবে)
কোয়েল: আচ্ছাআআ! এইবার বুঝেছি। বউয়ের দিকে অন্য ছেলেরা তাকাবে সেটা সহ্য হচ্ছে না আদিত্যদার। কিন্তু লাভ নেই বউ সুন্দরী হলে ছেলেরা তো তাকাবেই। হিহিহিহি!
কোয়েলের কথা শুনে দিলাম কোয়েলের বাহুর মধ্যে একটা চাপড় আর ও আরো জোরে হাসতে লাগলো। ধীরে ধীরে সবাই বাসে উঠে যাচ্ছে দেখে আমি আর কোয়েলও সেদিকে এগোলাম। রাজদা এখনও আসেননি, সব কিছু আদিত্য একাই সামলাচ্ছেন। তাহলে হয়তো সত্যি রাজদা আসবেন না। কথাটা ভেবে কোয়েলের জন্য খারাপ লাগলো। আমরা বাসের কাছে আসতেই দেখলাম আদিত্য নিজের বাইকে বসে ফোন ঘাটছেন কারণ লাগেজ তোলা হয়ে গেছে এবার যে যার মতো বসে উঠছে। এই ফাঁকে ওনার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন জিয়া। আমি আর কোয়েল একে অপরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগলাম ব্যাপারটা দেখে।
কোয়েল: আজকে ফার্স্ট টাইম আদিত্যদা নিজের বাইকে কোনো মেয়েকে বসিয়ে ভার্সিটি এনেছে। জিয়াকেও কোনোদিন বসতে দেয়নি এই কারণেই মনে হয় ও গেছে। খাবে ঝার দেখিস। (রেগে)
মৌমিতা: (মনে মনে– এই সময় কোনো সিনক্রিয়েট জানো না করেন উনি। ভার্সিটিতে সবাই দেখবে এই জন্যেই আমি বলেছিলাম আসবো না তাও শুনলেন না আমার কথা। অবশ্য বাকি সবার মতো কোয়েলেরও মনে হচ্ছে আমি আদিত্যের বাইকে প্রথম উঠলাম কিন্তু তা তো নয়।) চল একবার এগিয়ে দেখি ওদিকে। কোনোরকম সিনক্রিয়েট করলে ঘুরতে যাওয়ার মুড খারাপ হবে।
আমরা আদিত্যের দিকে এগিয়ে যেতেই আদিত্য আমার দিকে তাকালো আর হুট করেই আমার হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মেরে নিজের কাছে টেনে নিলেন। আমি তো পুরোই অবাক ওনার কাজকর্মে। উনি আমার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে জিয়াকে বললেন,
আদিত্য: তুই স্যরি চাইতে এসেছিস তাই না? আমাকে নয় মৌমিতাকে স্যরি বল। ও ক্ষমা করলে ক্ষমা পাবি নাহলে নয়।
আদিত্যের কথায় বুঝলাম জিয়া ক্ষমা চাইতে এসেছে কিন্তু এই ব্যাপারটা আমার ঠিক হজম হলো না। খটকা লাগছে, জিয়া ক্ষমা চাইতে এসেছে?
জিয়া: আ..আই অ্যাম স্যরি।
মৌমিতা: ইটস ওকে।
আদিত্য: সো জিয়া, তুই ক্ষমা পেয়ে গেছিস মানে এই না যে তুই যা খুশি তাই করবি। এটা তোর লাস্ট চান্স। ওকেই? যা এবার বাসে যা।
জিয়া কিছুক্ষণ আমাদের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে নেয় আর আদিত্য আমাকে বলেন,
আদিত্য: মৌমিতা বসো।
মৌমিতা: বসব মানে? বাইকে বসে কি করবো বাসে যাবার কথা তো।
আদিত্য: হ্যাঁ সেটা বাকি সবার ক্ষেত্রে। তোমার ক্ষেত্রে শুধু বাইক আর ট্রেইন। বুঝেছো?
কোয়েল: তার মানে তোরা দুজন বাইকে হাওড়া স্টেশন যাবি? ওয়াও! (হাততালি দিয়ে) এই মৌ জলদি উঠে পর, আমি বাসে গেলাম।
মৌমিতা: কিন…
আমি কিছু বলবো তার আগেই কোয়েল ঘুরে বাসের দিকে এক পা এগোতেই আচমকা থেমে গেলো কারণ ওর সামনে হুট করেই একটা বাইক এসে থামে। বাইকে বসে থাকা ব্যক্তি নিজের ফুল ব্ল্যাক হেলমেট টা খুলতেই আমরা অবাক, রাজদা?
রাজ: হলো গাইজ! সবাই বাসে উঠেছে তো? (বাসের দিকে ঘুরে, জোরে)
বাস থেকে জোরে আওয়াজ আসে যে “হ্যাঁ”। রাজদা হেসে কোয়েলের দিকে তাকিয়ে বলে,
রাজদা: তো ম্যাডাম? আপনিও আপনার বান্ধবীর মতো জলদি বসে পরুন। (বাঁকা হেসে)
আমি তো বেশ খুশি রাজদাকে দেখে কিন্তু কোয়েল কোনো উত্তর দিচ্ছে না দেখে আমি ভাবলাম কোয়েলকে ডাকবো। কারণ আমার কেমন জানো মনে হচ্ছে ও বেঁকে বসবে, এত সহজে মানবে না। আমার ভাবতে দেরী হলো কিন্তু কোয়েলের বলতে দেরী হলো না।
কোয়েল: জিয়া! (জিয়ার দিকে ঘুরলো) আমি জানি তুই বাইক রাইড খুব পছন্দ করিস। আদিত্যদার সাথে বাইক রাইডে যেতে পারিসনি তো কি হয়েছে রাজ আছে তো? তুই ওর সাথে চলে যা। আমি বরং অঙ্কিতের সাথে চলে যাবো বাসে। আমি চাইলেই অঙ্কিত আমাকে বাইকে নিয়ে যেতে পারে কিন্তু আমি বাসেই যাবো। হম? (হেসে) মৌ, আদিত্যদা আমি আসছি।
এই বলে কোয়েল রাজদার বাইক কাটিয়ে বাসের দিকে চলে যেতে নেয় কিন্তু বাইকটা পুরোপুরি পাশ কাটানোর আগেই রাজদা কোয়েলের হাত ধরে টেনে নিজের সামনে নিয়ে আসে আর কোমর জড়িয়ে ধরে বলে,
রাজ: বাইকটা আমার তাই আমি ডিসাইড করবো কে আমার বাইকে বসবে আর কে না। তোকে আমি বাইকে বসতে বলেছি, চুপচাপ বাইকে বস নাহলে…
রাজদার চোয়াল শক্ত হয়ে গেছে কোয়েলের কথাগুলো শুনে। কোয়েল মাথা তুলে করে কোনো কথা না বাড়িয়ে সবার দিকে একবার তাকিয়ে চুপচাপ বাইকে উঠে বসে। রাজদা নিজের বাইকের হ্যান্ডেলে ঝোলানো একটা প্যাকেট নিজের হাতে নিয়ে ওটা থেকে একটা স্টাইলিশ টুপি বার করে আর পিছন দিকে কোয়েলকে দিয়ে বলে,
রাজ: পর এটা।
কোয়েল টুপিটা নিয়ে পরে নেয়। যেহেতু কোয়েল হাইনেক মেরুন টি-শার্ট আর ব্ল্যাক হিপ্ট-আপ জিন্স পড়েছে তাই বেশ মানিয়েছে ওর সাথে টুপিটা।
রাজ: আদি, বাস এখন ছাড়বি না।
আদিত্য: কেন? ম্যাডামের সাথে কথা বলে এসেছিস?
