একদিন তুমিও ভালোবাসবে পর্ব-৩৭+৩৮+৩৯

0
1892

‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️
||পর্ব~৩৭||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা

৫৫.
মৌমিতা: কি করছিলিস তুই অঙ্কিতের সাথে?

কোয়েল নিজের বেডে চুপচাপ বসে থাকলে আমি ওর পাশে বসে কথাটা জিজ্ঞেস করলাম ওকে। কোয়েল কিছু একটা নিয়ে চিন্তা করছে সেটা বুঝলাম কিন্তু কি নিয়ে চিন্তা করছে এটা জানতে হবে। আমি যা আন্দাজ করছি সেটা ঠিক কি না ওর সাথে কথা বললেই বোঝা যাবে। কোয়েল আমার দিকে তাকিয়ে বললো,

কোয়েল: আমার মনে হয় এইবার তোর সবটা জানা উচিত।

মৌমিতা: তোর আর অঙ্কিতের ব্যাপারে?

কোয়েল: (মৌমিতাকে ঝাড়ি মেরে) হাট! ঘোড়ার ডিম। আমার আর অঙ্কিতের ব্যাপারে কি হবে ছাই? 😒 ওর আর আমার মধ্যে কিছু নেই বন্ধুত্ব ছাড়া।

মৌমিতা: ভাগ্যিস নেই। নাহলে বেচারা রাজদার কি হতো বলতো। (মুখ টিপে হেসে)

কোয়েল: (আমতা আমতা করে) তুই কি বলতে চাইছিস হ্যাঁ?

মৌমিতা: আহাহা, উনি জানো কিচ্ছু বুঝতে পারছে না। (মাথায় টোকা মেরে) তুই কি মনে করেছিস আমি তোর আর রাজদার বিহেভিয়ারে কিছু বুঝিনি? এতই বোকা নাকি আমি? হুহ! সব বুঝি আমি বুঝলি? (ভাও নিয়ে)

কোয়েল: হ্যাঁ, শুধু নিজেরটাই বোঝো না।

মৌমিতা: কাজের কথা বল বাড়তি কথা না বলে। (কথা ঘুরিয়ে)

কোয়েল: হয়ে গেলো ফুস। হাহ! শোন।

মৌমিতা: শোনার জন্যেই বসে আছি।

কোয়েল: হুঁ। আমি যেমন আন্দাজ করেছিলাম তোর আর আদিত্যদার মধ্যে কোনো একটা কানেকশন আছে তেমন অঙ্কিতও আন্দাজ করেছিল। যেদিন তোর পায়ে ব্যাথা লাগলো রণিতের থেকে পালাতে গিয়ে সেদিন তোকে আর আদিত্যদাকে অঙ্কিত দেখেছিল একসাথে। তখন ও’ও কিছু একটা সন্দেহ করে আর পরে আমাকে বলে।

মৌমিতা: তুই কি বলেছিলি?

কোয়েল: আমি এড়িয়ে গেছিলাম। কিন্তু পরে যখন রণিত তোকে প্রপোজ করলো আর আদিত্যদা ওরকম ভাবে রিয়াকট করলো তখন ও আবার আমায় এসে কঠোর ভাবে জিজ্ঞেস করে। সেদিন আর আমি কিছু লুকাইনি কারণ তখনও যদি লুকাতাম তাহলে প্রবলেম হতে পারতো, এটা তুইও জানিস ভালো ভাবে।

কোয়েলের কথাটা ঠিক। আদিত্যের ব্যবহারে যে আমূল পরিবর্তন এসেছে তাতে আমি যদি ভবিষ্যতে ওকে মেনেনি তাহলে সেটা খুব একটা আশ্চর্যের হবে না। তাই আমি কোয়েলের কথায় হ্যাঁ বোধক মাথা নেড়ে সায় দিলে কোয়েল বলে,

কোয়েল: এছাড়া অঙ্কিতকে সবটা জানানোর সবচেয়ে বড় কারণ, ও তোকে ভালোবাসে।

কোয়েলের কথাটা শুনে আমি শুধু ওর দিকে তাকালাম আর বললাম,

মৌমিতা: তারপর?

কোয়েল: তারপর ও সবটা শুনে খুব একটা রিয়াকট না করলেও মনে মনে কষ্ট পেয়েছে এটা বুঝেছিলাম। সেদিনের পর থেকে হুট করেই যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। ভয় হতো উল্টো পাল্টা কিছু করে বসবে না তো, এই ভেবে। তাই তোর প্রশ্নও এড়িয়ে যেতাম। আজকে হঠাৎ করেই আমি যখন ক্লাস থেকে বের হই তখন অঙ্কিতের মেসেজ আসে যেটায় বলা ছিলো আমি জানো লাইব্রেরির পাশে থাকা কমন রুমে ওয়েট করি।

মৌমিতা: এইবার বুঝলাম, তাই তুই তখন অভাবে চলে গেছিলি। কি কথা হলো অঙ্কিতের সাথে? কি বললো ও? ঠিক আছে তো?

ফ্ল্যাশব্যাক………………………

কোয়েল কমন রুমে ঢুকেই দেখলো অঙ্কিত চুপচাপ একটা বেঞ্চে নিচের দিকে তাকিয়ে বসে আছে। এই কয়েকদিনেই মুখটা কেমন জানো ফ্যাকাশে হয়ে গেছে এটা দেখে কোয়েলের খারাপ লাগলো। কোয়েল ধীর পায়ে এগিয়ে অঙ্কিতের কাঁধে হাত দিলে অঙ্কিত উঠে দাঁড়ায়।

কোয়েল: কি অবস্থা করেছো এটা নিজের?

অঙ্কিত: (তাচ্ছিল্য হেসে) ঠিকই আছি। তুই কেমন আছিস?

কোয়েল: ভালো। কোথায় ছিলে এতদিন?

অঙ্কিত: বাড়িতে গেছিলাম আবার কোথায় যাবো?

কোয়েল: তাহলে যোগাযোগ করোনি যে?

অঙ্কিত: (হেসে) নিজেকে সামলাতে চেয়েছিলাম, একা!

কোয়েল মাথা নামিয়ে নিলো পরিস্থিতি বুঝে। অঙ্কিত কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর জিজ্ঞেস করলো,

অঙ্কিত: মৌকে বলে দিয়েছিস আমার ব্যাপারে?

কোয়েল: নাহ। ও জিজ্ঞেস করেছিল তোমার ব্যাপারে কিন্তু কিছু বলিনি।

অঙ্কিত: আচ্ছা।

অঙ্কিত চুপ করে বেঞ্চে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। কোয়েল কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছে না তাই ওখান থেকে সরে আসাটাই ঠিক মনে করলো। কিন্তু কোয়েল সরে আসতে গেলেই অঙ্কিত কোয়েলের গাত ধরে বাঁধ সাধে। কোয়েল অঙ্কিতের দিকে তাকালে অঙ্কিত নিচের দিকে তাকিয়েই বলে,

অঙ্কিত: আমার সাথে এমনটা না হলেই পারতো বল? (ভাঙা গলায়)

কোয়েল: কেউ কখনও আগে থেকে বুঝতে পারে না করে উপর তাদের অনুভূতি আসবে। তুমিও বুঝতে পারোনি এমন কি মৌ নিজেও বুঝতে পারছে না সে আদিত্যদাকে ভালোবাসে। ভালোবাসার অনুভূতিটা এমনই অঙ্কিত। কেউ খুব জলদি বুঝে যায়, কেউ বুঝতেই পারে না আবার কেউ বুঝেও সেটাকে মানতে চায় না। অনেকে আবেগকে ভালোবাসা মনে করে আসল যাকে ভালোবাসে তাকে দূরে ঠেলে দেয় আবার অনেকে বিশ্বাস করতে পারে না যে তার অনুভূতি ভালোবাসা কারণ সে তো কাওকে কোনোদিন ভালোবাসেনি। এটাই আদিত্যদার সাথে হয়েছে। আর মৌ? ও নিজেও জানে ও ভালোবাসে কিন্তু সেটা মানতে চাইছে না ওর প্রতি আদিত্যদার করা ভুলের জন্য।

অঙ্কিত: আমি তাদের দলে যারা খুব তাড়াতাড়ি বুঝে ফেলে যে সে কাকে ভালোবাসে, তাই না? (হালকা হেসে)

কোয়েল: সত্যিই কি তাই অঙ্কিত?

