‘একদিন তুমিও ভালোবাসবে’ 🌸❤
||পর্ব~১||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা
১.
ফুলশয্যার রাতে ঘরের সব লণ্ডভণ্ড হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে আছে। আমি গা-ভর্তি গয়না, ভারী লেহেঙ্গা পরে চুপচাপ এক কোণে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎই পুরুষালি চিৎকারে আমি কেঁপে উঠলাম।
‘এই বিয়ে আমি মানি না! তাই আপনাকেও স্ত্রীর মর্যাদা আমি দেবো না। বুঝেছেন? যদি আমার কাছে স্ত্রীর মর্যাদা চাইতে আসেন তাহলে ঠিক এই ঘরের মতোই আপনার জীবনটা তছনছ করে দেবো আমি।’
কথাগুলো বলে গটগট করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন তিনি, আমার স্বামী। ও না! তিনি তো আমায় স্ত্রী হিসেবে মানেন না। কিন্তু তাই জন্যে কি আমিও তাকে স্বামী হিসেবে মানবো না? নাহ! এমনটা করতে পারবো না আমি। বিয়ে যখন হয়েছে তখন যেমনই হোক আমাকে মানিয়ে নিয়ে চলতে হবে।
“আদিত্য ব্যানার্জী!” সবচেয়ে বেশি বিরক্তির কারণ আমার জীবনে এই নামটা। আমি দুঃস্বপ্ন-এও কোনদিন ভাবিনি এই মানুষটাকে আমায় বিয়ে করতে হবে, সারাজীবন কাটাতে হবে। আমি “মৌমিতা চৌধুরি!”, ওহ স্যরি! এখন তো আমার বিয়ে হয়ে গেছে, এখন আমার নাম “মৌমিতা ব্যানার্জী!”।
২.
ফ্রেশ হয়ে আয়নার সামনে বসে নিজের গয়নাগুলো খুলে রাখছি। উনি যে সেই বেড়ালেন, এখনও আসেননি। অন্যমনুস্ক হয়ে কাঁচের চুড়িগুলো খুলছিলাম বলে হাত ফসকে কাঁচের চুড়িগুলো পরে গিয়ে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো। চুড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে ভাবছি, “ঠিক এইভাবে আমার তিলে তিলে গড়ে তোলা স্বপ্ন গুলোও ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো আজ।” কথাটা ভাবতেই এক গভীর দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো আমার।
‘ড্রেসিং টেবিলটা আমার মিস চৌধুরি! আপনি ওখান থেকে সরে গেলে খুব ভালো হয়।’
আমি আয়নায় তাকিয়ে দেখলাম উনি আমার পিছনেই দাঁড়িয়ে আছে। চোখে মুখে বিরক্তির ছাঁপ। আমি উঠে দাঁড়িয়ে চুড়িগুলো তুলে রেখে ওনার সামনে দাঁড়িয়ে বললাম,
‘আপনি যেমন এই বিয়েতে রাজি ছিলেন না তেমন আমিও রাজি ছিলাম না। অযথা আমার উপর এভাবে চোটপাট করে লাভ হবে না। বিয়েটা যখন হয়েই গেছে তা অস্বীকার করে কি কোনো লাভ আছে?’
উনি আমার হাতের কব্জি শক্ত করে চেপে ধরলেন আর তার ফলে চুড়িগুলো ভেঙ্গে যেতে লাগলো। আমার হাতে ফুটে গেলো কয়েকটা চুড়ির অংশ। আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছি ব্যাথা সহ্য করে। এখনও পর্যন্ত ওনার মুখের দিকে আমি তাকাইনি।
‘এতো সাহস ভালো না। আমার সামনে সাহস দেখানোর চেষ্টা করবেন না মিস চৌধুরি। তাই জন্যেই আপনাকে ‘মিস’ বলে সম্বোধন করছি। এই বিয়েটা আমি কোনদিন মানবো না, যেখানে আমার কোনো পছন্দ ছিলো না। খুব শীঘ্রই আমি এখান থেকে চলে যাবো তখন থাকবেন আপনি আপনার ঘর সংসার নিয়ে।’
উনি আমার হাত ছেড়ে সোজা ওয়াশরুমে চলে গেলেন। আমার হাত বেয়ে “টুপটুপ” করে রক্ত পরছে, তাও চোখ দিয়ে জল পরার জো নেই আমার। যখন বিয়ে হয়েছিল তখনই বুঝেছিলাম আমার জীবনটা শেষ। উনি ওয়াশরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে ওয়াডরব থেকে ড্রেস নিয়ে চেঞ্জ করে এসে শুয়ে পরলেন। আমি এখনও স্থির হয়ে ওই একই জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি।
‘এইসব ন্যাকামি না করলে চলছে না আপনার? রাত বিরেতে এভাবে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে না থেকে শুয়ে পড়ুন।’
ওনার দিকে ফিরে দেখলাম উনি পাশ ফিরে শুয়ে পরলেন। কিছু না বলে ওয়াশরুমে গিয়ে চোখ-মুখের সাথে হাতটা ধুয়ে নিলাম। রক্তক্ষরণের পরিমাণ টা বেশি কারণ যে জায়গায় উনি চেপে ধরেছিলেন সে জায়গায় হাতের শিরা ছিলো। আমি ঘরে এসে চারিদিকে তাকিয়ে দেখলাম একটা সোফা রাখা। সেখানেই গিয়ে শুয়ে পরলাম। শুয়ে শুয়ে ভাবছি,
‘আমার শত্রুরও জানো এহেনো ফুলশয্যার রাত না হয়। সবার এই রাত নিয়ে কত স্বপ্ন থাকে সেখানে আমার..?? কি করে পারলো আমার বাবা-মা এভাবে হুট করে আমার বিয়ে ঠিক করে দিতে? একবারও আমাকে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনও মনে করল না? যাক গে, যা করেছে তা হয়তো ভালোর জন্যেই করেছে। শুনেছি বাবা-মা কখনো সন্তানের খারাপের জন্য কিছু করে না। এই কথাটা সত্যি না মিথ্যে তা তো সময় বলবে।’
৩.