রাজ: হ্যাঁ, ম্যাডাম আসছেন। একটু ওয়েট কর। আমরা আসছি।
রাজদা কথাটা বলেই কোয়েলকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। কোয়েলদের যেতে দেখে আমি হাসলাম তারপর আদিত্যকে জিজ্ঞেস করলাম,
মৌমিতা: আপনি জানতেন তাই না রাজদা আসবেন?
আদিত্য: না। আমি সত্যিই জানতাম না। আমাকে রাজ একদিন আগে জানিয়েছিল যে ও মে বি আসতে পারবে না ওর অফিসের কাজের জন্য। ওর আসা না আসার কোনো সিওরিটি ছিলো না। হোয়াটএভার এসে যখন গেছে তখন আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। তুমি স্কার্ফটা সাথে রেখেছো নাকি ব্যাগ থেকে নিয়ে আসবো কোনটা?
মৌমিতা: না, না। আমার হ্যান্ড ব্যাগেই আছে আনতে হবে না।
আদিত্য: গুড।
মৌমিতা: বাইকে যাওয়ার কি দরকার ছিল আপনার মাথা যন্ত্রণাটা কমে যেতো বাসে রেস্ট নিলে।
আদিত্য: তোমার হাতে জাদু আছে। তোমার হাতের ছোঁয়া পেয়ে মাথা যন্ত্রনা ফুরুত হয়ে গেছে ঠিক যেমন রাজ কোয়েল পাখিকে নিয়ে ফুরুত হয়ে গেলো। (চোখ টিপ দিয়ে)
আমি হেসে ফেললাম ওনার কথা শুনে, উনি হাসলেন। আমি এখন বুঝতে পারছি ওনার বাইক নিয়ে আসার কারণ। এর মাঝেই প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডাম আর আমার শ্বশুর মশাই এসে উপস্থিত হলেন আর আদিত্য আমাকে বলে ওনাদের সাথে কথা বলতে গেলেন।
অন্যদিকে,
কোয়েল আর রাজ সেই ওদের পুরোনো চায়ের দোকানের থেকে চা খাচ্ছে। কোয়েল চুপচাপ মুখ গম্ভীর করে অন্যদিকে তাকিয়ে আছে। রাজ ওর পাশে দাঁড়িয়ে চায়ে চুমুক দিয়ে বললো,
রাজ: গত দুদিন সারারাত অফিসে ছিলাম। অফিসেই চেঞ্জ করে নিয়েছি ওয়াশরুমে গিয়ে তাই আসতে একটু লেট হয়ে গেছে। স্যরি!
কোয়েল কোনো উত্তর দিলো না। নিজের চা শেষ হতেই ভাঁড়টা ফেলে দিয়ে ঘুরে যেতে নিলেই রাজ নিজের চায়ের ভাঁড়টা ফেলে দিয়ে কোয়েলের হাত ধরে নিজের দিকে নিয়ে আসে। কোয়েল তাও তাকাচ্ছে না রাজের দিকে। রাজ কোয়েলের দু-গালে হাত রেখে নিজের দিকে ফেরালে দেখে ঠিক যেমন সে ভেবেছিল, কোয়েলের ছিল ছলছল করছে। রাজ একটা নিশ্বাস নিয়ে কোয়েলকে বোঝানোর চেষ্টা করে,
রাজ: আই নো আমি তোকে কল ব্যাক করিনি, কোনো মেসেজ করিনি বাট তাও সোশ্যাল মিডিয়ায় অনলাইন ছিলাম বাট ট্রাস্ট মি আমি জাস্ট আমাদের কলিগদের সাথে কথা বলছিলাম। এছাড়া কিছুই না, এতটাই প্রেসার ছিল আমার উপর যে কাওর সাথে কথা বলতে পারিনি। আদিকে জাস্ট জানিয়েছিলাম মে বি আমি যেতে পারবো না। সাত দিনের কাজ দুদিনে কমপ্লিট করাটা আমার একার পক্ষে খুব টাফ হয়ে গেছিলো। নিশ্বাস নেওয়ার সময় পাচ্ছিলাম না আমি বাট শুধুমাত্র তোর কথা ভেবে সবটা কমপ্লিট করেছি। প্লিজ রাগ করে থাকিস না, তুই ভালো ভাবে জানিস আমি মিথ্যে বলি না।
কোয়েল: এত কাজের প্রেসার ছিল? ঘুমাওনি তুমি দু-রাত? (চিন্তিত হয়ে)
রাজ: নাহ। অফিসে একটু ব্রেক নিয়েছিলাম দু থেকে চার ঘন্টার জন্য কজ মাথা যন্ত্রনা উঠে যেত।
কোয়েল: তার মানে দুদিনে জাস্ট আট ঘণ্টা তাও অফিসে? এরপরেও তুমি এতটা রাস্তা বাইকে যেতে চাইলে কেন? বাসে গেলে তো ঘুমাতে পারতে। (একনাগাড়ে)
রাজ: কারণ আমি জানি একজন বাইক রাইড খুব পছন্দ করে। আর এও জানি সে আমার এই দুদিনের বিহেভিয়ারে খুব হার্ট হয়েছে। (হেসে)
কোয়েল: একদম না। তুমি বাসে চলো যেতে হবে না বাইকে।
রাজ: আমি ঠিক আছি। বাসে কেন যেতে চাইছিস অঙ্কিত আছে তাই? (ইচ্ছা করে)
কোয়েল: একদম মজা করবে না। বদ, জমরাজ একটা! (বাহুতে চাপড় মেরে)
রাজ: চল, দেরী হয়ে যাবে নাহলে এবার।
কোয়েল আর কথা না বাড়িয়ে বাইকের দিকে এগিয়ে যায় আর রাজ টাকা দিয়ে এসে বাইক স্টার্ট দেয়। বাসের কাছে পৌঁছাতেই দেখে প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডাম আর আদিত্যের বাবা আকাশবাবু সবার সাথে কথা বলছেন। ওরা গেলে ওদের সাথেও কথা বলে নেন তারপর সবাই বাসে উঠে গেলে বাসের দরজা বন্ধ করে আদিত্য আর রাজ বাইকে নিয়ে আগে যায় আর ওদের পিছনে ওদেরকে ফলো করে বাস ছাড়ে।
‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️
||পর্ব~৪১||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা
৬১.
