‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️
||পর্ব~৩৪||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা
৫০.
সকালবেলা উঠে আমি আর কোয়েল রেডি হয়ে নিলাম ভার্সিটি যাওয়ার জন্য।
মৌমিতা: কি রে তুই রেডি তো? চল এবার।
কোয়েল: (ব্যাগ চেক করতে করতে) হ্যাঁ, হ্যাঁ চল। আমি রেডি।
আমি আর কোয়েল রুমের গেট লক করে নীচে নেমে এলাম। নিচে নেমে সামনে তাকাতেই আমি অবাক হয়ে থমকে দাঁড়ালাম। কোয়েল যেহেতু আমার পিছনে ব্যাগ চেক করতে করতে আসছিলো তাই আমার দাঁড়িয়ে যাওয়ার ফলে ও আমার সাথে ধাক্কা খেলো। বিরক্ত হয়ে আমায় জিজ্ঞেস করলো,
কোয়েল: কি রে? এভাবে হুট করে রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়লি কেন?
আমি কিছু না বলে সামনে তাকিয়ে থাকায় কোয়েলও আমার সাথে তাকালো। টাস্কি খেয়ে বললো,
কোয়েল: উরি বাবা! আজকে সূর্য কোনদিকে উঠেছে? স্বয়ং মৌ ম্যাডামের পতিদেব হস্টেলের বাইরে দাঁড়িয়ে?
মৌমিতা: চুপ কর! এতো জোরে কেন বলছিস? (রেগে)
কোয়েল আমার কোনো কথা না শুনে এগিয়ে গেলো ওনার দিকে। উনি গাড়িতে ঢেলান দিয়ে ফোনে কথা বলছিলেন অন্য দিকে ঘুরে। কোয়েল ওনার পিছনে গিয়ে দাঁড়ালে আমিও আস্তে আস্তে ওদিকে এগোই।
কোয়েল: (হালকা কাশি দিয়ে) উহ্হু উহ্হু!
কোয়েলের কাশি শুনে আদিত্য ওর দিকে ফিরে কল কেটে ফোন পকেটে ঢুকিয়ে কোয়েলকে জিজ্ঞেস করলো,
আদিত্য: কতো সময় লাগে রেডি হতে? পাক্কা ৩০ মিনিট ধরে আমি এখানে দাঁড়িয়ে আছি। ১১টায় ভার্সিটি পৌঁছনোর কথা সেখানে এখানেই ১১টা বাজে। (বিরক্ত হয়ে)
মৌমিতা: আসলে…
কোয়েল: (মৌমিতাকে আটকে) তা আপনি এখানে কেন শুনি? আগে তো কোনোদিন এভাবে দাঁড়িয়ে থাকা হয়নি। ইনফ্যাক্ট আমি যা জানতাম মিস্টার আদিত্য ব্যানার্জী কাওর জন্য কখনও অপেক্ষা করেনা তাহলে? তাহলে আজ এমন কি ব্যাপার হলো? হম, হম? (ভ্রু কুঁচকে)
কোয়েলের কথা শুনে উনি ঠোঁট কামড়ে হেসে আমার দিকে তাকালেই আমি চোখ নামিয়ে নেই আর উনি কোয়েলকে বলেন,
আদিত্য: সময় ও পরিস্থিতি মানুষকে বদলে দেয়, আদিত্য ব্যানার্জীকেও বদলে দিয়েছে। অনেক কিছু শিখিয়ে দিয়েছে কারণ আদিত্য ব্যানার্জী কখনও কোনো কিছুতে ভয় পেতো না কিন্তু আজ সে হারানোর ভয় পায়। বুঝলি? (কোয়েলের মাথায় টোকা মেরে)
কোয়েল: বাহবা! (টঁন্ট করে)
মৌমিতা: চল তো। দেরী হয়ে যাচ্ছে। (লজ্জায় আমতা আমতা করে)
কোয়েল মুচকি হেসে যখন দেখলো আদিত্য গাড়িতে ওঠার জন্য ঘুরছে তখনই সঙ্গে সঙ্গে জিজ্ঞেস করলো,
কোয়েল: তা আপনার প্রেতাত্মাটা কোথায়? তাকে দেখছি না তো।
কোয়েলের প্রশ্ন শুনে আদিত্য এমন একটা রিয়াকশন দিলেন যাতে বোঝা যাচ্ছে উনি কি বলবেন বুঝতে পারছেন না। কিছুক্ষণ চোখ ফরফর করে জিজ্ঞেস করলেন,
আদিত্য: প্রেতাত্মা কে?
কোয়েল: (জোরে হেসে দিয়ে) বুঝলেন না? অবশ্য ব্রহ্মদৈত্য বলিনি তো তাই বুঝতে পারেননি।
এইবার আদিত্যও হেসে ফেললেন। আমি যতদূর আন্দাজ করেছি কোয়েল রাজদার কথা বলছে। তাই আমিও হালকা হাসলাম আর আদিত্য উত্তর দিলেন,
আদিত্য: আমি তো জানতাম জমরাজ তার নাম তাই বুঝতে পারেনি। তা তুই কবে থেকে জমরাজের খোঁজ রাখছিস? কিছুদিন আগে মনে হয় শুনে ছিলাম ওর খোঁজ রাখার, ওর ব্যাপারে জানার কোনো দরকার নেই তাহলে? তাহলে আজ কি এমন ব্যাপার হলো? হম, হম? (কোয়েলের নকল করে)
কোয়েল: (মুখ কাঁচুমাচু করে) ধুর, ভালো লাগে না।
এটুকু বলেই কোয়েল আর এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে গাড়িতে ঝটপট উঠে পড়লো। কোয়েল গাড়িতে উঠতেই আমি আর আদিত্য মুখ চাওয়া-চাওয়ি করে হেসে ফেললাম। এরপর আমি গাড়িতে উঠতে গেলেই আদিত্য পিছন থেকে আমার হাত টেনে ধরে পিছনে নিয়ে আসলে আমি ওনার হাতের দিকে একবার তাকিয়ে ওনার মুখের দিকে তাকালাম। উনি বললেন,
আদিত্য: সামনে বসবে, আমার পাশে। আমি গাড়ির ড্রাইভার নই (কিছুক্ষণ থেমে) মেয়েদের মনের ড্রাইভার!
কথাটা শুনে আমি ওনার দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকাতেই উনি হেসে দিলেন। আমি ভেংচি কেটে মুখ ফিরিয়ে নিতেই উনি বললেন,
আদিত্য: অন্য সবার মতে মেয়ে”দের” মনের ড্রাইভার হলেও, আমার মতে আমি একটি মেয়ের মনের ড্রাইভার। (কানে কানে)
উনি হঠাৎ করেই আমার এতো কাছে এসে আমার কানে কানে কথাটা বললেন যে, ওনার নিশ্বাস আমি অনুভব করতে পারলাম।
কোয়েল: কি রে? দাঁড়িয়ে আছিস কেন এভাভে একা একা?
গাড়ি থেকে কোয়েলের ডাকে হুঁশ আসায় পাশে তাকিয়ে দেখলাম উনি গাড়িতে বসছেন ঠোঁটে মৃদু হাসি ধরে রেখে। আমি মাথাটা একটু ঝেড়ে নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম।
আদিত্য: (ড্রাইভে করতে করতে মনে মনে– কোয়েলের কাছে এখন তো এড়িয়ে গেলাম কিন্তু কতক্ষন এড়াতে পারবো বিষয়টা? জানতে পারলেই তো….বাপ রে! ভাবলেই তো আমার শরীরের জল শুকিয়ে যাচ্ছে সব।)
কোয়েল: (ফোনের দিকে তাকিয়ে মনে মনে– আদিত্যদা কি এড়িয়ে গেলো বিষয়টা? তাই তো মনে হচ্ছে। কেমন জানো খটকা লাগছে।)
৫১.
