#একটুখানি_সুখ
#আনিশা_সাবিহা
পর্ব ৩৭
সবে মোমবাতি নিয়ে নিজের রুমের দিকে ফিরছে স্বচ্ছ। সামনে করিডোর ধরে হাঁটতেই ফোনের রিংটোনের শব্দ তার হাঁটাতে বাগড়া দিল। হাঁটার গতি কমিয়ে ফোনটা বের করে কোনোরকমে স্ক্রিন দেখে নিল সে। স্ক্রিনে স্পর্শ নাম ‘পুলিশ অফিসার’ লিখাটি জ্বলজ্বল করছে। এতোদিন পর এই নম্বর থেকে ফোন পেয়ে কিছুটা হতবাক হয়ে গেল স্বচ্ছ। হাঁটা থামিয়ে বেশ করিডোরের রেলিং এ ভর করে কলটা রিসিভ করে স্বচ্ছ। ওপাশ থেকে গমগমে আওয়াজ শুনতে পাওয়া যায়।
“হ্যালো, মি. আহিয়ান স্বচ্ছ বলছেন?”
“ইয়েস অফিসার। এতোদিন পর হঠাৎ? কোনো দরকার?”
“দরকার ছাড়া তো পুলিশ কাউকে ডিস্টার্ব করে না মি. আহিয়ান! সরি ফর ডিস্টার্ব। বাট অনেকদিন পর কিছু ইনফরমেশন পেয়েছি আমরা।”
স্বচ্ছের কপালে বেশ কয়েকটি প্রগাঢ় ভাঁজ পড়ে। সে অফিসারের কথার কিছুই বুঝতে পারছে না। গম্ভীর কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“কি ইনফরমেশন? আর কিসের ব্যাপারে?”
“আপনার ছোট ভাইয়ের ব্যাপারে। মনে রেখেছেন নাকি ভুলে গিয়েছেন? আহিয়ান সৌমিত্র! মনে নেই?”
থতমত খেয়ে যায় স্বচ্ছ। কপালে জমতে শুরু করে ঘাম। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে চাইলেও যেন পারে না সে। গলা খাঁকারি দিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে বলে,
“মনে থা…থাকবে কেন? মনে আছে আমার।”
“আপনারা আমেরিকান পুলিশদের যতটুকু ইনফরমেশন দিয়েছিলেন সেই অনুযায়ী সৌমিত্র মারা গেছে। কিন্তু আমাদের কাছে যা যা ইনফরমেশন আছে সেই অনুযায়ী সৌমিত্র বেঁচে আছে। আর সে স্বাচ্ছন্দ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে।”
“হোয়াট ডু ইউ মিন অফিসার?”
“যেটা আপনি শুনছেন সেটাই মিন করছি।”
“আমার ভাই বেঁচে আছে আর আমরা জানি না? মজা করছেন?”
ওপাশ থেকে অফিসার বেশ সিরিয়াস হয়ে বলে উঠলেন,
“আমরা তো এটাই বুঝতে পারছি না আমরা আপনাদের সাথে মজা করছি? নাকি আমাদের মজার খোরাক বানাচ্ছেন?”
কিছুটা ঘাবড়ালেও সেটা প্রকাশ করে না স্বচ্ছ। সৌমিত্র নিশ্চয় কিছু ঘটিয়েছে। নাহলে পুলিশ অফিসার এতো জোর দিয়ে বলার সাহস পেতো না। এখন স্বচ্ছের একমাত্র চিন্তা কি কারণে পুলিশ অফিসার এতো কথা বলছে!
“আমরা কেন আপনাদের মজার খোরাক বানাতে যাব? আহিয়ান স্বচ্ছের সাথে কথা ঘুরাবেন না অফিসার। স্পষ্টভাবে বলুন কি বলতে চান।”
“আজকে সাভার রোডে একজন বৃদ্ধ লোকের এক্সিডেন্ট হয়েছে। একটা লাল রঙের কার ট্রাফিক রুলস না মেনে গাড়ি চালিয়ে গেছিল। ফলস্বরূপ একটা বৃদ্ধ লোককে ধাক্কা মেরে পালিয়ে যায় গাড়ির মালিকটি। সিসিটিভি ফুটেজে একটা ছেলেকে দেখা গেছে। যদিও ভালোভাবে দেখা যায়নি। ছেলেটা সঙ্গে সঙ্গে মাস্ক পরে নিয়েছিল। কিন্তু মাস্ক পরার আগের দৃশ্য দেখা গেছে বেশ খানিকটা। আপনার ভাইয়ের ছবির সাথে লোকটার ছবি মিলাতেই অধিকাংশই মিলে গেছে। বিষয়টা ইন্টারেস্টিং না?”