মৌমিতা: আপনার মাথা যন্ত্রণাটা সত্যি কমেছে তো?
আদিত্য আমার কথার কোনো উত্তর দিলেন না। বেশ কিছুক্ষণ ধরে লক্ষ্য করছি উনি আমার সাথে কথা বলছেন না শুধু বাইকই চালিয়ে যাচ্ছেন। ব্যাপার কি? কিছু ভুল করেছি নাকি আমি? কি আবার ভুল করলাম? ধুর ছাই! রাজদা আর কোয়েল আমাদের পাশে পাশেই চলছে। কোয়েল আমার দিকে তাকিয়ে ইশারা করলো আদিত্যকে ধরতে, আমি সঙ্গে সঙ্গে না বোধক মাথা নাড়ালাম। কোয়েল ইশারায় বোঝালো আদিত্য রেগে আছেন।
মৌমিতা: (মনে মনে– তার মানে আমি ওনাকে ধরে বসছি না দেখে উনি কোনো কথা বলছেন না? কিন্তু আমি তো ওনার কাঁধ ধরে বসেছি, এর থেকে বেশি কিছু কি ঠিক হবে? যদিও এখন আমাদের সম্পর্কটা ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছে কিন্তু তবুও! আমি সাহস পাচ্ছি না।)
আমার ভাবনার মাঝেই উনি ব্রেক কষলেন। পাশে তাকিয়ে দেখলাম চায়ের দোকান। তারমানে সবাই হয়তো চা খাবে। আমি নামতেই দেখলাম আমাদের বাসও এসে দাঁড়ালো। উনি বাইক সাইড করে রেখে বাসের দিকে চলে গেলেন, আমাকে কিছু বলার সুযোগই দিলেন না। আমি অসহায় মুখ করে দাঁড়িয়ে থাকলে কোয়েল এসে আমার পাশে দাঁড়িয়ে বললো,
কোয়েল: কি হলো? এখন মুখ বেজার করে রেখে কোনো লাভ আছে? যখন বললাম ধরে বসতে তখন তো বসলি না।
মৌমিতা: ধরেই তো বসেছিলাম আর কীভাবে ধরে বসবো?
কোয়েল: জড়িয়ে ধরে বসবি। শান্তি? (রেগে বিরক্ত হয়ে)
মৌমিতা: ধুর! (লজ্জা পেয়ে) আমাকে যে এতো জ্ঞান দিচ্ছিস নিজে তো রাজদাকে ধরে বসিসনি। বাইকের পিছনের হ্যান্ডেল ধরে বসেছিলি মাঝে মধ্যে ধরছিলিস, সেই বেলা?
কোয়েল: আমাদের সম্পর্কের সাথে তোদের সম্পর্কের অযথা তুলনা করিস না গাধী। (মৌমিতার মাথায় মেরে)
মৌমিতা: আরে, উনি কি মনে করবেন যদি আমি ওনাকে ওভাবে ধরি? তাছাড়া এখনও আমাদের সম্পর্কটা ততোটাও স্বাভাবিক হয়নি যে ওনাকে জড়িয়ে ধরে বসবো।
কোয়েল: তো স্বাভাবিক কর। আরে বাবা, আদিত্যদা যে সবটা ঠিক করার চেষ্টা করছে এটা আমরা দুজনেই বুঝতে পারছি কিন্তু তুই তো এমন ভাব করছিস জানো তোর এসবে কোনো যায়ই আসে না। হলে হলো আর না হলে না হলো। এমনটা যদি চলতে থাকে তাহলে কি করে হবে মৌ? তুইও একটু কিছু করে বোঝানোর চেষ্টা কর যে তুইও চাস সবটা ঠিক করতে, আদিত্যদাকে একটা সুযোগ দিতে।
আদিত্য: তোরা কেউ কিছু খাবি না?
কোয়েল: না, আমি কিছু খাবো না।
আদিত্য আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করলেন না দেখে চুপ করেই রইলাম আর উনি চলে গেলেন। বেশ খারাপ লাগলো ওনার ব্যবহারে।
রাজ: কি খারাপ লাগছে তো? দেখো, তোমার যেমন খারাপ লাগছে ওর ব্যবহারে আদিরও কিন্তু তোমার ব্যবহারে খারাপ লাগছে। ওর এটা তো মনে হতেই পারে তুমি ওকে সুযোগ দিতে চাও না আর এটা যদি আদির মাথায় ঢুকে যায় তাহলে কিন্তু ও আবার দূরে সরে যাবে তোমার থেকে, সবকিছুর থেকে। ট্রাস্ট মি! অনেক কষ্টে ও আজ চেঞ্জ হয়েছে, এভাবে ওকে দূরে ঠেলে দিয়ো না।
কোয়েল: এটাই বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম ওকে এতক্ষণ। ও যদি কোনো রেসপন্স না করে তাহলে কি করে কিছু ঠিক হবে? মৌ! আদিত্যদা আসছে তুই কথা বল।
কোয়েল আর রাজদা সরে গেলেন তৎক্ষণাৎ। আমি ওনার দিকে তাকালে দেখলাম উনি আমার দিকে একটা কেকের প্যাকেট এগিয়ে দিলেন। আমি প্যাকেটটা হাতে নিতেই উনি চলে যেতে নেন আর আমি ওনার হাত ধরে বাঁধ সাধি। উনি আমার দিকে তাকালেও ওনার হাত না ছেড়েই ওনাকে জিজ্ঞেস করি,
মৌমিতা: কি হয়েছে আপনার?
আদিত্য: কই কিছু না তো। (অন্য দিকে তাকিয়ে)
মৌমিতা: কথা বলছেন না কেন তাহলে?