কোয়েলের প্রশ্নটা কেন জানো অঙ্কিতের বুকে বিঁধলো। কোনো কিছু না বলেই সে চুপ করে রইলো।

কোয়েল: আমি তোমার অনুভূতিকে অপমান করছি না, আমি শুধু বলতে চাইছি তুমি সিওর? কারণ অনুভূতি বোঝাটা সহজ নয়। ভালোবাসা আর মোহের অনুভূতির মধ্যে পার্থক্য করা আমার মতে পৃথিবীর সব থেকে কঠিন কাজ। আমরা বুঝতেই পারি না কে মোহ আর কে ভালোবাসা। তখন বুঝি যখন ভালোবাসার মানুষটি দূরে সরে যায় আর প্রতিটা মুহূর্তে আমাদের তাকে মনে পড়ে। কিন্তু যার প্রতি মোহ ছিলো সে দূরে সরে গেলে অনেকদিন পর আমরা ঠিকই তাকে ভুলে যাই। তাই বলে কি একজন চলে গেলে অন্য একজনকে একসেপ্ট করলে আমরা ভালোবাসিনি? বেসেছি, কারণ দ্বিতীয় মানুষটা আমাদের মনে নিজেদের জন্য আলাদা জায়গা করে নিয়েছে। যাকে আগে ভালোবেসেছিলাম তার জায়গাটা ঠিকই মনের কোণে রয়ে গেছে তাই হঠাৎ করে মনে পড়লেই একটা কষ্ট অনুভব হয়। কেন? কারণটা হলো, তাকে ভালোবেসেছি!

কোয়েল থামলে অঙ্কিত ছলছল চোখে ওর দিকে তাকিয়ে বলে,

অঙ্কিত: দূরে সরে যাওয়ার পর বুঝতে পারলে তো অনেক দেরি হয়ে যাবে তাই না?

কোয়েল: হ্যাঁ। ওই জন্যেই তো বললাম, সব থেকে কঠিন কাজ। বুঝে উঠতে না পারলে বা দেরী হয়ে গেলে সারাজীবন কষ্ট পেতে হবে আর যারা বুঝে যাবে, তারাই ভাগ্যবান।

অঙ্কিত: কিন্তু বুঝবো কি করে?

কোয়েল: দুজন মানুষকে একসাথে ভালোবাসা যায়? এই প্রশ্নের উত্তর আমি বলবো, হ্যাঁ যায়। কিন্তু একটু তফাৎ থাকবেই। কেউ একজন বিশ আর কেউ উনিশ। মোহ আর ভালোবাসাটা তোমার তখন ওরকমই মনে হবে তাই সেই সময় দুজনের থেকে দূরে সরে দেখো। একজন না একজনের কথা ঠিকই বেশি মনে পড়বে, তফাৎ টা খুবই নিখুঁত ও সামান্য হলেও তখন বুঝতে হবে। সাধে কি আর কঠিন কাজ? (হেসে)

অঙ্কিত: জানি না মৌয়ের প্রতি আমার অনুভূতির আসল নাম কি? যেদিন জানবো সেদিন তোকে ঠিক জানাবো।

কোয়েল: অপেক্ষায় রইলাম, নিজেকে সময় দাও এখন। সবটা খুব তাড়াতাড়ি ঠিক হয়ে যাবে।

অঙ্কিত: দিলাম তো সময়। এবার কোম্পানি লাগবে তোর।

কোয়েল: (হেসে) তাই হবে।

অঙ্কিত হালকা হেসে চুপ করে গেলে কোয়েল অঙ্কিতের কাঁধে হাত রাখে আর অঙ্কিত কোয়েলের দিকে ছলছল চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে কোয়েলকে জড়িয়ে ধরে। কোয়েল বাঁধা দিতে পারে না, আলতো ভাবে পিঠে হাত বুলিয়ে দেয় অঙ্কিতের।

কিছুক্ষণ পর কোয়েলকে ছেড়ে দিয়ে অঙ্কিত নিজেকে স্বাভাবিক করে বলে,

অঙ্কিত: ক্লাবে যাবি?

কোয়েল: (কিছুক্ষন ভেবে) হোয়াই নট!

প্রেসেন্ট………..……………

কোয়েল: ক্লাবটা অঙ্কিতের দাদার। তোরা না আসলে ওই আমাকে পৌঁছে দিতো।

মৌমিতা: বুঝলাম, এই কথাগুলো রাজদাকে বলিস।

কোয়েল: (চুপ করে থেকে) বলবো তো ভাবছিলাম কিন্তু শুনলো আর কই? চলে গেলো অফিস। (মন খারাপ করে)

মৌমিতা: আবার দেখা যখন হবে তখন বলে দিস। তাহলেই তো হয়।

কোয়েল: আসলে, আসলে দোষটা আমারই।

মৌমিতা: কেন?

কোয়েল: ও আমাকে বলেছিল ভার্সিটিতে নিতে আসবে ছুটির সময় যেটা আমার মাথা থেকে একদম বেরিয়ে গেছিলো। আমি ওকে জানায়নি একবারও যে আমি অঙ্কিতের সাথে আছি কিন্তু তাও তো তেমন কিছু বললো না আজকে। কি রকম একটা চুপচাপ ছিলো যেটা আমার কাছে খুব অস্বাভাবিক লেগেছে।

মৌমিতা: (হঠাৎ করে) কোনোভাবে তোকে আর অঙ্কিতকে কমন রুমে দেখে নেয়নি তো?

কোয়েল আমার কথা শুনে চমকে উঠলো আর তারপর ভাবতে লাগলো কিছু একটা।

কোয়েল: (মনে মনে– হতেই পারে মৌ যেটা বলছে সেটা ঠিক। আমি আসছি না এই দেখে ও ভার্সিটিতে ঢুকেছিলো নিশ্চই। আর ও তো জানে আমি লাইব্রেরি তে থাকি ভার্সিটি শেষ হওয়ার পর মাঝে মধ্যে, স্কুলেও থাকতাম। লাইব্রেরির পাশের রুমেই তো ছিলাম, কোনোভাবে দেখে নিয়ে ভুল বুঝলো না তো? হয়তো কথাগুলো শুনতে পায়নি আজকে না হোক আগামীকাল আমি ওকে জানাবো পুরো ঘটনাটা। আমি অঙ্কিতকে ভালোবাসি ভেবে না আবার দূরে সরে যায় ছেলেটা।)

মৌমিতা: এত ভাবিস না এখন। রাজদার সাথে দেখা হলে সবটা বলিস তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।

কোয়েল: হম। আচ্ছা মৌ, তুই এতটা স্বাভাবিক কীভাবে? দেখে মনে হচ্ছে জানতিস সবটা।

মৌমিতা: সিওর জানতাম না, আন্দাজ করেছিলাম পুরো বিষয়টা। অঙ্কিতের বিহেভিয়ারে আন্দাজ করতে বাধ্য হয়েছিলাম।

কোয়েল: সেই, সবার বিহেভিয়ার দেখে তুমি বুঝে যাও তোমার প্রতি কার কেমন ফিলিংস শুধু নিজের বরেরটা বোঝো না।

মৃদু হাসলাম কোয়েলের কথাটা শুনে। কোয়েল আবার প্রশ্ন করলো,

কোয়েল: সত্যি বল তো, তুই কি সত্যি বুঝিস না আদিত্যদা তোকে ভালোবাসে?