সকালে ঘুম ভাঙতেই উঠে বসলাম। ঘরটায় ভালো ভাবে চোখ বুলিয়ে দেখলাম বিছানা পরিপাটি করে গুছানো। অর্থাৎ উনি ঘুম থেকে উঠে বিছানা গুছিয়ে গেছেন। আমি উঠে দাঁড়াতেই আমার হাতে কাঁটা জায়গায় ছোট্ট একটা ব্যান্ডেজ চোখে পরলো।
‘এটা আমার হাতে কি করে এলো? আমি তো রাতে এমনি শুয়ে পরেছিলাম। তাহলে কি উনি?’
নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করে উত্তর পেলাম “হ্যাঁ!” উনি ছাড়া আর কেই বা ছিলো এই ঘরে? দরজা তো বন্ধ ভিতর থেকে তাই কেউ আসতেও পারবে না।
‘মানুষটা যে কেমন? তা বুঝতে একটু সময় লাগবে আমার। কিন্তু উনি তো আমায় সেই সময়টুকুও দেবেন না।’
আর কথা না বাড়িয়ে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে নিচে নেমে গেলাম। দেখি শাশুড়ি মা কে কোনো ভাবে সাহায্য করতে পারি কি না। শাশুড়ি মা কে উদাসীন হয়ে ড্রয়িং রুমে বসে থাকতে দেখে আমি একটু অবাক হলাম।
‘মা, আপনি এভাবে এখানে বসে আছেন যে? কোনো সমস্যা হয়েছে?’
শাশুড়ি মা আমার দিকে করুন ভাবে তাকালেন। আমার হাত ধরে ওনার পাশে বসিয়ে বললেন,
‘আমায় ক্ষমা করে দাও বউমা। আমি ভাবিনি আমরা তোমার জীবনটা এভাবে নষ্ট করে দেবো।’
‘আমি কিছু বুঝলাম না মা। কি হয়েছে একটু খুলে বলবেন?’
‘আদি চলে গেছে আজ সকালে নিজের ইউনিভার্সিটি তে। ও ওখানেই হস্টেলে থেকে পড়াশোনা কম্পলীট করবে।’
শ্বশুরমশাইয়ের কথা শুনে বুঝতে পারলাম গতরাতে উনি যা বলেছিলেন তাই করেছেন। চলে গেছেন অনেক দুরে। নিজের উপর আজ বড্ড বেশি করুণা হচ্ছে আমার। এতো সুন্দর ভাগ্য করে জন্মেছি আমি? ভাবতেই অবাক লাগে আমার।
‘আমরা ভেবেছিলাম তোমার সাথে বিয়ে দিলে হয়তো আদি শুধরে যাবে। কিন্তু নাহ, ও আমাদের কোনো কথা না শুনে রাগ দেখিয়ে চলে গেলো।’
‘এতে আপনাদের কোনো দোষ নেই। সবই আমার ভাগ্যের দোষ।’
কথাটা বলে উঠে রান্নাঘরে চলে এলাম। বাবা-মার জন্যে চা বানিয়ে নিয়ে ওনাদের সামনে রাখলাম।
‘বউমা তোমার না ইচ্ছে ছিলো ইংরেজি অনার্স করার? সেটা তো যাদবপুর ইউনিভার্সিটি থেকে তাই না?’
‘হ্যাঁ বাবা। কিন্তু হঠাৎ এই প্রশ্ন?’
‘আমি তোমায় যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করে দেবো। কি বা করবে তুমি একা ঘরে থেকে। এর থেকে নিজের স্বপ্ন পুরন করো।’
বাবার কথা শুনে জানো আমি আকাশের চাঁদ হাতে পেলাম। শত কষ্টের মাঝেও এক চিলটে সুখ খুঁজে পেলাম। এবার আমি আমার স্বপ্ন কে আকড়ে ধরেই বেঁচে থাকবো। সব মেয়ে কি আর স্বামীর সোহাগ, সমর্থন পাশে পায়? আমিও না হয় নিজেকে সেই সব মেয়েদের দলেই মেনে নিলাম।
‘বাবা আমি যাদবপুরে থেকেই পড়াশোনা করতে চাই।’
‘সে কি কেন? এখান থেকে মানে কলকাতা থেকে তো যাদবপুর বেশি দূর নয়। ট্রেইনে গেলে বেশি সময় লাগবে না।’
‘না আসলে আমি ইউনিভার্সিটির কাছাকাছি থেকেই পড়তে চাই। আপনি প্লিজ ওখানে একটা হস্টেলের ব্যবস্থা করে দিন?’
আমার কথা শোনার পর শ্বাশুড়ি মা ইশারা করতেই উনি রাজি হয়ে গেলেন। মা হয়তো বুঝতে পেরেছেন আমি কেন ওখানে থেকে পড়াশোনা করতে চাইছি। আসলে এই ঘরে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না, কিছুতেই না। আমি দূরে যেতে চাই ওনার থেকে, উনি সম্পর্কিত সব কিছু থেকে।
চলবে।
‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️
||পর্ব~ ২||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা
৪.
চুপচাপ ক্লাসরুমের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছি। সামনে সিনিয়ররা বসে হাসাহাসি করছে। নিজেকে প্রস্তুত করছি ওদের উত্তর দেওয়ার জন্য। তখনই ওদের মধ্যে থেকে একজন বলে উঠলো,
‘আশা করছি বুঝতে পারছো আমরা তোমার সিনিয়র?’
ছেলেটির কথা বলার ধরন দেখে আমার মোটেও পছন্দ হলো না। আমি সোজাসুজি উত্তর দিলাম,
‘হ্যাঁ বুঝতে পারছি তো? আপনারা আমার সিনিয়র তো আমি কি করবো?’
‘বাহ, তুমি তো বেশ আমাদের থেকে এগিয়ে। একবারে কাজের কথায় চলে এলে। যাক ভালো, তাহলে শোনো কি করতে হবে তোমায়।’
‘আপনাদের কি খেয়ে দেয়ে কাজ নেই? এভাবেই জুনিয়রদের র্যাগ করেন নাকি? জানেন এটা এখন আইনত অপরাধ?’