আদিত্য: বলছি তো।
মৌমিতা: সেই। চুপচাপ দাঁড়ান এখানে।
ওনাকে কথাটা বলে কেকের প্যাকেটটা খুলে এক টুকরো কেক ওনার মুখের সামনে ধরলে উনি আমার দিকে বড়ো চোখ করে তাকান।
মৌমিতা: তাকাচ্ছেন কি? এমনিতেই মাথা যন্ত্রনা তার মধ্যে এভাবে খালি পেটে থাকলে কি করে হবে? চুপচাপ খান।
আদিত্য আমার হাত থেকে কেকের টুকরোটা খেয়ে নিয়ে আমার মুখের সামনে এক টুকরো কেক ধরলে আমিও খেয়ে নিলাম। এরপর আদিত্য আবারও আগের মতো কথা বলা শুরু করলেন আর আমি ওনার দিকে তাকিয়ে ভাবতে লাগলাম,
মৌমিতা: (মনে মনে– কোয়েল আর রাজদা ঠিকই বলেছেন, চেষ্টাটা তো দুজনের দিক থেকেই হওয়া উচিত। মানছি উনি ভুল করেছেন কিন্তু মাশুল হিসেবে এতদিন চেষ্টাটাও তো একাই করেছেন। ফুলশয্যার রাত ছাড়া আর একদিনও আমার সাথে খারাপ ব্যবহার করেননি এটাও তো আমি অস্বীকার করতে পারিনা। এইবার আমারও উচিত সবটা ঠিক করে নেওয়া।)
আদিত্য: কি দেখছো এভাবে? (হেসে)
মৌমিতা: আপনাকে।
আমার কথা শুনে আদিত্যের ঠোঁটের হাসি আরো বেশি প্রসারিত হলো। আমিও হেসে বললাম,
মৌমিতা: আপনিই পারেন এভাবে মাথা যন্ত্রণা নিয়ে হাসি মুখে থাকতে। (হাত ব্যাগ থেকে বাম বার করে) দেখি এদিকে আসুন এটা একটু লাগিয়ে দি।
আদিত্য: এটা আবার কেন? (মাথা দূরে সরিয়ে)
মৌমিতা: কারণ আপনার আবার ওষুধ খাওয়াতে এলার্জি। কোথায় একটা ওষুধ খেয়ে নেবেন তা না। আসুন এদিকে, মাথা নামান আমার হাত যাচ্ছে না। লম্বু কোথাকার!
আদিত্য: ভাগ্যিস লম্বা হয়েছিলাম নাহলে তোমার কাছে নত হতাম কি করে? (মাথা নামিয়ে) ভুল যারই থাকুক আমি অলওয়েজ তোমার কাছে নত হতে রাজি।
মৌমিতা: ঠিক আছে তাহলে আমিও মানিয়ে নিতে রাজি।
আমার কথায় আদিত্য জানো বিষম খাবে এমন অবস্থা। উনি বিস্ফারিত চাহুনির সাথে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলে আমি হেসে ওনার কপালের দু-দিকটায় বামটা লাগিয়ে দেই।
মৌমিতা: নিন, যান এবার। সবাই ডাকছে আপনাকে।
আদিত্য আমার দিকে তাকিয়ে ঠোঁট কামড়ে একটা হাসি দিয়ে চলে গেলেন। সত্যি! কত সামান্য ব্যাপারে উনি খুশি হয়ে গেলেন। ওনার কথা ভেবে আমিও হেসে ফেললাম। আমি মাথা ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকালে দেখি কোয়েল আর রাজদা চা খাচ্ছে আর একে অপরকে কিছু একটা বোঝাচ্ছে। আদিত্য রাজদার নাম ধরে ডাকতেই রাজদা চলে যান আর কোয়েল আমাকে এসে জিজ্ঞেস করে,
কোয়েল: কি ব্যবস্থা হলো?
মৌমিতা: সব ঠিক। কিন্তু আমি অন্য একটা কথা ভাবছি।
কোয়েল: কি কথা?
কোয়েল আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেই আমি ওর দিকে তাকিয়ে রহস্যজনক হাসি দিলাম।
৬২.
আদিত্য: তুমি সত্যি বলছো? তুমি পারবে?
মৌমিতা: পারবো না বলে মনে হচ্ছে আপনার? আর না পারলে আপনি তো আছেন আমাকে শিখানোর জন্য। (বিনয়ী ভাবে)
রাজ: এই কিউট ফেসের পাল্লায় পরিস না ভাই। শেষমেশ ট্রেইন মিস করে যাবো। (চিন্তিত ভাবে)
মৌমিতা: রাজদা প্লিজ! গাড়ি চালাতে পারলে বাইক কেন চালাতে পারবো না? (করুন ভাবে)
রাজ: গাড়ি আর বাইক কি এক বৌদিমনি? আর তোমার ব্যাপারটা তাও বুঝলাম কিন্তু তোমার বান্ধবী? ওহ মাই গড! (মাথায় হাত দিয়ে) ও কখনো সাইকেল চালিয়েছে কি না সন্দেহ? ও বলছে বাইক চালাবে। আমি বাসে যাচ্ছি তোরা যা ভালো বুঝিস কর।
কোয়েল: আদিত্যদা তুমি রাজি তো?
আদিত্য: আজ্ঞে। ওর উপর আমার পুরো ভরসা আছে। তাছাড়া আর বেশি রাস্তা বাকিও নেই। এখানে দাঁড়ানোর তো কোনো প্ল্যান ছিলো না, এটুকু রাস্তায় কি বা দাঁড়াবো। নেহাত সবাই বায়না করলো চা খাবে তাই। আমার মনে হয় এটুকু রাস্তা ওরা ঠিক ম্যানেজ করে নিতে পারবে। (মৌমিতার দিকে তাকিয়ে)
কোয়েল: হিহি। (জোর করে হেসে) তুমি অঙ্কিতকে ডেকে দাও বরং! ও আমাকে কোম্পানি দিয়ে…
কোয়েলের কথা শেষ হওয়ার আগেই রাজদা ওর হাত ধরে টানতে টানতে বাইকের কাছে নিয়ে চলে গেলে আমি আর আদিত্য দুজনেই হেসে ফেললাম।
আদিত্য: পারেও বটে এই দুটো।
মৌমিতা: আমার মনে হচ্ছে কোয়েল কষ্ট পেলো।
আদিত্য: কেন?
মৌমিতা: একটু ভেবে দেখুন নিজের কথা বুঝে যাবেন।
আমি কথাটুকু বলে চলে এলাম কারণ আমি জানি উনি বুঝে যাবেন। বাইকের কাছে এসে পৌঁছাতেই দেখলাম কোয়েল একদিকে মুখ করেদাঁড়িয়েআছে তো রাজদা আরেকদিকে।
আদিত্য: বুঝেছি।
মৌমিতা: (পিছনে তাকিয়ে) জানতাম।
আমি বাইকে বসে পড়লাম নিজের কার্ডিগানের হাতাটা কুনুই অবধি গুটিয়ে। উনি আমাকে চাবিটা দিয়ে আমার পিছনে বসলেন। এই কথাটাই আমার মাথায় ঘুরছিল যেটা আমি কোয়েলকে বলতেই কোয়েল রাজি হয়ে যায় কারণ ওর ও আমার মতো ইচ্ছা ছিল বাইক চালানোর।
আদিত্য: (মৌমিতার কানে কানে) অল দ্য বেস্ট!
