#একটুখানি_সুখ
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৯ ও ১০
পাত্রপক্ষের সামনে মুখ নিচু করে খিটখিটে মেজাজ নিয়ে বসে আছে মোহ। মাঝে মাঝে মিসেস. নিরার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে সে। মিসেস. নিরা ওকে ইশারায় শান্ত থাকতে বলছে। তবে মোহের মনে শান্তি মিলছে না। মাথা উঁচিয়ে সরু চোখে চশমা পড়া ব্যক্তিটির দিকে তাকাল মোহ। তার মিমির মতে এটাই সেই পাত্র। চোখে চিকন ফেমের চশমা, মাথায় জেল দিয়ে সেট করা চুল, মুখে ক্লিন শেভ দাড়ি। গাল যেন চকচক করছে। মুখে মুখে লজ্জা লজ্জা ভাব নিয়ে বসে আছে লোকটা। যা দেখে জ্বলে উঠে মোহ। তাৎক্ষণিক নিজের দৃষ্টি সরিয়ে ফেলতেই বয়স্ক মহিলা জিজ্ঞেস করে ওঠে,
“তোমার নাম কি মা?”
“মোহ আনবীর।”
দাঁতে দাঁত ভিড়িয়ে শান্ত থাকার চেষ্টা করে উত্তর দিল মোহ। আচ্ছা তারা কি বায়োডাটা দেখেনি? সেখানেই তো সব দেওয়া থাকে। তবে এত প্রশ্ন করার মানে কি? এবার একজন মধ্য বয়স্ক মহিলা বলল,
“আচ্ছা তোমার চুল দেখি! একটু কোঁকড়ানো মনো হচ্ছে। বড় কিনা দেখি? আঁচল দিয়ে ঢেকে রেখেছো যে!”
এবার অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে মোহ। এটা তার কাছে বেশি বাড়াবাড়ি। পাত্রী দেখতে এলে এভাবে কেউ চেক করে? মোহ রাগ দমাতে না পেরে কিছু বলতে উদ্যত হলো। কিন্তু কথাটুকু মুখ থেকে বের হলো না তার। কারো কন্ঠস্বর শুনে ঘাড় ঘুড়িয়ে দরজার দিকে তাকালো সে। দরজা পেরিয়ে হেঁটে আসা মানুষটাকে দেখে অবাক না হয়ে পারল না মোহ। এ তো স্বচ্ছ!
স্বচ্ছ মোহের দিকেই এগিয়ে আসছে। হম্বিতম্বি করে এগিয়ে এসে প্রথমেই মোহের চুড়ি পড়া হাতটা খপ করেই ধরে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিল স্বচ্ছ। মোহ কিছুটা চমকে উঠে অবাক নয়নে চাইলো স্বচ্ছের দিকে। স্বচ্ছ কিছুটা বিচলিত হয়ে বলল,
“তুমি এখন এখানে কি করছো? আমার সাথে যেতে হবে চলো ফাস্ট।”
“মানে? কোথায় যাব আপনার সাথে?”
“অভিয়েসলি আমার বাড়িতে।”
সকলে হতবাক হয়ে চেয়ে রইল। পাত্রপক্ষের ফ্যামিলিরা বাঁকা দৃষ্টিতে স্বচ্ছ আর মোহের দিকে চাইছেন। বিশেষ করে স্বচ্ছ এসে প্রথমেই মোহের হাতটা ধরে নেওয়ায় তারা সন্দেহের সঙ্গে দেখছে। বিষয়টা সামলাতে মিসেস. নিরা এগিয়ে আসেন।
“কি হয়েছে স্বচ্ছ? ও তোমার বাড়ি যাবে কেন এসময়?”
“ওপপস সরি! রিজন তো বলিই নি। দাদিমা যেতে বলল মোহকে। উনি মোহকে মিস করছেন। মন খারাপ করে আছেন। বাই দ্যা ওয়ে, আমি কি ভুল টাইমে এন্ট্রি নিলাম?”