‘জানি তো। তাই তো সবার উপর র্যাগ করিনা, কিছু টিপিক্যাল বেহেনজি ছাড়া।’
কথা শেষ হতেই ওদের পুরো গ্রুপ হাসাহাসি শুরু করলো। আমি ওখান থেকে রেগে বেরিয়ে আসতে নিলে ছেলেটি আমার হাত ধরে টান দেয় আর আমি আমার হাত ছাড়িয়ে সজোরে একটা চড় বসিয়ে দি ওর গালে। ওর বন্ধুরা রেগে বলে,
‘এইটারই তো অপেক্ষা করছিলাম আমরা। এই যে এইবার তুমি সিনিয়রদের গায়ে হাত তুলে অপরাধ করলে তার শাস্তি পেতে হবে। চিন্তা করো না, শাস্তি টা আমরাই দেবো।’
ওরা আমাদের দিকে এগিয়ে এলে আমি ছুটে ঘর থেকে বেরতে যাই আর কাওর সাথে পা বেজে হুমড়ি খেয়ে পরে যাই মেঝে তে। শুনতে পাই ওদের কথা,
‘বাহ জিয়া! কি দিলি। এক্কেবারে মাস্টার স্ট্রোক।’
পরে যাওয়ায় হাতের কুনুই আর পায়ের হাঁটুতে বেশ চোট পেলাম। উঠতে যাবো এমন সময় একজোড়া পা এসে আমার সামনে দাঁড়ালো। এটা একটা মেয়ে বুঝতে পেরে ওর মুখের দিকে তাকাতেই ও নীচু হয়ে সাহায্য করলো আমায় উঠতে। ওর সাহায্য নিয়ে উঠে দাঁড়াতেই ও আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
‘নতুন এসেছো?’
‘হ্যাঁ।’
আমাকে দাঁড় করিয়ে ও ওদের গ্রুপের দিকে এগিয়ে গেলো। এগিয়ে গিয়ে ওদের সামনে হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো,
‘বিনোদন হয়ে গেছে? তাহলে এবার আসতে পারো।’
‘এই কোয়েল! বেশি বাড়াবাড়ি করবি না নাহলে কিন্তু…’
‘নাহলে কিন্তু কি? কি করবে বেশি বাড়াবাড়ি করলে?’
ছেলেটি কিছু বলতে চেয়েও বললো না। জিয়া বলে মেয়েটি ছেলেটির কাঁধে হাত রেখে বললো,
‘দেখ কোয়েল আমাদের সব কাজে এভাবে তোর নাক না গলানোই ভালো।’
‘আমার নাক টা খুব সুন্দর তীক্ষ তো তাই আমি নাক গলিয়ে অন্যের নাক বোচা করতে ভালো বাসি। আমি কি করতে পারি না পারি তোমাদের সবার খুব ভালো ভাবে জানা আছে তাই…’
কোয়েলর কথা শেষ হওয়ার আগেই জিয়া বিরক্ত হয়ে চলে গেলো ওর দলবল নিয়ে। আমি বুঝলাম যে আমায় সাহায্য করলো তার নাম কোয়েল। মেয়েটি কে বেশ ভালো লাগলো, মনে হলো এর সাথে বন্ধুত্ব করা যেতেই পারে। আমার ভাবনার মাঝেই ও আমার চোখের সামনে তুড়ি বাজিয়ে আমার ঘোর কাটাল। আমি একটু ইতস্তত করে ওকে জিজ্ঞেসা করলাম,
‘তোমার নাম কোয়েল?’
‘কোয়েল ব্যানার্জী। কোয়েল বলেই সবাই চেনে আমায়। তুমি?’
‘মৌমিতা, মৌমিতা ব্যানার্জী। ইংরেজি অনার্স নিয়ে ভর্তি হয়েছি।’
‘হস্টেলে থেকে পরবি নাকি?’
‘হ্যাঁ।’
‘বুঝলাম। আরো অনেক কিছু সহ্য করতে হবে তোকে।’
ওর “তুই” বলে সম্বোধন করায় আমি একটু সাহস পেয়ে জিজ্ঞেসা করলাম,
‘বন্ধু হবে আমার?’
ও আমার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বললো,
‘নাহ। বান্ধবী হবো।’
প্রথমে নাহ বলে একটু থামার পর যখন বান্ধবী হবে বলে হেসে ফেললো তখন আমারও ভালো লাগলো। মেয়েটা যে বেশ রাগী এবং সাহসী তা দেখেই বোঝা যায়। পুরোপুরি আমার মতো যখন তাহলে বন্ধুত্ব ভালোই জমবে। হাঁটতে হাঁটতে ও আমায় বললো,
‘দেখ এখানে ওই জিয়ার দল একটু উৎপাত করে। সবার সাথে নয়, যারা একটু দুর্বল তাদের সাথেই। শক্ত থাকবি, তার মানে এই নয় যে দুমদাম হাত-পা চালাবি তাহলে মুশকিল হয়ে যাবে। নিজের রাগ সংযত রেখে মুখে উত্তর দিবি তাহলেই ওরা আর কিছু করতে পারবে না। এখন তো র্যাগ করা আইনত অপরাধ তাই ইচ্ছে করে এমন এমন কাজ করে যাতে মেয়েরা বাধ্য হয়ে গায়ে হাত তোলে। এই সুযোগ একদম দিবিনা।’
কোয়েলের কথা শুনে আমি একটা শুকনো ঢোঁক গিললাম। মনে মনে ভাবছি,
‘এখন কি হবে? প্রথম দিন এসেই তো আমি ওই ছেলেটাকে চড় মেরে দিলাম। এটা কি বলবো ওকে?’
‘কি রে? আমার কথাটা শুনে চুপ করে গেলি যে? এক মিনিট, তুই কি এমন কিছু করেছিস নাকি?’