ওনার কথায় ঘোর কাটার সাথে সাথে শরীর দিয়ে একটাশিহরণ বয়ে গেলো। আমি বাইকে স্টার্ট দিয়ে কোয়েলের দিকে তাকালে কোয়েল আমাকে চোখের ইশারায় বোঝায় এগোতে। আমি স্টার্ট দিয়ে এগিয়ে যাই সঙ্গে সঙ্গে কারণ আমাদের বাস এগিয়ে গেছে। আদিত্য অঙ্কিতকে বলে দিয়েছেন যে ঠিক ভাবে রাস্তা দেখিয়ে বাসকে আগে নিয়ে যেতে কারণ আমাদের একটু দেরী হতে পারে।
মৌমিতা এগিয়ে যেতেই কোয়েল একটা জোরে নিশ্বাস নেয় আর নিজের হাতের আঙ্গুলগুলো একসাথে ফাটিয়ে নেয়। তারপর নিজের স্লীভসটা একটু টেনে নিয়ে বাইক স্টার্ট দেয়। কিছুটা যেতেই কোয়েল স্পীড বাড়াতে শুরু করে নিমিষে মৌমিতাদের ধরে ওদের পাশে চলে যায়।
আদিত্য: তুই এত তাড়াতাড়ি এলি কীভাবে? এতটা স্পীড কি ফাস্ট টাইম নেওয়া ঠিক কোয়েল?
আমি এটা শুনে কোয়েলের দিকে তাকাতেই ও ইশারা করে এগানোর অর্থাৎ বাসের আগে যেতে হবে। কারণ প্রথমেই আমরা বুঝেছিলাম ওরা আমাদের ভরসায় বাসকে রাখবে না, আগেই রাখবে। তাই তখনই ঠিক করে নিয়েছিলাম ঠিক ভাবে চালাতে পারলে বাসের আগে যাবো। কোয়েলের ইশারা পেতেই আমিও স্পীড নিলাম।
আদিত্য: আমি কি তোমাকে ধরে বসতে পারি? (কানে কানে)
আমি শুধু হেসে মাথা নাড়ালে উনি আমার কোমরে হাত রেখে আস্তে আস্তে আমার কার্ডিগানের পকেটে হাত ঢুকিয়ে বসলেন। আমরা বাসের আগে চলে গেলাম ঠিকঠাক ভাবে বাইক চালিয়ে। এগিয়ে যেতেই আদিত্য হাত দেখিয়ে ড্রাইভার কে ইশারা করতেই বাস আমাদের পিছু পিছু আসতে লাগলো। এবার হয়তো অঙ্কিত নিজের সিটে চলে যাবে।
আদিত্য: রাজের হোস উড়ে গেছে, বেচারা। (হেসে)
আমিও হাসলাম আদিত্যের কথায় কারণ কোয়েল আমাদের আগে রয়েছে।
রাজ: একটু স্লো করো, ওরা আসুক।
কোয়েল: ধরে বসতে পারো ভয় লাগলে।
রাজ: যে আমাকে ধরে বসেনি আমার তাকে ধরে বসার অধিকার নেই।
কোয়েল বুঝলো আদিত্যের মতো রাজও গাল ফুলিয়েছে কিন্তু সেটা কাওকে বুঝতে দেয়নি, মনেই রেখেছে। তাই কোয়েল বললো,
কোয়েল: ঠিক আছে, আমি অধিকার দিলাম। এবার ধরে বসো কারণ মৌও এসে গেছে।
আমি আর কোয়েল দুজন এক স্পীডে বাইক চালিয়ে শিয়ালদহ স্টেশনের কাছে এসে এক সাইডে দাঁড়ালাম। বাস শিয়ালদহ স্টেশন থেকে দূরে দাঁড়িয়েছে। সবাই নেমে হেঁটে চলে আসবে স্টেশন অবধি। আদিত্য নিজের ঘড়ি দেখে বললো,
আদিত্য: গুড জব গাইজ! আমি ভাবতেই পারছি না এটা তোমাদের ফাস্ট টাইম!
আমি আর কোয়েল আদিত্যের কথা শুনে একে অপরকে চোখ টিপ দিয়ে মুচকি হাসলাম। রাজদা যে এতে বেশ অবাক হয়েছে তা বোঝাই যাচ্ছে। সত্যি তো, যেই মেয়ে কি না সাইকেল চালানো জানতো না সে বাইক চালাচ্ছে তাও যারা বাইক চালাতে জানে তাঁদেরই মত এতে অবাক তো হবেই। আমরা বাইক রেখে বাস যেখানে দাঁড়িয়েছে সেদিকে এগিয়ে যাই, আমরা আমাদের বাসকে দেখতে পেলে আদিত্য অঙ্কিতকে কল করে বলে দেয় সবাই জানো নামা শুরু করে ধীরে সুস্থে। স্টেশনে এসে ট্রেনে সবাই ঠিকঠাক করে যখন বসছে তখন আমি আদিত্যকে জিজ্ঞেস করলাম,
মৌমিতা: বাইকগুলোর কি হবে?
আদিত্য: এখানে আমার মাসির বাড়ি সো আমার দুই ভাই এসে যাবে আর পাঁচ মিনিটের মধ্যে। ওরা নিয়ে যাবে ওদের বাড়ি। আসছি আমি, কোথাও যাবে না এখন এখান থেকে।
আদিত্য চলে গেলে আমি দাঁড়িয়ে থাকি আর আমার নজর পরে জিয়ার উপর। আমি তাকাতেই ও চোখ সরিয়ে অন্যদিকে চলে গেলো। জিয়া বেশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতেই তাকিয়ে ছিল আমার দিকে তখনও এর এখনও। তখন বলতে, যখন আমি ওনাকে খাওয়াচ্ছিলাম আর বাম লাগিয়ে দিচ্ছিলাম। আমি কিছুতেই মানতে পারছি না জিয়া মন থেকে স্যরি চেয়েছে, এটা কোনো নতুন ষড়যন্ত্র না তো?
রাজ: কোয়েল আমি বলছিলাম যে…
কোয়েল: তুমি আমাকে যখন ফেলে রেখে গেছিলে তখনের কোয়েলের সাথে এখনের কোয়েলের অনেক তফাৎ আছে। তখনের কোয়েল রাজকে ছাড়া কিচ্ছু বুঝতো না কিন্তু এখনের কোয়েল রাজকে ছাড়াই সব কিছু পারে। তোমার আর আমার মাঝে তোমার দিক থেকে থাকা আমার প্রতি অবিশ্বাসটা হয়তো কোনোদিনও মিটবে না।
কোয়েল তাচ্ছিল্য হেসে মৌমিতার কাছে চলে গেলে রাজের চোখ ছলছল করে ওঠে।
রাজ: আমি তখন শুধুমাত্র মজা করছিলাম, আমি ভাবিনি তোমার এতে খারাপ লাগবে। আমি তোমাকে কখনোই অবিশ্বাস করিনি। আমি জানি তুমি অঙ্কিতের বিষয়টা নিয়েই কথা বলছো। তুমি অবিশ্বাসটা দেখলে তাঁর পিছনে আমার ভালোবাসাটা দেখলে না। বুঝলে না আমি তোমাকে অবিশ্বাস করি না, আমি তোমার পাশে অন্য কাওকে সহ্য করতে পারি না তাই এমন বিহেভ করি।
রাজ নিজের চোখের কোণের জলটা মুছে নেয় আর বাসের কাছে চলে যায় যেখানে আদিত্য সব একা সামলাচ্ছে।
‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️
||পর্ব~৪২||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা
৬৩.