পাত্রপক্ষ নজরে আসতেই শেষকথাগুলো বলে ফেলল স্বচ্ছ। মোহ না চাইতেও বেশ খুশি হলেও তা প্রকাশ করল না। তবে খুশিতে লাফিয়ে উঠার ইচ্ছেটা দমিয়ে রাখতে পারছে না সে। স্বচ্ছের হাত ধরে যদি এই পাত্রপক্ষের হাত থেকে বাঁচা যায় তাহলে মন্দ হয় না। অন্তত জীবনে স্বচ্ছের দ্বারা একটা তো ভালো কাজ হবে! মিসেস. নিরা অসাময়িক হেঁসে পাত্রপক্ষের উদ্দেশ্যে বলেন,
“ওহ, আপনাদের বলায় হয়নি। ও আমার ভাইয়ের ছেলে। মোহের মামাতো ভাই। আমার মা খুব অসুস্থ। উনিই হঠাৎ হয়ত আবদার করেছেন মোহকে দেখবেন। তাই স্বচ্ছ এসেছে। আর স্বচ্ছ উনারা মোহকে দেখতে এসেছেন।”
“ওহ রিয়েলি? ওয়াও। তাহলে বলা যায় রাইট টাইমে এন্ট্রি নিয়েছি। এদের সাথে মিনিমাম পরিচয়টুকু হওয়া যাবে। আমিও একটু দেখি আমার সো কলড কাজিনের বিয়েটা কার সাথে!”
বলামাত্র একটা অ্যাপেলের টুকরোতে হাত দিয়েও দিল না স্বচ্ছ। নাক শিটকে পাত্রের পাশাপাশি দুম করে বসে পড়ল সে।
“নাম কি পাত্রের?”
সবাই অদ্ভুত নয়নে চেয়ে আছে স্বচ্ছের দিকে। কেউ উত্তর দিল না। বরং চেয়েই আছে। যেন সে এই পৃথিবীর নয় ভিনগ্রহের বাসিন্দা। কারো উত্তর না পেয়ে সোজা হয়ে বসল স্বচ্ছ। ভ্রু কুঁচকে বলল,
“নাম জিজ্ঞেস করেছি। সবাই এমনভাবে তাকিয়ে আছে যেন আমি জিজ্ঞেস করে ফেলেছি যে, ‘তুমি কি প্রেগন্যান্ট?’ এটা তো বলিনি। আরে মি. পাত্র তুমি কি বোবা? নাকি স্মৃতি দুর্বল? ফুপি কাকে ধরে এনেছেন?”
“আমার নাম আদিল মাহমুদ।”
রাগের ঝাঁজ পাওয়া গেল পাত্রের কথায়। স্বচ্ছ সেটা বুঝে জিজ্ঞেস করল,
“একটা নাম বলতে এতক্ষণ? কথা বলতেও পারো না মি. আদিল? ওইযে সামনে যে বসে আছে যাকে বিয়ে করার জন্য এসেছো সে তো কথা বলে তোমার মস্তিষ্ক চিবিয়ে ফেলবে। তুমি কথা না বললে কি হয়?”
হাত মুঠো করে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি স্বচ্ছের দিকে নিক্ষেপ করছে মোহ। ভেবেছিল লোকটা তাকে বাঁচাতে এসেছে কিন্তু লোকটা তো উল্টে তাকে ফাঁসিয়ে দিচ্ছে। তাই সে বিলম্ব না করে উঠে দাঁড়িয়ে ঝাঁঝালো কণ্ঠে বলল,
“স্বচ্ছ ভাই? আপনার না আমাকে নানিমার কাছে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল? আপনি কি এখন বসে বসে বায়োডাটা নেবেন পাত্রের?”
“তোমার জন্য পাত্রটা পারফেক্ট কিনা বুঝতে হবে না আমায়?”
“আপনাকে বুঝতে হবে না। আমি নানিমার কাছে যাব। চলুন।”
মিসেস. নিরা আটকাতে চাইলেন মোহকে। কিন্তু তার আগেই মোহ উনার মুখের ওপর বলে দিলেন,
“মিমি! তুমি জানো আমি এখন কোনোকিছুর বিনিময়ে নানিমার বিষয়ে স্যাক্রিফাইজ করতে পারব না। সো প্লিজ আটকানোর চেষ্টা করবে না। আমি যাচ্ছি। স্বচ্ছ ভাই, আপনি যাবেন নাকি আমি একাই যাব?”