কোয়েল সত্যিটা ধরে ফেলায় আমি আর লুকাবো না ঠিক করলাম।
‘আসলে, হ্যাঁ তখন হাত ধরায় মেরে দিয়েছি একটা চড়।’
আমি ইতস্তত করে কথাটা বলে কোয়েলের দিকে তাকাতেই দেখলাম ও একদৃষ্টে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি স্যরি বলতে যাবো তখনই ও বললো,
‘যাক গে। যা করেছিস ভালো করেছিস হুহ!’
‘এই যে বললি মুশকিল হয়ে যাবে?’
‘ও দেখা যাবে যা হবে। ওর আমানত নাকি তুই যে টাচ করবে। আমি হলে তো হাত ভেঙ্গে রেখে দিতাম। যত্তসব লুইচ্চা লাফাঙার দল। হাটটটট!’
কোয়েল ভার্সিটি থেকে বেরিয়ে গেলো একা একা গজগজ করতে করতে। আমি ওর পিছু পিছু যাচ্ছি আর ভাবছি,
‘এই মেয়ে তো আমার থেকেও বড়ো গুন্ডি। কিছুক্ষন আগেই বললো গায়ে হাত তুলবি না আর এখন বলছে হাত ভেঙে রেখে দিতো? আমি এর সাথে মানিয়ে থাকতে পারবো তো? কি জানি বাবা।’
আর বেশি না ভেবে কোয়েলের পিছনে ছুট দিলাম কারণ ও অনেকটা এগিয়ে গেছে।
৫.
দুপুর হয়ে এসেছে। সকাল সকাল কলকাতা থেকে রওনা দিয়েছিলাম যাদবপুরের উদ্দেশ্যে আর এইসব ঘটনার শেষ হতে হতে দুপুর হয়ে গেলো। বেশ কিছুক্ষণ হেঁটে আসার পর আমরা হোস্টেলের সামনে এসে উপস্থিত হলাম।
‘আমি আর তুই রুমমেট ওকে?’
‘কিন্তু আমার রুম তো অন্য দিলো।’
‘সে আমি ম্যানেজ করে নেবো তোকে ভাবতে হবে না। তুই তাড়াতাড়ি একটু ফ্রেশ হয়ে নে। আজকে তোকে পুরো ভার্সিটি ঘুরে দেখাবো, কালকে থেকে নয় ক্লাস করবো ওকেই?’
‘ওকে।’
কোয়েল কে বলে আমি ফ্রেশ হতে গেলাম। বেশ ভালো লাগলো প্রথম দিনেই একজন বান্ধবী বানাতে পেরে। ফ্রেশ হয়ে এসে কোয়েলের সাথে বেরোলে ও এক এক করে হোস্টেলের সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। পরিচয় শেষ হওয়ার পর আমরা ভার্সিটি তে এসে উপস্থিত হই। ভার্সিটি ঘুরে দেখানোর সাথে সাথে কোন স্যার ম্যাডাম কেমন সেটাও কোয়েল আমাকে বলতে লাগলো। সেই সময় হঠাৎই আমার চোখ গেলো সামনের দিকে আর আমার পা থমকে দাঁড়ালো।
‘যার থেকে দুরে আসতে চাইলাম সেই সামনে চলে এলো?’
‘কি রে দাঁড়িয়ে পড়লি কেন?’
কোয়েলের প্রশ্নে ওর দিকে তাকিয়ে না বোধক মাথা নাড়তেই সকালে যাকে চড় মেরেছিলাম সেই ছেলেটা সামনে এসে দাঁড়ালো। বললো,
‘এখানে টিকে থাকাটা খুব একটা সহজ হবে না ম্যাডাম। আপনি সকালে যেটা করেছেন সেটা ঠিক করেননি।’
‘আপনিও সকালে যেটা করেছেন সেটা ঠিক করেননি। শুরুটা আপনি করেছিলেন আমি নয়।’
‘খুব কথা বলছেন তাই নাহ? সময় আসলে সবটা সুদে আসলে উসুল করে নেবো …’
কথা শেষ করার আগেই ছেলেটির পিছন থেকে একটি ছেলে এসে ওর কাঁধে হাত রাখলো। সেই ছেলেটি আর কেউ নয় আমার স্বামী আদিত্য ব্যানার্জী! যার থেকে আমি পালাতে চেয়েছিলাম। যার মুখ দেখারও ইচ্ছে আমার ছিলো নাহ। কি করে থাকবে বলুন তো? যে কি না নিজের স্ত্রী কে বিয়ের রাতে ঠিক মতো দেখে পর্যন্ত না, অপমান করে তার মুখ দেখার ইচ্ছে আর যারই থাকুক আমার একদমই নেই। কিন্তু আমার ভাগ্যটা এতোই ভালো যে ইনিই আমার সিনিয়র বের হলো। উনি ছেলেটি কে বললেন,
‘কি হয়েছে?’
‘এই মেয়েটা, এই মেয়েটা আমার গায়ে হাত তুলেছে আদি আজকে সকালে।’
ছেলেটার কথা শুনে উনি আমার দিকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। মনে হচ্ছে চেনার চেষ্টা করছেন। সেটা দেখে আমি ভাবছি,
‘ঠিকই ভেবেছিলাম তাহলে। মুখটাও ঠিক ভাবে দেখেননি। যেই সময় আমাকে ধরে কথাগুলো বলে ছিলেন সেই সময় মুখ নামিয়ে রেখেছিলাম বলে হয়তো দেখতে পাননি। কিন্ত হাতের ব্যান্ডেজ? ধুর, চিনতে না পারলেই ভালো হয়।’
এমন সময় উনি আমার হাতের দিকে তাকালেন যেখানে ব্যান্ডেজ করা আছে। তারপর আপাদমস্তক এক নজর দেখতেই চোখে মুখে বিরক্তির ছাঁপ ফুটে উঠলো ওনার। উনি ছেলেটিকে বললেন,
‘তুই যা। আমি কথা বলছি।’
ওনার কথা শুনে ছেলেটি কোনো রকম কোনো কথা না বলে চলে গেলো। এতক্ষণ ধরে কোয়েল চুপ করে থাকলেও এইবার কোয়েল ওনাকে বললো,
‘আদিত্য দা আমি তোমাকে একটা কথাই বলবো যে মৌমিতার কোনো দোষ নেই। তুমি খুব ভালো ভাবেই জানো আমি মিথ্যে বলি না। আর সবার সাথে কথা বলার প্রয়োজনও মনে করি না।’
‘হমম। তুই একটু এগিয়ে গিয়ে দাঁড়া। আমি তোর ফ্রেন্ডের থেকে সবটা শুনতে চাই।’
ওনার কথায় কোয়েল আমাকে ভরসা দিয়ে ওদিকে চলে গেলো। আমি মাথা নীচু করে চুপ চাপ দাঁড়িয়ে রয়েছি এমন সময় উনি বললেন,
‘তুমি এই ভার্সিটি তে?’