ভার্সিটিতে পৌঁছে সঙ্গে সঙ্গে ক্লাসের জন্য ছুট দিয়েছিলাম আমি আর কোয়েল। কারণ সত্যি আজকে লেট হয়ে গেছিলো। ভাগ্যিস আদিত্য গাড়ি করে পৌঁছে দিয়েছিলেন নাহলে ক্লাসটা মিস হয়ে যেতো। আজকে পরপর ক্লাস থাকায় কোয়েল আমাকে বললো,
কোয়েল: আজকে পর পর সব ইম্পরট্যান্ট ক্লাস। ধুর, বাংক মারাও যাবেনা যা মনে হয়। কারণ ম্যাডামেরা তো ক্লাস কখনও মিস করেন না।
মৌমিতা: যা বলেছিস। আচ্ছা কোয়েল, অনেকদিন তো হলো অঙ্কিত কোথায় বল তো? ওর তো কোনো খোঁজই নেই।
কোয়েল: (গম্ভীর ভাবে) হম।
মৌমিতা: কি হম? তুই কিছু জানিস না?
কোয়েল: (কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে) যতদূর জানি অঙ্কিতের মুড ভালো নেই। হয়তো কোথাও গেছে, একা সময় কাটাতে। ছাড় বাদ দে, চল ক্লাসে যেতে হবে।
কোয়েল এগিয়ে গেলে আমার একটু বিষয়টা অবাক লাগে। আজকাল অঙ্কিতের কথা বললেই কোয়েল কোনো না কোনো ভাবে এড়িয়ে যাচ্ছে বিষয়টা। কি ব্যাপার? কি লুকাচ্ছে আমার থেকে? আমি আর কিছু না ভেবে এগোতে নিলেই পিছন থেকে কেউ আমার নাম ধরে ডাকে,
__মৌমিতা?
মৌমিতা: (পিছন ফিরে) জিয়া! তুই এখানে?
জিয়া: (মৌমিতার সামনে দাঁড়িয়ে) হ্যাঁ, কারণ এটা আমারও ভার্সিটি।
মৌমিতা: হ্যাঁ, সে তো অবশ্যই। তা হঠাৎ আমাকে ডাকার প্রয়োজন পড়লো?
জিয়া: সে কি রে, তোকে ডাকবো না তো আর কাকে ডাকবো? একটা মিডল ক্লাস মেয়ে এসে হুট করে ভার্সিটির বড়োলোকের ছেলের জীবনে উড়ে এসে জুড়ে বসলো তার গার্লফ্রেন্ড থাকা সত্বেও। এখন তার সাথে দিনরাত ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাকে ডাকবো না তো কাকে ডাকবো?
মৌমিতা: (রাগ সংযত করে) কি বলতে চাইছিস?
জিয়া: এটাই যে আদির পিছন ভালোয় ভালোয় ছেড়ে দে নাহলে এর পরিণাম ভালো হবে না। আদিকে আমি ভালোবাসি আর আদি আমাকে সেই স্কুল লাইফ থেকে। তুই মাঝখান থেকে থার্ড পারসন হওয়ার চেষ্টা করিস না।
আমি কিছু বলতে গিয়ে জিয়ার পিছন দিকে তাকিয়ে থেমে গেলাম। এতক্ষনে কোয়েল আমাকে ওর পাশে না পেয়ে আবার ফিরে এসেছে। আমার কোনো উত্তর না পেয়ে কোয়েলকে আমার পাশে এসে দাঁড়াতে দেখে জিয়া কোয়েলকে বললো,
জিয়া: তোর সো কলড বেস্ট ফ্রেন্ডকে সামলে রাখ। ও বামন হয়ে চাঁদের দিকে হাত বাড়াচ্ছে। ও না জানলেও, তুই তো ভালো করেই জানিস আমার বাবা কে আর কি করতে…
__হ্যাঁ, হ্যাঁ তোর বাবা একজন বিখ্যাত স্মাগলার। স্মাগলারগিরি আর দুর্নীতি করে নিজের ক্ষমতা জাহির করে। তোর বাবার কতো ক্ষমতা, সে কে, কি করতে পারে কালকেই জেনে গেছে পুরো ভার্সিটি।
জিয়া: আদি! (জোরে)
আদিত্য: (কানে হাত দিয়ে) আস্তে কথা বল। আদিত্য ব্যানার্জীর সাথে উঁচু গলায় কথা বলার অধিকার বা সাহস কাওর নেই। আমি তোর সামনেই দাঁড়িয়ে আছি আর কানে খুব ভালো শুনতে পাই। ওকে? (পিঞ্চ করে)
জিয়া: এভাবে সবার সামনে তুমি আমাকে অপমান করছো? কিভাবে আমি তো তোমার…
আদিত্য: কেউ না! তুই আমার কেউ না। (সোজাসুজি)
জিয়া: কি? (ছলছল চোখে)
আদিত্য: বিশ্বাস কর, আমার মনে পড়ছে না আমি কবে তোর প্রপোজাল একসেপ্ট করেছিলাম। নিজের বাবার ক্ষমতায় তুই সবার উপর নিজের ধারণা চাপিয়ে বেড়াতিস কিন্তু এখন আর সেটা চলবে না। তুই আমার জুনিয়র, এটুকুই সম্পর্ক আমার তোর সাথে, গট ইট?
মৌমিতা: (মনে মনে– উনি এটা কি করছেন? এভাবে নিজের বিপদ নিজে কেন ডেকে আনছেন এই সময়। জিয়ার বাবা এমনিতেই রেগে আছেন তার মধ্যে এখন যদি জিয়ার সাথে এমন ব্যবহার করেন তাহলে তো আরো বিপদ বাড়বে। আমাকে তখন হাত দেখিয়ে চুপ করতে বললেন, ওনার কথা ভেবে আমি চুপ করে গেলাম আর এখন উনি নিজেই…)
আদিত্য: কান খুলে শুনে রাখ জিয়া, আজকের পর থেকে মৌমিতাকে অপমান করার কথা মাথাতেও আনবি না। শুধু মৌমিতা কেন? এই ভার্সিটির কোনো স্টুডেন্টকে অপমান করার কথা তুই ভাববি না।
আদিত্য পিছন ঘুরে গেলেন হুট করে আর সবার উদ্দেশ্যে জোরে চেঁচিয়ে বললেন,
আদিত্য: এই কথাটা সবার উদ্দেশ্যে। কাউকে কোনো রকম অপমান, র্যাগিং জানো না করা হয়।
__নিজের বাবাকে ভার্সিটির বোর্ড অফ মেম্বার করে খুব জোর দেখাচ্ছিস বল?
জিয়ার পাশ থেকে সৌভিকদা কথাটা বলতেই আদিত্য পিছন ফিরে ওনার দিকে তাকালেন। উনি নিজের শার্টের হাতা গোটাতে গোটাতে শুরু করে আবার বললেন,
সৌভিক: জিয়া যদি নিজের বাবার ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাহলে তুই কি করছিস? তুইও তো একই কাজ করছিস।
আদিত্য: (সৌভিকের হাতা গোটানো টা দেখে হেসে বললো) জিয়ার হয়ে চামচাগিরি করার জন্য ওর বাবা তোকে কত টাকা দেয়? এখন আর এই বাড়াবাড়ি টা করতে যাস না, ফল ভালো হবে না।
সৌভিক: (চোয়াল শক্ত করে) কেন? কি করবি তুই? মারবি আমাকে? তার আগে তোক….