“রিল্যাক্স যাচ্ছি।”
সোফা থেকে উঠে আসে স্বচ্ছ। দুজনেই বেরিয়ে আসে। বাড়ি থেকে।
বাইকে তড়িঘড়ি করে স্বচ্ছের কাঁধ চেপে ধরে উঠে পড়ে মোহ। যদিও তার শাড়ি অগোছালো হয়ে পড়েছে। শাড়ি পড়ে থাকার অভ্যেস তার বরাবরের মতো নেই। জীবনে যে কয়বার শাড়ি পড়েছে সেই কয়বার তার মা তার সাথে ছিল। কিছু প্রবলেম হলেই মায়ের কাছে গিয়ে ঘ্যানঘ্যান করত মোহ। এটা খুলে গেছে, সেটা খুলে গেছে! এখন তো ঘ্যানঘ্যান করার জন্য মানুষটাও নেই। বিধায় একা শাড়ি সামলাতে হচ্ছে মোহকে।
“আরে আস্তে! এভাবে কেউ হুমড়ি খেয়ে বাইকে উঠে পড়ে না। দুপুরে তো বাইকেই উঠতে চাইছিলে না। এখন এমন করছো যে আমার বাইকে না উঠতে পারলে তোমার দিনটাও যাবে না।”
“সেটাই ধরে নিন। আর থ্যাংক ইউ।”
মুখে বড় হাসির রেখা টেনে বলল মোহ। স্বচ্ছ গাড়ি স্টার্ট দিয়ে কনফিউজড হয়ে বলল,
“থ্যাংক ইউ বাট হুয়াই? সস্তা থ্যাংকস আহিয়ান স্বচ্ছকে দিচ্ছো কেন?”
“ওইতো ওই চিপচিপে পাত্রপক্ষের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য। উফফ… নিজেকে একেবারে একটা শং লাগছিল। একবার নানিমার কাছে যাই আমি একেবারে জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়ে থ্যাংক ইউ জানাবো তাকে।”
“তোমাকে কে বলল আমি তোমাকে বাঁচিয়েছি?”
“মানে?”
“মানে এটা। আমার মনে হচ্ছে উল্টেটা। আমি ওই কি যেন নাম! আদিল। ওকে বাঁচিয়েছি। তোমার মতো একটা মেয়ে ওর বউ হলে কি ফাঁসান ফাঁসবে জানো? ডু ইউ হ্যাভ এনি আইডিয়া? হি ডিজার্বস বেটার।”
মুখখানা বেলুনের ন্যায় চুপসে গেল মোহের। তার মনে দৃঢ় ইচ্ছে জাগল সমানের থাকা লোকটার মাথায় মেরে বাইক থেকে একেবারে ফেলে দেওয়ার। কিন্তু এই কাজটা করলে তো সে নিজেও পড়ে যাবে। তাই ইচ্ছেটাকে মাটিচাপা দিয়ে দিল মোহ। অনুরোধের সুরে বলল,
“শুনুন, আপনার কাছে রিকুয়েস্ট। প্লিজ যাবার সময় আর কোনো কথা বলবেন না। বিশেষ করে এমন কোনো কথা বলবেন না যাতে আপনাকে বাইক থেকে ফেলে দেওয়ার ইচ্ছেটা আবার জেগে ওঠে।”
বাইক থামিয়ে দেয় স্বচ্ছ মাঝরাস্তায়। সে দ্রুত বাইক থেকে নেমে মোহকে রাস্তা দেখিয়ে বলে,
“নামো!”
কপালে ভাঁজ পড়ে মোহের। মাঝরাস্তায় হঠাৎ লোকটা তাকে নামতে বলছে কেন? আশেপাশে দেখে নিয়ে বলে,
“নামব কেন? এখনো তো অনেক পথ আছে।”
“আমি বলছি নামো।”
ধমক দিয়ে বলল স্বচ্ছ। মোহ তড়িঘড়ি করে নামে গিয়েও পারল না। পেটের কাছে শাড়ি ধরে চোখ বড় বড় করে চেয়ে থাকল সে। স্বচ্ছ তা দেখে আবারি উঁচু সুরে বলে,
“কি হলো নামো? শুনতে পাচ্ছো না?”