আদিত্য সবাই উঠেছে কি না, ঠিকঠাক ভাবে বসেছে কি না দেখছিল সে সময় ওর ফোন বেজে ওঠে। ফোনটা দেখে ও রাজকে বলে,
আদিত্য: রাজ?
রাজ: হ্যাঁ বল।
আদিত্য: তুই এদিকটা একটু সামলেনে, আমি আসছি।
রাজ: কোথায় যাচ্ছিস?
আদিত্য: আরে ওই বাইকগুলো ভাইরা নিয়ে যাবে, ওরা এসে পরেছে তাই কল করেছিলো আমাকে।
রাজ: আচ্ছা আমি দেখে নিচ্ছি, তাড়াতাড়ি আসবি তিরিশ মিনিটের মধ্যে ট্রেইন ছাড়বে।
আদিত্য মাথা নেড়ে চলে গেলে রাজ মাথা ঘুরায় আর কোয়েলকেদেখতে পায়। মৌমিতা কথা বললেও কোয়েল তেমন একটা কথা বলছে না চুপচাপ বসে আছে। রাজ ওদিকে এগিয়ে গেলে কোয়েল হঠাৎ মাথা তুলতেই চোখে চোখ পরে যায়। রাজকে এগিয়ে আসতে দেখে কোয়েল সাথে সাথে উঠে পিছন দিকে চলে যায়।
রাজ: তোমরা নিজেদের জিনিস দেখে নিয়েছো তো?
মৌমিতা: হ্যাঁ, সব ঠিক আছে।
রাজ: কোয়েল কোথায় গেলো?
মৌমিতা: হুট করেই চলে গেলো কিছু না বলে। ট্রেইনে ওঠার পর থেকে দেখছি কেমন চুপচাপ।
রাজ: আমি দেখছি।
রাজদা কথাটা বলেই চলে গেলেন কোয়েল যেদিকে গেছে সেদিকে। আমি জানতাম কিছু না কিছু একটা হতে চলেছে। আশা করছি রাজদা ঠিক মানিয়ে নেবেন কোয়েলকে। কিন্তু আদিত্য কোথায় গেলেন? একটা ফোন করবো? নাহ থাক ব্যস্ত আছেন হয়তো। ঠিক সময়ে চলে আসবেন।
অন্যদিকে,
কোয়েল চুপচাপ ট্রেইন থেকে নেমে ফাঁকা একটা জায়গা দেখে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একমনে লোকেদের যাওয়া আসার ব্যস্ততা দেখছে। রাজ কোয়েলের পিছনে দাঁড়িয়ে আস্তে করে বললো,
রাজ: আই অ্যাম স্যরি কুহু!
কোয়েল কিছুটা কেঁপে উঠলো রাজের কথাটা শুনে। শরীর দিয়ে যে শিহরণ কোয়েলের বয়ে গেছে তা রাজকে টের পেতে না দিয়ে চুপচাপ একভাবেই দাঁড়িয়ে রইলো।
রাজ: আমি তখন তোমার সাথে মজা করছিলাম, আমি ভাবিনি তুমি হার্ট হবে। প্লিজ, ক্ষমা করে দাও। তুমি এভাবে মন খারাপ করে থাকলে আমার ভালো লাগে না। আর লাগবেই বা কি করে যেখানে আমার জন্যেই তুমি মন খারাপ করে আছো। কুহু…
কোয়েল তৎক্ষণাৎ রাজের দিকে ঘুরে রাজকে থামিয়ে বললো,
কোয়েল: আমাকে এই নামে ডাকা বন্ধ করো রাজ। তোমার কি মনে হয় তুমি এতদিন পর হুট করে এসে আমাকে এই নামে ডাকবে আর আমি সেটা মেনে নেবো? তুমি আমাকে এই নামে ডাকার অধিকারটা তখনই হারিয়ে ফেলেছো যখন কোনো কিছু বলার প্রয়োজন না মনে করেই চলে গেছিলে। রইলো বাকি আজকের কথা, হাহ! সে তো তুমি প্রথম থেকেই আমাকে শুধু হার্ট করে এসেছো, কষ্ট দিয়ে এসেছো। এটা আর কি এমন নতুন কথা? তোমার কথায় মন খারাপ করে আমার সময় নষ্ট করার কোনো ইচ্ছাই নেই। কে তুমি যে তোমার কথায় আমি মন খারাপ করে থাকবো? তুমি থাকো আর না থাকো এতে এখন আর আমার কিছুই যায় আসে না।
মৌমিতা: কোয়েল বলছিলাম…
আমি আদিত্যকে ফোনে না পেয়ে বাধ্য হয়ে রাজদাদের কাছে এলে দেখি রাজদা চুপচাপ মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কোয়েল আমাকে দেখে শুধু বললো,
কোয়েল: ট্রেইনে চল, ট্রেইন ছাড়বে কিছুক্ষণের মধ্যে।
মৌমিতা: আসলে আমি সে জন্যই এসেছি। আদিত্যকে ফোনে পাচ্ছি না, ট্রেইন ছাড়ার তো সময় হয়ে গেছে। আপনি কি একটু দে…
রাজ: হ্যাঁ আমি দেখছি।
রাজদা মাথা নিচু করে কোনোরকমে উত্তরটা দিয়ে চলে গেলেন। আমি কোয়েলের দিকে তাকাতেই কোয়েলও চলে গেলো ট্রেইনে। আমি আর কি করবো দাঁড়িয়ে থেকে এই ভেবে চলে গেলাম কোয়েলের পিছু পিছু।
মৌমিতা: এই কোয়েল? কি হয়েছে বল তো?
কোয়েল: কি হবে? কিছু না তো।
মৌমিতা: মিথ্যে বলিস না আমায়।
কোয়েল: কিছুই হয়নি মৌ। এত বেশি ভাবিস না এই নিয়ে। আদিত্যদা কে আরেকবার ফো… ওই তো আদিত্যদা!