এবার কাশি উঠে যায় স্বচ্ছের। জবাবে কি বলবে বুঝতে পারে না সে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমা হয়ে সেটা গাল বেয়ে পড়ে সেটা থুঁতনিতে এসে ঠেকল।
“আপনি সিউর কি করে হচ্ছেন? এতো বছর পর সৌমিত্র কি করে আসবে?”
“সেটা আমারও কুয়েশ্চন মি. আহিয়ান। উত্তর আপনি দেবেন। আমি আপনাকে সিসিটিভি ফুটেজ পাঠিয়ে দিচ্ছি। দেখে মিলিয়ে নিন তো। আশা করছি আপনি কোঅপারেট করবেন আমাদের সাথে। সৌমিত্রের মতো একটা ক্রিমিনাল ধরিয়ে দিতে হেল্প করবেন।”
“আ…আই উইল ট্রাই অ…অফিসার।”
ফোনটা ওপাশ থেকে কেটে গেল। স্বচ্ছের মেজাজ বিগড়ে গেল মূহুর্তেই। এতে ঝামেলা আর সইতে মন চাইছে না। সেই কবে থেকে এসব কিছু লুকিয়ে লুকিয়ে সে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। দাঁতে দাঁত চেপে ফোনটা ফেলে দিতে গিয়েও ফেলল না সে। ফোনটা জোরে চেপে ধরে রাগ নিবারণ করার চেষ্টা করল। তখনি ফোনে টুং করে মেসেজের শব্দ বেজে উঠল। তাড়াহুড়ো করে মেসেজ ওপেন করে স্বচ্ছ। একটা ভিডিও ক্লিপ পাঠানো হয়েছে তাকে। সেটাতে ক্লিক করতেই রাস্তায় একটা বৃদ্ধ লোককে ধাক্কা মারল লাল রঙের কারটি। স্বচ্ছ চোখমুখ খিঁচে ফেলল তা দেখে। কারের সামনের কাঁচ খোলা। কার কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়িয়ে ছিল। সেখান দিয়ে বেশ ভালোভাবে একটা যুবককে দেখা যাচ্ছে। বড় বড় দাড়ি তার গালে। যুবকটিকে চিনতে দেরি হলো না স্বচ্ছের। এবার ফোনটা ফেলেই দেয় স্বচ্ছ। উচ্চস্বরে বলে ওঠে,
“তোর বোকামির জন্য তোকে এবার ধরা পড়তে হবে সৌমিত্র। আমি এবার থাকব না বাঁচানোর জন্য। তোর আর মায়ের জন্য ভাবতে ভাবতে নিজেকে ভুলতে বসেছি আমি। এবার একটু স্বার্থপর হতে চাই।”
পরে থাকা ফোনটা হাতে নিয়ে দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে আবারও নিজের রুমের দিকে হেঁটে যায় স্বচ্ছ।
সন্ধ্যে নামতে না নামতেই কারেন্ট উধাও হয়ে গেছে। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। সবেই কারেন্ট চলে গেল। অতিরিক্ত বিরক্ত হয়ে ফোন খুঁজে চলেছে মোহ। সে বিরক্তির সুরে বলে ওঠে,
“স্বচ্ছ, আপনি মোমবাতি এনেছিলেন না? সেটা কোথায়?”
“আমি কি করে জানব?”
“কি করে জানবেন মানে? আপনি এনে রেখেছেন আর আপনি জানেন না?”
“না জানি না।”
বেশ খামখেয়ালি হয়ে গম্ভীর সুরে উত্তর দেয় স্বচ্ছ। মোহ বিকেলের পর থেকে খেয়াল করছে স্বচ্ছ বাহির থেকে মোমবাতি আনার পর কেমন যেন অদ্ভুত আচরণ করছে। মোমবাতি আনার পরই শুয়ে পড়েছিল স্বচ্ছ। তারপর আর ওঠেনি। ওইভাবেই শুয়ে আছে চোখ বুঁজে। স্বচ্ছ তো এমন শুয়ে থাকার মানুষ না। তাই বিষয়টা বেশ অদ্ভুত লাগছে মোহের।
কোনোরকমে ফোন হাতড়ে খুঁজে বের করে ফ্লাশ লাইট জ্বালিয়ে নেয় মোহ। তারপর মোমবাতির স্বচ্ছের বালিশের কাছেই খুঁজে পেয়ে স্বচ্ছকে চোখ রাঙিয়ে মোমবাতি নিয়ে মোমবাতি লাইটার দিয়ে জ্বালিয়ে নেয় সে। চোখ বুঁজে থাকা স্বচ্ছ আস্তে আস্তে চোখ মেলে। মোমবাতির আলোতে মুখরিত হয়ে উঠেছে ঘর। মোমবাতি হাতে ধরে এক সুন্দরী রমণী। মোমবাতির আলোতে ঝলমল করছে তার চেহারা। স্বচ্ছের দিকেই সরু চোখে তাকিয়ে আছে মেয়েটি। হরিণী চোখে সেই সরু দৃষ্টি আর চোখা মুখা মুখটা যেন অনন্য! সামনের মেয়েটা আসলেই বড্ড নেশালো। স্বচ্ছের সব থেকে বড় একটি নেশা। যাকে না দেখলে চোখের পাতা এক হয় না। কি এমন নেশাদ্রব্য দিয়ে তৈরি সে? তার মাঝে তো কোনো নেশাদ্রব্য নেই। তাহলে কেন এমন হয় স্বচ্ছের? যেন তাকে দেখলে আর অন্য কোনো কিছুই স্বচ্ছকে টানতে সক্ষম হয় না।
স্বচ্ছের এমন দৃষ্টি দেখে মোহের দৃষ্টিও পাল্টে গেল। চোখজোড়া বড় বড় করে চেয়ে থাকে স্বচ্ছের দিকে। হঠাৎ করেই স্বচ্ছ মোহের হাত টেনে ধরে মোহকে এনে ফেলে সরাসরি তার বুকের ওপরে। মোহ দ্রুত নিজের হাতে থাকা মোমবাতি সামলে নেয়।
“আরে আমার হাতে মোমবাতি আছে। পাগল নাকি আপনি? যেকোনো সময় আগুন জ্বলে যেতে পারে।”
“তো? এসব বাহিরের আগুন দেখতে পাও বুঝি? আমার মনের ভেতরে যে দাউদাউ করে ভালোবাসার আগুন জ্বলছে সেটা বুঝি তোমার চোখে পড়ে না?”
“আপনি দেখার সুযোগ দিয়েছেন কখনো?”
“এখন দেখবে?”
মোহ নিরব থাকে। স্বচ্ছ মোহের মাথা তার বুকের বাম পাশে চেপে ধরে। মোহ অনুভব করে স্বচ্ছের হৃৎস্পন্দন! এখানেই তো তার সুখ। তার প্রশান্তির জায়গা। এখানে মাথা রাখলে তো সব প্রশান্তি পাওয়া যায়। ভালোবাসার অন্য জগতে চলে যায় যায়।
“অনুভব করতে পারছো সেই আগুন?”
“হু। এখানে তো অনেক শান্তি। আগুন কোথায়?”
“তুমি বুঝবে না।”
“তাহলে কে বুঝবে?”
“তোমার মন।”
মোহ মৃদু হাসে। অতঃপর জিজ্ঞেস করে,
“কি হয়েছে আপনার?”
“কি হবে?”
কিছুটা ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায় স্বচ্ছ। মোহ ফিচেল কন্ঠে জিজ্ঞেস করে,
“কি হবে মানে? আপনি কেমন যেন অদ্ভুত আচরণ করছেন। আমার ভালো লাগছে না।”
“অশান্তি লাগছে আমার। এতো অশান্তি সহ্য হচ্ছে না। শান্তি খুঁজছি আমি।”
“আমি আপনাকে কি করে শান্তির খোঁজ এনে দিতে পারি বলুন?”
“তোমার কাছেই তো শান্তি। সেজন্যই তো তোমার কাছে এসেছি সুন্দরী।”
মোহও কি যেন মনে করে স্বচ্ছকে পরম আবেশে জড়িয়ে ধরে।
কিছুক্ষণ নিরবতা! নিরবতা ভেঙে মোহ মাথা উঠিয়ে বলে ওঠে,
“বাহিরে যাবেন?”
স্বচ্ছ ভ্রু কুঁচকায়।
“এখন? রাত হয়ে এসেছে তো।”
“তো কি হয়েছে?”
“এটা ঢাকা শহর মনে করো? এখানে তোমার মতো সুন্দরীকে সন্ধ্যার পর বাহিরে নিয়ে গেলে অনেক রিস্ক আছে। আমি কোনো রিস্ক নিতে চাইছি না সরি।”
মোহ মুখ ফুলিয়ে উঠে বসে স্বচ্ছের হাত টেনে বলে,
“ধুর… চলুন না!”
মোহের বায়নার কাছে হার মানে স্বচ্ছ। উঠে বসে সে। নিচে নামতে নামতে বলে,
“ঠিক আছে চলো।”
চলবে…