“নামতে পারব না আমি।”
“নামতে পারবে না মানে?”
“মানে পারব না।”
মোহের দিকে অগ্নিদৃষ্টি নিক্ষেপ করে স্বচ্ছ। ওর দিকে হাত বাড়াতেই মোহ দম ফেলে জোরে জোরে বলে ওঠে,
“বাইকে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে ওঠার সময় আমার শাড়ির অর্ধেক কুঁচি খুলে গিয়েছে। এখন যদি নেমে যাই পুরো শাড়ি খুলে টুলে যাবে।”
স্বচ্ছের চোখজোড়াও গোল গোল হয়ে যায় এবার। হালকা কেশে উচ্চস্বরে বলে,
“হোয়াট দ্যা…! ঠিক করে নাও এখনি।”
“রাস্তায়?”
ভয়ার্ত সুরে বলে মোহ। স্বচ্ছ বিরক্তির দৃষ্টিতে আশেপাশে তাকায়। এখন কোথায় শাড়ি ঠিক করার জায়গা করে দেবে সে মোহকে? মোহ আবারও কাঁচুমাচু হয়ে বলে,
“আর আমি একা ঠিক করতেও পারব না।”
“এখন কি শাড়ি ঠিক করে দিতেও সার্ভেন্ট প্রয়োজন তোমার?”
“আগে তো মা ঠিক করে দিতো।”
মিহি সুরে বলে মোহ। স্বচ্ছের চোখে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে সে। স্বচ্ছও তাকায় তার দিকে এরূপ কথা শুনে। মোহের দৃষ্টি মলিন। তার মলিন দৃষ্টি কেন যেন ক্ষীণ যন্ত্রণা দিল স্বচ্ছের হৃদয়ে। মেয়েটা সদ্য নিজের মা-বাবাকে হারিয়েছে। তার চোখে এখনো তাদের হারানোর যন্ত্রণা ভেসে ওঠে। ঢক গিলে স্বচ্ছ গাম্ভীর্যের সুরে বলে,
“ওকে লেটস গো।”
“কোথায়?”
“অবশ্যই পাবলিক প্লেসে নিজের শাড়ি ঠিক করবে না? কোনো রেস্তোরাঁ বা হোটেলে যাচ্ছি। সেখানে ওয়াশরুমে গিয়ে সব ঠিক করে নিবে। ইজ দ্যাট ক্লিয়ার?”
“কিন্তু এতখানি পথ কি করে যাব? এতখানি যেতে যেতে পুরো শাড়ি খুলে যাবে।”
স্বচ্ছ দাঁত কিড়মিড় করে তাকায় মোহের দিকে। তাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত দেখে নেয় সে। পেটের কাছে এসে আঁটকে যায় তার চোখ। কুঁচি বেশ খানিকটা খুলে যাওয়ায় হাত দিয়ে শাড়ি ধরে থাকবার পরেও পেটের কিছু অংশ দেখা যাচ্ছে। চোখ বন্ধ করে দ্রুত নজর সরিয়ে মাথা ঝাঁকায় স্বচ্ছ। বিদ্যুতের গতিতে গিয়ে বাইকে বসে পড়ে সে। আর শুকনো গলায় বলে,
“শাড়ি ঠিক করে ধরে রাখো মিস. মোহ। পেটের বেশ খানিক অংশ দেখা যাচ্ছে। লোভে পড়ে গেলে আমি দায়ি নই।”
মাথাটা ভনভন করে ঘুরে যায় মোহের। কি বেশরম কথাবার্তা! এমনভাবেও বলা যায়। শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতিতে এই লোকটার সঙ্গেই একই বাইকে কি করে যাচ্ছে সেটা যেন সে-ই জানে। এমন কথা না বললে কি পেটের ভাত হজম হচ্ছিল না?