সৌভিকদা এগিয়ে গিয়ে ওনার কলার ধরবে ঠিক ওই মুহূর্তে রাজদা সৌভিকদার হাতটা ধরে ফেলে। আদিত্য রাজের দিকে না তাকিয়ে সৌভিকদার দিকে তাকিয়ে হালকা হাসে যখন রাজদা কে দেখে সৌভিকদা ভয়ভীত চোখে আদিত্যের দিকে তাকায়। কেন জানি না সেই মুহূর্তেই কোয়েল আমার হাতটা শক্ত করে চেপে ধরে আর বলে,
কোয়েল: রাজকে আটকাতে বল মৌ। (ভয়ে ভয়ে, কাঁপা গলায়)
আমি কোয়েলের কথা শুনে ওনাদের দিকে তাকালাম। এমন পরিস্থিতিতে কি বলবো বুঝতে পারছি না। এখনও রাজদা সৌভিকদার হাত ছাড়েনি বরং আরো শক্ত করে ধরেছে। ওনার মুখ দেখলেই বোঝা যাচ্ছে উনি রেগে আছেন। আস্তে আস্তে আদিত্যদার পিছন থেকে পুরোপুরি ওনার পাশে এসে দাঁড়িয়ে সৌভিকদাকে বললেন,
রাজ: তুই হয়তো জানিস না আমি এসে গেছি, সেই জন্যই এই হাতটা আদির দিকে উঠেছে। আর তোর এই না জানার ফলে তোর এই হাতটা নাও থাকতে পারে এটা কি জানিস? (দাঁতে দাঁত চেপে)
আদিত্য: ছেড়ে দে রাজ। রণিতের অবস্থার কথা ও ভুলে গেছে মনে হয়। (রাজের হাতের উপর হাত রেখে)
রাজদা আদিত্যের কথা শুনে একবার কোয়েলের দিকে তাকালেন হয়তো আদিত্য কোনো ইশারা করেছিলেন। তারপর বাঁকা হেসে সৌভিকদার হাত ছেড়ে দিলে আদিত্য বলেন,
আদিত্য: কেন বেকার বেকার নিজের বিপদ নিজে ডাকছিস? জানিসই তো আমি যদি ধরি তাহলে শেষ পর্যন্ত না দেখে ছাড়ি না। (এক গালে হেসে)
রাজ: এরপরের বার তুই ধরিস বা আমি ছাড়া ও পাবে না। কথাটা মাথায় রাখতে বলিস ওকে।
কথাটুকু বলে রাজদা বেরিয়ে গেলো হনহন করে। আমি কোয়েলের দিকে তাকাতেই দেখলাম ও জানো হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। আমি আদিত্যের কথা শুনে আবার ওনাদের দিকে তাকালাম।
আদিত্য: (সৌভিকের কলার ঠিক করে) দেখ, আমি কোনো পাওয়ার ইউস করছি না। জিয়া যেই অ্যাডভান্টেজটা নিতো আমি সেটার শেষ করেছি জাস্ট। আমি চাই ভার্সিটিতে সবাই মিলে মিশে থাকবে দ্যাটস ইট! আশা করি বুঝে গেছিস। (সবাইকে উদ্দেশ্য করে) সবাই বুঝেছে তো?
সবাই হ্যাঁ বোধক মাথা নাড়লে আদিত্য সবাইকে যেতে বলে আর জিয়া তৎক্ষণাৎ ওখান থেকে চলে যায়। ওকে যেতে দেখে সৌভিকদাও ওর পিছনে চলে যায়। সবাই এক এক করে চলে যেতে শুরু করে, আমি কোয়েলের দিকে তাকিয়ে রাজদার যাওয়ার দিকে ইশারা করলে কোয়েলও সায় দিয়ে চলে যায় সেদিকে। আমি আদিত্যের কাছে এগিয়ে যাই, উনি আমাকে এগোতে দেখে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করে কি হয়েছে। আমি ওনার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করি,
মৌমিতা: আপনি এমনটা কেন করলেন?
আদিত্য: কি করলাম?
মৌমিতা: এভাবে জিয়াকে সবার সামনে অপমান কেন করলেন? এটা যদি পরেশবাবু জানতে পারেন তাহলে তো আপনার ক্ষতি করতে চাইবেন। আপনার তো জিয়াকে হাতে রাখার কথা ছিলো তাহলে…
আদিত্য: (মৌমিতার দিকে এগিয়ে) আস্তে আস্তে। এরকম রাজধানী এক্সপ্রেসের মতো ছুটছো কেন? আমি পালিয়ে যাচ্ছি না আর যাবোও না। তোমার কাছেই আছি, থাকবো।
ওনার কথাটা শুনে দমে গেলাম। চোখ নামিয়ে নিয়ে হাত কচলাতে থাকলে উনি এক পা পিছিয়ে গিয়ে বললেন,
আদিত্য: আজকে সকালেই তো বললাম, সময় ও পরিস্থিতি মানুষকে বদলে দেয়। আমাকেও দিয়েছে। আগের মতো পরিস্থিতি থাকলে হয়তো আমি এতো তাড়াতাড়ি এই স্টেপটা নিতামই না, জিয়াকে অপমান করা তো দূরের কথা। আর রইলো বাকি বিপদ, ক্ষতির কথা? ও বুঝে নেবো, কি বা করবে মারতে চাই..
মৌমিতা: আদিত্য! আজে বাজে কথা বলা বন্ধ করুন। এতো ইসিলি কথাগুলো বলছেন জানো আপনার জন্য কেউ চিন্তাই করে না? যারা আপনার জন্য চিন্তা করে তাদের কথাটা একটু ভাবুন। (একনাগাড়ে)
আদিত্য: (স্থির চোখে, শান্ত গলায়) কে চিন্তা করে আমার?
মৌমিতা: (আমতা আমতা করে) আমি আপনার বাবা-মা, রাজদা আ..আর কোয়েলের কথা ব..বলছিলাম।
আদিত্য: আর তুমি? (কৌতূহলটা বুঝতে না দিয়ে শান্ত ভাবে)
আমি ওনার কথা শুনে চোখের দিকে তাকাতেই সেই মায়ায় আটকে গেলাম। মন বলছে বলে দি যে, হ্যাঁ আমি আপনার চিন্তা করি! কারণ আপনি না মানলেও আমি আপনাকে নিজের স্বামী বলে মানি। কিন্তু কোথাও একটা গিয়ে আটকে গেলাম, হয়তো ওনার আমাকে অস্বীকার করায়। আমি চুপ করে থাকলে আদিত্য একটা তাচ্ছিল্য হাসি দেয় আর আস্তে আস্তে পিছতে শুরু করেন। উনি চলে যান! আর আমি স্থির ভাবে দাঁড়িয়ে থাকি।
অন্যদিকে,
সৌভিক: জিয়া, জিয়া! আমার কথাটা শোন। এরকম পাগলামি করিস না।
জিয়া ঘরের সব জিনিস এক এক করে ভাঙছে ভার্সিটি থেকে ফিরে। সৌভিক হাজার আটকানোর চেষ্টা করেও যখন পারলো না তখন কাছে গিয়ে জিয়ার বাহু দুটো শক্ত করে ধরে ঝাঁকিয়ে বললো,
সৌভিক: শান্ত হ তুই! শুধু কি তোর রাগ হচ্ছে আমার হচ্ছে না?
জিয়া: কি শান্ত হবো হ্যাঁ? আজ সবার সামনে আদি আমাকে ওই মিডিল ক্লাস মেয়েটার জন্য অপমান করেছে। ছাড়বো না, কাওকে ছাড়বো না আমি। সব শেষ করে দেবো, তারপর নিজেকে শেষ করে দেবো।
সৌভিক: শাট আপ! কি সব আজে বাজে কথা বলছিস? তোকে কিচ্ছু করতে হবে না। যা করার আমরা করবো! তুই চিন্তা করিস না।
__সৌভিক ঠিকই বলেছে মামনি! তোমাকে চিন্তা করতে হবে না। যা করার আমরা করবো। আদিত্য ব্যানার্জী এবার হারে হারে টের পাবে। ও যে সাপের গর্তে হাত ঢুকিয়েছে, ছোবল তো খেতেই হবে!
‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️
||পর্ব~৩৫||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা
৫২.