মৌমিতা: বুঝি তো।

কোয়েল: তাহলে?

মৌমিতা: ওনার আগের ব্যবহারগুলো মনে পড়লে মনে হয় উনি হয়তো বদলে যেতে পারেন আবার। কারণ ফুলশয্যার রাতে করা ব্যবহার আর ভার্সিটিতে আসার পরে ব্যবহারে আকাশপাতাল তফাৎ। এই ভালো ব্যবহারটা যে সাময়িক নয় কে বলতে পারে? আমি শুধু ওনার অনুভূতিটা কতটা সত্যি সেটাই যাচাই করছি। সত্যিকারের ভালোবাসলে কোনোদিন হার মানবেন না।

কোয়েল: এটা তো আদিত্যদার কথা। তুই ভালোবাসিস না?

মৌমিতা: (হালকা হেসে উঠে দাঁড়িয়ে) বিয়ের প্রথম দিন থেকেই ওনার জন্য আমার মনে জায়গাটা তৈরী হয়েছিল। ভার্সিটিতে এসে ওনাকে জিয়ার সাথে দেখার পর সেটা আরো বেশি মজবুত হয়েছে। যত মনকে বুঝিয়েছি ওনার থেকে দূরে থাকবো তত বেশি জড়িয়ে পড়েছি। প্রথমে ভেঙে পড়েছিলাম ওনাকে জিয়াকে “আই লাভ ইউ” বলতে শুনে। তখন ঠিক করেছিলাম কোনোভাবেই আর ওনাকে নিয়ে ভাববো না। তাই তো সব সময় নিজেকে বোঝাতাম আমি ওনাকে ভালোবাসি না। কিন্তু মনে মনে ঠিকই জানতাম যে আমি ওনাকে ভালোবাসি তাই তো জিয়াকে মানতে পারিনা ওনার পাশে ঠিক যেমন উনি এখন কাওকে মানতে পারেন না আমার পাশে অন্য কাউকে। ভালোবাসি দেখেই ওনার সাথে কথা বলি, ভালো না বাসলে এড়িয়ে যেতাম।

কোয়েল হুট করে আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে বললো,

কোয়েল: ইয়ে! কি মজা। দুজনেই বুঝে গেছে এবার শুধু প্রকাশ করার অপেক্ষা। হুরররে!

আমিও হেসে দিলাম কোয়েলের সাথে। তারপর খাওয়াদাওয়া সেরে নিয়ে যে যার মতো বই নিয়ে বসলাম।

‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️
||পর্ব~৩৮||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা

৫৬.
রাজ নিজের ঘরে বেডে বসে আছে বালিশ বুকে জড়িয়ে। একমনে কিছু একটা ভাবছে সে, সেই সময় ঘরের দরজায় কেউ “ঠকঠক” করলে রাজের হুঁশ আসে।

রাজ: কে?

__আমি আদিত্য!

রাজ: আয়।

আদিত্য ঘরে ঢুকেদরজা লক করে লাফ মেরে বেডে উঠে রাজের পাশে গিয়ে বসলে রাজ ভ্রু কুঁচকে চোখ বড়ো বড়ো করে বলে,

রাজ: বান্দরের মতো লাফালাফি করতে হলে চিড়িয়াখানাতে যা আমার ঘরে কি করছিস? কলা নেই আমার কাছে।

আদিত্য: চুপ করে শুয়ার।😒

রাজ: কেন? ওহ আচ্ছা আজকে তো তোর লাফালাফি করার কারণ আছে। নাচ করেছিস কি না বউয়ের সাথে। বুঝতে পারছি, বুঝতে পারছি। তা নিজের ঘরে গিয়ে গান চালিয়ে নাচ, আমার ঘরে কি?

আদিত্য: আমি এসেছি বলে খুব সমস্যা হচ্ছে তোর? ফাইন আমি চলে যাচ্ছি। (অভিমান করে)

রাজ: ড্রামাবাজ!

আদিত্য: (রাজের দিকে ঘুরে) এই তুই কি বলতে চাইছিস? আমার মধ্যে কি ইমনশনস নেই নাকি?

রাজ: সবে তৈরী হয়েছে।

আদিত্য: আব, সে যাই হোক! আছে তো। (আমতা আমতা করে)

রাজ সামান্য হাসে আদিত্যের ব্যবহার দেখে। আদিত্য এবার সিরিয়াস হয়ে রাজকে জিজ্ঞেস করে,

আদিত্য: কি হয়েছে তোর? বিকেল থেকে দেখছি কেমন চুপচাপ। অফিসে কোনো প্রবলেম নাকি কোয়েলের সাথে কিছু হয়েছে, কোনটা?

রাজ: কিছু না। বাদ দে, আমার ভালো লাগছে না এসব নিয়ে কথা বলতে।

আদিত্য: এসব নিয়ে কথা বলতে ভালো লাগছে না কিন্তু ভাবতে ভালো লাগছে? এমন কেন? আমার থেকে লুকিয়ে লাভ আছে রাজ?

রাজ: (নিশ্চুপ)

আদিত্য: (কাঁধে হাত দিয়ে) কি হয়েছে? বল আমায়?

রাজ উঠে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে সবটা বললো আদিত্যকে যা যা ও দেখেছে ভার্সিটিতে। রাজের কথা শেষ হতেই আদিত্য হো হো করে হেসে ওঠে। রাজ সেটা দেখে কিছু বলে না কারণ তার ভীষণ রাগ উঠছে। আদিত্য সেটা বুঝে নিজেকে স্বাভাবিক করে রাজকে বললো,

আদিত্য: আবে গাধা! অঙ্কিত কোয়েলকে না মৌমিতাকে ভালোবাসে। (হেসে দিয়ে)

রাজের বেশ কয়েক সেকেন্ড লাগলো আদিত্যের কথাটা বুঝতে। কিন্তু কথাটা বুঝে উঠতে লাফ মেরে আদিত্যের কাছে যেতে দেরী হলো না। আদিত্যের কাছে উঠে বসলেই আদিত্য বলে,

আদিত্য: এইবার তুই কেন বান্দরের মতো লাফালি? আমাকে তো খুব বলছিলি।(টোন করে)

রাজ: এই আদি! তোকে আমি কলার কাঁদি কিনে দেবো। আমাকে পুরো ব্যাপারটা বোঝা, আমি বুঝলাম না। (আগ্রহ প্রকাশ করে)

আদিত্য: কথাই বলবো না হুর! (তেজ দেখিয়ে)

রাজ: আচ্ছা আচ্ছা আর বলবো না কিন্তু তুই আমাকে বোঝা ভাই। এটা তুই কি বললি? কোয়েলের থেকে তো তুই আমার রাতের ঘুম কেড়ে নিলি। আশার আলো দেখিয়ে এভাবে নিভিয়ে দিস না। বল না ভাই! তোরে না আমি প্রেমের মনে বুঝলাম? তুই আমার সাথে এমন করবি? (অসহায় মুখ করে)

আদিত্য: হুহ! ঠিক আছে, ঠিক আছে। ওতো পাম দেওয়া লাগবে না, বলছি।

রাজ: হ্যাঁ, বল।

আদিত্য: অঙ্কিত মৌমিতাকে ভালোবাসে এটা আমি আন্দাজ করেছি। রণিতকে নিয়ে আমার রিয়াকশন দেখে অঙ্কিত মে বি কিছু একটা আন্দাজ করেছে আমাকে আর মৌমিতাকে নিয়ে।

রাজ: মে বি? (মন খারাপ করে)

আদিত্য: আরে সেটা আমাদের দুজনকে নিয়ে ও কি ভাবে সেটা নিয়ে। মৌমিতাকে ও ভালোবাসে এটা সিওর। ওর বিহেভিয়ারেই আমি বুঝে গেছি। আমি তো কি কোয়েল আর মৌমিতাও জানে দেখ গিয়ে। তুই সবে এসেছিস তাই জানিস না কারণ অঙ্কিতের সাথে তো তোর আজকেই দেখা।

রাজ: তাহলে কোয়েল কি করছিলো ওর সাথে?