আমি কোয়েলের কথা শুনে পিছন ফিরে দেখলাম আদিত্য আসছেন আমাদের দিকে। আদিত্য আমাদের সামনে এসে দাঁড়াতেই আমি রেগে বললাম,
মৌমিতা: কোথায় ছিলেন আপনি এতক্ষন? জানেন না ট্রেইন ছাড়ার সময় হয়ে গেছে? ট্রেইন ছেড়ে দিলে কি হতো হ্যাঁ? ফোনটাও ধরছিলেন না, চিন্তা হয় না নাকি? এতটা দায়িত্বজ্ঞানহীন কি করে হতে পারেন আপনি? (একনাগাড়ে)
আদিত্য: রিল্যাক্স মৌমিতা! আমি আমার ভাইদের সাথে কথা বলছিলাম তাই জন্যে কল রিসিভ করতে পারিনি। আ’ম স্যরি ফর দ্যাট বাট তুমি এতটা হাইপার কেন হয়ে যাচ্ছো? (মৌমিতাকে শান্ত করে)
ওনার কথা শুনে আমি চুপ করে যাই। সত্যিই তো, একটু বেশিই উত্তেজিত হয়ে পরেছিলাম আমি। এইবার নিজেরই লজ্জা লাগছে।
আদিত্য: আচ্ছা রাজ কোথায়? (এদিক ওদিক দেখে)
কোয়েল: রাজ তো তোমাকেই খুঁজতে গেলো মৌয়ের কথা শুনে। দেখা হয়নি ওর সাথে তোমার? (চিন্তিত সুরে)
আদিত্য: হ্যাঁ ও আমাকে জাস্ট বললো মৌমিতা চিন্তা করছে তাই তাড়াতাড়ি যেতে আর তোকে এই প্যাকেটটা দিতে বললো।
কোয়েল আদিত্যের হাত থেকে প্যাকেটটা নীচে দেখলো ওর সকালে পরা স্টাইলিশ টুপিটা যেটা ও কিছুক্ষণ আগে রাগের বশে ফেলে দিয়েছিল। সাথে ওর ফেভারিট চকলেট কেকের দুটো প্যাকেট রয়েছে আর কয়েক প্যাকেট চিপস। কোয়েল জিনিসগুলো দেখে সঙ্গে সঙ্গে আদিত্যকে বললো,
কোয়েল: রাজকে খুঁজে নিয়ে এসো আদিত্যদা প্লিজ!
আদিত্য: হ্যাঁ কিন্তু…
আদিত্যের কথা শেষ হওয়ার আগেই আমার নড়ে উঠলাম কারণ ট্রেইন ছেড়ে দিলো। আদিত্য সাথে সাথে নিজের পকেট থেকে ফোন বার করে রাজদা কে কল দিতে দিতে ট্রেইনের দরজার সামনে চলে গেলেন। আমরা ওনার পিছু পিছু গেলে উনি বলেন,
আদিত্য: রাজ ফোন ধরছে না। শিট! আমরা তো স্টেশন ক্রস করে যাচ্ছি।
আদিত্যের কথা শেষ হতে না হতেই আমরা স্টেশন ক্রস করে ফেললাম। আমি কোয়েলের দিকে তাকাতেই কোয়েল ভিতরে চলে গেলো। আদিত্য আমাকে বললো,
আদিত্য: রাজ হয়তো ইচ্ছা করেই ট্রেইনে উঠল না। ওদের মধ্যে নিশ্চই কিছু হয়েছে যার জন্য রাজের মন ভালো ছিলো না। আমার সাথে কথা বলার সময়েই আমি সেটা বুঝেছি।
মৌমিতা: আমি তো আপনাকে বলেছিলাম কিছু একটা হতে চলেছে ওদের মধ্যে। সেই থেকে কোয়েলও চুপচাপ ভীষণ। কি হবে এবার? রাজদা এটা ঠিক করলো না।
আমি আর আদিত্য ভিতরে আসতেই দেখলাম কোয়েল চুপচাপ প্যাকেটটা হাতে নিয়ে রাস্তার মাঝেই দাঁড়িয়ে আছে।
মৌমিতা: কোয়েল এভাবে দাঁড়িয়ে থাকিস না রাস্তার মাঝে। সিটে বসে পর, এখন তো কিছু করার নেই বল?
আমার কথা শুনে কোয়েল প্যাকেটটা মুঠো করে ধরলো। হুট করেই ডানদিকে তাকালো ও। কিছুক্ষণ ওদিকে তাকিয়ে থেকে আমার দিকে না তাকিয়েই প্যাকেটটা আমার হাতে দিয়ে ওদিকে চলে গেলো।
মৌমিতা: ও ওদিকে যাচ্ছে কেন? ওটা তো অন্য কেবিন।
আদিত্য: আমিও বুঝলাম না। আমি দেখে আসছি ওয়েট।
আদিত্য কোয়েলের পিছন পিছন গিয়ে একটু উঁকি দিতেই দেখে ট্রেইনের দরজার সামনে রাজ দাঁড়িয়ে আছে আর কোয়েল সবে গিয়ে ওখানে দাঁড়িয়েছে। এটুকু দেখেই আদিত্য সরে আসে। এসে মৌমিতাকে জানায় রাজ উঠে গেছে ট্রেইনে ওই দিকের দরজা দিয়ে।
কোয়েল: এগুলো কেন পাঠিয়েছো আদিত্যদাকে দিয়ে? নিজে দিতে পারোনি? (শান্ত ভাবে)
রাজ: (নিশ্চুপ)
কোয়েল: ফোন ধরছিলে না কেন? (শান্ত ভাবে)
রাজ: (নিশ্চুপ)
কোয়েল: সিগারেটটা ফেলো হাত থেকে।
রাজ এবার তাচ্ছিল্য হেসে উঠলো। কোয়েলের কথা শুনে সিগারেটটা ফেলার বদলে তাতে জোরে একটা টান দিলো। কোয়েল তা দেখে চোখটা বন্ধ করে একটা নিশ্বাস ছেড়ে রাজের কাছে গিয়ে সিগারেটটা ফেলে দিতে গেলে রাজ সিগারেটটা সরিয়ে নেয় কিন্তু ভুলবশত কোয়েলের হাতে ছ্যাঁকা খায়।
কোয়েল: আহহ!