কোয়েল রাজের পিছু নিয়ে এসে দেখলো রাজ ভার্সিটির বাইরে নিজের গাড়ির উপর এক হাত রেখে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষন আগের ঘটনার কথা মনে পড়তেই কোয়েল একটা শুকনো ঢোঁক গিললো আর ধীর পায়ে এগোতে লাগলো। রাজের পিছনে দাঁড়িয়ে বড়ো একটা নিশ্বাস নিয়ে রাজের কাঁধে হাত রাখলে রাজ মাথা তুলে কোয়েলের দিকে ফেরে। কোয়েলকে দেখে রাজ পকেটে হাত গুঁজে গাড়ির সাথে ঢেলান দিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে থাকে, সেই দেখে কোয়েল প্রশ্ন করে,
কোয়েল: এতক্ষন কোথায় ছিলে তুমি? আর আদিত্যদা এটা কি করলো? এভাবে জিয়াকে সবার সামনে অপদস্ত করার ফলে তো পরেশবাবু আরো ক্ষেপে যেতে পারেন। তখন কি…
রাজ: সৌভিক এর আগে কবার তোর সাথে কথা বলার বাহানায় তোকে ছোঁয়ার চেষ্টা করেছে?
কোয়েলকে বলতে না দিয়ে রাজ হঠাৎই হিম কণ্ঠে নিজের চাহুনি স্থির রেখে যেই প্রশ্নটা করলো সেটা কোয়েলকে ঘাবড়ে দিলো পুরোপুরি। কোয়েল কি উত্তর দেবে ঠিক করতে পারছে না ঠিক সে সময় রাজ আবার বললো,
রাজ: কিছু জিজ্ঞেস করেছি আমি?
কোয়েল: না, আমাকে কিছু করেনি। মৌকে প্রথম দিন থেকে ডিস্টার্ব করছিল জিয়ার সাথে…
রাজ: (কোয়েলের চোখের দিকে তাকিয়ে) মৌমিতা আসার আগে?
কোয়েল এবার মাথা নামিয়ে নিলো। কোয়েল জানে সে বেকার মিথ্যে কথা বলছে রাজকে কারণ রাজ সবই জানে। হুট করে চলে গেছিলো ঠিকই কিন্তু খোঁজ রাখেনি তা নয়। সব সময়ই খোঁজ রাখতো তা কোয়েল নিজেই জানতে পেরেছে এছাড়া আদিত্য তো ছিলোই খোঁজ দেওয়ার জন্যে। তাই সৌভিক কতবার কোয়েলকে বিরক্ত করেছে সেটাও রাজের জানার কথা। এটা কোয়েলের ধারণা, কোয়েল জানে না রাজের সম্পর্কে আদিত্যও কিছু জানতো না। সব বুঝেও কোয়েল মিথ্যেটা বলতে চাইছিলো কারণ এখন এমনিতেই রাজ সৌভিকের উপর রেগে আছে তার উপর কোয়েল সব সত্যি বলে দিলে আরো খারাপ হতে পারে বিষয়টা। কিন্তু শেষরক্ষা হবে বলে মনে হচ্ছে না আপাতত কোয়েলের। কোয়েল রাজের মুখের দিকে তাকালে দেখলো রাজ এখনও একভাবে ওর দিকে তাকিয়ে আছে,
কোয়েল: এখন এই নিয়ে কথা বলাটা কি জ…
কোয়েল রাজের চোখের দিকে তাকিয়ে আটকে গেলো। প্রত্যেকবার এমনই হয়, সে আটকে যায় ছেলেটার চোখে। মন চায় না তখন কিছু লুকোতে। বেশিরভাগ সময় ছেলেরা মেয়েদের চোখে আটকায় কিন্তু কোয়েলের ক্ষেত্রে বিষয়টা উল্টো। আর না পেরে বলেই দিলো সে,
কোয়েল: তুমি চলে যাওয়ার পরেই বিরক্ত করা শুরু করেছিল। ও ভার্সিটিতে ফাস্ট ইয়ারে থাকলেও আমার স্কুল থেকে ফেরার সময় রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতো। আমি এড়িয়ে যেতে গেলে একদিন হাত ধরেছিল আর আমি চড় মেরে দিয়েছিলাম। তারপর থেকে ও কিছু ক্ষতি করতে পারে এই ভেবে আমি আদিত্যদাকে আনতে যেতে বলেছিলাম আমায় কিন্তু কিছুদিন পর থেকে দেখলাম সৌভিকদা আদিত্যদার সাথে আসতে শুরু করলো। আদিত্যদার চোখের আড়ালে আমাকে ছোঁয়ার চেষ্টা করেছিল ঠিকই কিন্তু পারেনি।
কোয়েল কথা শেষ করতেই রাজ কোয়েলের দিকে সরু দৃষ্টিতে তাকালে কোয়েল মুখ কাঁচুমাচু করে আমতা আমতা করতে করতে বললো,
কোয়েল: ইয়ে মানে প্রথমবার আদিত্যদার থেকে আড়ালে হাত ধরে ছিল তারপর থেকে আমি সতর্ক থাকায় কিছু করতে পারেনি। (মনে মনে– জমরাজ একটা! বলিয়েই ছাড়লো। হুহ!)
রাজ কোয়েলের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিজের সানগ্লাসটা পরে নিয়ে কোয়েলকে বললো,
রাজ: ভার্সিটি যা। ক্লাস আছে তো?
কোয়েল: তুমি কোথায় যাচ্ছো?
রাজ: কাজ আছে।
রাজের মুড ভালো নেই বুঝে কোয়েল রাজের হাত ধরে বাঁধা দিলো। রাজ কোয়েলের দিকে তাকালে রাজের চোখ থেকে সানগ্লাসটা খুলে নিয়ে কোয়েল বললো,
কোয়েল: কাওকে মারতে ধরতে যেতে হবে না। আমার সাথে ভার্সিটি চলো, গল্প করবো।
রাজ: আমি এখানে থেকে গেলেই তুই যেই জিনিসটা নিয়ে ভয় পাচ্ছিস সেটা হবে। তাই আমার চলে যাওয়াটাই ভালো হবে। এই পরিস্থিতিতে আমি নিজের মাথাটা ঠান্ডাই রাখতে চাই যেটা সৌভিককে দেখলে সম্ভব নয়। (কোয়েলের হাতের উপর হাত রেখে) তুই যা।
কোয়েল: তাহলে আদিত্যদা এমনটা করলো কেন?
রাজ: মৌমিতার পছন্দ না তাই। আগের দিন মে বি মৌমিতার কথার দ্বারা আদি বুঝেছিল যে, জিয়াকে এভাবে ইউস করাটা মৌমিতার পছন্দ না। এছাড়া আদিরও ভালো লাগে না, অন্য সময় হলে ব্যাপারটা আলাদা ছিল।
কোয়েল: মৌকে এই বিষয়টা আমার বলা উচিত তাই না? তাহলে ওদের মধ্যে দূরত্বটা আরেকটু কমবে। (উত্তেজিত হয়ে),
রাজ: একদমই না। মৌমিতা নিজে ফীল করুক যে আদি ওকে ভালোবেসে বদলে গেছে। তাহলেই ওদের মধ্যে দূরত্বটা কমবে। যেমন আদি নিজে থেকে ফীল করেছিলো, শুধু বুঝতে পারছিল না ফিলিংসটা কি? তখন আমি হেল্প করেছি। খুব তাড়াতাড়ি মৌমিতাও এই পজিশনে আসবে, তখন তুই বলিস। আসছি।
কোয়েল: কোথায় যাচ্ছো সেটা তো বলো? ওই টিনা ফিনার কাছে নাকি? (সরু চোখ করে)
এতক্ষনে রাজের ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। বাঁকা হেসে উত্তর দিলো,
রাজ: হ্যাঁ।
কোয়েল: কি? (জোরে, রেগে)
রাজ: (অবাক হয়ে) কাম ডাউন কোয়েল। ও আর আমি এক অফিসে কাজ করি তাই বললাম কথাটা।
কোয়েল: সেই জন্যই এতো অফিস যাওয়ার তাড়া। কালকেও তাড়াহুড়ো করে গেলে আর আজকে সকালে আদিত্যদার সাথে এলে না। আসছি!