স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ওয়াশরুম থেকে বের হয় মোহ। শাড়িটা কোনোমতে ঠিক করতে পেরেছে সে। তবুও ঠিকঠাক হাঁটতে সক্ষম হচ্ছে না। ছোট ছোট পায়ের ধাপ ফেলতেই সে লক্ষ্য করে রেস্টুরেন্টের অনেক মানুষই তার দিকে অসাময়িক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। তাকিয়ে থাকার কারণটা জানা মোহের। সে শাড়ি ঠিক করে কুঁচি করতেই পারেনি। স্বচ্ছ যেই সিটে গিয়ে বসে আছে সেখানে যেতেই দেখতে পেল বেশ মনোযোগের সহিত ফোন ঘাঁটাঘাঁটি করে চলেছে স্বচ্ছ। মোহের উপস্থিতি বুঝে ফোন থেকে চোখ সরিয়ে মোহের দিকে তাকাতেই চোখজোড়া ছানাবড়া হয়ে যায় স্বচ্ছের। অস্ফুটস্বরে বলে,
“এটা কিভাবে শাড়ির কুঁচি ঠিক করেছো তুমি?”
“পারিনি তো। পারলে কি এভাবে ঠিক করে আসতাম নাকি?”
স্বচ্ছ কিছু বলতে গিয়েও বলল না। দাঁতে দাঁত চেপে ফোনে আবার চোখ রেখে বলল,
“বসো সিটে।”
ভ্রু কুঁচকায় মোহ। কনফিউজড হয়ে বলে,
“আমাদের না নানিমার কাছে যাওয়ার কথা ছিল? এখানে বসে কি করব? তাড়াতাড়ি যেতে হবে তো।”
“দুপুরে কিছু খাইনি আমি। খেয়ে তারপর যাব।”
“সেটা তো আপনার বাড়িতে গিয়ে খেলেও পারেন।”
স্বচ্ছ এবার চোখ গরম করে তাকায়। রাগে ফুঁসে উঠতেই বসে যায় মোহ। স্বচ্ছের টেরাবাঁকা কথা শোনার পরিস্থিতিতে নেই সে। না বসলে শাড়ির কুঁচি আবারও খুলে টুলে যেতে সময় লাগবে না। ফোনটা পকেটে রেখে বিষাদময় মুখে ওয়েটারকে ডাকে স্বচ্ছ। এগিয়ে আসে ম্যানেজার। হাসি হাসি মুখে বলে,
“স্যার আপনি আবার? একটু আগেই তো খেয়ে গেলেন তাই আবার আপনাকে দেখে একটু অবাক হলাম।”
ম্যানেজারের কথা শুনে সন্দেহ হয় মোহের। সন্দিহান হয়ে স্বচ্ছের মুখের পানে তাকায় সে। স্বচ্ছ বাঁকা চোখে মোহের রিয়েকশন বোঝার চেষ্টা করছে। তৎক্ষনাৎ আবারও ম্যানেজার মোহকে দেখে বলে উঠল,
“ইনি কে? আপনার মিসেস?”
এবার বিষম খায় মোহ। স্বচ্ছও কিছুটা স্তব্ধ হয়ে হালকা কেশে বলল,
“না। আপনি বরং ওয়েটারকে ডেকে দিন। আমি অর্ডার দেব।”
“আমাকেই বলুন আমি না হয় নিয়ে যাচ্ছি অর্ডার।”
“ওকে দেন। চিকেন বিরিয়ানি, মাটন ভুনা আর ভেজিটেবল স্যালাদ দিয়ে দিন। ফাস্ট। অলরেডি অনেক বেজে গিয়েছে। আর সবগুলো ডাবল করে দেবেন।”
ঘড়ি দেখে বলে স্বচ্ছ। ম্যানেজার তাড়াহুড়ো করে মাথা দুলিয়ে চলে যায় খাবারের অর্ডার নিয়ে। অর্ডার দিয়ে মোহের দিকে তাকাতেই মোহের অদ্ভুত চোখজোড়া তার দিকে স্থির থাকতে দেখে নড়েচড়ে বসে স্বচ্ছ। আর জোর দিয়ে বলে,
“কি ব্যাপার এভাবে তাকিয়ে আছো কেন? আমায় দেখোনি কোনোদিন? এভাবে তাকাবে না আমার দিকে।”
মোহ নজর সরালো না। বরং আরো গভীর দৃষ্টিপাত করল স্বচ্ছের দিকে। যা খেয়াল করে উসখুস করতে লাগল স্বচ্ছ। এবার মোহ দম নিয়ে বলল,
“আচ্ছা আপনি এখানে দুপুরে খেয়ে গিয়েছিলেন?”