‘আমি জানতাম না আপনিও এই ভার্সিটি তে পড়েন।’
‘জানার কথাও নয়। আমি তো তোমাকে চিনতেই পারিনি প্রথমে। যাই হোক আমি চাই না তুমি এখানে আমাকে তোমার হাসব্যেন্ড বলে পরিচয় দাও। এইটা জানো না হয় কোনো ভাবে।’
‘ঠিক আছে।’
‘আর শোনো!’
আমি চলে যাচ্ছিলাম ওনাকে পাশ কাটিয়ে সেই সময় উনি আবার ডাকলেন।
‘কিছু বলবেন?’
‘হ্যাঁ। স্যরি!’
আমি অবাক হয়ে ওনার মুখের দিকে তাকালাম। হয়তো প্রথমবারের জন্য আমি ওনার মুখটা ভালো ভাবে দেখলাম। আগে যতবার দেখা হয়েছে, শুধুমাত্র ঝগড়াই হয়েছে তাই আর মুখটা ভালো ভাবে দেখে হয়ে ওঠা হয়নি। ঘোর কাটলো যখন উনি স্যরি বলার কারণ বললেন,
‘বিয়ের দিন রাতে আমি যেই বিহেভটা করেছি সেটা আমার করা উচিত হয়নি। আমি বিয়ের কনসেপ্টটাকেই বিশ্বাস করিনা সো আমার জন্য এই হুট করে বিয়েটা মেনে নেওয়া পসিবল নয়। তুমি খুব ভালো ভাবেই জানো আমাদের বিয়েটা কি সিচুয়েশনে হয়েছে। তুমি বলেও ছিলে সেদিন রাতে কিন্তু আমি যতটা রুড বিহেভ করেছি তুমি করনি। এই সবের জন্যেই স্যরি! নাও তুমি তোমার রাস্তায় আর আমি আমার।’
‘ইয়াহ, ইটস ওকে। আব একটা কথা ছিলো..??’
‘কি কথা?’
‘আমার হাতের এই ব্যান্ডেজটা কি আপনি করেছিলেন?’
‘হ্যাঁ। তখনই তোমার মুখটা দেখেছিলাম তাই আজকে চিনতে পেরেছি। ব্যান্ডেজটার জন্য সিওর হয়েছি আর কি।’
‘ওহ আচ্ছা।’
উনি আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে গেলে কেন জানো আমার চোখটা ছলছল করে ওঠে। হয়তো ওনার আলাদা হওয়ার কথাটা শুনে। হাজার হোক স্বামী হন উনি আমার। উনি বিয়েটা কে অস্বীকার করলেও আমি করতে পারিনি। তাই তো উনি আলাদা হওয়ার কথা বলায় খারাপ লাগছে নিজের অজান্তে। নিজেকে স্বাভাবিক করে নিতেই কোয়েল এসে জিজ্ঞেস করলো,
‘কি বললো তোকে?’
‘বললো, বললো ওই ছেলেটা আর ডিস্টার্ব করবে না। আর আমাকেও একটু সংযত থাকতে।’
‘হমম। আদিত্য দা খারাপ নয়। ওদের গ্যাং এর লিডার আদিত্য দাই আর ওর পার্টনার কে জানিস?’
‘পার্টনার?’
‘হ্যাঁ। গ্যাং এরও পার্টনার আবার রিলেশনেরও। আই মিন ওরা বিএফ জিএফ।’
‘ওনার জিএফ আছে?’
‘ইয়াপ! জিয়া। যে তোকে র্যাগ করতে চেয়েছিল। তুই জানিস ও আমাদেরই ডিপার্টমেন্টের?’
‘কি?’
‘শুধুমাত্র আদিত্য দার জিএফ বলেই ও আদিত্য দার গ্যাং এর সাথে চলে আর যাকে ইচ্ছা তাকে র্যাগ করে। বাট সেটা আদিত্য দা জানে না। আদিত্য দা ওদের থেকে ডিফারেন্ট। জিয়ার ভয়েই কেউ আদিত্য দাকে বলেনা ওর সম্পর্কে আর আমি বলতাম না তার কারণ ও আমার ফ্রেন্ডের সাথে বা আমার সাথে কোনোদিন এরকম কিছু করেনি। কিন্তু এবার বলবো, যদি তোর সাথে আবার এমন কিছু করার চেষ্টা করে।’
‘তুই এতো খোঁজ রাখিস ওনার ব্যাপারে? তুই কি ওনাকে লাইক করিস নাকি?’
আমার কথা শুনে কোয়েল চুপ করে গেলো। জানো কোনো পুরোনো কথা মনে করিয়ে দিয়েছি আমি ওকে। ওর ওমন মুখ দেখে আমারও মন খারাপ হয়ে গেলো, তাহলে কি কোয়েলও ওনাকে পছন্দ করে?
‘হোস্টেল ফিরে যাই চল।’
কোয়েল চলে গেলো। আমি ঠিক করলাম ওর থেকে জানবো যে ও সত্যি ওনাকে লাইক করে কি না। তাই ওর পিছু পিছু গিয়ে ওর পাশে হাঁটতে হাঁটতে জিজ্ঞেস করলাম,
‘ওহ বুঝেছি। জিয়া ওনার জিএফ আর তুই ওনাকে লাইক করিস এটাই তোকে মনে করালাম বলে মন খারাপ?’