কোয়েল এক মুহূর্ত না দাঁড়িয়ে হনহনিয়ে পিছন দিক ফিরে হাঁটা শুরু করলো। রাজ তো বেকুবের মতো দাঁড়িয়ে আছে, বুঝেই উঠতে পারলো না ব্যাপারটা কি হলো, রানিং কি বলে গেলো কোয়েল। বুঝে উঠে সঙ্গে সঙ্গে চেঁচিয়ে বললো,
রাজ: বিকেলে নিতে আসবো। (হেসে)
রাজের কথাটা শুনে কোয়েল দাঁড়ালো কিন্তু রাজের দিকে ফিরলো না। আবার হাঁটা শুরু করলো, রাজকে বোঝালো সে শুনেছে। রাজ সামান্য হেসে সানগ্লাসটা পড়তে গেলে দেখলো ওটা নেই। থাকবে কি করে? ওটা তো কোয়েল নিয়ে চলে গেছে। রাজের আর কি করার, ও চুপচাপ চলে গেল ওখান থেকে।
৫৩.
আমি এদিক ওদিক কোয়েলকে খুঁজছি এমন সময় আমার ফোন বেজে উঠলো। আমি ফোন ব্যাগ থেকে বার করতেই দেখলাম শ্বাশুড়ি মা ফোন করেছেন।
মৌমিতা: হ্যাঁ মা, বলুন।
শ্বাশুড়ি মা: কি আর বলবো? আমার আর কিছু বলার নেই।
মৌমিতা: কেন মা? কি হয়েছে? (ঘাবড়ে গিয়ে)
শ্বাশুড়ি মা: তুই জানিস না? আমি যে কদিন ধরে এখানে আছি তা টের পেয়েও তুই একবারও দেখা করতে এলি না আমার কাছে। (মন খারাপ করে)
মৌমিতা: (জিভ কেটে) আসলে মা, পড়ার চাপটা একটু বেশি তো তাই যেতে পারিনি। খুব তাড়াতাড়ি যাবো আর গিয়ে দেখা করে আসবো।
শ্বাশুড়ি মা: থাক, থাক। আর বাহানা দেওয়া লাগবে না। একদিন একটু সময় করে আসিস, কতদিন কথা হয় না ঠিক মতো তোর সাথে।
মৌমিতা: (হেসে) আসবো। ঠিক মতো খাওয়া-দাওয়া করছেন তো আপনি?
শ্বাশুড়ি মা: হ্যাঁ। তুই?
মৌমিতা: করছি মা। আচ্ছা আমি এখন রাখি? ক্লাসে যেতে হবে।
শ্বাশুড়ি মা: ঠিক আছে।
আমি ফোন রেখে কোয়েলের দিকে তাকালাম। কথা বলার মাঝখানেই কোয়েল আমার সামনে এসে দাঁড়িয়ে ছিলো। কোয়েলের হাতে একটা সানগ্লাস দেখে আমি জিজ্ঞেস করলাম,
মৌমিতা: এটা কার?
কোয়েল: জমরাজের। আবার কার?
মৌমিতা: (হেসে) তুই নিয়ে এসেছিস কেন?
কোয়েল: আরে ভুল করে। যাই হোক, চল ক্লাসের জন্য লেট হচ্ছে।
আমরা ক্লাসে চলে গেলাম। কিন্তু ক্লাস শুরু হওয়ার কিছুক্ষন পর থেকেই হঠাৎ করে কোয়েল অন্যমনস্ক হয়ে গেলো। মাঝে একবার ফোন চেক করেছিল, তারপর থেকেই এমন করছে। বার বার করে টাইম দেখছে জানো ওর কোনো কিছুর তাড়া। রাজদার কি কিছু হলো? না, সেটা হলে তো কোয়েল আমাকে বলতো। তাহলে কি এমন ব্যাপার? এই করতে করতেই ক্লাস শেষ হওয়ার ঘন্টা পড়লো। আমি বেরিয়ে কোয়েলকে কিছু জিজ্ঞেস করবো তার আগেই কোয়েল আমাকে বলে উঠলো,
কোয়েল: মৌ, তুই চলে যা। আদিত্যদা ওয়েট করছে তোর জন্য। আমার একটু কাজ আছে, আমি আসছি।
মৌমিতা: কি কাজ?
কোয়েল: পরে বলবো। আসছি আমি।
মৌমিতা: রাজদা ঠিক আছে তো?
কোয়েল: হ্যাঁ, ও ঠিক আছে।
কোয়েল চলে গেলো হুরপার করে। আমিও বাইরের দিকে হাঁটা ধরলাম। মাথার মধ্যে অনেক কিছু ঘুরছে কিন্তু কিছুতেই হিসেব মেলাতে পারছি না। কেন জানো মনে হচ্ছে আমি জানি কোয়েল কোথায় গেল কিন্তু সিওর হতে পারছি না। এইসব ভাবতে ভাবতেই আদিত্যের গাড়ির সামনে পৌঁছে গেলাম। উনি আমাকে চিন্তিত দেখে জিজ্ঞেস করলেন,
আদিত্য: কি হয়েছে?
মৌমিতা: হম? না, কিছু না।
আদিত্য: কোয়েল কোথায়?
মৌমিতা: জানি না। বললো কি একটা কাজ আছে। আমাকে তো চলে যেতে বললো আপনার সাথে।
আদিত্য: ওহ বুঝে গেছি। (হেসে)
মৌমিতা: কি বুঝেছেন? (গম্ভীর ভাবে)
আদিত্য: রাজ আসবে ওকে নিতে আবার কি? (হেসে)
মৌমিতা: সত্যি কি শুধু তাই? (আনমনে)
আদিত্য: তা নয় তো কি। আমিও যেমন চিন্তা করি রাজও তেমন চিন্তা করে…
আদিত্যের কথা শেষ হওয়ার আগেই আমি ওনার দিকে সরু দৃষ্টিতে তাকালে উনি আমতা আমতা করে বলেন,
আদিত্য: কোয়েলের! আমিও যেমন কোয়েলের চিন্তা করি, রাজও করে। সেটাই বলছিলাম। চলো, পৌঁছে দি তোমায়।
আমি হেসে ফেললাম উনি পিছন ঘুরতেই। কিন্তু ভার্সিটির দিকে তাকাতেই আবার চিন্তা হতে লাগলো। কেন জানো একটা খটকা লাগছে।
আদিত্য: আসবেন তো ম্যাডাম? কতক্ষন ওয়েট করিয়ে রাখবেন ড্রাইভারকে?
মৌমিতা: উফ! অসহ্য।
আমি গাড়িতে বসলে উনি গাড়ি স্টার্ট করেন আর আমি সকালে মায়ের ফোন করার কথা ওনাকে বলতে শুরু করি।
অন্যদিকে,
রাজ: ক্লাস শেষ হয়েছে অনেক্ষন হয়ে গেলো। মানছি আমি ১৫ মিনিট লেট করেছি বাট ওর মধ্যে ও বেরিয়ে গেছে? আমার আগে বেরিয়ে যদি থাকে তাহলে তো আমাকে ফোন করতো, সেটাও তো করেনি। তাহলে কি বেরোয়নি এখনও? ওহ, ম্যাডামের তো আবার লাইব্রেরিতে সময় কাটানোর অভ্যেস। ওখানেই আছে নিশ্চিত তাই জন্যেই ফোন সাইলেন্ট।
রাজ গাড়ির সামনে অনেক্ষন অপেক্ষা করার পর নিজের মনে কথাগুলো বলে ভার্সিটিতে ঢুকে লাইব্রেরির দিকে চলে গেলো। লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখলো কোয়েল সেখানে নেই। ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে বাইরের দিকে আসতে গেলেই রাজ দাঁড়িয়ে যায়….
‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️
||পর্ব~৩৬||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা
রাজ গাড়ির সামনে অনেক্ষন অপেক্ষা করার পর নিজের মনে কথাগুলো বলে ভার্সিটিতে ঢুকে লাইব্রেরির দিকে চলে গেলো। লাইব্রেরিতে গিয়ে দেখলো কোয়েল সেখানে নেই। ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে বাইরের দিকে আসতে গেলেই রাজ দাঁড়িয়ে যায়….নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছে না আজ রাজের। তাই চোখ সরিয়ে সে নিচের দিকে তাকালো এবং চোখ বন্ধ করে একটা শুকনো ঢোঁক গিলে আবার সামনে তাকালো। নাহ! সে ভুল দেখছে না। সত্যিই, রাজের চোখের সামনে কোয়েল অঙ্কিতকে শক্ত ভাবে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে কমন রুমের মধ্যে।
রাজ: এটাই হয়তো দেখা বাকি ছিলো। (তাচ্ছিল্য হেসে)
রাজ নিজের চোখের জল আড়াল করে ওখান থেকে সরে এসে নিজের গাড়ির সামনে চলে আসে। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে রাজ একা একা তারপর চলে যায় নিজের অফিসে। অফিসে গিয়ে কিছুতেই কোনো কাজে মন লাগছে না। না চাওয়া স্বত্বেও চোখের সামনে বারবার দৃশ্যটা ভেসে উঠছে। যত নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে তত বেশি করেই জানো বেসামাল হয়ে পড়ছে সে। আর না পেরে হাতের সামনে থাকা ফুলদানিটা আছাড় মেরে ভেঙে ফেললো আর মাথা দু-হাত দিয়ে চেপে ধরে বললো,
রাজ: আমিই কেন সব সময় হারিয়ে ফেলি আমার ভালোবাসার মানুষটাকে। জীবনে কোনো কিছুই কেন সহজে পেতে পারি না আমি? সব কিছুর জন্যেই লড়াই করতে হয়। এইবার তো লড়াই করেও শেষ রক্ষা হলো না।
রাজ চেয়ারে মাথা ঠেকিয়ে উপরের দিকে তাকাতেই চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো। জোরে একটা নিশ্বাস নিতেই কাওর আওয়াজ পেলো রাজ দরজার বাইরে। তৎক্ষণাৎ নিজেকে স্বাভাবিক করে উত্তর দিলো,
রাজ: কাম ইন।
রাজ দেখলো টিনা এসেছে। সঙ্গে সঙ্গে নিজের ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত থাকার ভান শুরু করলো।
টিনা: সব ঠিক আছে রাজ?
রাজ: হ্যাঁ, কেন?
টিনা: না, কোনো কিছু ভাঙার শব্দ পেলাম তাই।
রাজ: ওহ! আসলে আমার হাত লেগে ফুলদানিটা পরে গেছে আর কিছুই না।
টিনা: ওহ আচ্ছা। তোমাকে খুব টায়ার্ড লাগছে, এই নাও একটু জল খাও।
টিনা রাজের সামনে জলের গ্লাস ধরলে রাজ সেটা নিয়ে নেয়। রাজ একটু জল খেতেই টিনা বলে,
টিনা: তুমি কি কিছু নিয়ে টেনশন করছো? আমার সাথে শেয়ার করতে পারো। (হেসে)
রাজ: নিজের লাইফের প্রতিটা প্রবলেম আমি অলওয়েজ নিজেই সলভ করেছি টিনা। যাকে আমার পাশে সব থেকে বেশি করে চেয়েছি প্রতি মুহূর্তে তাকেই আমি পাইনি আর পাবোও না কোনদিন। আসলে আমার ভাগ্যটাই এমন। যা চেয়েছি তা কখনওই পাইনি।
টিনা: কোয়েলের সাথে কিছু হয়েছে তাই না? রাজ, তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে যাকে তুমি এতদিন পাগলের মতো ভালোবেসে এসেছো সে হয়তো তোমাকে ভালোবাসেনা। এমনটাই যদি তুমি ফীল করে থাকো তাহলে আমি বলবো…
টিনার কিছু বলার আগেই রাজের হাতে থাকা গ্লাসটা রাজ ভেঙে ফেললে টিনা তা দেখে আতকে ওঠে। সে বুঝতে পেরেছে সে সঠিক কথাটাই বলেছে কিন্তু ভুল সময়।
টিনা: রাজ, রাজ তোমার হাত থেকে তো রক্ত পড়ছে।
রাজ: আমি ঠিক আছি। তুমি কাওকে পাঠিয়ে দাও যে, এটা পরিষ্কার করে দেবে। আমি আসছি।
রাজ উঠে দাঁড়ালে টিনা হতবাক হয়ে প্রশ্ন করে,
টিনা: রাজ তোমার হাত এতটা কেটে গেছে আর তোমার কোনো রিয়াকশন নেই?
রাজ: বললাম তো ঠিক আছি আমি। তুমি যাও কাওকে পাঠিয়ে দাও।
টিনা: ব্যান্ডেজটা এটলিস্ট করে….
টিনার কথা শেষ হওয়ার আগেই রাজের ফোন বেজে উঠলো। রাজ দেখলো আদিত্য ফোন করেছে তাই ফোন রিসিভ করে বললো,
রাজ: বল।
আদিত্য: কোথায় তোরা?
রাজ: (অবাক হয়ে) কোথায় আমরা মানে?
আদিত্য: মানে কোয়েল তোর সাথে তো? সেই জন্যই…
রাজ: (উৎকণ্ঠে) কি বলছিস তুই। কোয়েল আমার সাথে নেই। ও ভার্সিটিতে ছিলো অঙ্কিতের সাথে সেটা দেখে আমি চলে এসেছি। ও হোস্টেল ফেরেনি?
আদিত্য: না। ও এখনও ফেরেনি। আর কি বললি? অঙ্কিতের সাথে আছে?
রাজ: আমি আসছি। তুই কোথায়?
আদিত্য: আমি তো হোস্টেলের বাইরে আ…
আদিত্য কথা শেষ করার আগেই রাজ কল কেটে দিলো। আদিত্য ফোনের দিকে তাকিয়ে বললো,
আদিত্য: নাও, এইবার আসবে ছুটতে ছুটতে।
ওদিকে রাজ এক মুহূর্ত দেরি না করে পকেট থেকে রুমাল বের করে সেটা হাতে কোনোমতে পেঁচিয়ে হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলো। টিনা কিছু বলবে তো দূর, কিছু বোঝারও সুযোগ পেলো না।
৫৪.
মৌমিতা: অঙ্কিতকে একটা ফোন করি আমি?
আদিত্য: (ভ্রু কুঁচকে) কেন?
মৌমিতা: আপনি তো বললেন রাজদা জানালো কোয়েল অঙ্কিতের সাথে ছিলো তাই বললাম।
আদিত্য: হ্যাঁ তো তোমাকে কেন কল করতে হবে? আমার কাছে ফোন নেই নাকি অঙ্কিতের নাম্বার নেই কোনটা? (বিরক্ত হয়ে)
মৌমিতা: যাহ বাবা! কি খারাপ কথা বললাম যে বিরক্ত হচ্ছেন? ধুর! (মুখ ঘুরিয়ে)
আদিত্য: হুহ! আসল জায়গায় কিছুই বোঝেন না উনি। অন্য জায়গায় বুঝে বেশি। (বিরবিড়িয়ে)
আদিত্য বিড়বিড় করে কথাটা বলে অঙ্কিতকে ফোন করলেন আর আমি কিছু বলতে গিয়েও বললাম না। মনে মনে বেশ হাসিও পাচ্ছে আদিত্যর ব্যবহার দেখে। ঠিক হয়েছে, বুঝুক আমার কেমন লাগতো জিয়ার সাথে ওনাকে দেখে। কিন্তু…কেন হতো এমন আমার?
আদিত্য: মৌমিতা, এই মৌমিতা? কোথায় হারিয়ে গেলে? (তুড়ি বাজিয়ে)
মৌমিতা: হ..হ্যাঁ বলুন। খোঁজ পেলেন?