“অদ্ভুত প্রশ্ন করছো কেন? আমাকে দেখে কি খাদক মনে হয়? যে একটু আগে খেয়ে আবার খেতে চলে আসব?”
কড়া গলায় বলে মোহের বলা প্রশ্ন ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করল স্বচ্ছ। কিন্তু মোহের সন্দেহ আরো গাঢ় হলো। আগ্রহ নিয়ে বলল,
“ম্যানেজার কি ভুল বলল তাহলে? আর আপনি সব ডাবল অর্ডার দিলেন কেন? আর যা যা অর্ডার দিলেন সেসব আমার ফেবারিট।”
“তো কি বলতে চাইছো তুমি? তোমার সামনে আমি বসে বসে খাব আর তুমি হা করে চেয়ে থেকে দেখবে আর বাড়িতে গিয়ে আমার পেট খারাপ করবে? এটা হচ্ছে না সরি। আমি নিজের পেট খারাপ করতে চাইছি না। সো তুমিও খাবে। আর আমি কি করে জানব এসব তোমার ফেবারিট। যাক কোথাও না কোথাও আমাদের একটু তো মিল আছে। আর বেশি প্রশ্ন করবে না গোয়েন্দার মতো। কে তোমার বড়? আমি তো?”
মোহ সরু চোখে তাকিয়ে মাথা হালকা দুলাতেই স্বচ্ছ আবারও বলে ওঠে,
“সো প্রশ্ন করার অধিকার আমার। তুমি গোয়েন্দাগিরি করবে না আন্ডারস্ট্যান্ড?”
কিছু বলতে চেয়েও বলল না মোহ। ঠোঁট উল্টে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বসে রইল সে। প্রশ্নের উত্তরে নিজে হেরে যেতে যেতে সে বিরক্ত। কথা কাটাকাটিতে সে কবে জিতবে? লোকটা কথায় কথায় তাকে হারিয়ে দিতে দিতেও কি ক্লান্ত হয়ে যান না?
ভীষণ খিদে পেয়েছে মোহের। খাবার খেয়ে যাচ্ছে সে। মনে মনে বেশ কয়েকবার স্বচ্ছকে ধন্যবাদ জানালেও মুখে প্রকাশ করল না সে। তার মিমি তো পাত্রপক্ষের সামনে নিয়ে যাওয়ার চক্করে তাকে খাওয়াতেই ভুলে গেছে। এটা নিয়ে তার মিমির প্রতি চরম অভিমান হয়েছে মোহের। মনোযোগ দিয়ে খাওয়ার এক পর্যায়ে সে খেয়াল করে স্বচ্চ তার দিকে একমনে চেয়ে থেকে চামচ দিয়ে খাবার নাড়ছে। মুখে দিচ্ছে না খাবার। খাবার চিবোতে চিবোতে থেমে যায় সে। ‘স্বচ্ছ’ নাম মানুষটার চোখ বড্ড ঘোলাটে। সেই ঘোলাটে চোখে কোথাও না কোথাও হারিয়ে যায় মোহ। খুঁজে পায় না নিজেকে। এ কেমন ধারা রহস্যের দ্বার?
চামচ দিয়ে জোরে শব্দ করে মোহ স্বচ্ছের ধ্যান ভাঙাতেই স্বচ্ছ দৃষ্টি তাড়াহুড়ো করে সরিয়ে নেয়। খাবার নেড়েচেড়ে অল্প করে মুখে দেয়। মোহ নিচু সুরে জিজ্ঞেস করে,
“খাচ্ছেন না কেন?”
“খাওয়া হয়ে গেছে তাই।”
“কিছুই তো খেলেন না খাওয়া হয়ে গেল?”