আদিত্য: দেখ গিয়ে সান্তনা দিচ্ছিলো। ও হলো গিয়ে সান্তনা মাসি। (হেসে ফেলে)

[সুমি তোর বররে সামলা কইয়া দিলাম।😒]

রাজ: (হেসে) তারমানে ও ম্যানেজ করছে ব্যাপারটা?

আদিত্য: আমার যতদূর মনে হয় অঙ্কিতকে কোয়েল সবটা জানিয়ে দিয়েছে তাই অঙ্কিত গায়েব ছিলো। এখন এব্যাপারে মৌমিতা কি জানে সেটা আমি জানি না। কোয়েল আমাদের মাঝখানে তৃতীয় কাওকে আসতেই দেবে না, এই জন্যেই তো রেখেছি ওকে। (হেসে😁)

রাজ: (স্বস্তি ফিরে পেয়ে) বাঁচলাম। আমিই গাধার মতো আজে বাজে ভাবছিলাম।

আদিত্য: হ্যাঁ কারণ তুই তো গাধাই। তোর তো চিড়িয়াখানা থাকা উচিত ছিলো। (শুয়ে শুয়ে)

রাজ: আমি বরং যাই, আন্টিকে বলি তুই মৌমিতার সাথে বিয়ের পর থেকে কেমন ব্যবহার করেছিস। কি বলিস?

আদিত্য: (লাফ মেরে উঠে) এ ভাই! সোনা ভাই আমার। আমি না তোকে কষ্ট থেকে মুক্তি দিলাম? হ্যাঁ? তুই আমার সাথে এমন করবি? এমন করে না ভাই। (তোষামোদ করে রাজকে)

রাজ: আব আয়া না উট পাহাড়কে নিচে। চাল চাল বাজু হাট! হাওয়া আনে দে।(ভাও খেয়ে)

[এই নাহলে আমার বর।😗]

আদিত্য: কি দিনকাল পড়লো রে বাবা…

রাজ: হ্যাঁ যে, বান্দর চিড়িয়াখানাতে না থেকে ঘরে থাকছে।

আদিত্য: তোকে তো আমি..

আদিত্য আর রাজ ঘরের মধ্যে দৌঁড়াদৌঁড়ি শুরু করলো। একটা সময় হাঁপিয়ে গিয়ে একজন সোফায় আর একজন বেডে শুয়ে পড়লো। হাসতে হাসতে দুজন দুজনকে বালিশ ছুড়তে লাগলো।

আদিত্য: হেব্বি ভয় পেয়েছিলি বল? (বালিশ ছুড়ে, উঠে বসে)

রাজ: (বালিশটা ধরে নিয়ে) না ভয় পেয়ে কি উপায় আছে? এটা আমার ভাগ্য বস! যা চাইবো তা সহজে তো দূর কঠিন ভাবেও পাওয়ার চান্স নেই বললেই চলে। (তাচ্ছিল্য হেসে)

আদিত্য: সবটা ঠিক হয়ে যাবে দেখিস। কোয়েল সত্যিটা জানলে তোর উপর আর অভিমান করে থাকবে না কিন্তু…

রাজ: তোর এই কিন্তু টা নিয়ে আমারও ভয়। আর দেখিস, আমরা যেটা ভাবছি সেটাই হবে। তার থেকে মারাত্মক কিছু হলেও অবাক হবো না আমি।

আদিত্য: এখন ঘুম দে। কালকে সকালে তাড়াতাড়ি ভার্সিটিতে যেতে হবে। একটা কাজ করিস, কালকে তুই কোয়েল আর মৌমিতাকে নিয়ে ভার্সিটি চলে আসিস। আমি আগে চলে যাবো।

রাজ: হ্যাঁ ঠিক আছে। আসল কথা তো তুই বলবি, আমি না হয় পরে গিয়ে ম্যানেজ করে নেবো।

আদিত্য: ঠিক আছে।

আদিত্য ধপাস করে বেডের একপাশে শুয়ে পড়লে রাজ অবাক হয়ে বলে,

রাজ: নিজের ঘর কি করতে আছে? নিজের ঘরে গিয়ে ঘুমা।

আদিত্য: তোর ঘর মানেই আমার ঘর। গুড নাইট দোস্ত!

আদিত্য বালিশ চাপা দিয়ে দিল কানে যাতে রাজের আর কোনো কথা কানে না যায়। রাজ হেসে নিজের হাতে থাকা বালিশটা আদিত্যের দিকে ছুড়ে মারলো আর ব্যালকনিতে গিয়ে জ্যাকেটের পকেটে হাত গুঁজে দাঁড়ালো। বেশ ঠান্ডা পড়েছে তবে আকাশের চাঁদটা পরিষ্কার। এখন বেশ রিলিফ লাগছে রাজের। কিছুক্ষণ আগে যেই চিন্তা, যেই অস্বস্তিটা হচ্ছিলো আদিত্যের কথায় তা আর নেই।

রাজ: (মনে মনে– কোয়েল এই বিষয় নিয়েই হয়তো কথা বলবে বলছিলো। ভাগ্যিস আদি আগে বলে দিলো নাহলে কোয়েল বলা অবধি অপেক্ষা করতে গেলে দেখা যেতো আমার প্রাণটাই বেরিয়ে গেছে। উফ ভগবান! এই ভালোবাসাও আজব জিনিস মাইরি। নিজের করতে না পারলেও রাতের ঘুম উড়ে যায় আর না পারলেও ঘুম উড়ে যায়।)

হঠাৎ করে এতো রাতে রাজের ফোন বেজে উঠলে রাজের বুকের ধুকপুকানি বেড়ে যায়। তার মন বলছে কোয়েল ফোন করেছে। ফোন বার করতেই কোয়েলের নামটা ভেসে উঠলে রাজের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে। আর দেরী না করে সে রিসিভ করে নেয় কলটা।

রাজ: বল।

কোয়েল: কখন ফিরেছো অফিস থেকে?

রাজ: এক ঘন্টা মতো হয়েছে।

কোয়েল: রাত দশটা অবধি অফিসে থাকা লাগে?

রাজ: একটু কাজ ছিল।

কোয়েল: নতুন কিছু বলো, এই এক বাহানা আর শুনতে ভালো লাগছে না।

রাজ: নতুন কিছু বলতে গেলে ভাবা লাগবে, ওটা নেক্সট দিন বলবো তাহলে। (হেসে)

কোয়েল: হুহ! ঘুমাওনি কেন?

রাজ: ভাগ্যিস ঘুমাইনি নাহলে এত সুন্দর ঘুমটা ভেঙে যেত আমার। (মজা করে)

কোয়েল: আচ্ছা। গুড নাইট!

রাজ: আরে শোন তো…

কোয়েল: ঘুম পেয়েছে।

রাজ: হম, তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পর। কালকে সকালে ঠিক সময় রেডি থাকবি দুজন, আমি নিতে আসবো। গুড নাইট।

কোয়েল ফোন রাখতেই রাজ তাড়াতাড়ি করে ঘরে চলে গেলো ঘুমাতে। এদিক কোয়েল শুয়ে শুয়ে ভাবছে রাজকে কখন জানাবে সবটা। না জানে সে কি না কি ভেবে বসে আছে, আদৌ কিছু দেখেছে নাকি এমনিই মুড অফ ছিল। কিছুই বুঝতে পারছে না কোয়েল। এইসব আকাশপাতাল ভাবতে ভাবতেই কোয়েল ঘুমিয়ে পড়লো, মৌমিতা অনেক আগেই ঘুমিয়ে গেছে।

৫৭.
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠতেই কোয়েল আমাকে জানায় রাজদা আসবে নিতে। তাই তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে আমরা ঠিক সময়ে নিচে নামতেই দেখি রাজদা গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছে।

মৌমিতা: (মনে মনে– রাজদা তো নিজের গাড়ি নিয়েই এসেছেন। তাহলে উনি কোথায়?) উনি কোথায়?