আদিত্য: কোন জগতে ছিলে? চলো আমার সাথে।
আমি আর কথা না বাড়িয়ে গাড়িতে বসে পড়লাম। আদিত্য আর আমি গাড়ি করে একটা নাইট ক্লাবের সামনে দাঁড়ালাম। আমি কিছু জিজ্ঞেস করবো তার আগেই দেখলাম রাজদাও এসে উপস্থিত। তার মানে কোয়েল ক্লাবে আছে কিন্তু কেন?
আদিত্য: ভিতরে চলো। আছে আজকে ওর কপালে দুঃখ। (আস্তে করে)
মৌমিতা: ই..ইয়ে, কোয়েল এখানে আছে? ঠিক আছে তো? এতক্ষন ঠিক থাকলেও এরপর ঠিক থাকবে বলে মনে হচ্ছে না। (আদিত্যের কানের কাছে)
আদিত্য: ঠিক? ঠিকের কথা বলছো তুমি? ও জীবিত ফিরবে বলে মনে হচ্ছে না আমার। তুমি একটু ভালো করে সাথে থাকা ব্যক্তিটির দিকে ভালো ভাবে তাকাও, তুমিও বুঝতে পারবে। (মৌমিতার কানে কানে)
আমি একবার রাজদার দিকে তাকালাম, বেশ শান্ত। ঠিক যেমন আদিত্যও রেগে গেলে শান্ত হয়ে যায় তেমন। মানুষ হুট করে এতটা শান্ত হতে পারে সেটা এদের না দেখলে জানতাম না। আমি রেগে গেলে তো পারলে সব শেষ করে দি তাই আর কি। একদিকে ভালোই একজন রেগে গেলে আরেকজন শান্ত থাকবে।😗
আদিত্য: হয়ে গেলো!
আদিত্যের কথা শুনে আমি সামনে তাকালাম কারণ ইতিমধ্যে আমরা ক্লাবের ভিতরে চলে এসেছি। ক্লাবের মধ্যমণি হয়ে রয়েছে অঙ্কিত আর কোয়েল। আজ অনেকদিন পর অঙ্কিতকে দেখলাম, অনেকটা চেঞ্জ লাগছে ওর মধ্যে। আদিত্য কোয়েলকে ডাকতে যাবে তার আগেই জোরে গান বেজে উঠলো। পুরো ক্লাব অন্ধকার হয়ে গেলে “হুকাহ বার” গানটা চলতে শুরু করে আর কোয়েল, অঙ্কিত সেই তালে নাচতে শুরু করে।
[আপনারাও নাচুন, আমার সাথে একটু😁]
মৌমিতা: গানটা শেষ হোক তারপর যাবেন। (আদিত্যের কানে কানে)
আদিত্য কিছু না বলে শুধু রাজের দিকে তাকালেন। আমিও একটা ঢোঁক গিললাম আর রাজদার দিকে তাকালাম। রাজদার দৃষ্টি কোয়েল আর অঙ্কিতের উপর স্থির। বাপ রে বাপ! কি যে হবে।
মৌমিতা: ইশ! কোয়েল কি ভালো নাচছে। আমিও যদি একটু যে…ইয়ে না মানে কোনোদিন আসিনি ত..তো তাই।
আমি চোখ বন্ধই করে নিয়েছি আদিত্যের চাহুনি দেখে। আসলে এতো লোভ লাগছিলো তাই মুখ ফসকে কথাটা বলে ফেলেছি আর উনি শুনেও ফেললেন। ইশ! এক্ষুনি কেটে খেয়ে ফেলবেন মনে হচ্ছে।
আদিত্য: অঙ্কিতের সাথে নাচার খুব শখ তাই না? (দাঁত কিড়মিড় করে)
মৌমিতা: না না না। তা কেন? আমার তো একটু নাচতে ইচ্ছা করছিলো। আসলে কোনোদিন এমন ক্লাবে আসিনি তো তাই…
আদিত্য: আসার প্রয়োজনও নেই আর। এটাই ফাস্ট আর এটাই লাস্ট!
মৌমিতা: (অবাক হয়ে) মানে?
আমার কিছু বুঝে ওঠার আগেই উনি আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে কোয়েলদের কাছে চলে গেলেন। কোয়েল তো আমাদের দেখে বেজায় খুশি। আর আমি এখনও একটা শকের মধ্যে রয়েছি এই ভেবে যে, আমি ওনার সাথে ডান্স করছি? উনি আমাকে যেভাবে মুভ করাচ্ছেন আমিও সেভাবেই মুভি করছি, আমার দৃষ্টি ওনার দিকেই স্থির। ভার্সিটি ডান্স কম্পিটিশনে যেই আক্ষেপটা ছিলো সেটা এভাবে পূরণ হবে আমি ভাবতেই পারিনি। এসবের মাঝেই উনি হুট করে আমাকে ঘুরিয়ে দিয়ে আমাকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখ এনে বললেন,
আদিত্য: কম্পিটিশনের কথা ভাবছো বুঝি?
মৌমিতা: হ..হ্যাঁ মানে না।
আদিত্য: (আবার নিজের দিকে ঘুরিয়ে) জানতাম, আমারও আক্ষেপ ছিল ওটা নিয়ে পূরণ করে নিলাম একবারে। (চোখ টিপ দিয়ে)
আমি ওনার কথায় কি রিয়াকট করবো এখনও বুঝতে না পেরে ওনার সাথে এই মুহূর্তটা এনজয় করতে লাগলাম।
অন্যদিকে,
কোয়েলের চোখ হুট করেই রাজের দিকে গেলো আর ও থেমে গেলো।
কোয়েল: (মনে মনে– তার মানে আদিত্যদা আর মৌ একা আসেনি? রাজও এসেছে? ওহ শিট! আজকে তো ওর আমাকে ভার্সিটি থেকে নিতে আসার কথা ছিলো আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম। ও নিশ্চই টেনশন করছিল আর তারপরেই আদিত্যদাকে মনে হয় বলেছে।) আরে অঙ্কিত কোথায় নিয়ে যাচ্ছো?
অঙ্কিত কোয়েলকে থেমে যেতে দেখে কোয়েল যেদিকে তাকিয়েছিল সেদিকে তাকালো। রাজকে দেখতে পেয়েই সঙ্গে সঙ্গে কোয়েলের হাত ধরে টেনে নিয়ে চলে যায় রাজের কাছে।
অঙ্কিত: হেই রাজ! কেমন আছিস?
রাজ আগেই দেখেছে কোয়েল আর অঙ্কিত ওর দিকে আসছে সেটা দেখে ইচ্ছা করেই অন্যদিকে ঘুরে যায় নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টায়। অঙ্কিত এসে ডাকলে ওর দিকে ফিরে হাসি মুখে বলে,
রাজ: হাই! আমি ভালো আছি, তুই কেমন আছিস?
অঙ্কিত: এই তো এনার দয়াতে ভালোই আছি। উনি দয়াটা করলে আজীবন ভালো থাকবো। (কোয়েলের দিকে তাকিয়ে)
কোয়েল: চাল, চাল! আব মেইন ইটনা ভি কুছ খাস নাহি। (ভাউ দেখিয়ে)
রাজ জোরপূর্বক একটা হাসি দিলো। অঙ্কিত রাজের দিকে হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়ালে রাজ পকেট থেকে হাত বার করে না। অঙ্কিতের কাছে গিয়ে ওকে আলতো করে জড়িয়ে ধরার সময় হালকা করে হাতটা বার করে আবার চটজলদি পকেটে ভরে নেয়।
কোয়েল: (রাজের বাহু ধরে) চলো।
রাজ: কোথায়?
কোয়েল: আদিত্যদা আর মৌয়ের কাছে।
রাজ: ওরা তো ওদিকে ডান্স করছে আমি কি করবো?