‘নাহ রে। তেমন কিছুই না। আদিত্য দা কে আমি স্কুল লাইফ থেকেই চিনি। তাই জন্যেই বলতে পারলাম। এর চাইতে বেশি কিছুই নাহ।’
‘তাহলে মুড অফ হয়ে গেলো যে?’
‘এমনি। চল হোস্টেলে ফিরে বাকি গল্প করবো।’
আমিও আর কথা বাড়ালাম না। কেন জানো কোয়েলের কথায় একটু স্বস্তি পেলাম কারণ আমার মন বলছে ও সত্যি কথাই বলেছে আমায়।
‘ একদিন তুমিও ভালোবাসবে ‘ 🌸❤️
||পর্ব~৩||
@কোয়েল ব্যানার্জী আয়েশা
৬.
ভরা লোকজনের আড়ালে আমি এক কোণায় পিঠে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছি অসহায়ের মতো। না পারছি সরে যেতে আর না পারছি এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে। কাওকে বলার মতোও পরিস্থিতি নেই কারণ এই বিয়ে চলার মুহূর্তে কাকে বলবো যে আমার ব্লাউজের চেইনটা নীচে নেমে গেছে আর সেটা ধীরে ধীরে আরো নীচে নেমে যাচ্ছে। চারিপাশে লোকে ভর্তি, সরতেও পারছি না। না, এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে সম্মানের আর কিছু থাকবে না যে করে হোক যেতেই হবে। দু-হাত দিয়ে শক্ত করে নিজের ব্লাউজটা কোনোমতে চেপে ধরে এক পা এগাবো বুঝলাম, চেইনটা একদম শেষ প্রান্তে। চোখ বন্ধ করে এগোতে নিলেই পিঠে পুরুষালী শীতল হাতের স্পর্শ পেলাম। ঘুরে তাকাবো সে সময় ব্যক্তিটি কানে কানে বললো,
‘চুপ করে দাঁড়ান। আমাকে দেখার প্রয়োজন নেই, আপনার সন্মান বাঁচাটা প্রয়োজন। আশা করছি আর অসুবিধা হবে না।’
কথা শেষ হতেই আমি পুরোপুরি ঘুরে গেলাম কিন্তু কাউকে দেখতে পেলাম না, পাশে তাকাতেই দেখলাম ভিড়ের মাঝে চলমান একটি লোক। তৎক্ষনাৎ নিজের পিঠে হাত দিয়ে দেখলাম চেইনটা লাগানো।
‘ভারী অদ্ভুত লোক তো!’
আর কথা বাড়ালাম না বিষয়টা নিয়ে কারণ আমি উনাকে দেখতে পাইনি যার ফলে ধন্যবাদ জানানোরও উপায় নেই। আমার দিদির বিয়ে শেষ হতেই আমি একটা ঘরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে পা বাড়ালাম। ওয়াশরুমে গিয়ে দেখলাম না সব ঠিকই আছে। আজ আমার জেঠুর মেয়ের বিয়ে ছিলো, টিউশনি থেকে ফিরে কোনোমতে রেডি হয়ে উপস্থিত হয়েছি তাই আজ এরকম অবস্থা। চেইনটা যে ঠিক করে লাগাইনি তার খেয়ালই ছিলোনা। ভাগ্যিস লোকটা হেল্প করলো, এক মিনিট! লোকটা কে ধন্যবাদ যে কীভাবে জানাই।
এই ভাবতে ভাবতে ঘর থেকে বেরিয়ে এসে দরজা আটকে সামনে এগোতে নিলেই একজনের সাথে ধাক্কা লাগলো আর সে ধমক দিয়ে উঠলো। সামনে তাকিয়ে দেখলাম একটি ছেলে যার হাতে জুস ছিলো যা আমার সাথে ধাক্কা লাগায় ওনার গায়ে পরে গেছে।
‘শিট! এটাই হওয়া বাকি ছিলো।’
উনি নিজের ড্রেসের দিকে তাকিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘একটু দেখে চললে কি খুব দেরী হয়ে যেতো আপনার?’
‘আই অ্যাম এক্সট্রিমলি স্যরি! আসলে আমি বুঝতে পারিনি।’
‘এখন আপনার স্যরি বলাতে তো আর আমার ড্রেসটা ঠিক হয়ে যাবে না তাই না? তাও আপনি যেহেতু স্যরি বলেছেন তাই ইটজ ওকে।’
ছেলেটি আমাকে আর কিছু বলতে না দিয়েই চলে গেলো। আমি কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলাম না কারণ দোষটা আমারই ছিলো। এমন সময় নীচ থেকে আমার ডাক পড়লে আমি সেদিকে চলে যাই। একে, একে বিয়ে, বৌভাত শেষ হয়ে যায়। এরপরে একদিন আমি টিউশন পড়িয়ে বাড়ি ফিরতেই দেখি একজন ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলা বসে আছেন। আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমার বাবা আমাকে দেখিয়ে বলেন,
‘আমাদের একমাত্র মেয়ে মৌমিতা। উচ্চমাধ্যমিক পাস করে গ্রাজুয়েশন করবে ঠিক করেছে। আমার তেমন সামর্থ্য নেই দেখে ও নিজের পড়াশোনার খরচ নিজেই চালায় স্কলারশিপ আর টিউশনি করিয়ে। পড়াশোনায় আগ্রহী দেখে যে ঘরের কাজ জানে না তা নয়, ঘরের কাজও সব জানে তা আপনারা ওর মায়ের থেকেই জানতে পারবেন।’
আমি বুঝলাম না এদের কাছে আমার এতো তথ্য দেওয়ার কারণ। বড়দের কথার মাঝে কথা বলতে নেই তাই কিছু জিজ্ঞেসও করতে পারছি না। কিন্তু আমি ভাবিনি আমার সব প্রশ্নের উত্তর আসা ভদ্রলোকের একটা কথাতেই পেয়ে যাবো। উনি বাবা-মার দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘মৌ মা যদি ঘরের কাজ না’ও পারে তাতে কোনোরকম অসুবিধা আমাদের নেই। ওকে আমরা ঘরের বউ নয় মেয়ে করে নিয়ে যেতে চাই। প্রথম দেখাতেই আমরা ঠিক করে নিয়েছিলাম ওকেই আমাদের বাড়ির বউ করবো তাই আপনারা দয়া করে উদ্বিগ্ন হবেন না।’