রাজ: কে আদি? আদি ভার্সিটিতে আছে।

কোয়েল: এত আগে কেন? সব ক্লাস তো শুরু হয় ১০:৩০ টায়। (অবাক হয়ে)

রাজ: হ্যাঁ, আজকে কিছু কাজ আছে তাই। তোমাদেরকে পৌঁছে দিয়ে আমিও ওর সাথে দেখা করবো। তোমাদের আজকে গ্যাপ আছে কোনো?

মৌমিতা: না। আজকে পর পর তিনটে ক্লাস।

রাজ: দ্যাটস গ্রেট। চলো আর দেরী করা ঠিক হবে না।

রাজদা গাড়িতে উঠে গেলে আমি কোয়েলকে ধাক্কা দিয়ে রাজদার পাশে অর্থাৎ সামনে বসতে পাঠিয়ে নিজে পিছনের সিটে উঠে যাই। আমি আগে উঠলে রাজদার সাথে আমার চোখে চোখ পড়ে আর তখন রাজদা আমায় ইশারায় থ্যাংক ইউ বলে। আমিও চোখের ইশারায় সম্মতি জানাই আর কোয়েলও গাড়িতে উঠে পরে।

কোয়েল: (মনে মনে– আজকে তো মুড ভালোই আছে দেখছি। কালকে রাতেও তো ঠিকঠাক লেগেছে। তাহলে হয়তো অফিসের কাজের জন্যেই মুড অফ ছিলো ওই সময়। যাক গে, আমি আমার যা বলার বলে দেবো তাহলেই হলো।)

আমরা ভার্সিটি পৌঁছে ক্লাসের দিকে গেলে রাজদা প্রিন্সিপ্যালের রুমের দিকে চলে যায়। আদিত্য তারমানে ওখানে আছেন? আবার কি হবে কে জানে। বেশি না ভেবে আমরা ক্লাস অ্যাটেন্ড করতে চলে গেলাম। ফাস্ট ক্লাস শেষ করে সেকেন্ড ক্লাস করতে ঢুকছি এমন সময় আমি আদিত্যকে দেখতে পেলাম, উনি অনার্স লাস্ট ইয়ারের ক্লাসে ঢুকছেন রাজদাকে নিয়ে।

কোয়েল: স্যার আসছেন। চল ভিতরে।

কোয়েলের কথা শুনে ক্লাসে আমি ক্লাসে ঢুকে পড়লাম। ক্লাস শুরু হওয়ার কুড়ি মিনিটের মাথায় আদিত্যের গলার আওয়াজ পেলাম।

আদিত্য: আসতে পারি স্যার?

স্যার: হ্যাঁ, হ্যাঁ এসো।

আদিত্য আর রাজদা ক্লাসে ঢুকে স্যারের সাথে দু-একটা কথা বলে ক্লাসের সবার উদ্দেশ্যে বলতে শুরু করলেন,

আদিত্য: তোরা সবাই নতুন আমাদের ভার্সিটিতে সো তোরা মে বি জানিস না আমাদের ভার্সিটি থেকে প্রত্যেক ইয়ারে একটা উইন্টার ট্যুর করা হয়। এইবারও হচ্ছে আর সেটা দার্জিলিং। আমরা জাস্ট এখন সবাইকে জানাচ্ছি, পরের ক্লাসের মধ্যে ফুল নোটিস পেয়ে যাবি।

আদিত্য আমার দিকে তাকালেন কথা শেষ করে আমি চোখ সরিয়ে নিলাম। স্যার বললেন,

স্যার: তা রাজ? তুমি যাচ্ছো তো? লাস্ট ইয়ার হলেও এটাই তো তোমার ফাস্ট ইয়ার। এত বছর তো আদিই সবটা সামলেছে। এইবার ওকে একটু হেল্প করো।

রাজ কিছু বলতে যাবে তার আগেই আদিত্য রাজের গলা আর কাঁধ চেপে ধরে বললো,

আদিত্য: ও যাবে না ওর ঘাড় যাবে।

রাজ: আবে, ছাড় আমায় নাহলে আমার ভুত যাবে।

আদিত্যের কাজকর্ম আর রাজের কথায় স্যারও হেসে দিলেন। আদিত্য আর রাজ স্যারকে বলে তাড়াতাড়ি চলে গেলেন। আমি কোয়েলকে জিজ্ঞেস করলাম,

মৌমিতা: যাবি তুই?

কোয়েল: আদিত্যদা যাচ্ছে আর আমায় নেবে না এমনটা হতে পারে? আমি ভার্সিটিতে যখন ছিলাম না তখনও গেছি, আদিত্যদাই নিয়ে গেছে। কিন্তু এবার আর বোর হতে হবে না কারণ তুই যে থাকবি। (চোখ টিপ দিয়ে)

মৌমিতা: আমি? আমি যাবো না হুর। তুই ঘুরে আয়।

কোয়েল: ও হ্যালো! তোর বর ইউনিয়নের হেড আর এই পুরো ট্যুরের হর্তাকর্তা। তোর শ্বশুরমশাই ট্রাস্টি বোর্ডে রয়েছেন আর তুইই যাবি না? ওয়াহ ভাই ওয়াহ! তুই যেতে না চাইলেও তোকে যেতে হবে। টেনশন নট! (হেসে)

স্যার: আচ্ছা, আচ্ছা সবাই শান্ত হও। এই নিয়ে পড়ে আলোচনা করবে এবার ক্লাসে মনোযোগ দাও।

আমরা আর কথা না বাড়িয়ে ক্লাসে মনোযোগ দিলাম। পরের ক্লাস শুরু হওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই নোটিস চলে এলো। ওখানে বলা আছে সামনের সপ্তাহ অর্থাৎ সোমবার থেকে আগামী এক সপ্তাহ অর্থাৎ রবিবার অবধি ছুটি থাকবে ভার্সিটি। এই সময় যারা যারা ট্যুরে যাবে তাঁরা বাড়িতে যাবে নিজেদের লাগেজ গোছানোর জন্য আর বাদ বাকি যারা যাবে না তাদের আরো এক সপ্তাহ অর্থাৎ মোট দু সপ্তাহ ছুটি। সোমবার সকালে সবাই ভার্সিটিতে এসে মিট করবে এবং তারপর সবাই বাসে একসাথে রওনা হবে।

‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️
||পর্ব~৩৯||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা

৫৮.
মৌমিতা: কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন আপনি আমাকে? এটা তো হস্টেলের রাস্তা নয়? (ঘাবড়ে গিয়ে)

আদিত্য: তোমাকে কিডন্যাপ করেছি। (চোখ টিপ দিয়ে)

মৌমিতা: ধুর! মজা করছেন কেন? কোয়েলকে কোনো কিছু না জানিয়েই তো চলে এলাম। (মন খারাপ করে)

আদিত্য: কোয়েল জানে।

মৌমিতা: কোয়েল জানে? কিন্তু কীভাবে? (অবাক হয়ে)

আদিত্য: সবাই জানে যে ট্যুরের আগে বাড়ি যেতে হবে। তোমার বাড়ি কোনটা এটা কোয়েল ছাড়া আর কেই বা জানে?

মৌমিতা: আপনি, আপনি আমাকে আপনার বাংলোতে নিয়ে যাচ্ছেন?

আদিত্য: আমার না, আমাদের। (সামান্য হেসে)

আমি চুপ করে গেলাম ওনার কথায়। অবশ্য একদিকে ভালোই হবে, মা দেখা করতে বলেছিল সেটা হয়ে যাবে। আদিত্য গাড়ি থামালে আমি গাড়ি থেকে নেমে দরজার কাছে যাই আর কলিং বেল বাজাই। আদিত্য পাশে এসে দাঁড়ানোর কিছু সময়ের মধ্যেই মা দরজা খোলেন।

শ্বাশুড়ি মা: মৌ এসেছিস? যাক আসার সময় হলো তাহলে?