“আমি তোমার মতো খাদক নয়। সেজন্য হয়ত অল্পতেই চলে।”
লোকটা তাকে খোঁটা দিল? কি এমন খেয়েছে সে? খাওয়া অর্ধেকও শেষ করেনি। এসব ভাবতেই চোখমুখ লাল হয়ে আসে মোহের। খাবারের প্লেট ঠেলে দিয়ে ঝাঁঝালো কন্ঠে বলে,
“আমি আর খাব না।”
“জাস্ট কিডিং। মজা আর সিরিয়াস হবার পার্থক্য বোঝো না বোকা মেয়ে! আর তোমাক দেখে কে বলবে তুমি খাদক? নিজের চেহারা দেখেছো? মাঝে মাঝে সন্দেহ হয় ছোট ফুপি তোমায় খেতে দেয় কিনা! নাকি তুমি খেতে পারো না?”
রাগে-দুঃখে আবারও প্লেট কাছে টেনে নেয় মোহ। এবার আগের থেকে দ্রুত খেতে শুরু করে সে। মানুষটা কি তাকে অশান্তি দেবার জন্য এসেছে? এটা ভেবে ভেবে রাগে খাবার চিবিয়ে যাচ্ছে মোহ। স্বচ্ছ তার কান্ড দেখে মুখ ঘুরিয়ে মিটমিটিয়ে হেঁসে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে তার মনে হয় মেয়েটা বড্ড চালাক। আবার কখনো কখনো যেন পৃথিবীর সবথেকে বোকা তাকেই মনে হয়।
খাবার খাওয়া শেষে উঠে পড়ল দুজনেই। স্বচ্ছ রেস্টুরেন্টে বিল মিটিয়ে চলে এলো বাইকে। বাইকে উঠে বসতেই মোহকে দেখতে পেল সে। ছোট ছোট পায়ের ধাপ ফেলে ধীরে এগিয়ে আসছে মোহ। শাড়ির কুঁচি ঠিক না থাকার কারণে হাঁটতে সমস্যা হচ্ছে তার। স্বচ্ছ বড়বড় কয়েকটা শ্বাস ফেলে আবারও বাইক থেকে নামতেই ঘটে গেল আচমকা ঘটনা।
ভালোভাবে হাঁটতে না পেরে জুতোর সাথে শাড়ি পেঁচে গিয়ে পা মচকে গেল মোহের। নিজেকে সামলাতে না পেরে মৃদু চিৎকার দিয়ে বসতে নিলে স্বচ্ছ তড়িঘড়ি করে ধরে তাকে। নিজেকে সামলাতে গিয়ে মোহ নিজেও স্বচ্ছের পিঠের শার্ট খামচে ধরে সঙ্গে স্বচ্ছের হাতেও হাত রেখে তার দিকে ঢলে পড়ে। ডান পায়ে প্রচন্ড ব্যথা করছে তার। ঠোঁট কামড়ে ব্যথা সহ্য করছে সে।
“কেয়ারলেস গার্ল! মেয়ে হয়ে শাড়ি সামলাতে পারো না?”
মোহ কিছু বলল না। কিছু বলার মতো অবস্থাতে নেই সে। স্বচ্ছ তাকে ধরে নিয়ে গিয়ে বাইকে বসিয়ে নিজে হাঁটু গেড়ে বসল। মোহ চোখ বন্ধ করে ব্যথা সহ্য করছে। নিজের পায়ে স্বচ্ছের হাতের স্পর্শ পেতেই আঁতকে উঠে পা সরিয়ে নেয় সে।
“উফফ… কি করছেন এগুলো? পায়ে হাত দেন কেন আজব?”
স্বচ্ছ মোহের পা টেনে নিয়ে বলে,
“পা কি খারাপ জিনিস নাকি? নারীদের কোমল পায়ে এক অন্যরকম সৌন্দর্য থাকে। সেখানে আঘাত পেলে সে যতটা না যন্ত্রণা পায় তার কাছের কেউ তার চেয়ে বেশি যন্ত্রণা পায়।”
মোহের পায়ে আলতো করে মালিশ করে দিতে থাকল স্বচ্ছ অন্যমনস্ক হয়ে। মোহ স্বচ্ছের কথাগুলোর বিন্দুমাত্র মানে খুঁজে না পেয়ে ভ্যাবাচেকা খেয়ে বসে রইল। বেশ কিছুক্ষণ পর উঠে দাঁড়াল সহ্য। মোহ পা নাড়ালো। যন্ত্রণা কমেছে তবে পুরোটা কমেনি।
“বাড়ি গিয়ে মেডিসিন লাগিয়ে নেবে। যন্ত্রণা কমবে। নেক্সট টাইম শাড়ি পড়ার দরকার নেই। বুঝলে?”
মোহ তবুও কিছু বলল না। স্বচ্ছ বাইক স্টার্ট দিয়ে গাড়িটা মোহের বাড়ির দিকে ঘুরাতেই হতভম্ব হয়ে মোহ বলে,
“আরে ওদিকে যাচ্ছেন কেন? নানিমার কাছে যাব না?”
“না।”
স্বাভাবিক ভাবে উত্তর দেয় স্বচ্ছ। মোহ রাগে একাকার হয়ে প্রশ্ন করে,
“তাহলে এতদূর আনার মানে কি আমায়?”
“আমি অলরেডি বলেছি তোমায়। ওইযে আদিল ছেলেটা আরো ভালো ডিজার্ব করে। সো… তাকে বাঁচাতে এই প্রচেষ্টা।”
মাথা ঘুরে গেল মোহের। তার মানে স্বচ্ছ তাকে মিথ্যা বলে বাড়ি থেকে এনেছে। কাঁদবে না হাসবে জানা নেই মোহের। ফলস্বরূপ হা করে বসে রইল সে। কিছু বলতে গিয়েও পারল না। কি বলবে?
রাতের আঁধারে কমে এসেছে লোকজনের আনাগোনা। সকল জীবন যেন ঘুমের ঘোরে। এলোমেলো ভঙ্গিতে হাত-পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে আছে মোহ। পড়নে সেই শাড়িটাই রয়ে গেছে। চুলগুলো এলোমেলো। এসির বাতাসে ঠান্ডা হিম হয়ে এসেছে তার শরীর। তবুও নড়চড় নেই তার। টিমটিমে ল্যাম্পশিট জ্বালিয়ে রাখা। সেই বিকেলের দিকে স্বচ্ছ তাকে বাড়ি দিয়ে গেছে। তারপরই মিসেস. নিরা তাকে বলেছে তাকে পছন্দ করেছে ছেলের পরিবার। পছন্দ না করার কোনো কারণ নেই। বড়লোকের ঘর তার ওপর সুন্দরী মেয়ে। মা-বাবাও মারা গেছে। সব মিলিয়ে ভাবনা চিন্তা করেই যেন পাত্রপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারপর থেকে মিসেস. নিরার সঙ্গে রাগারাগি করে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়েছে মোহ। আর খোলেনি। আয়মানের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করতে করতে ঘুমিয়েই পড়েছে সে। রাতের খাবারও ভালো করে খাওয়া হয়নি তার। বিষণ্ণ মনে ঘুমিয়ে গেছে সে।
তার রুমের দিকে এগিয়ে আসতে দেখা যায় এক অবয়বকে। অবয়ব ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়। অচেনা হয়েও এক চেনা মুখ। সেই মুখেও এক অদ্ভুত বিষণ্ণতা। সেই আগন্তুক এসে হাত ছোঁয়ায় মোহের গালে। ঘুমের মাঝে আলতো কেঁপে ওঠে মোহ। ঠান্ডায় শিথিল হয়ে আছে গাল ও মুখশ্রী। বেশ যত্নের সাথে আগন্তুক লোকটি চাদর জড়িয়ে দেয় মোহের গায়ে। মোহের চুলে হাত দিতে গেলেই লোকটিকে চমকে দিয়ে অফ হয়ে যায় সমস্ত লাইট। আচমকা এমন কান্ডে কিছু হতবিহ্বল হয় লোকটি। খটখট শব্দে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ে সে।
চলবে..