আমি বিস্ফারিত চোখে একবার বাবার দিকে তাকাচ্ছি তো আরেকবার মায়ের। মা এসে আমায় উপরে যেতে বললো। আমার ঘরে আসতেই আলমারি থেকে একটা ভালো শাড়ি বের করে দিয়ে বললো,
‘চটপট সুন্দর করে শাড়িটা পরে তৈরি হয়েনে। আমি চাই ওদের সামনে তুই একটু সুন্দর ভাবে সেজে যাস। আমি একটু খাবারের আয়োজন করতে যাচ্ছি। তুই কিন্তু তাড়াতাড়ি তৈরি হয়েনে বলে দিলাম।’
আমি মুখ দিয়ে ‘টু’ শব্দটুকু করতেও হয়তো ভুলে গেছি। হঠাৎ এই বিয়ের খবর জানো আমার পুরো পৃথিবীটাই ওলট পালট করে দিয়েছে। আকাশ-পাতাল ভাবনার মাঝে মা কাঁধে হাত দিয়ে আমায় বললো,
‘আমি জানি তোর এখন বিয়েতে মত নেই কিন্তু তুই বিশ্বাস কর ওনাদের থেকে ভালো পরিবার আমরা আর পাবো না তোর জন্য। ওনারা নিজে তোকে পছন্দ করেছে সুপ্রিয়ার বিয়েতে। এক সপ্তাহ পর একটা ভালো বিয়ের তারিখ আছে, সেদিনই বিয়ে ঠিক হয়েছে।’
‘মা, এসব তুমি কি বলছো? আমি তোমার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না। এভাবে হুট করে বলা নেই কওয়া নেই আমি বিয়ে করে নেবো? কার সাথে বিয়ে করছি তাকেই তো চিনি না আমি।’
‘সব চিনে যাবি। ওনারা পুরোহিত মশাইয়ের থেকে দিনক্ষণ ঠিক করেই এসেছেন। বুঝতে পারছিস কতটা পছন্দ হয়েছে তোকে। তুই অনেক ভালো থাকবি মা দেখিস, আমাদের এই অভাবের সংসারে আর তোকে কষ্ট করতে হবে না। তুই তো জানিস তোর বাবার অবস্থা, তোর বিয়ে নিয়ে প্রচুর চিন্তা ছিলো আমাদের। এখন বিয়েটা করে নিলে তা আর থাকবে না কারণ ওনারা বলেছেন কিচ্ছু নেবেন না, আমরা যা সাজিয়ে দেবো মেয়েকে তাতেই হবে। আর এভাবে বাড়ি বয়ে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে এসেছেন তাদের তুই ফিরিয়ে দিবি? আমাদের কথা ভেবেই রাজি হয়ে যা মা, আমি বলছি তুই খুব ভালো থাকবি।’
মা চলে গেলো, আমি কিছুই বলতে পারলাম না মায়ের মুখের উপর। সত্যি তো, এই অভাব অনটনের সংসারে এরকম প্রস্তাব আসা হাতে চাঁদ পাওয়ার থেকে কম কিছু না। আজ অবধি বাবার উপর কোনো কথা বলিনি তাই এবারও বলবো না। এটাই আমার ভাগ্যে ছিল ভেবে মেনে নিলাম সবটা।
৭.
রাত হয়ে গেছে। চোখের জলটা মুছে জানলাটা বন্ধ করে সামনে ফিরলাম। দেখলাম কোয়েল এখনও একভাবে শান্ত চাহুনি নিয়ে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। আমি সেটা খেয়াল না করার ভান করে পড়ার টেবিলে আমার বইগুলো সাজাতে লাগলাম। এতক্ষণ ওকেই নিজের অতীত সম্পর্কে বলছিলাম। বিয়ে অবধিই জানালাম, আদিত্যের ব্যাপারে কিছু জানাতে ইচ্ছে করলো না। ওটা না হয় গোপনই থাক আদিত্যের কথা মতো। কিছুক্ষন পর কোয়েল আমার পাশে দাঁড়িয়ে আমার বই সাজাতে সাজাতে ভাঙা কণ্ঠে বললো,
‘আমার মনে হয় তুই বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়ে ঠিকই করেছিস। বাবা-মা আমাদের জন্য যেই সিদ্ধান্ত নেয় তা আমাদের ভালোর জন্যেই নেয়। বাবা-মা যেমন কিছুসময় ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে তেমন আমরাও যে সব সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নিই তা কিন্তু নয়। আমরাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভুল প্রমাণিত হই। যাই হোক, আমি একটু আসছি।’
কোয়েল কথাগুলো বলে আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে চলে গেলো ঘর থেকে। ওকে দেখে মনে হলো ও জানো অনেক কষ্ট নিয়ে কথাগুলো বললো।
‘কোয়েল এভাবে কেন বললো কথাগুলো? ওরও কি কোনো অতীত আছে? জানার চেষ্টা করতে হবে আমায়।’
রাতে ডিনার সেরে নিলাম আমি আর কোয়েল মিলে। কোয়েল ঠিক ব্যবস্থা করে নিয়েছে আমাদের একসাথে থাকার তাও আবার সকালেই। ম্যামদের সাথে যখন কথা বলছিল তখন দেখলাম ম্যামরা ওকে খুব স্নেহ করে। তাই হয়তো খুব তাড়াতাড়ি রাজি হয়ে গেলেন আমার ঘরটা চেঞ্জ করে দিতে। আমি শুতে যাচ্ছিলাম এমন সময় কোয়েল বললো,
‘চল একটু গল্প করি, তারপর ঘুমাবো।’
আমি জানো এই মুহূর্তটারই অপেক্ষা করছিলাম। এই সুযোগেই কোয়েলের থেকে ওর অতীত সম্পর্কে জানতে হবে।
‘কি রে? কি ভাবছিস এতো? টায়ার্ড লাগলে ঘুমিয়ে পর, অসুবিধা নেই।’
‘আরে না না। চল আমিও ভাবছিলাম গল্প করবো।’
‘তাহলে এতো কি ভাবছিলি?’