আদিত্য: ও আসেনি। আমি নিয়ে এসেছি। (আড় চোখেমৌমিতার দিকে তাকিয়ে)

আমি ওনাকে ভেংচি কেটে ভিতরে ঢুকতে গেলেই আদিত্য আমার হাত ধরে আটকে দেয় আর শ্বাশুড়ি মাকে বলেন,

আদিত্য: এমনিই ঢুকে যাবো? বরণ করবে না?

আদিত্যের প্রশ্ন শুনে আমি অবাক হয়ে ওনার দিকে একবার তাকিয়ে মায়ের দিকে তাকালে মাও ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আদিত্যের দিকে তাকান। আদিত্য ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বলেন,

আদিত্য: ইয়ে মানে হ..হরি কাকা বলছিলো তাই বললাম। এই বাড়িতে আগে মৌমিতা যতবার এসেছে ততবারই হরি কাকা আমাকে এটা বলেছে, আজ তুমি আছো দেখে মনে করলাম আর কি। (মাথা চুলকে)

শ্বাশুড়ি মা: এই ব্যাপার হরি?

হরি কাকা: না মানে… হ্যাঁ, হ্যাঁ। এই বাড়িতে বউমাকে বরণ করে তুললে খুব ভালো হয় আর কি। বাড়ির লক্ষ্মী বলে কথা, তাই বলেছিলাম। আদি বাবা বলেছিল পরে একদিন মনে করিয়ে দেবে।

শ্বাশুড়ি মা: বেশ। যা গিয়ে তৈরী করে নিয়ে আয়বরণের থালাটা।

হরি কাকা: সব তৈরীই আছে। আমি এক্ষুনি নিয়ে আসছি।

শ্বাশুড়ি মা: এক মিনিট, তৈরী আছে কীভাবে?

আদিত্য: (মনে মনে– কাম সেরেছে। হরি কাকা গো, ম্যানেজ দাও।)

হরি কাকা: ওই আদি বাবা বলে গেছিলেন আজকে বউমা কে আনবেন তাই তৈরী করে রেখেছিলাম। আমি নিয়ে আসছি।

হরি কাকা হুড়মুড়িয়ে ওখান থেকে চলে গেলেন। এতক্ষণের সব ঘটনাই আমি খুব ভালো ভাবে লক্ষ্য করেছি। যতদূর মন বলছে আদিত্যেরই কাজ এসব কারণ উনিই বলেছিলেন প্রথমদিন, পরে একদিন বরণ করে তোলার কথা। ইতিমধ্যে হরি কাকা বরণের থালা নিয়ে আসলে মা আমাদের দুজনকে একসাথে বরণ করে ঘরে তোলেন। ঘরে ঢুকে আদিত্য ফ্রেশ হতে গেলে আমি আর মা গল্প করতে থাকি। বেশ কিছুক্ষণ পর,

মৌমিতা: মা, আমি একটা কথা ভাবছিলাম।

শ্বাশুড়ি মা: হ্যাঁ, বল না।

মৌমিতা: অনেকদিন বাবা-মায়ের সাথে কথা হয় না, দেখা হয় না। এই ছুটিটা আমি আমার বাড়িতে কাটালে হয় না? (অনুরোধ করে)

শ্বাশুড়ি মা আমার কথায় বেশ চিন্তিত হয়ে পড়লেন। কিছু সময় পর উত্তর দিলেন,

শ্বাশুড়ি মা: ঠিক আছে। আগামীকাল সকালে আদি না হয় তোকে কলকাতা পৌঁছে দেবে। কেমন?

আমি খুশি হয়ে মাকে কিছু বলবো তার আগেই মায়ের পিছনে সদ্য এসে দাঁড়ানো আদিত্যর দিকে চোখ গেলো। মুখটা শুকনো লাগছে কিন্তু কেন? এই তো বেশ ঠিক ছিলেন। আমার হঠাৎ চুপ করে যাওয়া দেখে শ্বাশুড়ি মা পিছন ফিরলেন।

শ্বাশুড়ি মা: এই তো আদি, তুই আগামীকাল সকালে মৌকে একটু কলকাতায় ওর বাড়িতে পৌঁছে দিস তো। অনেকদিন ওর বাড়িতে যাওয়া হয় না। ঠিক আছে?

আদিত্য: হম।

উনি কোনোরকম মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে চলে গেলেন। শ্বাশুড়ি মা পিছন থেকে ডেকে বললেন,

শ্বাশুড়ি মা: আদি কোথায় যাচ্ছিস? খাবি তো, আয় এদিকে।

আদিত্য: আমি খাবো না মম। খিদে নেই আমার, তোমরা খেয়ে নাও।

এরপরেই ঘরের দরজা বন্ধের আওয়াজ পেলাম। শ্বাশুড়ি মা আমাকে বললেন,

শ্বাশুড়ি মা: যা মৌ, ফ্রেশ হয়ে কিছু একটু খেয়েনে। ডিনার করতে এখনও অনেক দেরী আছে।

মৌমিতা: হ্যাঁ, মা আমি যাচ্ছি। (মনে মনে- কি ব্যাপার? এরকম হঠাৎ করে মুড অফ হয়ে গেলো কেন ওনার? আমি কি কিছু ভুল…উনি আমার বাড়ি যাওয়া নিয়ে মুড অফ করলেন? তাই হবে, যায় ফ্রেশ হয়ে একটু কথা বলে আসি।)

অন্যদিকে,

আদিত্য: তোর মাথা খারাপ হয়েছে? তুই কি বলছিস তুই জানিস কোয়েল?

কোয়েল: তুমি শুধু শুধু চিন্তা করছো আদিত্যদা। আমি ঠিক সময় সোমবার সকালে পৌঁছে যাবো।

আদিত্য: কিন্তু…

কোয়েল: ওফ ওহ! এটা প্রথমবার নয় যে আমি একা যাচ্ছি কোথাও। খামোখা চিন্তা করছো তুমি।

আদিত্য: ফাইন! খেয়াল রাখবি নিজের আর ঠিক করে খাওয়া-দাওয়া করবি।

কোয়েল: আজ্ঞে। এবার আমি রাখি ফোনটা?

আদিত্য: হমম।

কোয়েল ফোন রাখলে আদিত্যও ফোন হাতে নিয়ে চিন্তিত ভাবে পিছন ফেরে।

আদিত্য: তুমি? কিছু বলবে?

মৌমিতা: আব, হ্যাঁ আসলে…

আদিত্য: ভিতরে আসো।

আমি ভিতরে গিয়ে ওনাকে জিজ্ঞেস করি,

মৌমিতা: কে ফোন করেছিল? কোয়েল?

আদিত্য: হ..হ্যাঁ। ও বাড়ি যাচ্ছে একা তাই আর কি। তুমি কি বলবে বলছিলে?

মৌমিতা: (মনে মনে– উনি কি কোয়েলের প্রসঙ্গটা এড়িয়ে যেতে চাইছেন? থাক, এই বিষয়ে আর কথা বলার এখন দরকার নেই তাহলে।) বলছি, আপনি যাবেন তো কালকে আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে?

আদিত্য: (মাথা নিচু করে) হম।

মৌমিতা: আপনার কি কালকে কোনো কাজ আছে?

আদিত্য: নাহ, কেন?

মৌমিতা: আমার কেন জানি না মনে হচ্ছে আপনার ইচ্ছা নেই আমাকে পৌঁছে দেওয়ার। তাই জিজ্ঞেস করলাম।

আদিত্য: (মনে মনে– ঠিকই ধরেছো, আমার একদম ইচ্ছা নেই তোমাকে নিজের চোখের আড়াল করার। তোমাকে এখানে নিয়ে আসার কারণ ছিল প্রতিটা মুহূর্তে তোমাকে নিজের চোখের সামনে রাখা। কিন্তু আমি ভুলে গেছিলাম তুমি চাও না সর্বক্ষণ আমাকে নিজের চোখের সামনে দেখতে।) না, তেমন কিছু না।

মৌমিতা: ত..তাহলে আপনিও তো আমার সাথে আমাদের বাড়িতে থাকতে পারেন?