কোয়েল: ওরা যেটা করছে সেটাই করবে।
কোয়েল অঙ্কিতের কানে কানে কিছু একটা বলে রাজকে জোর করে টেনে নিয়ে যায় ডান্স ফ্লোরে। সঙ্গে সঙ্গে একটা সফট মিউজিক বাজতে শুরু করে। কোয়েল নিজে রাজের গলার উপর দু-হাত রেখে চোখে চোখ মিলিয়ে জিজ্ঞেস করে,
কোয়েল: হাতে কি হয়েছে তোমার?
রাজ কোয়েলের চোখের থেকে চোখ সরিয়ে নিচে নামিয়ে নেয় আর কোয়েলের কোমরে হালকা ভাবে বাঁ হাত রেখে বলে,
রাজ: কিছু না।
কোয়েল: আমি ডান হাতের কথা বলছি। দেখাও?
রাজ দেখাতে না চাইলে কোয়েল একপ্রকার জোর করে হাতটা টেনে বার করে দেখলো হাতে একটা সাদা রুমাল বাঁধা যা ইতিমধ্যে লাল রং ধারণ করেছে।
কোয়েল: (হাত ছেড়ে) কীভাবে হয়েছে এটা?
রাজ: (নিশ্চুপ)
কোয়েল: ভার্সিটিতে আনতে গেছিলে?
রাজ: হম।
কোয়েল: তারপর?
রাজ: না পেয়ে ভার্সিটির ভিতরে গিয়েছিলাম কিন্তু পাইনি ভেবেছি ফিরে গেছো। তাই আমিও অফিস চলে গেছিলাম।
কোয়েল: হ্যাঁ সে তো তুমি যাবেই, তোমার টিনা আছে কি না অফিসে। (চাপা রাগ নিয়ে)
রাজ: (একবার তাকিয়ে) হম।
কোয়েলের গা’টা জ্বলে গেলো রাজের “হম” বলাতে। মানে রাজ স্বীকার করলো সে অফিসে যায় টিনার জন্য? কোয়েল পারছে না এখানেই রাজের মাথার মধ্যে একটা সজোরে বারি মারতে।
কোয়েল: স্বীকার করলে তবে? যাক ভালো।
রাজ: হম।
কোয়েল এবার কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে গেলো।
কোয়েল: (মনে মনে– এতটা শান্ত কেন ও আজকে? আমি তো ভেবেছিলাম আমাকে গিলে খাবে এতক্ষন কাওকে না জানিয়ে এখানে থাকার জন্য। তার কিছুই তো করলো না বরং কথাই বলছে না। কিছু কি হয়েছে অফিসে? নাকি…) আব, তোমাকে অনেক কিছু বলার আছে।
রাজ এবার তাকালো কোয়েলের দিকে।
রাজ: বলো।
কোয়েল: (একটু অবাক হয়ে) এখন নয়। পরে সময় করে বলবো। তোমাকে তো আমি সব কিছু শেয়ার করি জানোই।
রাজ: হম।
কোয়েল: হাতে ব্যান্ডেজ করে নেবে তো বাড়ি গিয়ে?
রাজ: হ্যাঁ করে নেব।
গান শেষ হয়ে গেলে সবাই থেমে যায় আর লাইট জ্বলে ওঠে। কোয়েল রাজকে ছেড়ে দূরে সরে দাঁড়ানোর পর আদিত্য আর মৌমিতার দিকে তাকালে দেখে ওরা একটা ঘোরের মধ্যে আছে। কোয়েল গিয়ে ওদের সামনে হাততালি দিকে ওরা একে অপরের দূরে সরে যায়।
আদিত্য: চল, তোদের পৌঁছে দি।
আদিত্য কথাটা বলে রাজকে নিয়ে নীচে চলে যায়। আমি আর কোয়েল অঙ্কিতের সাথে দেখা করে নীচে চলে যাই। কোয়েল রাজদাকে তার গাড়ির সামনে দেখে সেদিকে গিয়ে বলে,
কোয়েল: আদিত্যদা রাজের হাত কেটে গেছে। ও এই নিয়ে ড্রাইভ করবে নাকি? (চিন্তিত হয়ে)
আদিত্য: কি করে হাত কাটলো তোর? দেখা।
রাজ: আরে তেমন কিছু না ঠিক আছে। আমার একটু অফিসে যেতে হবে নাহলে তোদের সাথেই যেতাম। তোরা ফিরে যা, আমি পৌঁছে যাবো রাত হওয়ার আগে।
আদিত্য: সিওর?
রাজ: একদম। (হেসে)
আদিত্য: (মনে মনে– রাজকে এতো অফ লাগছে কেন? ও এতটা শান্ত কোনো সময় থাকে না। শান্ত বললে ভুল হবে, মনে হচ্ছে ও নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। আজকে রাতে জানতে হবে কি হয়েছে।) মৌমিতা, চলো।
আদিত্য আর আমি চলে এলে কোয়েল ওখানে দাঁড়িয়ে থাকে। আমিও আর ডাকিনি কোয়েলকে।
রাজ: আসছি।
কোয়েল: (রাজের বাহু ধরে) কি হয়েছে?
রাজ: কই কিছু না তো। আমার আবার কি হবে?
কোয়েল: আমার কাছে লুকাচ্ছো? কি চাইছো বলো তো তুমি?
রাজ: (মনে মনে– আমি যা চাই তা আর কখনো পাবো না।) মানে? কি চাইব?
কোয়েল: আমার মাথা গরম করিয়ে দিতে চাইছো তাই এরকম করছো। আমার কিন্তু ভালো লাগছে না রাজ। কি হয়েছে চুপচাপ বলো। (ধমক দিয়ে)
রাজ: এতো জোর এখনও আমার উপর?
কোয়েল পিছিয়ে গেলো রাজের কথা শুনে। বেশ অভিমান নিয়ে বললো,
কোয়েল: আমি জানতাম না এখন আমার তোমার উপর কোনো অধিকার নেই। আসলে তুমি কোনোদিন বলোনি তো তাই। ঠিক আছে আজকের পর থেকে মনে থাকবে কথাটা। স্য…
রাজ: (একঝটকায় কোয়েলকে কাছে টেনে) চুপ, চুপ, চুপ! এতো কথা কে বলতে বলেছে? আমি বলেছি? এখনও বাচ্চা আছিস। (গাল টেনে) যা, আদি অপেক্ষা করছে। আমি বাড়ি পৌঁছে ফোন করবো।
কোয়েল: চলে যাবো?
রাজ একটু অবাক চোখে তাকালো কোয়েলের দিকে। মনে পড়লো কোয়েল কিছু কথা বলবে বলেছিলো।
রাজ: আমি পরে শুনবো তোর সব কথা। আজকে আমাকে যেতেই হবে, তখন সব ফেলেই ছুটে এসেছিলাম তোর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছিল না শুনে। তুই যা, আমি হাতে ব্যান্ডেজ করে নেবো।
কোয়েল: কে করে দেবে? টিনা? (গাল ফুলিয়ে বাচ্চাদের মতো)
রাজ: (হেসে) ডাক্তারের দিয়ে করিয়ে নেবো মা আমার।
কোয়েল: হুহ! যাকে ইচ্ছা তাকে দিয়ে করাও আমার কি! ব্যাটা জমরাজ!
কথাটুকু বলেই কোয়েল পালালো। রাজ এদিকে একা একা দাঁড়িয়ে ভাবছে,
রাজ: যেই কাজ হয়ে গেলো অমনি পাল্টি মেরে পালালো। (হেসে, কিছুক্ষন থেমে) আমি কি ভুল ভাবছি? কোয়েল কি বলবে বলছিলো? হতে পারে কোয়েলের কথা শুনলে সবটা ক্লিয়ার হয়ে যাবে। আর নাহলেও আমি ওকে জিজ্ঞেস করবো। ওর বিহেভিয়ারে আমি ফীল করেছি ও আমাকে নিয়ে ভাবে, আমাকে ভালোবাসে।
[চলবে]