‘ওই গল্পের টপিক। আচ্ছা তুই তোর সম্পর্কে কিছু বল, ভবিষ্যতে কি করবি?’
‘আমি? আমার ইচ্ছে আছে একটা ভালো জায়গায় জব করার। ব্যাস আর কিছুই না।’
‘তোর বাবা মা, ভাই-বোন?’
‘কলকাতাতে থাকে বাবা-মা। ভাই-বোন নেই আমি একাই। ব্যাস এটুকুই পরিচয় আমার। আর কিছুই না।’
‘আর? বয়ফ্রেন্ড?’
কোয়েল চুপ করে কিছুক্ষন জানলা দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো। আমি ওর উত্তরের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। কোয়েল আস্তে করে বললো,
‘এইসব প্রেম-ভালোবাসা আমার কপালে নেই। আসলে আমি কাউকে বিশ্বাস করিনা রে তাই এইসব জড়াতে ভয় লাগে। এসব ছাড়, কালকে ভার্সিটিতে যেতে হবে তো?’
‘হমম। না জানি কি অপেক্ষা করছে আমার জন্য।’
‘আরে মৌমিতা…
‘মৌ, মৌ বলে ডাকতে পারিস আমায়। এটা আমার ডাকনাম, সবাই এই নামেই ডাকে আমায়।’
‘আচ্ছা। সো, তুই চিন্তা করিসনা। যা হবে দেখা যাবে এখন একটু শান্তিতে ঘুমা। দেখবি সকালে উঠে ফ্রেশ লাগবে। গুড নাইট!’
‘গুড নাইট!’
কোয়েল শুয়ে পড়লে আমিও একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুয়ে পড়ি। আগামীকালের জন্য তো আবার প্রস্তুত থাকতে হবে। যেই মানুসটাকে দেখতে চাইনা তাকেই হয়তো বারবার দেখতে হবে। এসব ভাবতে ভাবতেই আস্তে আস্তে চোখ এঁটে এলো আমার।
৮.
‘ওই যে চলে এসেছে আমাদের টিপিক্যাল বেহেনজি!’
আমি আর কোয়েল ভার্সিটিতে ঢুকছি এমন সময় আমাদের পিছন থেকে কয়েকজন টিজ করে আমাকে কথাটা বললো। কোয়েল আমার হাত ধরে বললো,
‘ক্লাসে চল। এসবে পাত্তা দিয়ে লাভ নেই।’
কোয়েলের কথামতো আমরা এগোতে নিলেই জিয়া আর ওর পাশে থাকা কয়েকজন ছেলে এসে আমাদের সামনে দাঁড়ালো।
‘বাহ, ক্লাসে যাচ্ছো বুঝি আমার থেকে পালিয়ে? কিন্তু তাতেও লাভ হবে না কেন জানো নিশ্চই? তোমার সো কল্ড ফ্রেন্ড এটা অবশ্যই জানিয়ে দিয়েছে যে আমিও ইংলিশ অনার্স ডিপার্টমেনটে। তাই পালিয়ে আর যাবে কোথায়?’
বলেই জিয়া হাসতে লাগলো, পাশ থেকে একটা ছেলে বলে উঠলো,
‘তোমার বেশ ক্ষমতা আছে তো, এই ভার্সিটির সব চাইতে দেমাগী মেয়েকে প্রথম দিনেই বান্ধবী বানিয়ে ফেললে?’
আমি উত্তর দিতে যাবো তার আগেই কোয়েল উত্তর দিলো,
‘তা আপনিও মেয়ে হয়ে যান। আপনার সাথেও বন্ধুত্ব করে নেবো। কি বলেন? পারবেন?’
কোয়েলের কথা শুনে আমিসহ জিয়াও হেসে ফেললো। সেই দেখে ছেলেটা রেগে জিয়াকে ধমক দিলো,
‘জিয়া!’
জিয়া হাসি থামিয়ে কোনো মতে বললো,
‘টেক আ চিল পিল! কোয়েলের সাথে কথা বলছিস কেন? কথা বল এই মিডল ক্লাস্টার সাথে যার ড্রেসিং সেন্স নেই। আচ্ছা মিডল ক্লাস মানলাম বাট ড্রেসিং সেন্স তো ভালো হওয়া উচিত। না আছে ড্রেসিং সেন্স আর না আছে টাকা পয়সা তাই তো এরকম ড্রেস পড়ে এতো বড়ো ভার্সিটিতে পড়তে চলে এসেছো। কি ভেবেছিলে এখানে এসে কোনো বড়লোক ছেলে পটিয়ে নেবে? এরকম লুক দিয়ে? ওহ মাই গড! ছেলে তো দূর কি বাত এই ভার্সিটির মেয়েরাও তোমার কাছে ঘেঁষতে চাইবে না এই থিংক!’
কথাগুলো বলে সবাই হাসিতে ফেঁটে পড়লো। কোয়েল কিছু বলতে যেতে নিলে আমি থামিয়ে দিলাম সেই দেখে জিয়া আবার বললো,
‘কোয়েল, এতদিন নিজের এটিটিউড দেখানোর পর এইরকম চামচাগিরি করাটা ঠিক তোকে মানাচ্ছে না তাও আবার এরকম একটা ক্ষ্যাত মেয়ের হয়ে। লেটস গ গাইস, আবার পরে এর পিছনে সময় নষ্ট করবো।’
এই বলে ওরা হাসতে হাসতে চলে গেলো। আমি কোয়েলকে বললাম,
‘চল ক্লাসে।’
‘এটা যাদবপুর ইউনিভার্সিটি মৌ। একটু তো সহ্য করতে হবে এসব।’
‘জানি। এখন আর কোনো কিছুতেই আমার কোনো যায় আসে না। আমার দরকার পড়াশোনা নিয়ে, সেটা মন মতো করবো তাহলেই হবে পাছে কে কি বললো যায় আসে না।’
‘দ্যাট’স দ্য স্পিরিট! চল।’
চলবে