চোখ মুখ খিঁচে নিজের মনের কথাটা বলেই ফেললাম। কিন্তু এবার চোখ তুলে তাকানোর সাহস হচ্ছে না। কাঁচুমাচু করে চোখ তুলে তাকাতেই দেখলাম উনি একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি চটজলদি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম,

মৌমিতা: না মানে আপনার খুব একটা অসুবিধা হবে না। আসলে বিয়ের পর আপনি অষ্টমঙ্গলাতেও তো গিয়ে থাকেননি তাই বলছিলাম।

কথা শেষ করতেই আমি নিজের হাতে ওনার হাতের স্পর্শ পেলাম। ওনার দিকে তাকাতেই দেখলাম উনি হাসি মুখে আমাকে বসার জন্য ইশারা করলেন। আমি বসতেই উনি বললেন,

আদিত্য: ঠিক আছে। আমি কালকের দিনটা থেকে পরেরদিন চলে আসবো কারণ ট্যুরের সবকিছুর আয়োজন আমাকে আর রাজকে করতে হবে। আমি না থাকলে রাজের উপর অনেক চাপ পরে যাবে। আমি আবার না হয় শনিবার দিন সকালে গিয়ে থেকে রবিবার দিন বিকেলে তোমাকে নিয়ে আসবো। চলবে?

মৌমিতা: (খুশি হয়ে) তাহলে আমি মা-বাবাকে জানিয়ে দি?

আদিত্য: অবশ্যই।

আমি খুশি হয়ে চলে আসতে নিলে আদিত্য আমার হাত আটকে বলেন,

আদিত্য: কোথায় যাচ্ছো? আজকে মা আছে তুমি আলাদা ঘরে শুলে কি ভাববে?

মৌমিতা: (চিন্তিত হয়ে) তাহলে?

আদিত্য: তোমার বাড়ি গেলেও তো আমাদের এক ঘরে শুতে হবে তাই না? আমি সোফায় শুয়ে পড়ছি, তুমি বেডে শুয়ে পরো।

মৌমিতা: আপনি সোফায় শোবেন? অসুবিধা হবে তো আপনার।

আদিত্য: আমি বেশিরভাগ সময় পড়ার টেবিলে ঘুমাই আর নাহলে সোফায়, তাই অসুবিধা হবে না। (হেসে)

মৌমিতা: (হেসে) আচ্ছা। আপনি আজকে আমাকে একটু হেল্প করবেন?

আদিত্য: ইংলিশে?

মৌমিতা: হ্যাঁ।

আদিত্য: ওকে।

৫৯.
আমাদের ছুটি শেষ। চোখের নিমিষে ছুটিটা শেষ হয়ে গেলো, বেশ ভালো কাটছিল বাবা-মায়ের সাথে সময়টা। আদিত্য ওনার কথা মতোই যেদিন গেছিলেন সেদিনও থেকেছেন আর আসার সময় একদিন থেকে নিয়ে এসেছেন। এখন বসে বসে ট্রলিতে জামাকাপড় গোছাচ্ছি আর উনি ল্যাপটপ নিয়ে বসে আছেন। এই সময় শ্বাশুড়ি মায়ের গলার আওয়াজ পেলাম।

শ্বাশুড়ি মা: ও জামাকাপড় গোছানো শুরু করে দিয়েছিস?

মৌমিতা: হ্যাঁ মা, এই তো শুরু করলাম। আগামীকাল সকালে আর সময় হবে না ঠিকঠাক মতো গোছানোর।

শ্বাশুড়ি মা: তা তোর আর আদির জামাকাপড় একসাথেই নিচ্ছিস তো?

আদিত্য মায়ের কথা শুনে ল্যাপটপ থেকে মুখ তুলে মায়ের দিকে তাকিয়ে আমার দিকে তাকালেন। আমিও ওনার দিকে তাকিয়ে আছি কি উত্তর দেওয়া উচিত এই ভেবে। উনি আমাকে চোখ দিয়ে চুপ থাকার ইশারা করে বললেন,

আদিত্য: মম আমি আর মৌমিতা একসাথে থাকবো না তাই আলাদাই লাগেজ করছি। আসলে এটা ভার্সিটি ট্যুর তো…

শ্বাশুড়ি মা: ভার্সিটি ট্যুর তো কি হয়েছে? তোরা তো স্বামী-স্ত্রী এটা এখন জানে তো সকলে তাই না? আগে না হয় প্রথম প্রথম জানাসনি, তাই বলে এতদিন পরেও কি জানাসনি নাকি?

আদিত্য: না মানে…

শ্বাশুড়ি মা: তাহলে একসাথে থাকলে অসুবিধা কি?

শ্বাশুড়ি মায়ের কথায় উনি আমার দিকে তাকালে আমি চোখ নামিয়েনি। আমার তো কিছু বলার নেই এখানে, উনিই সব রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছেন প্রথম দিনেই।

শ্বাশুড়ি মা: কি হলো চুপ করে গেলি যে? তোদের মধ্যে তো এখন সব ঠিকও হয়ে গেছে তাই না? তাহলে কেন আলাদা আলাদা থাকবি?

আদিত্য: মম প্লিজ, ওটা ট্যুর। ওখানে এরকম ভাবে থাকলে হবে না। মৌমিতা আমার সাথে থাকলে কোয়েল একা পড়ে যাবে। তাই আমি ঠিক করেছি আমি আর রাজ একসাথে থাকবো যেহেতু আমরা ট্যুরের দায়িত্বে আছি আর কোয়েল, মৌমিতা একসাথে থাকবে কারণ ওরা হস্টেলেও তো একসাথে থাকে।

শ্বাশুড়ি মা: আমি তো এটাই বুঝতে পারি না মৌমিতা এখনও কেন হস্টেলে থাকে। যাদবপুরে থেকে পড়ার ইচ্ছা তাই কলকাতাতে থাকে না বুঝলাম কিন্তু এই বাংলো তো বেশি দুর নয় ইউনিভার্সিটি থেকে, যতটা দূরত্বে হস্টেল ঠিক তাঁর উল্টো দিকে ততটা দুরত্বেই তো তোর বাংলো। তো এখানেই থাকতে পারে তাই না? এখানে থাকলে তোর সাথেই যাওয়া আসা করতে পারবে।

মৌমিতা: ক..কোয়েলের জন্য! কোয়েলের জন্যই আমি থাকি ওর সাথে, ওকে কোম্পানি দেওয়ার জন্য। আমারও ভালো লাগে, কারণ ও আমার ক্লাসমেট।

শ্বাশুড়ি মা: যা ভালো বুঝিস তোরা। আমি যাই ডিনার রেডি করি।

মা চলে গেলে আদিত্য আমার দিকে তাকান আমি সেটা উপেক্ষা করে নিজের কাজে লেগে পড়ি। আড় চোখে খেয়াল করি আদিত্যও তেমন কিছু না বলে নিজের কাজে লেগে পরেন। কি বা বলার আছে ওনার?