কোয়েল নিজের হাত ধরে হালকা চিৎকার করতেই রাজ সাথে সাথে সিগারেটটা ফেলে দেয় আর কোয়েলের হাত ধরে রেগে বলে,
রাজ: চাইছিস টা কি তুই বলবি? আমাকে কি শান্তিতে থাকতে দিবি না একটুর জন্যেও? কিছুক্ষণ আগেই তো বললি আমি কেউ হই না, আমার থাকা না থাকায় কোনো যায় আসে না তাহলে এখন এত খোঁজ কেন নিচ্ছিস? কি এমন হতো আমি না গেলে? ভালোই তো হতো তোর, তোকে অবিশ্বাস করা লোকটা তোর আশেপাশে থাকতো না শান্তিতে থাকতে পারতিস তুই। (একনাগাড়ে)
কোয়েল চুপচাপ মাথা নিচু করে থাকলে চোখের জল গাল গড়িয়ে রাজের হাতে পরে যেই হাত দিয়ে রাজ কোয়েলের হাতটা ধরে রেখেছে। রাজ নিমিষেই দমে যায়। কিছুক্ষণ আগেই রাজের এতটা খারাপ লেগেছিল কোয়েলের কথায়, এতটা অভিমান হয়েছিল তা এক মুহূর্তে রাজ ভুলে যায়। সে নিজে কোয়েলের কটূকথা সহ্য করে নিতে পারে কিন্তু তাঁর কথায় কোয়েল কষ্ট পেলে সেটা সহ্য করতে পারে না, নিজেকে তার অপরাধী মনে হয়। এখনও সেটাই হলো, রাজ উত্তেজিত হয়ে পরে কোয়েলকে নিয়ে।
রাজ: কুহ.. কোয়েল আ’ম স্যরি। আমার ভুল হয়ে গেছে আমি তোকে ওভাবে বলতে চাইনি। আ’ম রিয়েলি রিয়েলি স্যরি! আমি এই বিষয়ে তোকে আর কিছুই বলবো না। তুই চাস আমি তোর আশেপাশে না থা…আউচ্!
রাজকে কথা সম্পূর্ণ করতে না দিয়েই কোয়েল রাজের বুকে মারতে শুরু করে। রাজ এক কদম পিছিয়ে গেলে ট্রেইনের পিঠ ঠেকে যায়।
কোয়েল: সব সময় মহান সাজা তাই না? ইচ্ছে করে তুমি এমন বিহেভ করছো যাতে আমি নিজেই নিজের কাছে অপরাধী হয়ে যাই। কিছুক্ষণ আগে যে আমি তোমাকে খারাপ কথা বলেছি তুমি তাতে হার্ট হয়েছো, সেই জন্য আমাকে এখন কথা গুলো বলেছো সেটা আমি ভালো ভাবেই জানি। কিন্তু যেই আমি চোখের জল ফেললাম আমার খারাপ লেগেছে বুঝতে পারলে অমনি তুমি নিজের খারাপ লাগাটা ভুলে গিয়ে আমার কাছে স্যরি চাইছো? আমার খারাপ ব্যবহার করার বদলে খারাপ ব্যবহার না করে, ভালো ব্যবহার করে আমাকে অপরাধী সাজাতে চাইছো তাই তো? খালি ভালো মানুষী তাই না? আমি কিছু বুঝি না ভেবেছো? কেন করলে এমন? (কান্নামিশ্রিত কণ্ঠে)
রাজ: বিকজ আই ক্যান্ট বেয়ার ইউর টিয়ার্স! আমার দ্বারা হয় না তোর চোখে জল দেখা।
রাজের এমন ঠান্ডা গলার স্বর শুনে কোয়েলও এবার দমে গেলো। একদৃষ্টে তাকিয়ে রইলো রাজের লাল হয়ে যাওয়া মায়াবী চোখগুলোর দিকে, যা এখন বেশ ভয়ংকর লাগছে। কারণ সবুজ মণিজোড়ার চোখগুলো যখন লাল রং ধারণ করে তখন ভয়ংকর তো লাগবেই। কিন্তু কোয়েল এই চোখজোড়ার মাঝে নিজের অস্তিত্ব খুঁজে পায় তাই সে কিছুতেই চোখ সরাতে পারে না। এইবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি, কোয়েল টেরই পায়নি কখন রাজ তার কোমর জড়িয়ে তাকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়েছে, আকড়ে ধরেছে তাঁকে শক্ত করে। রাজ কোয়েলের কানের নীচে হাত প্রবেশ করাতেই কোয়েল চোখ সরিয়ে নিয়ে যায় কিন্তু রাজ তা হয়ে দেয় না। কোয়েলের মুখ নিজের দিকেই ঘুরিয়ে রাখে আর বলে,
রাজ: আমি তোকে অপরাধী করতে চাইনি বিশ্বাস কর। আমি পারি না তোর চোখের জল সহ্য করতে এর জন্য আমাকে যা করতে বলবি আমি তাই করবো, স্যরি বলাটা তো সামান্য বিষয়। আমি জানি তুই খুব ভালো ভাবেই তোর প্রতি আমার ফিলিংসগুলো বুঝিস কিন্তু কোনোদিনও স্বীকার করিসনি। আজ আমি সকালে তোকে হার্ট করতে চাইনি, আমি কখনো নিজের ইচ্ছায় তোকে হার্ট করার কথা ভাবি না।
কোয়েল: তাহলে কেন ছেড়ে গেছিলে আমাকে? কেন অতটা একা করে দিয়েছিলে আমাকে হুট করে? তুমি জানো আমি প্রতিটা মুহূর্তে তোমাকে কতটা মিস করেছি?
রাজ: আমি বাধ্য ছিলাম, নাহলে তোকে ছেড়ে যাওয়ার কথা আমি ভাবতেও পারি না। আমি তোকে অবিশ্বাস কখনোই করিনি। তোকে আর অঙ্কিতকে ওভাবে দেখে আমি কষ্ট পেয়েছিলাম। পরে আদি যখন আমাকে বললো, তুই আমাকে বললি তখন আমি যে কতটা রিলিফ পেয়েছি তোর ধারণা নেই। আমি তোকে অবিশ্বাস করিনি তোকে সারাজীবনের জন্য পেতে গিয়ে হারিয়ে ফেলেছি এইভেবে ভিতরে ভিতরে শেষ হয়ে গেছি প্রতিটা মুহূর্তে।
কোয়েল রাজের কথা শুনে নড়ে চড়ে উঠলে রাজ কোয়েলকে আরেকটু কাছে টেনে কোয়েলের চোখে চোখ রেখে বলে,
রাজ: আই লাভ ইউ! আই রিয়েলি রিয়েলি লাভ ইউ কোয়েল! আমি আর পারছি না তোকে ছাড়া থাকতে। প্লিজ, প্লিজ বি মাইন! ভীষণ ভালোবাসি তোকে।
কোয়েল রাজের দিকে অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর সরে আসে রাজের থেকে। তারপর বলে,
কোয়েল: এতো সহজে তোমাকে মেনে নেওয়া আমার পক্ষে সম্ভব না রাজ। আমি যতক্ষন না জানতে পারছি তুমি কেন আমাকে ছেড়ে গেছিলে ততক্ষণ অবধি আমার মনে খটকা থেকেই যাবে আমি পারবো না তোমাকে মেনে নিতে, কিছুতেই না!
কথাগুলো বলে কোয়েল চলে গেলো ভিতরে। রাজ একটা স্বস্তির নিশ্বাস ছেড়ে সামান্য হাসলো আর বাইরের দিকে তাকিয়ে রইলো।
চলবে