#একটুখানি_সুখ
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩৯
সকালের আলো বেশ ভালোভাবে ফুটেছে। পাখির কিচিরমিচির শুনতে পাওয়া যাচ্ছে চারিদিকে। বান্দরবান জায়গাটি বেশ গাছগাছালিতে ভরা। যা মন মাতিয়ে দিতে সক্ষম। গাছ বেশি থাকার কারণে পাখির আনাগোনাও বেশ। স্বচ্ছ ক্লান্ত ভঙ্গিতে রিসোর্টে প্রবেশ করলো। ধীরে ধীরে পা ফেলতে ফেলতে নিজের দিকে তাকিয়ে খেয়াল করল শার্টের বেশ কয়েকটা বোতাম খোলা। তাড়াহুড়োতে শার্টও ঠিকঠাক পরতে পারেনি সে। তৎক্ষনাৎ নিজের হাত দিয়ে বোতাম লাগাতে লাগাতে প্রথমেই গার্ডেন সামনে পড়ল। গার্ডেনের সরু রাস্তা দিয়ে যেতেই স্বচ্ছের খেয়াল হলো মোহের দিকে। ঘাড় বাঁকিয়ে তাকালো সে। মোহকে দেখতে পেলো। সে থম মেরে হাতে একটা কফির মগ নিয়ে বসে আছে বেতের চেয়ারে। তার সামনে বেতের টেবিলে অন্যহাত দিয়ে একভাবে বসে আছে সে। একটুও নড়াচড়া অবধি নেই। কেমন জানি শুঁকনো লাগছে তার মুখ। মোহের এমন আচরণ দেখে কপালে ভাঁজ পরে স্বচ্ছের। রিসোর্টের ভেতরে না গিয়ে মোহের কাছে এসে দাঁড়ায় সে। তবুও কোনো হেলদোল নেই মেয়েটার। সে নির্বিকার। একভাবে বসে আছে মাটির দিকে তাকিয়ে।
স্বচ্ছ এবার হাঁটু গেঁড়ে বসে মোহের সামনে। সঙ্গে সঙ্গে হকচকিয়ে ওঠে মোহ। স্বচ্ছ মোহের হাত ধরে বলে,
“হোয়াট? এভাবে পুতুলের মতো বসে আছো কেন?”
“এমনি। ভালো লাগছিল না তাই। আপনি তো রুমে ছিলেন না তাই একা বাহিরে এসেছি।”
“কখন ঘুম ভেঙেছে?”
“এইতো একটু আগেই। আপনি কোথায় গিয়েছিলেন?”
থমথমে কন্ঠে বলে মোহ। স্বচ্ছের দিকে মনোযোগ দিয়ে তাকায় সে। স্বচ্ছের মুখভঙ্গি দেখতে চায় মোহ। স্বচ্ছ যদি একবার সত্যি বলে তাহলে মোহের মনে কোনো দ্বিধা থাকবে না। সে অপেক্ষায় আছে স্বচ্ছ তাকে সত্যিই বলবে। কিন্তু তাকে ভুল প্রমাণিত করে দিয়ে স্বচ্ছ আমতা আমতা করে বলে ওঠে,
“ভোরে হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। তাই বাহিরে হাঁটতে গিয়েছিলাম। কখন এতো লেট হয়ে গিয়েছে বুঝতেই পারিনি।”
স্বচ্ছের এমন মিথ্যে কথায় মোহের পায়ের তলা থেকে যেন একটু একটু করে সরে যেতে থাকে। এক পাহাড় সমান যেই বিশ্বাস স্বচ্ছের প্রতি মোহের মনে জড়ো হয়েছিল সেটা একটু একটু ভেঙে যেতে থাকে। কোথাও একটা মস্তিষ্ক বলে ওঠে, তাহলে কোনটা মিথ্যা? আমার সঙ্গে কাটানো প্রতিটা মুহূর্ত মিথ্যা? নাকি রিসোর্টে যেটা দেখে এলাম সেটা মিথ্যা?
কেন যেন সম্পর্কটা নিজের ভিত্তি হারিয়ে ফেলছে। মোহের মাথা ভনভন করছে। স্বচ্ছের দিকে ঘৃণা সহ দৃষ্টিপাত করে সে। অনেকগুলো প্রশ্ন করতে ইচ্ছে করছে তাকে। মনে হচ্ছে এক্ষুনি এই বিশ্বাস আর এই ভরসার অযোগ্য মানুষটাকে ঠাটিয়ে থাপ্পড় মারতে। কিন্তু নিজেকে দমন করল মোহ। স্বচ্ছ তার কোনো উত্তর না পেয়ে জিজ্ঞেস করে,
“কেমন জানি লাগছে তোমায়। তুমি ঠিক আছো তো?”
বলেই মোহের গালে হাত দিয়ে বসে স্বচ্ছ। মোহের মন তবুও সহজে মেনে নিতে চায় না স্বচ্ছের এই স্পর্শ। এই হাত দিয়ে রিয়ানার হাত বেশ শক্ত করে ধরে রিসোর্টে ঢুকে গিয়েছিল সে। মোহ সরিয়ে নেয় নিজের গাল থেকে স্বচ্ছের হাতটা। আর রসকষহীন কাঠখোট্টা কন্ঠে বলে,
“আমার আবার কি হবে? কিছু হয়নি।”
“আচ্ছা, তুমি কি গতকালকের ঘটনাগুলো নিয়ে টেনসড? মানে আমাদের মধ্যে যা যা হয়েছে সেসব বিষয়ে তুমি চিন্তিত? হঠাৎ করেই…”
“নাহ। গতকালকে আমি সজ্ঞানে ছিলাম আমার যতদূর মনে আছে। তাই চিন্তিত হবার কোনো কারণ দেখি না আমি।”
“তাহলে তোমার শরীর কি খারাপ লাগছে?”
মোহ এবার আচমকা চেঁচিয়ে জবাব দিয়ে ওঠে,
“উফফ… এতো বিরক্ত করছেন কেন আপনি আমায়? আমি বলেছি আমার শরীর খারাপ? বলিনি তো। অযথা আজগুবি প্রশ্ন করে আমাকে ইরিটেট করবেন না স্বচ্ছ। আমাকে একা থাকতে দিন। প্লিজ!”
বলেই উঠে দাঁড়ায় মোহ। তার গায়ের প্রতিটা রগ যেন জ্বলছে দপদপ করে। কিছুতেই শান্ত থাকতে পারছে না। ইচ্ছে করছে সবকিছু ছেড়েছুড়ে চলে যেতে। হৃদয়ে দহন বাড়ছে তার। সেটা নজরে পড়ছে না স্বচ্ছের। ক্ষীণ এক যন্ত্রণা মোহকে গ্রাস করা শুরু করেছে সেই স্বচ্ছ আর রিয়ানার রিসোর্টে যাওয়ার দৃশ্যগুলো দেখেই। এবার গটগট করে হাঁটতে শুরু করে সে। ওপর দিকে হতবাক স্বচ্ছ। বিস্ময়ে কোনো কূলকিনারা পাচ্ছে না সে। কি বলবে বা কি করবে বুঝতেই পারছে না। নম্র স্বভাবের মোহ নামল মেয়েটির কাছ থেকে এমন আচরণ স্বচ্ছের মস্তিষ্কের চিন্তাভাবনা থামিয়ে দিয়েছে। মোহকে এমব ওভার রিয়েক্ট করতে স্বচ্ছ কখনো দেখেনি তাও কারণ ছাড়া। হঠাৎ কি হলো তার?
বেশ কিছুটা হেঁটে গিয়ে পিছু ফিরে তাকায় মোহ। স্বচ্ছকে ডাক দিয়ে বলে,
“শুনুন? আমি কালই বাড়ি ফিরে যেতে চাই। প্লিজ তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করুন। নয়ত ব্যবস্থা করে একা চলে যাব।”
বলেই আবারও সামনে ফিরে হাঁটতে লাগে মোহ। স্বচ্ছ এবার হতবিহ্বল হয়ে ঠাঁই হয়ে হাঁটু গেঁড়েই বসে থাকল বেশ কিছুক্ষণ। কি থেকে কি হয়ে যাচ্ছে স্বচ্ছের আন্দাজেও আসছে না!
দুপুরবেলা। এখন কিছুটা ঠান্ডা কমেছে। সূর্যের তাপ কিছুটা প্রখর। এর মধ্যে মোহ মোটা ব্ল্যাংকেট মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে আছে। এক প্রকার গুমরে কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে গিয়েছে সে। স্বচ্ছ তাকে ডেকেছে সকালে বার বার খেতে। কিন্তু মোহ সাফ না করে দিয়েছে। আর শেষে বলে দিয়েছে, তার বন্ধু রিয়ানার সাথে গিয়ে যেন খেয়ে নেয়। স্বচ্ছ তখনই বুঝে নিয়েছে মোহ এখনো কোনো কারণে রিয়ানার ওপর রাগ কমাতে পারেনি। মোহের সাথে ভালোভাবে কথা বলার আগেই পুলিশ অফিসার আবারও কল দিয়েছিল তাকে। তাই বেরিয়ে গেছে স্বচ্ছ ঘর থেকে।
পুলিশি সব ঝামেলা শেষ করার পর স্বচ্ছ আস্তে করে নিজের ঘরে ঢুকে পরে। ফোনটা পকেটে রাখতেই তার ঘোলাটে বর্ণের চোখ যায় ব্ল্যাংকেট দিয়ে মুখ অবধি ঢেকে রাখা মোহের দিকে। পা টিপে টিপে বেডের দিকে আসে সে। বিরবির করে বলে,
“মেয়েরা সত্যিই বড্ড হিংসুক হয়। দেখো! নিজের হিংসেতে পাগল হয়ে গিয়ে এই সময় ব্ল্যাকেট জড়িয়ে ঘুমাচ্ছে। এবার বুঝেছি বিয়ের কি জ্বালা।”
মোহের মুখ থেকে ব্ল্যাংকেট সরিয়ে দেয় স্বচ্ছ। মুখ ঘেমে একাকার মোহের। কপাল বেয়ে ঘাম ঝরছে তার। নাক লাল টুকটুকে হয়ে গিয়েছে। চোখেমুখে এখনো মলিন। স্বচ্ছ এবার পুরো ব্ল্যাংকেট সরিয়ে দেয়। দুষ্টু বুদ্ধি খেলে যায় মনে। ঠোঁট কামড়ে হেঁসে মোহের পিঠের নিচে হাত দিয়ে হুট করে তাকে কোলে তুলে নেয় স্বচ্ছ। সঙ্গে সঙ্গেই ধড়ফড় করে ঘুম ভেঙে যায় মোহের। উঠে বসতে চাইলেই তার মনে হয় সে হাওয়াই ভাসছে। দ্রুত নিজেকে সামলাতে স্বচ্ছের গলা জড়িয়ে ধরে সে। স্বচ্ছের দিকে তাকাতেই মনে পড়ে যায় এমন কিছু ঘটনা যেটা মোহের মন এখনো মেনে নিতে পারেনি। চোয়াল শক্ত করে কিছুটা ছটফটিয়ে উঠে বলে,
“কি সমস্যা আপনার? এটা কেমন কৌশল মানুষকে ঘুম থেকে জাগানোর? নামান আমাকে।”
“তোমার কি সমস্যা সুন্দরী? আমি তো তোমাকে ঘুম থেকে জাগাতে চাইনি। তুমি নিজে জেগে গেছো। আমাকে দোষ দিয়ে লাভ আছে বলো? আমি তো শুধু আমার বউকে কোলে নিলাম। ঘুম থেকে তো জাগাইনি।”
“আপনি আমাকে নামান। আমার ভালো লাগছে না এইসব। নামান আমাকে।”
চিল্লিয়ে বলে মোহ। স্বচ্ছ আগেও মোহের এমন কথাবার্তা শুনেছে। কোলে নিলেই ছটফটিয়ে নামিয়ে দিতে বলতো তাকে। কিন্তু এমন কর্কশ গলায় কখনো বলতে শোনেনি। বড় একটা শ্বাস নিয়ে মোহকে নিয়ে চেয়ারে বসে পড়ে স্বচ্ছ। মোহ নেমে যাওয়ার দৃঢ় চেষ্টা করেও পেরে ওঠে না। স্বচ্ছ তৎক্ষনাৎ মোহের গাল টিপে ধরে মোহের ঠোঁটে হুট করে নিজের ঠোঁটের স্পর্শ লাগিয়ে দেয়। মোহকে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয় স্বচ্ছ ভালোভাবে। ঠোঁটের স্পর্শ আরো গভীর হতে শুরু করে। অতঃপর ছেড়ে দেয় স্বচ্ছ। তারপর বলে,
“তারপর বলো? কি হয়েছে? এমন উদ্ভট ব্যবহার করে কি প্রমাণ করতে চাইছো তুমি?”
মোহ কিছুক্ষণ থম মেরে থাকে স্বচ্ছের কান্ডে। তারপর তেতে উঠে বলে,
“আপনি কি প্রমাণ করতে চাইছেন? আপনি আমাকে ভালোবাসেন?”
প্রশ্নটা করার সঙ্গে সঙ্গে ভ্রুজোড়া কুঁচকে যায় স্বচ্ছের। মুখ থেকে হাসি কোথাও বিলীন হয়ে যায়।
“কি বলতে চাইছো তুমি? আমি তোমাকে ভালোবাসি না?”
“সত্যিই কি ভালোবাসেন? ভালোবাসলে হয়ত…”
“ভালোবাসলে হয়ত কি?”
মোহ চুপ হয়ে যায়। সে মুখে আনতে পারে না সেসব না। চোখমুখ খিঁচে ফেলে সে। স্বচ্ছ তাকে জোর দিয়ে জিজ্ঞেস করে,
“বলো কি? আন্সার মি!”
“ভালোবাসলে আপনি অন্য মেয়ের হাত ধরে অন্য রিসোর্টে গিয়ে নিজেকে স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিয়ে একটা রুমে চলে যেতে পারতেন না।”
স্বচ্ছ হৃৎস্পন্দন যেন এক মূহুর্তের জন্য থেমে যায়। চোখমুখের রঙ পাল্টে যায়। বড় বড় শ্বাস ফেলতে থাকে। মোহ তা দেখে তাচ্ছিল্যের সাথে জিজ্ঞাসা করে,
“ঘাবড়ে গেলেন? হয় হয় এমন হয়! আসলে দোষটা কোথাও আমারই। ভুলেই গিয়েছিলাম আপনি আর আমি কোনোদিন এক না। আপনি তো তেমন নন। আপনি একজন এমন লোক যে অন্য একটা মেয়ের ঘরে হুট করে বিনা পারমিশনের রাতে মাতাল হয়ে ঘরে ঢুকে আসেন। অসভ্যের মতো আচরণ করেন। আপনার সাথে আমার যায় না।”
স্বচ্ছ হাতের বাঁধন আলগা করে দেয়। মোহ উঠে দাঁড়ায়। স্বচ্ছের চুপ থাকা মোহের কষ্ট বাড়ায়। মোহ চাইছিল স্বচ্ছ এর উত্তর দিক। কিন্তু স্বচ্ছ নির্বিকার। বরং অপরাধী যেমন মাথা নিচু করে থাকে তেমনই মাথা নিচু করে বসে আছে সে। তাহলে কি মোহ যা ভাবছে তা সত্যি হয়ে দাঁড়াল?
চলবে…
[বি.দ্র. ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। গল্পটি সম্পূর্ণ কাল্পনিক। বাস্তবে এর কোনো ভিত্তি নেই।]