রাতের খাওয়া-দাওয়া সেরে আমরা তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়লাম কারণ সকাল সকাল উঠতে হবে, আদিত্য বাস ঠিক করতে যাবেন। আমার ঘুমটা বেশ ভোরেই ভেঙে গেলো। আমি উঠে ফ্রেশ হয়ে ঘরে এসে দেখলাম উনি সোফায় নেই। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আছেন একহাতে সিগারেট নিয়ে।

মৌমিতা: আপনি এত সকালে উঠেছেন কেন? সাদ সকালে বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দেওয়া হচ্ছে বুঝি? (কোমরে হাত দিয়ে)

আমাকে দেখে আদিত্য হুড়মুড়িয়ে পিছন ফিরে বললো,

আদিত্য: তুমি, তুমি কখন এলে? আমি আসলে, আসলে…

মৌমিতা: অতো আসল নকল আমি জানি না। সোজা কথা বলুন। (রেগে)

আদিত্য: আব, এটা আমার হ্যাবিট। মাথা যন্ত্রণা করলে এটার দরকার পরে। (হাতের সিগারেট দেখিয়ে)

মৌমিতা: বাহ! অসাধারণ। মাথা যন্ত্রনা করলে মানুষে কফি খায় আর উনি সিগারেট খান। আজব!

আদিত্য: (নিশ্চুপ)

মৌমিতা: (মনে মনে– সকাল সকাল এভাবে রাগ দেখানোটা ঠিক না। মানুষের অভ্যেস তো থাকতেই পারে তাছাড়া কালকে মায়ের কথাগুলো শোনার পর তেমন একটা কথা বলেননি। এখন আমার এভাবে রিয়াকট করাটা ঠিক না।) আচ্ছা যান, ফ্রেশ হয়ে নিন। (নরম ভাবে)

আদিত্য: ব..বলছি একটু ব্ল্যাক কফি করে দেবে?

মৌমিতা: রাত থেকেই যখন মাথাটা ধরেছে তখনই বলতে পারতেন তাহলে তেল মালিশ করে দিতাম। আচ্ছা আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন আমি ব্ল্যাক কফি করে আনছি।

উনি ফ্রেশ হতে গেলে আমি নিচে যাই ব্ল্যাক কফি বানাতে। রান্নাঘরে গিয়ে দেখলাম হরি কাকা উঠে গেছেন।

মৌমিতা: আপনি উঠে পড়েছেন কাকা?

হরি কাকা: হ্যাঁ আসলে তোমরা যাবে তো তাই। কর্তামা এখনও ঘুমাচ্ছেন। তোমার আর যদি বাবার জন্য কফি করে দেই আমি?

মৌমিতা: আপনাকে কিছু করতে হবে না আমি করে নিচ্ছি। আপনি যান, গিয়ে ব্রেকফাস্ট রেডি করুন সবার জন্য তাহলেই হবে। উনি আবার বেড়াবেন আরেকটু পরে।

হরি কাকা: আচ্ছা।

হরি কাকা ব্রেকফাস্ট রেডি করতে শুরু করলে আমি ওনার জন্য কফি আর আমার জন্য চা বানিয়ে নিলাম। বানিয়ে ঘরে যেতেই দেখি উনি চুপচাপ সোফায় বসে আছেন আর চুল দিয়ে জল পড়ছে। হে ভগবান! এই শীতের সকালে এভাবে চুল ভিজিয়ে বসে আছেন? ঠান্ডা লেগে যাবে তো এমন করলে?

মৌমিতা: আপনি এভাবে চুল ভিজিয়ে বসে আছেন কেন?

আদিত্য: এ..এমনিই।

উনি মাথা তুলে আমার দিকে তাকাতেই দেখলাম ওনার চোখ গুলো লাল হয়ে গেছে। ইশ! এতটা মাথা যন্ত্রনা করছে আগে টের পেলে ওনাকে এভাবে কষ্ট পেতে হতো না। আমি সঙ্গে সঙ্গে টাওয়াল নিয়ে এসে ওনার সামনে দাঁড়ালাম। উনি মাথা উঠাতেই চুলটা মুছাতে শুরু করলাম।

আদিত্য: আরে, ঠিক আছে আমি।

মৌমিতা: চুপ একদম! কোনো কথা বলবেন না।

আমি ধমক দিতেই উনি চুপ করে গেলেন। মাথা মোছাতে মোছাতে ওনার স্পর্শে তৎক্ষণাৎ শিউরে উঠলাম। অনুভব করলাম আমার কোমর দু-হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরেছেন। আমি সামান্য হেসে আস্তে করে বললাম,

মৌমিতা: মায়ের কথা নিয়ে এতো ভাবার কিছুই হয়নি। যা হওয়ার তা হয়ে গেছে এখন সেসব নিয়ে ভেবে মাথা ব্যাথা না করাই ভালো। নিন, কফিটা খেয়ে নিন।

আমি সরে এসে ওনাকে কফিটা এগিয়ে দিতেই দেখলাম উনি আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।

মৌমিতা: ঠান্ডা হয়ে যাবে তো কফিটা। জলদি কফি খেয়ে শুয়ে পড়ুন।

আদিত্য: শুয়ে পরবো? আমাকে তো বেড়াতে হবে আবার।

মৌমিতা: যেটা বললাম চুপচাপ করবেন।

জোর দিয়ে কথাটা বলে আমি উঠে গেলে উনি পিছন থেকে বললেন,

আদিত্য: কাবার্ডে একটা প্যাকেট রাখা আছে। ওটা দেখে নাও একবার।

আমি ওনার কথা মতো কাবার্ড খুলতেই প্যাকেট দেখতে পেলাম। প্যাকেট খুলে দেখলাম চুড়িদার। ঠিক যেমন চুড়িদার আমার পছন্দ তেমন। প্যান্টটা ফিটিংস আর জামাটা শর্ট যেমনটা আগে পরা হতো। আমি খুশি মনে প্যাকেটটা ঠিকভাবে রেখে পিছন ফিরতেই দেখলাম উনি সোফায় মাথা পিছন দিকে হেলিয়ে চুপচাপ শুয়ে আছেন চোখ বন্ধ করে। তাই ওনার দিকে এগিয়ে গিয়ে বাম হাতে নিয়ে ওনার মাথার পিছনে দাঁড়িয়ে আস্তে করে কপালে লাগিয়ে দিয়ে মাথার দু-পাশ ম্যাসাজ করতে শুরু করলাম। উনি আদো আদো গলায় বললেন,

আদিত্য: থ্যাংক ইউ… বউ!

থ্যাংক ইউ অবধি তো ঠিকই ছিলো কিন্তু তারপরের দু অক্ষরের শব্দটা শুনে জানো আমার শরীর দিয়ে একটা শীতল শিহরণ বয়ে গেলো। আমি যে কিছু বলবো সেটাও পারছি না, কোনো শব্দই খুঁজে পাচ্ছি না বলার মতো। বেশ কিছুক্ষণ ওনার মাথাটা টিপে দেওয়ার পর আমি গিয়ে বিছানাটা গুছিয়ে, বিছানায় বসে ওনাকে ডাকলাম শুয়ে পরার জন্য। উনি আমার ডাক শুনে উঠে এসে আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়লেন আর বললেন,

আদিত্য: আমাকে দশটা নাগাদ ডেকে দিয়ো।

আমি ঘড়িতে তাকিয়ে দেখলাম ৬টা বেজে ১০ মিনিট। ভাগ্যিস আমি তাড়াতাড়ি উঠে গিয়েছিলাম নাহলে অতো তাড়াতাড়ি ওঠার কথা ছিলো না। না উঠলে উনি কিচ্ছুটি বলতেন না আমায় আর একা একা কষ্ট পেতেন। এরপর তো আবার আরেকটা হেডেক। এসব ভাবতে ভাবতেই কখন যে ওনার চুলে হাত প্রবেশ করিয়ে ফেলেছি খেয়াল করিনি। খেয়াল হতেই দেখলাম উনি বাচ্চাদের মতো চুপটি করে শুয়ে আছেন। আমি হাত না বের করে ওনার চুলে বিলি কাটতে কাটতে বাঁ হাত দিয়ে কোয়েলকে ফোন করলাম। দেখি খোঁজ নিয়ে, কি করছে। কুম্ভকর্ণর নাতনি মনে হয় এখনও ঘুম থেকেই ওঠেনি।

চলবে।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে